খরগোস আর সজারুর গল্প

খরগোস আর সজারুর গল্প

ভারি সুন্দর সকাল, ফসল কাটার প্রায় সময় হয়েছে, বজরার গাছে ফুল ধরেছে, রোদে ভরা আকাশ, প্রভাত-বায়ুতে সোনালি শস্যক্ষেতে উঠেছে ঢেউ, লার্ক পাটি নীল আকাশে পুলকভরা সুরে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে, ফুলের বনে শোনা যাচ্ছে মৌমাছির গুঞ্জন। গ্রামবাসীরা প্রাণবন্ত। তারা অনেকেই তাদের সব সেরা কাপড় পরে মেলায় চলেছে।

এমন চমৎকার দিন, সবাই সুখে ভরপুর; এমনকি ছোট্ট একটি সজারুও তার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে সুখ উপভোগ করছে। হাতের উপর হাত গুটিয়ে বুকের উপর রেখে সে মনের আনন্দে গান গেয়ে চলেছে। সজারুর বৌ কাপড় কাচছে আর বাচ্চাদের কাপড় পরাচ্ছে। সজারু ভাবলে, যাই শালগমের ক্ষেতটা আজ কেমন হয়েছে দেখে আসি। এই ক্ষেতে গিয়ে সজারু-পরিবার শালগম খেয়ে আসে বলে ক্ষেতটাকে সজারু তার নিজেরই বলে গণ্য করে। যেই ভাবা অমনি কাজ। বাড়ির দরজা বন্ধ করে ছুটল ক্ষেতের দিকে।

সবে সে শালগমের ক্ষেতের বেড়ার ধারে এসে পৌঁছেছে, এমন সময় এক খরগোসের সঙ্গে দেখা। খরগোস চলেছে বাঁধাকপির ক্ষেত দেখতে। খরগোস বাঁধাকপি খায় বলে সে-ও মনে করত ক্ষেতটা তার। সজারু খরগোসকে দেখে নমস্কার করে বললে—সুপ্রভাত!

কিন্তু খরগোস ছিলেন মস্ত বাবুলোক। তাঁর মেজাজও ভাল নয়। তিনি সজারুর নমস্কার ফিরিয়ে তো দিলেনই না, বরং উদ্ধতভাবে বলে উঠলেন—তুমি আবার এত সকালে ক্ষেতের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?

সজারু বললে—হাঁটতে বেরিয়েছি।

খরগোস হেসে বললেন—হাঁটতে বেরিয়েছি? তোমার ঐ বাঁকা পা হাঁটার খুব উপযুক্ত বলে তো মনে হয় না!

শুনে সজারু ভয়ানক রেগে গেল। আর যে যাই বলুক, কেউ যদি তার বাঁকা পা সম্বন্ধে কিছু বলত সে সহ্য করতে পারত না। সজারু তাই বললে—আপনার মনে হয় আপনার পা আমার পায়ের চেয়ে ভাল এই তো?

ধরগোস গম্ভীরভাবে বললে—আমার তো তাই মনে হয়।

সজারু বললে—তবে প্রমাণ করুন! যা বাজি ধরতে হয় ধরুন, আমি বলছি, আপনি আর আমি যদি রেসে দৌড়োই, আমিই জিতব।

খরগোস চেঁচিয়ে উঠল—মস্ত রসিকতা হচ্ছে! তোমার ঐ বাঁকা পা নিয়ে তুমি আমায় রেসে হারাবে? তবেই হয়েছে! যাই হোক, তুমি যদি চাও আমার কোন আপত্তি নেই। কী বাজি?

—এক সোনার মোহর আর এক বোতল সরাব। খরগোস বললে—রাজি। তাহলে এখনই আরম্ভ করা যাক!

সজারু বললে—না না, এত তাড়া কিসের? আগে বাড়ি গিয়ে কিছু খেয়ে আসি। আধ ঘণ্টার মধ্যে এইখানেই আমি ফিরে আসব।

খরগোস বললে—বেশ, আমি অপেক্ষা করব।

সজারু ভাবতে ভাবতে বাড়ি গেল। সে ভাবলে খরগোসের ভরসা তাঁর বড়-বড় পা, কিন্তু আমিই ওঁকে হারাবো। উনি ভাবেন উনি মস্ত এক ভদ্রলোক, কিন্তু আসলে ওঁর মাথায় কিছু নেই। ওঁর এই দম্ভের জন্যে ওঁকেই দাম দিতে হবে।

বাড়ি এসে সজারু তার বৌকে বললে—বৌ, শিগগির পোশাক পরে নাও। তোমায় এখন আমার সঙ্গে মাঠে আসতে হবে।

সজারুর বৌ জিজ্ঞেস করলে—কেন গো?

—খরগোসের সঙ্গে বাজি হয়েছে তার সঙ্গে আমার রেস। তাইতে যে জিতবে সে সোনার এক মোহর আর এক বোতল সরাব পাবে।

সজারু-গিন্নি চিৎকার করে উঠল—তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে গো? বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে?

সজারু বললে—মিছিমিছি চেঁচিয়ে না গিন্নি! আমার কাজ আমায় করতে দাও! পুরুষ মানুষের কারবার তোমরা কী বোঝ? এখনি তৈরি হয়ে নাও, আমার সঙ্গে যেতে হবে।

এরপর সজারুর গিন্নি বেচারা আর কী বলে? ভাল লাগুক আর নাই লাগুক, স্বামীর কথার বাধ্য হতেই হবে তাকে। দু-জনে যখন রাস্তায় বেরোলো সজারু বললে—এবার শোন ভাল করে মন দিয়ে। বড় ক্ষেতটা দেখতে পাচ্ছ? ঐখানে আমাদের রেস হবে। খরগোস দৌড়বে লাঙলের একটা নালা ধরে, আর আমি দৌড়ব আরেকটা ধরে। আমরা দৌড়তে শুরু করব ক্ষেতের এদিক থেকে। তুমি করবে কি, আগে থেকে চুপিচুপি ক্ষেতের ওদিকে গিয়ে আমার নালার শেষে চুপটি করে মাথা নিচু করে লুকিয়ে থাকবে। যেই দেখবে খরগোস এসে পৌঁছেছে, অমনি মাথা উঁচু করে বলবে—এই যে আমি এসে গেছি!

কথা কইতে কইতে সজারু আর তার গিন্নি ক্ষেতের উল্টোদিকে গিয়ে পৌঁছল। সেখানে ক্ষেতের নালীর মধ্যে বৌকে লুকিয়ে রেখে সজারু ফিরে গেল ক্ষেতের যেদিক থেকে তাদের দৌড় আরম্ভ হবে সেই দিকে।

খরগোস বললে—এখনও বল, সত্যিই কি তুমি দৌড়বে?

সজারু বললে—নিশ্চয়! আমি তৈরি!

—তবে রেস শুরু হোক।

যে যার নালায় গিয়ে ঢুকল। খরগোস বললে—এক, দুই, তিন। তারপর ঝড়ের মতো ছুট দিল মাঠের মধ্যে দিয়ে। সজারু কয়েক পা এগিয়েই আবার ফিরে এল নিজের জায়গায়। এসে চুপটি করে বসে রইল।

খরগোস যখন প্রাণপণে দৌড়ে মাঠের শেষে গিয়ে পৌঁছল, সজারু-বৌ তার মাথা উঁচু করে বললে—এই যে আমি এসে গেছি!

খরগোস অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সজারু-গিন্নির আর সজারুর চেহারা একেবারে এক। কাজেই খরগোস ভাবলে ও-ই সজারু। তার মনে হল কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। দেখি আর-একবার চেষ্টা করে। ভেবে সে ফিরে চলল মাঠ দিয়ে। এমন জোরে ছুটল যে তার কান উড়তে লাগল হাওয়ায়।

সজারু-বৌ যেমন ছিল তেমনি বসে রইল। খরগোস মাঠের ওপারে পৌঁছতে সজারু বললে—এই যে আমি!

খরগোস ভীষণ রেগে গেল। চেঁচিয়ে বললে—আর একবার!

সজারু বললে—আপনি যতবার ইচ্ছে করেন!

এই শুনে খরগোস না থেমে দৌড়নো শুরু করল। তিয়াত্তর বার মাঠ পার হল। এ পারে এলে সজারু বলে—এই যে আমি, ওপারে গেলে গিন্নিও বললে তাই। তিয়াত্তর বার ছুটে খরগোসের আর শক্তি রইল না। সে মরে পড়ে গেল।

সজারু মোহর আর সরাব জিতল। বৌকে ডেকে নিয়ে দু-জনে মিলে বাড়ি ফিরে গেল মনের আনন্দে।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন