রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌

রুম্‌পেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌

এক ছিল জাঁতাওয়ালা। জাঁতা পিষে খুব কষ্টে-সৃষ্টে যে দিন কাটাতো। ভারি গরিব ছিল সে, কিন্তু তার ছিল একটি সুন্দরী মেয়ে। একবার কোন এক সময়ে সে রাজার সঙ্গে কথা বলবার সুযোগ পেয়েছিল। নিজেকে জাহির করবার জন্যে কথায় কথায় সে রাজাকে বলে বসল যে তার এক মেয়ে আছে, তার এমন গুণ যে সে খড় থেকে সোনার সুতো কেটে বার করতে পারে।

শুনে রাজা জাঁতাওয়ালাকে বললেন—এ বিদ্যে আমার দেখবার খুবই লোভ হচ্ছে। তুমি যেমন বলছ, তোমার মেয়ে যদি তেমনই দক্ষ হয় তাহলে কাল তাকে আমার প্রাসাদে নিয়ে এস। আমি তাকে পরীক্ষা করব।

সেইমত পরদিন মেয়েটি প্রাসাদে এল। রাজা তাকে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন, সেখানে ঘর-ভর্তি শুধু খড়। মেয়েটিকে একটা চরকা আর একটি তকলি দিয়ে রাজা বললেন— নাও, এইবার কাজ শুরু করে দাও। আজ থেকে কালকের ভোর পর্যন্ত সময় দিলুম। এর মধ্যে যদি এই সমস্ত খড় সোনার সুতোয় কেটে ফেলতে না পারো তো তোমায় মৃত্যুদণ্ড দেব। বলে রাজা ঘরের দরজা বন্ধ করে তাতে চাবি দিয়ে তাকে একা ভিতরে রেখে চলে গেলেন।

বেচারি জাঁতাওয়ালার মেয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইল। সে ভেবেই পেল না কী করা যায়। খড় থেকে কী করে সোনা বার করতে হয়, তার কিছুই সে জানত না। যত সে বসে ভাবতে লাগল ততই তার দুঃখ বাড়তে লাগল। শেষে কান্না শুরু করে দিলে। তারপর হঠাৎ তার ঘরের দরজা খুলে গেল আর ক্ষুদে একজন বামন ঘরে ঢুকে বললে— নমস্কার কুমারী জাঁতাওয়ালী। এত কাঁদছ কেন?

মেয়েটি বললে— হায়, আমাকে খড় থেকে সোনার সুতো কাটতে হবে। কিন্তু আমি জানি না কেমন করে তা কাটতে হয়।

বামনটি বললে— আমি যদি কেটে দিই আমায় কী দেবে বল?

মেয়েটি বললে— আমার গলার হার।

বামন গলার হারটি নিয়ে চরকার সামনে বসে গেল তখনই। চরকা চলল ঘড়-ঘড় করে আর দেখতে দেখতে তকলি উঠল সোনার সুতোয় ভরে। বামন আর-একটা তকলি পরালো টেকোয়। তিন পাক ঘোরাতেই সেটাও গেল সোনার সুতোয় ভরে। এইভাবে চলল সকাল পর্যন্ত। একটি তকলিও বাকি রইল না— সমস্ত খড় হয়ে গেল সোনা।

সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজা এসে ঘরে ঢুকলেন। অত সোনা চোখে পড়তে তিনি অবাক হলেন, খুশিও হলেন ; কিন্তু লোভও বেড়ে গেল। কাজেই তিনি জাঁতাওয়ালার মেয়েকে আরো বড় একটা খড়ভর্তি ঘরে নিয়ে গেলেন, আর বললেন— প্রাণের ভয় যদি থাকে, তাহলে এক রাতের মধ্যে এই সমস্ত খড় থেকে সোনার সুতো কেটে ফেল।

মেয়েটি কী করবে ভেবে না পেয়ে কাঁদতে লাগল। বসে বসে কাঁদছে, সেই সময় আগের দিনের মত আবার তার দরজা খুলে গেল আর সেই বামন এসে বললে— আমি যদি সমস্ত খড় থেকে সোনার সুতো কেটে দিই তাহলে কী দেবে আমায়?

মেয়েটি বললে— আমার হাতের আংটি।

বামন তার হাত থেকে আংটি নিয়ে চরকার চাকা ঘোরাতে বসে গেল আর সকালের মধ্যে সমস্ত খড় থেকে সোনার সুতো কেটে দিলে।

রাজা অত সোনা দেখে ভারি খুশি, কিন্তু তখনও তাঁর তৃষ্ণা মেটেনি। তাই তিনি জাঁতাওয়ালার মেয়েকে আরো একটা বড় ঘরে নিয়ে গিয়ে ঘরভর্তি খড় দেখিয়ে বললেন— আজকের রাতের মধ্যেই এই সমস্ত তোমায় সোনা করে দিতে হবে। যদি পারো তাহলে তুমি আমার রানী হবে। রাজা মনে মনে জানেন— হতে পারে এ সামান্য জাঁতাওয়ালার মেয়ে কিন্তু এর মতো ঐশ্বর্যশালিনী মেয়ে সারা দুনিয়ায় আমি পাবো না।

মেয়েটি যখন ঘরে একা বসে কাঁদছে তখন সেই বামন আবার এল আর বললে— আবার যদি আমি এইসব খড় থেকে সোনার সুতো কেটে দিই তাহলে আমায় কী দেবে?

মেয়েটি বললে— আর তো আমার কিছুই নেই!

—বেশ, তাহলে তুমি যদি রানী হও তাহলে বল আমাকে তোমার প্রথম সন্তানটি দেবে?

জাঁতাওয়ালার মেয়ে ভাবলে— কী হয় কে জানে? কিন্তু এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার সে অন্য কোনো উপায় দেখতে পেলে না। তাই বামন যা চাইছিল দিতে সে রাজি হল আর বামনও সেবারের মতো খড় থেকে সোনার সুতো কেটে দিয়ে চলে গেল।

সকালবেলা রাজা এসে যখন দেখলেন তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন ঠিক তেমনটি হয়েছে, তখন তিনি তাঁর বিয়ের উৎসবের হুকুম দিলেন আর জাঁতাওয়ালার মেয়ে হল রানী।

তার এক বছর পরে রানীর একটি সুন্দর থোকা হল, কিন্তু ততদিনে তিনি সেই বামনের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন। হঠাৎ একদিন কোথা থেকে সেই বামন রানীর ঘরে ঢুকে পড়ল। ঢুকে বললে— যা তুমি দিতে অঙ্গীকার করেছিলে রানী, এবার তা দাও!

রানী ভয়ানক ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি বামনকে বললেন— রাজ্যের যত ঐশ্বর্য আছে নিয়ে যাও, ছেলেটিকে আমায় রাখতে দাও। কিন্তু বামন বললে— না, মরা ঐশ্বর্য নিয়ে আমার কী হবে? তার চেয়ে জীবন্ত জিনিস অনেক ভালো।

তাই শুনে রানী এত দুঃখ করতে লাগলেন, এত কাঁদতে লাগলেন যে বামনের শেষ অবধি তাঁর উপর মায়া হল। সে বললে, বেশ, আমি তোমায় তিনদিন সময় দিচ্ছি, তার মধ্যে তুমি যদি আমার নাম কী তা বলতে পারো তাহলে খোকা তোমার। নইলে আমার।

রাত্রিবেলা রানী শুয়ে শুয়ে যতরকম নাম মনে করতে পারেন ভাবতে লাগলেন। দেশে বিদেশে চারিদিকে লোক পাঠিয়ে দিলেন যেখানে যত নাম আছে সংগ্রহ করে আনতে।

পরের দিন যখন বামন এলো তখন রানী নিজের জানা যত নাম সমস্ত একে একে বলতে লাগলেন— কাসপার, মেলশোয়া, বালথাজার— কিন্তু প্রতিবারেই বামন বললে— না না, আমার নাম ও নয়। দ্বিতীয় দিন রানী দেশে বিদেশে যতরকমের অদ্ভুত নাম থাকতে পারে সমস্ত সংগ্রহ করে আনলেন। একটার পর একটা বলে যেতে থাকলেন বামনকে— গো-জিরজিরে, ঘূর্তকলিয়া, পদ্মাকড়, ঘুরনচর্কি। কিন্তু প্রতিবারেই বামন বললে— না না, আমার নাম ও নয়।

তৃতীয় দিন যেসব দূতেরা নাম সংগ্রহ করতে গিয়েছিল তারা ফিরে এসে বললে আর কোনো নতুন নাম তারা পায়নি, শুধু একজন বললে— আমি যখন খুব উঁচু এক পাহাড়ের উপর এক বনের ধার দিয়ে যাচ্ছিলুম যেখানে শেয়ালে খরগোস ধরে না, সেখানে দেখলুম ছোট্ট একটি বাড়ি আর তার সামনে একটা আগুন জ্বলছে। আগুনের সামনে এক বেখাপ্পা চেহারার বামন লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরছে। এক পা মাটিতে আর এক পা শূন্যে তুলে তিড়িং-তিড়িং করে লাফাচ্ছে আর গাইছে এই বলে—

রুম্‌পেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন নাম বড় শক্ত,
আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।
নির্জন পাহাড়ে নাচি আর গাই তাই
তানানানা তানানানা তানানা।
রুটি আজ বানিয়ে সরাব বানাবো কাল,
তার পরদিন যাব শহরে।
রানীর দুলাল কোলে ফিরব মনের সুখে—
আহা রে আহা রে আহা রে!

রানী শুনেই বুঝলেন এ সেই বামন। তিনি ভারি খুশি হলেন। শক্ত নামটি মুখস্থ করে নিলেন মনে মনে।

তার কিছুক্ষণ পরেই বামন এসে জিজ্ঞেস করলে— বলুন মহারানী আমার নাম কী?

রানী বললেন— তোমার নাম কি টম?

—না।

—তবে ডিক্‌?

—না।

—তবে দেখ তো এই নামটা হতে পারি কি না—রুম্‌পেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন?

—কে বলেছে এ নাম? কে বলেছে এ নাম? নিশ্চয় শয়তান বলে দিয়ে গেছে! এই বলে সেই বামন সরু গলায় এমন চ্যাঁচাতে লাগল যে কানে তালা লাগে আর-কি! রাগের চোটে বামন মাটিতে এমন জোরে ডান পা ঠুকল যে হাঁটু পর্যন্ত পা ঢুকে গেল মাটির মধ্যে। তখনও তার রাগ যায়নি। সে দু-হাতে বাঁ পা জড়িয়ে ধরে এমন টান মারল যে দেহটাই তার দু-টুকরো হয়ে ছিঁড়ে গেল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন