বারোটি শিকারীর গল্প

বারোটি শিকারীর গল্প

এক ছিলেন রাজপুত্র, তাঁর ছিল এক বাগ্‌দত্তা রাজকন্যা—তাঁকে তিনি কথা দিয়েছিলেন বিয়ে করবেন। তাঁকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। তাঁরা দু-জনে এক জায়গায় ছিলেন, খুব সুখে ছিলেন, সেই সময় একদিন খবর এল যে রাজপুত্রের বাবার ভারি অসুখ—বাঁচবেন কি না ঠিক নেই। এখনই তাঁকে বাড়ি যেতে হবে।

রাজকন্যাকে তিনি বললেন—তোমায় ছেড়ে এখন আমি যাচ্ছি, কিন্তু এই আংটি রেখে গেলুম—চিহ্ন। যখন আমি রাজা হব, তোমায় নিতে আসব।

বলে তিনি ঘোড়ায় চড়ে চলে গেলেন। বাড়ি গিয়ে দেখলেন, তাঁর বাবা মৃত্যুশয্যায়। রাজা বললেন—বাছা, আমি চোখ বোজবার আগে তোমায় একবার দেখতে চেয়েছিলুম। আমার কাছে কথা দাও, তোমার জন্যে যে কন্যা আমি পছন্দ করেছি তাকে তুমি বিয়ে করবে। বলে তিনি এক রাজকন্যার নাম করলেন। বাবার অবস্থা দেখে তার মন এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তার বাবা যেমন চান তেমনি সে অঙ্গীকার করল। তার বাবা চোখ বুজলেন।

রাজপুত্রের অভিষেক হয়ে গেল, তিনি রাজা হলেন। তখন বাবার কাছে যে অঙ্গীকার করেছিলেন তা পূরণ করবার সময় এল। তিনি রাজকন্যার কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। রাজকন্যা প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এদিকে তাঁর বাগ্‌দত্তা তাঁর এই বিশ্বাসঘাতকতার খবর পেয়ে এমন দুঃখ পেলেন যে সবাই ভাবল তিনি মারা যাবেন। রাজকন্যার বাবা বললেন—বাছা, কিসের তোমার এত দুঃখ? তুমি যা চাও তাই এনে দেব।

রাজকন্যা একটু ভেবে বললেন—বাবা, আমাকে এগারোটি মেয়ে এনে দিন, যাদের মুখ, দেহ, খাড়াই সব আমার মতো।

রাজা বললেন—যদি পাওয়া যায় তবে নিশ্চয় এনে দেব।

তখন রাজ্যের সর্বত্র খোঁজ পড়ে গেল। খুঁজে খুঁজে এগারো জন মেয়েকে বার করা হল, প্রত্যেককে ঠিক রাজকন্যার মতো দেখতে। রাজকন্যা বারোটি শিকারীর পোশাক তৈরি করতে হুকুম দিলেন। পোশাক তৈরি হয়ে গেলে মেয়েদের সবাইকে একটা করে সেই পোশাক পরতে বললেন; নিজেও একটা পরলেন। তারপর বাবার কাছে বিদায় নিয়ে সঙ্গিনীদের নিয়ে তিনি চললেন তাঁর বাগ্‌দত্ত রাজপুত্রের রাজসভায়। সেখানে পৌঁছে রাজকন্যা জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর যদি শিকারীর দরকার থাকে তাহলে তাঁরা রাজবাড়িতে চাকরি নিতে রাজি আছেন। রাজা তাঁকে দেখে চিনতে পারলেন না। কিন্তু তাদের সবারই চেহারা এত সুন্দর যে রাজা বললেন—হ্যাঁ, আমি শিকারীদের নেব। তারা সবাই রাজার শিকারী হয়ে গেল।

রাজার ছিল এক সিংহ, তার ছিল এক আশ্চর্য গুণ। যেখানে যা কিছু লুকোনো আছে বা গোপন আছে সব সে জানতে পারত।

একদিন সে রাজাকে বললে—মহারাজ ভাবছেন মহারাজের বারোজন শিকারী আছে, এই না?

রাজা বললেন—হ্যাঁ, তাই তো!

সিংহ বললে—ভুল, মহারাজ! ওরা বারোটি মেয়ে।

রাজা বললেন—তা কখনো হতে পারে না। প্রমাণ?

—বেশ তো, পাশের ঘরে কিছু মটরদানা ছড়িয়ে রেখে দেবেন কাল, তাহলেই দেখতে পাবেন। পুরুষ মানুষের পদক্ষেপ দৃঢ়—তারা যখন মটরদানার উপর দিয়ে হাঁটে, মটরদানা সরে না। কিন্তু কুমারীদের হাঁটা অন্যরকম—তারা এঁকেবেঁকে পা ফেলে চলে—তারা মটরদানা ছড়িয়ে ফেলবে।

সিংহের পরামর্শ শুনে রাজা খুশি হলেন। মেঝের উপর মটরদানা ছড়াবার হুকুম দিলেন তিনি।

এদিকে রাজার একটি চাকর ছিল, সে শিকারীদের ভাল চোখে দেখত। যখন সে শুনতে পেল এইভাবে তাদের পরীক্ষা করা হবে, সে গিয়ে সব বলে দিল। সে বললে—সিংহ প্রমাণ করে দেবে তোমরা সব কুমারী।

রাজকন্যা তাকে ধন্যবাদ জানাতে সে বললে—যত পারো দৃঢ়ভাবে মটরদানার উপর হেঁটো।

পরদিন সকালে রাজা যখন তাদের ডেকে পাঠালেন তারা এমন গট-গট করে হেঁটে এল যে একটিও দানা সরল না। তারা চলে যেতে রাজা সিংহকে ডেকে বললেন—তুমি মিছে কথা বলেছ—ওরা ঠিক পুরুষ মানুষের মতই হেঁটেছে।

কিন্তু সিংহ উত্তর দিলে—পরীক্ষার কথা আগে বলে দিয়ে ওদের কেউ সাবধান করে দিয়েছে। এক কাজ করুন। বসবার ঘরে বারোটি সুন্দর চরকা এনে সাজিয়ে রাখুন। তারপর আপনার শিকারীদের ডেকে পাঠাবেন। চরকা দেখে ওরা এত আনন্দ পাবে, কোন পুরুষ মানুষ অত পায় না।

এ পরামর্শে রাজা খুশি হলেন। তিনি চরকা আনতে হুকুম দিলেন। কিন্তু সেবারেও সেই দয়ালু চাকরটি শিকারীদের আগে থেকে সাবধান করে দিল। রাজকন্যা তাঁর সঙ্গিনীদের একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন—নিজেদের সংযত রাখবে। চরকাগুলোর দিকে ভুলেও তাকিয়ো না।

পরদিন রাজা যখন তাদের বসবার ঘরে ডেকে পাঠালেন, তারা একবারও চরকার দিকে তাকালো না।

রাজা সিংহকে বললেন—তুমি ভুল বলেছ। ওরা পুরুষই, আর কিছু নয়। চরকাগুলোর দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত।

সিংহ বললে—ওরা জানতে পেরেছিল পরীক্ষা হচ্ছে। তাই নিজেদের সংযত করেছিল।

কিন্তু রাজা আর সিংহকে বিশ্বাস করলেন না।

রাজা যখনই শিকারে যেতেন, বারোজন শিকারীকে নিয়ে যেতেন। যত দিন যেতে লাগল রাজার ততই তাদের ভাল লাগতে লাগল। একদিন হল কি, যখন তারা শিকারে ব্যস্ত সেই সময় খবর এল যে রাজার কনে আসছেন।

এদিকে রাজার যে সত্যিকারের কনে তিনি যখন শুনলেন, তিনি এমন একটা ধাক্কা খেলেন যে তার বুকের ধুকপুকুনিই প্রায় বন্ধ হয়ে যায়! অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন রাজকুমারী। রাজা ভাবলেন, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিকারীর কিছু একটা হয়েছে। তিনি দৌড়ে গিয়ে তাকে তুলে তার হাত থেকে দস্তানা টেনে খুলে ফেললেন। খুলেই দেখলেন, তাঁর বাগ্‌দত্তাকে যে আংটি দিয়েছিলেন সেই আংটি তার হাতে। শিকারীর মুখ ভাল করে দেখে রাজা তাকে চিনতে পারলেন। রাজা তার মুখে চুমু খেতেই সে জেগে উঠল। রাজা বললেন—তুমি আমার, আমিও তোমার। কেউ আমাদের ছাড়াতে পারবে না।

তিনি অন্য রাজকুমারীর কাছে এক দূত পাঠিয়ে খবর দিলেন তাঁর বিয়ে-করা এক বৌ আছে, তিনি যেন ফিরে যান। তারপর বিয়ে হয়ে গেল। সিংহের আবার আদর হল, কারণ সে-ই সত্যি কথা বলেছিল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন