হাড়ের গান

এক দেশে একবার এক বুনো বরা ভীষণ অত্যাচার শুরু করে দিল। মাঠে চাষীরা চাষ করছে, তাদের আক্রমণ। রাস্তা দিয়ে লোক যাচ্ছে তাদের তাড়া। এমনি করে তার খড়্গ দিয়ে অনেক মানুষকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললে। দেশের রাজা রটনা করলেন তাঁর দেশ থেকে যে এই বিভীষিকাটিকে দূর করতে পারবে তাকে তিনি অনেক পুরস্কার দেবেন। কিন্তু জন্তুটি এত বৃহৎ এত শক্তিশালী এত ভয়ানক যে যে-বনে বরাটা থাকত তার কাছে পর্যন্ত যেতে কেউ সাহস করল না।

অবশেষে রাজা ঘোষণা করলেন, যে সেই বুনো বরাহকে জীবন্ত অথবা মৃত অবস্থায় তাঁর কাছে এনে দিতে পারবে তার সঙ্গে তিনি তাঁর একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেবেন।

সেই দেশে দুই ভাই থাকত, তাদের বাবা ছিল বড় গরীব। তারা বলল, আমরা বুনো বরা মারব। বড় ভাই ছিল চালাক ধূর্ত; সে বলল বড়াই করে। আর ছোট ভাই ছিল সরল সহজ; সে বলল দেশের বিপদে তার প্রাণে সাড়া দিল বলে।

রাজা শুনে বললেন, দুই ভাই যদি বরাহ মারতে যেতে চায় তবে একসঙ্গে না গিয়ে দুজনে দু-দিকে যাক, আর বড়ভাই যাক সন্ধ্যায়, ছোটভাই যাক সকালে।

সকাল হতেই ছোট ভাই বেরিয়ে পড়ল। কিছু দূরে যেতেই তার সঙ্গে দেখা এক ক্ষুদে মানুষের। ক্ষুদে মানুষের হাতে একটি কালো বর্শা। সে এগিয়ে এসে বলল— এদিকে এস, এই বর্শাটা নাও। তোমার মনটা বড় ভালো তাই এটা তোমায় দিলুম। এটি হাতে নিয়ে তুমি বুনো বরাকে খুঁজে বার করতে পারবে। আর বরা-ও তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

ছোটভাই ধন্যবাদ জানিয়ে বর্শাটা নিল, নিয়ে সেটা কাঁধে ফেলে আর দেরি না করে গভীর বনে গিয়ে ঢুকল। একটু পরেই দেখা গেল জানোয়ারটা তার দিকে আসছে আর লাফ দিয়ে তাকে আক্রমণ করবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। ছোটভাই শক্ত হাতের মুঠোয় বর্শা ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। রাগে অন্ধ হয়ে জানোয়ারটা তীব্র বেগে যেই না এগিয়ে এল অমনি গেঁথে গেল বর্শা তার দেহে। কলজে পর্যন্ত গিয়ে ঠেকল বর্শা। সঙ্গে সঙ্গে সে মরে পড়ে গেল।

ছোটভাই তখন জানোয়ারটাকে কাঁধে ফেলে তার ভাইয়ের সন্ধানে চললো। বনের অপর দিকে পৌঁছে সে দেখল প্রকাণ্ড একটা হল্‌, সেখান থেকে সঙ্গীতের শব্দ আসছে, লোকে নাচছে গাইছে, সরাব খাচ্ছে— খুব আমোদ চলেছে। সেখানেই তার বড় ভাইকে পাওয়া গেল; বড় ভাই ভেবেছিল বরা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না; বরং একটু ফূর্তি করে সরাব টেনে মনের সাহস বাড়িয়ে নিই।

বড় দাদা জানলা দিয়ে দেখতে পেল ছোটভাই কাঁধে মরা শুয়োর নিয়ে ফিরছে। দেখে তার বেজায় হিংসে হল— মনে হল যেন বুক পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তার মনোভাব গোপন রেখে বাইরে বেরিয়ে এসে মুখে হাসি ফুটিয়ে ভাইকে বলল— এস ভাই এস, কত কষ্ট হয়েছে তোমার। চলো আমার ঘরে একটু জিরোবে। সরাব আনিয়ে দিচ্ছি খেয়ে শরীর ঠাণ্ডা কর।

ছোট ভাই ভাবল দাদা না জানি কত দয়ালু কত স্নেহপরায়ণ। সে মরা বরাহ নিয়ে তার দাদার ঘরে ঢুকল, তারপর কেমন করে তার সঙ্গে ক্ষুদে মানুষের সাক্ষাৎ হয়েছে, কেমন করে সে বর্শা পেয়েছে, কেমন করে সে বুনো জানোয়ারটাকে মেরেছে সব বলল।

দাদা শুনে বলল— ভাই, ক্লান্ত হয়ে এসেছ, আজ সন্ধে অবধি জিরোও।

তারপর অন্ধকার হতে দাদা বললে— চলো বাইরে বেরিয়ে একটু ঠাণ্ডা হয়ে আসি। এই বলে ভাইকে নিয়ে নদীর ধার অবধি গেল। নদীর-উপর দিয়ে একটি সাঁকো। বড় ভাই বললে— চলো ওপারে যাওয়া যাক।

ছোট ভাই আগে বড় ভাই পিছনে এই ভাবে চলতে চলতে বড়ভাই হঠাৎ ডাণ্ডা তুলে মারল ছোট ভাইয়ের মাথায়। এক ঘায়েই ছোট ভাই পড়ে মরে গেল।

পাছে আবার বেঁচে ওঠে এই ভয়ে তাকে তুলে নিয়ে বড় ভাই ঝপাং করে নদীর জলে ফেলে দিলে। উপর থেকে দেখা গেল পরিষ্কার জলের মধ্যে ডুবতে ডুবতে ছোট ভাইয়ের দেহ বালির মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। এই দুষ্কর্ম সেরে সে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে মরা বরাহটা কাঁধে তুলে রাজবাড়িতে গিয়ে উপস্থিত। রাজাকে বললে— বরা তো মেরেছি। এবার অঙ্গীকার মতো রাজকন্যাকে আমায় দিন।

বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল কিন্তু তার দুষ্কর্মের কথা খুব বেশি দিন চাপা রইল না। একদিন তা প্রকাশ হয়ে পড়ল। কয়েক বছর পরে একদিন এক রাখাল তার ভেড়ার পাল নিয়ে সেই সাঁকো পার হচ্ছে, হঠাৎ তার চোখে পড়ল জলের মধ্যে একটা চমৎকার হাড় পড়ে রয়েছে। দেখতে একেবারে বরফের মতো সাদা। সে ভাবলো এই দিয়ে বাঁশির একটা চমৎকার মুখনল বানানো যাবে।

সাঁকো পার হয়ে সে জলে নামল। তখন এক হাঁটু মাত্র জল। সেই জল পার হয়ে সে হাড়টাকে কুড়িয়ে নিল। তারপর বাড়ি এসে ঘষে ঘষে তার থেকে একটা বাঁশির মুখনল বানাল।

কিন্তু যেই না সে সেই মুখনলে ফুঁ দিলে তার শব্দ শুনে রাখাল তো অবাক। বাঁশি আগে যেমন বাজত তেমন তো বাজছে না— এর থেকে চমৎকার সুরে এক গান বার হচ্ছে। বাঁশি গেয়ে চললো—

আমার হাড়েতে আজি
ফুঁ দিয়ে বাজাও বাঁশি
জানো কি রাখাল আমি
কতকাল জলবাসী?
জলের তলের বালু
সেথা শুয়ে আছি আমি—
মরণ দাদার হাতে
জানে অন্তর্যামী।
আমারই অস্ত্রে বন্য বরাহ
পড়েছে ধরণীতলে—
দাদা লভিয়াছে রাজার কুমারী
ছলে বলে কৌশলে।

রাখাল বললে— আশ্চর্য বাঁশি তো। নিজে নিজেই গেয়ে চলে। যাই রাজাকে গিয়ে শোনাই—কিছু লাভ হতে পারে।

রাজার কাছে রাখাল গিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিতেই বাঁশি গেয়ে উঠল। ঐ একই গান, একই সুর।

রাজা তো শুনে অবাক। রাখালকে কিছু বকশিশ দিলেন। তারপর বললেন— আবার বাজা তো!

এবার শুনে রাজার মনে সন্দেহ উঁকি দিতে লাগল। কোথা থেকে হাড়টা পাওয়া গেছে জেনে নিয়ে তিনি হুকুম দিলেন সাঁকোর নিচের বালি উল্টে ভালো করে খুঁজে দেখতে। রাজার পাইক সেখানে গিয়ে বালি খুঁড়ে ছোট ভাইয়ের কঙ্কাল আবিষ্কার করল।

তখন আর বড় ভাই তার দোষ অস্বীকার করতে পারল না। রাজা হুকুম দিলেন ওকে বস্তায় পুরে জলে ডুবিয়ে দেওয়া হোক। তারপর ছোট ভাইয়ের দেহের অস্থি তুলে এনে গির্জের গোরস্থানে যত্ন করে কবর দেওয়া হল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন