খুনীর সঙ্গে বিয়ে

এক ছিল চাকিওয়ালা, তার ছিল এক ভারি সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটি বড় হলে তার বাবা ভাবলেন, মেয়ে এবার বিয়ে করে ঘর-সংসার পাতুক। যদি ভাল বর পাই তো মেয়ের বিয়ে দিই।

কিছুদিন পরে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এক বর এসে হাজির। তাকে দেখে মনে হয় তার অনেক পয়সা। চাকিওয়ালাকে লোকটির বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বললে না, তাই সে ভাবলে, এ-ই বা মন্দ বর কী? সে তারই সঙ্গে বিয়ের কথা দিয়ে দিলে। কিন্তু কনে বরকে দেখলে যেমন খুশি হয়, এ মেয়েটি এই লোকটিকে দেখে তেমন খুশি হতে পারলে না। তার উপর তেমন বিশ্বাসও জন্মালো না। যখনই মেয়েটি তার দিকে তাকাতে তার বুক কেমন যেন ভয়ে শিউরে উঠত।

একদিন সেই লোকটি মেয়েটিকে বললে— তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে ; তুমি আমার বাগ্‌দত্তা। তুমি কোনদিন আমার বাড়িতে আসো না কেন?

মেয়েটি বললে— তোমার বাড়ি কোথায় তা-ই আমি জানি না।

লোকটি বললে— আমার বাড়ি গভীর বনের মধ্যে।

গভীর বন শুনে মেয়েটি ইতস্তত করতে লাগল। বললে, বনের মধ্যে আমি পথে খুঁজে পাব না।

লোকটি বললে— সামনের রবিবার তোমায় আসতেই হবে। আমি সেদিন আরো কয়েকজনকে নিমন্ত্রণ করেছি। আমি বনের পথে ছাই ছড়িয়ে রেখে দেব, যাতে করে তা দেখে তুমি আসতে পার।

রবিবার মেয়েটি যখন বেরোতে যাবে, তার মনে-মনে বড় ভয় হল, অথচ কেন যে ভয় হতে থাকল বুঝতে পারলে না। ফেরবার সময় যাতে তার পথ হারিয়ে না যায় এই ভেবে সে পকেট ভরে শিমের বিচি আর ডাল নিয়ে নিল। বনের পথে ঢোকবার মুখেই সে দেখলে ছাই দিয়ে পথ চিহ্ন করা রয়েছে। তাই ধরে সে চলল, কিন্তু এক পা দু পা অন্তর সে ডাইনে বাঁয়ে শিমের বিচি আর ডাল ছড়িয়ে চলল।

প্রায় সারাদিন মেয়েটি পথ চলে শেষে বনের ঠিক মাঝখানে এসে হাজির হল। সেখানে প্রায় রাতের মত অন্ধকার। একটি বাড়ি। কিন্তু বাড়িটি দেখে মেয়েটির মোটেই ভাল লাগল না। বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখে, কেউ কোত্থাও নেই। সব সুনসান। হঠাৎ কোথা থেকে একটা গলা শোনা গেল—

ফিরে যাও ফিরে যাও বিয়ের কনে,
এ বাড়ি মরার বাড়ি জেনো তা মনে।

মেয়েটি মুখ উঁচু করে দেখতে পেল, দেয়ালের গা থেকে একটা খাঁচা ঝুলছে; তার মধ্যে এক পাখি। সে-ই বলছে ঐ কথা। পাখি আবার বললে—

ফিরে যাও ফিরে যাও বিয়ের কনে,
এ বাড়ি মরার বাড়ি জেনো তা মনে।

সুন্দরী কনেটি এক ঘর থেকে আর-এক ঘর ঘুরে ফিরল, কিন্তু সব ঘরই খালি। একটি প্রাণী কোথাও নেই। শেষে মাটির নিচের ঘরে ঢুকে দেখে, সেখানে এক বুড়ি থুত্থুড়ি বসে ঘাড় নাড়ছে।

—দেখ মা, আমার বর কি এখানে থাকেন?

বুড়ি বললে— হায় কন্যা, কোথায় যে তুমি এসেছ তার কিছুই তুমি জান না। তুমি এসেছ খুনীদের আড্ডায়। তুমি ভাবছ এইবার তোমার বিয়ে হবে? হবে বটে। বিয়ে হলেই মৃত্যু। এই দেখছ কড়াই? এতে আমি জল ভরে রেখেছি। যেই ওরা তোমায় হাতে পাবে অমনি আর কিছু বিবেচনা না করেই তোমায় কেটে এই জলে রান্না করবে। করে তোমায় খাবে। ওরা মানুষের মাংস খায়। আমি যদি দয়া করে তোমায় এখন না বাঁচাই, তো তোমার হয়ে গেল। এই বলে বুড়ি তাকে প্রকাণ্ড এক পিপের পিছনে লুকিয়ে বসিয়ে দিলে, যাতে তাকে দেখা না যায়।

—চুপটি করে ইঁদুরের মতো বসে থাকো। নড়ো না। নড়েছ কি সর্বনাশ! আজ রাত্রে যখন খুনীগুলো ঘুমোবে তখন আমরা দুজনে পালাবো। অনেকদিন ধরে এই রকম এক সুযোগের আশায় আমি বসে আছি।

এইকথা শেষ হতে না হতেই হৈ-চৈ করতে করতে খুনীর দল ঘরে ঢুকল। সঙ্গে করে তারা একটি মেয়েকে নিয়ে এসেছে। মেয়েটি চিৎকার করছে, কাঁদছে, কিন্তু খুনীগুলো মদের নেশায় এমনই বুঁদ যে সেদিকে নজরই দিচ্ছে না। তারা মেয়েটিকে তিন রং-এর তিন গেলাস সরাব খেতে দিল— লাল, সাদা আর হলদে। খেতেই মেয়েটি টলে পড়ে মরে গেল। বেচারা কনে পিপের পিছনে ভয়ে কেঁপে উঠল। তার নিজের কপালে কী আছে ভেবে তার গা শিউরে উঠল।

একজনের চোখে পড়ল মরা মেয়েটির কড়ে আঙুলে একটি সোনার আংটি। সে টানাটানি করে আংটিটাকে খোলবার চেষ্টা করল। শেষে না পেরে কুড়ুল দিয়ে মারল আঙুলের উপরে এক কোপ। কিন্তু কাটা আঙুলটা ছিটকে শূন্যে লাফিয়ে উঠে পড়বি তো পড় পিপের পিছনে যেখানে কনে লুকিয়ে আছে, তারই কোলে। লোকটা একটা আলো নিয়ে চারিদিকে খুঁজে দেখল, কিন্তু কোথাও পেল না। একজন বললে— পিপের পিছনে খুঁজে দেখেছ?

এ বুড়ি সেই সময় চেঁচিয়ে বললে— খাবে এস সবাই। যা খোঁজবার কাল খুঁজো। কাটা আঙুলটা পালিয়ে যাবে না।

খুনে বললে— বুড়ি ঠিক বলেছে। এই বলে তারা খোঁজা বন্ধ করে খাবার খেতে বসে গেল। বুড়ি করল কি, তাদের খাবারের মধ্যে বেশ খানিকটা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিল। হাই তুলতে তুলতে যেই না তারা শুয়ে পড়ল অমনি অকাতরে ঘুম।

ময়েটি যখন শুনলে সবার নাক ডাকছে, পিপের পিছন থেকে তখন সে বেরিয়ে এল। খুনীরা সারবন্দী হয়ে মেঝেতে শুয়ে। মেয়েটি তাদের উপর দিয়ে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে কোনরকমে পার হয়ে এল। বুড়ি তার সঙ্গে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই.দুজনে সেই পাপের জায়গা থেকে যত জোরে পারে ছুট দিলে।

হাওয়ায় সমস্ত ছাই উড়ে গিয়েছিল রাস্তা থেকে, কিন্তু শিমের বিচি আর ডাল থেকে শিকড় বেরিয়ে ছোট ছোট গাছ হয়ে গিয়েছিল। তাই দেখে চাঁদের আলোয় তারা চলতে লাগল।

সারা রাত হেঁটে সকাল বেলা তারা চাকি-কলে এসে হাজির হল। মেয়েটি বাপকে সব কথা খুলে বললে।

বিয়ের দিন আগেই ঠিক করা ছিল। বর সাজগোজ করে ঠিক দিনটিতে এসে হাজির। চাকিওয়ালাও সেদিন তার সব আত্মীয় বন্ধুদের নেমন্তন্ন করেছিল। সকলে মিলে যখন টেবিলের চারিপাশে বসল, সকলকে কিছু কিছু গল্প বলতে বলা হল। কনে মুখ বুজে চুপটি করে বসে ছিল। তার বলবার পালা আসতে বর বললে— তোমার কি কিছুই বলবার নেই কনেটি আমার? বল না কিছু!

মেয়েটি বললে—বেশ, আমি তাহলে কী এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখেছি তাই বলব। আমি যেন বনের মধ্যে একা বেড়াচ্ছিলুম। বেড়াতে বেড়াতে দেখলুম বনের মধ্যে এক কোণে একটি বাড়ি। বাড়ির মধ্যে জনপ্রাণী নেই। দেয়াল থেকে একটি খাঁচা ঝুলছে, তার মধ্যে এক পাখি। পাখি বলে উঠল—

ফিরে যাও ফিরে যাও বিয়ের কনে,
এ বাড়ি মরার বাড়ি জেনো তা মনে।

পাখিটি দুবার এই কথা বললে। তবে, সবই স্বপ্ন। আমি একটার পর একটা ঘরে ঢুকে দেখলুম, সবই খালি, সবই কেমন যেন! শেষে আমি মাটির নিচের ঘরে যেতে দেখলুম, সেখানে এক থুত্থুড়ি বুড়ি বসে বসে মাথা নাড়ছে।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম, এখানে কি আমার বর থাকে? সে বললে— হায় কন্যে, তুমি খুনির আড্ডায় এসেছ। তোমার বর এখানেই থাকে বটে, কিন্তু সে তোমায় কেটে টুকরো টুকরো করে রান্না করে খাবে। —আমি শুধু স্বপ্ন দেখছিলুম, বুঝছ তো?

তারপর বুড়ি আমায় একটা পিপের পিছনে লুকিয়ে রাখলে। লুকিয়ে রাখতে না রাখতেই খুনীরা এসে হাজির হিড়-হিড় করে একটি মেয়েকে টানতে টানতে। তারা মেয়েটিকে তিন রকম রঙের সরাব খেতে দিলে— লাল, সাদা আর হলদে। খেয়েই মেয়েটি মরে পড়ে গেল। —এসব স্বপ্ন দেখলুম, বুঝছ তো? তারপর তারা মেয়েটিকে টুকরো টুকরো করে কাটলে।—বুঝলে তো, এ শুধু স্বপ্ন। একজন খুনী দেখতে পেল, মেয়েটির হাতের কড়ে আঙুলে একটি সোনার আংটি। সে আংটিটা খুলে নেবার চেষ্টা করে যখন পারল না তখন কুড়ুলের এক কোপে আঙুলটা কেটে ফেললে। কিন্তু আঙুলটা লাফিয়ে উঠে টপাস্‌ করে এসে পড়ল একেবারে আমার কোলে। এই যে, আংটি-সুদ্ধ সেই আঙুল!

এই বলেই মেয়েটি আঙুলটি বার করে সবাইকে দেখালো।

বর এই শুনে ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল। সে পালাবার চেষ্টা করতেই নিমন্ত্রিতেরা তাকে ধরে ফেলল। পুলিসে ডেকে ধরিয়ে দিতেই বাদবাকি যে খুনীরা ছিল তারাও সব ধরা পড়ে গেল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন