বিশ্বাসী জন্‌

এক ছিলেন রাজা। তাঁর একবার অসুখ করল। তিনি ভাবলেন—এই আমার শেষ শয্যা। বললেন—বিশ্বাসী ‘জন্‌’কে ডেকে পাঠাও।

বিশ্বাসী জন্‌ ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় চাকর। সারা জীবন সে রাজার কাছে বিশ্বাসী থেকে সেবা করে গেছে।

বিছানার ধারে আসতে রাজা তাকে বললেন—বিশ্বাসী জন্‌, আমি বুঝছি আমার সময় হয়ে এসেছে। আমার একমাত্র চিন্তা আমার ছেলেকে নিয়ে। তার বয়েস এখনও কাঁচা—কি করতে হয় না-করতে হয় জানে না। তুমি আমায় কথা দাও যে তুমি সব সময় তাকে পথ দেখাবে, তার পালক-পিতার মতো হবে। তা নইলে আমি শান্তিতে চোখ বুজতে পারছি না।

বিশ্বাসী জন্‌ উত্তর দিল—আমি কোনো দিন তাকে ছেড়ে যাবো না। বিশ্বাসী হয়ে থেকে তার সেবা করব—তাতে আমার প্রাণও যায় যদি যাক।

রাজা শুনে বললেন—এবার আমি মনের সুখে এবং শান্তিতে মরতে পারব। তারপর বললেন—আমার মৃত্যুর পর ছেলেকে সমস্ত প্রাসাদে যত ঘর আছে, হল আছে, গুদাম আছে সব দেখাবে। তাদের মধ্যে যে ধন-রত্ন আছে সব দেখাবে। কিন্তু বড় বারান্দার শেষে যে শেষ ঘরটি, যাতে সোনার প্রাসাদের রাজকন্যার ছবি লুকোনো আছে সেটি কখনও দেখিও না। রাজপুত্র যদি সে ছবি দেখেন তাহলে ছবিকে তিনি এমনই ভালবেসে ফেলবেন যে তখনই অজ্ঞান হয়ে যাবেন। আর তারপর ঐ রাজকন্যার জন্যে তিনি যে-কোন বিপদ বরণ করতে এগিয়ে যাবেন। কাজেই এ বিষয়ে সাবধান থেকো।

বিশ্বাসী জন্‌ কথা দিল যে সব আদেশ পালন করবে। রাজা চুপ করে গেলেন—বালিশের উপর মাথা এলিয়ে দিয়ে মারা গেলেন।

বুড়ো রাজাকে কবর দিয়ে এসে বিশ্বাসী জন্‌ নতুন রাজাকে জানালো, সে তার বাবার মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে কি অঙ্গীকার করেছে। তারপর বলল—তোমার বাবার কাছে আমি যেমন বিশ্বাসী ছিলুম, তোমার কাছেও থাকব, তাতে যদি আমার প্রাণ যায় তো যাক।

শোকের দিন যখন শেষ হল বিশ্বাসী জন্‌ রাজাকে বললে—তুমি উত্তরাধিকার সূত্রে কি পেলে তা দেখবার সময় হয়েছে। চল তোমায় পৈতৃক প্রাসাদ দেখিয়ে দিই।

বলে তাকে নিয়ে সারা প্রাসাদের উপরতলায় নীচেরতলায় ঘুরতে থাকল। জমকালো সব ঘর আর অজস্র ধনরত্ন দেখালো। শুধু একটি ঘরের দরজা সে খুলল না—যে ঘরের মধ্যে ছিল সেই বিপজ্জনক ছবি। ছবিটি এমন জায়গায় টাঙানো ছিল যে দরজা খুললে প্রথমেই সেটা চোখে পড়বে। ছবিটি এমন আশ্চর্যভাবে আঁকা যেন মনে হয় নিঃশ্বাস ফেলছে। সারা দুনিয়ায় এ ছবির জোড়া নেই।

বিশ্বাসী জন্ প্রতিবারেই সেই দরজাটি এড়িয়ে চলে যাচ্ছিল। রাজা সেটা লক্ষ করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন—এ দরজাটা তুমি খুলছ না কেন ?

সে বলল—ওর ভিতরে যা আছে, তা দেখলে তুমি ভয় পেয়ে যাবে।

রাজা বললেন—আমি সমস্ত প্রাসাদ দেখেছি—এর ভিতরে কি আছে তা-ও দেখব। বলে তিনি এগিয়ে গিয়ে জোর করে দরজা খোলবার চেষ্টা করলেন।

বিশ্বাসী জন্ তাঁকে ডেকে বলল—তোমার বাবার মৃত্যুশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে আমি অঙ্গীকার করেছি, ও ঘরে কি আছে তোমায় দেখাবো না। সে অঙ্গীকার ভাঙলে তোমার আমার দুজনেরই বিপদ হবে।

কিন্তু রাজা বললেন—ও ঘরে ঢুকতে না পারলে আমার চলবে না। যতক্ষণ না নিজচক্ষে দেখি ততক্ষণ দিনে রাতে আমার মনে কোনো শান্তি থাকবে না। আর যতক্ষণ না তুমি দরজা খুলছ ততক্ষণ আমি এখান থেকে নড়বও না।

বিশ্বাসী জন্‌ দেখল আর কোনো উপায় নেই। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে চাবির বড় গোছা থেকে খুঁজে চাবিটা বার করল। দরজাটা খুলে সে নিজে গিয়ে ঢুকল আগে। ভাবল, রাজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে রাজা ছবিটা দেখতে পাবেন না। কিন্তু ভবী ভোলবার নয়। ডিঙ্গি মেরে উঁচু হয়ে রাজা তার কাঁধের উপর দিয়ে দেখলেন। যেই সেই সোনা আর জহরতে মোড়া রাজকন্যার পরমাশ্চর্য ছবি তাঁর চোখে পড়ল অমনি তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।

বিশ্বাসী জন্ তাঁকে টেনে তুলল। বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবল—হায় সর্বনাশ হয়ে গেল। এখন আমাদের কি হবে?

শুশ্রূষা করে রাজার জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে রাজা প্রথম কথা বললেন—আহা কী সুন্দর ছবি! এ ছবি কার?

বিশ্বাসী জন্‌ উত্তর দিলে—এ ছবি সোনার প্রাসাদের রাজকন্যার।

রাজা বললেন—এ রাজকন্যার প্রতি আমার ভালোবাসা এত যে বনের গাছের সব পাতার যদি মুখ থাকত তাহলে তারাও তা বলে শেষ করতে পারত না। এ রাজকন্যাকে পাবার জন্যে আমি প্রাণ পণ করলুম। আর তুমি, বিশ্বাসী জন্‌, আমায় ছেড়ে যাবে না।

বিশ্বাসী চাকর অনেকক্ষণ ধরে ভাবল, কি করা যায়? তার মনে হল রাজকন্যাকে পাওয়া দূরের কথা, তাঁর দর্শনটুকু পাওয়াও অতি কঠিন হবে।

শেষে তার মাথায় এক বুদ্ধি এল। সে রাজাকে বললে—রাজকন্যার চারিদিকে ঘিরে আছে শুধু সোনা—টেবিল, চেয়ার, পাত্র, পেয়ালা, গামলা, বাড়ির সব আসবাব সবই সোনার। তোমার রাজকোষে আছে দেড়শ মণ সোনা। রাজ্যের স্যাকরাদের ডেকে পাঠাও তারা তাই দিয়ে যতরকম পারে—পাত্র, যন্ত্র, পাখি, জীবজন্তু সুন্দর করে বানিয়ে ফেলুক। হলে সব নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব সৌভাগ্যের খোঁজে।

রাজ্যের যত স্যাকরাদের রাজা ডেকে পাঠালেন। তারা দিন রাত খেটে অবাক-করা সব জিনিস গড়ে ফেলল। তারপর সব জিনিস জাহাজে ভরা হলে বিশ্বাসী জন্‌ সওদাগরের পোষাক পরলে। রাজাও সওদাগরের ছদ্মবেশ ধরলেন। তারপর তারা সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে অনেক দূরে গিয়ে পৌঁছলেন সোনার প্রাসাদে, যেখানে রাজকন্যা থাকেন।

বিশ্বাসী জন্‌ বলল—তুমি জাহাজে থাকো, আমি আসছি। বলা তো যায় না, হয়তো আমি রাজকন্যাকে নিয়েই ফিরব। দেখো যেন সব ঠিক থাকে। সোনার পাত্রগুলি সব বার করতে হুকুম দাও। আর সারা জাহাজ সাজানো হোক।

তারপর সে সব রকম এক-একটা সোনার জিনিস চাদরে বেঁধে জাহাজ থেকে নেমে রাজপ্রাসাদে গিয়ে হাজির হল। প্রাসাদের উঠোনে পৌঁছে দেখলে একটি সুন্দরী ঝি হাতে দুই সোনার ঘড়া নিয়ে কুয়ো থেকে জল তুলছে। ঘড়া ভরে তুলে নিয়ে যেতে যাবে সেই সময় তার চোখে পড়ল একজন বিদেশী।

ঝি বললে—কে গা তুমি ?

সে বলল—আমি সওদাগর। বলে তার চাদর খুলে ধরলে।

ঝি বলে উঠল—কী সুন্দর জিনিসগুলি। বলে তার ঘড়া নামিয়ে রেখে সোনার খেলনাগুলি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল।

তারপর সে বলল—আমাদের রাজকন্যাকে এগুলি দেখাতেই হবে। রাজকন্যা সোনার জিনিস এত ভালবাসেন যে এগুলি সব তিনি কিনে নেবেন।

বলে জন্‌-এর হাত ধরে তাকে ভিতরে নিয়ে গেল। এ ছিল রাজকন্যার বসবার ঘরের ঝি।

রাজকন্যা সোনার জিনিসগুলি দেখে ভারি খুসি হয়ে বললেন—এদের কাজ এত সুন্দর, এত চমৎকার, এগুলি সব আমি কিনব।

কিন্তু বিশ্বাসী জন্ বলল—দেখুন, আমি হচ্ছি এক ধনী সওদাগরের চাকর। এখানে আপনাকে যা দেখালুম তা আমার প্রভুর জাহাজে যা আছে তার তুলনায় কিছুই নয়। অপূর্ব কাজ করা এমন সব সোনার জিনিস তাঁর কাছে আছে যা কেউ কোনোদিন দেখেনি।

রাজকন্যা বললেন—তবে সে সব এখানে নিয়ে আসুন, আমি দেখব।

জন্‌ বলল—দেখুন অত জিনিস বয়ে আনতে অনেক দিন লেগে যাবে। এত জিনিস আছে আর এত জায়গা লাগবে সাজাতে যে আপনার বাড়িতে পর্যন্ত কুলোবে না।

রাজকন্যার ঔৎসুক্য আর কল্পনা বেড়েই চললো। তিনি অবশেষে বললেন—নিয়ে চলুন আমায় জাহাজে। আমি নিজে গিয়েই দেখে আসব আপনার প্রভুর সম্পদ।

বিশ্বাসী জন্‌ মনের আনন্দে তাঁকে জাহাজে নিয়ে গেল। রাজা যখন দেখলেন ছবিতে যা দেখেছেন সত্যিকারের রাজকন্যা তার চেয়েও সুন্দরী, তাঁর নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার মত হল। রাজকন্যা সিঁড়ি দিয়ে জাহাজে উঠতে রাজা তাঁকে অভিবাদন করে নিয়ে গেলেন।

বিশ্বাসী জন্‌ মাঝিদের কাছে গিয়ে হুকুম দিল জাহাজ ছেড়ে দিতে। বললে, সমস্ত পাল খুলে দাও যাতে হাওয়ার আগে পাখির মতো উড়ে চলে জাহাজ।

রাজা রাজকন্যাকে প্রত্যেকটি সোনার জিনিস আলাদা আলাদা করে দেখাতে লাগলেন—থালা, বাটি, পাখি, বুনো জন্তু-জানোয়ার। দেখতে দেখতে অনেক ঘণ্টা কেটে গেল। মনের আনন্দে রাজকন্যা টেরই পেলেন না যে জাহাজ চলেছে। শেষ জিনিসটি দেখা হয়ে গেলে তিনি সওদাগরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফেরবার জন্যে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু জাহাজের ধারে এসে দেখলেন তাঁরা তখন মাঝ সমুদ্রে, ডাঙ্গা থেকে অনেক দূরে, পুরো পালে ভর করে জাহাজ বেগে চলেছে।

রাজকন্যা ভয় পেয়ে কেঁদে বললেন—হায়, এরা আমায় ছলনা করেছে। এই সওদাগর আমায় নিয়ে পালাচ্ছে। এর চেয়ে মরা আমার ভালো ছিল।

কিন্তু রাজা তাঁর হাত ধরে বললেন—আমি সওদাগর নই—রাজা। তোমার চেয়ে আমার বংশগৌরব কম নয়। কিন্তু তোমার ছবি চোখে দেখে পর্যন্ত তোমায় আমি এত ভালবেসেছিলুম যে এই ছলনা ছাড়া আর উপায় ছিল না। প্রথমবার তোমার ছবি যখন দেখি কন্যে, আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলুম।

এই শুনে সোনার প্রাসাদের রাজকন্যা কিছুটা ভরসা পেলেন। তাঁর বিশ্বাস ফিরে এল। রাজাকে তাঁর ভালই লাগল। তিনি তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হলেন।

এখন হল কি একদিন, তখনও তাঁরা সমুদ্রের উপর দিয়ে চলেছেন, আর বিশ্বাসী জন্‌ জাহাজের সামনের দিকে বসে বাজনা বাজাচ্ছে, সেই সময় সে দেখল মাথার উপর উড়ছে তিনটে দাঁড়কাক। বাজনা থামিয়ে সে শুনতে লাগল, কি বলছে তারা। সে পাখির ভাষা বুঝত।

প্রথম দাঁড়কাক বলল—ঐ যে দেখি সোনার প্রাসাদের সুন্দরী রাজকন্যা।

দ্বিতীয় দাঁড়কাক বলল—তা বটে, কিন্তু এখনও রাজার হাতের মুঠোয় আসেনি।

তৃতীয় দাঁড়কাক বলল—কেন, ঐ তো দুজনে পাশাপাশি বসে।

তখন প্রথম দাঁড়কাক আবার বলল—তাতে কি এসে যায়? ওরা যখন ডাঙায় নামবে অমনি একটা লাল ঘোড়া লাফিয়ে আসবে ওদের দিকে। রাজা অমনি তাতে চড়বার চেষ্টা করবেন। চড়লেই ঘোড়া রাজাকে নিয়ে শূন্যে উড়ে যাবে। আর কোনোদিন তিনি রাজকন্যার দেখা পাবেন না।

দ্বিতীয় দাঁড়কাক বলল—এর কি কোনো কাটান নেই?

—আছে। যদি আর কেউ রাজার আগেই ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠেই পিস্তল বার করে এক গুলিতে ঘোড়াকে মেরে ফেলে। তাহলেই রাজা বাঁচবেন। কিন্তু এ আর জানবে কে? আর না-হয় যে জানবে, সে করুক; কিন্তু যদি সে একথা কাউকে বলে তাহলে পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে হাঁটু পর্যন্ত তার পাথর হয়ে যাবে।

দ্বিতীয় দাঁড়কাক বললে—আমি আরও জানি। ঘোড়াকে মেরে ফেললেও রাজকন্যা হাত থেকে ফস্কে যেতে পারেন। ওঁরা যখন রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছবেন রাজা দেখবেন তাঁর জন্যে একটা বিয়ের পিরাণ রয়েছে—সোনার আর রূপোর সুতোয় বোনা। কিন্তু আসলে গন্ধকের বিষ দিয়ে তৈরি। যে গায়ে দেবে তার হাড় পর্যন্ত পুড়ে যাবে।

তৃতীয় দাঁড়কাক বললে—এর কোনো কাটান নেই?

দ্বিতীয় দাঁড়কাক বললে—আছে বই কি! রাজা নেবার আগে অন্য কেউ যদি দস্তানা হাতে সেটা তুলে আগুনে ফেলে পুড়িয়ে দেয় তাহলেই রাজা বাঁচবেন। কিন্তু কি করেই বা হবে তা? যে জানবে সে না-হয় করুক; কিন্তু যদি কাউকে বলে ফেলে তাহলে তার হাঁটু থেকে কলজে পর্যন্ত পাথর হয়ে যাবে।

তৃতীয় দাঁড়কাক বললে—আমি আরও জানি। বিয়ের পিরাণ পুড়ে গেলেও রাজা যে রাজকন্যাকে পাবেন তার ঠিক নেই। বিয়ের নাচ যখন শুরু হবে আর নতুন রানী যখন নাচবেন তখন হঠাৎ তিনি বিবর্ণ হয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে যাবেন—যেন মারা গেছেন। সেই সময় কেউ যদি তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁর ডান দিকের বুক থেকে তিন ফোঁটা রক্ত বার করে না দেয় তো তিনি সত্যিই মারা যাবেন। কিন্তু যে এটা জানে সে করে করুক কিন্তু যদি কাউকে একথা বলতে যায় তাহলে তার মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত পাথর হয়ে যাবে।

দাঁড়কাকদের মধ্যে এইরকম কথা হবার পর তারা উড়ে গেল। বিশ্বাসী জন্‌ সবই বুঝল, আর সেই থেকে সে গম্ভীর হয়ে গেল, মন-মরা হয়ে রইল। সে ভাবলে সে যা জানে তা যদি লুকিয়ে রাখে তাহলে মহা বিপদ ঘটবে রাজার। আবার সে যদি রাজাকে খুলে বলে সব কথা তাহলে তার প্রাণ যাবে।

অবশেষে মনে মনে সে বলল—প্রভুকে আমি বাঁচাবোই, তাতে যদি আমার মরণ হয় হোক।

তারা ডাঙায় এসে নামতেই দাঁড়কাকরা যেমন বলেছিল হল। কোথা থেকে লাফিয়ে এসে দাঁড়াল এক চমৎকার লাল ঘোড়া।

রাজা বললেন—বাঃ কি চমৎকার। এতে করেই আমি রাজপ্রাসাদে যাবো। এই বলে তিনি উঠতে যাবেন, সেই সময় বিশ্বাসী জন্‌ তাঁকে সরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘোড়াতে উঠেই খাপ থেকে পিস্তল বার করে গুলি করে ঘোড়াকে মেরে ফেলল।

রাজার অন্যান্য চাকরেরা চেঁচিয়ে উঠল—এ কী আস্পর্ধা। এমন সুন্দর ঘোড়া—রাজা তাতে চড়ে প্রাসাদে যাবার জন্যে তৈরী—তাকে মেরে ফেলল?

কিন্তু রাজা বললেন—চুপ কর সবাই। ও যা করেছে ভালই করেছে। ও আমার বিশ্বাসী জন্‌। কিসে আমার ভাল হবে ও জানে।

তারপর সকলে রাজপ্রাসাদে পৌঁছলেন। সেখানে দেখা গেল হলঘরে একটা থালা। থালার উপর সোনা আর রূপোয় বোনা বিয়ের পিরাণ ঝক্‌ঝক্‌ করছে। রাজা সেই দিকে এগিয়ে গিয়ে পিরাণটা গায়ে দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু বিশ্বাসী জন্ তাঁকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দস্তানা পরা হাতে সেটাকে তুলে নিয়েই তাড়াতাড়ি আগুনের মধ্যে ফেলে পুড়িয়ে ফেলল।

রাজার অন্যান্য চাকরেরা বিরক্তি প্রকাশ করল। তারা বললে—দেখ আস্পর্ধা! রাজার বিয়ের পিরাণ পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলল।

কিন্তু রাজা বললেন—কে জানে হয়তো বিশেষ কোনো কারণ ছিল। ও যা করে করুক। ও হচ্ছে আমার বিশ্বাসী জন্।

তারপর বিয়ের ভোজ সুরু হল। রাজকন্যাই প্রথমে নাচলেন। বিশ্বাসী জন্‌ তাঁকে এক মনে লক্ষ করতে লাগল। রাজকন্যা হঠাৎ একেবারে সাদা হয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। মনে হল যেন মারাই গেছেন। জন্‌ তাড়াতাড়ি তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে তুলে একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে তাঁকে শুইয়ে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর ডানদিকের বুক থেকে তিন ফোঁটা রক্ত বার করে নিলে। নিতেই তাঁর নিঃশ্বাস বইতে লাগল। রাজকন্যা উঠে দাঁড়ালেন।

রাজা সবই দেখছিলেন। কেন যে বিশ্বাসী জন্ এমন করল তিনি কিছুই বুঝলেন না। তিনি ভীষণ রেগে চীৎকার করলেন—ধরে নিয়ে যাও ওকে কারাগারে।

পরের দিন সকালে বিশ্বাসী জন্-এর প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়ে গেল। তাকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হল। বিশ্বাসী জন্‌ মরবার জন্যে যখন তৈরী তখন সে বললে—যে মরতে যাচ্ছে তাকে মরবার আগে একবার কথা বলবার অধিকার দেওয়া হয়। আমাকে কি সে অধিকার দেওয়া হবে ?

রাজা বললেন—হ্যাঁ, দেওয়া হল।

তখন বিশ্বাসী জন্‌ বললে—অন্যায় করে আমায় দণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমি সব সময়েই ছিলুম বিশ্বাসী। বলে সমুদ্রযাত্রায় সে দাঁড়কাকদের কি কি কথা শুনেছিল সব একে একে বললে। আর বললে, প্রভুকে বাঁচাবার জন্যে কী কী সে করেছে।

রাজা চেঁচিয়ে উঠলেন—বিশ্বাসী জন্ ! আমায় ক্ষমা কর, ক্ষমা কর। —ওকে নামিয়ে আনো।

কিন্তু বিশ্বাসী জনের মুখ দিয়ে শেষ কথাটি বেরতেই সে পাথর হয়ে পড়ে গেল।

রাজা আর রানী মহা দুঃখ পেলেন। রাজা বললেন—হায় হায়, এমন বিশ্বাসী মানুষকে কি বলে আমি এমন শাস্তি দিলুম? তিনি সেই পাথরের মূর্তিকে তুলিয়ে নিয়ে তাঁর শোবার ঘরে বিছানার পাশে দাঁড় করিয়ে দিলেন। যতবার তিনি দেখতেন তিনি কেঁদে বলতেন—হায়, কেমন করে তোমায় ফিরিয়ে আনব আমার বিশ্বাসী জন্‌ ?

কিছুদিন পরে রানীর দুই যমজ ছেলে হল। বেড়ে উঠতে তারা হল বাপ-মায়ের চক্ষের মণি। একদিন রানী যখন গির্জেয়, ছেলে দুটি বাড়িতে তাদের বাবার সঙ্গে খেলা করছে, রাজা সেই সময় পাথরের মূর্তির দিকে তাকিয়ে দুঃখভরা মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কেঁদে বললেন—হায় কি করে তোমার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারি বিশ্বাসী জন্‌ আমার ?

পাথরের মূর্তি হঠাৎ কথা বলতে আরম্ভ করল। সে বললে—আমাকে আবার তুমি প্রাণ দিতে পার যদি তোমার সব চেয়ে ভালোবাসার ধনকে আমার কাছে বলি দাও।

রাজা কেঁদে বললেন—পৃথিবীতে যা কিছু আমার আছে সব তোমায় দেব।

পাথর বলে চলল—নিজের হাতে তোমার দুই ছেলের মাথা কেটে ফেল। তাদের রক্ত মাখিয়ে দাও আমার গায়ে। তাহলেই আমি আবার প্রাণ ফিরে পাবো।

দুই প্রিয় শিশুকে হত্যা করতে হবে ভেবে রাজা ভয়ে কেঁপে উঠলেন। কিন্তু জন্‌-এর সমস্ত বিশ্বস্ততার কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। জন্‌ কেমন করে তার প্রাণ দিয়েছিল তা মনে পড়ল। তিনি তলোয়ার বার করে নিজের হাতে ছেলেদের মাথা কেটে ফেললেন। তারপর তাদের রক্ত নিয়ে যেই না পাথরের গায়ে লাগিয়ে দিলেন অমনি পাথর প্রাণ ফিরে পেল। বিশ্বাসী জন্‌ জীবন্ত হয়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল।

জন্‌ রাজাকে বলল—তুমি যে আমায় এত বিশ্বাস করলে তার পুরস্কার তুমি পাবে। বলে ছেলে দুটির কাটা মাথা তুলে নিয়ে ধড়ে লাগিয়ে তাতে একটু রক্ত মাখিয়ে দিতেই জোড়া লেগে গেল। তারা লাফিয়ে উঠে খেলা করতে সুরু করে দিলে—যেন কিছুই হয়নি।

রাজার খুবই আনন্দ হল। তিনি যখন দেখলেন রানী ফিরে আসছেন, তিনি জন্‌কে আর দুই ছেলেকে প্রকাণ্ড এক সিন্দুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখলেন।

রানী ফিরতে রাজা বললেন—গির্জেতে তুমি প্রার্থনা করেছ রানী?

রানী বললেন—করেছি। কিন্তু আমি সব সময় ভাবছিলুম বিশ্বাসী জন্‌-এর কথা আর কেমন করে আমাদের জন্যে তার এমন বিপদ হল তাই।

রাজা বললেন—দেখ রানী, জন্‌কে আবার আমরা জীবন দিতে পারি। কিন্তু তার বদলে আমাদের দুটি শিশুকেই বলি দিতে হবে।

শুনে রানীর মুখ শুকিয়ে গেল। বুক দুরু দুরু করে উঠল। কিন্তু তিনি বললেন—জন্‌ এত বিশ্বাসী ছিল, এত উপকারী ছিল যে দরকার হলে তা-ও করব।

শুনে রাজার আনন্দ হল। তিনি দেখলেন তিনিও যেভাবে দেখেছেন রানীও সেইভাবে দেখলেন। তিনি সিন্দুক খুলে বিশ্বাসী জন্ আর দুই পুত্রকে বার করে বললেন—ভগবানের জয় হোক। জন্‌ও বেঁচেছে, আমাদের শিশুদেরও কোনো বিপদ হয়নি। বলে যা যা ঘটেছিল তিনি বললেন।

তারপর সকলে তাঁদের জীবনের শেষ পর্যন্ত সুখে বেঁচে রইলেন।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন