পাখিয়া

এক ছিল বনের পাহারাদার। একদিন সে বনে শিকার করতে এসে একটি ছোট শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পেল। শব্দ অনুসরণ করে শেষে সে হাজির হল এক মস্ত গাছের নিচে। সেখানে এসে দেখল, গাছের মাথা থেকে কান্নার শব্দ আসছে। শিশুর মা যখন গাছ তলায় ঘুমোচ্ছিল সেই সময় তার কোল থেকে ছোঁ মেরে চিলে নিয়ে গিয়েছে তার ছেলেকে।

বনরক্ষক গাছে চড়ে শিশুটিকে নামিয়ে আনল। ভাবল—একে বাড়ি নিয়ে যাই। আমার ছোট্ট লিনার খেলার সঙ্গী হবে।

সেই থেকে ছেলেমেয়ে দুটি বনের পাহারাদারের বাড়িতে একসঙ্গে মানুষ হতে লাগল। ছেলেটির নাম হল পাখিয়া। আর লিনার সঙ্গে এত ভাব হল যে কেউ কারুর চোখের আড়াল হলে থাকতে পারত না।

বনরক্ষকের ছিল এক বুড়ি রাঁধুনি। একদিন সে দুটি বালতি নিয়ে জল আনতে গেল। একবার গেল, দু-বার গেল, বার বার জল এনে ভরতে লাগল।

লিনা দেখে বললে—সানা, এত জল আনছ কেন গো?

—যদি কাউকে না বল তো বলি।

লিনা বললে, সে কাউকে বলবে না।

রাঁধুনি বুড়ি বললে—কাল ভোরবেলা বনের পাহারাদার যখন শিকার করতে যাবে, তখন আমি জল ফোটাবো। যখন টগ্‌বগ্‌ করে ফুটে উঠবে, পাখিয়াকে তার মধ্যে ফেলে সিদ্ধ করে ফেলব।

পরদিন সকালে বনরক্ষক খুব ভোরে উঠেই শিকার করতে বেরিয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা তখনো ঘুমচ্ছে।

লিনা পাখিয়াকে বললে—তুমি আমায় কখনো ছেড়ে যেয়ো না।

পাখিয়া জবাব দিলে—আমি তোমায় কখনো ছেড়ে যাব না।

লিনা বললে—বলি শোন। সানা বুড়ি কাল যখন বলতির পর বালতি জল আনছিল আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম এত জল কেন আনছে? সে বললে, আমি যদি কাউকে না বলি তাহলে আমায় বলবে। আমি বললাম, বেশ কাউকে আমি বলব না। তখন সে বললে সকালবেলা বাবা যখন শিকারে যাবেন, সে হাঁড়িতে জল চড়াবে আর জল ফুটে এলে তাতে ফেলে তোমায় সিদ্ধ করবে। এখন ওঠ তাড়াতাড়ি, কাপড়-চোপড় পরে চল পালাই।

বাচ্চাদুটি উঠে তাড়াতাড়ি পোশাক পরে ছুটতে ছুটতে বাড়ির বাইরে পালিয়ে গেল।

জল যখন ফুটল, রাঁধুনি তাদের শোবার ঘরে ঢুকল পাখিয়াকে আনবার জন্যে। কিন্তু ঘরে বিছানার কাছে গিয়ে দেখে, দু-জনেই তারা পালিয়েছে। বুড়ি বেজায় ভয় পেয়ে গেল। মনে মনে বললে—বনের পাহারাদার বাড়ি ফিরে যখন দেখবে ছেলে-মেয়ে নেই, কী বলব তাকে? যাই, ছুটে গিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনি। রাঁধুনি তিনজন চাকরকে পাঠালো ছেলেমেয়েদের ধরে আনতে।

শিশু দুটি এক বনের ধারে বসে ছিল। অনেক দূর থেকে যখন দেখতে পেল তিনজন চাকর আসছে, লিনা পাখিয়াকে বললে—আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, তাহলে আমিও তোমায় ছেড়ে যাব না।

পাখিয়া জবাব দিলে—যতদিন বেঁচে থাকি তোমায় ছেড়ে আমি যাব না।

লিনা বললে—তুমি একটা গোলাপের ঝাড় হও। আমি তাতে একটি গোলাপের কুঁড়ি হব।

চাকর তিনজন যখন বনের কাছে এল, তারা দেখল কোথাও কিছু নেই, শুধু একটা গোলাপের ঝাড়, তাতে একটি গোলাপের কুঁড়ি। ছেলেমেয়েদের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তারা বললে—এখানে আর কিছু করবার নেই।

চাকরেরা ফিরে গিয়ে রাঁধুনি বুড়িকে বলল যে তারা কিছুই দেখতে পায়নি, শুধু একটি গোলাপ-ঝাড়, আর তাতে একটি গোলাপকুঁড়ি দেখেছে।

বুড়ি রাঁধুনি তাদের বকে বললে—গর্দভ সব! গোলাপ-ঝাড়টাকে উপড়ে গোলাপ-কুঁড়িটাকে ছিঁড়ে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারলে না? এক্ষুনি যাও—নিয়ে এস গে। কাজেই তারা ছুটল আবার।

ছেলেমেয়ে দুটি অনেক দূর থেকে তাদের দেখতে পেল। লিনা পাখিয়াকে বললে—আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আমিও তোমায় ছেড়ে কোনদিন যাব না।

পাখিয়া শপথ করলে—যতদিন বাঁচি তোমায় ছেড়ে যাব না।

তখন লিনা বললে—তুমি গির্জে হয়ে যাও, আর আমি তার মধ্যে ঝাড় হয়ে ঝুলে থাকি।

চাকর তিনজন এসে কিছুই দেখতে পেল না, শুধু দেখল এক গির্জে আর তার মধ্যে এক ঝাড়। তারা বলাবলি করল—এখানে আমরা কী করব? তার চেয়ে বাড়ি যাওয়া যাক।

বাড়ি আসতে রাঁধুনি জিজ্ঞেস করলে—তোরা কি কিছুই দেখতে পাসনি? তারা বললে—কিছুই না, শুধু এক গির্জে আর তার মধ্যে এক ঝাড়।

রাঁধুনি চেঁচিয়ে উঠল—গর্দভ সব! গির্জেটাকে ভেঙে ঝাড়টাকে আমার জন্যে নিয়ে আসতে পারলি না? এই বলে বুড়ি সেই তিনজন চাকরকে নিয়ে ছেলেমেয়ে দুটিকে ধরতে ছুটল।

ছেলেমেয়ে দুটি অনেক দূর থেকে দেখতে পেল তিনজন চাকর আর তাদের পিছনে পিছনে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বুড়ি রাঁধুনি আসছে। লিনা বললে—পাখিয়া, আমাকে ছেড়ে যেয়ো না; তাহলে আমিও তোমায় কখনও ছেড়ে যাব না।

সে শপথ করল—যতদিন বেঁচে থাকি, তোমায় ছেড়ে আমি যাব না।

লিনা বললে—তুমি পুকুর হয়ে যাও, আমি হাঁস হয়ে তাতে সাঁতার কাটব।

রাঁধুনি যখন পুকুরের ধারে পৌঁছল, সে মাটিতে শুয়ে পড়ল পুকুরের জল শুষে ফেলবার জন্যে। এদিকে হাঁস তাড়াতাড়ি করে সাঁতার কেটে বুড়ির কাছে এসেই ঠোঁট দিয়ে তাকে জলের তলায় নিয়ে গেল। ডুবে মরল সেই বুড়ি ডাইনি।

তখন ছেলেমেয়ে দুটি মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে গেল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন