বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার

এক বেড়ালের সঙ্গে এক ইঁদুরের ভারি ভাব হয়ে গেল। এত ভাব হল যে তারা ঠিক করল যে তারা দুজনে মিলে সংসার করবে।

বেড়াল বললে— শীতের সঞ্চয় চাই। নইলে যখন কিছুই পাওয়া যাবে না তখন আমরা খিদেয় ভুগবো। আর দেখ, তুমি কোথাও বেরবে না। বেরলেই ফাঁদে ধরা পড়ে যেতে পারো।

দুজনে অনেকক্ষণ ধরে পরামর্শ করে শেষে ছোট এক পাত্র চর্বি কিনে নিয়ে এল। তারপর ভাবনা হল কোথায় লুকিয়ে রাখা যায় চর্বিটুকু, যাতে চুরি না হয়। অনেক ভেবে-চিন্তে বেড়াল বললে— সব চেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে গির্জাস্থান। ঐ পুণ্যস্থান থেকে কেউ কিছু চুরি করবে না। তারা ঠিক করল গির্জের বেদির নিচে চর্বিটা রেখে আসবে আর যতদিন না সত্যিকারের দরকার হয় ততদিন ছোঁবেই না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বেড়ালের চর্বিটা চেখে দেখবার জন্যে বেজায় লোভ হল।

বেড়াল বললে— দেখ ইঁদুরমণি, আমার পিসতুতো বোন তার ছেলের নামকরণ করবার জন্যে আমায় নেমন্তন্ন করেছে। ছেলেটির রং দুধের মতো, গায়ে খয়েরি খয়েরি ছোপ। আজকে আমি সেখানে যাচ্ছি— তুমি বাড়িতে চুপচাপ থেকো— কেমন?

ইঁদুর বললে— নিশ্চয় নিশ্চয়। যাও তুমি ঘুরে এসো। আর যখন ভালো ভালো খাবার খাবে আমার কথা একটু মনে কোরো। এক ফোঁটা মিষ্টি লাল সরাব যদি আমিও খেতে পেতুম, কেমন হতো বল তো?

বেড়ালের সবটাই ভাঁওতা। তার কোন পিসতুতো বোনই নেই তা তাকে ছেলের নামকরণে ডাকবে কি করে? বেড়াল গির্জেয় গিয়ে সোজা ঢুকলো বেদির নিচে। তারপর চর্বির উপরটা চেটে মেরে দিল। খাওয়া সেরে বাইরের বাড়ির ছাদে ছাদে ঘুরে বেড়ালো খানিকক্ষণ, এ বেড়াল ও বেড়ালের সঙ্গে মোলাকাত করল, রোদে আড়মোড়া দিয়ে শুয়ে রইল খানিক আর যখনই তাদের সেই পাত্র ভরা চর্বির কথা মনে পড়তে লাগল সে একবার করে তার গোঁফ চেটে নিলে। তারপর সন্ধ্যে হতে ফিরল বাড়ি।

ইঁদুর বললে— এই যে এতক্ষণে? আশা করি নেমন্তন্ন বাড়িতে খুব জমেছিল?

বেড়াল বললে— হ্যাঁ তা তো বটেই।

ইঁদুর বললে— তাহলে, ছেলের নাম কি রাখলে?

বেড়াল বললে— ছেলের নাম হল উপর-গেলো।

—উপর গেলো? সে আবার কি রকম নাম? ভারি মজার তো। তোমাদের বংশে কি ঐ রকম নাম খুব চলে নাকি?

—কেন খারাপ কি? এক ইঁদুর বাচ্ছার নাম রেখেছিল খুঁটেখাই— তার চেয়ে তো এটা ভালো।

এর কিছুদিন পরে বেড়ালের আবার চর্বি খাবার ইচ্ছে হল।

বেড়াল বললে— ইঁদুরমণি, তোমার আর একদিন একা সংসার সামলাতে হবে। আমার সেই পিসতুতো বোনের আবার এক বাচ্চা হয়েছে। তার নামকরণ করতে হবে। তার আবার গলার লোমটা সাদা হাঁসুলির মতো; আমি আর না বলি কি করে বল?

ইঁদুর বেচারা বললে— বেশ যাও। আমি ঘর সামলাবো।

বেড়াল শহরের পাঁচিল ধরে ধরে গির্জের কাছে এসে উপস্থিত হল। সেখানে পৌঁছে সোজা চর্বির পাত্রের কাছে গিয়ে আধখানা চর্বি খেয়ে ফেললো। একটুও দেরি হল না।

সুস্বাদু চর্বি খেয়ে বেড়ালের মন খুশীতে ভরে উঠল। সে বললে— চুপি চুপি লুকিয়ে লুকিয়ে খাওয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই। তারপর সেদিন বাড়ি ফিরলে ইঁদুর জিজ্ঞেস করল—এ বাচ্চাটির কি নাম হল?

বেড়াল জবাব দিলে— এর নাম হল আধা সাবাড়।

ইঁদুর বললে— আধা সাবাড়? এমন নাম তো জীবনে শুনিনি। পাঁজি খুললেও এমন নাম পাওয়া যাবে না।

এর কিছুদিন পরেই বেড়ালের আবার নোলা সক্ সক্‌ করে উঠল।

সে ইঁদুরকে বললে— বার বার তিন বার। ভালো জিনিস সব সময় তিনবার হয়। আবার আমার নামকরণ করতে যেতে হবে। এবারের বাচ্চাটা একেবারে কালো, শুধু পাগুলি সাদা। এমন দেখা যায় না। তুমি আমায় যেতে দেবে তো?

ইঁদুর বিড় বিড় করে বললে— উপর গেলো, আধা সাবাড়— কি রকম অদ্ভুত সব নাম। ভারি আশ্চর্য লাগে।

বেড়াল বললে— লাগবেই তো। তার কারণ তুমি সব সময় বসে আছ বাড়িতে। দুনিয়াই দেখলে না তাই যা শোনো তাই তোমার আশ্চর্য লাগে।

কাজেই ইঁদুর ঘর-দোর গোছাতে লাগল— ধুয়ে মুছে রাখল সব। আর এদিকে লোভী বেড়াল বেরিয়ে গিয়ে চর্বির পাত্রটাকে শেষ করে দিয়ে এল।

বেড়াল মনে মনে বললে— যাক, সব শেষ হল, এবার মনটা নিশ্চিন্ত থাকবে। মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে আসতেই ইঁদুর জিজ্ঞেস করলে— তিন নম্বর বাচ্চার কি নাম হল?

বেড়াল বললে— অন্যগুলোর চেয়ে এমন কিছু ভালো হয়নি। এটার নাম হয়েছে সব সাবাড়।

ইঁদুর বলে উঠল— সব সাবাড়! এ রকম নাম কেউ শোনেনি। আমি তো কোনোদিনই শুনিনি। সব সাবাড়! এর মানে কি? বলে ঘাড় নাড়তে নাড়তে তার নিজের কোণটিতে গিয়ে গুটিয়ে মুটিয়ে শুয়ে পড়ল। এর পরে আর বেড়ালের নাম করণ করবার ডাক আসেনি।

তারপর যখন শীত এলো, বাইরে আর কোনো খাদ্যই পাওয়া যায় না তখন ইঁদুর তাদের সঞ্চয়ের কথা ভাবলে।

সে বললে— চলো বেড়াল আমাদের পাত্রটা আনতে যাই। কেমন চমৎকার খেতে হবে ভাবো তো।

বেড়াল বললে— নিশ্চয় নিশ্চয়।

দুজনে বেরল রাস্তায়। গির্জেয় পৌঁছে পাত্রের কাছে গিয়ে দেখে পাত্র খালি পড়ে রয়েছে।

ইঁদুর চেঁচিয়ে উঠল— এবার বুঝেছি মানেটা কি! তুমি যে কেমন বন্ধু তার প্রমাণ পেলুম। নাম করণ করবার ছলে তুমি সব খেয়ে ফেলেছ। প্রথমে উপর গেলো! তারপর আধা সাবাড়! তারপর—

বেড়াল গলা চড়িয়ে বলল— চুপ কর বেয়াদব। একটি কথা মুখ দিয়ে বেরিয়েছে কি তোকে সাবাড় করব।

ইঁদুর বেচারার ঠোঁট পর্যন্ত এসে গিয়েছিল— সব সাবাড়! সেটা আর সে নিরোধ করতে পারলে না; তার মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে বেড়ালও এক ঝাঁপে তার উপর পড়ে তাকেও শেষ করে দিল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন