ধড়ফড়ি মাছ

এক ছিল জেলে আর ছিল তার বৌ। ভারি গরিব। একখানি ভাঙা কুঁড়েয় সমুদ্রের ধারে কোন রকমে তারা মাথা গুঁজে থাকত। জেলে রোজ মাছ ধরতে যেত। মাছ ধরতে ধরতে একদিন হয়েছে কি, সুতোর আগায় টোপ বেঁধে জলে ফেলে চুপচাপ বসে আছে, হঠাৎ দেখে সুতোয় টান পড়েছে। সুতো গুটিয়ে দেখে, মস্ত এক ধড়ফড়ি মাছ ধরা পড়েছে।

ধড়ফড়ি মাছ বললে— দেখ জেলে ভাই, আমায় মেরো না। আমি সাধারণ ধড়ফড়ি মাছ নই। আমি জাদু-করা এক রাজপুত্র। আমাকে মেরে তোমার কী হবে? আমাকে খেতেও ভাল লাগবে না। আমায় জলে ছেড়ে দাও যাতে আমি সাঁতার কেটে চলে যেতে পারি!

শুনে জেলে বললে— সাবাস! অত কথা বলবার দরকার কী ভাই? যে মাছ মানুষের মত কথা কয় তাকে আমি জলে ছেড়ে দিতে এক্ষুনি রাজি। এই বলে সে সমুদ্রের চকচকে জলে ধড়ফড়িকে ছেড়ে দিলে আর সরু ফিতের মতো একটু রক্তের দাগ রেখে সে জলের মধ্যে মিলিয়ে গেল। জেলে তখন ছিপ গুটিয়ে নিয়ে তার ভাঙা কুঁড়েয় ফিরে গেল তার বৌয়ের কাছে।

জেলে-বৌ বললে— আজ কিছু মাছ ধরোনি?

জেলে বললে— না বৌ। একটা ধড়ফড়ি-মাছ ধরেছিলুম। সে মানুষের গলায় বললে যে সে একজন জাদু-করা রাজপুত্র। তাই তাকে জলেই ছেড়ে দিয়ে এসেছি।

বৌ বললে— তুমি তার কাছে কিছু চাইলে না?

জেলে বললে— চাইব আবার কী?

বৌ বললে—ও মা! এমন বোকা নিয়ে কোথায় যাব গো? চিরজীবন এই নোংরা ভাঙা কুঁড়েয় কাটাচ্ছ। একটা ভাল পরিষ্কার ঝরঝরে বাড়ি চেয়ে নিলেও তো পারতে? যাও, এখনি সমুদ্রের ধারে গিয়ে তাকে ডাক। ডেকে বল যে আমি একটা সুন্দর বাড়ি চাই। ঠিক দেবে।

জেলে কপাল চাপড়ে বললে— এখন সেখানে গিয়ে আমি করব কী বৌ?

জেলে-বৌ বললে— তুমিই তো তাকে ধরেছিলে। তুমিই তাকে ছেড়ে দিয়েছ। ও ঠিক তোমায় দেবে। যাও, শিগগির যাও।

জেলের একটুও যাবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু পাছে বৌ বিরক্ত হয় সেই ভয়ে গিয়ে দাঁড়ালো সমুদ্রের পারে।

গিয়ে দেখল সমুদ্র আগের মতো চক্‌চকে উজ্জ্বল নেই, কেমন যেন ঘোলাটে সবুজ হয়ে গেছে। সে জলের ধারে দাঁড়িয়ে বললে—

ধড়ফড়ি মাছ, ধড়ফড়ি মাছ
শোন আমার ভাই,
ইল্‌সেবিল বৌ আমার
যাই ধরে তাই চাই।
বৌয়ের কথার পর
চাইতে এলেম বর,
এখন, সাহস নাহি পাই।

ধড়ফডি মাছ সাঁতার কেটে এসে বললে— কী চাও বলই না।

জেলে বললে— হায়, আবার তোমায় ডাকতে হল। আমার বৌ বলে, আমি যখন তোমায় ধরেছিলুম তখনই বর চেয়ে নিলুম না কেন? বৌয়ের আর আমাদের ঐ ভাঙা কুঁড়েয় থাকবার ইচ্ছে নেই। তার একখানা ভাল বাড়িতে থাকবার সাধ হয়েছে।

ধড়ফড়ি মাছ বললে— বাড়ি যাও। তোমার বৌয়ের ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে।

জেলে ফিরে গিয়ে দেখল তার বৌ আর সেই পুরোনো কুঁড়েতে নেই। কুঁড়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সুন্দর একখানা বাড়ি। তার দরজায় একখানি বেঞ্চির উপর তার বৌ বসে রয়েছে।

জেলের হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বৌ বললে— দেখ আগের চেয়ে কত ভালো!

জেলে ভিতরে গিয়ে দেখল, চমৎকার একখানি বসবার ঘর। শোবার ঘর। শোবার ঘরে বিছানা পাতা। রান্না ঘর, ভাঁড়ার ঘরে থরে-থরে সাজানো নানারকম খাবার জিনিস বাসন কোসন থালা বাটি। বাইরে ছোট্ট একটি উঠোনে মুর্গি আর হাঁস চরছে, আর ছোট একখানি বাগান। তরকারি আর ফল গাছে.ভরা।

বৌ বললে— কেমন চমৎকার! দেখলে?

জেলে বললে— সত্যি! এখানে আমরা বেশ সুখেই থাকব।

—সে দেখা যাবে। বলে জেলে- বৌ স্বামীর সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুতে চলে গেল।

এক হপ্তা বেশ কাটল, তারপর জেলে-বৌ বললে, শোন জেলে। এ বাড়ি বেজায় ছোট, নড়বার চড়বার জায়গা নেই। বাগানটাও তথৈবচ। ধড়ফড়ি আমাদের আর-একটু বড় বাড়ি দিলেই তো পারত। আমি বড় একখানা পাথরের প্রাসাদে বাস করতে চাই। যাও ধড়ফড়িকে গিয়ে বল আমাদের একটা প্রাসাদ দিতে।

জেলে বললে— হায় বৌ, এই বাড়িই তো আমাদের পক্ষে যথেষ্ট। প্রাসাদ নিয়ে আমরা কী করব?

বৌ বললে— ভেবো না। যাও ধড়ফড়ির কাছে। সে ঠিক ব্যবস্থা করে দেবে।

জেলে বললে—না বৌ, ধড়ফড়ি আমাদের বাড়ি দিয়েছে, আবার আমি তার কাছে যেতে চাই না। রাগ করবে কি না কে জানে?

বৌ বললে— যা হোক তুমি যাও। ও ইচ্ছে করলেই দিতে পারবে, আর দেবেও দেখো, কোনো আপত্তি করবে না। যাও এখন।

জেলের ভারি অনিচ্ছে। মন ভার করে সে চলল। মনে মনে বললে— এটা উচিত হচ্ছে না। কিন্তু শেষ অবধি গিয়ে পৌঁজল সমুদ্রের তীরে। পৌঁছে দেখল সমুদ্রের রং আর সবুজ নেই। জল স্থির, কিন্তু রং তার ঘন বেগুনি আর ছাই মেশানো। সে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে ডাকল—

ধড়ফড়ি মাছ, ধড়ফড়ি মাছ,
শোন আমার ভাই,
ইল্‌সেবিল বৌ আমার
যাই ধরে তাই চাই।
বৌয়ের কথার পর
চাইতে এলেম বর,
এখন, সাহস নাহি পাই।

ধড়ফড়ি মাছ বললে— এবারে কী চাও?

জেলে ভয়ে ভয়ে বললে— হায়! আমার বৌ একটা বড় পাথরের প্রাসাদ চেয়েছে।

ধড়ফড়ি মাছ বললে— বাড়ি যাও। তোমার বৌ প্রাসাদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

জেলে ফিরে গিয়ে দেখল প্রকাণ্ড এক পাথরের তৈরি রাজপ্রাসাদ আর তার সামনের চওড়া সিঁড়ির উপরের ধাপে দাঁড়িয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছে তার স্ত্রী। সে আসতেই বৌ তার হাত ধরে বললে— চল আমরা ভিতরে যাই।

তারা ভিতরে ঢুকে দেখল প্রকাণ্ড এক হলঘর মার্বেল পাথরে বাঁধানো। সারি সারি দাঁড়িয়ে চাকরের দল ; জেলে আর বৌ আসতেই তারা দরজা খুলে সরে দাঁড়াচ্ছে। দেয়ালে ঝুলছে কারুকার্য করা পরদা আর ঘরে ঘরে সোনা-বাঁধানো চৌকি টেবিল, মেঝেতে দামি গালচে। টেবিলগুলো থরে-থরে সাজানো খাবারের ভারে নুয়ে পড়েছে। বাড়ির বাইরে প্রকাণ্ড এক উঠোন, তার গায়ে গায়ে ঘোড়ার আর গরুর আস্তাবল আর সারি সারি গাড়ি। উঠোনের পিছনে প্রকাণ্ড এক বাগান, সুন্দর বিচিত্র ফুলের আর রসালো ফলের গাছে ভরা। আর একটা পাঁচিল-ঘেরা ঘাসে ভরা মাঠ তাতে হরিণ হরিণী চরছে, খরগোস ঘুরে বেড়াচ্ছে। যা কিছু মানুষ চাইতে পারে সবই সেখানে।

জেলে-বৌ বললে— কেমন দেখছ গা? এইসব পেয়ে খুশি তো?

জেলে বললে— খুশি বই কি। এমনিই থাকুক তাহলে। এই সুন্দর প্রাসাদে আমরা সুখে স্বচ্ছন্দে থাকব।

জেলে-বৌ বললে— সে দেখা যাবে।

বলে তারা ঘুমোতে চলে গেল।

পরের দিন প্রথমে জাগল জেলে-বৌ। তখন সবে ভোর হচ্ছে। জেলে-বৌ তার বিছানা থেকে জানলার মধ্যে দিয়ে দেখতে পেল চারিদিকের দৃশ্য কি সুন্দর। জেলে তখন ঘুমোচ্ছে। জেলে-বৌ তার কনুইয়ের খোঁচায় তার স্বামীকে জাগালো। জাগিয়ে বললে— শুনছ গা? একবার জানলার মধ্যে দিয়ে দেখ। বল দেখি, এই সুন্দর দেশের রাজা হতে পারি আমরা? যাও তুমি ধড়ফড়ি মাছের কাছে। আমরা রাজা হব।

জেলে বললে— হায় জেলে-বৌ— আমরা রাজা হব কী করতে? আমি রাজা হতে চাইনে।

বৌ বললে— বেশ, তুমি যদি রাজা হতে না চাও, আমি হব। যাও ধড়ফড়ি মাছের কাছে। আমি রাজা হব।

জেলে বললে— হায় জেলে-বৌ! তুমি রাজা হতে চাইছ কেন? আমার ধড়ফড়ি মাছের কাছে যাবার একটুও ইচ্ছে নেই।

বৌ বললে— নেই কেন? যেতেই হবে তোমায়। আমি বলছি আমি রাজা হবই।

কাজেই জেলে আবার গেল। কিন্তু বিচারি ভারি মন-মরা হয়ে গেল, কারণ তার বৌ রাজা হতে চায়।

সে বললে— এটা উচিত নয়। এটা অন্যায়।

সমুদ্রের ধারে গিয়ে যখন সে পৌঁছল, দেখল জলের রং অন্ধকার ঘোলাটে, ঢেউ উঠেছে ; মনে হয় যেন অশুভ কিছু ঘটবে। সেখানে দাঁড়িয়ে ডাকল—

ধড়ফড়ি মাছ, ধড়ফড়ি মাছ,
শোন আমার ভাই,
ইল্‌সেবিল বৌ আমার
যাই ধরে তাই চাই।
বৌয়ের কথার পর
চাইতে এলেম বর,
এখন, সাহস নাহি পাই।

ধড়ফড়ি মাছ বললে— এবার তোমার বৌ কী চায়?

জেলে বললে— হায়! সে এবার রাজা হতে চায়।

ধড়ফড়ি মাছ বললে— যাও, ফিরে যাও। রাজা হয়েই গেছে সে।

জেলে ফিরে গেল। প্রাসাদের কাছে পৌঁছে দেখল প্রাসাদটা আরো বড় হয়েছে, তার মাথায় প্রকাণ্ড একটা কারুকার্য-করা বুরুজ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দরজায় সান্ত্রী। একদল সৈনিক ভেঁপু আর ড্রাম বাজাচ্ছে। বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই সে দেখল সব কিছু মার্বেল পাথরের আর সোনার। যেসব পর্দা ঝুলছিল সেগুলি হয়ে গেছে মখমলের, তাতে সোনার ঝালর। হল-ঘরের দরজা খুলে দিতেই সে দেখতে পেল সভাসদেরা এসে জড় হয়েছেন। তার স্ত্রী সোনা আর হীরেয় সাজানো একটা উঁচু সিংহাসনে বসে আছে। তার মাথায় সোনার মুকুট। হাতে এক সোনার রাজদণ্ড। তার দুপাশে রাজ-সঙ্গিনীরা পর-পর দাঁড়িয়ে আছেন স্থির হয়ে সারি বেঁধে।

জেলে এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললে— হায় জেলে-বৌ, তুমি কি এখন রাজা?

বৌ বললে— হ্যাঁ, আমি এখন রাজা।

জেলে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললে— তুমি রাজা হলে বৌ, ভালই হল। এর চেয়ে বেশি আর আমরা কিছু চাইব না।

জেলে-বৌ অস্বস্তি-ভরা সুরে বললে— না জেলে, আমার সময় কাটতে চাইছে না। আর সহ্য করতে পারছি নে। তুমি যাও ধড়ফড়ি মাছের কাছে। রাজা হয়েছি আমি, কিন্তু সম্রাটও হতে চাই।

জেলে বললে— হায় জেলে-বৌ! তুমি আবার সম্রাট হতে চাইছ কেন?

জেলে-বৌ বললে— ধড়ফড়ি মাছের কাছে যাও। সম্রাট আমি হবই।

জেলে বললে— হায় বৌ, মাছ তোমায় সম্রাট করতে পারবে না। আর আমিও তার কাছে গিয়ে ওকথা বলতে পারব না। সারা দেশে খালি একজনই সম্রাট আছেন, আর মাছ তোমায় সম্রাট করতে পারবে না। কিছুতেই পারবে না।

জেলে-বৌ বললে— কী বলছ! আমি হচ্ছি রাজা, তুমি হচ্ছ আমার স্বামী মাত্র। মাছের কাছে তোমায় যেতেই হবে। এক্ষুনি যেতে হবে। সে যদি আমায় রাজা করতে পারে তাহলে সম্রাটও করতে পারবে। সম্রাট আমি হবই। যাও শিগগির।

কাজেই তাকে যেতে হল। বেচারা বেজায় ভয় পেয়ে গেল। যেতে যেতে সে মনে মনে বললে— এর ফল কখনও ভাল হবে না। একটু লজ্জা থাকা উচিত, তাও নেই! ধড়ফড়ি মাছ শুনলেই সব ভেস্তে দেবে।

এই ভাবতে ভাবতে সে সমুদ্রের ধারে এসে পৌঁছল। পৌঁছে দেখল সাগরের জলে কালো। বড় বড় ঢেউ উঠছে। সমুদ্রের জল দুলছে এদিক থেকে ওদিক। বাতাস বইছে খরতর। জেলে ভয়ে কাঁপতে লাগল। সে খানিক দাঁড়িয়ে থেকে বললে—

ধড়ফড়ি মাছ, ধড়ফড়ি মাছ,
শোন আমার ভাই,
ইল্‌সেবিল বৌ আমার
যাই ধরে তাই চাই।
বৌয়ের কথার পর
চাইতে এলেম বর,
এখন, সাহস নাহি পাই।

ধড়ফড়ি মাছ এসে বললে— এবারে কী চায় তোমার বৌ?

জেলে বললে- হায়! আমার বৌ সম্রাট হতে চায়।

ধড়ফড়ি মাছ বললে— ফিরে যাও। সে সম্রাট হয়েছে।

জেলে ফিরে চলল। বাড়ির কাছে এসে দেখে সমস্ত প্রাসাদ চকচকে মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি। শ্বেত পাথরের মূর্তি আর সোনার কাজ চারিদিকে। ফটকের সামনে সৈনিকেরা কুচকাওয়াজ করছে, ভেঁপু বাজাচ্ছে, ড্রাম পিটছে। প্রাসাদের মধ্যে কাউন্ট, ব্যারন আর ডিউকরা আনাগোনা করছেন। জেলে ঢুকতেই তাঁরা সোনার দরজা খুলে ধরলেন।

জেলে ভেতরে ঢুকে দেখল প্রকাণ্ড এক নিরেট সোনার সিংহাসনে তার স্ত্রী বসে রয়েছে। তার মাথায় মস্ত এক সোনার মুকুট, তাতে হীরে ঝকমক করছে। এক হাতে ধরে আছে রাজদণ্ড, অন্য হাতে সাম্রাজ্যের প্রতীক আঁকা চক্র। দু-পাশে সারি বেঁধে ধনী জনেরা দাঁড়িয়ে আর চারিদিকে রাজন্যবর্গ, অমাত্য জমিদার।

জেলে স্তব্ধ হয়ে খানিক দাঁড়িয়ে থেকে তারপর জিজ্ঞেস করলে— জেলে-বৌ, তুমি কী এখন সম্রাট?

জেলে-বৌ জবাব দিলে— হ্যাঁ আমি এখন সম্রাট।

জেলে আরো খানিকক্ষণ তার বৌয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললে— হায় বৌ, সম্রাট হয়ে কি তোমার আরো ভাল হল?

জেলে-বৌ বললে— স্বামী, ওখানে তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমি সমস্ত খ্রীস্ট রাজ্যের ধর্মগুরু পোপ হতে চাই। যাও তুমি ধড়ফড়ি মাছের কাছে।

জেলে বললে— হায় বৌ! আরো তুমি কী চাইবে? পোপ হওয়া তোমার হবে না। সারা খ্রীস্ট জগতের শুধু একজনই পোপ আছেন। ধড়ফড়ি মাছের পক্ষে এ বর দেওয়া অসম্ভব।

জেলে-বৌ বললে— স্বামী, পোপ আমি হবই, কাজেই এক্ষুনি যাও তুমি। আজকেরই মধ্যে আমার পোপ হওয়া চাই।

জেলে বললে— না বৌ। আমার বলতে সাহস হয় না। বলে কোনো লাভ নেই। বলার কথা কল্পনাই করা যায় না। ধড়ফড়ি মাছ তোমায় পোপ করতে পারবে না।

জেলে-বৌ বললে— দেখ স্বামী! যে কথার মানে হয় না সে কথা বোলো না। সে যদি আমায় সম্রাট করতে পারে তাহলে পোপও করতে পারবে। এখুনি যাও। আমি হলুম সম্রাট— তুমি আমার স্বামী মাত্র, আমার আজ্ঞা পালন কর।

ভয়ে-ভয়ে গেল জেলে, কিন্তু একেবারে হকচকিয়ে গেল সে। সারা অঙ্গ তার কাঁপতে লাগল ; হাঁটু দুটো ঠক্‌-ঠক্ করতে থাকল।

বিষম ঝড় উঠল একটা, মেঘ ছুটে চলল আকাশের একদিক থেকে আরেক দিকে। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল, মনে হল যেন রাত নেমে এসেছে। গাছ থেকে পাতা খসে পড়তে থাকল, সমুদ্রের জল তীরের উপর আছড়ে পড়ে ফেনায় ফেনায় ফেনিয়ে গেল। দূরে ঢেউয়ের উপর আছাড়ি পিছাড়ি খেতে থাকল জাহাজ আর নৌকো। জাহাজ থেকে কামান ছুঁড়ে জানান দিতে থাকল যে তারা বিপদে পড়েছে। কালো মেঘের এক ফাঁকে একটুখানি নীল আকাশ দেখা যাচ্ছিল কিন্তু দক্ষিণ দিকের আকাশের লাল বর্ণ দেখে মনে হয় ভয়ানক ঝড় হচ্ছে। সমস্ত আশা ত্যাগ করে জেলে সাগরের ধারে দাঁড়িয়ে বললে—

ধড়ফড়ি মাছ, ধড়ফড়ি মাছ,
শোন আমার ভাই,
ইল্‌সেবিল বৌ আমার
যাই ধরে তাই চাই।
বৌয়ের কথার পর।
চাইতে এলেম বর,
এখন, সাহস নাহি পাই।

ধড়ফড়ি মাছ বললে— এবার কী চায় সে?

জেলে বললে— হায়! সে পোপ হতে চায়।

ধড়ফড়ি মাছ বললে ফিরে যাও। সে পোপ হয়েছে।

ফিরে গেল জেলে। গিয়ে দেখলে প্রকাণ্ড এক গির্জে। তার চারিদিকে ঘেরা প্রাসাদের পর প্রাসাদ। ভীড় ঠেলে এগিয়ে চলল সে। ভিতরে গিয়ে দেখল, হাজার হাজার বাতি জ্বলছে, আর তার স্ত্রী পা থেকে মাথা অবধি সোনার পোশাকে গা ঢেকে মাথায় তিনটে সোনার মুকুট পরে আরো উঁচু এক সিংহাসনে বসে। চারিদিকে তার পুরোহিতের দল। দু-পাশে দু-সারি মোমবাতি— সবচেয়ে বড়টা গম্বুজের মতো, তারপর ক্রমে ছোট হতে হতে শেষেরটা সরু কাঠির মতো। রাজারাজড়া সম্রাটেরা হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে তার জুতো চুম্বন করছে।

জেলে তার দিকে তাকিয়ে বললে— বৌ তুমি কী এখন পোপ হয়েছ?

জেলে-বৌ বললে— হ্যাঁ, আমি এবার পোপ।

জেলে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল— যেন জ্বলন্ত সূর্যের দিকে দেখছে।

সে বললে— হায়! পোপ হয়ে কি তোমার আরো ভাল হল?

জেলে-বৌ কোনো জবাব না দিয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল।

তখন জেলে বললে— দেখ বৌ, পোপ হয়েই তুমি সন্তুষ্ট থাক। এর উপরে তুমি আর উঠতে পারবে না।

জেলে-বৌ বললে— সে দেখা যাবে। বলে তারা ঘুমাতে গেল। কিন্তু বৌয়ের চোখে ঘুম এল না। আরো কী চাওয়া যায় তাই ভাবতে লাগল। জেলে বেশ আরামে নাক ডাকিয়ে ঘুম দিলে— সেদিন হাঁটাহাঁটিতে তার অনেক পরিশ্রম হয়েছিল। ভোরবেলা যখন আকাশ লাল হয়ে উঠছে, জেলে-বৌ বিছানাতে উঠে বসল। জানলার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে দেখল সূর্য উঠছে। দেখেই যে বলে উঠল— হয়েছে! সূর্য আর চাঁদকে আমার নিজের ইচ্ছেমত ওঠাতে আমি পারব না? বলে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে জেলেকে ঘুম থেকে তুলে বললে— স্বামী! ওঠ, উঠে ধড়ফড়ি মাছের কাছে যাও। আমি হব ব্রহ্মাণ্ডের হর্তাকর্তা!

জেলে আধ-ঘুমন্ত অবস্থায় কথাটা শুনে এমনই চমকে উঠল যে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তার মনে হল ভুল শুনেছে। চোখ কচলে সে বললে— হায় বৌ, কী বলছিলে তুমি?

বৌ বললে— স্বামী, আমি যদি ব্রহ্মাণ্ডের হর্তাকর্তা না হতে পারি, সূর্য আর চন্দ্রকে উদয়-অস্ত করাতে না পারি, তাহলে তা আমার পক্ষে অসহ্য হবে। জীবনে আমার কোনো সুখ থাকবে না।

বলে সে এমন বন্য দৃষ্টিতে জেলের দিকে তাকালো যে জেলের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল।

জেলে হাঁটু গেড়ে তার স্ত্রীর সামনে বসে বললে— হায় বৌ! ধড়ফড়ি মাছ এ করতে পারে না।, সম্রাট আর পোপ করে দিতে পারে কিন্তু এ তার পক্ষে অসম্ভব। আমি অনুরোধ করে বলছি, নিজেকে সংযত কর। পোপ হয়েই থাক।

বলতেই জেলে-বৌ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল, তার চুল খাড়া হয়ে উঠল। জেলেকে লাথি মেরে চিৎকার করে উঠল— অনেক সহ্য করেছি— আর নয়! শিগগির যাও!

জেলে উঠে দাঁড়িয়ে কোনোরকমে জামা গায়ে দিয়ে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল। এমনই ঝড় উঠেছিল যে জেলের পক্ষে তার দু-পা এক করে রাখাই মুশকিল হচ্ছিল। বাড়িঘর গাছপালা কাঁপছে, হেলছে দুলছে। পাহাড় পর্যন্ত থরথর করে উঠছে আর বড় বড় পাথর গড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রের জলে। অমাবস্যার অন্ধকারের মতো কালো আকাশ। বাজ পড়ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পর্বত-প্রমাণ কালো কালো ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা। জেলে চিৎকার করে ডাকল। অনেক কষ্টে তার কথা শোনা গেল—

ধড়ফড়ি মাছ, ধড়ফড়ি মাছ,
শোন আমার ভাই,
ইল্‌সেবিল বৌ আমার।
যাই ধরে তাই চাই।
বৌয়ের কথার পর।
চাইতে এলেম বর,
এখন, সাহস নাহি পাই।

ধড়ফড়ি মাছ জিজ্ঞেস করলে—এবার কী চায় সে?

জেলে বললে—হায়! সে ব্রহ্মাণ্ডের হর্তাকর্তা হতে চায়।

ধড়ফড়ি মাছ বললে—এবার তাকে তার ভাঙা কুঁড়েয় ফিরে যেতে হবে। আর গেছেও সে।।

সেই থেকে আজ পর্যন্ত তারা ভাঙা কুঁড়েতেই আছে।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন