হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌

হানস্‌ল্‌ ও গ্রেট্‌ল্‌

প্রকাণ্ড এক বনের ধারে বাস করত এক কাঠুরে, তার বৌ আর দুটি ছেলে-মেয়ে। ছেলেটির নাম হানস্‌ল্‌, মেয়েটির নাম গ্রেট্‌ল্‌। তারা ছিল ভারি গরিব, কোনদিন তাদের অভাব ঘুচত না। একবার এল দেশে দুর্ভিক্ষ। কাঠুরের ঘরে দু-বেলার জন্যে একটুরো রুটিও রইল না।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে কাঠুরে নিজের দুঃখের কথা ভাবতে ভাবতে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তার স্ত্রীকে বললে—আমাদের কী হবে? নিজেদেরই কিছু নেই, বাচ্চাদের কী খেতে দেব?

বৌ বললে—শোন বলি। কাল সকালে আমরা ছেলেমেয়েকে নিয়ে যেখানে বন সবচেয়ে গভীর সেইখানে যাব। একটা আগুন জ্বেলে দু-জনের হতে দু-টুকরো রুটি দিয়ে ওদের ছেড়ে আমরা নিজেদের কাজে চলে যাব। ওরা আর ফেরবার রাস্তা খুঁজে পাবে না। বাস, হয়ে গেল ছেলেমেয়ে!

কাঠুরে বললে—না বৌ। তা হয় না। প্রাণ ধরে ছেলেমেয়েকে গভীর বনের মধ্যে কেমন করে ছেড়ে দিয়ে আসব? বুনো জন্তুতে তাদের ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে যে!

কাঠুরে-বৌ বললে— কী বুদ্ধি তোমার! তাহলে আমরা চারজনেই না খেয়ে মরি। যাও এখনই বরং আমাদের কাফিনের কাঠগুলো করাত দিয়ে কেটে রেঁদা দিয়ে চেঁচে ঠিক করে রাখ।

এই বলে কাঠুরে-বৌ কাঠুরের পিছনে লেগে রইল। যতক্ষণ না পর্যন্ত তার কথায় রাজি হয় ছাড়ল না। কাঠুরে বললে— রাজি হলুম বটে, কিন্তু বেচারা ছেলেমেয়েদের কী হবে? তাদের জন্যে আমার বড় দুঃখ হচ্ছে।

পেটের জ্বালায় ছেলেমেয়ে কেউই ঘুমোচ্ছিল না। তাদের সৎমা তাদের বাবাকে কী বললে সব তাদের কানে গেল।

গ্রেট্‌ল্‌ আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললে—আর আমাদের কোন আশা রইল না!

হানস্‌ল্‌ বললে—কেঁদো না গ্রেট্‌ল্‌। আমি একটা উপায় করবই।

কাঠুরে কাঠুরেনী ঘুমোতে হানস্‌ল্‌ বিছানা ছেড়ে উঠল। তার ছোট কোটটা গায়ে দিল। দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালো। ফুটফুটে চাঁদের আলোয় বাড়ির চারপাশের সাদা নুড়িগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন নতুন চকচকে টাকার মতে। হানস্‌ল্‌ নিচু হয়ে যতগুলো পারে নুড়ি কুড়িয়ে তার পকেটে ভরে নিল।

তারপর সে গ্রেট্‌ল্‌-এর কাছে গিয়ে বললে—নির্ভাবনায় থাকো গ্রেট্‌ল্‌, ঘুমোও। ভগবান আমাদের ত্যাগ করবেন না। এই বলে সে নিজেও শুয়ে পড়ল।

ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে কাঠুরেনী এসে বললে—ওঠ কুঁড়ের বাদশারা! আমরা বনে যাব কাঠ আনতে।

তারপর তাদের হাতে এক টুকরো করে রুটি দিয়ে বললে—এই নাও তোমাদের দুপুরের খাবার। কিন্তু খবরদার, দুপুর হবার আগে খাবে না। আর কিছুই পাবে না তোমরা।

গ্রেটল্‌ তার আঁচলের আড়ালে রুটিদুটো ঢেকে রাখল। হানস্‌ল্‌-এর দুটি পকেট আগেই নুড়িতে ভরা ছিল। তাতে আর জায়গা ছিল না। তারপর তারা সবাই বেরিয়ে পড়ল বনের পথে। বনের পথে কিছুদূর যাবার পর হানস্‌ল্‌ একটু থেমে পিছন ফিরে তাদের বাড়ির দিকে তাকালো। কিছুদূর গিয়ে আবার তাকালো, তারপর আবার।

তার বাবা বললে—হানস্‌ল্‌, তুমি থেকে-থেকে কিসের জন্যে পিছন ফিরে তাকাচ্ছ? ভাল করে হাঁটো না!

হানস্‌ল্‌ বললে—আমি বাবা আমার সাদা বেড়ালটাকে দেখছি। আমাদের ছাদে বসে আছে। আমাকে বিদায় জানাবে বলে।

সৎমা বললে—বোকা ছেলে! ওটা বেড়াল নয়। সকালের রোদ চিমনিতে পড়ে ঐরকম দেখাচ্ছে।

কিন্তু হানস্‌ল্‌ বেড়ালের দিকে দেখছিল না। সে যতবার দাঁড়াচ্ছিল, একটা করে নুড়ি ফেলছিল পথে।

যখন তারা বনের মাঝখানে এসে পৌঁছল তাদের বাবা বললে—যাও ছেলেমেয়েরা, কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে এস। আগুন জ্বালিয়ে দিই যাতে তোমরা গরম থাকতে পার।

হানস্‌ল্‌ আর গ্রেট্‌ল্‌ ছোট ছোট শুকনো ডালের টুকরো জড় করে প্রকাণ্ড একটা স্তূপ করে ফেললে। তাতে আগুন দিতে যখন সেটা জ্বলতে থাকল তখন কাঠুরেনী বললে—এবার তোমরা আগুনের ধারে শুয়ে একটু জিরোও আর আমরা কাঠ কাটতে যাই। আমাদের কাঠ কাটা হয়ে গেলে তোমাদের নিতে আসব।

হানস্‌ল্‌ আর গ্রেট্‌ল্‌ আগুনের ধারে বসল। খাওয়ার সময় হলে তারা তাদের সামান্য রুটিটি খেয়ে নিল। তারা ভাবলে তাদের বাবা বোধহয় কাছেই আছে, কারণ কুড়ুলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আসলে সেটা কুড়ুলের শব্দই নয়। কাঠুরে একটা ডাল একটা মরা গাছের গায়ে বেঁধে দিয়েছিল, হাওয়ায় সেটা নড়ছিল আর শব্দ হচ্ছিল। বসে বসে তাদের বিরক্ত ধরে গেল। তারপর তাদের ঢুলুনি আসতে লাগল। শেষে তারা ঘুমিয়ে পড়ল।

যখন ঘুম থেকে উঠল তখন অন্ধকার রাত। গ্রেট্‌ল্‌ কাঁদতে আরম্ভ করলে—কী করে আমরা বনের বাইরে যাব? আর বেরোতে পারব না!

কিন্তু হানস্‌ল্‌ তাকে ভরসা দিয়ে বললে—একটু অপেক্ষা কর। এখুনি চাঁদ উঠবে। চাঁদ উঠলেই আমরা রাস্তা খুঁজে পাব।

পূর্ণ চাঁদ যখন উঠল হানস্‌ল্‌ তার ছোট্ট বোনের হাত ধরে দিনের বেলা সে যে নুড়ি ফেলে গিয়েছিল তাই দেখে হাঁটতে লাগল। নুড়িগুলি চাঁদের আলোয় মনে হতে লাগল নতুন চকচকে রুপোর টাকা! সারারাত তারা চলল। ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের বাবার কুটিরে এসে পৌঁছল।

দরজায় ধাক্কা দিতে কাঠুরেনী দরজা খুলে দেখে, হানস্‌ল্‌ আর গ্রেট্‌ল্‌। কাঁঠুরেনী বললে—দুষ্টু ছেলে-মেয়ে! বনের মধ্যে কি অতক্ষণ ঘুমোতে আছে? আমরা ভাবছিলুম তোমরা বুঝি আর ফিরতেই চাও না! তাদের বাবা খুব খুশি হল; ছেলেমেয়েকে বনের মধ্যে একলা ফেলে এসে তার মন বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

কিছুদিনের মধ্যেই আবার তাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে উঠল আর ছেলেমেয়েরা শুনতে পেল রাত্রিবেলা তাদের সৎমা বিছানায় শুয়ে তাদের বাবাকে বলছে—আমাদের সমস্ত খাবার ফুরিয়ে গেছে। বাকি আছে শুধু আধখানা রুটি। সেটা গেলে আর কিছুই থাকবে না। ছেলেমেয়েকে বিদায় করো! এবারে ওদের নিয়ে বনের মধ্যে আরো অনেক দূরে যেতে হবে যাতে করে আর কোনমতেই তারা পথ খুঁজে না পায়। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

শুনে কাঠুরে মনে বড় লাগল। সে বললে— তার চেয়ে বরং আমাদের শেষ রুটিটুকু ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ভাগ করে খাই।

কিন্তু কাঠুরের কথায় তার বৌ কর্ণপাতই করল না। শুধু তাকে বকতে থাকল, গালাগালি দিতে থাকল। কেউ যদি একবার ‘ক’ উচ্চারণ করে তাকে ‘খ’ বলতেই হবে। কাঠুরেরও হল তাই। প্রথমবার সে রাজি হয়েছিল, তাই দ্বিতীয়বারেও তাকে রাজি হতে হল। ছেলেমেয়েরা সে রাতেও দিব্যি জেগে শুয়ে ছিল। তাই তারাও সবকিছু শুনতে পেলে।

বাপ-মা ঘুমিয়ে পড়লে হান আবার নুড়ি কুড়িয়ে আনবার জন্যে উঠল। কিন্তু দরজা ঠেলে দেখে, দরজা বন্ধ। সৎমা তালা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। তাই সে আর বেরোতে পারলে না। কিন্তু সে তার ছোট বোনটিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললে— কাঁদিসনে গ্রেট্‌ল্‌, ঘুমো। ভগবান আমাদের সাহায্য করবেন।

ভোরবেলা কাঠুরেনী বাচ্চাদের ঠেলে তুললে। তুলে তাদের হাতে ছোট্ট একটুকরো করে রুটি গুঁজে দিলে—আগের চেয়ে অনেক ছোট্ট রুটি। পথে যেতে যেতে হানস্‌ল্‌ নিজের পকেটের মধ্যে রুটিটিকে গুড়িয়ে নিলে, আর কয়েক পা অন্তর থেমে থেমে এক টুকরো করে রুটি পথে ফেলে ফেলে যেতে লাগল।

কাঠুরে জিজ্ঞেস করলেন—হানস্‌ল্‌, তুমি থেকে-থেকে দাঁড়িয়ে কী দেখছ?

হানস্‌ল্‌ জবাব দিলে—আমার পোষা পায়রাটা আমাদের ছাদে বসে আছে, তাকেই দেখছি। ও আমাকে বিদায় জানাচ্ছে।

কাঠুরেনী বললে—যেমন বুদ্ধি! পায়রা কোথায়! চিমনির উপর সকালের আলো পড়ে ঐরকম মনে হচ্ছে।

তাহলেও ফাঁক পেলেই হানস্‌ল্‌ একটু করে রুটির গুঁড়ো ছড়িয়ে চলতে লাগল। সৎমা তাদের নিয়ে খুব গভীর বনের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। যেখানে এর আগে কোনদিন তারা আসেনি।

তারপর তারা একটা প্রকাণ্ড আগুন জ্বাললো আর কাঠুরেনী বললে—এখানেই তোমরা থাকো বাছারা। যখন ঘুম পাবে একটু ঘুমিয়ে নিয়ো। আমরা আরো দূরে যাচ্ছি কাঠ কাটতে। সন্ধেবেলা যখন আমাদের কাঠ কাটা হয়ে যাবে, তোমাদের এসে নিয়ে যাব।

দুপুরে খাবার সময় গ্রেট্‌ল্‌ তার রুটির আধখানা ভাগ তার দাদাকে দিলে। হানস্‌ল্‌-এর রুটি পথে ছড়িয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর তারা ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে সন্ধে হয়ে গেল, কিন্তু বেচারাদের নিয়ে যাবার জন্যে কেউ এল না।

যখন ঘুম ভাঙল, তখন বেশ অন্ধকার। হানস্‌ল্‌ তার ছোট বোনকে ভরসা দিতে থাকল—একটু দাঁড়া গ্রেট্‌ল্‌, এখনি চাঁদ উঠবে; আর যে রুটির গুঁড়ো আমি রাস্তায় ছড়িয়ে এসেছি তাই দেখে দেখে বাড়ি ফিরতে পারব।

চাঁদ উঠতে তারা বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু দেখল মাটিতে একটি টুকরোও রুটির গুঁড়ো পড়ে নেই। বনের যত পাখি তারা রুটির টুকরোগুলি খুঁটে খেয়ে গেছে।

হানস্‌ল্‌ গ্রেট্‌ল্‌কে বললে—দেখ না, ঠিক রাস্তা খুঁজে পাব। কিন্তু ফেরবার রাস্তা তারা খুঁজে পেল না। তারা সারা রাত বনের মধ্যে হাঁটল। তারপর সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত, কিন্তু বনের মধ্যে থেকে বেরোতে পারল না।

ভয়ানক খিদে। পথে দু-চারটে যা বেরি তুলে খেয়েছে এ ছাড়া কিছুই তাদের পেটে পড়েনি। এতই ক্লান্ত যে পা আর চলতে চায় না। একটা গাছতলায় শুয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তাদের বাড়ি ছেড়ে আসার পর সেটা হচ্ছে তৃতীয় দিন। তারা আবার হাঁটতে আরম্ভ করল। কিন্তু ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর বনের মধ্যে ঢুকতে থাকল তারা। এবার যদি সাহায্য না পায় তাহলে আর তাদের বাঁচবার উপায় নেই।

দুপুরবেলা তাদের চোখে পড়ল একটি বরফের মত সাদা পাখি গাছের ডালে বসে। শিস দিয়ে এমন সুন্দর গাইছে যে তারা দাঁড়িয়ে গেল শুনতে। গান শেষ হতে পাখিটি ডানা ঝাপটে তাদের মাথার উপর এসে উড়তে লাগল। হানস্‌ল্‌ আর গ্রেট্‌ল্‌ দেখল, পাখিটা কোথায় যায়! তারা পাখির পিছনে যেতে যেতে একটি বাড়ি দেখতে পেল। পাখিটি গিয়ে বসল সেই বাড়ির ছাদে।

বাড়ির কাছে পৌঁছে তারা দেখে, বাড়িটি রুটি দিয়ে তৈরি। তার ছাদ তৈরি কেক দিয়ে। জানলার কাঁচ মিছরির।

হানস্‌ল্‌ বললে—পাওয়া গেল তবু কিছু। বেশ পেট ভরে খাওয়া যাবে। ছাদের একটা টুকরো আমি খাব, গ্রেট্‌ল্‌। তুই জানলার একটা টুকরো খা, বেশ মিষ্টি লাগবে।

হানস্‌ল্‌ উপরে উঠে ছাদের এক টুকরো ভেঙে মুখে দিল চেখে দেখতে। গ্রেট্‌ল্‌ জানলার শার্সিতে গিয়ে লাগালে এক কামড়। ভিতর থেকে খাটো গলায় কে বললে—

ইঁদুরের মত কেটে কুটুর-কুটুর
কে খায় আমার বাড়ি খুটুর-খুটুর?

ছেলেমেয়েরা উত্তর দিলে—

বহিছে বাতাস বেগে ডাহিনে বামে
গগনের পবন যে মাটিতে নামে।

জোর বাতাসে বাড়ি নড়ছে, তাই খুট্‌খাট্‌ শব্দ হচ্ছে আর-কি! তারা নিশ্চিন্ত মনে খেয়ে চলল। হানস্‌ল্‌-এর স্বাদটা বড় ভাল লাগল। সে একটা মস্ত টুকরো ভেঙে নিয়ে আর গ্রেট্‌ল্‌ একটা গোটা গোল শার্সি খুলে নিয়ে মাটিতে বসে খাওয়া শুরু করে দিল।

হঠাৎ কুটিরের দরজা খুলে গেল আর এক থুত্থুড়ি বুড়ি বগলের তলায় লাঠির উপর ভর করে টলতে টলতে বেরিয়ে এল। হানস্‌ল্‌ আর গ্রেট্‌ল্‌ এমন ভয় পেয়ে গেল যে হাতে তারা যা ধরে ছিল তা পড়ে গেল তাদের হাত থেকে।

বুড়ি তার মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললে—আহা বাছারা আমার! এখানে কে তোমাদের নিয়ে এল? এস ভিতরে এস। আমার সঙ্গে থাকবে চল। তোমাদের কোন ভয় নেই।

বুড়ি তাদের হাত ধরে কুটিরের মধ্যে নিয়ে গেল। ভাল ভাল খাবার সাজিয়ে বুড়ি তাদের সামনে ধরল—চিনি-দেওয়া সরু-চাকলি, দুধ, আপেল, আর বাদাম। খাওয়া হয়ে গেলে বুড়ি তাদের দুটি ছোট্ট সাদা বিছানা দেখিয়ে দিল। তারাও তাতে শুয়ে পড়ল। তাদের মনে হল যেন স্বর্গে এসেছে!

বুড়ি যদিও মুখে ভাব দেখালো সে খুবই দয়ালু, আসলে সে ছিল অতি দুষ্টু এক ডাইনি। তার কাজ ছিল ছেলে ধরা। রুটি দিয়ে বাড়ি করার মানেই, যাতে লোভে পড়ে ছেলেরা এগিয়ে আসে। যখনই সে কোন বাচ্চাকে ধরতে পারত তাকে রান্না করে খেয়ে ফেলত। মস্ত ভোজ হত সেটা। ডাইনিদের চোখ হয় লাল। খুব বেশি দূরে দেখতে পায় না। কিন্তু জন্তু-জানোয়ারের মতো তাদের ঘ্রাণ-শক্তি প্রখর। মানুষ কাছে এলেই তারা গন্ধে টের পায়।

হানস্‌ল্‌ আর গ্রেট্‌ল্‌ যখন তার কাছে এল, ডাইনি মনে মনে একটা ক্রূর হাসি হেসে বললে—এইবার এদের পেয়েছি! আর পালাতে পারবে না!

বাচ্চারা ওঠবার আগে বুড়ি উঠল। সে যখন দেখল তারা বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে আর তাদের গালদুটি সুন্দর গোলাপি, সে মনে মনে বললে—বেড়ে খেতে হবে!

বুড়ি তার হাড়-বার-করা হাতে হানস্‌ল্‌কে ধরে ছোট্ট এক আস্তাবলে নিয়ে গেল। সেখানে গরাদে-দেওয়া এক ছোট্ট ঘরে তাকে বন্ধ করে দিলে।

হানস্‌ল্‌ যতই চিৎকার করুক বুড়ি সেদিকে কানও দিলে না।

তারপর বুড়ি গেল গ্রেট্‌ল্‌-এর কাছে। গিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে চেঁচিয়ে বললে—ওঠ্‌ কুঁড়ে-গিন্নি! জল তুলে আন্‌, আর তোর দাদার জন্যে ভাল দেখে কিছু রান্না কর! আস্তাবলে তাকে ধরে রেখেছি। তাকে মোটা করতে হবে। বেশ যখন মোটা হবে, তাকে খাব।

শুনে গ্রেট্‌ল্‌ আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। কিন্তু বুড়ি তাতে কর্ণপাতও করল না। ডাইনির হুকুম-মতো গ্রেট্‌ল্‌কে কাজ করে যেতে হল। বেচারা হানস্‌ল্‌-এর জন্যে ভাল-ভাল রান্না হতে থাকল। গ্রেট্‌ল্‌-এর ভাগ্যে জুটল শুধু কাঁকড়ার ঝোল।

রোজ সকালে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বুড়ি একবার করে আস্তাবলে যেত আর বলত—হানস্‌ল্‌, তোর আঙুল বার করে দেখা তো! মোটা হয়েছিস কি না দেখব!

হানস্‌ল্‌ একটা হাড়ের টুকরো বার করে দেখাতে। ডাইনির চোখের দৃষ্টি তো ভাল ছিল না—সে ভাবত বুঝি হানস্‌ল্‌-এরই আঙুল। বুড়ির ভারি আশ্চর্য লাগল, হানস্‌ল্‌ কেন এখনও মোটা হচ্ছে না!

পুরো চার হপ্তা চলে গেল তবু যখন হান মোটা হল না, বুড়ির ধৈর্য রইল না।

বুড়ি চেঁচিয়ে ডাকল—এদিকে আয় গ্রেট্‌ল্‌। জল নিয়ে আয়! রোগাই হোক আর মোটাই হোক হানস্‌ল্‌কে কেটে খাবই এবারে।

শুনে বেচারা গ্রেট্‌ল্‌-এর মনে এমন কষ্ট হল, যে কী বলব। যখন সে জল বয়ে আনছে, তার দু-চোখ দিয়ে সমানে জল ঝরছে। গ্রেট্‌ল্‌ বললে—বনের মধ্যে বুনো জানোয়ারে যদি আমাদের খেয়ে ফেলত তাহলে অন্তত দু-জনে একসঙ্গে আমরা মরতে পারতুম!

বুড়ি বললে—আর নাকে কাঁদতে হবে না! কেঁদে কোন লাভ নেই। মুখ বুজে কাজ কর।

পরের দিন সকালে গ্রেট্‌ল্‌কে হাঁড়ি ভরে জল আনতে হল। তারপর উনুন ধরিয়ে তার উপর জল-ভরা গুঁড়ি বসিয়ে দিতে হল।

ডাইনি এসে বললে—আগে আমরা পাঁউরুটি বেক করব। ময়দা ঠেসে রেখেছি। চুল্লি গরম করে রেখেছি। এই বলে গ্রেট্‌ল্‌কে ঠেলে ঠেলে চুল্লির ধারে নিয়ে গিয়ে বললে—চুল্লির দরজা দিয়ে গুঁড়ি মেরে ভিতরে ঢোক্‌। ঢুকে দেখ দিকি রুটি বেক করবার মত গরম হয়েছে কি না!

বুড়ির মতলব, গ্রেট্‌ল্‌ ভিতরে ঢুকলেই চুল্লির দরজা বন্ধ করে তাকে রোস্ট করে ফেলবে। কিন্তু গ্রেট্‌ল্‌ মতলবখানা বুঝে ফেলল। বুঝে ফেলে বললে—কী করে চুল্লির ভিতরে ঢুকতে হয় তা তো আমি জানি না!

ডাইনি খেঁকিয়ে উঠল—গর্দভ কোথাকার! কত বড় দরজাটা—ওর ভিতর দিয়ে আমিই ঢুকে যাব, তো তুই! এই দেখ্‌!

এই বলে গুঁড়ি মেরে উঠে ডাইনি বুড়ি তার মাথাটা চুল্লির মধ্যে সেঁধিয়ে দিলে। দিতেই গ্রেট্‌ল্‌ পিছন থেকে মারল এক ধাক্কা। ধাক্কার চোটে বুড়ির সমস্ত দেহটাই ঢুকে গেল চুল্লির ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেট্‌ল্‌ দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিলে।

ভিতর থেকে ডাইনি বুড়ির চিৎকার শোনা যেতে লাগল। কিন্তু গ্রেট্‌ল্‌ সেদিকে কান না দিয়ে ছুটে পালালো। বুড়ি মরল পুড়ে।

গ্রেট্‌ল্‌ যত জোরে পারে ছুটল আস্তাবলের কাছে। দরজা খুলে চেঁচিয়ে ডাকল—হানস্‌ল্‌, আমরা বেঁচে গেছি! ডাইনি বুড়ি পুড়ে মরেছে!

দরজা খুলতেই পাখির মতো বেরিয়ে এল হানস্‌ল্‌ খাঁচা-বাড়ি থেকে এক লাফে। খুশির চোটে দু-জনে দু-জনকে জড়িয়ে ধরে নাচতে লাগল।

আর যখন ভয় রইল না; তারা দু-জনে ঢুকল ডাইনির বাড়িতে। বাড়ির প্রত্যেক কোণে মুক্তো আর জহরতে ভরা সিন্দুক।

হানস্‌ল্‌ পকেট ভরে সেগুলো নিতে নিতে বললে—নুড়ির চেয়ে এগুলো ভাল।

গ্রেট্‌ল্‌ বললে—আমিও দু-মুঠো বাড়িতে নিয়ে যাব। বলে সে তার আঁচল ভরে ফেললে।

হানস্‌ল্‌ বললে—আর দেরি নয়। এখনই আমাদের এই মায়া-বন থেকে বেরিয়ে পড়তে হয়।

কিছুদূর যেতেই তারা প্রকাণ্ড এক হ্রদের ধারে এসে পৌঁছল।

হানস্‌ল্‌ বললে—এ জলাশয় পার হয়ে যাওয়া অসম্ভব। সাঁকো নেই, টপ্‌কে টপ্‌কে যাবার মতো পাথরও নেই।

গ্রেট্‌ল্‌ বললে—নৌকোও তো নেই। কিন্তু ঐ যে একটি হাঁস সাঁতার কাটছে। ওকে বললে হয়ত পার করে দেবে।

এই বলে গ্রেট্‌ল্‌ ডাকল—

প্যাঁক-পাক হাঁসমনি আয় আয় আয়
গ্রেট্‌ল্‌ ও হানস্‌ল্‌ ডাকিছে তোমায়।
নাই সাঁকো নাই পথ জলের উপরে।
পিঠে নিয়ে আমাদের দাও পার করে।

হাঁসটি সাঁতার কাটতে কাটতে তাদের কাছে চলে এল। হানস্‌ল্‌ বসল হাঁসের পিঠে আর বোনকে বসতে বলল তাঁর হাঁটুর উপর।

গ্রেট্‌ল্‌ বললে—না। তাহলে হাঁসের পক্ষে বেজায় ভারি হবে! বরঞ্চ একজন একজন করে পার হই।

হাঁসটি বড় ভাল। ভাইবোনকে একে-একে হ্রদ পার করে দিলে। ওপারে গিয়ে খানিকটা হাঁটতেই তাদের মনে হল বনটা চেনা-চেনা হয়ে আসছে। তারপর কিছু দূরেই চোখে পড়ল তাদের বাবার কুটিরটি। ছুটতে ছুটতে গিয়ে তারা এক দৌড়ে ঘরে ঢুকেই বাপের গলা জড়িয়ে ধরল। ছেলেমেয়েদের বনে ছেড়ে আসার পর থেকে কাঠুরের এক মুহূর্তও সুখে কাটেনি। আর এরই মধ্যে তার বৌ-ও মারা গেছে।

গ্রেট্‌ল্‌ তাঁর আঁচল ঝেড়ে যত মুক্তো যত জহরত সব মেঝেতে ছড়িয়ে দিলে। হানস্‌ল্‌ও তার পকেট থেকে মুঠো-মুঠো হিরে মুক্তো ঢেলে দিলে তার উপর।

এরপর তাদের দুঃখ ঘুচে গেল আর সকলে মিলে স্বচ্ছন্দে দিন কাটাতে লাগল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন