পাঁশমনি

এক ছিলেন ধনী পুরুষ। তাঁর স্ত্রী একবার খুব অসুখে পড়লেন। অসুখে পড়ে তিনি যখন বুঝলেন তাঁর সময় হয়ে এসেছে, তিনি তাঁর একমাত্র মেয়েকে বিছানার পাশে ডেকে বললেন— দেখ মা, সব সময় সৎপথে থেকো। তাহলে ভগবান সদাই তোমায় সাহায্য করবেন আর আমিও স্বর্গ থেকে তোমার দিকে চোখ রাখব।

এই বলে তিনি শেষ নিশ্বাস ফেলে চোখ বুজলেন। মেয়েটি প্রতিদিন তার মায়ের কবরের কাছে গিয়ে চোখের জল ফেলত। সব সময় সে সৎ পথে থাকত। যখন শীতকাল এল, কবরটি সাদা বরফের চাদরে ঢাকা পড়ে গেল। তারপর বসন্তের হাওয়ায় যখন বরফ গলে গিয়ে কবরের পাথর আবার বেরিয়ে পড়ল তখন সেই ধনী আবার একটি বিয়ে করলেন। নতুন বৌ তাঁর সঙ্গে করে দুটি মেয়ে নিয়ে এলেন ; তারা দেখতে শুনতে বেশ ভালো কিন্তু মন যেমন ময়লা তেমনি কুৎসিত।

তার পর থেকেই সৎ মেয়েটির সময় বড় খারাপ পড়ল।

মেয়ে দুটি বললে— এঃ, এ মেয়েটা কি আমাদের সঙ্গে এক ঘরে বসবে নাকি? খেতে গেলে খেটে খেতে হয়, বুঝলি? যা, রান্নাঘরে গিয়ে ঝিয়ের পাশে বস্‌গা!

তারা মেয়েটির গা থেকে সুন্দর জামা কাপড় খুলে নিল। তাকে পুরোনো একখানা ছাই রং-এর জামা পরতে দিল তার জুতোর বদলে দিল কাঠের খড়ম।

—দেখ দেখ রাজকন্যার সাজ দেখ এইবার! এই বলে তারা হাসতে হাসতে মেয়েটিকে রান্নাঘরে পৌঁছে দিয়ে এল।

রান্নাঘরে গিয়ে মেয়েটির খাটুনি আর শেষ রইল না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাড়ভাঙা খাটুনি। সূর্য উঠতে না উঠতে ঘুম থেকে ওঠা, জল তোলা, আগুন ধরানো, রান্না করা, ধোয়া মোছা। শুধু কি এই? তার বোনেরা যত রকমে পারে তাকে কষ্ট দিতে থাকল। ডাল আর মটরশুঁটি নিয়ে ছাইয়ের মধ্যে ফেলে দিত যাতে করে বেচারাকে ছাই থেকে খুঁটে খুঁটে প্রতিটি মটরশুঁটি আর ডাল বেছে বার করতে হয়। সারাদিনের খাটুনির পর রাত্রে যখন তার শরীর ভেঙে পড়ত তখন সে শোবার কোনো বিছানা পেত না। পোড়া কাঠের ছাইয়ের মধ্যে শুয়ে পড়ত। তার গা-ময় ধুলো আর ছাই লেগে থাকত আর সেইজন্যে বোনেরা তাকে বলত পাঁশমনি।

একদিন হল কি, তাদের বাবা মেলায় যাবেন বলে স্থির করলেন। তিনি তাঁর সৎ মেয়ে দুটিকে জিজ্ঞেস করলেন মেলা থেকে তাদের জন্যে কী আনবেন।

একজন বললে— দামি কাপড়।

আর-একজন বললে— মুক্তো আর জহরত।

—আর পাঁচমনি, তুমি? তোমার কী চাই?

—আপনি যখন বাড়ি ফিরবেন বাবা, তখন আপনার টুপির গায়ে প্রথম যে গাছের ডাল লাগবে সেটি ভেঙে আনবেন।

দুই সৎ মেয়ের জন্যে তিনি সুন্দর সুন্দর পোশাক মুক্তো আর হীরে নিয়ে ফিরলেন। আর ফেরবার পথে ঘোড়ার পিঠে যখন তিনি একটি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন হেজেল বাদামের একটি শাখা লেগে তাঁর টুপিটা পড়ে গেল। তিনি ঘোড়া থামিয়ে সেই হেজেল বাদামের ডালটা ভেঙে নিয়ে চললেন।

বাড়ি পৌঁছে তিনি সৎ-মেয়ে দুটি যা চেয়েছিল তাদের তাই দিলেন আর পাঁশমনিকে দিলেন সেই হেজেল গাছের ডাল।

পাঁশমনি বাবাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মায়ের কবরের কাছে গেল। সেখানে সেই ডালটা গুঁজে দিলে। তারপর এত কাঁদল যে তার চোখের জলে মাটি ভিজে গেল আর সেই ভিজে মাটির মধ্যে হেজেল শাখায় শিকড় গজালো। সেই ছোট্ট শাখা থেকে তার মায়ের কবরের উপর সুন্দর একটি হেজেল গাছের সৃষ্টি হল।

পাঁশমনি রোজ তিনবার করে কবরের কাছে যেত। সেখানে গিয়ে সে কাঁদত আর প্রার্থনা জানাতো। যেই পাঁশমনি সেখানে যেত অমনি কোথা থেকে একটি ছোট্ট সাদা পাখি এসে বসত গাছের উপর। আর যখনই পাঁশমনি কিছু চাইত, সেই পাখি গাছের উপর থেকে সেই জিনিসটি নিচে ফেলে দিত।

একবার হল কি, রাজা ঘোষণা করে দিলেন, তিন দিন ধরে এক মস্ত উৎসব হবে, তাতে দেশের যত সুন্দরী মেয়ে আছে সবার আসা চাই। রাজপুত্র তাদের মধ্যে থেকে নিজের বৌ বেছে নেবেন।

সৎ-বোন দুজন যখন শুনল রাজবাড়িতে তাদেরও নিমন্ত্রণ হয়েছে, তারা আনন্দে নেচে উঠল।

তারা পাঁশমনিকে ডেকে বললে— আমরা রাজবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছিল। আমাদের চুল আঁচড়িয়ে দে। জুতো পালিশ করে দে। ফিতে বেঁধে দে

পাঁশমনি হুকুম তামিল করল। চুল আঁচড়ে দিলে, জুতো পালিশ করে দিলে, ফিতে বেঁধে দিলে। তারপর সে কাঁদতে লাগল। তার ইচ্ছে ওদের সঙ্গে সেও রাজবাড়িতে যায়। সৎমার কাছে গিয়ে অনুমতি চাইতে সৎমা বললেন— তুমি যাবে পাঁশমনি! সারা গা তোমার ধুলো আর ছাইয়ে ভর্তি—তুমি যাবে রাজবাড়ির উৎসবে? তোমার না আছে পোশাক না আছে জুতো— তুমি যেতে চাও রাজবাড়িতে নাচের আসরে?

কিন্তু পাঁশমনি নাছোড়বান্দা। শেষে সৎমা রেগে বললেন— এই নাও একথালা ডাল দিলুম— বাছো বসে। দু-ঘন্টার মধ্যে যদি সমস্ত ডাল বেছে রাখতে পারো তো তোমায় যেতে দেব। এই বলে সেই এক থালা ডাল ছাইয়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে চলে গেলেন।

মেয়েটি খিড়কির দরজা দিয়ে বাগানে গিয়ে ডাকল— পায়রামনি, ঘুঘুমনি, আকাশের যত পাখি এস, তোমরা আমায় বাঁচাও—

ভালোগুলি খুঁটে খুঁটে দাও মোর থালে

খারাপ রহিবে যাহা রেখো নিজ গলে।

অমনি দুটি সাদা পায়রা রান্নাঘরের জানলা দিয়ে উড়ে এল, তাদের পিছনে ঘুঘুরা আর আকাশের যত ছোট ছোট পাখি। তারা বসে গেল সবাই পাঁশ-গাদার উপর। পায়রাদুটি ঘাড় নেড়ে শুধু একবার দেখিয়ে দিলে— খোঁট খোঁট খোঁট, আর অমনি সবাই খুঁটে তুলতে লাগল। যত ডাল ছিল তার ভাললাগুলি বেছে বেছে থালায় জমা করতে লাগল। এক ঘণ্টাও লাগল না, কাজ শেষ করে তারা উড়ে চলে গেল।

মেয়েটি তার সৎমার কাছে থালা নিয়ে গেল। সে ভাবলে এইবার সৎমা নিশ্চয় তাকে তাঁদের সঙ্গে রাজবাড়ির ভোজে নিয়ে যাবেন।

কিন্তু সৎমা বললেন— না পাঁশমনি, তোমার কোন কাপড়-চোপড় নেই। নাচতেও জানো না। লোকে তোমায় দেখে হাসবে।

মেয়েটি শুনে যখন কাঁদতে আরম্ভ করল তখন সংমা বললেন— তুমি যদি এক ঘণ্টার মধ্যে দু-থালা ডাল বেছে দিতে পারো তাহলে তোমাকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি। তিনি মনে মনে ভাবলেন—এ আর করতে হয় না!

সৎমা যখন দু-থালা ভর্তি ডাল ছাইয়ের গাদায় ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন মেয়েটি খিড়কির দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে ডাকল— পায়রামনি, ঘুঘুমনি, আকাশের যত পাখি এস তোমরা, আমায় বাঁচাও!

ভালোগুলি খুঁটে খুঁটে দাও মোর থালে

খারাপ রহিবে যাহা রেখে নিজ গলে।

দুটি সাদা পায়রা রান্নাঘরের জানলা দিয়ে ভিতরে ঢুকল, তাদের পিছনে ঘুঘুরা আর আকাশের যত ছোট ছোট পাখি। একঘণ্টা শেষ হবার আগেই সমস্ত ডাল বেছে দিয়ে তারা উড়ে চলে গেল।

এইবার সৎমা তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন, এই ভাবতে ভাবতে মেয়েটি থালা-ভর্তি বাছা ডাল নিয়ে সমার কাছে গেল।

কিন্তু তিনি বললেন— না না, তা কখনো হয়? তোমার না আছে কাপড়-চোপড়, না জানো তুমি নাচতে। আমাদেরই লজ্জা করবে তোমার সঙ্গে যেতে।।

এই বলে তিনি তাঁর দুই অহঙ্কারী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে চলে গেলেন।

সবাই যখন চলে গেল, পাঁশমনি তখন তার মায়ের কবরের কাছে হেজেল গাছের তলায় গিয়ে কেঁদে বললে—

সোনামনি গাছ মোর, ডালে দাও ঝাঁকি,

সোনা রুপো দিয়ে আজ দাও মোরে ঢাকি।

বলতেই পাখিটি সোনার কাজ করা রুপোর কাজ করা সুন্দর পোশাক আর রেশম আর জরির নক্সা করা একজোড়া জুতো ফেলে দিল। আর দেরি না করে তাড়তাড়ি পোশাক পরে জুতো পরে পাঁশমনি রাজবাড়িতে ছুটল। তার সৎমা সৎ বোনেরা তাকে চিনতে পারলে না। সোনার পোশাকে তাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল যে তারা ভাবলে সে বুঝি কোনো বিদেশী রাজকন্যা। পাঁশমনির কথা তারা একবার মনেও করল না। তারা জানত ধুলো আর ময়লার মধ্যে বাড়িতেই সে বসে বসে তখনও পাঁশগাদা থেকে ডাল খুঁটে খুঁটে বাছছে।

রাজপুত্র বিদেশী রাজকন্যার কাছে এগিয়ে এসে তার হাত ধরলেন। তারপর হাত ধরে তার সঙ্গে নাচতে লাগলেন। তিনি তার সঙ্গে ছাড়া আর কারো সঙ্গে নাচলেনই না, তার হাতও ছাড়লেন না। অন্য কেউ এসে মেয়েটির সঙ্গে নাচতে চাইতেই রাজপুত্র বললেন— না, এ আজকে আমারই সঙ্গী।

সারারাত নাচ চলল। যখন ভোর হয়-হয় তখন মেয়েটি বললে— এবার আমি বাড়ি যাব। রাজপুত্র বললেন— চল তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি। রাজপুত্র ভাবলেন, দেখে আসি, মেয়েটি কোন্ বাড়িতে থাকে। বাড়ির কাছে এসে মেয়েটি রাজপুত্রের হাত ছাড়িয়ে পায়রার যে ঘর তাইতে লাফিয়ে উঠে কোথায় যে মিলিয়ে গেল আর দেখতে পাওয়া গেল না।

রাজপুত্র দাঁড়িয়ে রইলেন। মেয়েটির বাবা উৎসব থেকে ফিরে আসতে রাজপুত্র তাঁকে বললেন যে বিদেশী মেয়েটি তার বাড়ির পায়রার ঘরের মধ্যে মিলিয়ে গেছে।

বুড়ো ভাবলেন— পাঁশমনি নাকি? একটা মস্ত কুড়ুল এনে তিনি পায়রার ঘরটাকে ফেঁড়ে ফেললেন। কিন্তু দেখা গেল তার মধ্যে কেউ নেই।

বাড়ির ভিতরে ঢুকে তিনি দেখলেন পাঁশমনি তার ময়লা কাপড়ে ছাইয়ের মধ্যে পড়ে ঘুমোচ্ছে আর চুঙির উপর মিট-মিট করে জ্বলছে একটা তেলের আলো। পাঁশমনি আসলে পায়রার ঘর থেকে লাফিয়ে চুপি-চুপি হেজেল গাছের তলায় গিয়েছিল। তার সুন্দর পোশাক খুলে মায়ের কবরের উপর রেখে দিয়েছিল। পাখি নিয়ে চলে গিয়েছিল সেই পোশাক। তারপর তার পুরোনো ছাই রঙের জামা পরে পাঁশমনি ছাইয়ের মধ্যে শুয়ে পড়েছিল।

দ্বিতীয় দিন যখন আবার রাজবাড়িতে উৎসব শুরু হল আর পাঁশমনির বাবা সৎমা আর সৎ বোনেরা তাকে ফেলে চলে গেল, সে আবার হেজেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বললে—

সোনামনি গাছ মোর ডালে দাও ঝাঁকি,
সোনা রুপো দিয়ে আজ দাও মোরে ঢাকি।

অমনি পাখিটি আগের দিনের চেয়ে আরো জমকালো পোশাক ফেলে দিলে। আর মেয়েটি সেদিন যখন সেই পোশাক পরে উৎসবের সভায় হাজির হল তার রূপ দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল।

রাজপুত্র তারই জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। সে আসতেই তার হাত ধরে তাকে নাচতে নিয়ে গেলেন। মেয়েটি রাজপুত্র ছাড়া আর কারো সঙ্গে নাচল না। কেউ এসে মেয়েটিকে তার সঙ্গে নাচতে বললেই রাজপুত্র বললেন— না, ও আজকে আমারই সঙ্গী।

রাত শেষ হয়ে এলে মেয়েটি যেতে চাইল। রাজপুত্র তার সঙ্গে চললেন কোন্‌ বাড়িতে সে যায় দেখবার জন্যে। কিন্তু বাড়ির কাছে এসেই মেয়েটি লাফিয়ে বাগানে ঢুকে পড়ল। সেখানে ছিল পাকা নাসপাতি ভরা মস্ত এক নাসপাতি গাছ। মেয়েটি টপ্‌ করে সেই গাছে উঠে পড়ল যেন কাঠবেড়ালির মত, তারপর আর তাঁকে দেখা গেল না।

রাজপুত্র দাঁড়িয়ে রইলেন। মেয়েটির বাবা ফিরতে তাকে বললেন— অজানা মেয়েটি আমার হাত ছাড়িয়ে আপনার নাসপাতি গাছের উপরে উঠে মিলিয়ে গেছে।

বুড়ো ভাবলেন— পাঁশমনি নাকি? তিনি একখানা কুড়ুল আনিয়ে গাছটাকে কাটিয়ে ফেললেন, কিন্তু গাছে কাউকে দেখতে পাওয়া গেল না। বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখা গেল পাঁশগাদার মধ্যে পাঁশমনি অন্যদিনেরই মতো শুয়ে রয়েছে। আসলে সে গাছ থেকে চুপি-চুপি নেমে পড়ে হেজেল গাছের পাখিকে তার পোশাক ফেরত দিয়ে তার ছাই রঙের জামা পরে শুয়ে পড়েছিল।

তৃতীয় দিন যখন তার বাবা মা আর বোনেরা চলে গেলেন, পাঁশমনি আবার তার মায়ের কবরের কাছে গিয়ে বললে—

সোনামনি গাছ মোর ডালে দাও ঝাঁকি,
সোনা রুপো দিয়ে আজ দাও মোরে ঢাকি।

অমনি পাখি এমন এক পোশাক উপর থেকে ফেলে দিল যে অমনটি কেউ কোনো দিন চোখে দেখেনি। জুতোজোড়ার সমস্তটাই খাঁটি সোনার। এইসব পরে মেয়েটি যখন উৎসব-সভায় হাজির হল সকলে নির্বাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। রাজপুত্র শুধু তার সঙ্গেই নাচলেন। আর কেউ নাচতে চাইলে বললেন— না, ও আজকে আমারই সঙ্গী।

রাত্রিশেষে মেয়েটি যখন ফিরতে চাইল রাজপুত্র আগের রাতের মত আজও চাইলেন তার সঙ্গে যেতে কিন্তু মেয়েটি এত জোরে ছুটল যে রাজপুত্র তার সঙ্গে পা রেখে চলতে পারলেন না। রাজপুত্র আগে থেকেই একটা ফন্দি করে রেখেছিলেন। রাজপ্রাসাদের সিঁড়িতে তিনি মোম জমিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। তার ফলে মেয়েটি যেই ছুটে নামতে যাবে অমনি তার বাঁ পায়ের জুতোটি সেই মোমের মধ্যে আটকে গেল। রাজপুত্র সেটি তুলে নিলেন। দেখলেন ছোট্ট সুন্দর একটি জুতো—আগাগোড়া সোনার তৈরি।

পরদিন সকালে তিনি সেটি নিয়ে পাঁশমনির বাবার কাছে হাজির হলেন। বললেন— এই সোনার জুতো যার পায়ে বসবে সেই আমার বৌ হবে, আর কেউ নয়।

শুনে দুই সৎবোন খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল, কারণ দুজনেরই ছিল সুন্দর পা। বড় মেয়ে জুতো নিয়ে ঘরে গেল পরবে বলে, মা পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। দেখা গেল তার পায়ের বুড়ো আঙুল এত বড় যে পা জুতোয় ঢোকে না।

তার মা তার হাতে একটা ছুরি দিয়ে বললেন— বুড়ো আঙুল কেটে ফেল। রানী হলে তোমায় আর হাঁটতেই হবে না।

মেয়েটি বুড়ো আঙুল কেটে জোর করে জুতোর মধ্যে পা ঢুকিয়ে মুখ টিপে ব্যথা সহ্য করে রাজপুত্রের সামনে এসে হাজির হল। রাজপুত্র তাকে ঘোড়ায় তুলে বিয়ে করতে নিয়ে গেলেন।

পথে পড়ল পাঁশমনির মায়ের কবর। সেখানে হেজেল গাছের ডালে দুটি পায়রা বসে ছিল। তারা বলে উঠল—

পিছু ফিরে দেখ কুমার পিছু ফিরে চাও,
রক্ত ঝরে পথ পরে দেখিতে না পাও?
জুতাটি যেমন ছোট।
পা হবে তেমনই ছোট।
সে হল তোমার বৌ, তারে নিয়ে যাও!

রাজপুত্র মেয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, টপ্‌-টপ্‌ করে রক্ত পড়ছে। কাজেই তিনি ঘোড়া ফিরিয়ে নকল বৌকে বাড়ি নিয়ে এসে বললেন— এ মেয়ে সে মেয়ে নয়।

তখন মেজ বোনের জুতো পরবার পালা। সে ঘরে জুতো নিয়ে এল পরতে। কোন রকমে আঙুলগুলো তো ঢুকল কিন্তু গোড়ালি আর ঢোকে না।

তার মা তার হাতে একটা ছুরি দিয়ে বললেন— গোড়ালির খানিকটা কেটে ফেল। রানী হলে তোমায় আর হাঁটতে হবে না।

মেয়েটি গোড়ালি থেকে এক চাকলা মাংস কেটে জোর করে জুতোর মধ্যে পা ঢুকিয়ে দিলে আর মুখ টিপে ব্যথা সহ্য করে রাজপুত্রের সামনে হাজির হল। রাজপুত্র তাকে নিজের ঘোড়ায় বসিয়ে বিয়ে করতে নিয়ে গেলেন। কবরের কাছে যখন তাঁরা এসে পৌঁছলেন তখন হেজেল গাছের সেই পায়রা দুটি বলে উঠল—

পিছু ফিরে দেখ কুমার পিছু ফিরে চাও,
রক্ত ঝরে পথ পরে দেখিতে না পাও?
জুতাটি যেমন ছোট
পা হবে তেমনই ছোট
সে হল তোমার বৌ, তারে নিয়ে যাও!

রাজপুত্র তার পায়ের দিকে তাকাতেই দেখলেন রক্তের ধারা বইছে, মোজাতেও রক্তের ছোপ। তখন তিনি ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নকল বৌকি তার বাড়িতে নিয়ে এলেন। বললেন— এ মেয়েও সে মেয়ে নয়। আর কি তোমার কোনো মেয়ে নেই?

বুড়ো জবাব দিলেন— না। শুধু আমার আগের পক্ষের স্ত্রীর একটি মেয়ে আছে— সে একটা খুদে পোকা। ঝিয়ের কাজ করে। সে রাজার বৌ হতে পারে না।

রাজপুত্র বললেন— তাকে ডেকে পাঠাও।

সৎ মা বললেন— না না, রাজকুমার। সে অসম্ভব নোংরা মেয়ে। তাকে মানুষের সামনেই আনা যায় না।

কিন্তু রাজপুত্র নড়বার পাত্র নন। তাঁর হুকুম অটল। কাজেই পাঁশমনিকে ডেকে পাঠাতে হল।

পাঁশমনি হাতমুখ ধুয়ে রাজপুত্রের সামনে এসে নিচু হয়ে তাঁকে অভিবাদন করল। রাজপুত্র তার হাতে সোনার জুতোটি দিলেন। মেয়েটি তক্তার উপর বসে তার পা থেকে কাঠের খড়ম খুলে ফেলে জুতোটা পরল। পরতেই চমৎকার কাপে কাপে মিলে গেল। মেয়েটি উঠে দাঁড়াতে রাজপুত্র যখন তার মুখের দিকে তাকালেন তখনই যে সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে তিনি নেচেছেন তাকে চিনলেন আর বললেন— এ-ই আসল বৌ!

সৎ মা আর সৎ বোনেরা হতাশ হয়ে গেল। রাগে তাদের মুখ হয়ে গেল সাদা। রাজপুত্র পাঁশমনিকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে চলে গেলেন।

যখন তাঁরা হেজেল গাছের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, দুটি পায়রা গেয়ে উঠল—

পিছু ফিরে দেখ কুমার পিছু ফিরে চাও
রক্ত ঝরে না আর, দেখেছ কি তাও?
জুতাটি যেমন ছোট
পা হল তেমনই ছোট
সে হল তোমার বৌ, তারেই নিয়ে যাও।

এই গান গেয়ে তারা দুটিতে উড়ে এসে পাঁশমনির দু’ কাঁধে বসল ; একটি ডান কাঁধে আর একটি বাঁ কাঁধে।

যখন বিয়ে শুরু হবে সেই সময় দুই দুষ্টু বোন রানীর অনুগ্রহ পাবার জন্যে আর তার ধনে ভাগ বসাবার আশায় তাড়াতাড়ি ছুটে এল। বিয়ের বর কনে যখন গীর্জেয় ঢুকবে কনের ডান পাশে দাঁড়ালো বড় বোন, কনের বাঁ পাশে দাঁড়ালো মেজ বোন। পায়রা দুটি অমনি দু-বোনের একটি করে চোখ খুবলে তুলে নিলে।

তারপর যখন গির্জে থেকে বেরোচ্ছে তখন বড় বোন বাঁ পাশে দাঁড়ালো, মেজ বোন ডান পাশে। অমনি পায়রা দুটি বোনেদের আর একটি করে যে চোখ ছিল তাও খুবলে তুলে নিলে। তাদের দুষ্টুমি আর কপটতার জন্যে তাদের দু’ চোখই কানা হয়ে গেল। সারা জীবন তারা ঐ পাপ ভোগ করলে।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন