গাধা

এক ছিলেন রাজা আর রানী—তাঁদের ছিল প্রচুর ধনসম্পদ, কিন্তু কোনো সন্তান ছিল না। দিনে রাতে রানী এই নিয়ে দুঃখ করতেন আর বলতেন—আমি হচ্ছি অফলা জমির মতো, যাতে কিছুই হয় না। অবশেষে ভগবান তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করলেন। কিন্তু রানীর যখন সন্তান হল তখন দেখা গেল তার চেহারা মানুষের মতো নয়—হয়েছে গাধার মতো। তারপর যখন তার গলা দিয়ে চিৎকার আর শব্দ বেরতে লাগল তখন রানী বললেন—গাধা হওয়ার চেয়ে তাঁর যদি কোনো সন্তানই না হত তাহলেই তিনি খুশী হতেন। একে নদীতে ফেলে দেওয়া হোক। মাছেরা খেয়ে ফেলুক।

কিন্তু রাজা বললেন—না। ঠাকুর যখন দিয়েছেন, একেই আমি ছেলে বলে গ্রহণ করব। আমার মৃত্যুর পর এই আমার সিংহাসনে বসবে— রাজমুকুট পরবে।

গাধা সব রকম যত্ন পেতে থাকল, বড় হতে লাগল। তার কান দুটো গাধার মতোই চমৎকার ভাবে লম্বা খাড়া হয়ে বেড়ে উঠল। গাধা ছিল ভারি আমুদে—লাফালাফি করত, খেলা করে বেড়াত আর তার ছিল গান-বাজনায় মন। একদিন সে এক বিখ্যাত বাদকের কাছে গিয়ে বলল—আপনি যা জানেন আমায় শেখান। আপনার মতো বীণা বাজাতে আমি শিখতে চাই।

বাদক বললেন—তাই তো রাজপুত্র, এ বড়ই শক্ত কাজ। তোমার আঙুল শুনি তো বীণা বাজাবার উপযুক্ত নয়—বেজায় বড় বড়। বীণার তার যে ছিড়ে যাবে।

কিন্তু কোনো ছুতোই রাজপুত্র কানে নিলে না। গাধা বীণা বাজাবেই। তার ছিল প্রচুর উৎসাহ, অধ্যবসায়, ধৈর্য। তারই বলে সে শেষ পর্যন্ত প্রায় গুরুরই মতো ওস্তাদ বীণাবাদক হয়ে উঠলো।

রাজপুত্র একদিন বেড়াতে বেড়াতে এক ঝর্ণার উৎসের কাছে এসে হাজির। সেখানকার পরিষ্কার কাঁচের মত জলে তার মুখের ছাপ পড়ল। রাজপুত্র দেখল গাধার মুখ। তাই দেখে মনের দুঃখে সে বেরিয়ে পড়ল দুনিয়া টহল দিতে—সঙ্গে নিল শুধু একজন বিশ্বস্ত অনুচর। চলতে চলতে তারা অবশেষে এক রাজ্যে এসে পৌঁছল—সেখানে এক বুড়ো রাজা আর তাঁর আশ্চর্য সুন্দরী এক কন্যা।

গাধা বলল—এইখানেই আমরা থাকব। বলে রাজধানীতে ঢোকবার দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। চেঁচিয়ে বলল—বাইরে অতিথি। দরজা খুলুন, আমরা ভিতরে ঢুকতে চাই।

কিন্তু দরজা খুললো না। গাধা তখন বসে তার সামনের দু-পা দিয়ে তার বীণা বাজাতে বসল। বীণার তার এত মধুর ভাবে বেজে উঠল যে দ্বারপাল আর থাকতে না পেরে উঁকি মেরে দেখল ব্যাপারখানা কি। ব্যাপার দেখে তার চক্ষুস্থির! ছুটলো রাজার কাছে খবর দিতে। বলল—শহরের ফটকে এক গাধা বসে বীণা বাজাচ্ছে, এমন তার হাত যে মনে হয় যেন মস্ত বড় ওস্তাদ বাজনদার!

রাজা বললেন—তাহলে বাজনদারকে ভিতরে নিয়ে এস।

বাজনদার আসছে শুনে ভিড় হয়েছিল। কিন্তু যখন সবাই দেখল গাধা তখন একটা হাসির রোল পড়ে গেল।

ঠিক হল গাধা রাজবাড়ির চাকরদের সঙ্গে বসে খাবে। কিন্তু গাধা তাতে গররাজি। সে বলল—আমি কি আস্তাবলের গাধা না কি? আমি রাজবংশীয়।

তখন তাকে বলা হল—বেশ তবে তুমি সৈনিকদের সঙ্গে বস।

গাধা বললে—না, আমি রাজার পাশে বসব।

শুনে রাজা হাসলেন। তাঁর মজা লাগল, বললেন—বেশ গাধা, তোমার ইচ্ছা মতোই হোক। এসো এদিকে।

তারপর তিনি বললেন—আচ্ছা গাধামনি, আমার কন্যাকে তোমার কেমন লাগে?

গাধা রাজকন্যার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাঁকে ভালো করে দেখে নিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল—আমার ভারি পছন্দ। এত সুন্দরী মেয়ে আমি কোথাও দেখিনি।

রাজা বললেন—বেশ, তবে তুমি রাজকন্যারই পাশে বসবে।

গাধা বললে—তাই তো আমি চাই।

বলে রাজকন্যার পাশে গিয়ে বসল।

তারপর খাওয়া-দাওয়া শুরু হল। সবাই দেখল আশ্চর্য নিপুণতার সঙ্গে গাধা খাওয়া-দাওয়া কথাবার্তা চালাচ্ছে।

রাজবংশীয় অতিথি এইভাবে রাজপ্রাসাদে রয়ে গেলেন। কিছুদিন থাকার পর গাধা ভাবল—এখানে আর থেকে লাভ কি? বাড়ি তো ফিরে যেতেই হবে একদিন—তাই যাই।

সে ঘাড় নীচু করে রাজার কাছে গিয়ে বললে—মহারাজ, এবার আমায় বিদায় দিন।

কিন্তু এদিকে গাধাকে রাজার ভারি পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। তাকে ছেড়ে দিতে তাঁর মন সরল না। তিনি বললেন—গাধামনি, তোমার কিসের দুঃখ? তোমার মুখ অমন হাঁড়ি হয়ে গেছে কেন? বল তুমি কি চাও—তাই দেব। সোনা চাও?

গাধা ঘাড় নেড়ে বললে—না।

—হীরে জহরত, ভালো ভালো পোশাক?

—না।

—অর্ধেক রাজত্ব?

—না।

—তবে কি যে চাও তা তো বুঝতে পারছি না। কি পেলে খুশী হও জানলে ভালো হত। আমার সুন্দরী কন্যাকে বিয়ে কতে চাও?

—হাঁ, ওইটিই আমার মনের ইচ্ছে।

বলেই গাধার মুখে হাসি ফুটে উঠল।

শুনে রাজার ভারি মজা লাগল। তিনি বললেন—বেশ তাই হোক।

জাঁকজমক করে বিয়ে হয়ে গেল।

রাত্রিবেলা বর-কনেকে যখন বাসর ঘরে নিয়ে যাওয়া হল, তখন গাধা যাতে কোনোরকম গাধামী না করে এই উদ্দেশ্যে রাজা তাঁর একজন অনুচরকে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে বললেন।

বর কনে দুজনে বাসর ঘরে ঢুকলে বর দরজায় খিল দিয়ে দিলেন। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে যখন বুঝলেন তাঁরা একা তখন এক ঝটকায় তাঁর গাধার চামড়া খুলে ফেলে দিলেন। অমনি ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক অপরূপ সুন্দর রাজপুত্র।

রাজপুত্র বললেন—এইবার বুঝলে তো আমি কে? তোমার উপযুক্ত কি না বল।

রাজকন্যা ভারি খুশী। বাসরঘরে দুজনের রাত কাটল।

সকাল হতেই রাজপুত্র লাফিয়ে উঠে গাধার চামড়া গায়ে জড়িয়ে নিলেন। কার সাধ্য বোঝে যে ভিতরে কি আছে বা কে আছে!

রাজা এলেন। এসে বললেন—গাধা খুশী তো?

বলে কন্যার দিকে ফিরে বললেন—তোমার নিশ্চয় মন খারাপ? এমন বর জুটলে কারই বা না মন খারাপ হয়?

রাজকন্যা উত্তরে বললো—বাবা, আমাকে যদি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বর এনে দিতে তাহলেও তাকে আমি আমার এই স্বামীর মতো ভালবাসতুম না। সারাজীবনে আর কাউকে আমি চাইব না।

শুনে রাজা অবাক হলেন। কিন্তু যে চাকর বাসর ঘরে লুকিয়ে ছিল সে এসে সব কথা রাজাকে বলে দিল।

রাজা শুনে বললেন—এ কখনও হতে পারে?

—তবে মহারাজ আপনি নিজেই দেখুন। আর শুনুন মহারাজ, যদি ওঁর গাধার চামড়াটা নিয়ে গিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে পারেন তাহলে আর কোনোদিনই উনি নিজেকে লুকোতে পারবেন না।

রাজা বললেন—বেশ কথা বলেছ।

বলে রাত্রে যখন বর কনে ঘুমিয়েছে রাজা গুপ্ত দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। চাঁদের আলোয় দেখেন রাজপুত্রের মতো চেহারার এক সুন্দর যুবাপুরুষ শুয়ে আছেন। মাটিতে পড়ে রয়েছে তার গায়ের চামড়া। রাজা সেই চামড়া তুলে নিয়ে গিয়ে বাগানে এক মস্ত আগুন করে তাতে নিক্ষেপ করলেন আর যতক্ষণ না তা পুড়ে ছাই হয়ে যায় ততক্ষণ নিজে দাঁড়িয়ে রইলেন।

রাজপুত্র প্রথম আলো ফোটবার সঙ্গে ঘুম ভেঙে উঠে যখন গায়ে গাধার চামড়া মুড়তে যাবেন, দেখেন চামড়া নেই।

ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন—তাহলে তো এবার আমার পালাতে হয়!

কিন্তু দরজার বাইরে বেরিয়েই দেখেন, দরজায় রাজা দাঁড়িয়ে।

রাজা বললেন—পুত্র, এত তাড়া কিসের? পালাচ্ছো কোথায়? কি আছে তোমার মনে? এমন সুন্দর ছেলে—আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে? তোমায় আমি অর্ধেক রাজত্ব ছেড়ে দিচ্ছি, আমার মৃত্যুর পর সবটাই পাবে।

রাজপুত্র বললেন—বেশ, তাহলে রইলুম। আশা করি ভালো দিয়ে যার আরম্ভ তার শেষটাও ভালো হবে।

রাজা তাঁর অর্ধেক রাজ্য তাকে দিলেন। এক বছর পরে রাজা স্বর্গে যেতে পুরো রাজ্যটাই সে পেল, তাছাড়া তার নিজের বাবার রাজ্যটাও বাবা মারা যেতে পেয়ে গেল।

দুই রাজ্য নিয়ে সে সুখে স্বচ্ছন্দে দিন কাটাতে লাগল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন