তিন রকমের ভাষা

সুইটজারল্যান্ডে থাকতেন এক বুড়ো জমিদার। তাঁর একমাত্র ছেলের বুদ্ধি-শুদ্ধি এতই কম ছিল যে সে কিছুই শেখতে পারত না।

একদিন তার বাবা তাকে বললেন—দেখ খোকা, তোমার জন্যে যা কিছু পারি আমি সব করেছি। কিন্তু যাই করি না কেন, তেমার মাথায় কিছুই থাকে না। আমি তোমাকে এক অতি দক্ষ মাস্টারের কাছে পাঠাতে চাই—তিনি তোমায় নিয়ে যা করবার করবেন।

তখন ছেলেটি অনেক দূরের এক শহরে গেল। সেখানে এক বছর রইল মাস্টারের কাছে। সময় হলে সে যখন বাড়ি ফিরল, তার বাবা বললেন—কী শিখে এলে খোকা বল তো?

ছেলে বললে—কুকুর যখন ঘেউ-ঘেউ করে, তখন সে কী বলছে তা বুঝতে শিখেছি আমি।

বাবা বললেন—তবে তো আমায় রাজা করেছ! এই শিখে এলে? যাও তাহলে আরেক জন মাস্টারের কাছে।

ছেলেটিকে আবার এক বছরের জন্যে একজন একনম্বর মাস্টারের কাছে রাখা হল।

ছেলে ফিরলে বাবা আবার তাকে একই প্রশ্ন কলেন।

ছেলেটি বললে—বাবা, আমি এখন পাখিদের ভাষা বুঝি।

বাবা রেগে আগুন হলেন। চেঁচিয়ে বললেন—হতভাগা ছেলে! এত অমূল্য সময় তোর পিছনে নষ্ট হল সে কি কিছুই না শেখার জন্যে? আমার সামনে এসে দাঁড়াতে তোর লজ্জা করছে না? যাই হোক আর একবার তোর জন্যে চেষ্টা করব। আর একজন মাস্টারের কাছে পাঠাবো। এখানেও যদি তোর কোন উন্নতি না হয় তাহলে তোকে আমি ত্যাজ্যপুত্তুর করব। তুই আর আমার ছেলে রইবি নে।

কাজেই ছেলেটি আর একজন মাস্টারের কাছে গেল আর এক বছরের জন্যে। সেখান থেকে ফিরলে তার বাবা যখন জিজ্ঞেস করলেন—কী শিখে এলে খোকা? খোকা বললে—এবারে বাবা আমি ব্যাঙের ডাক কী করে বুঝতে হয় শিখে এসেছি।

বাবা রাগে ফেটে পড়লেন। চিৎকার করে সারা বাড়িকে জড়ো করলেন সেখানে। তারপর বললেন—আজ থেকে এ আর আমার ছেলে নয়! এখানে আর ওর স্থান নেই। ওকে তোমরা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাও। যে খুশি ওর প্রাণ নাও গে।

চাকররা তাকে তাড়িয়ে দিল, কিন্তু মেরে ফেলতে তাদের মায়া করল। অক্ষত দেহেই ছেড়ে দিল তাকে। একটা হরিণ মেরে ফেলে তার চোখ আর জিভ কেটে বুড়ো জমিদারের কাছে পাঠিয়ে দিল যাতে তিনি বিশ্বাস করেন যে তাঁর ছেলেকে তাঁর হুকুম-মত হত্যা করা হয়েছে।

ছেলেটি মনের দুঃখে বাড়ি ছেড়ে যেদিকে দু-চোখ যায় ঘুরতে লাগল। শেষে রাস্তার ধারের এক সরাইখানায় পৌঁছে মালিককে জিজ্ঞেস করল—আমায় এক রাতের মত থাকতে দেবেন?

সরাইয়ের মালিক ছিলেন সেখানকার নগর-কর্তা, তিনি বললেন—নিশ্চয় দিতে পারি যদি তুমি রাত্রে ঐ পুরোনো বুরুজের মধ্যে থাকতে রাজি থাকো। কিন্তু তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি, জায়গাটা বুনো কুকুরে ভর্তি। তারা সব সময় চেঁচাচ্ছে, ঘেউ-ঘেউ করছে আর মানুষ ধরে ধরে খাচ্ছে। আশপাশের সবাই ঐ কুকুরদের ভয়ে তটস্থ। কেউই তাদের তাড়াতে পারে না।

ছেলেটি কিন্তু ভয় পাবার ছেলে নয়। সে বললে—আমি ঐ ঘেউ-ঘেউয়ানি কুকুরদের কাছেই যাব। শুধু ওদের মুখের কাছে ছুঁড়ে দেবার জন্যে আমায় কিছু দিন। দেখবেন ওরা আমায় কিছু বলবে না।

নগরকর্তা তাতে রাজি হয়ে বুনো কুকুরদের জন্যে কিছু মাংসের টুকরো দিলেন। তারপর ছেলেটিকে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিলেন বুরুজের কাছে।

ছেলেটি যখন ঢুকল, একটি কুকুরও তাকে দেখে ঘেউ-ঘেউ করে তেড়ে এল না, এমনই তার কুকুর-বিদ্যে। বরং তারা ল্যাজ নাড়তে নাড়তে সে যা দিলে তাই খেতে লাগল। তার একটি চুলও স্পর্শ করল না।

পরদিন ছেলেটি অক্ষত অবস্থায় হাজির হল সবার সামনে। নগরকর্তাকে সে বললে—দেখুন, আমি কুকুরের ভাষা বুঝি। কুকুররা আমায় বেশ পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছে কেন তারা এ দেশের এত ক্ষতি করছে। জাদুবিদ্যের বলে তারা বুরুজের কাছে আটকা পড়ে আছে। এখানে অনেক ধন সম্পত্তি আছে, তাই তাদের পাহারা দিতে হচ্ছে। বুরুজের নিচে থেকে সেই সম্পত্তি খুঁড়ে বার করে যতদিন না উদ্ধার করা হবে ততদিন কুকুরদেরও কোন শান্তি নেই, এখানকার লোকদেরও নেই। জাদুও ততদিন ভাঙবে না। কুকুরদের সঙ্গে কথা কয়ে এই আমি জেনেছি।

এই খবর শুনে সবাই ভারি খুশি হল। নগরকর্তা বললেন, ছেলেটি যদি সত্যিই ঐ ধন দৌলত খুঁড়ে উদ্ধার করে দিতে পারে তাহলে তিনি তাকে দত্তক পুত্র নেবেন, কারণ তাঁর কোন সন্তান নেই।

ছেলেটি আবার বুরুজে গেল। কুকুরদের সঙ্গে কথা কয়ে ভাল করে জেনে নিলে সম্পত্তিটা কোথায়। তারপর এক-পেঁটরা সোনা নিয়ে নগরকর্তার বাড়ি ফিরে এল।

জাদু কেটে গেল। বুনো কুকুরের চিৎকার আর ঘেউ-ঘেউ থেমে গেল সেই থেকে। দেশ থেকে অশান্তি দূর হল।

এর কিছুদিন পরেই ছেলেটি ভাবল সে একবার রোম নগরে যাবে। পথে পড়ল এক জলা। জলার মধ্যে এক দঙ্গল ব্যাঙ ডাকছে খুব চেঁচিয়ে। সে দাঁড়িয়ে গেল শুনতে। সে ওদের ভাষা বুঝত বলে যা শুনল তাতে করে সে ভারি চিন্তিত হয়ে পড়ল, তার মনে দুঃখও হল। রোমে পৌঁছেই সে শুনল ধর্মগুরু পোপ মারা গেছেন, আর অন্যান্য যাজকদের মধ্যে কে তাঁর পদে অধিষ্ঠিত হবেন এই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলেছে।

অবশেষে এই ঠিক হল যে, যার উপর স্বর্গের সঙ্কেত এসে পড়বে সে-ই হবে পোপ।

এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে-সঙ্গে জমিদারপুত্রের পোশাকে এক নবীন যুবক গির্জের মধ্যে এসে ঢুকলেন। যেই না ঢোকা অমনি দুটি বরফের মত সাদা পায়রা উড়ে এসে তাঁর দু-কাঁধে বসে পড়ল।

যে-সব যাজকেরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সবাই স্বীকার করলেন যে ঐ হল স্বর্গের ইঙ্গিত। জমিদার-পূত্রকে তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন—তিনি পোপ হবেন কি না?

উত্তর দিতে প্রথমে সে ইতস্তত করল কারণ তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে এমন উচ্চপদের সে উপযুক্ত। কিন্তু পায়রারা তার কানের কাছে বললে—ওঁরা যা চাইছেন তাতে রাজি হও! সে তাদের কথা বুঝল। বুঝে বললে—আমি রাজি।

তখন তাকে পোপের পোশাক পরানো হল, তাকে পবিত্র করা হল। ব্যাঙেরা যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তা পূর্ণ হল। তারা বলেছিল এক মাসের মধ্যে সে হবে মহা-পুরোহিত। এই শুনে তাঁর বেজায় দুশ্চিন্তা হয়েছিল।

এর পর তাকে বড়-বড় ধর্ম সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে হল। ধর্মসঙ্গীত গাইতে হল গলা ছেড়ে, যদিও সে এক বর্ণও লাতিন ভাষা বুঝত না। সেই পায়রা দুটি তার দু-কাঁধে এসে বসত আর ফিস্-ফিস্ করে শব্দগুলি তার কানের কাছে বলে দিত। কাজেই শেষ অবধি তার কুকুরের ভাষা, ব্যাঙের ভাষা আর পাখির ভাষা এমন কাজে লেগেছিল যে মনে হত সে মস্ত পণ্ডিত।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন