বুড়ো বাপের তিন ছেলে

বুড়ো বাপের তিন ছেলে

অনেক কাল আগে এক বাপ একদিন তার তিন ছেলেকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ডেকে পাঠিয়ে তিনি বড় ছেলের হাতে দিলেন একটা মোরগ, মেজো ছেলের হাতে একটা কাস্তে আর ছোট ছেলের হাতে একটা বেড়াল।

দিয়ে বললেন—আমি বুড়ো হয়েছি। আমার দিন শেষ হয়ে এল। মারা যাবার আগে আমার উচিত তোমাদের কিছু দিয়ে যাওয়া। টাকাকড়ি আমার নেই, যা তোমাদের দিচ্ছি তা হয়তো মনে হবে তুচ্ছ। কিন্তু এই তুচ্ছ জিনিসকেই কি করে মহা কাজে লাগানো যায় তা তোমাদেরই উপর নির্ভর করবে। এমন এক-একটি দেশ খুঁজে বার কোরো যেখানে তোমাদের যে জিনিসগুলি দিলুম তার কথা কেউ শোনেনি। তাহলেই দেখবে তোমাদের ভাগ্য খুলে যাবে।

বাপ মারা গেলে বড় ছেলে বেরিয়ে পড়ল তার মোরগ নিয়ে। কিন্তু যেখানেই যায় সব শহরেই দূর থেকে তার চোখে পড়ে গির্জের চূড়োয় মোরগ বসে হাওয়ার সঙ্গে ঘুরছে। গ্রামে গেলে শোনে সব দিক থেকে মোরগের ডাক আসছে। এ সব জায়গায় তার পাখি কিছুই নতুন নয়। কাজেই বড়লোক হওয়া তার ভাগ্যে ঘটবে না বলেই মনে হতে থাকল।

শেষে হল কি, সে এসে উপস্থিত হল এক দ্বীপে যেখানকার বাসিন্দারা কোনোদিন মোরগের কথা শোনেইনি। সময় কেমন করে গণনা করতে হয় তা-ই তারা জানে না। কোনটে সকাল কোনটে সন্ধে এটা তারা বুঝতো বটে, কিন্তু রাত্রে যদি তারা জাগত তো কোনোমতেই বুঝতে পারত না কত রাত হল বা কখন সকাল হবে।

বড় ভাই বলল—দেখুন কী মহৎ প্রাণী! যেন এক বীর ঘোড়সওয়ার। মাথার উপর টকটকে লাল চূড়ো, পায়ে বর্শা। রাত্রে তিন বার ইনি ডাকেন—নিয়মিত। শেষবার ডাকলেই সকাল হয়ে আসে। তারপর আরও আছে। কখনও কখনও দিনের আলোতেই ইনি ডেকে ওঠেন। তখন বুঝতে হবে সতর্ক বাণী দিচ্ছেন—আবহাওয়া এইবার বদলাবে।

শুনে দ্বীপের বাসিন্দারা ভারি খুশী। সারা রাত তারা জেগে রইল মোরগের ডাক শুনবে বলে। রাত দুটো, চারটে, ছটার সময় যখন মোরগ ডেকে উঠল তাদের যা আনন্দ! তারা জিজ্ঞেস করলে পাখিটা বিক্রির জন্যে কি না? কত দামই বা তার ?

বড় ভাই বললে—একটা গাধা যত সোনা বয়ে নিয়ে যেতে পারে তা-ই হচ্ছে এর দাম।

সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে বললে—এ রকম জন্তুর পক্ষে এ তো অতি উপযুক্ত মূল্য। সেই দামই তাকে দেওয়া হবে, ঠিক হল।

ধন বোঝাই করে সে যখন বাড়ি ফিরল তার ভাইরা খুব অবাক হয়ে গেল। মেজো ভাই বললে—এবার দাদার মতো আমিও বেরব। দেখি কাস্তে বেচে ধন আনতে পারি কি না।

কিন্তু তার সম্ভাবনা দেখা গেল খুবই কম। যেখানেই যায়, যে সব চাষীদের সঙ্গে দেখা হয় তাদের হাতে তার চেয়েও ভালো কাস্তে। শেষে ভাগ্যক্রমে সে এক দ্বীপে এসে পৌঁছল, সেখানকার বাসিন্দারা কোনোদিন কাস্তের নামও শোনেনি। সে দ্বীপে শস্য পাকলেই চাষীরা গিয়ে গাছ সুদ্ধ উপড়ে নিত। এতে খাটুনিও হত যেমন শস্যও নষ্ট হত তেমনি। মেজো ভাই তার কাস্তের কাজ দেখাতে সুরু করল। তাদের এক ক্ষেত শস্য যখন পলকের মধ্যে কেটে ফেলল সকলের মুখ একেবারে হাঁ হয়ে গেল। তারা বললে—যত দাম লাগুক, এমন একটা বস্তু আমাদের চাই। মেজোভাই তেমনি এক ঘোড়া বোঝাই সোনা নিয়ে ফিরে গেল।

ছোট ভাই-এরও ইচ্ছে বেরিয়ে গিয়ে দেখবে তার বেড়াল নিয়ে সে কি করতে পারে? বেরিয়ে পড়ল। প্রথমটা দুই দাদার যা হয়েছিল তারও তাই হল। যতদিন সে মহাদেশের এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ালো তার কপালে কিছুই জুটল না। সব জায়গাতেই প্রচুর বেড়াল—যত দরকার তার চেয়েও বেশী—এত বেশী যে বেড়ালের বাচ্ছা হলেই লোকে তাদের ডুবিয়ে মেরে ফেলে।

অবশেষে সে এসে পৌঁছল এক দ্বীপে। সেখানে ভাগ্যক্রমে কেউ-ই কোনোদিন বেড়াল দেখেনি। সে দ্বীপে এত ইঁদুর যে নেংটিগুলো পর্যন্ত ঘরে ঢুকে টেবিল চেয়ারে উঠে নৃত্য করে বেড়াত, গৃহস্বামী ঘরে থাকুন আর নাই থাকুন। সবাই অনুযোগ করত। রাজা কোনোমতেই ভেবে পেতেন না কেমন করে তাঁর প্রাসাদ থেকে ইঁদুরের বাহিনী তাড়ানো যায়। কোণে কোণে ইঁদুরের কিচিমিচি। যাতে দাঁত বসাতে পারে তাই তারা কেটে শেষ করে।

এমন ক্ষেত্র বেড়াল কখনও পায়নি। ইঁদুর তাড়িয়ে ফিরতে লাগল সে। পলকের মধ্যে দুটো ঘর থেকে ইঁদুর সাফ করে দিল। দ্বীপের বাসিন্দারা রাজাকে গিয়ে ধরলে, এমন এক আশ্চর্য জীব যে-কোনো মূল্য দিয়ে কেনা উচিত। এতে প্রজাদের পরম উপকার হবে।

ছোট ভাই যা দাম চাইল রাজা খুশী হয়ে তাই দিলেন। সে বললে—এক খচ্চরের পিঠে যত সোনা আর মাণিক্য ধরে তাই দিবেন। দুই দাদার চেয়েও মূল্যবান পুরস্কার নিয়ে ছোট ভাই বাড়ি ফিরে এল।

ইতিমধ্যে রাজপ্রাসাদে গিয়ে বেড়ালটি যত পারে ইঁদুর খেয়েছে। এত খেয়েছে যে রাজপ্রাসাদে ইঁদুরই আর বিশেষ বাকি নেই। ইঁদুরের পিছনে ছুটে আর ইঁদুর খেয়ে শেষে তার বেজায় তেষ্টা পেয়ে গেল। তখন সে চুপটি করে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে ডেকে উঠল—মিঁউ! মিঁউ!

এই অত্যাশ্চর্য শব্দ শুনে রাজা তাঁর সমস্ত প্রজাদের ডেকে পাঠালেন। সেই ডাক যখন তাদের কানে গেল অনেকে ভয়ের চোটে প্রাসাদ ছেড়ে দৌড় দিলে। রাজা সভা ডাকলেন, কি করা যায় তাই বিচার করবার জন্যে। অনেক আলোচনার পর ঠিক হল যে বেড়ালের কাছে একজন দূত পাঠানো দরকার। দূত গিয়ে বেড়ালকে বলুক তিনি যেন এখনই প্রাসাদ ছেড়ে চলে যান, নইলে জোর করে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে।

সভাসদরা বললেন—ইঁদুর বরং ভালো ছিল—ওদের অত্যাচার অভ্যেস হয়ে এসেছিল আমাদের। এখন ইঁদুর তাড়াতে গিয়ে নিজেদের প্রাণ দিতে আমরা রাজি নই।

দূত গিয়ে বেড়ালকে জিজ্ঞেস করল যে, তিনি প্রাসাদ ছেড়ে যেতে রাজি আছেন কি না? বেড়ালের তেষ্টা প্রতি মুহূর্তে বাড়ছিল, সে শুধু জবাব দিলে—মিউ! মিউ!

দূত এর মানে করল—না! না! —রাজার কাছে গিয়ে বলল, বেড়াল নড়তে চাইছে না।

সভাসদরা বললেন—তবে এবার রাজশক্তি আরোপ করা হোক।

কামান সাজানো হল। প্রাসাদের চারিদিকে গোলা ছোঁড়া হতে থাকল। বেড়াল যে ঘরে ছিল সেখানে যখন আগুন এসে পৌঁছল, সে জানলা দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে গেল। যারা গোলা ছুঁড়ছিল তারা তাকে দেখতে পেল না; কাজেই তারা গোলা ছুঁড়েই চলল যতক্ষণ না রাজার প্রাসাদ পুড়ে ছাই হয়ে গেল।

সকল অধ্যায়

১. তুষারিণী আর সাত বামনের গল্প
২. লাল-ঢাকা খুকি
৩. বারো ভাইয়ের গল্প
৪. চরকা-কাটা তিনি বুড়ি
৫. হাঁস-চরানি মেয়ে
৬. মুচি আর দুই পরী
৭. সোনার পাহাড়ের রাজা
৮. খুনীর সঙ্গে বিয়ে
৯. বুড়ো-আংলা টম
১০. ব্যাঙ ও রাজকন্যা
১১. ধড়ফড়ি মাছ
১২. বুনো গোলাপের বেড়া
১৩. রুমপেল্‌-স্টিল্‌ট্‌-স্খেন্‌
১৪. পাঁশমনি
১৫. কাঁপুনি শেখার গল্প
১৬. সুলতান কুকুরের গল্প
১৭. নেকড়ের বড়াই
১৮. শেয়াল আর বেড়ালের গল্প
১৯. ফুর্তিভায়ার অ্যাড্‌ভেঞ্চার
২০. এক-চোখো, দু-চোখো আর তিন-চোখো
২১. বুড়ো ঘোড়া
২২. নেকড়ে আর শেয়ালের গল্প
২৩. বনের বাড়ি
২৪. জীবন-বারি
২৫. জুনিপার গাছ
২৬. বুড়ো আর তার নাতি
২৭. দুই পথিকের গল্প
২৮. চোর-চূড়ামণি
২৯. ফ্রিয়েম মাস্টার
৩০. একটি পেরেক
৩১. নাচুনি রাজকন্যা
৩২. দোয়েল আর ভাল্লুক
৩৩. নেকড়ে বাঘ আর সাতটি ছাগলছানা
৩৪. রোলান্ডের গল্প
৩৫. নুটুরানী
৩৬. আশ্চর্য সালাদ
৩৭. হানস্‌ল্‌ ও গ্রেটল্‌
৩৮. গোলাপ-খুকি
৩৯. লোহার হান্স্‌
৪০. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪১. ব্রেমেন শহরের বাজিয়ের দল
৪২. পাখিয়া
৪৩. কার্ল কাটৎস-এর ঘুম
৪৪. সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
৪৫. রাখাল ছেলে
৪৬. হাঁদুরামের সোনার হাঁস
৪৭. বারোটি শিকারীর গল্প
৪৮. দাঁড়কাক
৪৯. সাদা সাপ
৫০. হাতকাটা মেয়ে
৫১. তিন রকমের ভাষা
৫২. ইচ্ছা-পূরণ
৫৩. ভালুচাম
৫৪. সিংহ রাজপুত্র
৫৫. চাষীর চালাক মেয়ে
৫৬. চাষী আর শয়তান
৫৭. চতুরা গ্রেট্‌ল্‌
৫৮. কে কত বোকা
৫৯. চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
৬০. কাঁচের কাফিন
৬১. খরগোস আর সজারুর গল্প
৬২. পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
৬৩. ভাই-বোন
৬৪. হুতুম-থুমো
৬৫. ইঁদুর, পাখি আর সসেজ
৬৬. বেড়াল আর ইঁদুরের সংসার
৬৭. সাতটি দাঁড়কাক
৬৮. ফ্রেডেরিক ও ক্যাথেরিন
৬৯. তিন টুকরো সাপ
৭০. হাড়ের গান
৭১. চতুরা এল্‌সি‌
৭২. সর্বনেশে অতিথি
৭৩. আশ্চর্য গেলাস
৭৪. শেয়াল আর হাঁসের দল
৭৫. ডাক্তার সবজান্তা
৭৬. ধনী কৃষকের গল্প
৭৭. তিনটি কঠিন কাজ
৭৮. কাঠুরের মেয়ে
৭৯. আশ্চর্য এক বাজনদার
৮০. স্বর্গে ঢুকে দর্জি কি করেছিল
৮১. ট্রুডে গিন্নী
৮২. যমরাজের ধর্মছেলে
৮৩. ছোট চাষী
৮৪. নেকড়ে-বৌ আর শেয়ালের গল্প
৮৫. শবাচ্ছাদনী
৮৬. সূর্যের আলোয় সব কিছু প্রকাশ হবে
৮৭. সুন্দর কনে আর কালো কনে
৮৮. গাধা
৮৯. অকৃতজ্ঞ পুত্র
৯০. আকাশ-ঝরা টাকা
৯১. চুরি-করা আধলা
৯২. কোন কন্যা সব চেয়ে ভালো
৯৩. শ্লাউরাফ্‌ফেন দেশের গল্প
৯৪. ডিট্‌মার্শের আশ্চর্য গল্প
৯৫. বিচক্ষণ চাকর
৯৬. স্বর্গের দ্বারে কৃষক
৯৭. জীবনের দৈর্ঘ্য
৯৮. মৃত্যু-দূত
৯৯. ঈভের নানান ছেলেমেয়ে
১০০. কবরের মধ্যে গরীব ছেলেটি
১০১. অলস বৌ
১০২. কুকুর আর চড়াইয়ের গল্প
১০৩. কুঁড়ে হরি
১০৪. য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
১০৫. বুড়ো বাপের তিন ছেলে
১০৬. বিশ্বাসী জন্‌
১০৭. গোলাপ কুমারী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন