শকওয়েভ – ৫৬

কাজী আনোয়ার হোসেন

ছাপ্পান্ন

বুলেটের মত লেকের সারফেস বিদীর্ণ করল এয়ারক্রাফটের নাক। যতটা ভেবেছিল, তার চেয়ে অনেক জোরালোভাবে সিটবেল্টের মধ্যে ঝাঁকিয়ে দিল ওদেরকে ক্র্যাশ-ল্যাণ্ডিঙের ধাক্কা। ভুস করে জলের নিচে তলিয়ে গেল ককপিটের জানালা।

মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য মনে হলো রানার, ওদের ঘাড় ভাঙতে চলেছে প্লেনটা হ্রদের তলদেশে আছড়ে পড়ে। কিন্তু না! পানি স্পর্শ করার আগেই বিমানের নাক বেশ খানিকটা উঁচু করে ফেলতে পেরেছে ও জলসমতলের প্রায় সমান্তরাল হয়ে নেমেছে ওরা লেক টোবায়।

দু’পাশে পানি ছিটিয়ে লেকের বুক চষে চলল যন্ত্রপাখির দুই ডানা। অসম্ভব মনে হচ্ছে কম্পমান এয়ারক্রাফটের আস্ত থাকাটা। প্রচণ্ড গর্জনে দু’পাশ দিয়ে প্রস্রবণের মত ছিটকে উঠছে পানি।

ককপিটের জানালা দিয়ে এক ঝলকের জন্য দেখতে পেল রানা, প্রচণ্ড বেগে কাছে চলে আসছে আগ্নেয় শিলায় তৈরি এক দ্বীপ। পাথুরে দ্বীপের সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত করল ও নিজেকে।

…না, হলো না সংঘর্ষ। মন্থর হতে হতে দ্বীপটার কয়েক মিটার দূরে থাকতে থেমে গেল প্লেনের গতি। থিতিয়ে এল চারপাশের পানির আলোড়ন।

সঙ্গে সঙ্গে সূচনা হলো আরেক বিপদের। ডুবে যেতে শুরু করেছে বিমান। স্তম্ভিত রানা নিচে তাকিয়ে দেখতে পেল-হু-হু করে পানি ঢুকছে ককপিটে।

সিটবেল্ট রিলিজ বাটনে থাবড়া মেরে ঘুরল ও শরীর বাঁকিয়ে। আধখোলা চোখে একটা সিটের বেল্টে ঝুলছে সেলেনা বার্নহার্ট।

ফেনায়িত পানি এখন ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের উপর। শর্ট সার্কিটের কারণে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ ছুটছে টাশ্-টাশ্-ফাঁৎ আওয়াজে।

সিটবেল্ট থেকে মুক্ত করল রানা সেলেনাকে, ঝাঁকি দিল কাঁধ ধরে।

চোখ খুলে গেল সেলেনার, দেখল ওকে বোবা দৃষ্টিতে।

‘সেলেনা! সেলেনা!’ চেঁচিয়ে ডাকল রানা। ‘শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?’ জেট ইঞ্জিনের বধির করে দেয়া তীক্ষ্ণ, কর্কশ গর্জনের নিচে চাপা পড়ে গেল উচ্চারিত শব্দগুলো।

হ্রদের একেবারে নিচে নেমে এসে ওদের ঠিক উপর দিয়ে চলে গেল এফসিক্সটিন দুটো। তবে আক্রমণে গেল না। মুহূর্তেই কালো এক জোড়া বিন্দুতে পরিণত হলো বহু দূরে।

মাথা ঝাঁকাল সেলেনা।

‘আর ইউ অল রাইট?’

‘হ-হ্যাঁ… ঠ-ঠিক আছি আমি!’ জবাব এল অস্ফুটে।

রোটারি ক্যাননের গুলিতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়নি বটে, তবে এখনকার পরিস্থিতিও কম ভয়ানক নয়। ডুবন্ত এয়ারক্রাফট থেকে বেরোনোর দিকে মনোযোগ দিল রানা।

পানি বাড়ছে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে গুস্তাফ। বেল্ট খোলার জন্য টানাটানি করে চলেছে উন্মাদের মত।

পানি ঠেলে এগিয়ে খুলে দিল ওটা রানা। হ্যাঁচকা টান দিয়ে আসন থেকে দাঁড় করাল লোকটাকে।

‘মুভ!’ হুঙ্কার ছাড়ল ও ক্যাডেটদের প্রতি দয়ামায়াহীন সেনা অফিসারের মত। ক্যানভাস ব্যাগটা চোখে পড়তেই তুলে নিয়ে কাঁধে ঝোলাল ওটা।

বিমানের সামনের দিক নিচু হচ্ছে আগে। এরই মধ্যে প্রায় পুরোপুরি ডুবে গেছে ককপিট।

হ্যাচওয়ের দিকে এগোতে লাগল ওরা পানি ভেঙে। তেরছা হয়ে থাকা ফিউযেলাজের মাঝামাঝি অংশে ঊরু- সমান পানি।

এমার্জেন্সি লিভার টানল রানা। বাইরের পানির চাপের বিপরীতে খুলল দরজাটা কাঁধের ধাক্কা দিয়ে। খোলা হ্যাচ দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকতে লাগল জলস্রোত।

গুস্তাফের কোঁ-কোঁ আপত্তি গ্রাহ্য না করে ওকেই প্রথমে দরজা দিয়ে বের করে দিল রানা। শব্দ হলো—ঝপাস! শক্ত করে সেলেনার কোমর জড়িয়ে ধরে ঝাঁপ দিল ও এবার ঈষদুষ্ণ পানিতে।

স্বল্প দূরত্বটুকু পেরোচ্ছে ওরা ডাঙার উদ্দেশে, পিছনে ধীরে ধীরে ডুবছে এসটি-ওয়ান।

তীরে পৌঁছে সেলেনাকে টেনে তুলল রানা পানি থেকে। এর পর গেল গুস্তাফকে সাহায্য করতে। গজ কয়েক দূরে হাবুডুবু খাচ্ছে লোকটা, বিষম খাচ্ছে গলায় পানি ঢুকে।

অনেক কষ্টে কালো লাভার উপর টেনে তোলা গেল গুস্তাফকে। তাকিয়ে দেখল রানা, কলকল আওয়াজে শেষ ক’টা বুড়বুড়ি ছেড়ে তলিয়ে গেল এসটি-ওয়ানের লেজটা।

কালো পাথরের উপর বসে রয়েছে তিনজনে। ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরছে গা থেকে। ওদের পিছনে এক-দেড় শত ফুট উঁচুতে মাথা তুলেছে ভলকানিক আইল্যাণ্ডের পাহাড়। ওটার গায়ে জড়াজড়ি করে থাকা অপুষ্ট গাছগুল্মগুলো ছাউনির ভূমিকা নিয়ে রোদ আড়াল করছে।

‘গেল তোমার নানাশ্বশুরের প্লেনটা!’ তৃষিত নয়নে ডুবে- যাওয়া জায়গাটার দিকে তাকিয়ে বলল সেলেনা।

রানা গম্ভীর।

‘অনেক দামি ওটা, তা-ই না?’

‘সে তো বটেই।’

‘মনে হচ্ছে না, উদ্ধার পাওয়ার কোনও উপায় আছে এখান থেকে…

‘ন্‌-নাহ।’

‘তার মানে, গেলাম আটকা পড়ে!’ হতাশায় ডুবে গেল সেলেনার কণ্ঠ। ‘কে জানে, কোন্ কালে কে এসে উদ্ধার করবে আমাদের!’

‘চিন্তা কোরো না।’ আকাশ জরিপ করছে রানা। ‘বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না সেজন্যে। রেডিয়োতে জানিয়ে দেবে পাইলট, কোথায় ডুবেছে এসটি-ওয়ান। আমাদের তুলে নিতে দেরি করবে না মিলিটারি।’

দুই হাতে হাঁটু বেড় দিয়ে ধরে বসে আছে গুস্তাফ। চুপ মেরে গেছে একদম।

‘কী করব তা হলে? সাঁতরে পেরোব ওটা?’ লেকটার দিকে ইঙ্গিত করল সেলেনা। ‘সমস্যা ছিল না, কষ্ট করে যদি সাঁতারটা শিখে নিতাম।’

‘শিখলেও ফল হতো না খুব একটা,’ সান্ত্বনার সুরে বলল রানা। ‘গোটা লেক পাড়ি দিয়ে যদি পৌঁছুতেও পারি ওপারে, বেশি

দূর পালিয়ে বাঁচতে পারব না ওদের হাত থেকে।’ ঘুরল ও ব্যাগটার দিকে। চেইন খুলে বের করে আনল এআর- ফিফটিন রাইফেলের খণ্ডাংশগুলো। শুকনোই রয়েছে প্লাসটিকে মোড়ানো ব্যাঙ্কনোটের তোড়া। উঠে দাঁড়াল রানা পার্টগুলো নিয়ে।

‘তা হলে কি প্রতিরোধ করবেন?’ ওকে অস্ত্র বের করতে দেখে প্রশ্নটা করেছে গুস্তাফ। তাকিয়ে আছে ভুরু কুঁচকে।

‘অ্যাসল্ট ট্রুপের গোটা একটা রেজিমেন্টকে আশা করছি না আমি।’ শীতল হাসি রানার ঠোঁটে। ‘তবে হাজির যদি হয়ও, মনে হয় না, সহি সালামতে বেরিয়ে যেতে পারব এ বিপদ থেকে। কী মনে হয় আপনার?’

সৈকতের বুকে উঁচু হয়ে জেগে থাকা বড় এক চ্যাপ্টা পাথরের উপর উঠে পড়ল ও। যত দূর সম্ভব, ছুঁড়ে মারল কালো ম্যাগাজিনটা!

ঝপাত করে পানিতে পড়ল ওটা।

এর পর অন্যত্র পড়ল অস্ত্রটার উপর আর নিচের অংশ। ‘এবার আপনার পিস্তলটা।’ হাত বাড়িয়ে চাইল ও কোল্ট কমাণ্ডারটা।

‘ক্র্যাশ-ল্যাণ্ডিঙের সময় হারিয়েছি ওটা, বেজার মুখে জানাল গুস্তাফ।

‘তা-ও ভালো। দাঁত দেখাল রানা। এখন যেটা করতে পারি আমরা, সেটা হলো প্রতীক্ষা… ওয়েটিং ফর গড়ো। স্যামুয়েল বেকেটের নাটকের শিরোনাম ওটা!

ঠিকই বলেছিল ও – অপেক্ষা করতে হলো না বেশিক্ষণ। আধঘন্টা পুরো হওয়ার আগেই আওয়ান হেলিকপ্টারের ধপ্‌ আওয়াজে ভঙ্গ হলো ভলকানিক লেকের নীরবতা।

ইন্দোনেশিয়ান এয়ার ফোর্সের ছাপ দেয়া সেকেলে এক ফ্রেঞ্চ অ্যারোস্পেশাল এসএ থ্রি থার্টি পিউমা টুপ ট্রান্সপোর্টকে আসতে দেখল রানা চোখের উপর হাতের ছাউনি তৈরি করে। দুনিয়ার দুর্বল নেতৃত্বের মিলিটারি ফোর্সগুলোর মত অন্যান্য দেশের বাতিল লোহালক্কড় জোড়াতালি দিয়ে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে অনেকের মত ইন্দোনেশীয়রাও।

ষাট গজ উপরে নেমে এসে বাতাসে ভাসছে চপারটা। উত্তাল পানির প্রশস্ত এক বৃত্ত তৈরি করেছে টোবা হ্রদের বুকে। খোলা হ্যাচ দিয়ে ঝুপ করে পানিতে পড়ল একখানা আউটবোর্ড ডিঙি। পিনড্যাড অ্যাসল্ট রাইফেল সহ তিন সৈনিক নামল নৌকায়। ছুটে আসতে লাগল দ্বীপের দিকে।

‘ভালো বা মন্দ-যেটাই হোক, শুরু তো হলো!’ উঠে . দাঁড়াল রানা। দেখে মনে হচ্ছে, ফুর্তিতে রয়েছে ও।

অস্ত্র কাঁধে ডিঙি থেকে তীরে নামল সৈন্যরা।

রাইফেলের নলের মুখে তিন বন্দিকে তোলা হলো নৌকায়। ভাসমান ‘কপ্টারটার উদ্দেশে পানি কেটে ফের ছুটে চলল ডিঙি। ওঠার জন্য দড়ির মই ঝুলছে হেলিকপ্টার থেকে।

‘কিচ্ছু ভেবো না!’ রোটরের গোলমাল ছাপিয়ে সেলেনার কানে অভয় দিল রানা।

বাতাসে এলোমেলো চুলগুলো আঙুল দিয়ে আঁচড়ে সরাল মেয়েটা মুখের উপর থেকে। হাসল অনিশ্চিত হাসি।

মই বেয়ে উঠে সৈন্যদের বাড়ানো হাতে প্রথমে ধরা দিল সেলেনা। ওকে টেনে তোলা হলো পিউমাতে।

এর পর গুস্তাফের পালা।

পিঠে রাইফেলের ব্যারেল ঠেকানো অবস্থায় সব শেষে উঠল রানা। এক সৈন্য ছিনিয়ে নিল ওর ব্যাগটা।

গুটিয়ে নেয়া হলো মই। কপিকলের সাহায্যে টেনে তোলা হলো রাবারের ডিঙি। তার পর ঘুরল হেলিকপ্টার আরও উঁচুতে উঠে। উড়ে চলল পেকানবারুর এয়ার বেইস অভিমুখে।

সকল অধ্যায়

১. শকওয়েভ – ১
২. শকওয়েভ – ২
৩. শকওয়েভ – ৩
৪. শকওয়েভ – ৪
৫. শকওয়েভ – ৫
৬. শকওয়েভ – ৬
৭. শকওয়েভ – ৭
৮. শকওয়েভ – ৮
৯. শকওয়েভ – ৯
১০. শকওয়েভ – ১০
১১. শকওয়েভ – ১১
১২. শকওয়েভ – ১২
১৩. শকওয়েভ – ১৩
১৪. শকওয়েভ – ১৪
১৫. শকওয়েভ – ১৫
১৬. শকওয়েভ – ১৬
১৭. শকওয়েভ – ১৭
১৮. শকওয়েভ – ১৮
১৯. শকওয়েভ – ১৯
২০. শকওয়েভ – ২০
২১. শকওয়েভ – ২১
২২. শকওয়েভ – ২২
২৩. শকওয়েভ – ২৩
২৪. শকওয়েভ – ২৪
২৫. শকওয়েভ – ২৫
২৬. শকওয়েভ – ২৬
২৭. শকওয়েভ – ২৭
২৮. শকওয়েভ – ২৮
২৯. শকওয়েভ – ২৯
৩০. শকওয়েভ – ৩০
৩১. শকওয়েভ – ৩১
৩২. শকওয়েভ – ৩২
৩৩. শকওয়েভ – ৩৩
৩৪. শকওয়েভ – ৩৪
৩৫. শকওয়েভ – ৩৫
৩৬. শকওয়েভ – ৩৬
৩৭. শকওয়েভ – ৩৭
৩৮. শকওয়েভ – ৩৮
৩৯. শকওয়েভ – ৩৯
৪০. শকওয়েভ – ৪০
৪১. শকওয়েভ – ৪১
৪২. শকওয়েভ – ৪২
৪৩. শকওয়েভ – ৪৩
৪৪. শকওয়েভ – ৪৪
৪৫. শকওয়েভ – ৪৫
৪৬. শকওয়েভ – ৪৬
৪৭. শকওয়েভ – ৪৭
৪৮. শকওয়েভ – ৪৮
৪৯. শকওয়েভ – ৪৯
৫০. শকওয়েভ – ৫০
৫১. শকওয়েভ – ৫১
৫২. শকওয়েভ – ৫২
৫৩. শকওয়েভ – ৫৩
৫৪. শকওয়েভ – ৫৪
৫৫. শকওয়েভ – ৫৫
৫৬. শকওয়েভ – ৫৬
৫৭. শকওয়েভ – ৫৭
৫৮. শকওয়েভ – ৫৮
৫৯. শকওয়েভ – ৫৯
৬০. শকওয়েভ – ৬০
৬১. শকওয়েভ – ৬১
৬২. শকওয়েভ – ৬২
৬৩. শকওয়েভ – ৬৩
৬৪. শকওয়েভ – ৬৪
৬৫. শকওয়েভ – ৬৫
৬৬. শকওয়েভ – ৬৬
৬৭. শকওয়েভ – ৬৭
৬৮. শকওয়েভ – ৬৮
৬৯. শকওয়েভ – ৬৯
৭০. শকওয়েভ – ৭০
৭১. শকওয়েভ – ৭১
৭২. শকওয়েভ – ৭২
৭৩. শকওয়েভ – ৭৩
৭৪. শকওয়েভ – ৭৪
৭৫. শকওয়েভ – ৭৫
৭৬. শকওয়েভ – ৭৬
৭৭. শকওয়েভ – ৭৭
৭৮. শকওয়েভ – ৭৮
৭৯. শকওয়েভ – ৭৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন