শকওয়েভ – ৪৭

কাজী আনোয়ার হোসেন

সাতচল্লিশ

সরে গিয়েছিল ট্র্যাপডোরের উপর থেকে, সেকেণ্ডের ভগ্নাংশের জন্য তাকাতে পারল লোকটা রানার দিকে। স্কি মাস্কের চেরা ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান চোখ দুটো যেন ফেটে পড়ছে প্রচণ্ড অবিশ্বাসে।

নির্মমভাবে ব্যারেলের খোঁচা দিল রানা তার পেটে। পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে টিপে দিল ট্রিগার। অত কাছ থেকে, এমনকী একটা বার্ড-শটের গুলিতেও নির্ঘাত মারা পড়বে মানুষ।

বোমার মত গর্জে উঠল বারো-বোর, প্রচণ্ড ঝাঁকি দিল রানার কাঁধে।

গুলির ধাক্কায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না লোকটা। উড়ে গিয়ে পড়ল ছ’ফুট দূরে।

গুলিবিদ্ধ হানাদার মেঝেতে পড়ার আগেই পরবর্তী অ্যাকশনে গেছে রানা। ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে অস্ত্র ঘুরিয়েই পেয়ে গেল ও দুই নম্বর টার্গেটকে।

আরেকটা বোমার আওয়াজ। এমনভাবে ধরাশায়ী হলো কালো পোশাকধারী, কাস্তের কোপে যেন কোমরের নিচ থেকে পা দুটো কেটে নেয়া হয়েছে আখের মত।

দ্বিতীয় আরেকটা বুলেট পুরে দিল রানা লোকটার শরীরে।

আচমকা বাজিপটকা শুরু হওয়ায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে হানাদাররা। কাভার নেয়ার জন্য প্যাসেজের দিকে ছুট দিল তৃতীয় ব্যক্তি।

আরও একবার হুঙ্কার ছাড়ল শটগান। কিন্তু দৃষ্টিপথ থেকে সরে যাওয়ায় বুলেট গাঁথল না টার্গেটের গায়ে, বেরিয়ে গেল কোমরের বেশ খানিকটা মাংস ছিঁড়ে নিয়ে। দেয়ালে সৃষ্ট গুলির গর্তটার চারপাশে লেপটে গেল এক পশলা রক্তের ঝলক।

পায়ের তলায় কম্পন অনুভব করে নিচে তাকাল রানা। সেলেনার আগে ট্র্যাপড়োর থেকে বেরোনোর জন্য হুড়োহুড়ি করছে রিপোর্টার সাহেব।

‘একটা অস্ত্র দিন আমায়!’ কান্নার মত শোনাল আতঙ্ক- জর্জরিত কণ্ঠটা। ‘যে-কোনও একটা অস্ত্র!’

লোকটাকে অগ্রাহ্য করল রানা। ওর ভাবনা গ্রেনেড নিক্ষেপকারীকে নিয়ে। বিস্ময়ের ধাক্কা এতক্ষণে নিশ্চয়ই সামলে নিয়েছে লোকটা। কোথায় পরবর্তী আঘাত হানতে হবে, বোধগম্য হতে সময় লাগবে না তার। কেবিনের তলার আবদ্ধ জায়গায় গ্রেনেড এসে পড়লে চেতনা হারাবে সবাই। বদমাশগুলোর কাজ তখন সহজ হয়ে যাবে।

‘একটা অস্ত্র লাগবে আমার!’ ভাঙা রেকর্ডের মত ঘ্যান ঘ্যান করছে গুস্তাফ। ‘এভাবে অরক্ষিত থাকব আমি!’

‘এই নিন!’ বিরক্ত হয়ে লোকটার হাতে ব্রাউনিংটা গুঁজে দিল রানা। ‘মুখটা বন্ধ করবেন এবার?’ হাত বাড়াল নিচু হয়ে।

গলায় ঝোলানো বেরেটা সহ চারকোনা ফোকর দিয়ে বেরিয়ে এল সেলেনা।

সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গল থেকে গ্রেনেড চার্জের চাপা ‘হুফ’ আওয়াজ এল ওদের কানে। ট্র্যাপডোরের নিচে ওটার বাউন্স খাওয়ার থপ-থপ শোনা গেল পরক্ষণে।

দম চাপল রানা। তাড়াহুড়ো পড়ে গেল এখন!

এমনভাবে গুস্তাফকে গর্ত থেকে টেনে তুলল ও, লোকটা যেন ময়দার বস্তা। ফ্লোরবোর্ডে বেধে গিয়ে ব্রাউনিংটা ওর হাত থেকে পড়ে যাওয়ায় চিৎকার ছাড়ল সুইডিশ। কিন্তু একটা সেকেণ্ডও সময় নেই ওটা তুলে আনার।

ধপ্ করে ‘বস্তা’-টা ফেলে দিল রানা। স্টান ব্লাস্টের প্রেশার ওয়েভ আটকাতে সময়মতই লাথি মেরে লাগিয়ে দিতে পারল ট্র্যাপডোরের ডালা। ও-ও ওটা বন্ধ করল, গ্রেনেডটাও বিকট আওয়াজে ফেটে কাঁপিয়ে দিল গোটা কেবিন।

সটান উঠে দাঁড়িয়ে টলতে লাগল অনুসন্ধানী রিপোর্টার, হাত চাপা দিয়েছে দু’কানে।

ঝটিতি চারপাশটা দেখে নিল রানা। লিভিং রুম এখনও পরিষ্কার। তবে থাকবে না বেশিক্ষণ। ইগলের ডানা ছড়ানোর ভঙ্গিতে একটা লাশ পড়ে রয়েছে মেঝেতে। আরেকটা লেপটে রয়েছে দেয়ালের সঙ্গে। তৃতীয়জনের রক্তের ধারা গেছে প্যাসেজের অন্ধকারে।

চুরচুর হয়ে যাওয়া ফ্রন্ট উইণ্ডো দিয়ে এক নজর চেয়েই আরও কালো পোশাকধারী দেখতে পেল ও। দ্রুত এগিয়ে আসছে কেবিনের দিকে। তিন কি চারজন হবে সংখ্যায়। হুড়মুড় করে সামনের পোর্চে উঠে পড়ল পদশব্দ!

একটা কালো মূর্তি উদয় হলো দরজায়। ঝিলিক দিল কালো চকচকে গানমেটাল।

শটগান নিয়ে পাঁই করে শরীর ঘোরাল রানা। অস্ত্রধারী গুলি করতে পারার আগেই চেপে দিল ট্রিগার।

‘গুডুম’ আওয়াজ ছেড়ে দরজার চৌকাঠ আর সংলগ্ন দেয়ালে অর্ধবৃত্তাকারে কামড় বসাল মসবার্গের কার্ট্রিজ। ঝরা পাতার মত লুটিয়ে পড়ল কালো মূর্তি।

আরও লোক জড়ো হয়েছে নিহতের পিছনে। ট্রিগার চেপে পর পর দু’বার আগুন ঝরাল রানা।

ওদিক থেকেও পাল্টা গুলি এল।

মুখের পাশ দিয়ে বুলেট বেরিয়ে যাওয়ার হলকা অনুভব করল রানা। গুলির আঘাতে স্প্লিন্টার উড়ল পিছনের দেয়াল থেকে।

শেষ কার্তুজটা খরচ করে ফেলেছে রানা। পিস্তল হারিয়েছে ট্র্যাপডোরের তলায়। একমাত্র কার্যকর অস্ত্রটা রয়েছে সেলেনার হাতে। দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে ঘোরাচ্ছে ও সেটা দরজার দিকে, পিছন থেকে বাধা পেল রানার। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগেই সেলেনাকে নিয়ে প্যাসেজে সরে গেল ও। ওদের আগেই অন্ধকারে সেঁধিয়েছে গুস্তাফ ভিকান্দার।

ছুটন্ত রানাদের পিছনে দেয়াল খুঁচিয়ে চলল শত্রুর বুলেট। গজ দুয়েক এগিয়েছে, জবুথুবুভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বেঁচে যাওয়া অস্ত্রধারীর মুখোমুখি হলো ওরা অকস্মাৎ।

অস্ত্র তুলল আহত লোকটা।

সেলেনাও তাক করল বেরেটা।

দু’জনের একজনও গুলি করতে পারার আগে বর্ণা নিক্ষেপকারীর মত ইস্পাতের ভারি মসবার্গ ছুঁড়ে মারল রানা।

বুকে মাঘলের জোরালো এক খোঁচা খেল গানম্যান। পরমুহূর্তেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। জুডোর প্যাঁচে ওকে মেঝেতে ফেলে নির্দয়ভাবে লাথি মারতে লাগল বুকে, পেটে, মাথায়।

‘এসো, সেলেনা!’ বলল ও মার থামিয়ে। ভূপাতিত লোকটার অস্ত্র তুলে নেয়ার সময় নেই এ মুহূর্তে। যে-কোনও মুহূর্তে প্যাসেজে হাজির হয়ে যাবে ওদের আরও লোক।

আরও তিন বার গুলি হলো।

চিৎকার ছেড়ে নিজের বাহু চেপে ধরল সেলেনা।

ওকে টেনে নিয়ে ঢুকে পড়ল রানা ব্যাক হলওয়েতে, যেদিক দিয়ে প্রবেশ করেছিল কেবিনে। সামনেই এক্সিটটা। বাম দিকে রান্নাঘর। পিছন-দরজার ময়লা কাঁচ ভেদ করে দেখতে পেল, আরও দু’জন ছুটে আসছে কেবিনের দিকে

চিন্তা-ভাবনা করারও সময় নেই এখন। প্রোপেন গ্যাসের দুটো সিলিণ্ডার রয়েছে হাতের কাছে। হাঁটু দিয়ে ঠেলে ওগুলোর ভিতর তরল গ্যাসের ওজন অনুভব করল রানা। লাকড়ির বাক্স থেকে ছোট্ট কুঠারটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়েই ব্লেডের চওড়া দিকটা দিয়ে গায়ের জোরে সিলিণ্ডারের মাথায় বসানো ভালভের গায়ে ঘা মারল।

তিন বার আঘাত করতেই বেঁকে গেল ভালভ। হিসহিস আওয়াজে বাষ্প হয়ে বেরোতে লাগল ভিতরের তরল।

কুঠারটা ফেলে দিয়ে উপরের তাকে ছোঁ দিল এবার রানা। প্যারাফিন ল্যাম্প দুটোর তারের হাতল ঠেকল হাতে। এবার ও-দুটো আর দিয়াশলাই নিয়ে ছুট দিল ও কিচেনের দিকে।

বাইরে, পোর্চের সিঁড়িতে থমকে গেছে শত্রুপক্ষ। রানার মার খেয়ে পর্যুদস্ত লোকটা ছুটে আসছে হলওয়ে ধরে।

সেলেনাকে নিয়ে হুড়মুড় করে কিচেনে ঢুকে পড়ল রানা। সন্ত্রস্ত সুইডিশও অনুসরণ করল ওদেরকে।

কাঁধের ধাক্কায় কবাট লাগিয়ে দিল রানা। লোহার ভারি বোল্ট টেনে দিয়েই ছুটে গেল ও পাইন টেবিলের দিকে।

‘হেঁইয়ো’ বলে টান মেরে টেবিলটা কাত করে ফেলল রানা। পুরু টেবলটপটা দরজার দিকে মুখ করে দিয়ে মেয়েটার কবজি ধরে টেনে বসিয়ে দিল অস্থায়ী ব্যারিয়ারটার পিছনে।

‘কোথায় লেগেছে, দেখি!’ সময় নষ্ট না করে সেলেনার রক্তাক্ত আস্তিন ছিঁড়ে ফেলল ও। স্বস্তির সঙ্গে আবিষ্কার করল, স্রেফ ত্বক ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে বুলেটটা।

‘ডাক্তারির সময় নয়…’ বলা শুরু করেছিল সেলেনা, দরজার উপর গুলির ঝড়ে শেষ করতে পারল না কথা। রানা ওকে বাধা দেয়ার আগেই বেরিয়ে এল ব্যারিয়ার ছেড়ে। সাব-মেশিন গানটাকে ফুল-অটোতে দিয়ে এক ঝাঁক বুলেট পাঠাল দরজার দিকে।

কান ঝালাপালা করা বিশ্রী আওয়াজে ভরে উঠেছে রান্নাঘর। কার্তুজের খালি খোসা ঝরে পড়ছে মেঝেতে। নানান দিকে কাঠের কণা ছিটিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকার মত বড়সড় এক গর্ত তৈরি হয়েছে দরজার মাঝখানে। রানা যতক্ষণে মেয়েটাকে আবার টেবিলের পিছনে নিয়ে এল, ততক্ষণে খালি হয়ে গেছে বেরেটা।

এখন পুরোপুরি নিরস্ত্র ওরা। ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক দল মার্সেনারি খাপ পেতে রয়েছে দরজার ওপাশে। অনর্গল গুলির ধাক্কায় যে-কোনও মুহূর্তে উড়ে যাবে দরজার বাধা।

কবাটের ফোকরটা দিয়ে এসে টেবিলটপের গা থেকে কাঠ খুবলে তুলছে বুলেট। বেশিক্ষণ নিরাপত্তা দিতে পারবে না ওটা। কানে হাত চাপা দিয়ে প্যাচ মারা কেন্নোর মত মেঝেতে পড়ে আছে গুস্তাফ।

খুলল রানা ম্যাচবক্সটা। প্যারাফিন লণ্ঠন দুটো নিয়ে এল নাকের কাছে। যেমনটা আশা করছিল, তেলের তীব্র গন্ধ পেল।

‘কী করছ, রানা?’ ত্রস্ত কণ্ঠে জানতে চাইল মেয়েটা।

‘খানিক গরম করতে হবে এগুলো।’ খস্ করে দেশলাই জ্বালল রানা।

সকল অধ্যায়

১. শকওয়েভ – ১
২. শকওয়েভ – ২
৩. শকওয়েভ – ৩
৪. শকওয়েভ – ৪
৫. শকওয়েভ – ৫
৬. শকওয়েভ – ৬
৭. শকওয়েভ – ৭
৮. শকওয়েভ – ৮
৯. শকওয়েভ – ৯
১০. শকওয়েভ – ১০
১১. শকওয়েভ – ১১
১২. শকওয়েভ – ১২
১৩. শকওয়েভ – ১৩
১৪. শকওয়েভ – ১৪
১৫. শকওয়েভ – ১৫
১৬. শকওয়েভ – ১৬
১৭. শকওয়েভ – ১৭
১৮. শকওয়েভ – ১৮
১৯. শকওয়েভ – ১৯
২০. শকওয়েভ – ২০
২১. শকওয়েভ – ২১
২২. শকওয়েভ – ২২
২৩. শকওয়েভ – ২৩
২৪. শকওয়েভ – ২৪
২৫. শকওয়েভ – ২৫
২৬. শকওয়েভ – ২৬
২৭. শকওয়েভ – ২৭
২৮. শকওয়েভ – ২৮
২৯. শকওয়েভ – ২৯
৩০. শকওয়েভ – ৩০
৩১. শকওয়েভ – ৩১
৩২. শকওয়েভ – ৩২
৩৩. শকওয়েভ – ৩৩
৩৪. শকওয়েভ – ৩৪
৩৫. শকওয়েভ – ৩৫
৩৬. শকওয়েভ – ৩৬
৩৭. শকওয়েভ – ৩৭
৩৮. শকওয়েভ – ৩৮
৩৯. শকওয়েভ – ৩৯
৪০. শকওয়েভ – ৪০
৪১. শকওয়েভ – ৪১
৪২. শকওয়েভ – ৪২
৪৩. শকওয়েভ – ৪৩
৪৪. শকওয়েভ – ৪৪
৪৫. শকওয়েভ – ৪৫
৪৬. শকওয়েভ – ৪৬
৪৭. শকওয়েভ – ৪৭
৪৮. শকওয়েভ – ৪৮
৪৯. শকওয়েভ – ৪৯
৫০. শকওয়েভ – ৫০
৫১. শকওয়েভ – ৫১
৫২. শকওয়েভ – ৫২
৫৩. শকওয়েভ – ৫৩
৫৪. শকওয়েভ – ৫৪
৫৫. শকওয়েভ – ৫৫
৫৬. শকওয়েভ – ৫৬
৫৭. শকওয়েভ – ৫৭
৫৮. শকওয়েভ – ৫৮
৫৯. শকওয়েভ – ৫৯
৬০. শকওয়েভ – ৬০
৬১. শকওয়েভ – ৬১
৬২. শকওয়েভ – ৬২
৬৩. শকওয়েভ – ৬৩
৬৪. শকওয়েভ – ৬৪
৬৫. শকওয়েভ – ৬৫
৬৬. শকওয়েভ – ৬৬
৬৭. শকওয়েভ – ৬৭
৬৮. শকওয়েভ – ৬৮
৬৯. শকওয়েভ – ৬৯
৭০. শকওয়েভ – ৭০
৭১. শকওয়েভ – ৭১
৭২. শকওয়েভ – ৭২
৭৩. শকওয়েভ – ৭৩
৭৪. শকওয়েভ – ৭৪
৭৫. শকওয়েভ – ৭৫
৭৬. শকওয়েভ – ৭৬
৭৭. শকওয়েভ – ৭৭
৭৮. শকওয়েভ – ৭৮
৭৯. শকওয়েভ – ৭৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন