শকওয়েভ – ২২

কাজী আনোয়ার হোসেন

বাইশ

উড়ন্ত কোনও রকেটশিপে উঠেছে যেন ওরা। ঝাপসা দৃষ্টিতে পাতাল-সমাধির ছাতে সৃষ্টি হওয়া ফোকর দিয়ে দেখতে পাচ্ছে গির্জার জ্বলন্ত কড়িকাঠ।

চুম্বকের মত রানার সঙ্গে সেঁটে রয়েছে সেলেনা। শ্বাস নিচ্ছে হাঁপানি রোগীর মত। বুকের ভিতরটায় মনে হচ্ছে, কেউ যেন পেট্রোল ভরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। টিপ টিপ করছে কপালের দুই পাশ। কুলুঙ্গির সামনে দিয়ে তাপ আর শিখার আরেকটা ঝাপটা বয়ে গেলে নিজেকে গুটিয়ে নিল আরও।

মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে রানার। বড় আশা করে ওর কাছে এসেছে সেলেনা। অথচ দু’জনকেই মরতে হচ্ছে আজ জ্যান্ত কাবাব হয়ে!

আগুন! ভূমিকম্প! বজ্রধ্বনি! পাথরধস! এই সব বিশৃঙ্খলার মাঝে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত মাথায় ভেঙে পড়তে চলেছে আস্ত গির্জাটাই।

এসব থেকে মনটা সরাতে চাইল রানা। আচ্ছা, মারা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কীভাবে?

ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে?

জ্যান্ত পুড়ে?

নাকি ইট-কাঠ-পাথরের নিচে চাপা পড়ে?

কথাগুলো মাত্র ভেবেছে রানা, এমন সময় চারপাশ থেকে শুরু হলো কী সব পতনের জোরালো আওয়াজ। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল রানা। ধসে পড়ছে গোটা গির্জা ভেতরের দিকে।

থেমে গেছে ভয়ঙ্কর কাঁপুনিটাও।

কুলুঙ্গির মুখ দিয়ে আসা তাজা বাতাসের স্পর্শ পেল শুষ্ক ঠোঁটে!

আবার শ্বাস নিতে পারছে স্বাভাবিকভাবে!

বেরিয়ে এল ওরা বাইরে। চারপাশের অবস্থা দেখে আঙুল দিয়ে বুকে ক্রুশ আঁকল সেলেনা।

পুরো গির্জাটা ধসে গেছে। একটা দেয়ালও আস্ত নেই। ধিকিধিকি জ্বলা কাঠকয়লার স্তূপের নিচ থেকে বেরিয়ে রয়েছে সেই পবিত্র ক্রুশচিহ্ন, কালো দেখাচ্ছে আগুনে পুড়ে।

ছোট ছোট শিখায় আগুন জ্বলছে এখনও এখানে-ওখানে। ধোঁয়ার সুউচ্চ এক স্তম্ভ উঠে গেছে আকাশপানে, যেন গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছে তারাগুলোকে।

রানার বাহু ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেলেনা। আগুনের আভার প্রতিফলন ঘটছে ঘাম আর অশ্রুভেজা চেহারাটায়। কালি লেগে রয়েছে দু’গালে। লাল চুলগুলো ধুলোয় ধূসর।

হঠাৎ কী হলো… কাছে টেনে নিয়ে সেলেনার ঠোঁটে চুমু দিল রানা। সাহসী মেয়ে!

‘রানা!’ কাষ্ঠহাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। কণ্ঠে চাপা উল্লাস। ‘মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় জীবন পেলাম! তা-ই না?’

‘হ্যাঁ!’ নিজের কানেই ফাঁপা শোনাল রানার কণ্ঠস্বর। ‘এত বড় ভূমিকম্পের পর বেঁচে যাওয়াটা অলৌকিক ব্যাপার।’

‘ভূমিকম্প নয়, রানা! বুঝতে পারোনি তুমি?’

‘এ ছাড়া আর কী? কী বুঝতে পারিনি?’

‘অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছিলাম না কন্ট্রোলগুলো। নিশ্চয়ই অজান্তেই চাপ পড়ে গিয়েছিল বিশেষ কোনও বাটনে। ওই অবস্থাতেই ঢুকিয়ে দিই ওটা ওদিককার দেয়ালের একটা গর্তের মধ্যে।’ ধোঁয়া ওঠা একটা স্তূপ দেখাল সেলেনা।

‘কী বলছ… বুঝতে পারছি না!’

‘নিশ্চয়ই কোনভাবে চার্চের ন্যাচারাল ফ্রিকিউয়েন্সির সঙ্গে সমন্বিত হয়ে গেছে ডিভাইসটা। সত্যি সত্যি তা-ই ঘটেছে কি না, কখনোই বোধ হয় জানতে পারব না আমরা; কবর খুঁড়ে ভাঙাচোরা যন্ত্রটা বের করে আনলেও না। তাতে কী! অন্তত শিয়োর তো হলাম, কাজ করে ওটা!’

কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না রানা। চোখের সামনে ভিন গ্রহের প্রাণী দেখলেও বোধ করি আশ্চর্য হতো না এতটা

‘অরিজিনাল টেসলা ডিভাইস কাজ করত অ্যানালগ সিস্টেমে,’ কথার সুতো ধরল মেয়েটা। ‘ম্যানুয়ালি করতে হতো সমন্বয়।’

‘দাঁড়াও… দাঁড়াও!’ এই বার বাধা দিল রানা। ‘তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাইছ না—ছোট ওই মেশিনটার কেরামতি এটা?’

বিমল হাসছে সেলেনা। ‘এর চেয়ে বোধ হয় মিরাকলেই বিশ্বাস করা সহজ হবে তোমার জন্যে!’

এবারও জবাব জোগাল না রানার মুখে। নিরীহদর্শন ওই যন্ত্রের দক্ষযজ্ঞ এসব? বিশ্বাস করতে চায় না মন। সেলেনার কথা যদি সত্যি হয়…

‘আরেকটু হলেই তো সেইমসাইড হয়ে যেত!’ বেরিয়ে গেল ওর মুখ দিয়ে।

‘হয়নি তো, রানা; হয়েছে?’ আবারও হাসল মেয়েটা।

শরীর ঝাড়াঝুড়ো দিয়ে ভদ্রস্থ হওয়ার চেষ্টা করল সেলেনা। আস্তিনে মুছল মুখের কালিঝুলি।

রানা খুঁজছে ওর ব্যাগটা।

পাওয়া গেল ওটা। খানিকটা পুড়ে গেছে আগুনে। গরম হয়ে রয়েছে ভিতরের জিনিস।

‘সেরেছে!’ প্রমাদ গনল ও মনে মনে। আগুনের তাপে নষ্ট না হলেই হয় রিমোট হার্ড ড্রাইভটা!

মেশিন কারবাইনটা বের করে দেখল, ঠিকঠাক রয়েছে কি না। না, ঠিকই আছে। অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ মোকাবেলার জন্য হাতেই রাখল ওটা।

বেরিয়ে এল ওরা ধ্বংসস্তূপ মাড়িয়ে।

‘কী মনে হয়, রানা?’ বলল সেলেনা নার্ভাস স্বরে। ভীত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে গাছগাছালির অন্ধকারের দিকে। ‘ওরা কি এখনও রয়েছে আশপাশে?’

‘না থাকলেই ভালো হবে ওদের জন্যে,’ কঠোর শোনাল রানার জবাবটা। ‘শালাদের টেকনিক পছন্দ হয়নি আমার।’

কিন্তু ফলাফল দেখার জন্য অপেক্ষায় নেই কেউ। চরাচর নির্জন।

এগোল দু’জনে ফটকের দিকে। খটখটে শুকনো ক্ষুধার্ত ফুসফুসে রাতের তাজা বাতাস টেনে নিচ্ছে প্রাণভরে। আস্তে আস্তে বুকের উপর থেকে সরে যাচ্ছে সাঁড়াশির চাপ।

অবিকল আগের মতই রয়েছে যেন সব কিছু। এখনও তালা ঝুলছে গেটে। এখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে বিএমডাব্লিউ সেভেন সিরিজের গাড়িটা। যেন ওরা দু’টি মাত্র প্রাণী ছাড়া কেউ আসেনি এই দিকে

গেট ডিঙাল দু’জনে। রানাই নামল প্রথমে অপর পাশে। ক’গজ দূরে দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়িটার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল ও। কী একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে মনে।

‘আমরা যে এখানে এসেছি, জানত ওরা,’ বলল ও সেলেনাকে। ‘কী করে জানল? কেউ তো ফলো করেনি আমাদের প্যারিস থেকে! তা হলে এখানে আমাদেরকে ওরা লোকেট করল কীভাবে?’

‘কীভাবে, রানা?’

‘হাজারো উপায় রয়েছে,’ নিজেই দিল রানা নিজের প্রশ্নের উত্তর। ‘কিন্তু কোনটাই যুক্তিগ্রাহ্য মনে হচ্ছে না।

কিছুক্ষণ চিন্তা করল সেলেনা। ‘এমন কি হতে পারে, রানা, মনমার্দাতেই ছিল ওরা ঘাপটি মেরে… ক্যারেনের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার সময় থেকেই ছিলাম ওদের চোখে চোখে? পাবলিক প্লেসে হয়তো করতে চায়নি কিছু, মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট হতো তাতে। তবে যেহেতু অনুসরণ করেনি, সেক্ষেত্রে একটা সম্ভাবনাই মাথায় আসছে আমার…’

‘কী সেটা?’

‘ট্র্যাকিং ডিভাইস।’

‘গুড শট।’

‘দেখা যাক, রয়েছে কি না। তেমন কিছু পাওয়া গেলে, কোনও ঝোপের মধ্যে ফেলে দিতে পারি ওটা,’ বুদ্ধি জোগাল সেলেনা। ‘এতে যারা দূর থেকে মনিটর করছে আমাদের, ভাববে, এখনও এখানেই রয়েছে গাড়িটা। এভাবে ওদের নজর এড়িয়ে ফিরতে পারব আমরা প্যারিসে। … আরেকটা কাজ করা যায়। ধরো, কোনও ট্রাকের পিছনে লাগিয়ে দিলাম ডিভাইসটা। জার্মানি কিংবা আরও দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিলাম নচ্ছারগুলোকে।’

পিছন ফিরল রানা। গগনচুম্বী ধোঁয়ার দিকে তাকাল। আগুন নিভে গেলেও, বহু দূর থেকে চোখে পড়বে ধোঁয়া।

‘কেউ না কেউ রিপোর্ট করেছে নিশ্চয়ই আগুন দেখে,’ বলল ও। ‘যে-কোনও মুহূর্তে এসে হাজির হবে পুলিস, অ্যামবুলেন্স আর দমকল বাহিনী। তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে, ইচ্ছে করেই লাগানো হয়েছে আগুনটা। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসবে রিপোর্টারেরা। গাড়িটা তখনও এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে নানান থিয়োরির জন্ম দেবে ওরা…’

‘কী বলতে চাইছ, রানা?’

‘বলতে চাইছি, এখানেই ফেলে যেতে হবে গাড়িটা।’

‘কেন… কেন?’ বিস্মিত সেলেনা।

‘নিশ্চিত থাকতে পারো, টিভি আর রেডিয়োর খবরের দিকে খেয়াল রাখবে আমাদের বন্ধুরা। নিউজে অ্যালপিনাটার কথা বলা না হলে সন্দেহ হবে ওদের। হয়তো ভাববে, বেঁচে গেছি কোনভাবে। শুরু হবে তখন তত্ত্বতালাশ। গাড়িটা ফেলে গিয়ে মনোযোগ ডাইভার্ট করে দিতে হবে ওদের। আবার ধরা পড়ার আগে কিছুটা সময় পাচ্ছি তাতে।

‘ধরা পড়ে যাব?’ সেলেনার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

‘পড়াই তো উচিত।’

সকল অধ্যায়

১. শকওয়েভ – ১
২. শকওয়েভ – ২
৩. শকওয়েভ – ৩
৪. শকওয়েভ – ৪
৫. শকওয়েভ – ৫
৬. শকওয়েভ – ৬
৭. শকওয়েভ – ৭
৮. শকওয়েভ – ৮
৯. শকওয়েভ – ৯
১০. শকওয়েভ – ১০
১১. শকওয়েভ – ১১
১২. শকওয়েভ – ১২
১৩. শকওয়েভ – ১৩
১৪. শকওয়েভ – ১৪
১৫. শকওয়েভ – ১৫
১৬. শকওয়েভ – ১৬
১৭. শকওয়েভ – ১৭
১৮. শকওয়েভ – ১৮
১৯. শকওয়েভ – ১৯
২০. শকওয়েভ – ২০
২১. শকওয়েভ – ২১
২২. শকওয়েভ – ২২
২৩. শকওয়েভ – ২৩
২৪. শকওয়েভ – ২৪
২৫. শকওয়েভ – ২৫
২৬. শকওয়েভ – ২৬
২৭. শকওয়েভ – ২৭
২৮. শকওয়েভ – ২৮
২৯. শকওয়েভ – ২৯
৩০. শকওয়েভ – ৩০
৩১. শকওয়েভ – ৩১
৩২. শকওয়েভ – ৩২
৩৩. শকওয়েভ – ৩৩
৩৪. শকওয়েভ – ৩৪
৩৫. শকওয়েভ – ৩৫
৩৬. শকওয়েভ – ৩৬
৩৭. শকওয়েভ – ৩৭
৩৮. শকওয়েভ – ৩৮
৩৯. শকওয়েভ – ৩৯
৪০. শকওয়েভ – ৪০
৪১. শকওয়েভ – ৪১
৪২. শকওয়েভ – ৪২
৪৩. শকওয়েভ – ৪৩
৪৪. শকওয়েভ – ৪৪
৪৫. শকওয়েভ – ৪৫
৪৬. শকওয়েভ – ৪৬
৪৭. শকওয়েভ – ৪৭
৪৮. শকওয়েভ – ৪৮
৪৯. শকওয়েভ – ৪৯
৫০. শকওয়েভ – ৫০
৫১. শকওয়েভ – ৫১
৫২. শকওয়েভ – ৫২
৫৩. শকওয়েভ – ৫৩
৫৪. শকওয়েভ – ৫৪
৫৫. শকওয়েভ – ৫৫
৫৬. শকওয়েভ – ৫৬
৫৭. শকওয়েভ – ৫৭
৫৮. শকওয়েভ – ৫৮
৫৯. শকওয়েভ – ৫৯
৬০. শকওয়েভ – ৬০
৬১. শকওয়েভ – ৬১
৬২. শকওয়েভ – ৬২
৬৩. শকওয়েভ – ৬৩
৬৪. শকওয়েভ – ৬৪
৬৫. শকওয়েভ – ৬৫
৬৬. শকওয়েভ – ৬৬
৬৭. শকওয়েভ – ৬৭
৬৮. শকওয়েভ – ৬৮
৬৯. শকওয়েভ – ৬৯
৭০. শকওয়েভ – ৭০
৭১. শকওয়েভ – ৭১
৭২. শকওয়েভ – ৭২
৭৩. শকওয়েভ – ৭৩
৭৪. শকওয়েভ – ৭৪
৭৫. শকওয়েভ – ৭৫
৭৬. শকওয়েভ – ৭৬
৭৭. শকওয়েভ – ৭৭
৭৮. শকওয়েভ – ৭৮
৭৯. শকওয়েভ – ৭৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন