শকওয়েভ – ৫১

কাজী আনোয়ার হোসেন

একান্ন

প্রায় মাঝবিকেলে পৌঁছুল ওরা নিদ্রালু এয়ারফিল্ডে।

নতুন কোনও বিমান আসেনি এখানে। যেখানটায় যেভাবে ছেড়ে গিয়েছিল, সেভাবেই মরা রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ব্রেযনেভ এসটি-ওয়ান। এয়ারক্রাফটের বিচিত্র নমুনাগুলোর একটাও, এমনকী ওড়ার উপযুক্ত যেগুলো, সেগুলোও জায়গা বদল করেনি এক ইঞ্চি।

‘আপনাদের প্লেন?’ গুস্তাফ ভিকান্দারের মুগ্ধ দৃষ্টি সরছে না টার্বোপ্রপের উপর থেকে।

‘না!’ জবাব দিল রানা চাঁছাছোলা কণ্ঠে। ‘ওটায় করে এসেছি আমরা!’ হ্যাঙারের পাশে দাঁড়ানো সুইডিশ মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফটটার দিকে ইঙ্গিত করল ও। আংশিক খুলে ফেলা হয়েছে বিমানটা।

গিবসনের সঙ্গে লড়তে গিয়ে সারা দেহে ক্ষত আর কালশিরে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে রানার। সেজন্য খিঁচড়ে রয়েছে মেজাজটা। প্রথমে নিজে উঠল প্লেনে। আইলে ওদের ব্যাগগুলো ফেলে প্রথমেই অপ্রশস্ত ফিউয়েলাজ ধরে এগোল বাথরুমের দিকে। রক্ত, ধুলোময়লায় যা-তা হওয়া চেহারাটা ধুয়ে নেয়ার জন্য পানি ছিটাল মুখে। স্বস্তির বিষয় হলো, বেশির ভাগ রক্তই ওর নিজের নয়।

ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে দেখে, দামি আর্টিফিশাল লেদারের আর্মচেয়ারে ইতোমধ্যে রাজার মত জাঁকিয়ে বসেছে গুস্তাফ। দেখে মনে হচ্ছে, মলিন পোশাক পরা ছিটগ্রস্ত কোনও বিজনেস-ক্লাস প্যাসেঞ্জার এক গ্লাস ঠাণ্ডা শারির জন্য অপেক্ষায় রয়েছে এয়ারহোস্টেসের।

ওকে পাশ কাটিয়ে ককপিটে ঢুকে পড়ল রানা।

ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলে বসানো কমপিউটার টার্মিনালের দিকে চিন্তামগ্নভাবে তাকিয়ে রয়েছে কো-পাইলটের সিটে বসা সেলেনা।

‘বেশ লম্বা অভিযান আমাদের সামনে,’ পাশের পাইলট সিটে আসন নেয়ার পর, বলল ও রানাকে। ‘যাত্রাপথ নিয়ে ভেবেছ কিছু?

ঘাড় দোলাল রানা। ‘ভেবেছি।’ জঙ্গুলে আর পার্বত্য পথ ধরে জাকউইক ফেরার ফাঁকে মাথার মধ্যে পৃথিবীর মানচিত্র বিছিয়ে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের সম্ভাব্য রুটগুলোর তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছে ও। কন্ট্রোলের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে মৃদু টোকা দিল একটা ডিজিটাল রিড-আউটে। ‘এটা বলছে, এখনও এক হাজার মাইলের বেশি চলার মত ফিউল রয়েছে আমাদের। বার্লিন বা তার কাছাকাছি পর্যন্ত যাওয়া যাবে এ দিয়ে। পৌঁছে যাব সন্ধ্যার মধ্যে। ফিউল আর কিছু সাপ্লাই নিয়ে পরবর্তী যাত্রার আগে ওখানেই কাটিয়ে দেব রাতটা।’

মাথা ঝাঁকিয়ে অনবোর্ড কমপিউটারের কিবোর্ডে হাত রাখল সেলেনা।

‘ভাগ্য ভালো যে, ওয়াই-ফাই রিসেপশন পাচ্ছি।’ অনলাইন সার্চের জন্য তৈরি ও। ‘কী খুঁজব, বলো তো!’

‘ছোট আর দূরের কোনও জায়গা। যে-কোনও শহরেই ডজন ডজন ছোটখাটো এয়ারফিল্ড থাকে কাছাকাছির মধ্যে, যেগুলোতে তেমন ভিড়ভাট্টা থাকে না। দুম করে বড় কোনও এয়ারপোর্টে নামতে পারব না আমরা। তা ছাড়া, ওসব জায়গায় জেট এ ফিউল পাবে তুমি সেভেন ফরটি সেভেনের জন্যে। কিন্তু হানড্রেড এলএল আভগ্যাস পাওয়ার গ্যারান্টি নেই কোনও। অথচ ওটাই প্রয়োজন আমাদের।’

‘বুঝেছি।’ বার্লিনের কাছাকাছি এয়ারফিল্ড লিখল সেলেনা কিওঅর্ডে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে খুঁটিয়ে দেখল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আসা ফলাফলগুলো। ‘এই যে… দ্য ফ্লুগঅ্যাকাডেমি ফ্রেইহফ। বার্লিনের দক্ষিণে পাণ্ডববিবর্জিত একটা এলাকা। এটা মনে হচ্ছে কাজে আসবে আমাদের। আসলে ফ্লাইং স্কুল ওটা একটা। তবে ছোটখাটো চার্টার এয়ারলাইন আর প্রাইভেট প্লেনগুলো ব্যবহার করে ওটাকে এয়ারফিল্ড হিসেবে।’

‘হ্যাঁ… চলবে মনে হচ্ছে।’

একটা কি চাপল রানা। এসটি-ওয়ানের সফিস্টিকেটেড ফ্লাইট কমপিউটার স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রবেশ করল ল্যাটিচ্যুড ও লঙ্গিচ্যুড কো-অর্ডিনেট এবং আলটিচ্যুড ও রানওয়ে লেংথ ডেটায়। সেই সঙ্গে সিস্টেমে প্রি-সেট করল এয়ারফিল্ডের রেডিয়ো ফ্রিকিউয়েন্সি।

পরবর্তী একটি ঘণ্টা কাটাল ওরা সবচেয়ে ভালো রুটটা বাছাই করার পিছনে। দূরত্বের খুঁটিনাটি, ফিউল রেঞ্জ ক্যালকুলেশন, টাইম জোন এবং মাইলকে নটিকাল মাইলে রূপান্তরের হিসাবনিকাশ দিয়ে নোটপ্যাড ভরিয়ে তুলল সেলেনা। প্রতিটা পয়েন্ট হিসাব করতে গিয়ে একটু পর পরই তাকাতে হচ্ছে সাত হাজার মাইলের বেশি সর্বমোট দূরত্বের রিড-আউটের দিকে। যত বার রিফিউল করতে হবে, তত জায়গায় পয়েন্ট করা হয়েছে রুটটা।

জার্মানি থেকে যে-পথটার খসড়া করা হলো, ষোলো শত মাইল দক্ষিণ-পুবে জর্জিয়ার তিবিলিসি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে ওদের ব্রেযনেভ এসটি-ওয়ানের ফিউল। যাত্রাপথে স্বায়ত্তশাসিত বা আধা-স্বায়ত্তশাসিত মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলোর উপর দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে উড়তে হবে ওদেরকে।

এর পর মহাসাগরের উপর দিয়ে দীর্ঘ উড়াল শেষে পৌঁছুবে ওরা ভারতের দক্ষিণতম অংশে। ইণ্টারনেটে খুঁজে- পেতে বের করা অপ্রধান এয়ারফিল্ডটি বেঙ্গালুরু থেকে কয়েক মাইল দূরে।

রানার অভিজ্ঞতায়, সচরাচর বেশ স্বাচ্ছন্দ্যময় জায়গা ভারত দেশটা। আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির ঘুণপোকা ভিতরটা ফোপরা করে ফেললেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনুকূল তা রানাদের জন্য। পয়সাকড়ির অভাব নেই ওদের। কোথাও না আটকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলে খুশি করে দিতে হবে দুয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে।

এর পর যাত্রার পঞ্চম ও শেষ পর্ব। ভারত মহাসাগর পেরিয়ে মেডান। উত্তর সুমাত্রার রাজধানী ওটা।

‘আশা করছি, প্লেন রাখার জন্যে নিরাপদ কোনও জায়গা পেয়ে যাব ওখানে,’ বলল রানা। ‘এর পর ভাড়া করতে হবে গাড়ি। ঘাঁটির পথ দেখাবে আমাদের গুস্তাফ ভিকান্দার।’

সম্পূর্ণ উড়ালপথের রিড-আউটের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে মাথা নাড়ল সেলেনা। ‘গড়পড়তা দু’শ’ পঁচাশি নট ক্রুজ স্পিডে, যাত্রাবিরতি আর রিফিউলিং সহ হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, আটচল্লিশ ঘণ্টার মত লাগছে মেডান পৌঁছুতে। আমার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে, রানা… প্রায় দুটো দিন প্লেনটাকে ওড়াতে হবে তোমার!’

‘চিন্তা কোরো না ও-নিয়ে,’ হেসে বলল রানা। ‘এ-ই আমাদের শেষ সুযোগ। অর্ধেক দুনিয়া পাড়ি দেয়ার পর যদি দেখা যায়, ফক্কা সব—খেল খতম! সেটা যেন না হয়, সেই প্রার্থনাই করো।’

সকল অধ্যায়

১. শকওয়েভ – ১
২. শকওয়েভ – ২
৩. শকওয়েভ – ৩
৪. শকওয়েভ – ৪
৫. শকওয়েভ – ৫
৬. শকওয়েভ – ৬
৭. শকওয়েভ – ৭
৮. শকওয়েভ – ৮
৯. শকওয়েভ – ৯
১০. শকওয়েভ – ১০
১১. শকওয়েভ – ১১
১২. শকওয়েভ – ১২
১৩. শকওয়েভ – ১৩
১৪. শকওয়েভ – ১৪
১৫. শকওয়েভ – ১৫
১৬. শকওয়েভ – ১৬
১৭. শকওয়েভ – ১৭
১৮. শকওয়েভ – ১৮
১৯. শকওয়েভ – ১৯
২০. শকওয়েভ – ২০
২১. শকওয়েভ – ২১
২২. শকওয়েভ – ২২
২৩. শকওয়েভ – ২৩
২৪. শকওয়েভ – ২৪
২৫. শকওয়েভ – ২৫
২৬. শকওয়েভ – ২৬
২৭. শকওয়েভ – ২৭
২৮. শকওয়েভ – ২৮
২৯. শকওয়েভ – ২৯
৩০. শকওয়েভ – ৩০
৩১. শকওয়েভ – ৩১
৩২. শকওয়েভ – ৩২
৩৩. শকওয়েভ – ৩৩
৩৪. শকওয়েভ – ৩৪
৩৫. শকওয়েভ – ৩৫
৩৬. শকওয়েভ – ৩৬
৩৭. শকওয়েভ – ৩৭
৩৮. শকওয়েভ – ৩৮
৩৯. শকওয়েভ – ৩৯
৪০. শকওয়েভ – ৪০
৪১. শকওয়েভ – ৪১
৪২. শকওয়েভ – ৪২
৪৩. শকওয়েভ – ৪৩
৪৪. শকওয়েভ – ৪৪
৪৫. শকওয়েভ – ৪৫
৪৬. শকওয়েভ – ৪৬
৪৭. শকওয়েভ – ৪৭
৪৮. শকওয়েভ – ৪৮
৪৯. শকওয়েভ – ৪৯
৫০. শকওয়েভ – ৫০
৫১. শকওয়েভ – ৫১
৫২. শকওয়েভ – ৫২
৫৩. শকওয়েভ – ৫৩
৫৪. শকওয়েভ – ৫৪
৫৫. শকওয়েভ – ৫৫
৫৬. শকওয়েভ – ৫৬
৫৭. শকওয়েভ – ৫৭
৫৮. শকওয়েভ – ৫৮
৫৯. শকওয়েভ – ৫৯
৬০. শকওয়েভ – ৬০
৬১. শকওয়েভ – ৬১
৬২. শকওয়েভ – ৬২
৬৩. শকওয়েভ – ৬৩
৬৪. শকওয়েভ – ৬৪
৬৫. শকওয়েভ – ৬৫
৬৬. শকওয়েভ – ৬৬
৬৭. শকওয়েভ – ৬৭
৬৮. শকওয়েভ – ৬৮
৬৯. শকওয়েভ – ৬৯
৭০. শকওয়েভ – ৭০
৭১. শকওয়েভ – ৭১
৭২. শকওয়েভ – ৭২
৭৩. শকওয়েভ – ৭৩
৭৪. শকওয়েভ – ৭৪
৭৫. শকওয়েভ – ৭৫
৭৬. শকওয়েভ – ৭৬
৭৭. শকওয়েভ – ৭৭
৭৮. শকওয়েভ – ৭৮
৭৯. শকওয়েভ – ৭৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন