শকওয়েভ – ১০

কাজী আনোয়ার হোসেন

দশ

এ ধরনের পরিস্থিতি নতুন নয় রানার জন্য। শুধু রিফ্লেক্সের কারণে ডান পায়ে চাপ দিয়ে এক লাফে বিল্ডিঙের আড়ালে ফিরে আসতে পারল ও। আরও দুটো গুলির আওয়াজ হলো প্রথমটার পর পরই। পড়েই যাচ্ছিল, কিন্তু দুই হাতে জড়িয়ে ধরে ওকে খাড়া রাখল সেলেনা।

আকস্মিক আঘাতে প্রায় অবশ হয়ে গেছে রানার পা।

অস্ত্রটা ছেড়ে দিয়ে ঊরু আঁকড়ে ধরল রানা দুই হাতে। পরিষ্কার দেখতে পেল বুলেটের গর্তটা, জিনস ভেদ করে গুলি ঢুকেছে ভিতরে। অবশ হয়ে গেছে নিতম্ব থেকে হাঁটু পর্যন্ত!

প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল রানা। বেরিয়ে এল ম্যাগাজিন দুটো। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাঁকা হয়ে গেছে ওগুলোর একটা। প্রচণ্ড ঘা খেয়ে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে কঠিন অ্যালয়।

বুলেটের আঘাত বেশির ভাগটাই গেছে ম্যাগাজিনের উপর দিয়ে। তবে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার চিহ্ন নেই কেন? আর রক্ত? গেল কোথায়?

চামড়ায় তপ্ত কিছুর ছোঁয়া পাচ্ছে রানা। পকেটের আরও গভীরে হাত ঢুকিয়ে পেয়ে গেল তামা আর সীসের চ্যাপ্টা, খাঁজ কাটা চাকতিটা। নাইন মিলিমিটার বুলেটের শেষ পরিণতি ওটা।

স্বস্তিতে ছেয়ে গেল রানার অন্তর। আবারও স্বাভাবিক স্পন্দন শুরু হলো হৃদযন্ত্রে। বাতিল ম্যাগাজিনটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিচ থেকে আবার তুলে নিল বেরেটা।

চেপে রাখা শ্বাস ছাড়ল সেলেনা। ‘ভেবেছিলাম, গুলি খেয়েছ তুমি!’

‘বুলেটের ব্যাপারে বরাবরই ভাগ্যটা আমার অনুকূলে থাকে বলতে পারো,’ সরস মন্তব্য রানার। যেদিক থেকে গুলি এসেছে, সেদিকে আবারও সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কোনা থেকে।

বেশি দূরে নয় আক্রমণকারী… তিরিশ কি চল্লিশ গজ তফাতে আড়াল নিয়েছে কোথাও। শিকারির পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতীক্ষায় রয়েছে, আবার কখন ফাঁকায় পাবে ওদেরকে।

কোথায় থাকতে পারে লোকটা?

সিমেন্টের ব্যাগ অথবা ইটের পাঁজার ওপাশে?

নাকি নিচু ওই দেয়ালটার পিছনে?

সাব-মেশিন গানের ব্যারেলটা কোনা দিয়ে বের করে ট্রিগার চেপে এপাশ-ওপাশ বুলিয়ে আনল রানা। মোরব্বার মত ঝাঁঝরা হয়ে গেল সিমেন্টের ব্যাগগুলো। পাঁজার ইটগুলোকে একত্র করে রাখা টেপটা ছিঁড়ে হুড়মুড় করে নিচু দেয়ালের উপর আর পিছনদিকে ধসে পড়ল স্তূপ।

সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল একটা আর্তচিৎকার। এতগুলো ইটের ঘা খেয়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা ‘অদৃশ্য’ শত্রুর।

হামাগুড়ি দিয়ে সরে এল সে দেয়ালের আড়াল থেকে, এঁকেবেঁকে ছুটতে আরম্ভ করল পিছনের বিল্ডিংগুলোর দিকে।

জায়গায় দাঁড়িয়েই গুলি শুরু করল রানা। কিন্তু দুটো গুলির পরই খালি হয়ে গেল ম্যাগাজিন। লাইফ-লাইন পেয়ে আবার অদৃশ্য হলো দুশমন।

বিড়বিড় করে গাল বকতে বকতে অস্ত্রে ঢোকাল রানা অবশিষ্ট ম্যাগাজিনটা। খর দৃষ্টি রেখেছে দালানগুলোর উপর, যেগুলোর কোনটার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে অস্ত্রধারী।

নীরবতা। পাল্টা কোনও গুলি এল না ওদিক থেকে।

দ্রুত চলছে রানার মস্তিষ্ক। চেষ্টা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে একবার, দ্বিতীয় বার আর খোলা জায়গায় বেরোনোর খায়েশ ওর নেই।

শুটারও নিশ্চয়ই সামনে থেকে নজর রাখবে না আর ওদের মুভমেন্টের উপর! বরঞ্চ ঘুরপথে এসে অ্যামবুশের চেষ্টা চালাবে। রানা নিজে হলে ঠিক তা-ই করত।

তাড়াতাড়ি একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে ওকে। ভুলচুক করলেই মাশুল দিতে হবে জানটা খুইয়ে।

তৃতীয় আরেকটা অপশন বেছে নিল রানা। সামনেও যাবে না, পিছনেও নয়। উঠে পড়বে উঁচু কোথাও।

ভারাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করল আঙুল তুলে। বিবশ ভাবটা কেটে গিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক এখন বাঞ্চ পা, রয়ে গেছে কেবল অস্বস্তিকর জ্বালাটুকু।

ব্যথা উপেক্ষা করে চারতলার ছাতে উঠে যাওয়া মইয়ের কাছে চলে এল রানা। আগে উঠতে বলল সেলেনাকে।

চারপাশে চেয়ে বুঝে ফেলল রানা নির্মাণশ্রমিকদের আজ আগেভাগে ছুটি দেয়ার কারণটা। বিশাল এক আণ্ডারগ্রাউণ্ড ওয়াটার-রিযারভয়েরের তলীটা ঢালাই হয়ে যেতেই আজ ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে।

যতক্ষণ না প্রথম ভারাটাতে পৌঁছুল সেলেনা, নিচেই দাঁড়িয়ে রইল রানা। ও উঠে যাওয়ার পর পরই মই বাইতে শুরু করল রানা নড়বড়ে তক্তা লক্ষ্য করে।

সেলেনা ততক্ষণে মই বেয়ে রওনা হয়ে গেছে পরবর্তী লেভেলের দিকে। চারতলার ছাতে উঠে থামল ওরা। কিন্তু কোনও দিকেই লোকটার চিহ্ন দেখা গেল না।

গোটা বিল্ডিংটাই ঘিরে দেয়া হয়েছে মাচা দিয়ে। সাবধানে পা ফেলে সেলেনাকে নিয়ে চলল রানা দালানটার পিছনদিকে। বিল্ডিং-কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য মাচাগুলো আবার তারের জালের সেফটি ব্যারিয়ার দিয়ে ঘেরাও করা। জাল ভেদ করে দেখতে পাচ্ছে রানা পাশের বিল্ডিঙে যাওয়ার পাদানিগুলো। ছুরির পিঠ দিয়ে মসৃণ করা ধূসর পরিজের মত দেখতে লাগছে ওগুলোকে।

কংক্রিটের চকচকে পিচ্ছিল সরু সারফেসের উপর দিয়ে যাবে কি যাবে না, কয়েক মুহূর্ত তা নিয়ে দোটানায় ভুগল রানা। শেষমেশ ভাবল, কেই সারা সারা—যা হওয়ার, তা হবে!

রেইলিং আঁকড়ে ধরেছে সেলেনা। ‘আমার উচ্চতা- ভীতির কথা বলেছি কখনও তোমাকে?’ ভুলেও তাকাচ্ছে না ও নিচের দিকে।

‘আর উপায় তো নেই… চলে এসো।’ গম্ভীরভাবে পা বাড়াল রানা।

নিচে একবার ঝাড়ু দিয়ে এল ওর দৃষ্টি। চল্লিশ ফুট উঁচুতে রয়েছে ওরা। চমৎকার নজর রাখা যাচ্ছে এখন সাইটের উপর। কিন্তু না, প্রতিপক্ষের নামনিশানা নেই কোথাও।

পাদানিতে পা রাখল রানা। সাবধানে এগোতে এগোতে বিল্ডিং, গ্যারাজ, কনস্ট্রাকশন ইকুপমেন্ট—ভালো মত দেখে নিচ্ছে সম্ভাব্য আত্মগোপনের জায়গাগুলো।

নাহ!

হঠাৎ মেয়েটা ‘খোঁত’ করে উঠতেই একটা হার্টবিট মিস করল ও। ঘুরল পাঁই করে।

ঘুরপথই বেছে নিয়েছে বদমায়েশটা। রানাদের মতই নিচে না থেকে উঠে এসেছে উপরে। পিছন থেকে এসে পাকড়াও করেছে সেলেনাকে। এক হাতে ওর গলা পেঁচিয়ে ধরে, বর্ম হিসাবে ব্যবহার করছে মেয়েটাকে।

ফ্রি হয়ে গেল রানার অস্ত্র ধরা হাতটা।

লোকটার এমএক্সফোরের মোটা সাইলেন্সার টিউব সেলেনার ঘাড়ের পাশে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে চেপে ধরা।

‘অস্ত্র ফেলো,’ নির্দেশ এল নিরাবেগ স্বরে। ‘না হলে মরবে মেয়েটা।’

‘শুট হিম, রানা!’ চেঁচিয়ে উঠল সেলেনা। ‘আমার যা হয়, হোক!’

‘বাহ, বাহ! এক্কেবারে রোমান্টিক সিনেমার ডায়ালগ!’ সাব-মেশিন গানের সাইলেন্সারটা আরও একটু গেঁথে গেল সেলেনার ঘাড়ের মাংসে। গলার উপর থেকে হাতটা সরে এসে চেপে ধরল মুখটা।

মোচড়ামুচড়ি করে ছাড়া পেতে চাইছে বেপরোয়া সেলেনা, পেরে উঠছে না শক্তিশালী লোকটার সঙ্গে। লোকটার হাসি হাসি বিদ্রূপাত্মক অভিব্যক্তিতে লেখা: ‘কাঁচা কাজ করি না আমি, ডারলিং!’

রানাও টের পেয়েছে সেটা। নিষ্ঠুর, মর্মান্তিক মৃত্যু কানের কাছে ফিসফিস করছে। কোনও চালাকি চলবে না এর সঙ্গে। খসে পড়তে দিল ও পাটাতনের দিকে নিচু করা বেরেটাটা।

‘লাথি মেরে ফেলে দাও কিনার দিয়ে,’ পরবর্তী আদেশ এল।

লাথির দরকার হলো না, জুতোর আগা দিয়ে অস্ত্রটায় মৃদু ঠেলা দিল রানা। সেফটি রেইলের নিচের ফাঁক দিয়ে কাত হয়ে হারিয়ে গেল ওটা। মাচানের ধাতব খুঁটির সঙ্গে ঠং-ঠনাৎ বাড়ি খেয়ে পড়ল গিয়ে চল্লিশ ফুট নিচের জমিনে।

‘গুড বয়।’ ক্রূর হাসিতে বেঁকে গেল শয়তানের ঠোঁট।

খেয়াল করল রানা, ট্রিগারে চাপ বাড়াচ্ছে লোকটার আঙুল। সিঙ্গল শটে সেট করা অস্ত্রটার ফায়ার সিলেক্টর। মাযল বিস্ফোরিত হলে কানের নিচ দিয়ে মগজ ভেদ করে বেরিয়ে যাবে গুলি।

‘ট্রিগার টিপলে মরবে তুমি!’ অদ্ভুত শান্ত শোনাল রানার কণ্ঠস্বর।

বিকশিত পদ্ম ফুলের মত মধুর হাসি দিল বাদামিচুলো গানম্যান। ‘আয়ু শেষ তোমার। বেহুদা মুখ খরচা না করে দু’-চার সেকেণ্ড নিজের উপরঅলাকে ডাকো!’

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই এক ঝটকায় সেলেনা নিজেকে ছাড়িয়ে নিলে হাসিটা পরিণত হলো নগ্ন বিস্ময়ে।

মাপা স্পিডে বেরেটাধারীর পায়ের নলী বরাবর জুতোর হিল চালিয়ে দিল সেলেনা, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড চাপে মাড়িয়ে দিল ওর পায়ের আঙুল। কারাতের কৌশলে মুচড়ে দিল আগ্নেয়াস্ত্র ধরা হাতটা।

যন্ত্রণার চোটে সেলেনাকে ‘ওরেব্বাপ!’ ডেকে বসল বীরপুরুষ। ট্রিগারে চাপ পড়তেই কেশে উঠল সাব-মেশিন গান।

ওদের অনেক দূর দিয়ে বেরিয়ে গেল গুলিটা। মাচানের পিছনের দেয়ালে লেগে তীক্ষ্ণ শিস তুলে ছুটল আরেক দিকে

হাতটা এখনও মুচড়ে ধরে রয়েছে সেলেনা, হাঁটু ভাঁজ করে বসাতে চাইছে বদমাশটাকে। খেপা ষাঁড়ের মত মাথা দিয়ে ঢুস দিল ওকে বাদামিচুলো।

চিৎপটাং হয়ে পড়ল বেচারি পাটাতনের উপর। অল্পের জন্য রক্ষা। আরেকটু হলেই নিচে পড়ে যেত সেফটি ব্যারিয়ারের নিচের ফাঁক দিয়ে।

হাঙরের মত হিংস্র মুখভঙ্গি করে অস্ত্র তাক করল লোকটা পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে সেলেনার মাথাটা উড়িয়ে দেয়ার জন্য।

তার আগেই দুনিয়াসেরা দৌড়বিদ উসাইন বোল্টের মত ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা গানম্যানের উপর।

সাব-মেশিন গান ধরা হাতটা নিষ্ঠুরভাবে আছড়াল ও ব্যারিয়ারের গায়ে, খসিয়ে ফেলল অস্ত্রটা। চারতলা থেকে নিচে পড়বার আগেই সর্বশক্তিতে কনুই চালাল রানা প্রতিদ্বন্দ্বীর অ্যাডাম’স অ্যাপল লক্ষ্য করে।

কিন্তু জায়গামত লাগানো গেল না। সামান্য পিছিয়ে গিয়ে রানার আঘাত এড়িয়ে গেল লোকটা।

বড় কঠিন পাত্র সে। কয়েক সেকেণ্ডেই নিজেকে সামলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানার উপর। রেইলের পাশে ধস্তাধস্তি শুরু হলো দু’জনের। সমানে সমান।

নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সেলেনা। এখনও সামলে নিতে পারেনি বেমক্কা গোঁত্তাটা।

ওজনদার একটা ঘুসি এসে পড়ল রানার বাম পাঁজরে। ব্যথার স্রোত ছুটল আশপাশে। পরমুহূর্তে ওর নাকমুখ সই করে কপাল ঠুকল খেপা ষাঁড়।

সুযোগটা কাজে লাগল রানা। আলগোছে সরে গিয়ে শত্রুর মোমেন্টামের সঙ্গে নিজের শক্তি যোগ করে ঠুকে দিল ওর মাথাটা মাচানের খুঁটিতে।

বিকট ‘ঠন্’ আওয়াজে থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা স্ট্রাকচার।

তাতেও সন্তুষ্ট নয় রানা। প্রতিপক্ষের শরীরটা ঘুরিয়ে দিয়ে দু’হাতে এবার মুচড়ে ধরল ওর কান দুটো। কান টানলে মাথা আসে। পিছিয়ে এনে আবারও লোকটার নারকেল ফাটাল রানা লোহার পাইপে আছড়ে। ফাটা নারকেল নিচু হতেই ধাতব খুঁটিতে দেখা গেল রক্ত।

এবার সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ডান হাঁটু দিয়ে মারল রানা ওর নাভি বরাবর।

মাতালের মত টলমল করতে করতে সেফটি রেইলিঙের উপর চিত হয়ে পড়ল পরাস্ত দুশমন। বেঁকে গেল তারের জাল। একদিকের জয়েন্ট খুলে গিয়ে রেইলিং থেকে আলগা হয়ে ঝুলতে লাগল ব্যারিয়ারের গোটা একটা অংশ।

রক্ত মাখা মুখটা এবার লক্ষ্য রানার। গায়ের জোরে একটা বিরাশি সিক্কা হেঁকেই কাতরে উঠল নিজেই। দাঁতে লেগে কেটে গেছে ওর আঙুলের গাঁট।

ব্যালান্স ঠিক রাখার জন্য হাত দুটো দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে রক্তাক্ত প্রতিপক্ষ। তা-ও শেষ রক্ষা হলো না। গতি হারিয়ে কাত হয়ে পড়া লাটিমের মত আচমকা একটা পাক খেয়ে লুটিয়ে পড়ল পাটাতনের প্রান্তে। কী ঘটতে যাচ্ছে, হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে হাহাকার উঠে এল বুকের গহীন থেকে। দেহের ঊর্ধ্বাংশের বেশির ভাগটা পাটাতনের বাইরে পড়ায় চল্লিশ ফুট নিচে পড়া এখন অবশ্যম্ভাবী।

হঠাৎই খড়কুটো ঠেকল হাতে! নিচের দিকে রওনা হওয়ার আগেই বাতাসে থাবা মেরে পেয়ে গেল রানার শার্টের আস্তিন।

এমন কিছুর জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না রানা। প্রফেশনাল কিলারের শরীরের ওজনে আচমকা হুমড়ি খেয়ে পড়ল ও পাটাতনের বাইরের দিকে, দেখল উল্কার বেগে উপরে উঠে আসছে নিচের জমিন।

মাচানের একটা খুঁটি ধরে ফেলে পতন ঠেকাল রানা। ঝাঁকুনির চোটে মনে হলো, হাতটা ছিঁড়ে আসবে কাঁধের জয়েন্ট থেকে। তীব্র ব্যথা হাত বেয়ে ছড়িয়ে পড়ল পিঠে।

শূন্যে ঝুলছে ও বিপজ্জনকভাবে। কিছুই নেই পায়ের তলায়!

তলোয়ারের মত বাতাস চিরল সেলেনার চিৎকার।

রানার মত ভাগ্য অত ভালো নয় বদমাশটার। খড়কুটো পেলেও ধরে রাখতে পারেনি। ডিগবাজি খেয়ে চিত হয়ে আছড়ে পড়েছে নির্মীয়মান আণ্ডারগ্রাউণ্ড পানির টাঙ্কির তাল কে তাল ভেজা, নরম কংক্রিটের ঠিক মাঝখানে। চারদিকে কাদার মত ছিটকে উঠল এক রাশ সিমেন্ট, বার্ ও কুচিপাথর।

নরম কাদার বিছানায় ল্যাণ্ড করে একটা মুহূর্ত চিত হয়ে শুয়ে থাকল লোকটা। যেন বুঝতে পারছে না, কী ঘটেছে। তার পরই আঠালো কাদা চোরাবালির মত টেনে নিতে শুরু করল তাকে। এই বার নড়ে উঠল লোকটা দুর্বলভাবে। চোখ মেলে চাইল চারপাশে।

বিপদের ভয়াবহতা উপলব্ধি করেই ঝটকা দিয়ে উঠল মাথাটা কংক্রিট থেকে। নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল মরণ- চিৎকার। হাতপা ছুঁড়ে চোরাকাদার মাঝে দাপাদাপি করছে পেশাদার খুনি, মুক্ত হতে চাইছে কংক্রিটের মৃত্যু-আলিঙ্গন থেকে। কিন্তু ওর হাতের নাগালে কিছুই যে নেই ডুবে যাওয়া ঠেকানোর মত! জানে না, বাঁচার চেষ্টায় ছটফট করে আরও ঘনিয়ে আনছে মৃত্যু।

চিত হয়ে পড়লেও প্রথমে তলিয়ে গেল ওর হাত দুটো। দেখতে দেখতেই বুক পর্যন্ত উঠে এল কংক্রিট, স্পর্শ করল চিবুক। চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর ছেড়ে। ঘাড়টা পিছনে হেলিয়ে যথাসম্ভব উপরদিকে জাগিয়ে রেখেছে নাক। চোখ দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল, এখন দেখা যাচ্ছে শুধু নাক ও জুতোর ডগা। তবু চেষ্টা করছে লোকটা।

লাভ কী! নিয়তি যখন নির্ধারিত হয়েই গেছে!

নাকটা তলিয়ে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেল জুতোটাও। পুরোপুরি ডুবে গেছে লোকটা কাদার ভিতর। অন্ধ আততায়ী তার পরও বাঁচার জন্য মরিয়া। বোঝা গেল, কংক্রিটের ভেতর ছটফট করছে সে শ্বাসের জন্য। একটু পরেই স্থির হয়ে গেল সব। প্রথমে সাব-মেশিন গান, তার পর আস্ত একটা মানুষকে গিলে নিয়ে কয়েকটা বুদ্বুদ ছাড়ল কংক্রিটের তাল। তৃপ্তির ঢেকুর ছাড়ল যেন। ভালোমানুষটির মত চুপ করে নির্নিমেষে চেয়ে রয়েছে চল্লিশ ফিট উপরে ঝুলন্ত পরবর্তী শিকারের অপেক্ষায়।

বাতাসের গায়ে খামচি মারল রানা।

‘রানা!’ আবার শোনা গেল সেলেনার গলা।

হামাগুড়ি দিয়ে চলে এসেছে ও পাটাতনের কিনারায়। ভার্টিগোর সমস্যা গ্রাহ্য না করে তাকাল নিচে। দু’চোখে আতঙ্ক। ঝুলন্ত রানার উদ্দেশে বাড়িয়ে দিল নিজের একটা হাত।

নাগাল পেল না রানার। পেলেও টেনে তুলতে পারত কি না, সন্দেহ।

‘রানা!’ আবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল ডাকটা।

ঘামে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে গেছে স্টিলের খুঁটি। ছুটে যেতে পারে যখন-তখন। এদিকে শরীরের পুরো ওজন নিতে হচ্ছে বলে ব্যথায় টনটন করছে আঙুলগুলো। অবশিষ্ট শক্তি জড়ো করে খালি বাম হাতটা উপরদিকে ঝাপটা দিল রানা।

নাগালে ঠেকল সেফটি রেইলিঙের ঝুলে থাকা অংশটা।

দাঁতে দাঁত পিষে শরীরটা উপরদিকে টেনে তুলতে শুরু করল ও, যতক্ষণ না তক্তার নাগাল পেল পায়ে। পাটাতনের কিনারায় হাঁটু ঠেকতেই বাহু পাকড়ে ধরে উঠতে সাহায্য করল মেয়েটা, টেনে সরিয়ে আনল ওকে কিনারা থেকে।

সটান হয়ে শুয়ে পড়ল রানা। চোখ দুটো বোজা। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক, কাঁপছে হাতপা। কাহিল হয়ে গেছে প্রচণ্ড পরিশ্রমে।

সেলেনার অবস্থাও তথৈবচ। গান সাইলেন্সারের লাল সিল বসে গেছে ঘাড়ে।

খানিকটা স্থির হওয়ার পর উঠে বসল রানা। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘ইউ অল রাইট?’

বনবেড়ালের থুতু ছিটানোর ভঙ্গিতে মুখ ঝামটা দিল সেলেনা। ‘আরে, মিয়া, তোমার কথা বলো!’

‘আস্ত আছি, এটুকু বলতে পারি।’ ওর বিখ্যাত ভুবন ভোলানো হাসিটা উপহার দিল রানা।

‘হাসছ তুমি! তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, এতক্ষণ যা ঘটল—মজার এক রসিকতা সেসব! ওরা এসেছিল তোমার সঙ্গে স্রেফ তামাশা করতে, তা-ই না?’

মিলিয়ে গেল রানার হাসিটা।

‘প্রমাণ চেয়েছিলে না?’ ভর্ৎসনার সুরে বলল সেলেনা। ‘সন্তুষ্ট এখন, জনাব?’

কিছু বলার নেই রানার। উঠে দাঁড়াল ও পরিশ্রমের ধকল উপেক্ষা করে। চ্যাপ্টা হওয়া বুলেটের বেগের কারণে এখনও অসাড় হয়ে রয়েছে ঊরুর মাংস। পাঁজরে খাওয়া ঘুসিটার জন্য ব্যথা জানান দিচ্ছে মাঝে মাঝে ঝিলিক দিয়ে।

নিচে উঁকি দিল।

কংক্রিটের উপরটা দেখে কে ভাবতে পারবে, আস্ত এক পূর্ণবয়স্ক মানুষের গোর হয়েছে ওর ভিতরে! একটা মোটে মাঝারি বুদ্বুদ ছাড়া আর কোনও আলামত নেই কোথাও।

সকল অধ্যায়

১. শকওয়েভ – ১
২. শকওয়েভ – ২
৩. শকওয়েভ – ৩
৪. শকওয়েভ – ৪
৫. শকওয়েভ – ৫
৬. শকওয়েভ – ৬
৭. শকওয়েভ – ৭
৮. শকওয়েভ – ৮
৯. শকওয়েভ – ৯
১০. শকওয়েভ – ১০
১১. শকওয়েভ – ১১
১২. শকওয়েভ – ১২
১৩. শকওয়েভ – ১৩
১৪. শকওয়েভ – ১৪
১৫. শকওয়েভ – ১৫
১৬. শকওয়েভ – ১৬
১৭. শকওয়েভ – ১৭
১৮. শকওয়েভ – ১৮
১৯. শকওয়েভ – ১৯
২০. শকওয়েভ – ২০
২১. শকওয়েভ – ২১
২২. শকওয়েভ – ২২
২৩. শকওয়েভ – ২৩
২৪. শকওয়েভ – ২৪
২৫. শকওয়েভ – ২৫
২৬. শকওয়েভ – ২৬
২৭. শকওয়েভ – ২৭
২৮. শকওয়েভ – ২৮
২৯. শকওয়েভ – ২৯
৩০. শকওয়েভ – ৩০
৩১. শকওয়েভ – ৩১
৩২. শকওয়েভ – ৩২
৩৩. শকওয়েভ – ৩৩
৩৪. শকওয়েভ – ৩৪
৩৫. শকওয়েভ – ৩৫
৩৬. শকওয়েভ – ৩৬
৩৭. শকওয়েভ – ৩৭
৩৮. শকওয়েভ – ৩৮
৩৯. শকওয়েভ – ৩৯
৪০. শকওয়েভ – ৪০
৪১. শকওয়েভ – ৪১
৪২. শকওয়েভ – ৪২
৪৩. শকওয়েভ – ৪৩
৪৪. শকওয়েভ – ৪৪
৪৫. শকওয়েভ – ৪৫
৪৬. শকওয়েভ – ৪৬
৪৭. শকওয়েভ – ৪৭
৪৮. শকওয়েভ – ৪৮
৪৯. শকওয়েভ – ৪৯
৫০. শকওয়েভ – ৫০
৫১. শকওয়েভ – ৫১
৫২. শকওয়েভ – ৫২
৫৩. শকওয়েভ – ৫৩
৫৪. শকওয়েভ – ৫৪
৫৫. শকওয়েভ – ৫৫
৫৬. শকওয়েভ – ৫৬
৫৭. শকওয়েভ – ৫৭
৫৮. শকওয়েভ – ৫৮
৫৯. শকওয়েভ – ৫৯
৬০. শকওয়েভ – ৬০
৬১. শকওয়েভ – ৬১
৬২. শকওয়েভ – ৬২
৬৩. শকওয়েভ – ৬৩
৬৪. শকওয়েভ – ৬৪
৬৫. শকওয়েভ – ৬৫
৬৬. শকওয়েভ – ৬৬
৬৭. শকওয়েভ – ৬৭
৬৮. শকওয়েভ – ৬৮
৬৯. শকওয়েভ – ৬৯
৭০. শকওয়েভ – ৭০
৭১. শকওয়েভ – ৭১
৭২. শকওয়েভ – ৭২
৭৩. শকওয়েভ – ৭৩
৭৪. শকওয়েভ – ৭৪
৭৫. শকওয়েভ – ৭৫
৭৬. শকওয়েভ – ৭৬
৭৭. শকওয়েভ – ৭৭
৭৮. শকওয়েভ – ৭৮
৭৯. শকওয়েভ – ৭৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন