শকওয়েভ – ৬৭

কাজী আনোয়ার হোসেন

সাতষট্টি

সেলেনার নির্জীব শরীর ঢেকে দেয়া ডালপাতাগুলো সরিয়ে, জড়িয়ে ধরল ওকে রানা। টেনে তুলল পাড়ের আরও উঁচুতে।

জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে মেয়েটার। নীলচে-বেগুনি রং ধারণ করেছে ঠোঁট জোড়া। শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে আছে মরা মানুষের মত। নানা রকম কাটাছেঁড়ার দাগ দেহের উন্মুক্ত অংশে। ডালের খোঁচা লেগে হয়েছে ওগুলো। তবে সিংহভাগ রক্তের উৎস হেয়ারলাইনের ঠিক নিচের গভীর ক্ষতটা। যেখানটায় রক্ত নেই মুখে, পাঁশুটে দেখাচ্ছে জায়গাগুলো।

হাঁটু গেড়ে বসল রানা মেয়েটার পাশে। এক মুহূর্তও দেরি না করে কাত করে দিল ওকে বাঁ দিকে। ফিনকি দিয়ে পানি বেরিয়ে এল সেলেনার মুখ দিয়ে।

‘কিচ্ছু হয়নি… কিচ্ছু হয়নি তোমার!’ বিড়বিড় করে, পালস খুঁজছে রানা। ওর নিজের হৃৎপিণ্ড দামামা বাজাচ্ছে বুকের খাঁচায়।

নাহ… পাওয়া গেল না নাড়ি!

তাড়াতাড়ি সিপিআর দেয়া শুরু করল রানা। নিজের বুকের সবটুকু বাতাস ভরে দিল ও সেলেনার মুখে। বরফের মত ঠাণ্ডা আর প্রাণহীন মনে হলো মেয়েটার ঠোঁটের স্পর্শ। সোজা হয়ে বসে বুকের উপর চাপ দিতে লাগল ফুসফুস দুটোকে সচল করার জন্য।

নাহ… কাজ হচ্ছে না!

হাল না ছেড়ে পুনরাবৃত্তি করল প্রক্রিয়াটার।

নাহ!

আবার। নাহ!

আবারও।

ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে উঠল মেয়েটা! তার পরই কাশির বেগ বেড়ে গেল বেদম। বন্ধ চোখের পাতা জোড়া কাঁপতে লাগল তিরতির করে।

আবার ওর নাড়ির স্পন্দন দেখল রানা। এত ক্ষীণ আর অনিয়মিত যে, ফের থেমে যেতে পারে যখন-তখন।

‘পাওয়া গেছে ওকে!’ হাঁকল রানা গলার সবটুকু জোর দিয়ে। ‘এই যে… এদিকে!’

এক সেকেণ্ড পর চিৎকার করে সাড়া দিল সিআইএ এজেন্ট।

ধীরে ধীরে চোখ দুটো খুলে গেল সেলেনার। প্রথমে মনে হলো, দেখতে পাচ্ছে না কিছু। আস্তে আস্তে ভাষা ফুটল চোখে। ঠোঁটে ফুটল এক চিলতে হাসি।

‘রানা!’ প্রায় শোনাই গেল না কণ্ঠটা।

‘এই তো আমি!’ খুশি আর শঙ্কায় লাফাচ্ছে রানার হৃৎপিণ্ড। ‘দুঃখিত তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্যে!’

‘রানা…’ কিছু যেন বলতে চাইছে সেলেনা। সংজ্ঞা হারানোর কারণে এবারেও শেষ হলো না কথা।

চট্ করে আবার নাড়ি দেখল রানা। না, আছে। বোঝা যায় কি যায় না।

‘তাড়াতাড়ি আসুন, মিস্টার কোহেন!’ চেঁচিয়ে উঠল ও। তক্ষুণি দেখা গেল ওকে। পিছলে নেমে এল কোহেন কাদাটে পাড় বেয়ে।

‘ঠিক আছেন তো উনি?’

‘ভালো ঠেকছে না মাথার আঘাতটা।’ নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনাল গলাটা রানার কাছে। ‘সাহায্য করুন আমাকে। হাসপাতালে নেয়া দরকার এক্ষুণি।’

‘তুলব কী করে উপরে?’ ঘন গাছে ছাওয়া দুরারোহ ঢালের দিকে চেয়ে বলল কোহেন।

‘এদিক নয়, ওদিক দিয়ে যাব।’ পুব দিক নির্দেশ করল রানা। জায়গাটা নিচু। ‘ওদিকটায় গাছপালা নেই। কোথাও- না-কোথাও রাস্তা পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই।’

‘কিন্তু একমাত্র উঁচু জায়গাগুলোই ডোবেনি পানিতে।’ তবে এ-ও লক্ষ করল কোহেন, আগের চাইতে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে পানি।

দীর্ঘ, প্রাণান্ত পরিশ্রম হলো দু’পাশ থেকে সংজ্ঞাহীন দেহটা ধরে উতরাই বেয়ে নামতে গিয়ে। পলিমাটি আর দুর্ভেদ্য ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে কায়ক্লেশে পেরোতে হচ্ছে শৈলশিরা।

মাটির কাছাকাছি নেমে আসছে সূর্যটা। সন্ধ্যা নামার বাকি নেই বেশি।

কালশিটে পড়া গোড়ালি ম্যাসাজ করার জন্য একটু পর পর থামতে হচ্ছে কোহেনকে।

যতই এগোচ্ছে, ততই পাতলা হয়ে আসছে গাছগাছালি। ফাঁকায় বেরিয়ে এসে এই প্রথম অনুধাবন করতে পারল ওরা ধ্বংসলীলার মাত্রাটা।

পুরোপুরি নেমে গেছে এখন বানের পানি। প্লাবনের স্মৃতি হিসাবে ছোটবড় কয়েকটা পুকুর রেখে গেছে স্থানে স্থানে। ডুবন্ত সূর্যের লালচে আভায় কী রকম বিচিত্র দেখাচ্ছে চরাচর। সিক্ত ধ্বংসক্ষেত্রটা দেখে মনে হচ্ছে, হিরোশিমা- নাগাসাকির মত নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে এখানটায়।

‘হায়, মা মেরি!’ আঁতকে উঠল কোহেন। ‘মানুষ, না পিশাচ ওরা? কেমন করে করতে পারল এটা!’

‘আবারও করবে!’ ক্রুদ্ধ মুখভঙ্গি করল রানা। ‘যদি না ওদের থামানো যায়!’

একটা তৃণভূমিতে এসে পৌঁছেছে ওরা। কাদা আর আবর্জনার সুবিশাল প্রান্তর এখন ওটা। প্রায় লীন হয়ে গেছে মাঠ চিরে ঘুরে ঘুরে চলে যাওয়া সরু আলপথ।

আবার শুরু হলো হাঁটা। জনমানবহীন, সুবিস্তৃত ধ্বংসযজ্ঞের পটভূমিতে তিনটে মাত্র চলমান, খুদে অবয়ব।

কোথাও-না-কোথাও জনমানুষের দেখা মিলবে নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়নি বন্যার ছোবলে।

যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিককে যেভাবে বহন করে সহযোদ্ধা, তেমনিভাবে কাঁধের উপর তুলে নিয়েছে রানা মেয়েটাকে। সেলেনার শ্বাসপ্রশ্বাস অনুভব করছে ও নিজের শরীরে। ধীর আর সংক্ষিপ্ত।

চলতে চলতে বাধা পেল ওরা। উল্টে যাওয়া একটা ট্রাক আটকে রেখেছে রাস্তা। আবর্জনার পাহাড় জমেছে যানটার উপর। স্টিয়ারিং ধরা অবস্থাতেই ডুবে মরেছে হতভাগ্য ড্রাইভার।

ট্রাকটার পাশ দিয়ে বর্জ্যের ঢিপি পেরিয়ে এগিয়ে চলল রানা আর কোহেন।

নামতে শুরু করেছে তাপমাত্রা। প্রশস্ত, কালো ডানা ছড়িয়ে নেমে আসছে সন্ধ্যা। বোঝা যাচ্ছে, খুব ঠাণ্ডা পড়বে রাতে।

‘ধরব ওঁকে কিছুক্ষণের জন্যে?’ আরও আধঘণ্টা ক্লান্তিকর পথচলার পর প্রস্তাব করল সিআইএ এজেন্ট।

উপকার হতো ধরলে। কিন্তু মেয়েটাকে ছেড়ে দেয়ার মত ভুল করতে চায় না রানা দ্বিতীয় বার। তা ছাড়া কোহেনেরও পায়ে ব্যথা।

‘ধন্যবাদ, মিস্টার কোহেন,’ আন্তরিকতার সঙ্গে এড়িয়ে গেল রানা।

‘ফিল বলে ডাকুন আমাকে। প্লিজ।’

‘ঠিক আছে, ফিল। না পারলে বলব তখন আপনাকে। আপনার অবস্থাও তো সুবিধের মনে হচ্ছে না।’

‘চিন্তা করবেন না ও-নিয়ে।’

এর পর ফুরিয়ে গেল কথা।

আঁধার যত ঘনাচ্ছে, ততই সেলেনাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে রানার। শিগগিরই সুচিকিৎসা দরকার সেলেনার। তা না হলে… ভাবতে চায় না বাকিটা। কোহেনের পায়ের ব্যথা খারাপের দিকে গেলে দেরি হয়ে যাবে আরও-এ নিয়ে ও চিন্তা কম নয়। গোঁয়ারগোবিন্দের মত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পাশে পাশে আসছে কোহেন। মচকানো গোড়ালি নিয়ে কেমন লাগে হাঁটতে, সে-অভিজ্ঞতা নতুন নয় তার কাছে।

দুঃস্বপ্নভূমি পেরিয়ে এসেছে ওরা। অদ্ভুত রকমের স্বাভাবিক এখন আঁকাবাঁকা পথটা। কোনও কালেই ঘটেনি যেন কোনও ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

শিগগিরই অপেক্ষাকৃত বড় আরেকটা রাস্তায় গিয়ে পড়ল দু’জনে। সত্যিকার অর্থেই টের পাওয়া যাচ্ছে এখন দুর্যোগের ভয়াবহতা। মৃত আর আহতয় বোঝাই অসংখ্য ট্রাক, কার পেরিয়ে যাচ্ছে ওদের। এমনকী মোটরসাইকেলগুলোকেও অস্থায়ী ট্রেলার টানতে হচ্ছে। সুদীর্ঘ আলোর মিছিল যেন গাড়ির সারিগুলো। ধপ্ আওয়াজে যান্ত্রিক পতঙ্গের কালো কালো অবয়বগুলো সাঁঝের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে ছুটে চলেছে দুর্গত এলাকার দিকে।

রেসকিউ অপারেশন শুরু হলো তা হলে! সময়সাপেক্ষ, অসম্ভবপ্রায় কাজটা। শেষ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা কততে গিয়ে ঠেকবে, অনুমানেও আসছে না রানার। তার পর রয়েছে পঙ্গু কিংবা আহতরা, কখনোই যারা আর ফিরতে পারবে না স্বাভাবিক জীবনে।

গোঁ গোঁ করতে করতে পিছন-খোলা একটা ট্রাক পেরিয়ে গেল ওদের। খোলা অবস্থায় ঝুলছে টেইলগেটটা। আতার বিচির মত অন্ধকারে দেখতে পেল রানা, মানুষ উপচে পড়ছে গাড়িটার ফ্ল্যাটবেড থেকে। তবে এতটা নয় যে, আরও তিন- চারজনের জায়গা হবে না।

ছুটল ও হুমড়ি খেয়ে। ঝাঁকুনিতে মেয়েটার ক্ষতি যাতে না হয়, খেয়াল রেখেছে যথাসাধ্য।

‘দাঁড়ান, ভাই… একটু দাঁড়ান!’ হাঁক দিল ও ট্রাক ড্রাইভারের উদ্দেশে।

রানার ডাক অগ্রাহ্য করে চলে যাবে মনে হচ্ছিল ট্রাকটা। কিন্তু না, থামল ওটা।

টেইলগেটের দিকে এগিয়ে যেতেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল কয়েকজন। সযতনে ধরে তুলে একজনের বিছিয়ে দেয়া কম্বলে শুইয়ে দিল মেয়েটাকে।

এর পর কোহেনকে উঠতে সাহায্য করে, নিজেও সেলেনার পাশে উঠে বসল রানা।

চলতে শুরু করল গাড়ি।

রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো। যত বারই কাত হচ্ছে ট্রাক, ককিয়ে উঠছে আহতরা।

নয়-দশ বছরের এক বাচ্চা মেয়ের মাথায় ব্যাণ্ডেজ পেঁচানো। মুখটা রক্তে মাখামাখি।

এক ইন্দোনেশিয়ানের ঊরুর হাড়ে কমপাউণ্ড ফ্র্যাকচার হয়েছে। ব্যথায় খিঁচিয়ে রেখেছে চেহারা। রাতের শীতল বাতাসেও সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে ঘামে।

কথা বলার মত অবস্থায় নেই আহতদের সঙ্গী অধিকাংশ লোকই।

আটাশ-ঊনতিরিশ বছরের শ্বেতাঙ্গ এক টুরিস্ট লিয়ঁ-র জেরার্ড বলে পরিচয় দিল নিজের। চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে লোকটা। সুনামি এসে আঘাত হানার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সে স্ত্রীর কাছ থেকে। বউয়ের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, রানা ওকে দেখেছে কি না।

‘না’ বলতে হলো রানাকে।

ইনল্যাণ্ডের দিকে ছোটা অন্য কোনও ট্রাকে হয়তো উঠতে পেরেছে মেয়েটা—এই বলে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করল ফরাসি। আশা করছে, সহি-সালামতেই খুঁজে পাবে ওকে পাদাং পানজাঙের হসপিটালে। বেশির ভাগ যাত্রীরই গন্তব্য ওটা।

কাজ চালানোর মত ইংরেজি জানে ফিতরি নামে স্থানীয় এক মহিলা। কাঁদতে কাঁদতে বলল, উপকূলের এক গাঁয়ে বাস করত পরিবার-পরিজন নিয়ে। সবাইকে হারিয়েছে প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসে।

বেচারিকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে, ভেবে পেল না রানা। খটরমটর ঝাঁকুনি খেতে খেতে ছুটে চলেছে ট্রাক। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রয়েছে কোহেন। বুকের উপর ঝুলে পড়েছে মাথাটা।

রানার কাছে মনে হচ্ছে, পেরিয়ে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। একটু পর পর রক্ত মুছে দিচ্ছে মেয়েটার মুখ থেকে। কতক্ষণে জ্ঞান ফিরবে ওর, অধীর হয়ে রয়েছে সেই প্রতীক্ষায়। বয়স্কা এক মহিলা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছে সেলেনার একটা হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে।

এক মুহূর্তের বিরাম নেই আহতদের যন্ত্রণাকাতর বিলাপধ্বনিতে। স্বজন হারানো মানুষগুলো কাঁদছে নীরবে, কেউ কেউ ঠায় বসে রয়েছে কাঠপুতুলের মত। সহধর্মিণীকে খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশায় অনর্গল বকে চলেছে ফরাসি লোকটা।

রেসকিউ কনভয়ে যোগ দেয়া গাড়ির মিছিল ওদের পিছনে। আরও সারভাইভার নিয়ে দ্রুতগামী পিকআপ ট্রাক- কারগুলো শাঁ করে চলে যাচ্ছে আগে।

চরম ব্যস্ততা দেখা গেল হাসপাতালে পৌঁছে। এক জায়গায় এত কোলাহল এর আগে কোথাও দেখেছে বলে মনে করতে পারল না রানা। ট্রাক যখন গেট দিয়ে ঢুকছে, ফ্লাডলাইটের আলোয় আলোকিত নরক বলে মনে হলো গাড়ি আর মানুষে ঠাসাঠাসি চিকিৎসাকেন্দ্রটাকে। এমার্জেন্সি ওয়ার্ডের দিকে ছুটছে যেন সবাই ধাক্কাধাক্কি করে। অস্থায়ী অ্যামবুলেন্স, ট্রাক, প্রাইভেট কার, ঠেলাগাড়িতে; এমনকী পায়ে হেঁটেও লোকজন আসছে চিকিৎসা নিতে।

বুঝতে কষ্ট হয় না, সহ্যের ক্ষমতা হারিয়ে ত্রাহি মধুসূদন দশা হাসপাতাল কর্মচারীদের। খোঁড়া, রক্তাক্ত, ব্যাণ্ডেজ জড়ানো, মৃত্যুপথযাত্রীর অবিরাম ঢল আর আতঙ্কিত আর্তনাদে স্তম্ভিত ওরা।

এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার আর ক্যামেরাপার্সনরা। ভটভট আওয়াজে ক’মিনিট পর পরই আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছে হেলিকপ্টারগুলো। রোটরের হাওয়ায় ভিড় ঠেলে এগোনো প্যারামেডিকরা হয়রান হয়ে যাচ্ছে স্ট্রেচারগুলোর চাদর সামলাতে সামলাতে।

‘তিল-ঠাঁই-আর-নাহি-রে’ অবস্থা হাসপাতালের ভিতর। যত বেশি সম্ভব, সেবা দেয়ার চেষ্টায় ছুটোছুটিরত ডাক্তার- নার্সদের হাঁকডাকে সরগরম করিডোর। ঠাস ঠাস করে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে দরজাগুলো।

হাতপা ভাঙা পেশেন্টদের বয়ে নেয়া হচ্ছে রক্তাক্ত চাদরে ঢেকে, সবাই জীবিতও নয়। চিকিৎসা পাওয়ার অপেক্ষায় নারী, পুরুষ, শিশু মানবেতরভাবে গাদাগাদি করে রয়েছে হাসপাতাল করিডোরে

মেঝেময় রক্ত। সাফ করতে করতে নাকাল হচ্ছে পরিচ্ছন্ন-কর্মীরা।

প্রিয়জন হারানো মানুষগুলো উদ্ভ্রান্তের মত সন্ধান করে ফিরছে ভিড়ে ভিড়াক্কার হাসপাতালের আনাচে-কানাচে, ডাকাডাকি করছে স্বজনদের নাম ধরে। সঙ্গে থাকা ছবি দেখাচ্ছে একে-তাকে। নেতিবাচক উত্তর পেলে ছুটে যাচ্ছে আরেকজনের কাছে। কান্না, চিৎকার, গোলমাল আর বিচ্ছিরি গন্ধের ঘূর্ণিপাকে পড়ে ঝিমঝিম করে উঠল রানার মাথা। লাল, নীল, হলুদ রং দুলছে চোখের সামনে। ভোঁ ভোঁ করছে দুই কান।

এরই মাঝ দিয়ে বয়ে নিয়ে চলেছে ও সেলেনাকে।

শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল এক সিস্টারকে। ক্রন্দনরত এক পরিবার হারানো শিশু আর এক মরণাপন্নকে দেখার মাঝে সময় দিতে পারল ওকে কয়েকটা সেকেণ্ড।

পেশেন্টের অবস্থা বুঝে ভিড়াক্রান্ত করিডোর ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল এক ওয়ার্ডে। ওরাও ঢুকল, এক পেশেন্টকে সার্জারিতে নিয়ে যাওয়ার কারণে খালি হলো একটা বিছানা।

যত্নের সঙ্গে সেলেনার অচেতন দেহটা বেডে শুইয়ে দিল রানা। গায়ের উপর চাদর টেনে দিল নার্স। দশ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসছে, কথা দিয়ে ত্বরিত পায়ে হারিয়ে গেল মহিলা গোলমালের মধ্যে।

দশ মিনিট নয়, পঁচিশ মিনিট পর দেখা মিলল নার্সের। বুকে ‘ডক্টর আবদুল্লাহ’ লেখা ব্যাজ আঁটা মাঝবয়সী এক ইন্দোনেশীয়কে নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে। টানা কয়েক দিন ঘুমাননি মনে হচ্ছে লোকটাকে দেখে।

‘দেখবেন একটু, ডক্টর!’ সকাতরে বলল রানা। ‘অনেকক্ষণ ধরে অজ্ঞান হয়ে আছে!’

মাথার গভীর ক্ষতটা পরীক্ষা করে চিন্তিত মনে হলো ডাক্তারকে। এক এক করে চোখের পাতা তুলে আলো ফেললেন মণিতে। রোগিণীর ব্যাপারে বেশ ক’টা প্রশ্ন করে সংক্ষেপে রায় জানালেন রানাকে: একিউট কঙ্কাশন।

হড়বড় করে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে এর পর যে- কথাগুলো বললেন ভদ্রলোক, সেখান থেকে ‘সাবঅ্যারাকনয়েড ব্লিডিং’ এবং ‘সাবডিউরাল হেমাটোমা’-র মত ভীতিকর শব্দগুলো ধরতে পারল রানা। অবস্থা কতখানি গুরুতর, জানতে চাইল ও।

ভবিষ্যদ্বাণী করতে রাজি হলেন না ডাক্তার। তবে দুই- তিন সেকেণ্ডের জন্য চেতনা ফিরলে যে চিনতে পেরেছে রানাকে, মনে করতে পেরেছে ওর নাম—এটা ভালো লক্ষণ বলে জানালেন। যদিও বেশ সিরিয়াস আঘাতটা। এক্স-রে করার আগপর্যন্ত এর বেশি মন্তব্য করা সম্ভব নয়।

মেয়েটার পাশ ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না রানার। তার পরও বেরোতে হলো ওয়ার্ড ছেড়ে। সেলেনার বেডের চারপাশে পর্দা টেনে দিয়েছে নার্স। শুরু করেছে কাপড় খোলার কাজ। এক্স-রের আগে ভালো মত ধুয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে ক্ষতগুলোর। কোনও রকম অযত্ন হবে না ওর, আশ্বাস দিয়েছে মহিলা।

কোনও মতে নিজেকে খাড়া রেখেছে রানা। বড় একটা চিন্তা দূর হওয়ায় এতক্ষণে ব্যথা মালুম হচ্ছে শরীরের নানা জায়গার আঘাতগুলোয়।

‘কিছু হয়নি আমার,’ বলল বটে, তা-ও জোর করে বসিয়ে দিল ওকে আরেক সেবিকা। পরীক্ষা করবে রানাকে।

সিরিঞ্জের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক আর পেইনকিলার পুশ করে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল মহিলা নতুন কোনও ক্রাইসিস হ্যাণ্ডেল করতে। প্রতীক্ষমাণ অসংখ্য মানুষকে মনোযোগ দিতে গিয়ে কর্মী-মৌমাছির মত অবিশ্রাম ছুটোছুটি করতে হচ্ছে ওদের মত আরও অনেককে।

হলওয়েতে একটা কোনা খুঁজে নিয়ে ধপ্ করে মেঝেতে বসে পড়ল রানা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। হতক্লান্ত ও। ধসে পেছে একেবারে। বসে বসে এখন প্রতীক্ষা আর শুভকামনা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

মাথা নিচু করে মনে মনে ভাবছে রানা এর পরের কর্তব্য। এত দূর পর্যন্ত যে আনতে পেরেছে ওকে, সেজন্য নিজের উপর সন্তুষ্ট ও। এখন ভালোয় ভালোয় ওকে দেশে ফেরত পাঠাতে পারলে…

চোখ বন্ধ করে কতক্ষণ এভাবে বসে আছে, বলতে পারবে না রানা। ক্লান্তি ও দুর্বলতা সত্ত্বেও এক ফোঁটা ঘুম নেই ওর চোখে। উদ্বেগ, যন্ত্রণা আর অনিশ্চয়তা ছাপিয়ে নতুন এক অনুভূতি মাথাচাড়া দিচ্ছে মনের মধ্যে। মগজ গুলিয়ে দেয়া তীব্র এক আলোড়ন। গনগনে ইস্পাতের ফলা ঠাণ্ডা পানিতে চুবালে যেরকম শক্ত হয়ে ওঠে, হিমশীতল ক্রোধে তেমনি আচমকা দৃঢ় হয়ে গেল মুঠো। রক্তের বান ছুটল ওর শিরায়, ধমনিতে।

কারও উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলল রানা।

ওর উপর ঝুঁকে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সোজা হলো ফিল কোহেন।

‘শিয়োর ছিলাম না, আপনাকে আবার দেখতে পাব কি না,’ বলল সে এক চিলতে হেসে। ‘কেমন আছেন উনি?’

‘জানি না এখনও। ভুলেই গিয়েছিল রানা কোহেনের কথা।

‘বসি এখানে?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ… বসুন না!’

‘থপ্পাস’ করে টাইলস বসানো মেঝেতে রানার পাশে বসে পড়ল লোকটা

‘কোডিন দিয়েছে এরা,’ বলল মুখ বিকৃত করে। ‘তা-ও কী যে যন্ত্রণা করছে শালার-পো-শালা গোড়ালিটায়! মনে হচ্ছে, এক লাফে ছাত ফুঁড়ে উঠে যার আকাশে।’

ঠোঁটের কোণে সহানুভূতির হাসি টেনে আনল রানা।

‘বিয়ার টিয়ার পাওয়া গেলে মন্দ হতো না। ঠোঁট চাটল সিআইএ এজেন্ট। ‘সাহারা মরুভূমি হয়ে আছে গলার ভিতরটা।’

‘সার্জিকাল স্পিরিটে কাজ চলবে?’ রসিকতা করল রানা। ‘সেটার ব্যবস্থা মনে হয় করা যাবে।’

দু’জনেই হাসল ওরা।

‘চিন্তা করবেন না, রানা।’ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলে উঠল কোহেন। ‘সুস্থ হয়ে উঠবেন মিস বার্নহার্ট।’

‘তা-ই যেন হয়, মিস্টার কোহেন। ‘

‘ফিল’ মনে করিয়ে দিল কোহেন।

‘ও, হ্যাঁ… ফিল।’

‘অনেক দিন ধরে একসঙ্গে বোধ হয় আপনারা? সরি… ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেললাম হয়তো… ‘

‘যা ভাবছেন, ওরকম কিছু নয়।’ বিব্রত রানা। ‘ভালো বন্ধু আমরা–ব্যস।’

‘মাফ করবেন। যেভাবে উতলা হয়ে পড়েছিলেন… অন্য কিছু ভেবেছিলাম সেজন্যে…

চুপ রইল রানা।

মুখচোখ কঠিন হয়ে উঠল কোহেনের। মুহূর্ত কয়েক তাকিয়ে রইল টাইলসের দিকে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ডুব দিয়েছে স্মৃতির সাগরে।

‘সিণ্ডি আর আমি…’ বলে উঠল দূরাগত কণ্ঠে। শীঘ্রি বিয়ে হতে যাচ্ছিল আমাদের!’

‘দুঃখিত…’ বলতে পারল শুধু রানা।

অদৃষ্টের উদ্দেশে ভেংচি কাটল যেন কোহেন। ফাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে শূন্যে।

‘অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি, আসুন,’ প্রস্তাব করল রানা। ‘কোরে ছিলেন বলছিলেন…’

‘হ্যাঁ। সেমপার ফাই—মানে, ‘অলওয়েজ ফেইথফুল’ তকমা জুটিয়ে নিয়েছি মানুষকে গর্ব করে দেখানোর জন্যে। রক্তাক্ত, নোংরা শার্টের আস্তিন উপরে তুলল কোহেন।

গ্লোবের উপর বসা একটা আমেরিকান ইগল শোভা পাচ্ছে এক্স-মেরিনের বাহুতে। গোলকটার পিছনে নোঙর আঁকা। ছবিটার মত নিচের নীল হরফগুলোও ঝাপসা হয়ে এলেও পড়া যাচ্ছে এখনও ইউএসএমসি আর তার উপর মেরিন কোরের নীতিবাক্য সেমপার ফিডেলিস কথাটা।

‘সাত বচ্ছর ছিলাম ওখানে,’ জানাল কোহেন।

‘এখনও সেই ধার আছে আপনার?’ রানার জিজ্ঞাসা । হতাশ চেহারা করল লোকটা। ‘মনে হয়, আর জনমের ঘটনা সেগুলো। তবে আপনি বোধ হয় ভোলেননি কিছু! মেজর বলে ডাকছিল ওরা আপনাকে…

‘হ্যাঁ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ছিলাম একটা সময়।’

‘ছাড়লেন কেন? নাকি…..’

‘সে অনেক কথা,’ এড়িয়ে গেল রানা। বুকে সামান্যতম ভয় নেই বলে আর্মিতে যোগ দিয়েছিল ও। দ্রুত পদোন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু মেজর জেনারেল রাহাত খানের ডাকে সেনাবাহিনী ছেড়ে এসে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে-সেসব কথা একে বলার মানে নেই কোনও।

‘বুঝলাম, বলতে চাইছেন না। অন্য একটা প্রশ্নের জবাব দিন তা হলে। কী করবেন এর পর?’

‘বিপদ যদি কেটে যায় সেলেনার, নিরাপদ কোথাও পৌঁছে দিতে হবে ওকে…’

‘সেটা না হয় হলো। তার পর?’ রানার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে কোহেন।

‘আছে কিছু পরিকল্পনা।’

‘বুঝতে পারছি বোধ হয়।’ সঙ্কল্প দেখতে পাচ্ছে লোকটা রানার চোখে। ‘সাথে নেবেন আমাকে?’

কী খুঁজল রানা কোহেনের দৃষ্টিতে। বলল, ‘বেঁচে ফেরার নিশ্চয়তা নেই কিন্তু!’

‘প্রতিশোধ ছাড়া আর কিছুই ভাবছি না আমি!’ মৃত প্রেয়সীর অনিন্দ্য সুন্দর মুখটা ভেসে উঠল সিআইএ এজেন্টের মানসপটে। ধকধক প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে দুই চোখে।

উপরনিচে মাথা দোলাল রানা। ডান পাঞ্জাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘হাত মেলান তা হলে। ফ্যান্টম হোল্ডিংস আর পসাইডন সম্পর্কে যা যা জানেন, সব বলুন আমাকে।’

করমর্দনের মাধ্যমে অলিখিত চুক্তি হয়ে গেল দুই অগ্নিপুরুষের মাঝে

সকল অধ্যায়

১. শকওয়েভ – ১
২. শকওয়েভ – ২
৩. শকওয়েভ – ৩
৪. শকওয়েভ – ৪
৫. শকওয়েভ – ৫
৬. শকওয়েভ – ৬
৭. শকওয়েভ – ৭
৮. শকওয়েভ – ৮
৯. শকওয়েভ – ৯
১০. শকওয়েভ – ১০
১১. শকওয়েভ – ১১
১২. শকওয়েভ – ১২
১৩. শকওয়েভ – ১৩
১৪. শকওয়েভ – ১৪
১৫. শকওয়েভ – ১৫
১৬. শকওয়েভ – ১৬
১৭. শকওয়েভ – ১৭
১৮. শকওয়েভ – ১৮
১৯. শকওয়েভ – ১৯
২০. শকওয়েভ – ২০
২১. শকওয়েভ – ২১
২২. শকওয়েভ – ২২
২৩. শকওয়েভ – ২৩
২৪. শকওয়েভ – ২৪
২৫. শকওয়েভ – ২৫
২৬. শকওয়েভ – ২৬
২৭. শকওয়েভ – ২৭
২৮. শকওয়েভ – ২৮
২৯. শকওয়েভ – ২৯
৩০. শকওয়েভ – ৩০
৩১. শকওয়েভ – ৩১
৩২. শকওয়েভ – ৩২
৩৩. শকওয়েভ – ৩৩
৩৪. শকওয়েভ – ৩৪
৩৫. শকওয়েভ – ৩৫
৩৬. শকওয়েভ – ৩৬
৩৭. শকওয়েভ – ৩৭
৩৮. শকওয়েভ – ৩৮
৩৯. শকওয়েভ – ৩৯
৪০. শকওয়েভ – ৪০
৪১. শকওয়েভ – ৪১
৪২. শকওয়েভ – ৪২
৪৩. শকওয়েভ – ৪৩
৪৪. শকওয়েভ – ৪৪
৪৫. শকওয়েভ – ৪৫
৪৬. শকওয়েভ – ৪৬
৪৭. শকওয়েভ – ৪৭
৪৮. শকওয়েভ – ৪৮
৪৯. শকওয়েভ – ৪৯
৫০. শকওয়েভ – ৫০
৫১. শকওয়েভ – ৫১
৫২. শকওয়েভ – ৫২
৫৩. শকওয়েভ – ৫৩
৫৪. শকওয়েভ – ৫৪
৫৫. শকওয়েভ – ৫৫
৫৬. শকওয়েভ – ৫৬
৫৭. শকওয়েভ – ৫৭
৫৮. শকওয়েভ – ৫৮
৫৯. শকওয়েভ – ৫৯
৬০. শকওয়েভ – ৬০
৬১. শকওয়েভ – ৬১
৬২. শকওয়েভ – ৬২
৬৩. শকওয়েভ – ৬৩
৬৪. শকওয়েভ – ৬৪
৬৫. শকওয়েভ – ৬৫
৬৬. শকওয়েভ – ৬৬
৬৭. শকওয়েভ – ৬৭
৬৮. শকওয়েভ – ৬৮
৬৯. শকওয়েভ – ৬৯
৭০. শকওয়েভ – ৭০
৭১. শকওয়েভ – ৭১
৭২. শকওয়েভ – ৭২
৭৩. শকওয়েভ – ৭৩
৭৪. শকওয়েভ – ৭৪
৭৫. শকওয়েভ – ৭৫
৭৬. শকওয়েভ – ৭৬
৭৭. শকওয়েভ – ৭৭
৭৮. শকওয়েভ – ৭৮
৭৯. শকওয়েভ – ৭৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন