শকওয়েভ – ১৬

কাজী আনোয়ার হোসেন

ষোলো

দিনটার মতই গুমোট আর উষ্ণ রাতটা।.

র‍্যু দে টোস ফেয়াস-এর অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িটার চতুর্থ তলায় যে বা যারা পার্টি দিচ্ছে, সদ্য ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডে বোধ হয় কিচ্ছু যায় আসে না এদের।

চারতলার ব্যালকনির খোলা জানালা দিয়ে ছলকে আসা মিউজিক আর উচ্চস্বরে হাসির আওয়াজ জটলা পাকাচ্ছে নিচের জনাকীর্ণ ক্যাফে-বারের শোরগোলের সঙ্গে।

বাযার সিস্টেমের সামনে দাঁড়িয়ে চারতলার বাঁ দিকের ফ্ল্যাটটার বাটন টিপে চলল রানা বার বার।

‘কী করছ তুমি?’ জিজ্ঞেস না করে পারল না সেলেনা।

‘গুবলেট করছি পার্টিটা,’ জবাব পেল। ‘অবশ্য আরও একটা কারণ রয়েছে।’

মুহূর্ত পরেই বোঝা গেল কারণটা। ‘ক্লিক’ আওয়াজে ছোট্ট ইনসেট ডোরটার ইলেকট্রনিক লক খুলে যেতেই কবাট ঠেলে পাথুরে প্যাসেজে পা রাখল রানা, পিছনে সেলেনা।

উপর থেকে গেট খুলে দিয়েছে চারতলার বাসিন্দারা। হয়তো ভাবছে, ওদের কোনও অতিথি এল বুঝি। চাইছে, গেট লাগিয়ে সোজা উপরে চলে আসুক মেহমান।

প্রাঙ্গণের কেন্দ্রে গিয়ে শেষ হয়েছে প্যাসেজটা। এক ধারে কেয়ারটেকারের অ্যাপার্টমেন্ট, আরেক ধার দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠেছে ন্যাড়া ধাপগুলো।

হুল্লোড় আর ধুমধাড়াক্কায় জমজমাট হয়ে আছে থার্ড ফ্লোর। সিঁড়ি আর ল্যাণ্ডিঙে ভুরভুর করছে সিগারেটের ধোঁয়া। গলাগলি আর মদ্যপান চলছে জুটিতে জুটিতে।

এরই মাঝ দিয়ে ‘এক্সকিউজ মি’ বলতে বলতে আরও উপরে চলল রানা-সেলেনা।

আশ্চর্য রকম অন্ধকার আর নীরব টপ ফ্লোরটা। নিচতলার আয়োজন যেন অন্য কোনও গ্রহের ঘটনা।

লোহার গরাদেঅলা জোড়া জানালা হালকাভাবে আলোকিত করেছে L শেপের ল্যান্ডিং। বাইরে তাকালে ঘরবাড়ির ছাত আর রাস্তাঘাট ছাড়া চোখে পড়ে দূরের স্যাক্রে কেয়ার ব্যাসিলিকা—জ্বলজ্বল করছে সোনালি ভাস্কর্যের মত।

ছোট আরেকটা জানালা খোলা পাশের গলির দিকে। দেখার মত কিছু নেই ওদিকে। পাশের হোটেলের নীল নিয়ন বাতি জ্বলছে-নিভছে ক্ষণে ক্ষণে।

দুটো লাল দরজা ল্যাণ্ডিঙের দুই প্রান্তে। ক্যারেনের অ্যাপার্টমেণ্ট চিনিয়ে দিল সেলেনা, নিয়ন-আলোয় আলোকিত জানালার কাছের দরজাটা।

ফরাসি আর ইংরেজিতে ক্রাইম সিনের সীমা লঙ্ঘন না করার সতর্কবাণীঅলা পুলিস-টেপ দিয়ে ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে ঢোকার মুখে।

জীবনের সাড়া নেই অপর দরজার ওপাশে। ক্যারেনের প্রতিবেশী হয় ঘুমিয়ে পড়েছে সকাল সকাল, ভাবল রানা, আর নয় তো অঘটনটার ধাক্কা সামলাতে সাময়িকভাবে উঠেছে গিয়ে আত্মীয় স্বজন কিংবা কোনও বান্ধবীর ডেরায়। তার পরও, মার নেই সাবধানের।

ব্যাগটা নামাল রানা কাঁধ থেকে। মিনি-ম্যাগলাইটটা বের করে নিয়ে সতর্কভাবে আলো ফেলল দরজায়।

‘ঢুকছ নাকি ভিতরে?’ নিচু কণ্ঠে জানতে চাইল সেলেনা।

‘তা তো অবশ্যই।’

‘বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হচ্ছে না সেটা। তা ছাড়া চাবি কই? কনসিয়ার্জকে গিয়ে অনুরোধ করারও তো উপায় দেখছি না। নাকি ভাবছ, আলিবাবার মত চিচিং ফাঁক মন্ত্ৰ পড়লেই খুলে যাবে দরজা?

‘চাবি ছাড়াই কিন্তু ঢুকতে ঢুকতে পেরেছে ক্যারেনের হত্যাকারী।’

টেপ স্পর্শ না করে দরজায় ঠেলা দিল রানা। পুরু, নিরেট মনে হচ্ছে কবাট। জোর-জবরদস্তির কোনও চিহ্ন নেই কাঠের গায়ে।

প্যারিসিয়ান অ্যাপার্টমেন্টগুলোর বাইরেটা দেখতে যেমনই হোক না কেন, উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সাধারণত লোহার ভারি ডেডলক আর ছিটকিনির সমাহার থাকে দরজার ভিতরদিকে। এহেন নিরাপত্তা-ব্যবস্থা টেকনিকালি দুর্বল হলেও শক্তি না খাটিয়ে দরজা ভাঙা প্রায় অসম্ভব।

রানার কাছে ধাঁধার মত লাগছে ব্যাপারটা। স্লেজহ্যামার কিংবা ক্রো-বার ছাড়া ঢুকল কীভাবে ক্যারেনের হন্তারক? বিশেষ করে, শিকার যেখানে আগেভাগেই শঙ্কিত নিজের নিরাপত্তা নিয়ে! নির্ঘাত সব ক’টা ছিটকিনি আর তালা দিয়েছিল মেয়েটা।

‘আমার কী মনে হয়, জানো?’ বলে উঠল সেলেনা। ‘ক্যারেনের পরিচিত ছিল লোকটা। নয় তো ভান ধরেছিল পরিচিত কারও। পুলিসের ছদ্মবেশেও এসে থাকতে পারে। কায়দা করে দরজা খুলিয়েছে ওকে দিয়ে।’

জবাব না দিয়ে ছোট জানালাটার কাছে চলে গেল রানা। নিয়ন সাইনের কারণে নীলচে আভায় আলোকিত হচ্ছে নিচের গলিটা। ঘাড় উঁচু করে এপাশ-ওপাশ দেখে নিল উপরদিকে। তার পর জানালা থেকে সরে এসে ভাবল কী যেন।

‘আমার তা মনে হয় না,’ সেলেনার মন্তব্যের জবাব দিল – ও এতক্ষণে।

‘কী, রানা?’

‘কাউকে ঢুকিয়েছে দরজা খুলে।’ সেলেনা আর কিছু বলার আগেই জুড়ে দিল, ‘দাঁড়াও একটু এখানে।’ কথাটা বলেই, সিঁড়ি ধরে রওনা হলো নিচে।

‘কী হলো হঠাৎ?’ এক রাশ উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করল সেলেনা। ‘তুমি আবার চললে কোথায়?’

‘এই তো… আসছি এক মিনিটের মধ্যেই। এখানেই থাকো তুমি, যেয়ো না কোথাও।’

অনিচ্ছুক সেলেনা থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জায়গায়। শুনতে পাচ্ছে সিঁড়িতে বিলীয়মান রানার পদধ্বনি।

গেল কোথায় মানুষটা? কেন?

দুয়েকটা মিনিট যেতে-না-যেতেই বড় বেশি একাকিত্বে ভুগতে লাগল সেলেনা। আরও কয়েক মিনিট পেরোলে মাসুদ রানা নামের যাচ্ছেতাই লোকটার প্রতি জমতে লাগল ক্ষোভ। এই মানুষটার মতিগতি বোঝা শয়তানেরও অসাধ্য! কোনও মানে হয় ওকে এরকম টেনশনে রাখার? একটা কিছু ব্যাখ্যা দিয়ে তো যাবে!

অবশ্য আগেও ঠিক এরকমটাই ছিল রানা। একা কাজ করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাকিদের মনে করে বোঝা। হুঁহ! মাথায় কী চলছে, শেয়ার করবে না কারও সঙ্গে। ভয়ানক বিরক্তিকর!

নীলাভ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছে এখন, সময় গড়িয়েছে, কিন্তু একটুও বদলায়নি ওর প্রিয় মানুষটা।

অস্থিরতা দমন করার জন্য শুরু করল পায়চারি। তাতে ফল হলো উল্টো। টেনশন বেড়ে গেল আরও। এবার নিষ্ঠুর ওই খুনি দখল করে বসল মনটা।

একটা সেকেণ্ডের জন্যও পুলিসের ব্যাখ্যা মেনে নেয়নি সেলেনা। কোনও সাইকোপ্যাথের কাজ হতে পারে না এটা। তবে ঠাণ্ডা মাথার খুনির থিয়োরিটাও কম ভয়ঙ্কর নয়।

ভাবতে না চাইলেও চিন্তাটা হানা দিচ্ছে মনে–ঠিক এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল আততায়ী কয়েক দিন আগে। রেডি হচ্ছিল ক্যারেনের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার জন্য।

পোকামাকড়ের মত মেরে ফেলেছে ওর বান্ধবীকে!

কেন এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো বেচারিকে?

কী ধরনের দানব হলে করতে পারে এ কাজ?

জীবনে কোনও দিন কাউকে ব্যথা দেয়নি যে মেয়েটা!

রাগে, ক্ষোভে কান্না পেল রীতিমত। কেঁপে উঠল সেলেনা আবেগে জর্জরিত হয়ে।

আরেকটা আশঙ্কা জুড়ে বসল মগজে। এখন যদি ফিরে আসে খুনিটা? মন বলছে- অযৌক্তিক দুশ্চিন্তা করছিস। তবু কেন কুঁকড়ে আসতে চাইছে ওর অন্তরটা?

অন্ধকারে রানার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অলক্ষুণে চিন্তাগুলো ঘুণপোকার মত কুরে কুরে খেতে লাগল মেয়েটাকে।

এখনও যদি জায়গাটার ওপর নজর রেখে থাকে হত্যাকারী—খুনটা কারও মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছে কি না, শিয়োর হওয়ার জন্য?

কিংবা আবারও যদি অপরাধস্থল রেকি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে? তাড়াহুড়োয় ফেলে গেছে, এমন কোনও আলামত তুলে নেয়ার জন্য যদি আসে?

আর এসে যদি দেখে, সম্পূর্ণ একাকী একটা মেয়ে…

নীলচে আলোর কল্যাণে ল্যাণ্ডিঙে পড়া দীর্ঘ, ভুতুড়ে ছায়াগুলোর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে স্থবির হয়ে গেল সেলেনা। কী যেন নড়ে উঠল না অন্ধকারে? ভয়ে গিঁট পাকিয়ে গেল পেটের মধ্যে।

দুরো, ছাই! ভয়কাতুরে মনের কল্পনা ছাড়া কিছু নয় ওটা।

ইনহেল… নাউ এক্সহেল। ইনহেল… এক্সহেল। অটো- সাজেশন দেয়া শুরু করল নিজেকে। দুর্ভাবনার হাত থেকে মুক্তি পেতে অক্সিজেনের সাপ্লাই বাড়াচ্ছে মস্তিষ্কে। রাতের উষ্ণতা সত্ত্বেও কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীরটা।

তখুনি আবার আঁতকে উঠল নিচের রাস্তা থেকে আসা অ্যামবুলেন্সের পিলে চমকানো তীক্ষ্ণ সাইরেন শুনে।

‘ধুপ’ করে একটা শব্দ হতেই চমকে উঠল আবারও। নিচের কোনও ফ্লোরে হয়েছে বোধ হয় আওয়াজটা।

‘দুত্তোর, পোড়ামুখী!’ নিজেকে শাসাল মেয়েটা। ‘ডরাচ্ছিস কেন বাচ্চাদের মত?’

দূরে মিলিয়ে গেল সাইরেনের করুণ বিলাপ। নিজের দু’বাহু আঁকড়ে ধরে ছটফট করতে লাগল সেলেনা।

কোন্ চুলোয় মরতে গেলে তুমি, রানা?’ মুখেই উচ্চারণ করে ফেলল চিন্তাটা। নিজের উদ্বেগাকুল কণ্ঠস্বরে বিতৃষ্ণা জাগল নিজেরই উপর।

ডোরনবের খুটখাটের সঙ্গে বান্ধবীর অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলে যেতেই বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল সেলেনা। কলজেটা যেন এক লাফে উঠে পড়েছে গলার কাছে।

ছায়ায় ঢাকা পুরুষালি একটা অবয়ব সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে!

সকল অধ্যায়

১. শকওয়েভ – ১
২. শকওয়েভ – ২
৩. শকওয়েভ – ৩
৪. শকওয়েভ – ৪
৫. শকওয়েভ – ৫
৬. শকওয়েভ – ৬
৭. শকওয়েভ – ৭
৮. শকওয়েভ – ৮
৯. শকওয়েভ – ৯
১০. শকওয়েভ – ১০
১১. শকওয়েভ – ১১
১২. শকওয়েভ – ১২
১৩. শকওয়েভ – ১৩
১৪. শকওয়েভ – ১৪
১৫. শকওয়েভ – ১৫
১৬. শকওয়েভ – ১৬
১৭. শকওয়েভ – ১৭
১৮. শকওয়েভ – ১৮
১৯. শকওয়েভ – ১৯
২০. শকওয়েভ – ২০
২১. শকওয়েভ – ২১
২২. শকওয়েভ – ২২
২৩. শকওয়েভ – ২৩
২৪. শকওয়েভ – ২৪
২৫. শকওয়েভ – ২৫
২৬. শকওয়েভ – ২৬
২৭. শকওয়েভ – ২৭
২৮. শকওয়েভ – ২৮
২৯. শকওয়েভ – ২৯
৩০. শকওয়েভ – ৩০
৩১. শকওয়েভ – ৩১
৩২. শকওয়েভ – ৩২
৩৩. শকওয়েভ – ৩৩
৩৪. শকওয়েভ – ৩৪
৩৫. শকওয়েভ – ৩৫
৩৬. শকওয়েভ – ৩৬
৩৭. শকওয়েভ – ৩৭
৩৮. শকওয়েভ – ৩৮
৩৯. শকওয়েভ – ৩৯
৪০. শকওয়েভ – ৪০
৪১. শকওয়েভ – ৪১
৪২. শকওয়েভ – ৪২
৪৩. শকওয়েভ – ৪৩
৪৪. শকওয়েভ – ৪৪
৪৫. শকওয়েভ – ৪৫
৪৬. শকওয়েভ – ৪৬
৪৭. শকওয়েভ – ৪৭
৪৮. শকওয়েভ – ৪৮
৪৯. শকওয়েভ – ৪৯
৫০. শকওয়েভ – ৫০
৫১. শকওয়েভ – ৫১
৫২. শকওয়েভ – ৫২
৫৩. শকওয়েভ – ৫৩
৫৪. শকওয়েভ – ৫৪
৫৫. শকওয়েভ – ৫৫
৫৬. শকওয়েভ – ৫৬
৫৭. শকওয়েভ – ৫৭
৫৮. শকওয়েভ – ৫৮
৫৯. শকওয়েভ – ৫৯
৬০. শকওয়েভ – ৬০
৬১. শকওয়েভ – ৬১
৬২. শকওয়েভ – ৬২
৬৩. শকওয়েভ – ৬৩
৬৪. শকওয়েভ – ৬৪
৬৫. শকওয়েভ – ৬৫
৬৬. শকওয়েভ – ৬৬
৬৭. শকওয়েভ – ৬৭
৬৮. শকওয়েভ – ৬৮
৬৯. শকওয়েভ – ৬৯
৭০. শকওয়েভ – ৭০
৭১. শকওয়েভ – ৭১
৭২. শকওয়েভ – ৭২
৭৩. শকওয়েভ – ৭৩
৭৪. শকওয়েভ – ৭৪
৭৫. শকওয়েভ – ৭৫
৭৬. শকওয়েভ – ৭৬
৭৭. শকওয়েভ – ৭৭
৭৮. শকওয়েভ – ৭৮
৭৯. শকওয়েভ – ৭৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন