শকওয়েভ – ৬২

কাজী আনোয়ার হোসেন

বাষট্টি

ছোট্ট একটা সম্ভাবনা রয়েছে যান্ত্রিক ফড়িংটা নিচে নামার আগেই কারখানা ছেড়ে পালানোর। কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে সুযোগটা।

ছোঁ দিয়ে ক্যানভাস ব্যাগটা তুলে নিয়েই দৌড়াল রানা সেলেনার পিছনে।

কয়েক কদম দৌড়েই চপারটাকে দেখতে পেল রানা। ট্যাকটিকাল ভেস্ট পরা এক লোক ঝুঁকে রয়েছে হ্যাচওয়ের বাইরে। লোকটার দস্তানা পরা হাতে ছোটখাটো কালো জিনিসটাও নজর এড়াল না।

সময় যেন ধীর হয়ে গেল। স্লো মোশনে সূর্যালোকে বেরিয়ে যাচ্ছে সেলেনা, এমনটাই মনে হলো রানার।

‘দাঁড়াও! যেয়ো না!’ ডাকল ও চিৎকার করে।

কিন্তু জোরে ছোটার কারণে থামতে পারল না সেলেনা।

ওকে দেখা মাত্রই ফায়ার করল এয়ারক্রাফটে বসা মেশিন গানার।

কংক্রিটের গায়ে ছোবল মারল বুলেট। দরজার আশপাশের দেয়াল থেকে খুবলে তুলল পাথরের চলটা।

দৌড়ের বেগে কয়েক পা এগিয়ে ব্রেক কষল রানা।

সামনেই হাতপা ছড়িয়ে পড়ে আছে সেলেনা। বোঝা যাচ্ছে না, গুলি লেগেছে কি না।

হাত বাড়িয়ে ওর কবজি ধরল রানা। টেনে নিয়ে চলল দরজার দিকে।

নিচের দিকে নাক তাক করে জমিনের আরও কাছে নেমে এসেছে কালো জেট রেঞ্জার, লেজটা উপরদিকে। খোলা সাইড হ্যাচ থেকে গুলি চালানো অব্যাহত রেখেছে মেশিন গানধারী।

আবার ঢুকে পড়ল ওরা বিল্ডিঙের ভিতর।

আক্রমণের আকস্মিকতাই শুধু বিহ্বল করে দেয়নি রানাকে; গুলি খেয়েছে সেলেনা, এহেন শঙ্কায় চলচ্ছক্তি লোপ পাওয়ার দশা হয়েছে ওর। দরজার আড়ালে পৌঁছে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা করে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো।

‘ঈশ্বর!’ শ্বাস চাপল সেলেনা। ‘আরও একবার রক্ষা পাওয়া গেল অল্পের জন্যে!’

‘দৌড় দাও আরও!’ বকল ওকে রানা। স্বস্তির বান ডেকেছে শরীরে। বিনিময়ে ওর গালে চুমু দিল সেলেনা।

যদিও বেশিক্ষণ থাকল না স্বস্তিটা। স্রেফ কয়েক গজ দূরে ল্যাণ্ড করার জন্য নামতে শুরু করেছে ‘কপ্টারটা। প্রবল বাতাসের কারণে সৃষ্টি হয়েছে ধুলোর ঘূর্ণি।

বিশাল ফড়িঙের স্কিড দুটো জমিন ছুঁয়েছে কি ছোঁয়নি, তার আগেই হ্যাচ থেকে লাফিয়ে নামল শুটার। ঝটিতি এমপিসেভেন সাব-মেশিন গান রিলোড করে ছুটে এল আগাছা ছাওয়া ফাটা কংক্রিটের উপর দিয়ে।

দৃশ্যটা উঁকি মেরে দেখছিল রানা, নিচু হয়ে দরজার কাছ থেকে সরে গেল ও আরও একটু ভিতরদিকে। যে-কোনও একটা অস্ত্রের খোঁজে উদ্ভ্রান্তের মত তাকাচ্ছে চারপাশে। কাজে আসবে, এমন যে-কোনও কিছু।

রোটরের মত্ত ঝাপটায় তৈরি হওয়া ধূলিঝড়ের ভিতর দিয়ে দেখতে পেল অস্ত্রটা, ঘাড়ভাঙা গুস্তাফের কাছ থেকে খানিকটা দূরে পড়ে আছে।

হাত বাড়িয়ে ঝাঁপ দিল রানা ওটার জন্য। খপ করে তুলে নিয়েই ধুলোর মাঝে মাপা গড়ান দিল একটা। তড়াক করে দু’পায়ের উপর সিধে হয়েই তাক করল অস্ত্রটা হুড়মুড় করে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়া গানম্যানের দিকে।

‘অস্ত্র ফেলো!’ টারবাইনের জোরালো আওয়াজ ছাপিয়ে হুকুম করল রানা।

খেলনা বই আর কিচ্ছু নয় মডিফায়েড পিস্তলটা। এমন একজনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে চাইছে ও ওটা নিয়ে, যে- লোক অ্যামেচার নয় গুস্তাফ ভিকান্দারের মত। গলার স্বর আর চোখের চাউনিতে ধরা পড়ে যেতে পারে ধোঁকাটা, সে- ব্যাপারেও সতর্ক রানা।

ট্রিগার থেকে আঙুল সরিয়ে অস্ত্র নামাতে দেখে সংক্ষিপ্ত একটা সময়ের জন্য মনে হলো ওর, কাজে দিয়েছে কৌশলটা। পরক্ষণেই বুঝতে পারল, কারণটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ধীর পায়ে এন্ট্রান্স দিয়ে প্রবেশ করল রানার চিরশত্রু কবির চৌধুরী।

অমনটাই প্রথমে মনে হলো রানার। তার পর যখন দেখল—পাঁচ ফুট চারের বেশি নয় লোকটা উচ্চতায়, ভাঙল ওর ভুলটা। তা ছাড়া হাত, পা, চোখবিহীন যে-লোকের শেষ পরিণতি দেখেছিল ও মিয়ানমারের গোয়ানো দ্বীপে, সেখান থেকে বেঁচে ফেরাটা শুধু অসম্ভবই নয়, অলৌকিকও বটে। [রানা ৩৫৫, শয়তানের দ্বীপ দ্রষ্টব্য।]

পাতলা, সাদা চুল আর অস্থিচর্মসার, হলদেটে মুখটা দেখলে মনে হয়, কমপক্ষে সত্তর হবে এর বয়স। ঢলঢলে একটা সুট চড়িয়েছে বুড়িয়ে যাওয়া শরীরে। ওটার সঙ্গে ম্যাচিং করে পরেছে বাদামি কর্ডরয় ট্রাউযার। শরীরের ওজন চাপিয়ে দিয়েছে এক জোড়া ছড়ির উপর—একটা কালো, আরেকটা সাদা।

দেখেও দেখল না যেন সাব-মেশিন গানধারীকে। দীর্ঘ কাল ধরে সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরায় এমন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে যে, লোকটার উপস্থিতি কোনও প্রভাবই ফেলে না বৃদ্ধের মধ্যে।

পিছন পিছন এল বাকি লোকগুলো। সংখ্যায় সাতজন ওরা। সামনের দু’জনের হাবভাবে সিআইএ এজেন্টের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। পুরোদস্তুর কালো সুট আর সানগ্লাস পরা আস্ত দাঁড়কাক যেন। মনে হচ্ছে, কড়া ইস্তিরি দেয়া মাল। কিন্তু প্রায় নিশ্চিত রানা, সিআইএ এজেন্ট নয়, অন্য কিছু এরা। বাকি পাঁচজনকে দেখাচ্ছে স্পেশাল ফোর্সের প্রাক্তন সদস্যের মত। ভাড়া করে আনা চালু বন্দুকবাজ। কঠোর চেহারা। কঠিন চাউনি। চুলগুলো খাটো করে ছাঁটা। সাব-মেশিন গানারের মত কমব্যাট আর্মার প্রত্যেকের পরনে। প্রত্যেকেই বহন করছে কালো এআর-ফিফটিন রাইফেল।

মন্থর পায়ে রানার কাছাকাছি হলো সেলেনা, বুড়োটা আর ওর অনুচরদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অকেজো পিস্তলটা ফেলে দিল রানা মেঝেতে।

কংক্রিটের উপর ওয়াকিং স্টিকের ঠুকঠুকের প্রতিধ্বনি উঠছে ফাঁকা দালান জুড়ে। ন্যূনতম দৃষ্টিপাত না করে গুস্তাফ ভিকান্দারের নিথর দেহটা পেরিয়ে এল বৃদ্ধ। রানা-সেলেনার ছ’ফুট তফাতে এসে থেমে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। পার্চমেন্টের মত শীর্ণ মুখটার চাইতেও দর্শনীয় জিনিস অভিব্যক্তিহীন পাথুরে চোখ দুটো। বেশির ভাগ মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না, এমন সব ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী ও-দুটো।

শিরশির করে ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত উঠে এল রানার শিরদাঁড়া বেয়ে ঘাড়ের কাছে। এমন একজনের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, এ জগতে পূর্ণ হয়েছে যার পাপের ঘড়া। সমস্ত অশুভের প্রতিনিধিত্ব করছে যেন নবাগত এই লোক।

মেজর মাসুদ রানা আর ডক্টর সেলেনা বার্নহার্ট,’ উচ্চারণ করল লোকটা বালি-ঘষা কণ্ঠে। ‘যে যার জায়গায় খ্যাতিমান আপনারা। অধমের নাম জোসেফ নিকলসন। তবে অধিকাংশ লোকে চেনে স্রেফ চিফ হিসেবে। গত কয়েকটা দিন কম দৌড়ঝাঁপ হয়নি আপনাদের জন্যে। শেষ পর্যন্ত পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে সম্মানিত বোধ করছি নিজেকে।’

‘আমরা করছি না,’ সোজা-সাপটা বলল রানা।

অদ্ভুত ধরনের নির্লিপ্তি নিয়ে মুখটা ওর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরখ করতে লাগল চিফ নিকলসন। চলনে-বলনে নির্জীবতা সত্ত্বেও, মুদিত-প্রায় চোখ দুটোর তীব্র দৃষ্টি যেন অন্তর ভেদ করছে রানার। জখমগুলো দেখল ভালো করে।

‘আমাদের অতিথিদের ভদ্রতাবোধে বেশ ঘাটতি রয়েছে, দেখতে পাচ্ছি,’ ফের বলে উঠল নির্জীব কণ্ঠে। ‘তবে নিশ্চিত থাকুন, মারধর করার নির্দেশ আমি দিইনি। ওদের যদি মনে হয়ে থাকে, আপনাকে পিটিয়ে নরম করা দরকার, সেটা করেছে ওদেরকে আপনি ভয় পাইয়ে দিয়েছেন বলে।’

‘এত ভয় পাওয়ার কী আছে? আমি তো সম্পূর্ণ নিরস্ত্র এক লোক।’

‘তার পরেও এর কী অবস্থা করেছেন, দেখুন!’ মৃদু মাথা নেড়ে মেঝেতে পড়ে থাকা গুস্তাফের লাশটার দিকে ইঙ্গিত করল চিফ। ‘যাক গে, যা বলছিলাম… ধরা পড়ার কিছুক্ষণ বাদেই আপনার ব্যাপারে ব্রিফ করা হয় ওদের। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, লোগান বালবোয়ার সত্যিকার পরিচয় পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ওরা। আপনার ব্যাকগ্রাউণ্ডের মতই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন আপনি প্রতিটা কাজে—বার বার যেভাবে আমাদের প্রতিটা মিশন ব্যর্থ করে দিয়েছেন, তাতে এ আতঙ্কের জন্যে ওদের দোষ দেয়া যায় না। কম রিসোর্স ইউজ করা হয়নি আপনাদের দু’জনকে পাকড়াও করার জন্যে, হারাতে হয়েছে অত্যন্ত দক্ষ বেশ ক’জন এজেন্টকে। সহজে পরাজিত হওয়ার পাত্র ছিল না ওরা। তার পরও আপনি যেভাবে সামলেছেন ওদেরকে—বিস্ময়কর!’ ঠোঁট বেঁকে গেল লোকটার। ওটা কি হাসি, না ভেংচি, বোঝা গেল না।

‘গিবসনের ব্যাপারে আন্তরিক দুঃখিত আমি,’ ব্যঙ্গ করল রানা। ‘বড়ই করুণ মৃত্যু হয়েছে হারামিটার।’

‘বিশ্বাস করা কষ্টকর।’

‘মাথা নাড়ল বৃদ্ধ। ‘এমনকী ভিকান্দারের মত নিরীহ লোককেও কেড়ে নিয়েছেন আপনি আমার কাছ থেকে।’ অনুযোগ ফুটল যেন কণ্ঠস্বরে। ‘বুঝতে পারছি না, কাকে বসাব ওর জায়গায়। আজকের দিনে ওরকম একজন যোগ্য লোক পাওয়া খুবই মুশকিল।’

‘পেয়ে যাবেন,’ কৃত্রিম সান্ত্বনা রানার কণ্ঠে। ‘এ ধরনের ইতর লোকের অভাব নেই দুনিয়ায়।’

‘একটা প্রস্তাব আছে আমার।’

‘কী প্রস্তাব?’

‘লোকটার জায়গা নিতে পারেন আপনি। বুঝতেই পারছেন, গুণের কদর করি আমরা।’

‘অনেক ধন্যবাদ। ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্য পরিকল্পনা রয়েছে আমার।’

‘দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে, আপনার যে-পরিকল্পনাই থেকে থাকুক না কেন, বাস্তবায়নের সুযোগটা আর পাচ্ছেন না, মেজর। ছুটোছুটির পালা সাঙ্গ হয়েছে আপনাদের।’

‘এটা বলার জন্যে এদ্দূর এসেছেন!’ প্রথমবারের মত মুখ খুলল সেলেনা। ‘অভিভূত হয়ে গেলাম আপনাদের আন্তরিকতা দেখে…’

ওর দিকে ঘাড় ঘোরাল চিফ। ‘আপনি আর মেজর রানাই আমাদের ইন্দোনেশিয়া সফরের প্রধান উপলক্ষ নন।’ এক পলকের জন্য অমায়িক দাদা-নানা গোছের মনে হলো বৃদ্ধকে। পরক্ষণেই আবার মৃত্যুশীতল চাউনিটা ফিরে এল চোখে। ‘মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশাল এক নাটকের রিহার্সাল তত্ত্বাবধান, যেটা শুরু হতে যাচ্ছে…’ পিছনে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল শান্ত স্বরে, ‘কতক্ষণ সময় আছে, গ্রেগর?’

দুই সহযোগীর একজন কোটের আস্তিন সরিয়ে চোখ রাখল গাবদাগোবদা মিলিটারি ঘড়িতে। ‘আটাশ মিনিট একচল্লিশ সেকেণ্ড, স্যর।’ একান্ত বাধ্য রোবট-মানবের নিরাসক্ত মুখোশও পুরোপুরি ঢাকতে পারল না কণ্ঠস্বরের উদ্বিগ্ন কাঁপুনি।

সে-ই শুধু নয়। সশস্ত্র গুণ্ডাগুলোও নার্ভাসভাবে পায়ের ভর বদলাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার উত্তেজনা দেখতে পাচ্ছে রানা লোকগুলোর চেহারায়। হেলিকপ্টারে ফেরার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছে ওরা। আটাশ মিনিট একচল্লিশ সেকেণ্ডের আগেই লেজ গোটাতে চাইছে এখান থেকে।

‘রিহার্সাল!’ উচ্চারণ করল সেলেনা শ্লেষের কণ্ঠে। ‘ছোট্ট মেশিনটা আরেক বার চালু করছেন তা হলে! আবার একটা পরীক্ষা… আসল কাজের আগে আবারও একটু ফাইন- টিউনিং! সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ব্যাপারে ভুল বলেননি তা হলে মিস্টার ভিকান্দার! কিন্তু কী সেই পরিকল্পনা?’

‘শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কৌতূহলী আপনি, ডক্টর বার্নহার্ট।’ দাঁত দেখাল নিকলসন। ‘তারিফ করতে হয় বিজ্ঞানের প্রতি আপনার এ নিঃস্বার্থ আকর্ষণের। অত্যন্ত আফসোসের ব্যাপার, আমাদের সাফল্য দেখার জন্যে জীবিত থাকছেন না আপনি। সে যা-ই হোক… খুচরো আলাপ বাদ দিয়ে যে-কাজে এসেছি, সে-কাজে মনোনিবেশ করা উচিত এখন। ঘুরল চিফ নিজের লোকেদের দিকে।

স্বস্তির পরশ লাগল আট সহচরের মধ্যে। ‘নিয়ে এসো ওকে,’ নির্দেশ দিল চিফ।

ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দুই মার্সেনারি পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল এন্ট্রান্স দিয়ে। খানিক বাদেই ফিরল আবার আরেকজনকে নিয়ে।

লোকটার হাত দুটো টেপ দিয়ে পিছনে আটকানো। কালো কাপড়ের হুড টেনে দেয়া হয়েছে মুখের উপর। ওই অবস্থাতেই দু’দিক থেকে জাপটে ধরে হাঁটতে বাধ্য করা হচ্ছে তাকে লম্বা লম্বা পদক্ষেপে।

দু’পাশের দু’জনের চেয়ে মাথায় উঁচু বন্দি মানুষটা। কিন্তু শারীরিক যন্ত্রণায় ঝুঁকে রয়েছে যেন। রক্তের দাগে ভরা শার্টের সামনের দিকটা। কোত্থেকে এসেছে ওই রক্ত, এটা বুঝতে রকেট-সায়েন্টিস্ট হতে হয় না।

চোখে প্রশ্ন নিয়ে রানার দিকে তাকাল সেলেনা। কে এই লোক?

‘বাঁধন খুলে দাও,’ আবার নির্দেশ দিল চিফ।

বন্দির মাথা থেকে টান দিয়ে হুড সরিয়ে ফেলল এক মার্সেনারি। আরেকজন মিলিটারি নাইফ বের করে চালিয়ে দিল জোড়া কবজির মাঝখানে। ‘ফড়াত’ করে ছিঁড়ে গেল প্লাসটিকের টেপ।

ভালো করে চাইল রানা লোকটার দিকে। শ্বেতাঙ্গ। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের ঘরে বয়স। ঘন, বাদামি চুল মাথায়। গড়ন চমৎকার হলেও শরীরের বাঁধুনি ততটা নিরেট নয়।

ভীষণ অসুস্থ দেখাচ্ছে লোকটাকে। সারা মুখ জুড়ে ক্ষত আর কালশিটে দেখে আন্দাজ করল রানা, অন্তত কয়েক দিন ধরে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালানো হয়েছে এর উপর।

মারের চোটে প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছে বেচারার চোখ দুটো। তার পরও ঠাহর করার চেষ্টা করছে চারপাশটা, কষ্ট সহ্য করে তাকাচ্ছে ইতিউতি। যন্ত্রণাকাতর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো রানা-সেলেনার উপর। বুঝতে কষ্ট হলো না, ওদেরই মতন একই জিনিস ভাবছে নির্যাতিত লোকটা: কারা এরা?

‘অপেক্ষার সময়টুকু সঙ্গ দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো আপনাদের সম্মানে,’ রঙ্গ করল চিফ। ‘শো শুরু হওয়ার আগে তেইশ মিনিট পাচ্ছেন একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে।’ মৃদু নড করল বৃদ্ধ সঙ্গীদের উদ্দেশে।

ক্রমবর্ধমান উৎকণ্ঠায় এতক্ষণ ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিল আট অনুচর, অনুনয়ের দৃষ্টি দিচ্ছিল ঊর্ধ্বতনের প্রতি।

‘ঠিক আছে, যাওয়া যাক তা হলে,’ সিদ্ধান্ত জানাল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ‘সিল করে দাও বাড়িটা। নিশ্চিত করবে, মেহমানরা যাতে পালাতে না পারে।’

‘কোনও হ্যাণ্ডকাফ, বাঁধন — কিচ্ছু না?’ অবাক হলো রানা।

‘বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, ইয়াংম্যান। একটু পরেই টের পেয়ে যাবেন সব কিছু। আগে থেকে জানিয়ে দিয়ে চমকটা মাটি করতে চাই না। দর্শনীয় এক বিশেষ অনুষ্ঠান উপভোগ করতে চলেছেন আপনারা একেবারে সামনের সারিতে বসে। সৌভাগ্যবান মনে করুন নিজেদের। শিগগিরই হতে চলেছেন ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অ্যাডিউ, মেজর রানা। অ্যাডিউ, ডক্টর বার্নহার্ট। সত্যিই ভালো লাগল আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে।’

‘আউ রিভোয়া (আবার দেখা হবে), চিফ নিকলসন, ‘ বলল রানা প্রত্যুত্তরে।

‘অত নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে?’ সম্বোধনে আন্তরিক খুশি হয়েছে বৃদ্ধ। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীর হায় রে জীবন-নদে? ঘটনাবহুল, সমৃদ্ধ একটা জীবন কাটিয়েছেন আপনি। এবার মেনে নিন নিজের শেষটা।’ শেষ কথা বলে দেয়ার তৃপ্তি পরিষ্কার ফুটে উঠল লোকটার চোখে-মুখে।

ছড়ির উপর ঘুরে দাঁড়াল চিফ। দুর্বল পা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব, হাঁটা শুরু করল দরজার দিকে।

নার্ভাস তাড়ায় অনুসরণ করল সুট পরিহিত জোড়া দাঁড়কাক।

শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রানা, সেলেনা ও বেনামী বন্দির দিকে অস্ত্র ধরে রেখে সবার শেষে বেরিয়ে গেল ছয় সৈন্য। লাগিয়ে দেয়া হলো ইস্পাতের উঁচু দরজা। জোরালো ধাতব আওয়াজের সঙ্গে ভিতরে আটকা পড়ল ওরা। শেকলটাও তালায় আটকানোর শব্দ পাওয়া গেল।

এর একটু পরেই শোনা গেল হেলিকপ্টারের ধুবধুব আওয়াজ।

সকল অধ্যায়

১. শকওয়েভ – ১
২. শকওয়েভ – ২
৩. শকওয়েভ – ৩
৪. শকওয়েভ – ৪
৫. শকওয়েভ – ৫
৬. শকওয়েভ – ৬
৭. শকওয়েভ – ৭
৮. শকওয়েভ – ৮
৯. শকওয়েভ – ৯
১০. শকওয়েভ – ১০
১১. শকওয়েভ – ১১
১২. শকওয়েভ – ১২
১৩. শকওয়েভ – ১৩
১৪. শকওয়েভ – ১৪
১৫. শকওয়েভ – ১৫
১৬. শকওয়েভ – ১৬
১৭. শকওয়েভ – ১৭
১৮. শকওয়েভ – ১৮
১৯. শকওয়েভ – ১৯
২০. শকওয়েভ – ২০
২১. শকওয়েভ – ২১
২২. শকওয়েভ – ২২
২৩. শকওয়েভ – ২৩
২৪. শকওয়েভ – ২৪
২৫. শকওয়েভ – ২৫
২৬. শকওয়েভ – ২৬
২৭. শকওয়েভ – ২৭
২৮. শকওয়েভ – ২৮
২৯. শকওয়েভ – ২৯
৩০. শকওয়েভ – ৩০
৩১. শকওয়েভ – ৩১
৩২. শকওয়েভ – ৩২
৩৩. শকওয়েভ – ৩৩
৩৪. শকওয়েভ – ৩৪
৩৫. শকওয়েভ – ৩৫
৩৬. শকওয়েভ – ৩৬
৩৭. শকওয়েভ – ৩৭
৩৮. শকওয়েভ – ৩৮
৩৯. শকওয়েভ – ৩৯
৪০. শকওয়েভ – ৪০
৪১. শকওয়েভ – ৪১
৪২. শকওয়েভ – ৪২
৪৩. শকওয়েভ – ৪৩
৪৪. শকওয়েভ – ৪৪
৪৫. শকওয়েভ – ৪৫
৪৬. শকওয়েভ – ৪৬
৪৭. শকওয়েভ – ৪৭
৪৮. শকওয়েভ – ৪৮
৪৯. শকওয়েভ – ৪৯
৫০. শকওয়েভ – ৫০
৫১. শকওয়েভ – ৫১
৫২. শকওয়েভ – ৫২
৫৩. শকওয়েভ – ৫৩
৫৪. শকওয়েভ – ৫৪
৫৫. শকওয়েভ – ৫৫
৫৬. শকওয়েভ – ৫৬
৫৭. শকওয়েভ – ৫৭
৫৮. শকওয়েভ – ৫৮
৫৯. শকওয়েভ – ৫৯
৬০. শকওয়েভ – ৬০
৬১. শকওয়েভ – ৬১
৬২. শকওয়েভ – ৬২
৬৩. শকওয়েভ – ৬৩
৬৪. শকওয়েভ – ৬৪
৬৫. শকওয়েভ – ৬৫
৬৬. শকওয়েভ – ৬৬
৬৭. শকওয়েভ – ৬৭
৬৮. শকওয়েভ – ৬৮
৬৯. শকওয়েভ – ৬৯
৭০. শকওয়েভ – ৭০
৭১. শকওয়েভ – ৭১
৭২. শকওয়েভ – ৭২
৭৩. শকওয়েভ – ৭৩
৭৪. শকওয়েভ – ৭৪
৭৫. শকওয়েভ – ৭৫
৭৬. শকওয়েভ – ৭৬
৭৭. শকওয়েভ – ৭৭
৭৮. শকওয়েভ – ৭৮
৭৯. শকওয়েভ – ৭৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন