শকওয়েভ – ১

কাজী আনোয়ার হোসেন

এক

ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে থেকে থেকে তুষারের চাবুক আছড়ে পড়ছে নগ্ন পর্বতের গায়ে। প্রচণ্ড ঝড়-ঝাপটা সইতে সক্ষম ফোর-হুইল-ড্রাইভেরও সাধ্য নেই এহেন দুর্যোগপূর্ণ আব- হাওয়ায় এত উঁচুতে পৌঁছায়।

পশ্চিম মঙ্গোলিয়ার বায়ান-ওলগি প্রদেশ। আলতাই পর্বতমালা।

শীতকালীন এ তুষারবৃষ্টি যে শিগগিরই মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠবে, সে-সম্পর্কে সম্যক ধারণা রয়েছে তৈমুরের। টানা তুষারপাতের কারণে, কে জানে, পরের বার হয়তো শিকারের সন্ধানে আসতেই পারল না এত দূর!

আরগালি ভেড়ার ক্ষুরের চিহ্ন ধরে ধরে আধ মাইলমত রুক্ষ, পাহাড়ি পথ পিছে ফেলে এসেছে তরুণ শিকারি। বহু নিচে রশি দিয়ে বাঁধা ওর টাট্টু ঘোড়া।

এ অঞ্চলের মানুষের কাছে নেকড়ে হচ্ছে সার্বক্ষণিক উদ্বেগের কারণ। তবে বহু দূর থেকেই ওগুলোর উপস্থিতি টের পাওয়ার ক্ষমতা রয়েছে আরগালির। চলার পথে জায়গায় জায়গায় থেমে বিশ্রাম নিচ্ছে পেঁচানো শিংঅলা, বিরাটাকৃতি পাহাড়ি ভেড়াগুলো। তৃপ্তির সঙ্গে চিবাচ্ছে খরখরে হিদারের চাপড়া। পালটার অনুত্তেজিত আচরণ দেখে আশ্বস্ত হয়েছে শিকারি — সহি সালামতেই রয়েছে ওর ঘোড়াটা।

শিকারে অস্বাভাবিক দক্ষতা রয়েছে ছেলেটার। ভেড়ার পালের চোখ এড়িয়ে শিকারের একেবারে নাকের কাছে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে সে। গত পাঁচটি বছর ধরে পাহাড়ে পাহাড়ে শিকারের কাজ করে বেড়াচ্ছে তরুণ তৈমুর। ওর যখন বারো বছর বয়স, যার পর নাই ভেঙে পড়েছিল বুড়ো বাপটার শরীর। ঘোড়ায় চেপে দূর-যাত্রায় বেরোনোর উপায় আর ছিল না তার। তখন থেকেই পরিবারের হাল ধরেছে সে।

যে-কোনও স্থলচর বা খেচর প্রাণীর অগোচরে নিঃশব্দে তার একেবারে কাছে পৌঁছে যাওয়ার বিরল প্রতিভা রয়েছে এই তরুণের। বাপ-মা আর ছ’ভাই-বোনের মাংসের জোগান দিচ্ছে মূলত ও-ই। মঙ্গোলিয়ার নিঠুর পরিবেশে মাংসই হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রধান জ্বালানি।

বাতাসে ওর গায়ের গন্ধ যাতে চরে বেড়ানো ভেড়াগুলোর নাকে না পৌঁছয়, সেজন্য অত্যন্ত সতর্ক রয়েছে মঙ্গোলিয়ান। পাথরের উপর দিয়ে স্বচ্ছন্দে পা ফেলে ফেলে চুপিসারে পৌছে গেল লক্ষ্যবস্তুর এক শ’ মিটারের মধ্যে।

উঁচু মত এক জায়গায় অবস্থান নিয়েছে ও। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে নির্বাচিত ভেড়াটার পাশের দিকটা। বিশাল এক মদ্দা ওটা। চার ফুটমত হবে, আন্দাজ করল শিকারি।

অতি সন্তর্পণে এইমিং পজিশনে নিয়ে এল মান্ধাতার আমলের মার্টিনি-হেনরিটা। স্থির হয়ে গেল ওর শরীরটা আগ্নেয়াস্ত্রের পিছনে। রাইফেলের ব্রিচ খুলে, বেল্ট থেকে বড়সড় একখানা কার্তুজ টেনে নিয়ে নীরবে ঢোকাল অস্ত্রে। এর পর ব্রিচ বন্ধ করে ওপরে তুলল রিয়ারসাইটের পাতাটা। এই রেঞ্জ থেকে অনুমান করতে পারছে, ঠিক কতখানি উপরে লক্ষ্যস্থির করতে হবে। চলতে চলতে মাধ্যাকর্ষণের টানে নেমে এসে সঠিক লক্ষ্যে আঘাত হানবে ঘুরন্ত, ভারি বুলেট।

দূরে মূর্তির মত স্থির হয়ে রয়েছে জানোয়ারটা। কেবল মুখটা নড়ছে তেরছা চিবানোর ভঙ্গিতে।

মনে মনে কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হলো তরুণ। শ্রদ্ধা নিবেদন করল পাহাড়-পর্বতের দেবতার প্রতি। চোখ মিটমিট করে পাপড়ি থেকে ঝরাল তুষারকণা। আলতো করে আঙুল জড়িয়েছে ট্রিগারে।

সাধারণ, স্বাভাবিক ছন্দে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে না শিকারি এখন। টার্গেটের উপর পরিপূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করায় হৃৎপিণ্ডের গতি যে ধীর হয়ে এসেছে, অনুভব করছে বিলক্ষণ। নিশানাভেদে ব্যর্থ হলে, ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে জানোয়ারগুলো। সেক্ষেত্রে আজ আর উপায় নেই শিকার পাওয়ার। এ হপ্তাটাই পার করতে হবে মাংসের জোগান ছাড়া।

কিন্তু না, বিফল হবে না ও। আত্মপ্রত্যয়ের অভাব নেই ওর তরুণ বুকে। আজ রাতে, বহু দিন পর আবার মাংস তুলে দেবে ও পরিবারের সবার মুখে।

মোক্ষম মুহূর্ত বুঝে ধীর ভঙ্গিতে টেনে দিল সে ট্রিগার।

সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো যেন কেয়ামত!

বিস্ফোরণের জোরালো শব্দের সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল গানসাইটের উপর দিয়ে দেখা দৃশ্যটা।

প্রথমে বিহ্বল তৈমুরের মনে হলো, কীভাবে জানি বিস্ফোরিত হয়েছে ওর প্রাচীন রাইফেলটা।

না। তা তো নয়! আস্তই রয়েছে এটা। আর গুলিও হয়েছে ঠিকঠাক। মদ্দা ভেড়াটা গুলি খেয়ে লাফিয়ে শূন্যে ওঠার আগেই ঘটে গেছে ভয়ঙ্কর কী যেন।

পাহাড়টা কি সরে যাচ্ছে পায়ের নিচ থেকে? প্রবল এক ঝাঁকিতে শূন্যে ছুঁড়ে দিল ওকে অদৃশ্য এক শক্তি। ফুরসতই পেল না চিৎকার করার।

গড়াতে গড়াতে, ডিগবাজি খেতে খেতে পর্বত থেকে পিছলে পড়ছে তৈমুর। গুরুগম্ভীর আওয়াজে ভরে রয়েছে ওর শ্রবণেন্দ্রিয়। কীসের এক জোর আঘাতে জ্ঞান হারাল বেচারা।

.

জ্ঞান যখন ফিরল, আকাশটা ততক্ষণে কালো হয়ে গেছে।

অনেক, অনেকক্ষণ পর উঠে বসল তৈমুর। তুষার সরাল চোখের পাতা থেকে। ঠাণ্ডায় কাঁপছে ঠকঠক করে। জামা- কাপড়ে চাপড় দিয়ে তুষার আর ধুলো সাফ করল।

খানিক পর কোনমতে সোজা হয়ে দাঁড়াল ও। টলছে। প্রলয়ঙ্করী ভূমিধসে জানে না কখন কোথায় হারিয়েছে শিকারের একমাত্র অবলম্বন- মার্টিনি-হেনরিটা। ধসটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে ওকে পর্বত থেকে।

ঘটনার আকস্মিকতা এখনও সামলে উঠতে পারেনি ছেলেটা। রাইফেলটার খোঁজে আবার পাথুরে ঢাল বেয়ে উঠতে আরম্ভ করল কষ্টেসৃষ্টে।

উপরে উঠেই কুঁকড়ে গেল ও তীব্র আতঙ্কে। ভয় পাচ্ছে সামনের দিকে তাকাতে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভয় পরাজিত হলো কৌতূহলের কাছে।

নিচের অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা দেখে শ্বাস আটকে এল ওর।

বিশাল, প্রায়-নিখুঁত একটা বৃত্তাকার জায়গা জুড়ে ঘটা প্রলয়কাণ্ডের সীমানার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও পাহাড়টার চূড়ায়। শিকারির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যত দূর দেখতে পাচ্ছে, তত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত এই ধ্বংসযজ্ঞ।

তাকাল আশপাশে। নিশ্চিন্তে চরতে থাকা আরগালিগুলো উধাও হয়ে গেছে ভোজবাজির মত।

প্রকাণ্ড সব পাথর খসে পড়ে সমান হয়ে গেছে পাহাড়ের ওপাশটা। তলায় আছড়ে পড়ে গুঁড়িয়ে গেছে পাথরগুলো। পাইনের জঙ্গল পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন।

নরকের কোনও রাক্ষস যেন তাণ্ডবনৃত্য চালিয়েছে এলাকা জুড়ে!

নানান অভিব্যক্তির মিশেলে ভাংচুর শুরু হলো ধুলো-ময়লা আর অশ্রুর দাগ লাগা মুখটায়। আদিগন্তবিস্তৃত বিচিত্র আভার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে ও। জীবনে দেখেনি এরকম কিছু। বহু দূরে উড়ন্ত মেঘের ভিতর দিয়ে চাকু চালাচ্ছে যেন বিজলির ফলা। কিন্তু বজ্রের গর্জন নেই কোনও। স্রেফ বিছিয়ে রয়েছে যেন অপ্রাকৃত নৈঃশব্দ্যের ভারি চাদর।

সহসা দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল মনে, অশুভ কোনও অলৌকিক ইশারাতেই মহাবিপর্যয় ঘটে গেছে এখানে।

ভয়ার্ত গোঙানি বেরিয়ে এল তৈমুরের মুখ থেকে। পিছিয়ে এসে তাড়া খাওয়া আরগালির মত পড়িমরি করে উতরাই বেয়ে নেমে যেতে লাগল ও পাহাড় থেকে। ফিরে যাচ্ছে যেখানে বেঁধে রেখে গিয়েছিল ওর টাট্টু ঘোড়াটা।

অধ্যায় ১ / ৭৯

সকল অধ্যায়

১. শকওয়েভ – ১
২. শকওয়েভ – ২
৩. শকওয়েভ – ৩
৪. শকওয়েভ – ৪
৫. শকওয়েভ – ৫
৬. শকওয়েভ – ৬
৭. শকওয়েভ – ৭
৮. শকওয়েভ – ৮
৯. শকওয়েভ – ৯
১০. শকওয়েভ – ১০
১১. শকওয়েভ – ১১
১২. শকওয়েভ – ১২
১৩. শকওয়েভ – ১৩
১৪. শকওয়েভ – ১৪
১৫. শকওয়েভ – ১৫
১৬. শকওয়েভ – ১৬
১৭. শকওয়েভ – ১৭
১৮. শকওয়েভ – ১৮
১৯. শকওয়েভ – ১৯
২০. শকওয়েভ – ২০
২১. শকওয়েভ – ২১
২২. শকওয়েভ – ২২
২৩. শকওয়েভ – ২৩
২৪. শকওয়েভ – ২৪
২৫. শকওয়েভ – ২৫
২৬. শকওয়েভ – ২৬
২৭. শকওয়েভ – ২৭
২৮. শকওয়েভ – ২৮
২৯. শকওয়েভ – ২৯
৩০. শকওয়েভ – ৩০
৩১. শকওয়েভ – ৩১
৩২. শকওয়েভ – ৩২
৩৩. শকওয়েভ – ৩৩
৩৪. শকওয়েভ – ৩৪
৩৫. শকওয়েভ – ৩৫
৩৬. শকওয়েভ – ৩৬
৩৭. শকওয়েভ – ৩৭
৩৮. শকওয়েভ – ৩৮
৩৯. শকওয়েভ – ৩৯
৪০. শকওয়েভ – ৪০
৪১. শকওয়েভ – ৪১
৪২. শকওয়েভ – ৪২
৪৩. শকওয়েভ – ৪৩
৪৪. শকওয়েভ – ৪৪
৪৫. শকওয়েভ – ৪৫
৪৬. শকওয়েভ – ৪৬
৪৭. শকওয়েভ – ৪৭
৪৮. শকওয়েভ – ৪৮
৪৯. শকওয়েভ – ৪৯
৫০. শকওয়েভ – ৫০
৫১. শকওয়েভ – ৫১
৫২. শকওয়েভ – ৫২
৫৩. শকওয়েভ – ৫৩
৫৪. শকওয়েভ – ৫৪
৫৫. শকওয়েভ – ৫৫
৫৬. শকওয়েভ – ৫৬
৫৭. শকওয়েভ – ৫৭
৫৮. শকওয়েভ – ৫৮
৫৯. শকওয়েভ – ৫৯
৬০. শকওয়েভ – ৬০
৬১. শকওয়েভ – ৬১
৬২. শকওয়েভ – ৬২
৬৩. শকওয়েভ – ৬৩
৬৪. শকওয়েভ – ৬৪
৬৫. শকওয়েভ – ৬৫
৬৬. শকওয়েভ – ৬৬
৬৭. শকওয়েভ – ৬৭
৬৮. শকওয়েভ – ৬৮
৬৯. শকওয়েভ – ৬৯
৭০. শকওয়েভ – ৭০
৭১. শকওয়েভ – ৭১
৭২. শকওয়েভ – ৭২
৭৩. শকওয়েভ – ৭৩
৭৪. শকওয়েভ – ৭৪
৭৫. শকওয়েভ – ৭৫
৭৬. শকওয়েভ – ৭৬
৭৭. শকওয়েভ – ৭৭
৭৮. শকওয়েভ – ৭৮
৭৯. শকওয়েভ – ৭৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন