শকওয়েভ – ২১

কাজী আনোয়ার হোসেন

একুশ

হাই-পাওয়ারড আগ্নেয় ডিভাইস নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কম নয় রানার জীবনে। জানে, কত দ্রুত আর কত কার্যকরভাবে হাড় গলানো অগ্নিকাণ্ড ঘটানো সম্ভব ইটপাথরের কোনও স্থাপনাতে। ধোঁয়ায় শ্বাস আটকে মৃত্যু যদি না-ও হয় ওদের, তবে মরবে প্রচণ্ড উত্তাপে কাবাব হয়ে। ফাঁকফোকর গলে কটুগন্ধী ধোঁয়া ঢুকছে তো, ঢুকছেই! এরই মধ্যে দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

দ্রুত কমে আসছে ওদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা!

জ্যা-মুক্ত তীরের মত নিচে নেমে এসে সমাধি-কামরার ভিতরে খোঁজাখুঁজি শুরু করল রানা। কী খুঁজছে, নিজেও জানে না।

‘কী হচ্ছে এসব? কীসের ধোঁয়া এটা, রানা?’ বিপদের আশঙ্কা দেখলে মা যেমন কোলের শিশুকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে, তেমনি করে টেসলা ডিভাইসটা জাপটে ধরে রেখেছে সেলেনা, চোখে উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টি।

‘আমাদেরকে কাবাব বানানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছে!’ শ্লেষের সঙ্গে জবাব দিল রানা।

ঢাকনাখোলা কফিনে হাত ভরে দিয়েছে রানা। যা খুঁজছিল, পেয়ে গেছে! ‘ফড়াত’ করে লম্বা এক ফালি কাপড় ছিঁড়ে নিল কঙ্কালটার গা থেকে। টান দিয়ে ওটা ছুটিয়ে নিতেই ছিটকে বেরোল পাঁজরের ক’খানা আলগা হাড়। এত দিনে কাঠামো হারিয়েছে গলাকাটা কঙ্কাল।

সেলেনার হাতে কাপড়টা গুঁজে দিল রানা। ‘পেঁচিয়ে নাও নাকে-মুখে!’

‘কী বলছ, রানা!’ গা গুলিয়ে উঠল মেয়েটার। ‘একটা লাশের শরীরে জড়ানো ছিল এটা!’

‘যা বলছি, করো!’ কড়া ধমক লাগাল ওকে রানা। ‘এক্ষুণি!’

রেকিং বারটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে এক দৌড়ে উপস্থিত হলো আবার দরজার সামনে। বাটালি-অংশটা ফাঁকের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে চাড় দিতে লাগল এপাশ-ওপাশ। ধোঁয়ার দাপটে জলে ভরে উঠেছে চোখ দুটো।

ওদিক থেকে বাতাস বয়ে এলে কী ঘটতে পারে, জানা আছে রানার। পাতালপুরীতে আগুন ধরে গিয়ে অত্যুত্তপ্ত চুল্লিতে পরিণত হবে কামরাটা। ত্বরান্বিত হবে কাবাব তৈরির প্রক্রিয়া!

শরীরের সমস্ত জোর খাটিয়ে বারটা ফাঁকের আরও ভিতরে ঢুকিয়ে দিল রানা, চাড় লাগাল সর্বশক্তিতে।

এক টুকরো পাথর ভেঙে এল কবাটের কিনার থেকে!

আশার আলো জ্বলে উঠল ওর বুকের মধ্যে। চেষ্টা চালিয়ে গেল বেপরোয়ার মত। অসম্ভব জ্বালা করছে চোখ জোড়া। গলা জ্বলছে ধোঁয়ায়। কাশতে কাশতে জান বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়।

আরেকটা টুকরো খসে পড়ল এবার খিলান থেকে।

লোভাতুরভাবে দরজার প্রান্ত চাটতে শুরু করেছে আগুনের কমলা জিভ! ত্বরিত গতিতে প্রতিকূলতার দিকে মোড় নিচ্ছে পরিস্থিতি।

হঠাৎই হতোদ্যম হয়ে পড়ল রানা। বুঝতে পারছে, বৃথাই এ পরিশ্রম।

‘চলে এসো, রানা!’ চিৎকার করে ডাকল ওকে সেলেনা।

একটা মুহূর্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বে দুলল রানা। তার পর স্খলিত পায়ে নেমে এল ও সিঁড়ি ভেঙে। ধূম্রজাল ভেদ করে পৌঁছুল মেয়েটার কাছে।

কাফনের কাপড়ের টুকরোটা মুখে জড়িয়ে নিয়েছে সেলেনা। আগুনের আভায় আলোকিত কবরখানার দূরপ্রান্তে বসে আছে হামাগুড়ি দিয়ে। ডিভাইসটা হাতে নেই।

বন্দিশালার দেয়াল ভাঙতে চেয়েছিল রানা। পাথর খসিয়ে আনতে চেয়েছিল স্টিলের বার দিয়ে বাড়ি মেরে মেরে। জানত না, অসম্ভব পুরু ওই দেয়ালের ভিত্তি নেমে গেছে মেঝের দশ ফুট গভীরে। জানলে হয়তো ওই চেষ্টায় নষ্ট করত না সময়।

অবশ্য আর কোনও বিকল্পও তো ছিল না ওর হাতে! বেরোনোর একমাত্র পথ কারার ওই লৌহকপাট! পুড়ে কয়লা হতে চলেছে ওরা দরজা ভেঙে বেরোতে ব্যর্থ হওয়ায়!

হাঁটু ভাঁজ করে সেলেনার পাশে বসে পড়ল রানা। অক্টোপাসের আলিঙ্গনে বাঁধল মেয়েটাকে। মানবঢাল হয়ে বাঁচাতে চাইছে যেন আগুন আর ধোঁয়া থেকে।

আর মাত্র কয়েকটা মিনিট! তার পরই লকলকে জিভের আওতায় পেয়ে যাবে ওদেরকে সর্বগ্রাসী আগুন। কিন্তু তার আগেই প্রাণটা নিংড়ে বের করে নেবে শ্বাসরোধকারী ধোঁয়া।

রানার বাহুডোরে ছটফট করছে সেলেনা, মুখ লুকাতে চাইছে বুকের আরও গভীরে।

মেয়েটার চুলের মাঝে নাক ডুবিয়ে দিল রানা। অন্তিম পরিণতির হাতে সঁপে দিয়েছে নিজেদের। আর কিছু তো করারও নেই!

নিজের করুণ মৃত্যু নিয়ে তিল পরিমাণ আক্ষেপ নেই ওর। নিজেও বলতে পারবে না, এ পর্যন্ত কত বার দাঁড়াতে হয়েছে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে। বিপদসঙ্কুল ক্যারিয়ারে বারংবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হতে উপেক্ষা করতে শিখেছে রানা মরণের চোখরাঙানিকে।

কিন্তু সেলেনার তো প্রাপ্য নয় এটা! বান্ধবীর হত্যার কারণ জানতে চেয়েছে, এটাই ওর অপরাধ?

গুড়গুড় করে উঠল রানার বুকের মাঝে। অমনটাই বোধ হলো প্রথমে। পরক্ষণেই ভাঙল ভুলটা।

ওদের পায়ের তলা থেকে আসছে গুড়গুড় শব্দ ও কম্পন! মেঝের অনেক গভীর থেকে আসছে যেন। সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে বেড়েই চলেছে কম্পনের মাত্রা। সঙ্গে একটা গভীর, গম্ভীর ধ্বনি আসছে চারপাশ থেকে। অতিশয় চাপ সৃষ্টি করছে কানের পর্দায়।

সেলেনাও টের পেয়েছে ছন্দোময় কাঁপুনিটা। রানার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে চাইল ওর দিকে। নড়ছে মুখটা। কী যেন বলছে ও রানাকে।

কানে ঢুকল না রানার। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা বজ্রনাদের নিচে চাপা পড়ে গেল কথাগুলো।

নিরুপায় হয়ে কাঁপা কাঁপা আঙুল তুলে দেখাল সেলেনা কফিন-রাখা আঁধার কুলুঙ্গির দিকে।

তাকাল রানা চোখ সরু করে। ধোঁয়ার কারণে দৃষ্টি চলে না। খুদে একটা আলোর মিটিমিটি দেখতে পেল যেন।

কী ওটা? অক্সিজেনের অভাবে চোখের ভেলকি দেখাচ্ছে মস্তিষ্ক? নাকি—

মুখ খুলতে গিয়েও স্বর ফুটল না কণ্ঠে। থরহরিকম্প দশা গোটা সমাধিকক্ষের!

ভূমিকম্প! ক্রিং ক্রিং করে ওয়ার্নিং বেল বাজল রানার মনের মধ্যে।

কিন্তু এ তো এক কথায় অসম্ভব! শক্তিশালী ভূমিকম্প—তা-ও আবার নর্দার্ন ফ্রান্সে?

কানের বারোটা বাজিয়ে ভিতর দেয়ালের গোটা একটা অংশ হুড়মুড় করে ধসে পড়ল আচমকা। ভেঙে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল পাথরগুলো। দেয়ালের গায়ে তৈরি খাঁজঅলা ফোকরটা দিয়ে ড্রাগনের মুখ থেকে বেরোনো আগুনের হলকা ঢুকছে ঘরে, যেন শিকারের আশায়।

পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে কোনও রকমে উঠে দাঁড়িয়েছে ওরা। কাশতে কাশতে সামনের দিকে ঝুঁকে এসেছে দেহের উপরের অংশ।

কিংকর্তব্য স্থির করতে পারছে না রানা। টান দিল ওর কবজি ধরে। নিয়ে চলেছে কুলুঙ্গির দিকে। বধির করে দেয়া নির্ঘোষ ছাপিয়ে শুনতে পেল ও: ‘মাথা বাঁচাতে হবে, রানা!’

আজন্মের খিদে নিয়ে দেয়ালে তৈরি গহ্বরের মাঝ দিয়ে রাক্ষুসে হাঁ-টা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে অগ্নিদানব। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ানক লাগছে চারপাশ থেকে ছেঁকে ধরা প্রলয়ঙ্করী ভাইব্রেশন। কম্পনের তাড়নায় মেঝেটা সরে সরে যাচ্ছে পায়ের নিচ থেকে। কিছুতেই অসহায় মানুষ দুটোকে খাড়া থাকতে দেবে না বলে পণ করেছে যেন!

লক্ষ্যস্থলে পৌছে রানার হাতটা ছেড়ে দিল সেলেনা। দুই হাত দিয়ে লুই দে ইলিয়েলের কফিনের প্রান্ত আঁকড়ে ধরে টেনে চলল সর্বশক্তিতে। কুলুঙ্গি থেকে বের করতে চাইছে ওটাকে।

মেয়েটার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে অমসৃণ কফিনটা দু’হাতে ধরল রানাও। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টানতে লাগল, এক পা সামনের দেয়ালে ঠেকিয়ে। মেরুদণ্ড ভাঙার অবস্থা হলো কাজটা করতে গিয়ে।

দু’জনের সম্মিলিত চেষ্টায় অনড় থাকা সম্ভব হলো না প্রাচীন শবাধারের। পাথরে পাথর ঘষার আওয়াজ তুলে বেরিয়ে আসতে লাগল বাইরের দিকে। প্রথমে কয়েক ইঞ্চি, তার পর আরও একটু… যতক্ষণ না ওজনের ভারসাম্য হারিয়ে কাত হয়ে ভূমিসাৎ হলো ওটা কুলুঙ্গি থেকে। ঝাঁকুনি লেগে ছিটকে বেরোল নরকঙ্কালটা, হাড়হাড্ডি খুলে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে।

কফিন ডিঙিয়ে কষ্টেসৃষ্টে উঠে এল সেলেনা খালি হয়ে যাওয়া কুলুঙ্গিটায়। উঠেই হাত বাড়িয়ে দিল রানাকে সাহায্য করার জন্য।

বজ্রের আওয়াজ তুলে শক্তিশালী একটা শব্দতরঙ্গের ঢেউ এসে কাঁপিয়ে দিল প্রাচীন প্রকোষ্ঠ। যেখানটায় দাঁড়িয়ে রয়েছে রানা, পাথরের ধস নামল তার কয়েক গজ দূরেই। ধুলোয় অন্ধকার হয়ে গেল জায়গাটা।

ঢেউয়ের মত আবারও ছোবল দিল আগুন। পিঠের উপর আগুনে-ড্রাগনের নিঃশ্বাসের তপ্ত ছোঁয়া লাগতেই হাচড়ে- পাচড়ে কুলুঙ্গিতে উঠে পড়ল রানা।

ঘাড় গুঁজল ওরা ফোকরটার একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে ভবিতব্যের হাতে নিজেদের ছেড়ে দেয়া ছাড়া কিচ্ছু করার নেই এখন আর!

সকল অধ্যায়

১. শকওয়েভ – ১
২. শকওয়েভ – ২
৩. শকওয়েভ – ৩
৪. শকওয়েভ – ৪
৫. শকওয়েভ – ৫
৬. শকওয়েভ – ৬
৭. শকওয়েভ – ৭
৮. শকওয়েভ – ৮
৯. শকওয়েভ – ৯
১০. শকওয়েভ – ১০
১১. শকওয়েভ – ১১
১২. শকওয়েভ – ১২
১৩. শকওয়েভ – ১৩
১৪. শকওয়েভ – ১৪
১৫. শকওয়েভ – ১৫
১৬. শকওয়েভ – ১৬
১৭. শকওয়েভ – ১৭
১৮. শকওয়েভ – ১৮
১৯. শকওয়েভ – ১৯
২০. শকওয়েভ – ২০
২১. শকওয়েভ – ২১
২২. শকওয়েভ – ২২
২৩. শকওয়েভ – ২৩
২৪. শকওয়েভ – ২৪
২৫. শকওয়েভ – ২৫
২৬. শকওয়েভ – ২৬
২৭. শকওয়েভ – ২৭
২৮. শকওয়েভ – ২৮
২৯. শকওয়েভ – ২৯
৩০. শকওয়েভ – ৩০
৩১. শকওয়েভ – ৩১
৩২. শকওয়েভ – ৩২
৩৩. শকওয়েভ – ৩৩
৩৪. শকওয়েভ – ৩৪
৩৫. শকওয়েভ – ৩৫
৩৬. শকওয়েভ – ৩৬
৩৭. শকওয়েভ – ৩৭
৩৮. শকওয়েভ – ৩৮
৩৯. শকওয়েভ – ৩৯
৪০. শকওয়েভ – ৪০
৪১. শকওয়েভ – ৪১
৪২. শকওয়েভ – ৪২
৪৩. শকওয়েভ – ৪৩
৪৪. শকওয়েভ – ৪৪
৪৫. শকওয়েভ – ৪৫
৪৬. শকওয়েভ – ৪৬
৪৭. শকওয়েভ – ৪৭
৪৮. শকওয়েভ – ৪৮
৪৯. শকওয়েভ – ৪৯
৫০. শকওয়েভ – ৫০
৫১. শকওয়েভ – ৫১
৫২. শকওয়েভ – ৫২
৫৩. শকওয়েভ – ৫৩
৫৪. শকওয়েভ – ৫৪
৫৫. শকওয়েভ – ৫৫
৫৬. শকওয়েভ – ৫৬
৫৭. শকওয়েভ – ৫৭
৫৮. শকওয়েভ – ৫৮
৫৯. শকওয়েভ – ৫৯
৬০. শকওয়েভ – ৬০
৬১. শকওয়েভ – ৬১
৬২. শকওয়েভ – ৬২
৬৩. শকওয়েভ – ৬৩
৬৪. শকওয়েভ – ৬৪
৬৫. শকওয়েভ – ৬৫
৬৬. শকওয়েভ – ৬৬
৬৭. শকওয়েভ – ৬৭
৬৮. শকওয়েভ – ৬৮
৬৯. শকওয়েভ – ৬৯
৭০. শকওয়েভ – ৭০
৭১. শকওয়েভ – ৭১
৭২. শকওয়েভ – ৭২
৭৩. শকওয়েভ – ৭৩
৭৪. শকওয়েভ – ৭৪
৭৫. শকওয়েভ – ৭৫
৭৬. শকওয়েভ – ৭৬
৭৭. শকওয়েভ – ৭৭
৭৮. শকওয়েভ – ৭৮
৭৯. শকওয়েভ – ৭৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন