সাংস্কৃতিক খিস্তি

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

ঝগড়া এবং গালাগালির প্রকারভেদ নিয়ে এ যাবৎ কোনও গবেষণা হয়েছে কিনা, আমার জানা নেই। তবে স্থান, কাল এবং পাত্র ভেদে ঝগড়া নানারকমের হয় এবং একই কারণে গালাগালিরও প্রকারভেদ আছে। যাঁরা স্থান, কাল এবং পাত্র নির্বিশেষে ঝগড়া করতে পারেন, সেই সব অতি শক্তিমান মানুষেরা এই প্রবন্ধের আওতায় পড়বেন না, কেননা কবি যেমন প্রায় নির্বিষয়ক জিনিসের ওপরেও কবিতা লিখে ফেলতে পারেন, এঁরাও তেমনি তুচ্ছ কিংবা বিনা কারণেই অতি আকস্মিকভাবে ঝগড়ার সৃষ্টি করতে পারেন। তাঁদের এই অহৈতুকী শক্তি এবং তাঁদের গলার আরোহণ অবরোহণ সংযোগে যে বিচিত্র গালাগালি পরিবেশিত হয় তার একটি বর্ণনা আপাতত নিষ্প্রয়োজন, কেননা আমার সভ্য সমাজের কথা বলছি। কিন্তু এই সভ্য সমাজের অন্তঃকলহ, যদি নিকৃষ্ট ঝগড়ার রূপ নেয় কিংবা তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে যদি এমন কোনও শব্দ-চিত্র পাওয়া যায়, যার অর্থ শালীনতা অতিক্রম করে, তাহলে পাঠক যেন আমাকে ক্ষমা করবেন। অবশ্য সেই সঙ্গে এও মনে রাখবেন যে আপনিও সেই সভ্য সমাজের একজন।

পাঠক! দশরথের কথা স্মরণ করুন। তিনি নিজেই একসময় প্রেমে গলে গিয়ে বর দিতে চেয়েছিলেন কৈকেয়ীকে। তারপর যেই কৈকেয়ী বর চাইলেন, অমনি যদি কৈকেয়ীর বংশ তুলে দশরথ বলেন— এমন কথা বলতে তোর দাঁত খসে খসে পড়ছে না— না নাম তে কেন মুখাৎ পতন্ত্যধো, বিশীর্য্যমাণা দশনাঃ সহস্রধা— তাহলে কি বলব দশরথ ঝগড়াটে নন? তার ওপরে দেখুন, ‘ভদ্দরলোকের’ ঘরে স্ত্রীলোককে গালাগালি দেওয়ার ভাষাও যে খুব পরিশীলিত ছিল, তাও নয়। ‘মাগী মিনশে’র উতোর চাপান ছেড়েই দিলাম, পুরুষ মানুষ কিঞ্চিৎ কুপিত হলেই ‘দাসীত্র-পুত্তীত্র’ মানে দাসীপুত্রী কিংবা গর্ভদাসী— এ ছিল বাঁধা গৎ।

অনেকেই জানেন, কিংবা জানেন না যে, সেকালে স্ত্রী ঋতুমতী হলে, সেই তিন-চার দিনের জন্যও পুরুষ মানুষের একটি দাসীর প্রয়োজন হত এবং প্রয়োজন যখন হত তখন পুত্রও জন্মাত— স্বয়ং মহাত্মা বিদুরই এই জাতের ছেলে, ধৃতারাষ্ট্রেরও বৈশ্য-রমণীর গর্ভে একটি পুত্র ছিল, যুযুৎসু। সে যাই হোক, দাসীদের দেখা হত প্রায় গণিকার প্রতিনিধি হিসেবে, কাজেই দাসীপুত্রী কিংবা গর্ভদাসী— ভদ্রলোকের গালাগালি নয়, তবু ভদ্রলোকেরাই এই শব্দগুলি ব্যবহার করতেন। কিংবা ধরুন, কোনও পুরুষ মানুষ যদি কোনও স্ত্রীলোককে বলেন ‘ভ্রমরটেন্টে’ অথবা ‘টেন্টাকরালে’ তাহলে প্রথমত শব্দমাধুর্যেই সেই স্ত্রীলোকের পিত্তি চটে যাবে, তার পরে সে যদি বোঝে ‘ভ্রমরটেন্টা’ মানে প্রায় গণিকা, আর ‘টেন্টাকরালে’ মানে জুয়োচোর, তাহলে কোন স্ত্রীলোক ঝগড়া না করে থাকবে? অথচ রাজশেখরের কর্পূরমঞ্জরীতে ঠিক এই ভাষায়ই রাজার পরিচায়ক বিদূষক গালাগালি করেছে রাণীর পরিচারিকা বিচক্ষণাকে। প্রত্যুত্তরে বিচক্ষণা কটু কথা ব্যবহার করেননি। যদি বলেন বিদূষক ‘হাই সোসাইটি’র কোনও প্রতিনিধি নয় এবং তার কথাই অমনিধারা; তাহলে কৌরবকুলের শ্রেষ্ঠ পুরুষ দুষ্মন্তের ভাষণটি দিতে হয়।

মনে রাখবেন, ইনি কালিদাসের দুষ্মন্ত নন, ইনি মহাভারতকার ব্যাসের দুষ্মন্ত। এখানে দুর্বাসার শাপ টাপের বালাই নেই। বরঞ্চ শকুন্তলা দুষ্মন্তের শ্রম লাঘব করে ছেলেকে বেশ খানিকটা বড় করে নিয়ে এসেছেন কণ্বমুনির আশ্রম থেকেই। দুষ্মন্ত দেখেই চিনতে পেরেছেন তাঁর স্ত্রীকে, কিন্তু সভাসদ পরিজনবর্গের সামনে পূর্বকামুকতা প্রকাশের ভয়ে শকুন্তলাকে ডেঁটে বললেন— কে হে তুমি দুষ্ট তাপসী? শকুন্তলা সরল মনে আত্ম-পরিচয় দিলেন। মা মেনকা, বাবা বিশ্বামিত্রের পরিচয়ও দিলেন। রাজা বললেন— দেখ, ওসব ছেলে-টেলের খবর আমি জানি না, মেয়েরা ভীষণ মিথ্যে কথা বলে— অসত্যবচনা নার্য্যঃ। আর তোমার মা’র কথা বোলো না, সে তো একটা কুলটা-বেশ্যা—বন্ধকী জননী তব। তোমাকে পূজার নির্মাল্যের মতো ছুঁড়ে ফেলেছিল হিমালয়ের কোলে। বাপও তোমার কামলুব্ধ। পুংশ্চলীর মতো কথা বোলো না, কোথা থেকে একটা ‘শালস্তম্ভে’র মতো বিরাট ছেলে ধরে নিয়ে বলে কিনা, আমার ছেলে। সাধুবেশে আমাকে ভাঁড়ানোর চেষ্টা কোরো না, তুমি এখন এসো।

অনেক পুরুষ মানুষেরই জীবনের অভিজ্ঞতা এইরকম যে তাঁর স্ত্রীর মধ্যে পরমা লক্ষ্মীর অংশ যতখানি, তার থেকে নিত্য ‘বাচালরূপিণী’ সরস্বতীর অংশটাই বেশি। সকলেই যেমন জানেন যে, বিদ্যা কিংবা বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন বাগদেবী, তেমনি অনেকেই বোধ করি জানেন না যে, ঝগড়াঝাঁটিরও একজন অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেন এবং তিনিও বাগদেবী। সরস্বতীর বরপুত্রদের কথাটা হয়তো তত পছন্দ হচ্ছে না, কিন্তু দেবী ভাগবত পুরাণটি খুলে দেখবেন আমার কথা সত্যি। একসময় নাকি লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং গঙ্গা— এঁরা তিনজন ভগবান শ্রীহরির স্ত্রী-রূপে বিরাজ করছিলেন। তিনজনই বড় ঘরের মেয়ে, কাজেই সমান প্রেমের অংশীদার। কিন্তু তাঁদের ঝগড়াঝাঁটি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যাতে শাপ-শাপান্ত বাকি ছিল না কিছুই।

সাধারণ গৃহস্থ বাড়ির কর্তার মতো নারায়ণ অনেকদিন বাইরে থাকতে লাগলেন। অবশেষে একদিন ভেতরে এসে দেখলেন পারস্পরিক শাপ-শাপান্তের পালা শেষ। তিনি প্রথমেই অভিমানিনী সরস্বতীকে টেনে নিলেন বুকে— বাসয়ামাস বক্ষসি। তারপরে অনেক দুঃখে নারায়ণ বললেন— যে বাড়িতে তিনটি বউ এবং সে বউয়ের চরিত্র যদি তিন রকমের হয়, তাহলেই বিপদ। ব্যাধির জ্বালা বরং সহ্য হয়, বিষ খাওয়ার জ্বালা— সেও ভালো; কিন্তু— দুষ্টস্ত্রীণাং মুখজ্বালা মরণাদতিরিচ্যতে— ঝগড়াটে স্ত্রীলোকের মুখ ঝামটা সহ্য করার থেকে মরণ ভালো। কিন্তু যে সরস্বতীকে নারায়ণ বুকে টেনে নিলেন, তাঁর সম্বন্ধে গঙ্গা লক্ষ্মীকে বলেছিলেন— ”ছেড়ে দাও বড়দি, এই ঝগড়াটে মেয়েছেলেটাকে— দুঃশীলা মুখরা নষ্টা নিত্যং বাচালরূপিণী। ও আমার করবেটা কী? ইনি বাক্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তাই তো কলহপ্রিয়া— বাগধিষ্ঠাত্রী দেবীয়ং সততং কলহপ্রিয়া। দুর্মুখীর কত শক্তি আছে, আর আমার সঙ্গে কত ঝগড়া করতে পারে, আমি আজ তাই দেখব।”

এখন সরস্বতী যেহেতু স্ত্রীলোক তাই পৃথিবীর তাবৎ স্ত্রীলোকের কিছু স্বাভাবিক বাক-সিদ্ধ থাকলেও থাকতে পারে, তবে এক্ষেত্রে সাধারণীকরণ একেবারেই ঠিক হবে না। বিশেষত সংস্কৃত সাহিত্যে এমনও প্রাচীন শ্লোক পাওয়া যায় যেখানে শুধুমাত্র রান্না না হওয়ার অপরাধে স্বামী দেবতা আপন স্ত্রীকে ‘মহাপাপিনী’ বলে সম্বোধন করছেন। স্ত্রীও কম নন, তিনি বললেন— ”পাপী আমি নই, পাপী তোমার বাবা!” আর যায় কোথা, স্বামী বললেন— বদ মেয়েছেলে কোথাকার, খুব যে কথা বেরুচ্ছে মুখ দিয়ে? গিন্নি ততোধিক ঝেঁজে বললেন— বদ মেয়েছেলে আমি? বদ হল তোমার মা-বোনেরা— তবৈব জননী রণ্ডা রণ্ডা ত্বদীয়া স্বসা! কর্তা বললেন— ”বেরোও আমার বাড়ি থেকে।” গিন্নি বললেন— মজা নাকি, বাড়িটি কি তোমার, যে বললে আর বেরিয়ে যাব। কর্তা এবার আর্তস্বরে ভগবানের কাছে মরণ ভিক্ষা চাইলেন, এবং ভাবলেন বুঝিবা তাঁর বাড়িতে উপপতির ভাগ্য খুলে গেছে— হা হা নাথ মমাদ্য দেহি মরণং জারস্য ভাগ্যোদয়ঃ।

গালাগালির ক্ষেত্রে লঘু-গুরু বিচার থাকে না, দেশ-কাল নিয়েও গালাগালি প্রচুর, আর জাতি-বর্ণ নিয়ে গালাগালির শেষ নেই। যার মধ্যে প্রথমবয়সি ছাত্রদের চিরশত্রু গুরুদের কথা আগে আসে।

আমাদের বিদ্যাও গুরুমুখী, ধর্মও গুরুমুখী, কাজেই সমাজে গুরুর প্রতিপত্তির সঙ্গে সঙ্গে গুরুনিন্দাও তৈরি হচ্ছিল। একজন বললেন— হাজারো গুরু আছে, যারা শুধু শিষ্যের টাকা ঝেড়েই খালাস; এমন গুরু দেখলাম না যে শিষ্যের সন্তাপ হরণ করতে পারে— গুরবো বহবঃ সন্তি শিষ্যাবিত্তাপহারকাঃ। তং তু গুরুং ন পশ্যামি শিষ্য-সন্তাপহারকম।। বেশিরভাগ গুরুর সম্বন্ধে এই আক্ষেপ ভালোই খেটে যায়, তবু যাঁরা অতিরিক্ত গুরুভক্ত তাঁরা যেন আমার পরের কথাগুলি মনে না রাখেন। কাশ্মীরের কবি ক্ষেমেন্দ্রসুন্দর গুরুর মুখ দেখেননি নিশ্চয়, গুরুদের মুখগুলি তাই তাঁর কাছে— কৃষ্ণাশ্ব-শকৃদবর্ত্যা— কালো ঘোড়ার পাছার মতো। ব্যাঙের নাড়িভুঁড়ি মাখা মানুষও কেমন করে অপ্সরাদের প্রেমাস্পদ হয়ে পড়বে— এই স্বপ্ন দেখান গুরুরা। অল্প পরিচয়েই দীক্ষা দেন আর মুগ্ধচিত্ত পুরুষের টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করেন। কোনও কোনও গুরু আবার হাত দেখে ভাগ্যও বলেন— তোমার হাতের ধনরেখাটি তো বেশ বড়ো, তবে তোমার স্বামীর মন যেন একটু চঞ্চল— এই ধরনের কথা বলে, বেটা ধূর্তগুরু, কূলবধূদের কুসুমকোমল হাতগুলি বসে বসে টেপে— মৃদনাতি কুলবধূনাং কমল-কোমলং পাণিম।

ক্ষেমেন্দ্র পর্যায়ক্রমে অনেকেরই শ্রাদ্ধ করে ছেড়েছেন এবং হাত দেখার কথায় মনে পড়ল, জ্যোতিষীদের সম্বন্ধেও ক্ষেমেন্দ্রর ধারণাটি চমৎকার। তিনি বলেন— হতভাগা জ্যোতিষীগুলো, বসে বসে কখন গগনের চাঁদ বিশাখা নক্ষত্রের সঙ্গে সমাগম করছে, তার খবর রাখে; কিন্তু বেটা জানে না, যে তার নিজের বউই কতকগুলি রসিক-কামুকের সঙ্গে উপগত হল— গণয়তি গগনে গণকশ্চন্দ্রেণ সমাগমং বিশাখায়াঃ। বিবিধ-ভুজঙ্গ-ক্রীড়াসক্তাং গৃহিণীং ন জানাতি।

রসিকতার কথা থাক। রসিকতা-মাখানো গালাগালির পর্যায়ে, ছেলে থেকে আরম্ভ করে শ্বশুরগৃহের ‘দুগ্ধলুব্ধ বেড়ালে’র মতো জামাই সবাই আছে। তার থেকে যেকথা বলা হয়নি, তাই বলি। আমার পূর্ব প্রতিজ্ঞামতো একটা কথাই বলা হয়নি, তা হল দেশ ধরে গালাগালির কথা।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কর্ণের সারথি হিসেবে শল্য একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ থেকে কর্ণকে বিরত করতে চাইছিলেন শল্য। অনেক উতোর-চাপানের পরেও শল্য যখন থামলেন না, কর্ণ তখন শল্যের মাতৃভূমি মদ্রদেশের দফা রফা করে ছাড়লেন। কর্ণ বললেন— মদ্রদেশের লোক তুমি, তোমার আর কত বোধ থাকবে? বহু দেশ ঘুরে এসে এক বামুন ঠাকুর আমাকে জানিয়েছেন— কুরু, পাঞ্চাল, মৎস্য, কোশল এসব দেশের লোকেরা সব ভালো মানুষ। আর বাহীক, মদ্রক, কিংবা পঞ্চনদীর দেশটি হল একেবারে বাজে লোকের আড্ডা।

আপাতত বেশি বিস্তারে যাব না, শুধু এইটুকু বলব, ভিন প্রদেশের লোকেরা আমাদের কেউ ভালো চোখে দেখেননি। বাঙালিরা বেদের ক্রিয়াকলাপ জানে না, কি বেদ উচ্চারণ জানে না— এসব কঠিন কথা তো অনেক শুনেছি এবং তা গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু দেখুন, ভাষা বা মানুষের জীবনের এবং জন্মের অধিকার, সেটি নিয়ে রঙ্গ করলে বড়ো দুঃখ লাগে। অথচ রাজশেখর আমাদের অর্ধমাগধী প্রাকৃত শুনে ব্রহ্মার মুখসম্ভবা সরস্বতীকে পাঠিয়েছেন জগৎপিতা ব্রহ্মার কাছে এবং তাঁর আর্জি হল— পিতা, আমার দ্বারা গৌড়দেশের ভাষা চালানো সম্ভব নয়, তার চেয়ে গৌড়ের লোকের জন্য পৃথক একটি সরস্বতীর অর্ডার দিন অথবা গৌড়ীয়রা নিজেদের ভাষা ত্যাগ করুক— গৌড়স্তজতু বা গাথাম অন্যা বা অস্তু সরস্বতী। মনে রাখা দরকার, দেশ-বিদেশের সংস্কৃতি এবং ভূগোল সম্বন্ধে রাজশেখরের জ্ঞান ছিল টনটনে; কাজেই গৌড়দেশের উচ্চারণ বলতে যে একেবারে বাঙাল দেশের উচ্চারণ বোঝাব, তার উপায় নেই, যদিও বাংলাদেশের খানিকটা অবশ্য তখন গৌড়দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

রাজশেখরের কথার সূত্র ধরে বলতে পারি, বাংলাদেশের লোকেরা চিরকালই তাদের ভাষার জন্য কথা শুনেছে; সিনেমা-বায়োস্কোপে বাঙাল-ভাষাভাষী একটি চাকরের ভূমিকা নতুন হাস্যরসের যোগান দিত। বাস্তবিক পক্ষে বাঙালদের সম্বন্ধে যদিও বা প্রাচীন শ্লোক আমার নজরে আসেনি, বা থাকলেও তা আমার জানা নেই। ধরেই নেওয়া যায়, বাঙালদের সম্বন্ধে যে শ্লোকগুলি বানানো হয়েছে তা ঘটিদেরই বানানো।

যেমন ধরুন— কখনও আশীর্বাদ নিও না পূর্ববঙ্গীয় মানুষের কাছ থেকে, কেননা তাঁরা যদি বলেন, ‘শতায়ু হও’, তাহলে শোনাবে যেন ‘হতায়ু হও’— আশীর্বাদং ন গৃহ্নীয়াৎ পূর্ব-বঙ্গ-নিবাসিনাম। শতায়ুরিতি বক্তব্যে হতায়ুরিতি বাদিনাম।। এ তো গেল সাধারণ রসিকতা। আমার এক শিক্ষকের কল্যাণে নবদ্বীপ-নিবাসী এক মহাপণ্ডিতের হাতে লেখা পুঁথি দেখতে পাই, যে পুঁথিখানি অন্তত ১৬/১৭শ শতাব্দীর। ন্যায়শাস্ত্রের বিষয় নিয়ে লেখা, সেই পুঁথির একটি পত্রে একই হাতের লেখা একটি শ্লোক ছিল। শ্লোকটির মানে হল— বাঙালরা নাকি জায়গাবিশেষে সিংহের মতো পরাক্রমশালী কিন্তু যুদ্ধ করতে গেলে একেবারে হরিণের মতো— স্থানে সিংহসমাঃ রণে মৃগসমাঃ। পালানোর ব্যাপারে বাঙালরা একেবারে শেয়াল। চেহারাটা একেবারে বাঁদরের মতো। তার ওপরে মুখের গড়ন— একেবারেই বিড়ালবদন— রূপে মর্কটবৎ বিড়ালবদনাঃ; স্বভাবে ক্রুর, খল এবং নির্দয়; বাঙালরা খাবার জোগাড় করবে বকের মতো ধ্যান দিয়ে, তবে খেতে পেলে যাই খেতে দাও, কাকের মতো খাবে, আর খাওয়ার ভঙ্গিটা ঠিক যেন শুয়োরের মতো। স্ত্রী-পুরুষের মৈথুন কর্মে বাঙালরা ঠিক যেন ছাগল— আহারে বক-কাক-শূকর-সমাঃ ছাগোপমা মৈথুনে। কবির শেষ আক্ষেপ হল— হায় এইরকম বাঙালরাও যদি মানুষ হয় তবে প্রেতাত্মা ভূতগুলো সব কেমন হবে— বাঙ্গালা যদি মানুষা হরে হরে প্রেতাস্তদা কীদৃশাঃ।  

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন