চাওয়াটাকে কমাতে হবে বাছা

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

চাওয়াটাকে কমাতে হবে বাছা

দিব্যদৃষ্টিধর কবির চোখ তো মিথ্যে নয়। তিনি ঠিক ধরেছিলেন যে, ঈর্ষাসূয়া-জর্জর মানুষ সব সময়ই ভাবে— এ পারে কোনও সুখ নেই, যত সুখ নদীর ওই পারেই আছে। জনান্তিক এইসব দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে শুধু দুঃখই আছে কিনা, অথবা সেই দুঃখগুলি দুঃখবিলাস কিনা, নাকি সেগুলি স্বপ্ন, অথবা স্বপ্ন পূরণের বাধা থেকেই এ-সমস্ত দীর্ঘশ্বাস— তা দিয়ে প্রচুর যুক্তি-তর্ক কথা-কাটাকাটি চলতে পারে। কিন্তু আমি জানি— দীর্ঘশ্বাস বস্তুটা খুব একমাত্রিক নয়, এক নিমিত্তক তো নয়ই। আর সুখ জিনিসটাও এমনই যে, তা বেশিরভাগ সময়েই— এইরকম না হয়ে ওইরকম হলে ভালো হত— এই ধরনের একটা কল্পিত নিসর্গের ওপরে নির্ভর করে।

আমার মনে আছে— দক্ষিণের ধামুয়া স্টেশনের কাছে রেললাইনের ধারেই নিরঞ্জন সরকারের বাড়ি ছিল। আম-জাম-জারুল-কাঁঠালের ছায়ার যখন এক একটা মন-কেমন-করা অপরাহ্ন নেমে আসত, তখন ওখান দিয়ে একটা মালগাড়ি যেত। ক্লান্তগমন সেই মালগাড়িটার যাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত ছন্দ ছিল— প্রায় একই রকম, প্রায় একই বস্তুবাহী এক-একটি বগি চোখের সামনে সর্পিল হয়ে উঠতে উঠতে যখন তার মাথাটা আর দেখা যেত না, তখনই অনেকক্ষণ ধরে চোখে পড়ত সেই গার্ডের কামরা। প্রায়শই দেখতাম— গার্ড সাহেব তাঁর কামরায় ছোট্ট চত্বরটুকুর মধ্যে এসে ওঠা-নামার সিঁড়ির ওপর দু-পাশে দুই হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর উদাস দৃষ্টি পার্শ্ববর্তী গ্রামের অনন্ত বৈচিত্র্যের ওপর ভেসে ভেসে যাচ্ছে। কী-ই বা তাঁর চোখে পড়ে এই গ্রাম্য ধূসর জীবনের মধ্যে। কখনও ন্যাংটো ছেলের পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া, কখনও হাঁস-মুরগির চলন-বলন, কদাচিৎ রোদ্দুরে শুকোতে দেওয়া বেগুনি রঙের শাড়ি অথবা মাথায় ফেসটু-ফেসটু কাশফুল নিয়ে আশিতে-পাওয়া বুড়ির দুনিয়ার ওপর অনন্ত উচ্চারণ।

গার্ড সাহেব নিশ্চয়ই ভাবেন, বেশ আছে এরা। নিস্তরঙ্গ নিশ্চিন্ত জীবন বীতানো। আর তাঁকে কিনা এই ঘোর ঘুরপথে মালগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে চলতে হচ্ছে— কোথা থেকে কোথায়! কিন্তু আমি যে নিরঞ্জন সরকারের মাঠে বসে মালগাড়ির গার্ডকে দেখতাম, আমার কাছে তিনিই ছিলেন আমার জীবন-দর্শনের প্রতীক। কত শহর গ্রাম গঞ্জ দেখতে দেখতে, কত অজানা পথ পেরিয়ে নিত্য-নতুন এই মন্থর পথ চলা— এটাই তো জীবন। নচিকেতার মতো কবিয়াল অনন্ত স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেও বুঝি এমন সুখ-স্বপ্ন দেখে।

মিশ কালো রাত আর পিচ কালো রাস্তাকে / চিরে দিয়ে ছুটে চলে ট্রাক/ ঘুম-চোখো ড্রাইভার / চলে চাকা পরিবার/ ফেলে আসা পথ হতবাক।/ সস্তার মদ খেয়ে/ ট্রাকের ছাতেতে শুয়ে/ তারা গোনে ভবঘুরে/ হেলপার পাগলা জগাই।/ রাত বলে যাই যাই/ ডাক দিয়ে যাই।

আমি জানি— আপনারা কী বলবেন। বলবেন— বেশ তো দোতলার ঘরে শুয়ে আছ। মাস গেলে মাইনে পাচ্ছ, পুরোনো ফ্রিজ-টিভি বদলাচ্ছ, আর আমাদের উদ্দেশ্যে বুলি ঝাড়ছ— চোখ-ভাসা গার্ড সাহেব, ভবঘুরে পাগলা জগাই। এমন দ্বিচারিতা কি না করলেই নয়? উত্তরে বলি— ঠিকই বলেছেন। হয়তো এটা দ্বিচারিতাই, কারণ সত্যিই তো, মাস গেলে মাইনে পাই, মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যেই পুত্র-পরিবার প্রতিপালন করি, তাহলে এই সব কথা তো ভাববিলাসই বটে। কষ্ট সহ্য না করেও বিভিন্ন কষ্ট সহ্য করা মানুষের জীবন নিয়ে ভাবালুতা তৈরি করা তো দ্বিচারিতাই বটে।

এটাও খুব সত্যি, আমি যখন এক গার্ড-সাহেবকে তাঁর কর্ম-জীবনের স্বপ্নিল যাত্রা প্রসঙ্গে কিছু স্বপ্নিল কথা বলেছিলাম, তিনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন— মালগাড়িকে কেউ মানুষ বলে মনে করে না। আট ঘণ্টা ডিউটি দেব, সেটা ঠিক আছে, কিন্তু রাস্তায় নামলে সব ট্রেন আগে ‘পাস’ করবে, তারপর মালগাড়ি। মালগাড়ি লেট হতেই থাকে। এমন অবস্থায় একটা জায়গায় গিয়ে আমরা রিপোর্ট দিয়ে দিই— আর যাব না। আমার ডিউটি শেষ, অন্য লোক ডিউটি করুক। এ-সব কথা শুনে বাস্তবের রুটি-রুজি, আর আমার মতো কর্মস্তরে নিযুক্ত মানুষের রূঢ় আরোপিত কল্পনা নিয়ে সযৌক্তিক তর্কালাপ চলতেই পারে, আমি জানি। এমনকী নচিকেতার স্বসুরারোপিত হেল্পার পাগলা জগাইকেও বাস্তববাদী সমাজ-সচেতন ডাক্তারদের পোস্ট মর্টেম সহ্য করতে হবে, তা জানি। তবু আমার মতো মানুষের কাছে স্বপ্নপারের রেলগাড়িটাও মিথ্যে নয়, মিথ্যে নয় ‘ট্রাকের ছাতেতে শুয়ে’ তারা গোনা পাগলা জগাই।

আসলে মানুষের ভাবনালোক তৈরি হবার মধ্যে বিভিন্ন বৈচিত্র্য যেমন থাকে, তেমনই তরতমও থাকে কতরকম। ‘ভাবনালোক’ কথাটা দার্শনিক তথ্য আলঙ্কারিক দৃষ্টি থেকে বেশ ভারি এবং একটা কঠিন শব্দ বটে। অল্প পরিসরে সেটা বোঝানোও সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলাই যায় যে, ছোটোবেলা থেকে বাবা-মা তাঁর ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বড় হবার যে বাসনা তৈরি করেন, প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব, ইস্কুল, আত্মীয়স্বজন এবং নিজের মধ্যেও যে উচ্চাশা পূরণের ইচ্ছা থাকে— সে সব কিছু মিলেই একটি মানুষের ভাবনালোক তৈরি হয়। এবং এই ভাবনালোকের ক্রিয়াকাণ্ড, পরিশ্রম-ব্যায়াম-চেষ্টা যদি প্রত্যাশিতভাবে তথা সফলভাবে চলতে থাকে, তবেই একটা মানুষ গুণধর, বিদ্যাধর, অর্থকর বড় মানুষে পরিণত হতে পারে।

সবিনয়ে জানাই— এই ভাবনালোকের ক্রমান্বয়ী বিস্তার এবং একটি সফল মানুষ হয়ে ওঠার প্রতি আমার সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং শুভেচ্ছা আছে। কিন্তু ব্যক্তিগত স্তরে বলতেই হবে, আমার নিজের কোনও ভাবনালোক ছিল না, অথবা ভুল বলা হল— ভাবনালোক প্রত্যেকেরই থাকে, কিন্তু যে প্রত্যয়ে যে সাধনায় সার্থক বড় মানুষ হওয়া যায়, তার কিছুই আমার মধ্যে ছিল না এবং আমার বাপ কিম্বা আত্মীয়-পরিজনও আমার মধ্যে সেই বাসনালোক তৈরি করার কোনও প্রচেষ্টা নেননি বলেই আমার স্বপ্নপারের মালগাড়ির গার্ড-সাহেব আমার কাছে এখনও এক সুদীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস অথবা সুখের মতো ব্যথা।

আমার মনে আছে, আসলে বারংবার ঘটনার আবৃত্তি ঘটায় নিজেরই ভালো করে মনে আছে যে, খুব ছোটবেলাতেও আমি লোকের কাছে— বিশেষত দুর্বল প্রকৃতির অতিথি এলে, তাঁদের কাছে এটা-ওটা অনেক জিনিস চাইতাম। সেকালে অতিথিদেরও যে আর্থিক অবস্থা এবং মানসিক গঠন ছিল, তাতে খাদ্যবস্তু বা বালকোচিত পছন্দের জিনিস চাইলেই যে তাঁরা বিগলিত হয়ে দিয়ে দিতেন, তা মোটেই নয়। বরঞ্চ এখন বুঝতে পারি— তাঁরা যথেষ্টই আমাকে ন্যাজে খেলাতেন। আমার চোখ-মুখ আমার দুরাগ্রহ-চালিত অন্তরাল চেষ্টা চার-পাঁচ দিন বাড়িতে থাকা অতিথিকে অস্বস্তিতে ফেলত। কিন্তু আমার মনে হত— তিনি কলকাতায় বেড়াতে এসে এর-তার জন্য, নিজের জন্য নানান জিনিস কিনছেন, আমাকেই বা অল্প স্বল্প দেবেন না কেন? যাইহোক, বারংবার চক্ষু-চাওয়া-চায়ি, অতিথির পশ্চাৎ-কচ্ছদেশ না ছাড়া— এ-সব শেষ পর্যন্ত আমার বুদ্ধিমতী জননীর চোখে পড়ে যেত। আমি উত্তম-মধ্যম খেতাম অতিথির সামনেই। অতিথির চেষ্টাতেই শেষপর্যন্ত আমার মুক্তি ঘটত এবং তিনি পরেরবার কোনও জিনিস দেবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে কোথায় চলে যেতেন। এবং পরেরবার এলেও যথারীতি পূর্ব-প্রতিজ্ঞা ভুলে যেতেন।

এই বিচিত্র বাস্তবের মধ্যে আমার পিতাঠাকুরের ভূমিকাটা ছিল অদ্ভুত। তিনি ইংরেজি এবং সংস্কৃতে ভালো পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু প্রথম জীবনের ইংরেজির ক্যারিশমা বয়স ঢলতেই সংস্কৃতের প্রতিস্থাপনায় নীতি-ধর্মের আকার গ্রহণ করেছিল। তিনি আমার ক্ষুব্ধা জননীকে আশ্বস্ত করে বললেন— অর্থ, বস্ত্র, খাদ্য যা বলো এগুলো যখন একটা মানুষ চায়, সেই চাওয়ার মধ্যেই এত কষ্ট, এত লজ্জা আছে যে, সেই লজ্জা-কষ্টের যন্ত্রণা যদি দাতা বুঝতেন, তাহলে ধমনী কেটে নিজের রক্তও দিয়ে দিতেন— দাদা চেত তদ বিজানীয়াদ দদ্যাৎ স্থপিশিতান্যপি। আবার জননী বললেন— তোমার ছেলেকে দেখে কী মনে হচ্ছে? দাও-দাও বলে পরের কাছে চাইতে তার খুব দুঃখ লজ্জা যন্ত্রণা হচ্ছে বলে মনে হয় তোমার? আমার পিতাঠাকুর বললেন— এত তাড়াতাড়ি তুমি হতাশ হয়ো না। ও এখনও বালক।

‘বালক’। আমার মা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন— এত যে বারণ করি, তবু সেদিন অমুকের সঙ্গে গিয়ে দোকানে রসগোল্লা খেয়ে এল। আমার ভাইয়ের বাড়িতে তার ছেলে মেয়ের পুজোতে ভালো জামা-কাপড় হয়েছে বলে আমার ভাইয়ের কাছেই তোমার ছেলে বলল— আমার জামা প্যান্ট হবে না? আমার যা লজ্জা হয়েছে তাতে আর কোনওদিন এই ছেলেকে নিয়ে আমি ভাইয়ের বাড়ি যাব না। আমার পিতাঠাকুর এতটুকুও রাগ না করে বেশ জ্ঞানী-জ্ঞানী ভঙ্গিতে বললেন— দ্যাখো, যাচকের একটা লক্ষণ আছে। শাস্ত্র বলে…। মা রেগে বললেন— রাখো তোমার শাস্ত্র। আমি মরছি নিজের জ্বালায়, অপমানে। আর উনি শাস্ত্র আওড়াচ্ছেন। পিতাঠাকুর বললেন— এই যে তোমার অপমান হচ্ছে, তা তোমার ছেলের চাওয়ার জন্য যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি তোমার ভাইয়ের জন্যও। সে তোমার ছেলের সামনে নিজের ছেলে-মেয়েকে পুজোয় জামা-কাপড় দিচ্ছে অথচ তাদেরই সমবয়সি ভাগনেকে দিচ্ছে না— এটাও কি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে না?

মা বললেন— দিচ্ছে। কিন্তু তাদেরও তো আর্থিক অবস্থা এমন আহামরি নয়। নিজের ছেলেমেয়েদের কোনও রকমে দিয়েছে, আর হয়তো পারেনি। পিতা বললেন— এক্কেবারে ঠিক। সেটা তো হতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে যার কিছুই নেই, আমরাও যে ছোট্ট ছেলেটিকে কিছুই দিতে পারিনি, তার ইচ্ছা হবে না, লোভ হবে না, ভাইবোনদের সজ্জা দেখে মন কেমন করবে না? এটাও তো স্বাভাবিক। মা বললেন— তার মানে ওর স্বভাবের মধ্যেই চাওয়া আছে। পিতাঠাকুর উত্তর দিলেন— স্বভাবের মধ্যে চাওয়া থাকলে তার চেহারাটা অন্যরকম হয়। বিদ্যাবান মানুষকে, রুচিশীল ভদ্রলোককে যদি বিপাকে পড়ে চাইতে হয় কারও কাছে, তবে পায়রার গলাটা যেমন ওঠা-নামা করে, তেমনই তাঁদের গলাতেও শব্দ স্তব্ধ হয়ে ওঠানামা করে। যা চাইতে যাচ্ছেন, তার জন্য গলায় কণ্ঠটা হয়ে যায় পায়রার মতো গতিশীল— কণ্ঠে পারাবতস্যেব বাক করোতি গতাগতম। তোমার ছেলের কি এইরকম হয়েছিল বলে মনে করো? যদি হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে ওর বুদ্ধি আছে, বিদ্যা আছে, রুচি আছে, নইলে বুঝতে হবে, ও বালক।

আমার মাতা ঠাকুরাণী সরলা, বড় ঘরের মেয়ে, অথচ স্বামীর কল্যাণে দরিদ্র— এতসব তিনি বুঝলেন না। কিন্তু তিনি চুপ করে গেলেন। আমার মনে আছে— সেদিন আমার পিতাঠাকুর আমাকে বলি রাজার পৌরাণিক গল্প বলেছিলেন। দৈত্যরাজ বলি কেমন দোর্দণ্ড প্রতাপে স্বর্গরাজ্য অধিকার করেছিলেন। দেবতাদের অনুরোধে বলি রাজাকে জব্দ করার জন্য ভগবান বিষ্ণু কিভাবে বামন-রূপে জন্মালেন— এই সব গল্প। গল্পের সঙ্গে অবশ্য এই মন্তব্যও ছিল যে, কেমন মানুষের কাছে চাইতে হয়? দেবার মধ্যেও কত সুখ বলিরাজের। উজাড় করে দেবার সুখ। এই সুখ যার নেই তার কাছে চাইতে নেই। আবার যাচকের যন্ত্রণাও কত, সেও তো কহতব্য নয়। অমন যে ত্রিভুবনেশ্বর ভগবান বিষ্ণু তিনিও যখন দান চাইতে এলেন, তখন তাঁকে লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে বেঁটে বামন হয়ে আসতে হল— বলিমনুযাচন-সময়ে শ্রীপতিরপি বামনো জাতঃ।

সেইকালে, সেই বয়সে এই কথাগুলির মধ্যে যে তাৎপর্য নিহিত ছিল, তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না, কিন্তু এটা এখন বুঝি। এখন বুঝি, তিনি কি স্নিগ্ধতায় বালকের এই মনোবৃত্তি বুঝেছিলেন এবং বুঝেছিলেন দাতার মর্ম। আমাদের শাস্ত্রকারেরা দানের মহিমা কীর্তন করেছেন খুব এবং পরের কাছে চাওয়াটা একেবারেই পছন্দ করেননি। কাউকে কিছু দিতে গেলে সেই দেওয়াটার মধ্যে যেন কোনও অহংকার না থাকে, আত্মস্ফীতি না থাকে, এই ভাবনাটা উচ্চগ্রামে বাধা আছে সেই উপনিষদের কাল থেকে, আর কী অসাধারণ সংক্ষিপ্ত অথচ কঠিন আদেশের মতো সেই কালান্তক অনুশাসন— দেবার মধ্যে যেন সৌন্দর্য থাকে— শ্রিয়া দেয়ম— অর্থাৎ কিনা হেলাফেলা করে অগোছালো ছুঁড়ে দেওয়ার মধ্যে হৃদয় থাকে না কোনও। যে চাইছে তার হৃদয়ের সঙ্গে একাত্মতা না হলে দাতার দানের মধ্যে কৃত্রিমতা আসে, অন্তরে কষ্টও থেকে যায় ভালোরকম।

উপনিষদ বলছে— যা দিতে হবে, বাছা! লজ্জার সঙ্গে দিয়ো— হ্রিয়া দেয়ম— অর্থাৎ তোমার দানের মধ্যে যেন কোনও অহংকার না থাকে। দান করার পর যদি এমন শ্লাঘা তৈরি হয় যে, আমি না থাকলে এ লোকটা ভেসে বয়ে যেত, তাহলে সেটা যেমন যাচকের হৃদয়কেও আঘাত করে, তেমনই তা পরোক্ষে দাতাকে হীন এক অভিমান মঞ্চে প্রতিষ্ঠা করে। আমার পিতাঠাকুর বলেছিলেন— দৈত্যরাজ বলির মনেও কি দান করতে করতে এই শ্লাঘা তৈরি হয়েছিল? হয়তো হয়নি, অথবা হয়েছিল। কিন্তু ভগবান বিষ্ণু যখন বামন-রূপে দান গ্রহণ করতে এলেন, তখন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তাঁকে শুভবুদ্ধি দিয়ে বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন— তুমি বিরত হও, বলি! আমি এই বেঁটে বামনটিকে চিনেছি। ইনি ভগবান বিষ্ণু। দেবতাদের কার্য-সাধনের জন্য অশেষ কপটতায় ইনি বেঁটে বামন হয়ে এসেছেন তোমার কাছে দান চাইতে। উনি জানেন, দান চাইলে তুমি কিছুতেই না করবে না। তুমি কোনও কথা দিয়ো না এঁকে। উনি তোমার ধন-ঐশ্বর্য রাজ্যাধিকার সব কেড়ে নেবেন। তুমি যেন কিছু দেবে বলে স্বীকার কোরো না এই মায়া-মানুষটির কাছে— দাস্যতাচ্ছিদ্য শত্রুায় মায়া-মানবকো হরিঃ।

বলি বললেন— আমি বুঝি, আপনি আমার ভালোর জন্যই বলছেন, গুরুদেব। কিন্তু আমি না বলি কী করে। আমি রাজ্যনাশ, বিত্তনাশ কোনও কিছুই ভয় পাই না। আমি যখন স্বীকার করেছি, অতএব দিতেই হবে আমাকে। আমার সব গেলেও এই বেঁটে বামুনটির ইচ্ছাপূরণ করতে হবেই আমাকে— ততো বটোরস্য দদামি বাঞ্ছিতম। আমরা জানি— বলি-মহারাজের ভাবনার মধ্যে খুব যে অহংকার ছিল, তা নয় কিন্তু সেটাকে অহংকারের মতোই দেখতে লাগল। বিশেষত শুক্রাচার্যের মনে হল যেন অহংকার কাজ করছে তাঁর মনে। যা হোক বলি নিজের কথা রাখলেন। বিষ্ণুরূপী বামনকে পা রাখার জায়গা দিতেই তাঁর দুই চরণের ব্যাপ্তিতে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল, দ্যুলোক-ভূলোক-অন্তরীক্ষ সব অধিক্রান্ত হয়ে গেল। তৃতীয় পাদভূমির জন্য জায়গা চাইতেই নিরুপায় সত্যসন্ধ বলিরাজ নিজের মাথাটি নত করে বললেন— আমার মাথায় রাখুন ওই তৃতীয় চরণ— পদং তৃতীয়ং কুরু শীর্ষ্ণি মে নিজম।

যাঁর নিজের পা-দুটি শত শত রাজার মুকুট-মণি আভায় রঞ্জিত হত, তিনিই মাথা নত করে যাচক, দান-গ্রহীতার চরণ গ্রহণ করছেন, এইখানেই সকল অহংকার, আত্মশ্লাঘার সমাপ্তি ঘোষণা হয়ে যায়। উপনিষদের কথা সত্য হয়ে ওঠে— লজ্জার সঙ্গে দিয়ো। উপনিষদের শেষ আদেশটা আরও চমৎকার। বলা হয়েছে— যা দেবে বাছা, শ্রদ্ধার সঙ্গে দিয়ো, আর শ্রদ্ধা যদি না থাকে, তো বাপু দিয়ো না— শ্রদ্ধয়া দেয়ম, অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম। যাকে দিচ্ছি, সেখানে যদি শ্রদ্ধা না থাকে, তাহলে গ্রহীতার আর্থিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থা এবং তাঁর মন— এর কোনওটাকেই কিন্তু তেমন করে বিশ্বাস করা হল না অথবা গ্রহীতার ক্লিষ্ট-দীর্ণ বর্তমানটাকে একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়া হল। আর আমি প্রতিদিন শত শত এমন ‘দেয়া’ দেখি, যেখানে অবিশ্বাস আর যান্ত্রিকতায় ‘দেওয়া’-র শোভাটুকুই নষ্ট হয়ে যায়। নিজেকে এমন প্রবঞ্চনা করার চেয়ে না দেওয়াটাই ভালো।

এই যে বলিরাজার কাহিনি বলতে গিয়ে দানের রসতত্ত্ব বিস্তার করলাম, সেটা নিতান্তই অপ্রসঙ্গ হয়ে উঠবে যদি না আমার যাচনার প্রবৃত্তিটাকে এতটুকুও বিচার না করি। আজকাল অনেক বাচ্চা, বালক, বালিকা, যুবক, এমনকী যুবতীদেরও দেখি— তাদের কিছুই ভালো লাগে না। বুড়ো বুড়ি অথবা প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের কথা বুঝি— সংসারের ঘানি ঘোরাতে ঘোরাতে যে ঘূর্ণন তৈরি হয়, তা এমনই তাঁদের অন্তর্জাত হয়ে যায় যে, বাকি জীবনটা টলতে টলতেই চলতে থাকে। কিন্তু ওই যে তিন-চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে-মেয়েগুলো— ওদের মধ্যেও কেমন ভালো না লাগার অবসন্নতা তৈরি হয়েছে। ওদের রসগোল্লা-সন্দেশ ভালো লাগে না, ভালো তরকারি-মাছ ভালো লাগে না, দুধ মোটামুটি বর্জ্য পানীয়ের মধ্যে পড়ে। একজন মা বললেন— আমার মেয়েটা শুধু মাঝে-মাঝে পটেটো চিপসটা হাতে নিয়ে খায়, অন্যান্য খাবার তাকে দীর্ঘ সময় ধরে অসীম ক্ষমতায় গেলাতে হয়।

আমার জিজ্ঞাস্য হয়— এই যে কিছুই ভালো লাগছে না, কিছুই ‘ভাল্লাগে না’— এই অবসন্নতার মধ্যে এক অদ্ভুত তামসিক অহংকার কাজ করে। তার চেয়ে চাওয়া ভালো, উদাসীন স্তব্ধতার চেয়ে জাগতিক বিকার অনেক ভালো— তা নইলে এই সুন্দরী পৃথিবীর অনন্ত সৌন্দর্যগুলি কেমন অপ্রতিভাত রয়ে যাবে মানুষের কাছে। কারণ হিসেবে বলতেই পারি যে, অতিরিক্ত পাওয়ার কারণে উপভোগ-স্পৃহা ভোঁতা হয়ে যায়। কিন্তু এই ‘ভাল্লাগে-না’র দলটিকে তো মোটেই কাম-লোভ-বিবাগী ঋষিতুল্য মনে হয় না। মনে তো হয় না যে, এরা মাটির ঘরে খুঁদ-কুড়ো খেয়ে ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে প্রেমানন্দে জীবন কাটিয়ে দেবেন। তার মানে দৈনন্দিন যে না-চাইতেই-পাওয়া চলে, সেই পাওয়ার সরবরাহটুকু অবিচল থাকলেই তবে এই না চাওয়া আসে। অর্থাৎ তাকে আর চাইতেই হচ্ছে না, ভোগের উপকরণগুলি না চাইতেই যার কাছে উপস্থিত হয়, সে কী করে আমার সেই বল্গাহীন আকাঙ্ক্ষার কথা বুঝবে?

চাইতে চাইতে তেমন কিছুই যখন আমার জুটল না, তখন একদিন একটা ঘটনা ঘটল। তখন প্রথম টেরিলিন শার্ট বেরিয়েছে, ইস্তিরি না করলেও তার ভাঁজ ঠিক থাকে, অল্প পরিশ্রমে অল্প কাচাতেই এক্কেবারে পরিষ্কার। আমার বড় দাদা সেটা পরে অফিস যান, লোকজন টেরিয়ে দেখে, আমিও দেখি। তৎকালীন দিনে অভিনব-দর্শন এই টেরিলিন শার্টটি যথেষ্ট মাপ দিয়ে বানানো হওয়া সত্ত্বেও দাদার আকস্মিক স্বাস্থোদ্ধার ঘটেছিল বলে সেটি পরিত্যক্ত হল এবং উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর অভাবে আমি সেই শার্টের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। বালক বয়সে একটি বৃহৎ সাইজের শার্ট পরে স্কুলে যাতায়াত করছি। একটি অমার্জিত হাফ প্যান্টের মধ্যে অর্ধেকের বেশি চকচকে শার্ট গুঁজে জামার ওপরের পকেট প্রায় বেল্টের কাছে চলে এলেও বন্ধু-বান্ধব এবং পাড়াপড়শির বিপুল চাউনিকে আমি উৎসাহ এবং কদর দানের পক্ষে অধি-আরোপন করলাম এবং হস্তীসদৃশ চক্ষু-নিমীলনের উদাসীন্যে জগৎকে দেখতে লাগলাম। এই অদ্ভুত পরিধান দিনের পর দিন পুনরাবৃত্ত হতে থাকায় আমার অন্য এক হিতৈষী দাদা আমাকে বিস্তর বকাবকি করে সেই অগুলফলম্বিত শার্টটি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলেন। আমি ক্রোধে উন্মত্ত বহুতর বিপরীত আচরণ করে স্তব্ধ হলাম।

এমন অবস্থায় আমার পিতাঠাকুর, যিনি ক্লাস এইটেই আমাকে শ্রীধর স্বামীর টাকা-সহ গীতা পড়াতে আরম্ভ করেছিলেন, তিনি বললেন— বিভিন্ন জিনিসের ওপর তোমার যে এত লোভ হয়, তার কারণ জানো? তুমি এইগুলিকে জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন বলে ভাবছ এবং বারবার সেগুলির মানসিক সঙ্গ করায় সেগুলির প্রতি তোমার কামনা জন্মাচ্ছে। আমি বললাম— এটা কী রকম? তিনি বললেন— ওই যে পাশের বাড়ির সুমন্ত, ওর বউটা কালো, বেঁটে, খাঁদা নাক, ওই মৌটুসিকে তো সুমন্ত বিয়েই করতে চায়নি। যা হোক জোর করে বিয়ে হল, তারপর দিন-রাত ওর সঙ্গে থাকে, একসঙ্গে সর্বত্র যায়, এইভাবে সঙ্গ করতে করতে এখন এমন হয়েছে যে সুমন্ত মৌটুসিকে ছাড়া থাকতেই পারে না। মৌটুসি যদি বাপের কাছে গিয়ে দুদিন থাকতে চায় তো সুমন্ত বাড়িতে অনর্থ করে। তাহলে কী দাঁড়াল? একটা ব্যক্তি বলো আর বস্তু বলো, সহ্য করতে করতেই তার ওপর কামনা জন্মায়, ভালোবাসা জন্মায়। কামনার বস্তু পেলে সেটাকেই ভালো লাগতে থাকে। ওই তো দেখলে— যেদিন থেকে তোমার দাদা ওই টেরিলিনের শার্ট গায়ে তুলেছে, সেদিন থেকে ওটার ওপর তোমার মানসিক সঙ্গ চলছে। তারপর এটা পেলে। কামনার বস্তু হাতের মুঠোয় এল, সঙ্গলাভ আরও প্রত্যক্ষ বাস্তব হয়ে উঠল। তুমি ওটা ছাড়া আর ভাবতেই পারছ না। আজকে ওটা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, অতএব তোমার রাগ হচ্ছে— ঠিক যেমন মৌটুসি বাপের বাড়ি যেতে চাইলে সুমন্তর রাগ হয়।

আমার পিতাঠাকুর এবার সিদ্ধান্ত দিয়ে বললেন— চাওয়াটাকে কমাতে হবে, বাছা। চাওয়ার তো শেষ নেই, চাওয়াটাকে কমাতে পারলে তুমি তোমার বড় দাদার চেয়েও ধনে-মানে বড়লোক হতে পারবে। আমার মনে আছে— আমার সেই অবোধ বয়সেও— এখনকার ছেলেমেয়েদের বুদ্ধি চেতনা অনেক বেশি— আমি ক্লাস এইটেও নিতান্ত অবোধ, তবু আমার পিতাঠাকুর শঙ্করাচার্যের টীকা উদ্ধার করে বললেন— কামনা আর ক্রোধ হল পিঠোপিঠি ভাই, কামনা যদি কোনওভাবে আহত প্রতিহত হয়, তবেই ক্রোধ তৈরি হবে, রাগ হবে ভেতরে ভেতরে। ইচ্ছার জিনিসটা পেলাম না বলে। তাই বলছিলাম কী-বাবা ইচ্ছেটাকেই কমাতে হবে। আর ইচ্ছেটাকে যদি কমিয়ে রাখতে পারো, তাহলে দেখবে দুনিয়ায় তোমার চেয়ে বড়লোক নেই।

এই কথাটায় আবার আমার খটকা লাগল। এত সহজে বড়লোক হওয়ার ভাবনাটা আমার জীবন দিয়ে বুঝেছি। আর এইখানেই আমার সেই মালগাড়ির গার্ড স্বপ্ন দিয়ে যান অথবা সেই পাগলা জগাই। সত্যিই তো আমি কত বড়লোক দেখলাম, দিনের পর দিন, কত রকম বড়লোক— ধনৈশ্বর্যে বড়লোক, শক্তি প্রভাবের বড়লোক, ক্ষমতার বড়লোক— যার দু-লাখ আছে, সে পাঁচ লাখ চায়, যার পাঁচ লাখ আছে, সে কুড়ি-তিরিশের দিকে দৌড়চ্ছে। অন্যদিকে শক্তি-প্রভাব ক্ষমতার প্রসারিত ক্ষেত্র দেখুন— চাহিদার শেষ নেই, পাড়ার ক্ষমতা থেকে বেপাড়ার ক্ষমতা, ইউনিট থেকে জোন, জোন থেকে একে একে অনন্ত, প্রদেশ থেকে স্বদেশ। কথাটা খুব ভালো বলেছিলেন এক নীতিশাস্ত্রের কবি। তিনি বলেছিলেন— চাওয়ার কোনও শেষ নেই। যে নিঃস্ব সে একশ টাকা চাইছে, একশতী দশ হাজার চাইছে, দশ হাজারি এক লক্ষ চায়, লক্ষ থেকে একটি রাজ্যের রাজা হতে ইচ্ছা যায়। এইভাবে সুরপতি ইন্দ্র সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা হতে চান, ব্রহ্মা চান ভগবান শ্রীহরির পদ, আর শ্রীহরি ভাবেন— আমি শিব হব না কেন— এই যে অনন্ত চাওয়া, এই চাওয়ার তো শেষ নেই— ব্রহ্মা বিষ্ণুপদং হরিঃ শিবপদং তৃষ্ণাবধিং কো গতঃ।

আমার পিতাঠাকুর বললেন— দ্যাখো বাবা। সবচেয়ে গরীব মানুষ হলেন তিনি, যিনি অসন্তুষ্ট। কারণ অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, যশ— এতে যদি কোনও না কোনও সময়ে তৃপ্তি না আসে, তবে ওই আকাঙ্ক্ষা আর না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকেই কারও গ্যাস্ট্রিক আলসার, কারও হার্ট অ্যাটাক, কারও সেরিব্রাল। অনন্ত অর্থ আছে, তবু ভোগ করার সময় নেই যাঁদের, তাঁরা এই বিপুল অর্থসাধনের অথবা ক্ষমতা সাধনের উপায়গুলিই উপভোগ করেন কিন্তু অতৃপ্তির মধ্যে এই যে তৃপ্তিলাভ সেটা কখনও কারণ কার্যের বৈপরীত্য ঘটাতে পারে না, অতৃপ্তি তার থেকেই যাবে। অথচ অর্থহীন হলেও যে লোকটা সন্তুষ্ট, তার মতো বড়লোক সুখী আর কেউ নেই।

আমি এই দৃষ্টি নিয়েই রাসবিহারী এভিনিউয়ের ধারে সেই ছিন্নবস্ত্র রমণীর দিকে তাকাই। পোকা বেগুন, ধসা আলু এবং অপক্ব কুমড়োটাকে সাইজ করে অপরাহ্নের নম্রতায় রান্না করতে বসেছেন তিনি। পচা আদার একাংশ এবং পেঁয়াজের অবিধ্বস্ত অংশ কেটে নিয়ে ফুটপাতের পাথরে বাটনা বাটাও হল। তারপর তরকারি চড়িয়ে নুন হলুদ দেবার পর তিনি যখন পাশে শুয়ে থাকা শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে তার মুখে লোলচর্ম স্তনটি গুঁজে দিলেন, তখন তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত তৃপ্তিতে ভেসে চলেছে তাঁর অন্য একটি বাচ্চার দিকে। তার কপালে নজর-না-লাগা কাজলের টিপ। কাঁধ থেকে পা পর্যন্ত এইটাই জামা, সে হাততালি দিচ্ছে, ফুটপাতের রুক্ষা যুবতী হাসছে। ভেবে দেখুন— এই তৃপ্তির মধ্যেই সমস্ত নন্দনকানন ফুটপাতে বাসা বাঁধে।

আমি এ-কথা বলিনি যে, জীবনে উচ্চাশা পোষণ কোরো না, কিম্বা বড়লোক হওয়া খুব খারাপ। অনন্ত পরিশ্রম, অনন্ত কর্ম এবং সন্তুষ্টিহীন অনন্ত উদ্যোগের মাধ্যমে নিজেকে তো প্রমাণ করতেই হবে। কিন্তু এটাও সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, পরিশ্রম, কর্ম এবং উদ্যোগের মধ্যেই কিন্তু নিজেকে চিনে নিতে হয়। বুঝে নিতে হয় আমি কতটা পারি, আর কতটা পারি না। নিজেকে চেনার এই জায়গাটা যদি ভ্রান্তি আর অনমনীয়তায় ভরা থাকে, তাহলে দুর্বার তৃষ্ণা এবং চেয়ে চেয়ে না পাবার যন্ত্রণা জীবনের তন্তুগুলিকে ছিন্ন করে দেয়। আমি সে দিন একটি সামান্য তরুণীকে দেখলাম, যে চার হাজার টাকা মাইনে পায়, কিন্তু তার হাতে বারো হাজার টাকার মোবাইল। জীবনভোগের এই তৃষ্ণা যদি একদিন তার অবসাদ ডেকে না আনে, তাহলে বুঝতে হবে যে, ঈশ্বর তাকে যে এতটা বোকা এবং নির্বোধ করে পাঠিয়েছেন, এটাই তার পক্ষে পরম এক আশীর্বাদ। নইলে যে কী হত!

আসলে আজকের দিনের নিরানন্দ, হতাশ্বাস ছেলে-মেয়েদের দেখে দেখে আমার খুব মায়াও হয়, কষ্টও হয়। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার পরিকাঠামো আমাদের এই অশান্তিটুকু দিতে পেরেছে যে, উচ্চশিক্ষার সঠিক মান ছাড়াই আমরা নিজেদের উচ্চশিক্ষিত মনে করতে পারি। তাতে আরও অশান্তি এই যে, হাতে একটা মিষ্টি কুমড়ো নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে গেলে আমাদের মান নষ্ট হয়। অন্যদিকে আই. টি. আই অথবা ব্যবসার জোরে যার হাতে খানিক পয়সা এল, সে ভাবে— আমিই প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তি, কারণ উচ্চশিক্ষাও তো পয়সার জন্যই চেয়েছিলাম। ওটা হয়নি এটা হয়েছে, অতএব আরও চাই।

হতাশ্বাসদের আমি জীবন দিয়ে বোঝাতে চাই— বেঁচে থাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন, সেটা হল সুখ। অর্থের সমাগম হলেও সুখ দরকার, অর্থের অনাগমেও তাই। কারণ পৃথিবীতে এখনও কত স্বচ্ছ সুন্দরী নদী আছে, যেখানে জল খাওয়ার বাধা নেই। পরবার জন্য সস্তার কাপড় এখনও অনেক আছে, অন্তত তাতে লজ্জা নিবারণের বাধা নেই কোনও। মন্দির চত্বর, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু এখনও কত আছে, যাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে এক বেলা খেলে বেশ খুশিই হন তাঁরা। আমি এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ইলেকট্রিকের বিল জমা দিয়ে এসেছিলাম বলেই তিনি আমাকে রাত্রিবেলা খাবার নেমন্তন্ন করেছিলেন। ঠিক এমন একটা নির্ভয় অবস্থা যদি হত, এবং সেই আমার মালগাড়ির গার্ডটি যদি তাঁর বিদ্যে-বুদ্ধি-মাইনে এবং স্বক্ষমতায় সন্তুষ্ট থেকে থাকেন, তাহলে গ্রাম শহর পেরিয়ে যেতে যেতে অপরাহ্নের ছায়ায় বসা গ্রাম্য তরুণীর চুল আঁচড়ানো দেখতে পাবেন তিনি। দেখতে পাবেন ভুবনডাঙার মাঠে অপরিচ্ছন্ন বাচ্চা ছেলেরা কী সুন্দর ফুটবল খেলছে। বয়স্ক মাসিমা কপালে ডগডগে সিঁদুর পরে এ-বাড়িতে এসে ভ্রূকুটি কুটিল নেত্রে পরচর্চা করছেন ওই রেললাইনের ধারে। আমার মালগাড়ির গার্ড সাহেব জানেন— প্রত্যেকে আমরা কোনও না কোনওভাবে মালগাড়ির বগি টেনে চলছি, প্রত্যেকে বাড়ি ফিরে বাস করি এক ভাঙন-নদীর তীরে— প্রতিদিন যে নদীর ঢেউ আমার ঘর ছুঁয়ে ভয় দেখিয়ে যায়, তাকে ভয় পেয়ে লাভ নেই, বরং তাকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমি চলব মুসাফির। অবিরাম চলতে চলতেই একদিন সেই মধু পেয়ে যাব— চরৈবেতি। চরণ বৈ মধু বিন্দেত।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন