তারই মাঝে যে জন একাকী

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

ছোটোবেলায় ইংরেজি সিনেমা দেখতে দেখতে কথাটা প্রথম শুনি। পরিচিত নায়ক ভুল বুঝেছে নায়িকাকে। নায়িকা অশ্রুবাষ্প সামলাতে সামলাতে বাড়ি ঢুকছেন কোনওমতে। গৃহে অপেক্ষমাণ বাবা-মা তাঁর সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করলেন উৎকণ্ঠিত নেত্রপাতে। কিন্তু মেয়ে কোনও দিকে তাকাল না এবং অদ্ভুত এক আবেগ-স্খলিত গতিতে নিজেকে কোনও মতে ঠেলে নিয়ে আপন ঘরের বিছানায় উপুর করে ফেলল। তার ভ্যানিটি ব্যাগ পড়ে রইল একদিকে, বিছানায় অর্ধেক পা বাইরে, বেশবাস বিস্রস্ত, বিছানায় মুখ ঘষে সে উচ্চৈচঃস্বরে কাঁদতে আরম্ভ করল। স্নেহময়ী জননী এসে মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলেন, আর অমনি মেয়ে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে জননীকে প্রায় ঠেলতে ঠেলতে দরজার বাইরে নিয়ে গেল। তার মুখে একটাই শব্দ পুনরুক্তির কাঠিন্যে সু-উচ্চে ধ্বনিত হচ্ছে— লীভ মি আলোন, লীভ মি আলোন।

পরবর্তীতে অবশ্য এই ‘ডাইলগ’ আমি অনেক শুনেছি— আমার নিজের কালের সমবয়সিদের মুখেও অনেক শুনেছি এ-কথা। আর এখন প্রায় শোনাই যায় না। আধুনিক মানুষের এই ক্ষোভ প্রশমিত হয়েছে, তারা এখন একা কাঁদার, একা হাসার এবং একা মরার সুবিধে পাচ্ছে। এই সেদিনই এক আপ্লুত দম্পতির নতুন কেনা ফ্ল্যাট দেখতে গিয়েছিলাম— মানে, গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম সন্ধ্যাবেলায়। তাঁদের একটি চার বছরের বাচ্চা, আর একটি আধ বছরের। দুটি বাচ্চার জন্য দুটি আয়া। বাড়িতে অতিথি-সমাগমের কারণেই বাচ্চাদুটির প্রতি তাদের সেবা-সাধন আপাতত মধুরতায় পরিণত। বড় অদ্ভুত লাগল— প্রায় তিন ঘণ্টা ওই বাড়িতে ছিলাম, তার মধ্যে মুহূর্তকালের জন্যও চার বছরের বাচ্চাটি একবারও জন সমাগমের মধ্যে এল না, এমন কোনও দুষ্টুমিও দেখলাম না যাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে অতিথির সমুদাচার। একবারের তরেও সেই দুগ্ধপোষ্য শিশুটির আয়া এই পৃথিবীর নতুন অতিথিটিকে গর্বিত মুখে নিয়ে এল না অন্যান্য মানুষের সামনে। আমাদেরই সহাগতা এক মহিলা— না না, এটাকে আমি কোনও আদিখ্যেতা বলতে পারি না— উদগলিত স্নেহেই প্রবেশ করেছিলেন নন্দনের সংবাদবহ সেই শিশুটিকে কোলে নিতে। তিনি হাত বাড়াতেই— এ কথা আমরা তাঁর মুখেই পরে শুনেছি— শিশুধাত্রী আয়া শিশুটিকে সগর্বে আগলে রেখে একটি টিউব দিল সেই মহিলার হাতে। বলল— একটু মাখিয়ে নিন হাতে, হাতটা একটু ধুয়ে নিন। গঙ্গাজল।

আমাদের এই মহিলাটি সরল মানুষ। বড় বাড়ির আয়া-র টিপ্পনিও তিনি বোঝেননি। তিনি আমতা-আমতা করে বললেন— না না, এইটুকুনি জলস্পর্শ করে কী হবে? তার চেয়ে হাতটা বরং আমি ভালো করে ধুয়েই নিই বেসিনে। আয়া বলল— হাত ভালো করে ধুয়ে নিলেও এই গঙ্গার জলটুকু আপনাকে স্পর্শ করতেই হবে মা! মহিলা বললেন— সত্যি এমনটা নিয়ম নাকি? আমি অবশ্য আমার জ্যাঠার বাড়িতে একটা ‘নেবাসালফ’-এর টিউবে গঙ্গাজল ভরে রাখতে দেখতাম। চামচ দিয়ে প্লেট থেকে খেলেও তিনি হাতটাকে এঁটো হয়েছে বলে ভাবতেন, অতএব এক ফোঁটা গঙ্গাজল দিয়ে শুধু শুদ্ধ করে দিতেন আমাদের। বলতেন— গাঙ্গং বারি পাপাপহারি। মহিলা বললেন, এখানেও কী সেই নিয়ম? আমাদের রীতার গঙ্গাজলে এত ভক্তি? আয়া বলল— না, দিদি! এ সে গঙ্গাজল নয়, এ হল কীটনাশক জল, টি-বিতে দ্যাখোনি, যতই ধোও, কীটাণু তবু হাতের খাঁজে ঘুরে বেড়ায়? মহিলা এমনিতে শিক্ষিত মানুষ, তিনি বুঝতে পারলেন— ডিস-ইনফেকট্যান্ট দিয়ে আগে নিজেকে এই গৃহের উপযুক্ত করে নিতে হবে, তারপর এই শিশুকে স্পর্শ করা যাবে। স্নেহ-চুম্বনের জন্য নিজের ঠোঁটে গালেও সেটা মেখে নেওয়া দরকার কিনা কে জানে। এরপর কী অদ্ভুত একটা প্রতিক্রিয়া দেখলাম জানেন! খুব ছোঁয়াচে রোগীর ঘরে যদি ভদ্রতাবশত ঢুকতেই হয়, তাহলে যে প্রতিক্রিয়ায় ভয়াক্রান্ত মনে আমরা শেষপর্যন্ত প্রায় ছিটকে বেরিয়ে আসি, ঠিক সেইভাবেই মহিলা বেরিয়ে এলেন। কেউ তো আর নিজেকে ছোঁয়াচে রোগী মনে করে না। এক্ষেত্রে ওই দুধের বাচ্চাটাই যেন সংক্রামক রোগের এক আরোপিত বাহন হয়ে উঠল বিপ্রতীপভাবে।

আপনারা বলতেই পারেন— এটা তো গ্রাম্যতার চূড়ান্ত। এটা একবিংশ শতাব্দী, আমরা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এই স্বর্গশিশুর সর্বাঙ্গীন কুশল চাই। সেখানে আমি কী করছি? আমি অবিজ্ঞানের দূষণ-স্পর্শে এই শিশুটিকে আক্রান্ত করতে চাইনি। সবিনয়ে জানাই— আমি বোধবুদ্ধিহীন গ্রাম্য মানুষ, অল্পপ্রাণ ভারতীয়। যাঁরা এই দূষণের চক্রান্ত থেকে বাঁচবার জন্য বিচিত্র বিশ্বায়িত আচরণ করছেন, তাঁরা সকলেই একশ শরৎ বেঁচে থাকুন এবং এই অদূষণের প্রয়াস চালিয়ে যেতে থাকুন। তাঁদের জন্য আমার কোনও বক্তব্যও নেই। এই দূষণের চেয়ে আমার কাছে বরং অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল সেই স্বতন্ত্র প্রকোষ্ঠটি, যেখান থেকে একবারও বেরিয়ে এল না সেই চার বছরের শিশুটি, যার ডানপিটে হবার কথা ছিল। আর ছ-মাসেরটির তো বেরিয়ে আসার প্রশ্নই ওঠে না— বহিরাগত জীবাণু-কীটাণুদের মধ্যে! শুনলাম নাকি রাতের আয়া থাকেন ছ মাসের শিশুটিকে নিয়ে ওই একক প্রকোষ্ঠ, আর চার বছরেরটিকে এগারোটায় ঘুম পাড়িয়ে দিলে সে সেই সকালে ওঠে— আর মাতা-পিতা অন্য ঘরে শায়িত থাকেন চর্চিত দাম্পত্যের রোমন্থনী নিদ্রায়।

সম্পূর্ণ গৃহ এবং গার্হস্থের মধ্যে এই একক এবং প্রায় পৃথক প্রকোষ্ঠগুলি নিয়ে আমার ভারী দুশ্চিন্তা হয়। ওঁরা অনেক কিছু বলছেন বটে যে, এমন পৃথকত্ব নিয়ে থাকলে এই শিশু নিজের ওপর নিজে নির্ভর করবে। নিজের কাজ নিজে করতে শিখবে এবং তার পার্সোনালিটি তৈরি হয়ে উঠবে সুষম সুঠামভাবে। এইসব শিশু-পণ্ডিতেরা একবারও ভেবে দেখলেন না যে, এই নিজের ওপর নিজে নির্ভর করা, আর নিজের কাজ নিজে করাটাই যদি খুব বড় একটা শিক্ষণীয় শৃঙ্খলা হয়, তাহলে তো এই বিবাহ-কৌতুকেরও কোনও প্রয়োজন ছিল না। এদের বোঝাতে পারি না যে, নির্ভরতা হল সেই ‘পাটিসাপটা’-র পুর, অথবা সেই ‘মাসালা-দোসা’র ভিতর— যা আস্বাদন করতে গেলে প্রথম কামড় দিতে হয় একটা খসখসে আবরণের ওপর। এই আবরণটাই তো ‘পার্সোনালিটি’— যা ধারণ করে রাখে আস্বাদনী নির্ভরতাকে। বস্তুত বিচিত্র-বিপুল মানুষের সঙ্গে চলতে চলতে অহরহ অন্তঃক্রিয়ায় যে পারিবারিক সামাজিক সঙ্গতি তৈরি হয়, সেই পারস্পরিক নির্ভরতাই প্রদীপের তেলের মতো বাইরের পার্সোনালিটিকে ফিড করে; জ্বলতে বা জ্বালতে সাহায্য করে প্রদীপের সূচাগ্র শিখাটিকে। নির্ভরতা হল সেই দূরান্বয়ী দৃষ্টিপাত যা স্থান-সময় অতিক্রম করেও জাগিয়ে রাখতে পারে ব্যক্তিত্বকে— তবু জানি, একদিন তুমি দেখা দিয়েছিলে বলে/ গানের ফসল মোর এ জীবনে উঠেছিল ফলে/ আজও নাই শেষ; রবির আলোক হতে একদিন/ ধ্বনিয়া তুলেছে তার মর্মবাণী, বাজায়েছে বীণ/ তোমার আঁখির আলো।

রসিকজনেরা বলেন— এ কবিতা নাকি কাদম্বরী দেবীর প্রতি। কেমন লাগে অবশেষে এই দূরন্বয়ী দৃষ্টিপাত যা অশেষে গান তৈরি করে? আমার সেই পরমাত্মীয়ের মাত্র চার বছরের শিশুটিকে তিনি যেভাবে এক সাধন-জগতে এনে ফেলেছেন, তাঁকে এক পৃথক প্রকোষ্ঠে সন্নিবিষ্ট করে যেভাবে অদ্ভুত এক স্বনির্ভরতার অভিযানে শামিল করেছেন, তাতে আমার দুটি ভয় হয়। প্রথমত, আপন প্রকোষ্ঠের এই ‘এককত্ব’ শেষ পর্যন্ত অগাধ কোনও ‘একাকী’-ত্বের জন্ম না দেয়। আর দ্বিতীয়ত, একাকীত্বের এই সাধনের মধ্যে স্বনির্ভরতার চেয়েও পরোক্ষে ভেসে আসে মাতৃলোক বা পিতৃলোকের ওপর চরম নির্ভরতা। আর ঠিক এখানেই আমার কথিত ‘নির্ভরতা’ এই শৈশব নির্ভরতার সঙ্গে গুলিয়ে যেতে পারে। এখনকার দিনে প্রত্যেকটি ঘরে একটি করে সন্তান পিতা-মাতা-ভাই-বোন পরিবৃত পরিবারের মধ্যে থাকেন না বলে গৃহকর্ত্রীকে আজকাল দশ জনের জন্য রান্নাও করতে হয় না, দশদিকে তদারকিও করতে হয় না, এমনকী অন্যের নিন্দা-মন্দ সামাল দেবার জন্য আপন কূট-কর্ণ ব্যবহার করে পরবর্তী পদক্ষেপও তৈরি করতে হয় না। ফলে দশভুজা জননীর অনন্ত জীবনীশক্তি প্রয়োগের আধার মাত্র একজনই— প্রত্যক্ষে সন্তান, অভাবে স্বামী। একক মায়ের এই একক নজর সন্তানের প্রতিটি পদক্ষেপে জননীর এই প্রতিপদ-সাক্ষিতা— এখানে যে নির্ভরতা তৈরি হয়, সেটাকে আমি অক্ষমতার পূর্ণ নামান্তর মনে করি।

এই নির্ভরতার পরিণতিতে আমি পঞ্চাশ বছর বয়সের বাবাকে ছেলের কলেজে অ্যাডমিশন নেবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি গণ্ডায় গণ্ডায়। এই নির্ভরতার কারণে একটি মেয়েকে কলেজে চাকরি পাওয়ার পর প্রথম দিনে দেখেছিলাম— তার বাবাও মেয়ের সঙ্গে কলেজ-পরিদর্শনে এসেছেন। আর ঠিক এই নির্ভরতায় কলেজ পরীক্ষার সময় অনন্ত মায়েদের দেখি— তাঁরা ছেলের মাথায় ছাতা ধরে রোদ নিবারণ করছেন আর ছেলে নির্বিকার চিত্তে ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে এক হাতে খাতা পড়ছে, আর এক হাতে ডাব খাচ্ছে।

আমি এই নির্ভরতার কথা বলিনি, কারণ এই নির্ভরতাও সেই আত্মারাম প্রকোষ্ঠ তৈরি করে এবং বাবা-মা সেই আত্মারামতার সুযোগ করে দেন। এখানে বাবা-মা একভাবে তাঁদের আত্মার তৃপ্তি ঘটান, আর পুত্র-কন্যারা অন্যতর এক প্রকোষ্ঠে আত্মকাম হয়ে ওঠে পিতা-মাতার আত্মকামের প্ররোচনায়। আমি সত্যি এইরকম নির্ভরতার কথা বলছি না। আমি ছোটো-বড়ো কারও সেই পৃথক প্রকোষ্ঠের প্রয়োজন বোধ করি না, যেখানে মানুষ একা তাঁর জীবন-বোধ তৈরি করে। ভাইবোন নেই, পিতা-মাতার দোষদর্শী স্নেহচ্ছায়া নেই, বন্ধু-বান্ধবের তির্যক-মধুর তিরস্কার-পুরস্কার নেই— শুধু আমি একা চলি নিজেরই একক পরিচালনায়। এখন প্রাচুর্য আছে বাবার এবং মায়ের। বাবা-মা ছোটোবেলা থেকে পুত্র-কন্যাদের দুধ গিলিয়ে দেন, পেস্ট্রি গিলিয়ে দেন, পিৎসা গিলিয়ে দেন, স্কুলের কোয়েশ্চেন-অ্যানসারও গিলিয়ে দেন। এদের কাউকে চুরি করে ঠাকুরঘরের কলা নাড়ু খেতে হয় না, কিংবা বাপের পকেট মেরে সাড়ে বত্রিশ ভাজাও খেতে হয় না। এরা সকলে অন্তকাম, আত্মারাম। এদের কোনও লোভ নেই, স্পৃহা নেই, অনেক পেতে পেতে এরা সকলে কেমন অবসন্ন জীবন যাপন করে। আর তা না হলে কেমন যেন একমুখো— জানে কেবল— জীবনে উন্নতি করতে হবে। চারদিকে কী হচ্ছে জানে না; না রাজনীতি, না শেয়ালদা স্টেশন, না কলেজ স্ট্রিট, না থিয়েটার— কোনওদিকেই নজর নেই। মাগো! এই থমমারা শুধুই উন্নতিকামী ছেলে-মেয়েগুলোকে নিয়ে কী করব আমরা!

আমার নিজের মনে হয়েছিল— বিশেষত আমার মতো গ্রাম্য মানুষ যারা, তারা জানে— অতি শৃঙ্খলা কিংবা অতি সততারও একটা যন্ত্রণা আছে। আমার মন্দকথার পরামর্শ এটাই বলে দিয়েছে যে, বিশৃঙ্খলার মধ্য থেকে যদি শৃঙ্খলা না শেখা যায়, তবে সেই শৃঙ্খলার ভিত্তিটুকু পোক্ত হয় না। আমার এমনও মনে হয়— ছোটোবেলার বালক জীবন, স্কুল জীবন এবং কলেজ জীবন— এখানে যে নানান বিশৃঙ্খল আচরণ করে ছেলে-মেয়েরা তার অনন্ত প্রয়োজন আছে জীবনে এবং সেটাই স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিকতায় বাবা-মা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার অনন্ত তিরস্কার ভোজনও খুব স্বাভাবিক এবং তারও অসীম প্রয়োজন আছে জীবনে। মহাভারত একটা খাঁটি কথা বলেছিল। বলেছিল— যে লোকটা তপোবনেই জন্মাল, তারপর সারা জীবন ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে তপস্যা-টপস্যা করল এবং অবশেষে তপোবনেই মারা গেল— তপোবনেষু যে জাতা তত্রৈব নিধনং গতা— অথচ সে শরীর মনের কামনা কী জিনিস তা জানাল না, জীবন উপভোগ করতে কেমন লাগে তা জানাল না, তেমন মানুষ কোন ধর্ম পালন করল? আদৌ কিছু পালন করল কি— তেষাম অল্পতরো ধর্মঃ কাম-ভোগমজানতাম?

আমি এই পৃথক প্রকোষ্ঠের কথা বলছিলাম— যেটাকে ওঁরা বলেছেন তপোবন। তপোবন মানেই সেখানে কোনও বিকার হবার কথা নয়; এই যেমন রাজা দুষ্মন্তকে দেখার পর শকুন্তলা বলেছিলেন— এ আবার কেমন হল আমার, এই মানুষটাকে দেখামাত্রই আমার মনের মধ্যে তপোবনের বিরোধী এই সব বিকার দেখা যাচ্ছে কেন- কিং নু খলু ইমং প্রেক্ষ্য তপোবন-বিরোধিনঃ বিকারস্য গমনীয়াস্মি সংবৃত্তা। এই যে বিকারের কথা বলছি, ভারতবর্ষের দার্শনিক পরিভাষায় এই বিকার কোনও খারাপ জিনিস নয়— শুধু মূল প্রকার বা প্রকৃতি থেকে সেটা অন্যরকম। দার্শনিক ভাষায় সোনার তাল যদি প্রকৃতি হয়, তবে হার, কেয়ুদ, অঙ্গদ তার বিকৃতি বা বিকার, মাটির তাল যদি প্রকৃতি হয় তবে মাটির থালা, গেলাস, কলস মাটির বিকার। তপোবনের মধ্যে শুধু নিয়ম, কানুন, শৃঙ্খলা। তার মধ্যে ‘তৈল-চিক্কন-শীর্ষ’ কতগুলি ব্রহ্মচারীকেই দেখেছেন শকুন্তলা, দুষ্মন্তের মতো রাজপুরুষ দেখেননি কখনও, কিংবা দেখেননি এমন পুরুষ। অতএব তাঁকে দেখে এক উর্বরা রমণীর বিকার হওয়াটা স্বাভাবিক, স্বাভাবিক অন্য রকম লাগা।

তবে এতো হৃদয়ের বিকার-কথা। আমি বলছি সেইসব শিশুর কথা, যারা একটা বল দেখলে পায়ে লাথি মারবে, একটা সুন্দর কাঁচি দেখলে প্রয়োজনীয় কাগজও কেটে ফেলার চেষ্টা করবে, বড়রা গল্প করলেও ফোড়ন কাটবে। এই বিশৃঙ্খল আচরণের মধ্যে যে গেলই না, যে একা বসে রইল এক তপোবন-প্রকোষ্ঠে বন্ধ হয়ে, সেই শৃঙ্খলিত বালকটির জন্য আমার মায়া হয়। এরা পথ চলবে কী করে? এরা ভবিষ্যতে বনগাঁ লাইনের ট্রেনে উঠবে কী করে? এরা আমাদের শুটকো মাস্টারকে ফেস করবে কী করে— যিনি ক্লাসে এসেই আমাদের বার করে দিতেন অসভ্যতার বদনাম দিয়ে, বিনা কারণে। সেদিন পথে যেতে যেতে শুনলাম— মা তাঁর ছেলেকে স্বশাসনে বলছেন— তোর টিফিন অন্য ছেলে খায় কী করে? আমি এই কষ্ট করে তোকে টিফিন বানিয়ে দিই, আর নেপোয় দই মেরে যাচ্ছে! এর উত্তরে বালক বলল— মা ! নেপো কে? ও তো আমাদের সঙ্গে পড়ে না। মা বললেন— নেপো কে— সেটা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি নিজের টিফিন নিজে খাবে।

আমাদের কিন্তু এইখানেই সমস্যা হয়ে গেছে। স্কুলের যে সহপাঠী বন্ধু আমার টিফিন খেয়ে ফেলেছে তাকে আমি ‘নেপো’ ভাবছি, আমার কাছে যে সামান্য উপকার আশা করবে তাকে আমি ‘নেপো’ ভাবব। বস্তুত জীবনের চলার পথে এই যে একটি বালক-কিশোরকে নিজের টিফিন বক্সের দিকে গুটিয়ে নিয়ে আসা— এই জায়গা যেমন একক ঘরানার সংক্রমণ ঘটায়, তেমনই এটা অন্যদের সঙ্গে চলার শিক্ষাটাও রুদ্ধ করে দেয়।

আমরা যখন পরম ঈশ্বরের নরলীলায় আবির্ভাবের রসশাস্ত্রীয় বিবরণ-বিবর্তনের কথা বলি, তখন তার রসশাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় বলি যে, একমেবাদ্বিতীয়াং যে ব্রহ্ম, সেই ব্রহ্মপুরুষেরও আর একা একা থাকতে ভালো লাগছিল না বলেই তিনি এক থেকে বহু হয়েছেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদের মতো প্রাচীন উপনিষদ বলল— সেই পরম পুরুষের আর একা একা ভালো লাগছিল না, কেননা একা-একা কারওরই ভালো লাগে না— স বৈ নৈব রেকে। যস্মাদ একাকী ন রমতে। সেইজন্য তিনি নিজেকে দ্বিধা ভাগ করলেন, তিনি স্ত্রী হলেন, পতি হলেন। তার মানে দুই কিংবা বহু মানেই আস্বাদনের জগৎ। অপর এবং বহুর মাধ্যমে নিজেকেই আস্বাদন করা। আমার প্রভুত্ব আস্বাদনের জন্য আমার চাকর-বাকর লাগে, আমার পৌরুষ আস্বাদনের জন্য স্ত্রী লাগে, আমার অন্তর্গত বাৎসল্য আস্বাদনের জন্য আমার পুত্র-কন্যা লাগে, তেমনই আমার জাগতিক আমিকে আস্বাদন করার জন্য জগতের মানুষকে লাগে। তা নইলে নিজেকেই আস্বাদন করা যায় না, নিরুপায়ে আত্মমেহন করতে হয় শুধু। স্বয়ং ভগবান আত্মারাম হওয়া সত্ত্বেও যেখানে নিজেকে আস্বাদনের জন্য ধরাধামে নরলীলায় সামিল হতে চান, সেখানে আমরা মানুষ হয়ে একা হওয়ার অদ্বৈতবাদী ভূমিকা তৈরি করছি।

এর মধ্যে আবার অনেক একক আছেন যাঁরা সংসারে এক-একটি ইউনিট হিসেবে কাজ করেন। আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার স্বামী, আমার বউ। আর কেউ নেই— অর্থাৎ রমণাতীত সম্পর্কের বাইরে আর সকলেই বাইরের লোক। এঁদের কাছে মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়িরাও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, তারা পশ্চিমের প্রাপ্তস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখে যাচ্ছেন আপন সৃষ্টির মহিমা। এঁদের কাছে বন্ধু-বান্ধব, খুড়তুতো-মাসতুতো, কাজের লোক, পাড়ার মেশোমশাই— সকলেই ‘আউট সাইডার’। আমার যৌবন সন্ধিতে এক বাড়িওলাকে দেখতাম— তিনি রেশনের আতপ চাল আনাতেন সারাক্ষণের কাজের লোককে দিয়ে, নিজেরা চামরমনি চালের ভাত খেতেন সব্যঞ্জনে, আর যে শীর্ণকায়া মধ্যবয়সি মহিলাটি সারা দিন-রাত তাঁর বাড়িতে খাটতেন, তাঁকে দিয়ে তিনি রেশনের নিকৃষ্ট আতপ চালটি আনিয়ে, তাঁকে দিয়েই সেটা পৃথক রান্না করিয়ে, তাঁকেই সেটা খেতে দিতেন। মাছ দিতেন না, কিন্তু মাছ কোটাতেন তাঁকে দিয়েই, রান্নাও করাতেন তাঁকে দিয়েই। বাড়ির কত্তাবাবুকে এ-ব্যাপারে বললে— তিনি বলতেন, ও-সব মেয়েদের ব্যাপার, বলতে পারব না। আর গিন্নীমা বলতেন— ওরা ওদের বাড়িতে কী রাজভোগ খায় রে। এর থেকেও খারাপ খায়। এখানে তো খেয়ে খেয়ে নধর হয়েছে। এ-কথার উত্তর দিত না শীর্ণকায়া মহিলাটি। কিন্তু জনান্তিকে বলত— বাড়িতে আমরা সিদ্ধ চালই খাই, হয়তো একটু মোটা, এই যা। আর আমাদের পাড়ার দত্তদের পুকুর থেকে দু’টো চারা-পোনা গেঁথে আনলে কখনও কিছু বলে না। আর ল্যাটাটা, চিংড়িটা ও গেরামের বাড়িতে এমনিই পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় উদাহরণ আমার বড় দাদার বাড়িতে। তিনি শেষাশেষি সাউথ সিটির পঁচিশ তলায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর আগে যখন দারুণ অসুস্থ হলেন, তখন আয়া-মাসির প্রয়োজন হল। আয়ার নিয়ম— সে সকাল আটটায় আসবে আর রাত্রি আটটায় যাবে। নিয়মানুসারে সে নিজের খাবার ব্যবস্থা নিজে করবে, অর্থাৎ সে বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসবে। ভালো কথা; কিন্তু সে বেচারা চম্পাহাটি থেকে ঢাকুরিয়ায় আসবে— বাড়ির পোষ্যদের খাবারের ব্যবস্থা করে। নিজের খাবার টিফিন বক্সে ভরারও সময় হয় না তার। কিন্তু বউদি তাকে কিছুতেই স্বগৃহ পক্ব অন্ন-ব্যঞ্জন খেতে দেবেন না— কেননা সেগুলি অতি মহার্ঘ, অতি দামী, যদিও সেগুলি ভাত-ডাল-ডালনার বাইরে কিছু নয়। সবচেয়ে বিপদ হল— আয়া-মাসির বাথরুম পেলে তিনি তাঁকে নিজের শৌচাগারে যেতে অনুমতি দেবেন না, তাঁকে পঁচিশতলা থেকে আয়া-ঝি-চাকরদের জন্য পৃথক-নির্দিষ্ট লিফটে নেমে প্রয়োজন সেরে আসতে হবে। আয়া বলল— দেখুন, একে বর্ষাকাল তাতে আমার একটু ‘পোস্টেটে’র ব্যামো আছে। এত ঘন ঘন যদি অতদূর পথ অতিক্রম করতে হয়, তবে দিনে আমাকে পাঁচ-ছবার কাপড় ধুয়ে শুকোতে হবে। তার চাইতে এখানেই যদি অনুমতি দেন! বউদি তাঁর তথাকথিত ‘নিত্য শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত’ বাথরুম ব্যবহারের অনুমতি দিলেন না। আমার দাদা এই গৃহ-যন্ত্রণার বিনিময়ে শহরতলীর এক হাসপাতাল বেছে নিলেন মৃত্যু-বরণের জন্য।

এই ঘটনার পর আমার মহাভারতের বিদুরের কথা মনে হল। তখন মহাভারতের যুদ্ধোদ্যোগ চলছে। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের দূত হয়ে পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। ধৃতরাষ্ট্র মুখে শান্তির কথা বলেছেন বটে, কিন্তু পাণ্ডবদের হৃত রাজ্য ফিরিয়ে দেবার কথা একবারও বলছেন না। এতে যুধিষ্ঠিরের মতো ধীর ব্যক্তিত্বও ক্ষিপ্ত হয়ে গেছেন এবং তাঁর মুখেও এখন যুদ্ধের কথা শোনা যাচ্ছে। দূত হিসেবে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের দ্বিচারিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। ফিরে এসে তিনি দুশ্চিন্তিত ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বাক্যালাপ করেননি। এই অবস্থায় ধৃতরাষ্ট্রের ঘুম আসছে না রাত্রে, অজানা আশঙ্কা তাঁকে পীড়িত করছে। তিনি সেই সময় বিদূরকে ডেকে পাঠালেন মন শান্ত করার জন্য। বিদুর নিজেও ধৃতরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন— কেননা ধৃতরাষ্ট্র নিজের এবং নিজ পুত্রের স্বার্থান্বেষিতা ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। এখন এই বিপন্ন মুহূর্তে তিনি বিদুরকে ডাকছেন যেহেতু, তাই বিদুরও কথা শোনাতে ছাড়লেন না ধৃতরাষ্ট্রকে। বিদুর কিন্তু কোনও ব্যক্তিগত আক্রমণ করলেন না তাঁকে। তবে কী কী কারণে মানুষ তাঁর পরিজনদের কাছ থেকে সরে গিয়ে একা হয়ে পড়ে, সেটা বোঝাতে গিয়ে বিদুর প্রথমে মূর্খ আর পণ্ডিতদের লক্ষণ বললেন সবিস্তারে। তারপর কোন কোন কাজ একা করা উচিত অথবা একা করা উচিত নয় অথবা এক, দুই, তিন, চার এইভাবে সাত পর্যন্ত সংখ্যাগুলি জীবনের কোন কোন বস্তুর সঙ্গে জড়িত, তার একটা পরিসংখ্যান দিলেন। এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে সম্বন্ধিত বস্তুগুলির সম্বন্ধ যেভাবে বিদুর দেখিয়েছেন, সেটা যে কত ভালো, তা এখানে সবটা বললে ভালো হত। কিন্তু সম্পাদক অত জায়গা আমাকে দেবেন না, জানি। অতএব নিরুপায়ে এক, দুই।

বিদুর বলেছিলেন— এক-এর জায়গাগুলো শোনো। প্রথমে বিষ। বিষ শুধু একজনকেই মারে, যার শরীরে বিষ ঢুকল, সে ছাড়া অন্য কেউ মরে না। অস্ত্রও তাই, যাকে মারলে, সেই একা মরে, অন্য কেউ নয়। কিন্তু রাজার গুপ্ত মন্ত্রণা যদি বাইরে পাঁচ কান হয় একবার, তাহলে রাজা একা ধ্বংস হন না, প্রজাদের সঙ্গে সবান্ধবে তিনি ধ্বংস হয়ে যান। তাঁর রাজ্যপাটও থাকে না। দুই, ভালো খাবার কখনও একা খেয়ো না, সকলে মিলে খাও, আস্বাদন তাতেই বাড়ে। তুমি যে অসামান্য ভালো জিনিসটা খাচ্ছ, তার প্রমাণ কী? যদি আরও অন্যজন সেই অসামান্য ভোজ্যটি চেখে দেখে এবং একইভাবে উল্লম্ফিত হয়, তবে স্বাদুতম রসের মূল্য বাড়ে। বস্তুত শুধু খাদ্যবস্তু নয়, আস্বাদনের যে কোনও বস্তুই একাকী আস্বাদ্য হলে কবি তাঁর মধুর কণ্ঠধ্বনির জন্য শ্রোতার অপেক্ষা করতেন না। এমনকী এক প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা— সেও তার প্রথম হওয়া প্রেমের আস্বাদন কাউকে না কাউকে না বলে পারে না— তাতে আরও বোঝা যায়— স্বাদু বস্তুর আস্বাদন একা গ্রহণ করতে নেই— একঃ স্বাদু ন ভুঞ্জীত।

ঠিক এই মুহূর্তেই না বললেও— কেননা এই মুহূর্তে বিদুর শুধু ‘এক’-এর ভালো-মন্দ নিয়ে ব্যস্ত আছেন— স্বাদ বস্তুর একক উপভোগের সঙ্গে তিনি গৃহাশ্রিতদের খুব জড়িয়ে রেখেছেন মনে হয়। সত্যি বলতে কী, এখন আর কেউ কারও আশ্রয় নেয় না। আর কাউকে কেউ আশ্রয় দেয়ও না। ‘শ্রি’-ধাতুর অর্থ যাওয়া, পৌঁছানো, সেবা করা। আশ্রয় করা মানে অবলম্বন করা, অবলম্বন করতে গেলে নিজের অহং ত্যাগ করতে হয়। অর্থহীনতা, সহায়-সম্বলের অভাব, আপন বুদ্ধির অপ্রামাণিকতার কথা কেউ যদি স্বাত্মারোপিত অহংকার ত্যাগ করে নিজেই বুঝতে পারে, তবেই সে আশ্রয় নেয়। গরিব লোক ধনীর আশ্রয় নেয়, বুদ্ধিহীন— বুদ্ধিমানের আশ্রয় নেয়, সংসার-যন্ত্রণায় বিমূঢ় ব্যক্তি গুরুর আশ্রয় নেয়, ভীত-ত্রস্ত বলবানের আশ্রয় নেয়। আবার এমন মানুষ আছেন, যাঁরা নিজের অহংকার-ইগো-ত্যাগ করতে পেরেছেন বলেই বলতে পারেন— নিরাশ্রয়ং মাংজগদীশ রক্ষ।

বিদুর যখন তিন-এর সংখ্যায় আসবেন, তখন একেবারে আদেশ দিয়ে বলবেন— তিন প্রকারের মানুষকে বিপৎকালেও কখনও ত্যাগ করবে না। যে আগে বহুকাল তোমার সেবা করেছে, তাকে; যে এখন তোমার সেবা করছে, তাকে এবং যে বলেছে— আমি তোমারই অধীন, আমি তোমারই— ভক্তঞ্চ ভজমানঞ্চ তবাস্মীতি বাদিনম। আমার জীবনে আমি এই শরণাগত মানুষগুলিকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, দেখেছি শরণাগত পালক-মানুষদেরও। সবচেয়ে বড় কথা— আমি তাঁদের মধ্যে যে ‘রিলেশনশিপ’ দেখেছি, তাতে ভক্ত-ভৃত্য মারা গেলে প্রভুকে হাউ হাউ করে স্বজন-বিয়োগের কান্না কাঁদতে দেখেছি। আবার ভৃত্য-ভক্ত-অনুরক্তকে দেখেছি— তাঁরা অনেক সময় পুত্র-কন্যার কর্তব্য করেছেন। আমার পূর্ব-বাংলার গাঁয়ের বাড়িতে লতা-পাতায় সম্পর্কিত, এমনকী অসম্পর্কিত ব্যক্তিও অনেকে থাকতেন।

তাঁদের গাঁয়ে স্কুল ছিল না। আর আমার পিতাঠাকুর যেহেতু স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন, কাজেই তাঁরই স্কুলে ভর্তি হয়ে তাঁরই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা। আমাদের কাছারি ঘরে তাঁদের টিনের বাক্স এবং বিছানার সরঞ্জাম থাকত গোটানো অবস্থায়। কিন্তু শুধু খাবার ব্যাপার বলি— আমার মা যা রান্না করতেন, বা আমার পিতাঠাকুর যা খেতেন, তাঁরাও তাই খেতেন। বাড়িতে কর্তার পাতে একটু ঘি দিতে গেলে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন ‘ছ্যাড়াগুলোর জন্য আছে তো?’ সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত না হলে তিনি ঘি প্রত্যাখ্যান করতেন। আমার পিতা-কথিত ‘ছ্যাড়ারা’ আমাদের বাড়ির কাজও করে দিতেন অনেকে। আমরা অনেক নির্ভরশীল ছিলাম তাঁদের ওপর এবং তাঁদেরও প্রতিপত্তি এতটাই তৈরি হয়ে যেত কালে কালে যে এই সব অপরজনের হাতে আমরা প্রচুর চড়-থাপ্পড়ও খেয়েছি, কিন্তু এমন কখনও বুঝিনি যে তাঁদের বিরুদ্ধে নালিশ জানালে পিতা-মাতা আমাকে সায় দেবেন।

আশ্রিত জনের এই পরিভাষা মহাভারতের কবিও জানতেন বলেই বিদুরের মুখে আমরা এই কথা শুনি— খাবার সময় আশ্রিত লোকদের আগে খাবার ভাগ করে দাও এবং নিজে পরিমিত আহার করো— মিতং ভুঙক্তে সংবিভজ্যাশ্রিতেভ্যঃ। এই আশ্রিতের মধ্যে কিন্তু কাজের লোক, ঝি-চাকর সবাই যেমন পড়ে, তেমনই পড়েন তাঁরা, যাঁদের কথা বিদুর চার-সংখ্যার কর্তব্যের মধ্যে বলেছেন। বিদুর বলেছেন— মহারাজ! তুমি সম্পন্ন গৃহস্থ। অতএব চার রকমের মানুষ তোমার ঘরে আশ্রিত হয়ে নির্দ্ধিধায় বাস করুন। প্রথম হলেন বৃদ্ধ জ্ঞাতি, দ্বিতীয় ভালো বংশের মানুষ, অথচ আশ্রয় নেই কোথাও। তৃতীয়, কোনও বন্ধু যদি বিপাকে দরিদ্র হয়ে থাকে, আর চতুর্থ হলেন সেই সব বোনেরা— স্বামীর ঘরে গিয়েও বা দুর্ভাগ্যবশত যাঁদের সন্তান হয়নি— বৃদ্ধো জ্ঞাতিরবসন্নঃ কুলীনঃ /সখা দরিদ্রো ভগিনী চানপত্যা।

এইরকম আশ্রিত জনের একটা দুটো প্রকার আমাদের পঞ্চাশ বছর আগের গাঁ কেন, এই শহরের দেখেছি। আমার সেই সাউথ সিটির বউদি ফুট কেটে বলেছিলেন— তোমরা বিধবা পিসিটাকে তো খাটিয়ে নিতে ভোলো না। খেতে-পরতে দিচ্ছ বলে তাঁকে কোন সম্মানে রেখেছ? আমার কাকা তাঁকে বলেছিলেন— আমার বোন যদি এতটুকুও ঘরের কাজ না করে পাট-ঠাকুরের মতো বসে থাকতেন, তাহলে এতদিন এক গভীর অবসাদ তাঁকে গ্রাস করত। বস্তুত, তিনি যে এই বাড়ির জন্য করেন, ভাবেন— এটাই তাঁকে সম্মান দেওয়া। স্বামী-পুত্র হারিয়ে যিনি এ-বাড়িতে বসে আছেন, তাঁর ব্যস্ত থাকার দরকার আছে। তুমি তাকে একটু মেনে চলার সম্মানটুকু দেখাও, তাতেই পরম সুখ হবে আমাদের। বস্তুত আশ্রিত জনের সঙ্গে স্বাদু অন্নের একত্র এবং অবিশেষ ভোজন যেমন গৃহকর্তার আন্তর নীতির মধ্যে পড়ে, তেমনই আমি দেখেছি আশ্রিত জনকে নিজের ঘরের কাজে সামিল করে নেবার মধ্যে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক দিশা আছে, সেটা সেকালের গৃহস্থ অচেতনেই বুঝতেন।

মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ মহাভারতের শ্লোকটি বোঝাতে গিয়ে বলেছেন— বৃদ্ধ জ্ঞাতি কুলধর্মান উপদিশতি— জ্ঞাতিদের মধ্যে বুড়ো মানুষটির কাছে কুলধর্ম শিখতে হয়। এখনকার দিনে ‘জ্ঞাতি’-কথাটা বোঝানোই সম্ভব নয়। তবে কিনা গাঁয়ে-গঞ্জে পুরনো কালে আমাদের পূর্ব-প্রজন্মেই জ্ঞাতি-বিবাদ যথেষ্ট ছিল দেখেছি, কিন্তু সেগুলি প্রধানত জমি-জিরেত নিয়ে ঝামেলা। কিন্তু তাই বলে জ্ঞাতিকুলের বৃদ্ধ মানুষটির সম্মান কম ছিল না। তাঁদের কাছে বালক-যুবকেরা পুরনো কালের বংশ-মর্যাদার গল্প শুনত— এও যেমন দেখেছি, তেমনই এক বৃদ্ধ তাঁর ঘরে পাঠশালা বসাতেন এবং জমি-বিবাদীর ছেলে তাঁর ঘরে গিয়ে ‘কড়াক্কিয়া গণ্ডাক্কিয়া’-র নামতা পড়ছে এবং সেই বাড়িতেই আউসের ফ্যানাভাত খেয়ে বাড়ি ফিরছে, এ আমার নিজের চোখে দেখা। মহাভারত আশ্রিতের মধ্যে আর একজনকে বলেছেন ‘অবসন্নঃ কুলীনঃ’। অবসন্ন বলতে কেউ লিখেছেন আশ্রয়শূন্য, কিন্তু বড় বংশের মানুষ।

বস্তুত এই প্রথম সেই আধুনিক চেনা শব্দটার প্রয়োগ ঘটল— অবসন্ন— যে অর্থই করুন এটার, শুধু মনে রাখতে হবে— যে ধাতুর উৎস থেকে অবসন্ন কথাটা আসছে, সেই ধাতু থেকেই অবসাদ-কথাটির সৃষ্টি। এই অবসন্ন-বিশ্লেষণের সঙ্গে বৃদ্ধ-শব্দটাও একত্রে আসা উচিত। আসলে উচ্চবংশের এই কুলীন বৃদ্ধদের একটা বড় ভূমিকা ছিল সেকালের রাজতন্ত্রে। আপনারা এই প্রসঙ্গে দ্রোণাচার্যের কথা ভাবুন— কোথাকার কোন পঞ্চাল দেশের মানুষ, হত-দরিদ্র অবস্থায় হস্তিনাপুরে এসে শ্যালক কৃপাচার্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে কুরুকুলের বাচ্চাদের সামনে অস্ত্রের কেরামতি দেখিয়ে কৌরব-বাড়িতে স্থায়ী ঠিকানায় বসে গেলেন। পঞ্চালদেশের বন্ধু দ্রুপদকে হতমান করে অর্ধেক রাজত্ব পেলেন পঞ্চালে, কিন্তু আর ফিরলেন না। কুরুকুলের অস্ত্রাচার্যের গৌরবে চিরকাল আশ্রিত হয়ে থাকলেন, কিন্তু তাঁর মর্যাদা কতটা ছিল, সেটা মহাভারতের পাঠক-মাত্রেই জানেন। আমি শুধু ভাবি— এই কর্মক্ষম মানুষটি— যিনি আপন ব্রাহ্মণ সমাজে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিলেন ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করার জন্য, তাঁকে যদি আশ্রয় না দিতেন ভীষ্ম, তাহলে শুধু কর্মহীনতার অবসাদ তাঁকে কোথায় নিয়ে যেত কেউ জানে না।

নীলকণ্ঠ টীকাকার লিখেছেন— এমন নিরাশ্রয় অবসন্ন কুলীনেরা বাড়িতে থাকলে তাঁরা শিশুদের কুলাচার শিখিয়ে বড় করে তোলেন। আমরা বলব— এটা খুব যান্ত্রিক উদাহরণ হল। আমাদের কালে এই আশ্রিত বৃদ্ধেরা বাড়ির ছোটোদের পড়াশোনার ভার সহ আরও কত-শত বিবাহ অন্নপ্রাশন এবং অমুক বাড়ির মেয়ের সঙ্গে তমুক বাড়ির ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্য কত চেষ্টা করতেন, সেগুলি এখন ভাবলে আমার নিজেকে বড় হীন লাগে, সামাজিক সেবায় নিজেকে পতিত বোধ করি। আর বিদুর কথিত গৃহস্থের দরিদ্র সখা এবং তাঁর অনপত্যা ভগিনীদের আশ্রয় হতেন যাঁরা, তাঁদের গৌরব গান করার চেয়ে তাঁদের আন্তরিকতার মাধুর্য প্রচার করতে আমার বেশি ভালো লাগে। গৃহকর্তার আপন অর্থকৃচ্ছ্রিতা এইসব সম্পর্কের মধ্যে কখনও কখনও চিড় ধরিয়েছে বটে, কিন্তু শত কৃচ্ছ্রিতাতেও এঁরা ঘর থেকে বিতাড়িত হতেন না। আর গৃহস্থ যদি সম্পন্ন হতেন, তবে ভাইয়ের ঘরে বিধবা বোনের আধিপত্য এবং মর্যাদা কিংবা দরিদ্র সখার সঙ্গে গৃহকর্তার সন্ধ্যার মজলিশি আড্ডা— সে সব আমার কাছে এখন ‘নস্টালজিয়া’র জায়গা নিয়েছে।

আমি প্রথমে যেটা বলেছিলাম— পৃথক প্রকোষ্ঠের কথা। সত্যি বলতে কী, এমন আশ্রিত-পালনেরও প্রয়োজন নেই, ‘শরণাগত-দীনার্ত-পরিত্রাণ- পরায়ণতারও প্রয়োজন নেই এত। আজকের দিনে সেটা সম্ভবও নয় হয়তো। কিন্তু আজকের দিনে মানুষের মধ্যে ছোট-বড়-নির্বিশেষে এত যে অনন্ত অবসাদ দেখি, তার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ বোধহয় পৃথক, আলাদা এবং বিশেষ ভাবার চেষ্টা, নিজের পুত্র কিংবা কন্যাকে জাগতিক সমস্ত পুত্র-কন্যার মিছিল থেকে পৃথক ভাবানোর চেষ্টা। বরঞ্চ সামাজিক জীবনে যেগুলি আমাদের নির্ভরতার জায়গা— সে পিতা-মাতাই হোক, বন্ধু-বান্ধবই হোক, এমনকী বাড়ির কাজের লোক অথবা আয়া-মাসিই হোক— কারণ এঁরা ছাড়া আর কেউ এখন সম্পর্কের মধ্যেই আসেন না— আমি শুধু বলব— এঁদের মধ্যেই অনন্ত নির্ভরতা খুঁজুন, এঁদের প্রতিপালন করুন প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে।

আর্থিক সচ্ছলতার ব্যক্তিগত প্রয়োজন এবং জন্ম-নিয়ন্ত্রণের কারণে পিসি-মাসির সংখ্যাই এখন ভীষণ কম, বিধবা পিসি তো দূরের কথা। বেকার কাকাও বড় অপ্রতুল, বরঞ্চ পরিচয়ের ক্ষেত্রে দাদু-দিদিমা অথবা ঠাকুরমা-ঠাকুরদাদার সংখ্যাই বেশি এখন। সামাজিক নিয়মেই যেখানে একটি বালক-বালিকার জন্য পৃথক প্রকোষ্ঠ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, সেখানে মনের দুঃখ এবং মনের সুখ অভিব্যক্ত করার মানুষ এখন বড় কমে গেছে। তবু এই অবস্থাতেও মানুষকে আমি মানুষের সঙ্গ করতে পরামর্শ দিই— নিজের পরিবারের বাইরের কিছু মানুষ— যাঁদের সঙ্গে পরিচয় এবং অকারণ আলাপচারিতার কথা ভাবুন, তাঁদের পিছনে পয়সা খরচ করেও আত্মীয়তা করুন তাঁদের সঙ্গে। তাঁদের ওপর নির্ভর করুন, আপনার নিজের নির্ভরতা, অর্থাৎ কিনা আপনিও যে নির্ভরযোগ্য, সেটা বোঝান তাঁদের কাছে, আপনি নিজে নেমে আসুন আপন অভিমান মঞ্চ থেকে, নিজের নিভৃত প্রকোষ্ঠ থেকে— এ আমাদের কবির আদেশ— সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন