আগ বাড়িয়ে যেও না বাপু

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

আগ বাড়িয়ে যেও না বাপু

জীবন যেমন করে বয়ে চলে তার মধ্যে বহুতর মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। কেউ উৎসাহী, কেউ প্রতিবাদী, কেউ ভীরু, আবার কেউ বা সুযোগ-সন্ধানী। যাঁরা প্রতিবাদী অথবা উৎসাহী— অন্য মানুষের স্বাধিকার, পীড়ন, প্রয়োজন নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁদেরকে অনেক দাম দিতে হয়। নিজের সময়, সুযোগ, সুখ, অর্থ এমনকী জীবনের বিনিময়েও তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যান। যাঁরা ভীরু তাঁরা নিজের বাঁচার তাগিদে আর অন্য কোনও ঝুঁকি নেন না। আর আছেন সুযোগসন্ধানী, তাঁর প্রতিবাদে সুর মেলান, সবার শেষে মুখ দেখান, সই করেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে লিপ্ত হন না এবং নিজের কোনও অসুবিধে না করে কাম্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।

আমার জীবনে একটা ঘটনায় দেখেছিলাম— এক জায়গায় জমি নিয়ে গণ্ডগোল চলছিল। একটা বিশাল জমি, যেখানে বিভিন্ন লোক ছোট ছোট ‘প্লট’ কিনেছিলেন ২-কাঠার অথবা ৪-কাঠার। সেই বিশাল ফাঁকা জমিটা একদিন বেদখল হয়ে গেল। কৃষক-সমিতি, মৎসজীবী সমিতি, আরও অনেকরকম সমিতি সেখানে বসে গেল তাদের বিভিন্ন দাবির ইস্তেহার নিয়ে। জমি বেদখল হবার পর ছোট ছোট প্লট হোল্ডারদের মিটিং বসতে লাগল দফায় দফায়, মাসে-মাসে। দিন, মাস, বছর অনেক চলে গেল, মিটিং-ও অনেক হল ইতিকর্তব্যতা বিষয়ে। সেইসব মিটিংয়ে দু-চার জন লোক প্রায় নিয়মিত অনুপস্থিত থাকতেন, কখনও সখনও যদি বা তাঁরা মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন, তখন তাঁরা প্রচুর বক্তৃতা দিতেন এবং উপস্থিত জনের দোষ ধরতেন। অনিয়মিত ব্যক্তির মুখে এমন মুখর দোষদর্শন নিয়মিত উপস্থিতদের পছন্দ হত না। তাঁরা ঝগড়া করে বললেন— আপনারা মিটিংয়েও আসবেন না, আবার বড় বড় কথাও বলবেন। এমন দোষারোপ শুনে একজন শেষপর্যন্ত মুক্ত মনে বলেই ফেললেন— দেখুন! সব সময় আমার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। আমার কাজ আছে। আর মনে রাখবেন— আপনারা সবাই যদি জমি পান, তাহলে আমিও পাব। ভারতবর্ষ যদি স্বাধীনতা লাভ করে, তবে মালদা-ও স্বাধীনতা পাবে। অতএব থামুন মশাই। আমি চললাম।

এবারে মনে হল সেই সংস্কৃত নীতিশাস্ত্রের কথা— যে নীতিশাস্ত্র সোজাসুজি সবসময় একজনকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে না। কখনও বা সার্বিক একটা উপদেশের মাধ্যমে সেই সব মানুষের কথা তির্যকভাবে বলে, যারা অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে নিজের ভোগটুকু ঠিক গ্রহণ করে নেন। শ্লোক বলেছে— দ্যাখো বাপু! এক দঙ্গল মানুষের মধ্যে যদি থাকো, তবে সবার সামনে দাঁড়িয়ে কখনও প্রতিবাদী হতে যেয়ো না। কেননা, একটা কথা সবসময় মনে রেখো যে, কাজ যদি হয়ে যায়, তবে ফলটা সবাই একইরকম পাবে—

ন গনস্যাগ্রতো গচ্ছেৎ সিদ্ধে কার্যে সমং ফলম।

এখানে উপদেশটা এমনভাবেই দেওয়া হয়েছে, যাতে দুনিয়ার তামাম সুবিধেবাদী লোকেরা সচেতন হয়, যাতে তারা আরও সুযোগ নিতে পারে। কথাটা যে মিথ্যে নয়, সেটারও খুব বাস্তব প্রমাণ আছে। রাজনৈতিক প্রতিরোধের মধ্যে যদি গণতান্ত্রিকতা না থাকে, তাহলে মিটিং-মিছিলের সামনে যারা থাকেন, তাঁরাই বিপদের সামনে পড়েন। মারমুখী পুলিশের প্রথম মার-গুলি তাঁদের ওপরেই এসে পড়ে। এমনকী মিটিং-মিছিল না হয়ে যদি অনেকগুলি মানুষের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় কোনও সংগঠিত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে, এবং কর্তৃপক্ষের যদি শক্তি বেশি থাকে, তাহলে অতি প্রতিবাদী ব্যক্তির ওপর নানা বিপদ নেমে আসতে পারে। সংস্কৃত নীতিশ্লোক সে কথা মনে রেখে বলেছে— দঙ্গলের সামনে কখনও যেয়ো না বাপু। যদি কোনওভাবে অপরপক্ষকে প্রভাবিত না করা যায় এবং তার ফলে যদি কোনও বিপত্তি হয়, তখন যে লোকটা সামনে থেকে বেশি কথা বলেছে, সে-ই সবার আগে মার খায় বা তাকে মারা হয়— যদি কার্যবিপত্তিঃ স্যাৎ মুখরস্তত্র হন্যতে।

কথাটা সেই জায়গাতেই আসে। অর্থাৎ সেইসব সুযোগসন্ধানীদের উদ্দেশই এই নীতিশ্লোক রচিত হয়েছে, যারা ভাবেন— ভারতবর্ষ যদি স্বাধীন হয়, তবে মালদাও স্বাধীন হবে। তবে এই শ্লোকের উদ্দেশ্য— সুযোগসন্ধানীদের চরিত্র অনুকরণ করা নয়, বরঞ্চ উদ্দেশ্য হল, সুযোগসন্ধানীদের চরিত্র বিশ্লেষণ করা এবং তা অবশ্যই তির্যকভাবে।

প্রসঙ্গটাকে যদি একটু অন্যরকম এবং কাব্যিক করে তোলা যায়, তবে অসাধারণ একটা পদাবলীর কথা মনে পড়ে। পদাবলীটি বলরাম দাসের লেখা। যদিও এই পদাবলীর আরও একটা সংস্করণ আমি দেখেছি এবং সেটাই এই ভাবনায় প্রথম লিখিত পদাবলী কিনা, সেই গবেষণা আমার মনে নেই। তবে এটা বলতে পারি যে আমার পূর্ব দৃষ্ট পদাবলীটিই বেশি মধুর। পদাবলীর আরম্ভটি ছিল এইরকম। কিশোর বয়সে কৃষ্ণ তাঁর রাখাল বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এবং গোচারণের ধেনু নিয়ে গোষ্ঠ বিহারে যাচ্ছেন এবং জননী যশোমতী পুত্রস্নেহের অধিক্যবশত কৃষ্ণের এই গোচারণ ব্যাপারটাকে বড্ড সাহসের কাজ বলে মনে করেছেন। কিন্তু কৃষ্ণ যখন যাবেনই, তাই অনেকগুলি সাবধানবাণী আছে তাঁর সামনে এবং বালক কৃষ্ণের উদ্দেশে এই ‘সাবধান’ উচ্চারণ করছেন জননী যশোমতী।

যশোমতী বলছেন— আমার মাথার দিব্যি রইল, কৃষ্ণ! তুমি যাবার সময় কখনও গোরুগুলির সামনে দিয়ে চলাফেরা করবে না— গোরু নিয়ে যাবার সময় গোরুর কাছাকাছিই থাকতে হবে বটে, কিন্তু তুমি তোমার মোহন বাঁশিটি বাজাতে থাকবে, আমি ঘরে বসেও যেন সেটা শুনতে পাই। তাতে বুঝব— তুমি ঠিক আছ—

আমার শপথি লাগে না যাইও ধেনু আগে
 পরানের পরান নীলমণি!
নিকটে রাখিও ধেনু পুরিও মোহন বেণু
 ঘরে বসি আমি যেন শুনি।

এইভাবে সেই সাংঘাতিক কথাটা। কথাটা অবশ্য মায়ের দিক থেকে একরকম, আমাদের দিক থেকে আরেক রকম। বর্তমান প্রস্তাবে আমরা আমাদের দিক থেকেই দেখব অবশ্য। ভাবুন একবার, যশোমতী বলেছেন— গোপাল আমার। তুমি কিছু বেশি উৎসাহে সবার আগে আগে যাবে না। সবার আগে যাবে তোমার দাদা বলরাম। আর সমস্ত রাখাল-বালকেরা থাকবে বলরামের বাম-ভাগে। আবার সকলের পিছনেও তুমি যাবে না। সবার পিছনে থাকবে তোমার সব বন্ধুরা— শ্রীদাম, সুদাম, দাম, বসুধাম— এরা সব। আর তুমি থাকবে ঠিক মাঝখানে। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, জননী যশোমতী কংসরাজার ভয় পান। যেখানে সেখানে কংসরাজার গুপ্ত ঘাতকেরা অঘাসুর, বকাসুরের রূপে কৃষ্ণকে মেরে ফেলার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে, অতএব ভয়টা খুব অমূলকও নয়। জননীর স্নেহ তাই চায় যাতে কৃষ্ণের কোনও ক্ষতি না হয়, বালক কৃষ্ণকে জীবিত রাখার জন্য তাঁর অমূল্য নির্দেশ—

বলাই ধাইবে আগে আর শিশু বাম ভাগে
 শ্রীদাম-সুদাম সব পাছে।
তুমি তার মাঝে যাইও সঙ্গ ছাড়া না হইও
 মাঠে বড়ো রিপুভয় আছে।

আমরা জননী হিসেবে যশোমতীর ভয়টুকু বুঝতে পারি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও তো ভাবতে হবে যে, পরম বাৎসল্য রসে জননীর হৃদয় যতই জারিত হোক, জননী হিসেবে তিনি কিন্তু আর কোনও বালকের কথা ভাবলেন না। কৃষ্ণ-জ্যেষ্ঠ বলরাম কিন্তু কৃষ্ণের মতোই বসুদেবের অন্যতর পুত্র, রোহিণীর গর্ভজাত, এই যা। তবে তিনিও বৃন্দাবনেই থাকেন এবং কৃষ্ণের মতো তিনিও মানুষ হচ্ছেন নন্দরাজার আশ্রয়েই। যশোমতী হয়তো দেবকী-বসুদেবের সব খবর রাখেন না, কিম্বা অতিরিক্ত পুত্র-বাৎসল্যে কোনও খবর রাখতে চান না। কিন্তু এটা কেমন হল! অত্যন্ত স্বার্থপরের মতো কাজ হল না কি? উদ্যত এবং লম্ফমান ধেনুগুলির আকস্মিক পশ্চাদ-পদের চাট খাওয়ার জন্য বলরাম আগে আগে যাবেন, অন্য শিশুরা বাঁ দিক থেকে কৃষ্ণকে সুরক্ষা দেবে, আর শ্রীদাম-সুদাম সব পাছে। একেবারে মধ্যমণি হলেন কৃষ্ণ। আসলে পুত্র বাৎসল্যেই হোক অথবা অন্য কোনও কারণে— জননী যশোমতী এই নীতিশাস্ত্রীয় কথাটি সার বুঝেছিলেন যে, সবার আগে আগে, আগ বাড়িয়ে যেও না বাপু! কার্য যদি সিদ্ধ হবার হয় তাহলে সকলে একই ফল পাবে। কিন্তু কাজ যদি না হয়, কিম্বা যদি দুর্ঘটনার সামনে পড়ো, তাহলে সামনে যে আছে, যে বাধা দিচ্ছে, যে বেশি কথা বলছে, সে-ই প্রথম মারটা খাবে।

এই নীতিশাস্ত্রের কথাটা যশোমতীর মনের ভাবের সঙ্গে সর্বাংশে মেলে না, কিন্তু নিজেকে বা স্নেহেরজনকে সকল ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এই নীতিশাস্ত্র যে একাংশে কাজ করছে, তা বলাই বাহুল্য। তবে সকলের হয়ে কথা বলতে গিয়ে, সকলের আগে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত ভদ্র প্রতিবাদ করতে গিয়ে সর্বশেষে বেদম মার খাওয়ার ঘটনা আমার নিজের জীবনেই এমন সত্য হয়ে এসেছিল যে, এই নীতিবাক্য যদি তখন আক্ষরিক অর্থে স্বার্থপরের মতোই বুঝতাম, তাহলে হয়তো আর মার খেতে হত না, চিরকাল গা বাঁচিয়েই চলতে পারতাম। তবে হ্যাঁ, পরিস্থিতি, সময় এবং পাত্র একটা ব্যাপার বটে, যা সব সময় বোঝা যায় না এবং তারই ফলে বিপদ ঘটে মানুষের। আমারও হয়তো তাই ঘটেছিল। ঘটনাটা একটু খুলে না বললে পরবর্তী নীতিশাস্ত্রীয় শ্লোকটাও বোঝাতে পারব না।

১৯৭৬ সাল, আমি তখন নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াই। উইকএন্ড-এ বাড়ি ফিরছি। ট্রেন দেরিতে চলছিল এবং হাওড়াগামী নলহাটি প্যাসেঞ্জার ছ’টায় এসে বাঁশবেড়িয়া স্টেশনে দাঁড়াল। আর একটা স্টেশন গেলেই ব্যান্ডেল এবং তখন এই কয়লার ট্রেন ডিজেলে পরিণত হবে, তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে হাওড়ায়। কিন্তু সেই যে ট্রেন এসে থামল সন্ধে ছ’টায়, আর নড়ে না। ওদিক আপ-লাইনে একটার পর একটা ট্রেন চলে যাচ্ছে, যাত্রীরা হাসিমুখে চলে যাচ্ছেন। আমরা বসে আছি তো বসেই আছি। আপ ট্রেনের এই ক্রিয়া কুশলতা নিয়ে প্রশ্ন করল সহগামী যাত্রীরা বলছেন— অফিস যাত্রীরা ফিরছে, ওদের আটকাবে না, ওদের ঘাঁটাবে না কেউ। এমনই বসে থাকতে থাকতে নানা কথা শুনতে শুনতে রাত্রি আটটা বাজল। যাত্রীরা অনেকেই স্টেশন মাস্টারের কাছে খবর নিতে যাচ্ছেন, নানা খবর আনছেন, আমরা শুনছি। রাত্রি ন’টা বাজল। এর পরে কখন ট্রেন ব্যান্ডেল পৌঁছবে, সিংগল লাইনে কখন আমাদের সুযোগ আসবে, আর কখনই বা বাড়ি পৌঁছব। হাওড়া স্টেশনে বাসও বন্ধ হয়ে যাবে তখন। আসন্ন ভবিষ্যৎ-সুরাহার জন্য আমরা জনা কতক লোক লাইন পেরিয়ে স্টেশন-মাস্টারের ঘরের দিকে রওনা হলাম সরেজমিনে ব্যাপারটা বুঝতে। যেতে যেতে আর একটা বড় দলের সঙ্গে আমাদের দেখা হল। আমরা একসঙ্গে গেলাম স্টেশন-মাস্টারের ঘরের দিকে। স্টেশনের নাম বাঁশবেড়িয়া।

গিয়ে দেখলাম— অন্য আরও লোক সেখানে কথা বলছে। আমরা যেতে দলটা আরও বড় হল। সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদের পর্যায় থেকে কথা তখন উচ্চগ্রামে উঠছে, কেউ কেউ অনর্থক চেঁচাচ্ছেন, কারও কথাই ভালো করে শোনা যাচ্ছে না, দু-একজন স্টেশন-মাস্টারের টেবিলে ঘুষি থাবড়া মারছেন, যেন সেগুলি স্টেশন-মাস্টারের মাথাতেই মারা হচ্ছে। অন্তত স্টেশন-মাস্টার তেমনটাই বুঝলেন বোধহয়। আসলে এই বোঝাবুঝি, কথা-কাটাকাটি সহস্ততাল বিক্ষোভ-প্রদর্শন অনেকক্ষণ ধরেই চলেছে এবং নিরুপায় স্টেশন-মাস্টারের ধৈর্য অনেকক্ষণ আগেই চলে গিয়েছে। আমি অনেকক্ষণ এই চিৎকার-চেঁচামেচি শোনার পর একটা বৃহৎ গর্জন করে সকলকে থামানোর চেষ্টা করলাম। শব্দ একটু শান্ত হতেই স্টেশন-মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করলাম— আসল ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবেন? ঘটনাটা ঠিক কী, আমরা কখন মুক্তি পাব? নম্র গলা শুনে বুদ্ধিমান স্টেশন-মাস্টার এবার নিজের গলা চড়ালেন এবং হঠাৎই দেখলাম— কিছু গুন্ডা-ধরনের লোক বাঁশবেড়িয়ার বিখ্যাত বাঁশ নিয়ে সমবেত জনতাকে তাড়া করছে। সকলে এধার-উধার পালাচ্ছে এবং মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম সকলেই প্রায় উধাও এবং আমি বেশ দেরি করেই হতচকিতভাবে ছোটার চেষ্টা করছি। মারমুখী বাঁশ-ধারীরা শেষ বোধহয় আমাকেই কথা বলতে দেখেছে— সে কী বলতে চাইছিল সে কেমন লোক— এ-সব তাদের বিচারের মধ্যে আসে না। তারা আমাকেই শেষ কথা বলতে দেখেছে, অতএব এলোপাথারি বাঁশের বাড়ি পড়তে লাগল আমার ওপর। তখনই আপ-লাইনে ট্রেন আসছিল, দু-চারজন এমনও একটা চেষ্টা নিল, যাতে ট্রেনের তলায় আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায়। এমতাবস্থায় এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। আমাদের ট্রেনের যিনি ‘গার্ড’, তিনি প্রায় কোথা থেকে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং উদ্যত বংশীধারীদের দু-একটা বাঁশের বাড়ি বোধহয় সহ্যও করলেন। গার্ড-সাহেবের গায়ে রেলের ইউনিফর্ম ছিল, তিনি আমাকে যথাসম্ভব আড়াল করে চেঁচাতে লাগলেন— ওরে কাকে মারছিস তোরা? ইনি কলেজে পড়ান, ইনি এমন কিছু করতে পারেন না, যাতে এইভাবে মারা যায়। মারমুখোরা থামল এবং যাবার সময় বলে গেল— আমরা কী জানি, ওকেই যে শেষ কথা বলতে শুনেছি।

গার্ড সাহেব আমাকে ধরে নিয়ে এসে গার্ডের ঘরেই বসালেন, যথাসম্ভব সান্ত্বনা দিলেন এবং বললেন— এইসব গুন্ডারা রাত বিরেতে নানা অপকর্মের প্রশ্রয় পায় স্টেশন-মাস্টারের কাছ থেকে, বিনিময়ে স্টেশন-মাস্টারের বিপদ হলে এরা ঝাঁপিয়ে পড়ে, প্রশ্রয়ের প্রতিদান হয়। সর্বশেষে গার্ডবাবু আমাকে যথেষ্ট সমাদর করেও শেষ কথা বললেন— আপনি স্যার, ওখানে না গেলেই ভালো করতেন, এসব জায়গায় কথা বলে কোনও লাভ নেই। বরঞ্চ যারা গলা ফাটাচ্ছিল, আর টেবিল চাপড়াচ্ছিল, তারা দেখুন— সময়মতো ঠিক পালিয়ে গেছে। মাঝখান থেকে আপনার মতো লোকের গায়ে বাঁশের বাড়ি পড়ল, আপনাকে ওরা লাইনে ফেলে দিতে চাইছিল। আমি সময়মতো না এসে গেলে…!

বাস্তবিক গার্ড-সাহেব আমার প্রাণদাতা। ওঁর সমস্ত কথা এবং সেদিনকার সমস্ত পরিস্থিতি পরে অনেকবার রোমন্থন করেছি, তাতে ওই সংস্কৃত নীতিবাক্যের কথাই প্রথমত মনে পড়েছে— দলের মধ্যে সবার সামনে গিয়ে কথা বলতে যেয়ো না বাপু! ঝামেলা হলে সবার আগে তুমিই মরবে। কথাটা একদিকে ঠিক, কিন্তু তার পরেও অনেক ভেবেছি— কেন এমন হল? ঝামেলা হলে, অন্যায় হলে, বিপত্তি আসলে মানুষ তো প্রতিবাদ করবেই। কিন্তু এটাও বোধহয় ঠিক যে, সেই প্রতিবাদেরও সময় আছে, পাত্র আছে এবং আছে অপরিহার্য পরিস্থিতি। ‘অপরিহার্য’ বলছি এইজন্য যে, ট্রেন-লাইন তো বাস রাস্তা নয়, স্টেশন-মাস্টারকে সামগ্রিক পরিস্থিতি বুঝেই ‘সিগন্যাল’ দিতে হবে। বিশেষত আমি যে পরিস্থিতিতে গিয়ে সামান্য মুখর হয়েছিলাম, সেই প্রচেষ্টাটাই বৃথা ছিল, আমার না যাওয়াটাই সমুচিত ছিল। নতুন একটা নীতি শ্লোক মনে পড়ল। ভারি সুন্দর শ্লোক এবং শ্লোকের মর্মে আছে সেই সার্বিক দৃষ্টি— কোন কোন অবস্থায় অথবা কী কী করলে মানুষের মহান বৃত্তি বা গুণগুলি নষ্ট হয়ে যায়। আমি মহান নই, মহান গুণও আমার মধ্যে নেই, কিন্তু যে-কোনও মানুষের ভিতরে যে ধৈর্যটুকু থাকে, সেই ধৈর্যটুকু তো নিজের বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ করেই রাখা যেত, আমি তাও পারিনি। কেন পারিনি, সেইজন্যই এই শ্লোকোচ্চারণ।

কার্পণ্যেন যশঃ ক্রুধা গুণচয়ো দম্ভেন সত্যং ক্ষুধা
মর্যাদা ব্যসনৈর্ধনং চ বিপদা স্থৈর্যং প্রমাদৈ-দ্বির্জঃ।
পৈশুন্যেন কুলং মদেন বিনয়ো দুশ্চেষ্টয়া পৌরুষং
দারিদ্র্যেণ জনাদরো মমতয়া চাত্মপ্রকাশো হতঃ।।

ক্রান্তদর্শী কবি তাঁর স্বরচিত শ্লোকে লিখেছেন, এক-একটি কারণে মানুষের এক-একটি সদগুণ নষ্ট হয়ে যায়। যেমন, কৃপণতায় যশ নষ্ট হয়, ক্রোধে নষ্ট হয় মানুষের সদগুণ, দম্ভ-অহংকারে মানুষের সত্যনিষ্ঠা নষ্ট হয়, ক্ষুধার তাড়নায় নষ্ট হয় আত্মমর্যাদা। বিপদ আসলে মানুষের স্থিরতার বিনাশ ঘটে। বিলাস-ব্যসনে উড়ে যায় টাকা-পয়সা। অন্যায় আচরণ আর অনবধানে ব্রাহ্মণের চরিত্র নষ্ট হয়। আত্মীয়-স্বজনের অকারণ দোষ আবিষ্কার করতে করতে আত্মীয় পরিজন দূরে সরে যায়, ঐশ্বর্যের অহংকারে সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলির শাসন শিথিল হয়ে যায়। আর অস্থানে, অজায়গায় পৌরুষ দেখাতে গেলে সে পৌরুষ যে কেমন বিফলে যায়, এমনকী তা কী রকম অনর্থও ডেকে আনে, আমার সেই বাঁশবেড়িয়ায় মার খাওয়ার ঘটনাই তার প্রমাণ। শেষ পংক্তিতে কবি বলেছেন— মানুষ যদি দরিদ্র হয়, তাহলে লোকসমাজে তার আদরটুকুই হারিয়ে যায়, আর পিতা-মাতার অতিরিক্ত মমতায় সন্তানের ব্যক্তিত্বই প্রকাশিত হয় না ঠিকমতো। তার মানে মমতায় ব্যাহত হয় মানুষের আত্মপ্রকাশ।

এই সম্পূর্ণ শ্লোকটির মর্ম যদি আমার চর্চা থাকত তাহলে সেদিন বাঁশবেড়িয়ার মার থেকে ঠিক বেঁচে ফিরতাম।  

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন