বনমাঝে কী মনোমাঝে

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

বৃন্দাবন মানে চরম-এর আস্বাদন, পরম-এর সংগ্রহণ। চরম-এর আস্বাদন গ্রহণ করতে হলে নিজেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে নিয়ে বসতে হয় দ্রষ্টার আসনে; উপভোক্তার উৎসুক হৃদয়-কমল সেখানে বিছিয়ে রাখতে হয়— কখন মধুকর আসে নেচে-নেচে— বনমাঝে কী মনোমাঝে, কখন কমলকলির বুক চিরে মধু খায় এক ফোঁটা, আর রাধাভাব-ভাবিত চৈতন্যের তদগত বাক্য স্ফুরিত হবে— সেই লম্পট আমাদের জোর করে কেমন অবশ করে দিল গো, আমরা দাসী হয়ে গেলাম! কী সাহস গো এই মানুষটার— কেনাপি শঠেন বয়ং হঠেন/ দাসীকৃতা গোপবধূ-বিটেন। আবার যিনি দাসী হলেন, সেই বিনোদিনী রাইকিশোরী এক মুহূর্তে ঠাকুরানী হয়ে ওঠেন বৃন্দাবনে, শক্তি শক্তিমানকে হারিয়ে দেন ভালোবাসার শক্তিতে, রাধারাণী বৃন্দাবনের অধিশ্বরী হয়ে ওঠেন, মনোমোহন কৃষ্ণকে তাঁর পায়ে ধরে সেধে বলতে হয়— আমি দেবতাদের আয়ু পেলেও সারাজীবন তোমার ভালবাসার ধারে কাছেও যেতে পারবো না— না পারয়ে’হং নিরবদ্য সংযুজাং/ স্বসাধুকৃত্যং বিবুধায়ুযাপি বঃ।

এই ভালোবাসার আসন পাতা হয়েছে বৃন্দাবনে, সেও নাকি এক কমলাসন, দিনের বেলায় তার দ্বাদশ দল পাপড়ি খুলে যায় দ্বাদশ বনের লীলাভূমিতে, আর রাতের বেলায় রাধাকৃষ্ণের দুই মূর্তির ঘনিষ্ঠতা বুকের মাঝে নিয়ে সে বুজে যায় লোকচক্ষুর সামনে। তবে কিনা, এই বৃন্দাবনের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল— বৃন্দাবন শুধুমাত্র এক রমণ-রমণীর চরম ভাব-মাহাত্ম্য তৈরি বিলাসভূমিই নয়, ভালোবাসার যত শ্রেষ্ঠ প্রকার আছে তারও শ্রেষ্ঠ মানবী ভূমি এই বৃন্দাবন। কেননা সর্বশক্তির আধার ভগবানকে এখানে নেমে আসতে হয়েছে প্রভুশক্তির সমস্ত মহিমা খণ্ডিত করে, ঈশ্বরের সমস্ত অভিমান ত্যাগ করে তাঁকে প্রবেশ করতে হয়েছে মানুষের ধূসর জগতে। হ্যাঁ, এখানেও তিনি ভগবান বটে, তবে এ-ভগবান তার্কিক-মীমাংসক-বৈদান্তিক দার্শনিক ভগবান নন, এই ভগবানকে হাত দিয়ে যেন স্পর্শ করা যায়, তাঁর সঙ্গে যেন কথা বলা যায়, তাঁকে যেন ডেকে আনা যায় ইশারা করে— বনমাঝে কী মনোমাঝে। ওই যাঁর সম্বন্ধে Pascal বলেছিলেন— God of Abraham, Isaac, Jacob, not of the philosophers and scholars, God who is found only in the ways taught by Gospels.

আমাদের ইঙ্গলস-সাহেব কৃষ্ণের পূর্বজীবনের ভাবনায় হরিবংশ পুরাণকে একটা বড় প্রমাণ ধরে বলেছিলেন যে, এই পৌরাণিক ব্রজভূমিতে আমরা এক ধূসর গ্রাম্য জগতে পৌঁছাই। সত্যি এখানে নাগরক বৃত্তের কোনও মানুষ থাকে না। এখানে নগর-পুরুষের কৃত্রিমতা নেই, নাগরিক সচেতনতা নেই। বৃন্দাবন আসলে ব্রজভূমি— সেকালের দিনে মথুরা নগরে যিনি রাজার উপাধি ধারণ করেছিলেন, সেই অত্যাচারী কংস রাজার গো-প্রজনন কেন্দ্র এবং গোচারণভূমি এটা। সেকালের দিনে সব রাজ্যেই এমন একটা জায়গা থাকত এবং গোচারণ-ক্ষেত্রের সাধারণ নামই ব্রজ, কিন্তু বৃন্দাবন নামের জায়গাটা ব্রজ-নামেই রূঢ় হয়ে উঠল শুধু কৃষ্ণের জন্য। মথুরা নগর থেকে কৃষ্ণ এখানে পরিত্যক্ত হয়েছেন জন্মের পরেই এবং তিনি বড় হয়ে উঠছেন গোপালক-মুখ্য, ব্রজভূমির মোড়ল নন্দগোপের ঘরে। যে গাঁয়ে তিনি থাকেন তার নাম নন্দগাঁও। এখানে কাছেই নীল যমুনা প্রবাহিনী। কিন্তু গ্রাম্য জীবন এখানে গড়ে উঠেছে গোরুকে কেন্দ্র করেই। আমাদের সাহেব বলেছিলেন— নাগরিক কৃত্রিমতার বাইরে এ এক ধূসর জগৎ।

বৃন্দাবন মানেই এখানে হাটে-মাঠে গোপুরীষ, গৃহে-গোঠে গোবর ছরা। দিনের কাজে মেয়েদের ভূমিকা এখানে বড় বেশি, ফলে গোরুর হম্বা রবের সঙ্গে এখানে মেয়েদের কথা-কানাকানি, তাদের দধিমন্থ-শব্দ আর হাসি বড় বেশি চোখে পড়ে এখানে— গোব্রজং গোরুতং রম্যং গোপ-নারীভিরাবৃতম। এখানে পরিবেশটা যেমন অকৃত্রিম, তেমনই মানুষের ভাব-ভালোবাসা-স্নেহও ভীষণ অকৃত্রিম। কৃষ্ণ যে এখানে মানুষ হচ্ছেন গোপবালকের মতো, কিন্তু গাঁয়ের মোড়লের ছেলে বলে তাঁর আদর একটু বেশি। অবশ্য বৃন্দাবনের মেয়েরাও কিছু কম যায় না। তাদের সাজগোজ একটু বেশি ‘লাউড’, একটু বেশি ‘কালারফুল’। তাদের মধ্যে হলুদ-নীল কাপড়ের চলটা যে বেশি, সে কথা পৌরাণিক আগে থেকে বলে রেখেছেন— নীল-পীতাম্বরাভিশ্চ তরুণীভিরলংকৃতম। আমার তো মনে হয়, অতিস্নেহশীলা জননী যশোমতী ছেলের বায়নায় একদিন বোধহয় নিজেরই একখানি হলুদ কাপড় পরিয়ে দিয়েছিলেন ছেলেকে, তাঁর কোলের ছেলের এই হলুদ কাপড়খানিই শেষপর্যন্ত তাঁর ‘কনট্রাস্ট পারসোনালিটি’ তৈরি করেছে, অন্যেরা হাসলেও তিনি রেগে যান না— জয় পীতাম্বর-ধর/ নীল-কলেবর/ বঙ্কিম-সুন্দর/ দেহি পদম।

জননী যশোমতী বড় সরলা রমণী। এতকাল পরে ছেলে কোলে পেড়ে বড় বেশি অত্যাদরা। ছেলের দোষ দেখতে পান না এক ফোঁটা। গোরু চরানোর জন্য শত রাখলের মেলায় যখন তাঁর ছেলেটি গোষ্ঠের পথে রওনা হয়, তখনও পদাবলীর স্বার্থান্বেষিণী কান্না ভেসে আসে— বললাম তোমার দাদা আগে আগে যাবে, ‘আর শিশু বামভাগে’, কিন্তু ‘তুমি তার মাঝে যাইয়ো— অর্থাৎ কিনা অন্যদের যা হয় হোক, গোরুর লাথিই খাক বা অন্য কোনও সমস্যা, কিন্তু তোমার যেন কোনও আঁচ না লাগে। এমন এক জননী কী করে বিশ্বাস করবেন যে, তাঁর কৈশোরগন্ধী ‘মোহনা’ ছেলেটি গোরু চর দেবার পরেই ‘শ্রীদাম-সুদাম-সনে’ খেলায় মেতে ওঠে, তারপর খেলা যখন জমে ওঠে, তখন সে আস্তে আস্তে চলতে থাকে বেতসী লতায় ঘেরা কুঞ্জবনের দিকে— কৃষ্ণদাস কবিরাজের মতো বৈরাগী মানুষ তা দিব্য দেখতে পান, কিন্তু জননী যশোদা দেখতে পান না, অন্যেরাও দেখতে পায় না— কুঞ্জে কুঞ্জে বিহরতি ন কেনাপি সংলক্ষ্যতে’সৌ।

আসলে দেখবেন কী করে যশোদা। এই নন্দগাঁও থেকে গোচারণভূমি পেরিয়ে আরও একটা গ্রাম। এই গ্রামের নাম বর্ষাণা। এখানে বিনোদিনী রাইকিশোরী থাকেন বাবা বৃষভানুর ঘরে। একটু দূরেই উঁচাগাঁও, সেখানে থাকেন রাইকিশোরীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ললিতা। এঁদের সঙ্গে আছে আরও সব তরুণীর দল। এরা সকলে কৃষ্ণকে ভালোবাসে, বিশেষত রাধারানী এই নন্দগ্রামের ছেলেটিকে ভালোবাসে বলেই, তারাও সকলে ভালোবাসে কৃষ্ণকে। দিনের বেলায় যমুনায় জল আনতে যাবার ছলে, সূর্যপূজার ছলে এই সব রমণীরা চলে আসে কুঞ্জে-কুঞ্জে। আর সন্ধ্যাবেলায় এরা আবারও শুদ্ধ বস্ত্র পরে যশোমতীর সঙ্গে দেখা করতে যায়, যেন সারা দিনে কী হয়েছে তারা জানে না। আর যশোমতী জননী তো জানেনই না— কী হয় সেই বনমাঝে কী মনোমাঝে!

এরকমই একটা দিনের কথা খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর অন্তরালে বসে লিখেছিলেন গাথা সপ্তশতীর কবি সাতবাহন হাল। সেদিনও গোপরমণীরা অনেকেই উপস্থিত, কৃষ্ণের বন্ধুরাও সব ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁকে। যশোমতী পরম স্নেহে পায়েস খাওয়াচ্ছেন ছেলেকে। এমন সময়ে নন্দবাবা বুঝি বিয়ের কথা তুলেছিলেন ছেলের। তাতে যশোমতী পরম স্নেহে বলেছিলেন— এখনও আমার দামোদর বালক একেবারে— অজ্জাবি বাল্যে দামোদরেত্তি। রসিক রূপ গোস্বামী লিখছেন— শুধু বালক কেন বলছো? বলো দুগ্ধমুখ বালক। যশোমতীর মুখে এই কথা শুনে— হাল অসামান্য ব্যঞ্জনায় বলেছেন— সমস্ত গোপরমণীরা নাকি ত্যারচা করে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসেছিল। আর রূপ গোস্বামীর নাটকে কৃষ্ণর বন্ধু ভাঁড় বিদূষক মধুমঙ্গল যশোমতীর কথা শুনে গোপরমণীদের দিকেই তাকিয়ে অসভ্যের মতো হেসে বলেছিল— সত্যি তোমার ছেলে দুগ্ধমুখই বটে, কেননা সারাদিনই তো সে গোপরমণীদের…

কৃষ্ণের তীব্র কটাক্ষে থামতে হয়েছিল মধুমঙ্গলকে। তবে কি না এই হল বর্ষাণা, রাধারানীর বিলাসভূমি। ব্রজবাসীরা গান গেয়ে বলে—

চুরাশি ক্রোশ ব্রজভূমি বৃন্দাবনে চারটি গ্রাম কৃষ্ণের একান্ত নিজের জায়গা—

ব্রজ চৌরাসি কোসমে/চার গাঁও নিজ ধাম।
বৃন্দাবন অরু মধুপুরী/বরসানো নন্দগ্রাম।।

বৃন্দাবনের পরিক্রমা-পথে মথুরা একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান বটে, তবে সে শুধু কৃষ্ণের মৌল জন্মভূমির কারণে, আর বৃন্দাবন থেকে কৃষ্ণ মথুরায় পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে, কিন্তু চৈতন্যের রাধাভাবে মথুরা খানিক ঐশ্বর্যভূমি— এখানে কৃষ্ণকে প্রভু বলে মানতে হয়, কংসধ্বংসী ঈশ্বর বলে তাঁকে মান-সম্মান করতে হয় বলে দূরত্ব বজায় রাখতে হয় তাঁর সঙ্গে। কিন্তু বৃন্দাবন এমন নয়, এখানে ভালোবাসার তাগিদে পরম ঈশ্বরকেও গুটিসুটি হয়ে থাকতে হয়। এমনকী মেনে নিতে হয় ভালোবাসার অত্যাচারও— ‘মোর পুত্র মোর সখা মোর প্রাণপতি’। একবার শিশু-কৃষ্ণ মাটি খেয়েছিলেন বলে জননী যশোমতী তাঁকে হাঁ করিয়ে মাটি বার করতে গিয়েছিলেন। সেই সময় নাকি কৃষ্ণের ওপর ভগবত্তার ভর হয় এবং তিনি সেই হাঁ-মুখের মধ্যে বিশ্বরূপ দেখাতে আরম্ভ করেন। যশোমতী কিন্তু সেখানে ভগবানের বদলে ভূত দেখেছিলেন। অপদেবতার এমন আপদ দেখে যশোমতী সেদিন সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে চান করিয়ে, গায়ে-গোবরের জল ছিটিয়ে এমন ভূতাপসরণ মন্ত্র পড়েছিলেন যে, কৃষ্ণের বিভূতিযোগ মাথায় উঠে গিয়েছিল সেদিন। বিশেষত বিশ্বরূপের ভর ভেঙে গোবর-জলের অত্যাচারটুকুই যেহেতু মাতৃ বাৎসল্যের চরমতম অভিধান, তাই এই সরসতাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃন্দাবনকে বৈকুণ্ঠধামের ওপরে তুলে দেয়। এই ঘটনা নিয়ে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সভায় এসে বিশ্বরূপ-দর্শনের মাহাত্ম্য নিয়ে মাথা ঘামান না, বরঞ্চ তির্যক সরসতায় একটা ধাঁধা ছুড়ে দেন সভাকবিদের উদ্দেশ্যে— কবিতা পাদপূরণ করুন দেখি, কবিতার শেষ পঙক্তিতে থাকবে— ‘বরষি গিলিছে যেন চাঁদে’। মাছ-খাওয়া বাঙালি ধুরন্ধর স্বভাবকবি দাশরথি রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন—

একদিন শ্রীহরি/ মৃত্তিকা-ভক্ষণ করি/ ভূমিতে পড়িয়া বড় কাঁদে।
রাণী অঙ্গুলি হেলায় ধীরে/ মৃত্তিকা বাহির করে/ ‘বরষি গিলিছে যেন চাঁদে।’।।

এই যশোমতীর বৃন্দাবন। এখনও চৌরাশী ব্রজপরিক্রমার সময় গোকুলে গেলে নন্দবাবার সেই ঘরখানা ব্রজবাসীরা দেখাবে— এখানে যশোমতী বসতেন, এই সেই দোলনা-ঠেলার রুপোর দড়ি, আর ওই যে মন্দির দেখছেন, ওখানে যশোমতীর মাখন তোলার ভ্রমিদণ্ডটি রাখা আছে, একবার স্পর্শ করুন। হয়তো তর্ক আসবে এখানে, যুক্তি কাজ করবে লৌকিক তাড়নায়, কিন্তু এটা তো বিশ্বাসের জায়গা, এখানে বহুদূর থেকে স্বপ্নলোকের গান ভেসে আসে— যমুনে, তুমি কি সেই যমুনে, প্রবাহিনী! আসলে স্বর্গের উচ্চতাকে মাটিতে এনে ফেলা, কিংবা ঈশ্বরতত্বের ভূমিকাটাকে লঘু করে মানুষের গণ্ডীর করে নিয়ে আসার কাজটা কৃষ্ণই করে দিয়েছিলেন। চলুন একবার গিরিরাজ গোবর্ধনে— একখানা ছোট্ট খুদে পাহাড়। অথচ বিশ্বাসের পরম ঐশ্বর্য ধারণ করে এখনও কী বিরাট সেই প্রস্তরী প্রতিমা। এখানে দাঁড়িয়েই কৃষ্ণ বলেছিলেন— বন্ধ করো আমার গয়লা-ভাইরা সব! বন্ধ করো সেই স্বর্গলোকের দূর-দেবতার পূজা। আজ থেকে আর ইন্দ্রপূজা হবে না এখানে।

এই আদেশ ধ্বনির মধ্যে পূর্বাগত পরম্পরার ভয় থাকে। গোপবৃদ্ধরা বলেছিলেন— বোলো না এসব কথা। ইন্দ্র-ভগবান রাগ করবেন, বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে। এর উত্তরে কৃষ্ণের বক্তব্য ছিল সাম্যবাদের অধিক। কৃষ্ণ বলেছিলেন— দ্যাখো বুড়ো! আমরা বৃন্দাবনের বনবাসী মানুষ, গোরুর ওপরেই আমরা জীবন-জীবিকা নির্বাহ করি। অতএব গোরুই আমাদের দেবতা, এই পাহাড় আমাদের দেবতা। এই বনই আমাদের দেবতা— গাবো’স্মদদৈবতং বিদ্ধি গিরয়শ্চ বনানি চ। কৃষ্ণ আরও বললেন বৃহত্তর জীবনের কথা। বললেন— যারা কৃষক তাদের কাছে কৃষিকর্মই সব, যারা ব্যবসা করে তাদের কাছে পণ্যই সব, আমাদের কাছেও তেমনই গোরুই সব। যার যেটা বিদ্যা, সেই বিদ্যাই তার কাছে দেবতা— বিদ্যয়া যো যয়া যুক্তস্তস্য সা দৈবতং পরম।

কৃষ্ণের কথাটা এতটা লৌকিক যুক্তিবাদে প্রতিষ্ঠিত হয় বলেই গোপ্রজননের ব্রজভূমি বৃন্দাবনে গো-বর্ধন গিরিরাজের এত কদর। কৃষ্ণ স্বয়ং গোবর্ধন গিরিরাজের প্রতিমা হয়ে গেছেন। ব্রাহ্মণ্য-বৃত্তের বাইরে যাঁরা শালগ্রাম-শিলা স্পর্শও করতে পারেন না, তাঁরা অষ্টকোশী গোবর্ধন পরিক্রমা করে গিরিরাজ গোবর্ধনের ভগ্নাংশ একটি শিলীভূত কৃষ্ণ-প্রস্তর হাতে নিয়ে, তাঁকে এক টুকরো হলুদ কাপড় জড়িয়ে নেন, তারপর দূর-দূরান্তের প্রদেশে আসেন নিজের ঘরে, কৃষ্ণ তাঁর অভিন্ন মূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত হন ভক্তের হৃদয়ে— গিরিরাজ-কিশোর।

তাও তো বৃন্দাবনের পরিক্রমায় আমরা বংশীবটে গেলামই না, স্পর্শ করতে পারলাম না শ্যামল কিশোর আর বিনোদিনী রাইকিশোরীর প্রেমভূমি। বৃন্দাবনের একটা উৎসবের ধারে-কাছে যেতে পারলাম না— না কৃষ্ণজন্মাষ্টমী, না রাসস্থলীর রজঃস্নান, না হোলি! কিন্তু এই তো সেই দিন আসছে, যখন আবিরে-গোলালে রাঙা হয়ে উঠবে বৃন্দাবনের আকাশ; বর্ষাণায় শ্রীজির মন্দির থেকে রাধারাণীর মূর্তি সেদিন প্রাঙ্গণে এসে বসবে, যেন তিনি দেখবেন— নন্দগাঁও থেকে কৃষ্ণ আর সহযোগী পুরুষরা রঙ-পিচকারী হাতে আসবে, আর বর্ষাণা থেকে বেরোবে ললিতা-বিশাখা, রূপমঞ্জরী-অনঙ্গমঞ্জরীর দল, আর রাইকিশোরী নিজে বেরোবেন— অরুণ উরনী মাথে/ রঙ্গ-পিচকারী হাতে— তারপর কী খেলা হবে শুরু—

ইত-তে নিকসে কুঁয়ার-কনহাইয়া ইত বৃষভানুকুঁয়ারি

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন