নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
বাসের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হচ্ছিল। যেমন সামান্য বিষয় নিয়ে ট্রেনে-বাসে উত্তুঙ্গ ঝগড়া হয়, তেমনই। একজন সগর্বে হুংকারে বলছিলেন— আমি মিথ্যে বলিনি, মিথ্যে বলছেন আপনি। প্রত্যুত্তরী মানুষটি আরও স্ফীত-স্বরে বললেন— আমি জীবনে মিথ্যা কথা বলিনি, এখনও বলছি না— আপনি জুতোর ডগা দিয়ে আমার পা মাড়িয়ে দিয়েছেন। বাদীপক্ষ বললেন— এটাই তো সবচেয়ে বড়ো মিথ্যে, আমি আজ জুতো পরিইনি, তো জুতোর ডগা কোথায় পেলেন? অন্যজন বললেন— জুতো দিয়ে মাড়াননি, স্যান্ডেল দিয়ে মাড়িয়েছেন। ব্যাপারটা একই। প্রতিবাদী বললেন— কি করে ব্যাপারটা এক হল? আগে বললেন ‘জুতো’, এখন বলছেন ‘স্যান্ডেল’। এটা মিথ্যে নয়? কী আমার ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির এলেন রে। জুতো নয় স্যান্ডেল। এবারে তৃতীয় একজন ধর্মসংস্থাপনার্থায় এগিয়ে এসে প্রলেপ দিয়ে বললেন— জুতো হোক, স্যান্ডেল হোক, একজনের একটু লেগেছে, আপনি ‘সরি’ বললেই তো মিটে যায়। অন্যতর চতুর্থ জন এবার যথাসম্ভব উঁচু হয়ে দেখলেন— এভাবে ‘ধর্ম-সংস্থাপন’ সম্ভব নয়, দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনার্থে তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন— কী বললেন, ‘সরি’ বলতে হবে! এটা আজকাল একটা ‘স্টাইল’ হয়েছে, মশাই। আপনি আমার পোঁদে লাথিটা মেরে দিলেন, তারপর বললেন ‘সরি’।
এই ঝগড়াটা আরও অনেকক্ষণ চলতে পারত। কিন্তু শেয়ালদা স্টেশন এমনই এক নির্বিকার অথচ সচল জীবনের প্রান্তভাগ, যা এই ধরনের সমস্ত ঝগড়া সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়, আবার পরের দিনের অন্যতর এক বিবাদের সম্ভাবনা অন্তর্জাত করে রাখে। হেথা নয়, অন্য কোনওখানে।
এ-রকম ঘটনা রোজ ঘটে, অথচ সত্যের একটা সক্রোধ অন্বেষণ থেকেই যায় ঐ সব ক্ষেত্রে, সর্বত্র; আর আমার মন্দকথার ভাবনালোকে এই প্রশ্নটা অহরহ তৈরি হতে থাকে— সত্য ব্যাপারটা কোথাও কোথাও সত্যিই বড় নির্মমভাবে রক্ষা করার ব্যাপার থাকে— কিন্তু কোথাও কোথাও সত্য ব্যাপারটা সমাজ সংসার এবং রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এতটাই আপেক্ষিক হয়ে ওঠে যে, সেখানে মিথ্যে বলাটাই সবচেয়ে বেশি কাম্য হয়ে ওঠে। আমার মনে আছে— যৌবনের সন্ধিকালে আমার এক বন্ধুকে জনৈকা রমণী সোৎসাহে ভীষণ ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছিল। রমণী সুন্দরী ছিলেন না, বরঞ্চ ন্যূনাধিক কুৎসিতই বটে, কিন্তু তাহার হৃদয় ছিল, যৌবনোদ্ধত মন ছিল এবং হৃদয়ে বলিবার মতো কবিতা ছিল, শক্তিও ছিল। কিন্তু আমার বন্ধু ছা-পোষা উন্নতিকামী। সুন্দরী স্ত্রী, দেখনদারি সাহচর্য এবং ধনে-মানে নির্বোধ জীবন কাটানো ছাড়া সে আর কিছু ভাবত না। ফলে সে সেই অসাধারণী তথাকথিতাকে প্রত্যাখ্যান করল, কিন্তু সোজাসুজি নয়, প্রত্যাখ্যান ঘটল আমার কাছে এবং আমাকেই সে সংবাদ পৌঁছে দিতে হবে তার কাছে।
বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এইক্ষেত্রে সত্য বলাটা আমার কাছে ভীষণই অবজ্ঞেয় মনে হয়েছিল এবং আমি সেই মেয়েটির কাছে আমার বন্ধুর সম্বন্ধে এমন চরম বিশ্বাসযোগ্য চরম মিথ্যা কথা বললাম, যাতে তার মনটা এক্কেবারে উঠে গেল। খবর আছে আমার কাছে— সে রমণী এখন বেশ ভালো আছে, তার স্বামী তাকে যথেষ্টই ভালোবাসে।
রাজার জন্য যেমন রানি আছে, কানার জন্য তেমনই কানী আছে। বরঞ্চ আমার সেই পুরুষ বন্ধুই সৌন্দর্য আর বিপনণের অতিমাত্রায় কেমন যেন বিষণ্ণ এখন। ভাগ্যিস সেদিন মিথ্যে বলেছিলাম। এটা কি মিথ্যে বলার উপকার?
শুনি নাকি গ্রীক-দার্শনিক অ্যারিস্টটলকে এক ব্যক্তি শুধিয়েছিলেন— ‘মহাশয়। মিথ্যা-কথনের উপকার কী? অ্যারিস্টটল নাকি চটজলদি জবাব দিয়েছিলেন— ‘মিথ্যা কথনের উপকার এই যে, সত্য বলিলেও লোকে বিশ্বাস করে না।’ অত বড় দার্শনিক, সমাজকে যিনি ভালো করে তুলতে চান শুধুমাত্র ভালো সামাজিক প্রসব করার জন্য, তিনি কিন্তু আমাদের মিথ্যা-বিষয়িণী ধর্মযুক্তি শুনলে মুচ্ছো যেতেন। তাঁকে নিয়ে সমস্যা এই যে, তিনি দর্শনের মহাকূটের মধ্যে জীবনটাকেও বলি দিয়ে দেন। কিন্তু বাস্তবের চলমান জীবন তো শুধু আর নীতির শুষ্ক পরিসরে গড়ে ওঠে না। সেখানে লোভ, মোহ, কূটকচালি, পরচর্চা এবং প্রয়োজনীয় অসভ্যতাও আছে। আমাদের মহাভারতীয় দার্শনিকরা তাই জীবন বুঝে দর্শনের নিদান দেন। বিশেষত আমাদের ভারতবর্ষ হল অসাধারণ এক ভাবভূমি। এখানে নীতিশাস্ত্রও মানুষের হৃদয় বুঝে বিধান দেয়। এখানকার ভগবানও পৃথিবীর সবচেয়ে মরমী কবি। তিনি যখন কৃষ্ণ হয়ে অর্জুনের সঙ্গে কথা বলেন তখন এমন উপদেশও দেন যে, বাপু! সময় বুঝে মানুষ দেখে মিথ্যে কথা বলতে পারো, সেটাও ধর্ম। মনে পড়ে আমার সেই মরণাপন্ন পিতৃব্যের কথা। তাঁর বাঁচার বড় সাধ ছিল। ধন উপার্জন করেছেন প্রচুর, কিন্তু ভোগের সময় পেলেন না। সুন্দরী স্ত্রী এবং বশংবদ পুত্র থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁদের সাহচর্য এবং প্রদর্শন-গৌরব থেকে বঞ্চিত হলেন। কর্কট রোগের আক্রমণে তিনি যখন দিনে-দিনে কাতর হচ্ছেন, দিনে দিনে তাঁর স্ত্রী-পুত্র যখন ভেঙে পড়ছেন অবসাদে, তখন প্রতিদিন আমার কাজ ছিল তাঁকে অকপটে মিথ্যা কথা বলা। আমি তাঁকে আধুনিক চিকিৎসার অব্যর্থ ফল সম্বন্ধে এমন উচ্চকোটির বক্তৃতা দিতাম এবং নব নির্মীয়মান ওষুধগুলির বহুল কার্যকারিতার বিষয়েও এমন আশাপ্রদ কল্পচিত্র অঙ্কিত করতাম যে, কর্কট-দষ্ট আমার পিতৃব্য প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই ভাবী আরোগ্যের সম্ভাবনায় চাঙ্গা হয়ে উঠতেন। নিঃসঙ্কোচে জানাই— এই প্রত্যেক সন্ধ্যাতেই আমি অকাল-বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দিতাম না, মিথ্যা কথা বলতাম। এবং আমি সেটা ভালোই করেছি।
আমাদের দেশের দার্শনিক, ধার্মিক শাস্ত্রকারেরা এ-বিষয়ে ভীষণ রকমের বাস্তববাদী, এমন একটা অসাধারণ প্রসঙ্গে তাঁরা এই মিথ্যাকথনের সমর্থন জানিয়েছেন যে, সেটা উল্লেখ না করলে আমার সহৃদয় পাঠককুলকে বঞ্চিত করা হবে। মহাভারত-বিখ্যাত মহারাজ যযাতিকে আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই। সেই যযাতি, যিনি দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর স্বামী। অবশ্য যযাতীর চেয়েও দেবযানীকে আমি বেশি বিখ্যাত মনে করি। দেবযানী শুক্রাচার্যের লাই-পাওয়া মেয়ে, তাতে আবার ক্ষণে ক্ষণে প্রেমে পড়ার অভ্যাস ছিল তাঁর। মহাকবি রচিত দেবযানী এবং বার্হস্পত্য কচের কথা স্মরণ করুন— শ্রুতিনাটক করতে গেলেও সেখানে কচের ভূমিকায় স্বপ্রতিভা ক্ষুদ্র হয়। মাঝে মাঝে শুধু— ‘নহে নহে দেবযানী’ বলে আবৃত্তিকারকে অসন্তুষ্ট চিত্তে অবসর করে দিতে হয় দেবযানীর আবৃত্তিতে। এ-হেন দেবযানী মহারাজ যযাতিকে জাতি-কুল ভেঙে বিয়ে করেও অন্তরে অন্তরে গুরুকন্যার সমস্ত আত্মসচেতনতা নিয়েই স্বামীগৃহে গিয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই সাতশ’ দাসীর বাহিনী, যার মাথায় ছিলেন হেড-দাসী শর্মিষ্ঠা। রাজকন্যা হয়েও দুর্ভাগ্যবশত শর্মিষ্ঠা আজ দাসী, তাঁর বিবাহ করার বা ভালোবাসার অধিকারও সেই দাসীত্বের অঙ্গীকারে।
শর্মিষ্ঠা থাকেন দেবযানীর চোখের আড়ালে দাসীদের আবাসে, অশোক-ফুলের উদ্যান প্রান্তে। সেখানেও বসন্তের হাওয়া দেয় কখনও এবং রাজা যযাতি সেদিন বিনা কারণে চলে গিয়েছিলেন অশোক বনের প্রান্তে ঘুরতে ঘুরতে। এই সুযোগ শর্মিষ্ঠা ছাড়েননি, তিনি প্রেম নিবেদন করেছেন রাজার কাছে, এতকালের অবরুদ্ধ বাসনা উজার করে দিয়ে। মহারাজ যযাতি এবার ভয় পেয়েছেন, দেবযানী হইতে ভয়। তাঁর প্রেমের মধ্যেও সেই অপাদান কারকের বীজ আছে যেখানে গুরুকন্যার অহং এবং আত্মসচেতনতা স্বামী রাজার মনেও ত্রাসের সঞ্চার করে। অতএব যযাতি ভয় পেলেন। ঠিক এইরকম দ্বিধা-দ্বন্দ্বদীর্ণ রাজার কাছে অদ্ভুত এক জীবন-সত্য উচ্চারণ করেছেন অসুর রাজার কন্যা শর্মিষ্ঠা।
যযাতি বলেছিলেন— আমি এমন মিথ্যাচরণ করব কী করে? দেবযানী আমার বিবাহিত স্ত্রী, তিনি থাকতেও তোমার প্রেম-কামনায় সাড়া দিয়ে এমন মিথ্যা আচরণ করি কী করে? শর্মিষ্ঠা বলেছিলেন— ভয় নেই, মহারাজ! অন্তত পাঁচটা জায়গায় মিথ্যে বললে কোনও দোষ নেই। কেমন এই পাঁচটা জায়গা? আমরা বলব— প্রখর বাস্তব-বোধ এবং জীবন-যন্ত্রণার অসহনীয় মর্মবোধ না থাকলে শর্মিষ্ঠার মুখ দিয়ে এমন জীবন সত্য উচ্চারণ করাতেন না মহাভারতের কবি। ‘জীবন-সত্য’ এই কারণে বলছি যে, স্বয়ং কৃষ্ণের মুখেও উচ্চারিত হয়েছে এই একই কথা এবং তিনি এমন সংকট-মুহূর্তে ওই একই কথা বলেছেন যাতে আপতকালে মিথ্যে কথা বলাটাই যেন ধর্ম হয়ে ওঠে।
শর্মিষ্ঠা বলেছিলেন— ন নর্মযুক্তং বচনং হিনন্তি— অর্থাৎ মহারাজ! আমরা যখন হাসি-ঠাট্টা করি, তামাশা-মস্করা করি, তখনই মিথ্যে কথা বলি, মিথ্যে বলে অন্যের পিছনে লাগি, তাহলে সে মিথ্যেটা মোটেই মিথ্যে কথা নয়। এটা আমরাও বুঝি, হাসি-ঠাট্টার সময় কত যে মিথ্যে বলেছি, কত যে চমক তাতে নিহিত ছিল, এখন তা মনে হলে ভয়ই করে। তবে বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে নেহাতই সরল হৃদয়কে নিয়ে অনেক প্রাণঘাতী ইয়ার্কি দেখেছি, সেগুলো নর্মবচনের মধ্যে পড়ে না, ধর্মের মধ্যে তো নয়ই। বরঞ্চ সেটাকে হিংসে বলাই ভালো। এর পরেই শর্মিষ্ঠার মুখে সেই বিতর্কিত ভয়ংকর উক্তি— এবং এই উক্তি জীবন-যন্ত্রণায় নিতান্ত আহত এক রমণীর মুখ থেকেই বেরোতে পারে। শর্মিষ্ঠা বলেছিলেন— মেয়েদের কাছে মিথ্যা বললে কোনও দোষ নেই, মহারাজ। আর বিয়ের ব্যাপারে মিথ্যে বললেও দোষ নেই— ন স্ত্রীষু রাজন ন বিবাহ-কালে।
কোনও মহিলা-মহল কিম্বা কোনও স্বাধীনতা-কামিনী বিদুষী-সভায় যদি কখনও শর্মিষ্ঠার এই আপ্তবাক্য উচ্চারণ করেছি, তখন তাঁরা অনেকেই হেঁই হেঁই করে প্রতিবাদ করেছেন— বলেন কী মশাই! এটা কোনও নীতি! কোনও শাস্ত্র! এইভাবেই তো চিরকাল হেনস্থা করা হয়েছে, পুরুষরা ঘরে বিয়ে করবে, বাইরে অন্য মেয়েদের নিয়ে ফূর্তি করবে, তার বাড়িতে এসে মিথ্যে কথা বলবে, এই তো চিরকাল হয়েছে, এই তো ভারতবর্ষের শাস্ত্র। এই সব সভায় আমি প্রথমত মূক হয়ে থাকি, প্রতিবাদী আক্রমণে এমনই স্তিমিত হয়ে থাকি, যেন শর্মিষ্ঠা খুব খারাপ কথাই বলেছেন। কিন্তু মনে মনে আমি তো শর্মিষ্ঠারই সমর্থক, বিবাহিতা দেবযানী থেকেও তথাকথিত নষ্টা শর্মিষ্ঠাকে আমি বেশি পছন্দ করি। আর শুধু আমি কেন, দুনিয়াসুদ্ধু লোক জানে যে, শর্মিষ্ঠার কোনও উপায় ছিল না। দেবযানীর কৌশলে এবং ব্যক্তিত্বে ভালোবাসা, এমনকী ভালোলাগার পথটুকুও শর্মিষ্ঠার কাছে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে দেবযানীর ভালোবাসাও তো ভালোবাসা নয়, সে হল বলাৎকৃত বিবাহ বন্ধনের নাগপাশ, সেখানে পান থেকে চুন খসলে দেবযানীর শাসন নেমে আসে। এই অবস্থায় মুক্ত বসন্তের হাওয়ার মতো শর্মিষ্ঠা এসেছিলেন যযাতির জীবনে। শর্মিষ্ঠার কথা তাই ফেলতে পারেননি যযাতি। শর্মিষ্ঠাকে ভালো লেগেছিল যযাতির, তিনি তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। হয়তো বা দেবযানীর রাহুর প্রেম যযাতির এই ভালোবাসার স্বীকরণ ত্বরান্বিত করেছিল। অন্যদিকে শর্মিষ্ঠাও যযাতিকে এতটাই ভালোবেসে ছিলেন মনেপ্রাণে যে, যযাতির ভালোবাসার আধার হিসেবে তিনি ‘মিথে’ পরিণত হয়েছিলেন। কালিদাসের কণ্বমুনি স্বামীর ভালোবাসা পাবার আধারে শর্মিষ্ঠার কথা বলেই আশীর্বাদ করেছিলেন শকুন্তলাকে। বলেছিলেন— মহারাজ যযাতি যেমন শর্মিষ্ঠাকে ভালোবাসতেন, প্রশংসা করতেন, তুমি তেমনটাই হয়ে ওঠো দুষ্মন্তের কাছে— যযাতেরিব শর্মিষ্ঠা ভর্তুর্বহুমতা ভব।
তবে জানেন তো, এ-সব অ-প্রাসঙ্গিক কথা, তবু সেটা আস্তে আস্তে বলতে হয়, জানাতে হয়, কেননা তাঁর জীবনে যন্ত্রণাটুকু না জানালে প্রেম-নিবেদনের সময় তাঁর আপাত উচ্চারিত অন্যায় কথার মর্ম বোঝা যাবে না। শর্মিষ্ঠা বলেছিলেন— মেয়েদের কাছে মিথ্যে বললে দোষ নেই, রাজন! বিয়ের সময়, বিয়ের কারণে মিথ্যে বললেও দোষ নেই। এর মানে কিন্তু নিশ্চয়ই এই নয় যে, যখন-তখন মেয়েদের কাছে পৌরুষের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিথ্যে কথা বলা যাবে। বস্তুত যে যে জায়গায় মিথ্যার উচ্চারণ করতে বলেছেন শর্মিষ্ঠা, সেখানে সেখানেই সার্বিকভাবে কিছু আপৎকালীন উচ্চারণ করেছেন। সেই দিক থেকে ভাবলে শর্মিষ্ঠার বলা পাঁচটি মিথ্যের মধ্যে কোথাও লঘুতাও আসে, আবার কোনওটাতে ভীষণ গভীরতাও আসে। এই মুহূর্তে এই যে বলেছেন শর্মিষ্ঠা— মেয়েদের কাছে মিথ্যে বললে দোষ নেই, সেটার মধ্যে লঘুতার অংশই বেশি এবং সেটা জীবনের বিভিন্ন সত্যের সঙ্গে মিলে যায়। যেমন ধরা যাক, যে পুরুষ অভীষ্টা রমণীর কাছে প্রেম নিবেদন করে, সে কি সব সত্য কথা বলে! নিজের সম্বন্ধে যা বলে, তাও কি সব সত্য, অথবা অভীষ্টার রূপ-গুণ-কর্মের প্রশংসায় পুরুষের যে মুখরতা, তার মধ্যেও সত্য থাকে নাকি সব? অথবা ধরা যাক, সংসার শাসনে আহত এক প্রৌঢ়। সে এককালে বড় আমোদী মানুষ ছিল, প্রচুর আড্ডা মারত, প্রচুর কফিহাউসে যেত এবং প্রচুর অবাস্তব কথা বলত। এখনও সে সব উত্তরঙ্গ ভাবনা তাকে হাতছানি দেয়, মাঝে মাঝে সে লাগাম ছেড়ে দেয় নিজের, কিন্তু সংসার-সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সে মানুষ শাসিত হয়, ভর্ৎসিত হয় কৃতকর্মের জন্য। ধরা যাক, এই একরকম একটা বিধ্বস্ত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তার পুরাতনী বান্ধবীর। ধরা যাক, এখনও তার চটক কমেনি, বরঞ্চ প্রৌঢ়তার মেদবন্ধন তাকে প্রৌঢ়পুষ্প কদম্বের পরিণতি দিয়েছে; ধরা যাক, বিবাহিত জীবনের অম্লমধুর রসাস্বাদ তার অন্তরে ঝরে পড়া বকুলের গন্ধ-স্পৃহা জাগায় এখনও। আর আপনিও বা কেমন লোক, মশায়! আপনি বিবাহিত, প্রৌঢ়, সন্তানের পিতা, সমাজে প্রতিষ্ঠিত, তবু কেন পুরাতনী বান্ধবীর অচঞ্চল জীবনের সামান্য ব্যর্থতাটুকু শোনার জন্য বসে গেলেন কফি-হাউজে। কেমন একটু কষায় মধুর এই পরিস্থিতি এবং নিজেকে প্রৌঢ়া রমণীর কাছে আরও একবার যাচাই করে নেবার জন্য আপনি সময় দিলেন তো। এখন এমন একটা অকল্পনীয় অথচ লুণ্ঠিত সময়ের ‘জাস্টিফিকেশন’ দেখানোর জন্য আপনি বাড়ি গিয়ে কী করবেন? সত্য কথা বলবেন নাকি স্ত্রীর কাছে? বলবেন নাকি— আজ মালবিকার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল, আবার বছর কুড়ি পরে অথবা সেই মালবিকা? ‘সেই বারান্দায় লাফানো চড়াই’, যে মাঝে-মাঝে তার সঙ্গে অশ্রুভাগ করে। ‘শিশির ঝিকোয় নীচু ঘাসের ওপর’। সেই বা কী বলবে বাড়ি গিয়ে? সত্য কথা বলবে?
বাড়ি ফিরে গিয়ে একটি লুণ্ঠিত সন্ধ্যার জন্য আপনার ভরসা কবি রবিবাবু, যিনি লিখেছিলেন— অকারণের আনন্দে সাহিত্য গড়িয়া উঠে। আপনাকে বলতে হবে— আজ কলকাতা শহরের যা অবস্থা এই মিছিল, এই ট্রাফিক জ্যাম, তার মধ্যে ছোটোবেলার বন্ধু কালো-ফটকের সঙ্গে দেখা। ও এখন মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি যত অকারণ বাগবিস্তার, যত অকারণের সাহিত্য, যতখানি ভালো করে অথবা বলা ভালো যতখানি বিশ্বাসযোগ্য করে আপনি বলতে পারবেন, আপনার মনোভূমি তখন রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়েও সত্য হয়ে উঠবে।
একটি মহিলা-কলেজের বিদ্বৎসভায় ‘সিচুয়েশনাল এথিকস’ নিয়ে কথা বলার সময় আমি এমনতর মিথ্যার প্রয়োজন নিয়ে দু-চারটি বাণী দিয়েছিলাম। প্রগতিশালিনী রমণীরা তাতে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন— এটা কেমন অন্যায় কথা, মেয়েদের কাছে মিথ্যে বলা যাবে, আর মেয়েরা মিথ্যে বললেই যত দোষ? আমি বললাম— আমি আবার সে-কথা কখন বললাম? ‘সিচুয়েশনালি’ এখানে উল্টো দিকটাও একইরকম। অর্থাৎ এইরকম প্রয়োজনীয় ঝুটি-মুটি মেয়েরাও ছেলেদের কাছে বলতেই পারে। ওই দীপশিখা হাতে মালবিকা নেমে এসেছিল, বাড়ি গিয়ে তাকেও শপিং, ট্রাফিক এবং ছোট মাসির সঙ্গে দেখা হবার কথা বলতে হবে। পাঁচ রকমের মিথ্যের মধ্যে এইটেতে যেমন পুরুষ-রমণীর পারস্পরিকতা স্বতঃসিদ্ধ, তেমনই এর পরে কল্পটিও একই পারস্পরিকতায় আবদ্ধ। শর্মিষ্ঠা বলেছিলেন, ন স্ত্রীষু রাজন ন বিবাহ-কালে। অর্থাৎ কিনা মেয়েদের কাছে (উল্টো দিকে পুরুষের কাছেও) কোমল প্রয়োজনে মিথ্যা বললে যেমন দোষ নেই, তেমনই বিয়ের ব্যাপারেও মিথ্যে বললে কোনও দোষ নেই এবং এটা তো উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
যিনি মেয়ের বাপ হন, তাঁর দুঃখ তো আমরা জানি। মেয়ের বিয়ে দেবার সময় কালো-কুৎসিত মেয়ের জন্য দুখী বাপকে বলতেই হয়— তেমন কালো নয় গো দাদা, ও উজ্জ্বল শ্যাম, ওই নাকটা একটু চাপা। জগতে তথাকথিত সেই কালো-কুৎসিত পছন্দ করার জন্য তেমন বরও আছে, আমরা জানি এবং এও জানি যে রাজার জন্য যেমন রানি আছে, কানার জন্যও কানী আছে। তবে মাঝখানে মিথ্যে-সত্যি, সত্যি-মিথ্যে কিছু বলতেই হয়, যেমনটা ছেলে পক্ষও বলেন। ছেলের বিদ্যে-বুদ্ধি, অফিসের মাইনে এবং রূপ সম্বন্ধে ছেলের পিতা-মাতা সামাজিক উচ্চতার কারণে আরও বেশি মিথ্যে কথা বলতে পারেন এবং বলেনও। বিবাহ-পরবর্তীকালে এক গ্রাম্য রমণীর তদগত ধিক্কার শুনেছিলাম। তিনি বলতেন— কত শুনেছি ‘গ্যাজো’, ‘গ্যাজো’। অহন দেখি— গ্যাজোটও না, কিছুই না। তার মানে ছেলেকে ‘গ্র্যাজুয়েট’ পরিচয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী উদঘাটনে এই সত্য বেরিয়ে এসেছে যে তিনি ‘গ্যাজো’ও নন, এমনকী কিছুই না। তাহলে বিবাহ-কালে বিবাহ ঘটানোর জন্য যে মিথ্যে চলে সেটা ‘সিচয়েশনাল নেসেসিটি’, অতএব মিথ্যাটা দোষ নয়।
একেবারে শেষ দুটি কল্পে আরও যে দুটি মিথ্যার প্রয়োজন-মাফিক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেখানে অতিবড় নীতিবাগীশও ভগবান রামকৃষ্ণের ভাষায় ‘ট্যাঁ’ করে উঠবেন তার একটা হল, যদি প্রাণ যাবার মতো অবস্থা হয়, তখন মিথ্যে বললে যদি প্রাণ বাঁচে, তবে মিথ্যে তো বলতেই হবে। আর দ্বিতীয় হল যদি ধন-সম্পত্তি, জমি-জিরেত সব যেতে বসে, তাহলেও মিথ্যে বললে কোনও পাতক নেই, দোষ নেই। ধন সম্পত্তির গহন-কুটিল ব্যাপার নিয়ে আমি বেশি কথা বলতে চাই না। কেননা এ বাবদে নানান অসভ্যতাও আছে— সম্পত্তির ভাগ নিয়ে ঠকানোর কৌশল থেকে হাজারো মিথ্যা চালাচালির আধার হল টাকা-পয়সা, জমি-জিরেত, পিতৃ পরম্পরাগত সম্পত্তি, আমরা বলব— ঠকিয়ে নেওয়া ছাড়া আপন ন্যায়ার্জিত সম্পত্তি রক্ষণের ক্ষেত্রে যদি মিথ্যাচারণ কোনও সুবিধা দেয়, তবে সেই মিথ্যাচার অনাচরণীয় নয়। তবে কিনা এ-বাবদে আমি সত্যি বেশি কথা বলতে চাই না। বরঞ্চ প্রাণ যাবার অবস্থা হলে কেমন মিথ্যাচার গ্রহণীয় যে ব্যাপারে আমি আপনাদের মহাভারতের একটা গল্প শোনাব।
এটা কিন্তু আগেই জেনে নেওয়া ভালো যে, ‘সিচুয়েশনাল এথিকসে’র ব্যাপারে সম্পূর্ণ মহাভারত অন্তত দুশোটা উদাহরণ সাজিয়ে দিতে পারে। তার মধ্যে একটি কাহিনি ভীষণরকমের তাৎপর্যপূর্ণ। কাহিনির প্রস্তাবনার মধ্যেই যে ঘটনাটা ঘটেছে, তার সূত্র ধরেই অন্য কাহিনিতে যেতে হবে আমাদের এবং দুটোই ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যা বলার প্রয়োজন হিসেবে কথিত এবং বিস্তারিত। ব্যাপারটা হয়েছিল এইরকম যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় মহামতি যুধিষ্ঠির বারংবার যুদ্ধবীর কর্ণের হাতে নাকাল হচ্ছিলেন। এক্ষেত্রেই যুধিষ্ঠির নিজে খুব বড় যোদ্ধা ছিলেন না, কিন্তু বারংবার যুদ্ধে লাঞ্ছনা লাভ করলে বীর ভাইদের সামনে, বিশেষত সাধারণ সৈন্যদের প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে নিজেকে কেমন লাগে। তার মধ্যে মহাবীর অর্জুন মাঝে-মাঝেই কর্ণবধের প্রতিজ্ঞাটি ঝালিয়ে নেন সবার সামনে, সদম্ভে। এতে যুধিষ্ঠিরের আরও রাগ হয়। ভাবেন বুঝি— ব্যাটার কিছু করার ক্ষমতা নেই, মাঝে মাঝে ফাল পাড়ে। কিন্তু কর্ণের মতো মহাবীরকে হত্যা করার জন্য সময়ের যে পরিপক্বতা প্রয়োজন, সেটা তখনও আসেনি বলেই অর্জুনকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এমনকী বিপন্ন ভীমকে কর্ণের সামনে রেখেও একদিন অন্যত্র চলে যেতে হল অর্জুনকে।
কিন্তু সেদিন আর যুধিষ্ঠিরের সহ্য হল না। সর্বসমক্ষে লাঞ্ছিত যুধিষ্ঠির চিৎকার করে অনেক কথা বললেন। হাটে-মাঠে অর্জুনের যত প্রশংসা সব প্রথমে উচ্চারণ করলেন তাচ্ছিল্য করে, আর শেষে বললেন— সারা জীবন ধরে এই অর্জুন শুধু তার গাণ্ডীব দেখিয়ে ধমকে গেল সবাইকে, এই করবে সেই করবে কত কী। আরে কিছুই যখন পারিস না, তখন তোর এই গাণ্ডীব ধনুকটা অন্য কাউকে দিয়ে দে না বাবা— দেহি অন্যস্মৈ গাণ্ডীবমেতদ অদ্য। বেশ তো, ওই গাণ্ডীবটা কৃষ্ণের হাতেই ছেড়ে দে, আর তুই বরং ওই রথের ঘোড়ার লাগাম ধর। যুধিষ্ঠির শেষে বললেন— ঝাঁটা মারি তোর গাণ্ডীবের মুখে, ঝাঁটা মারি তোর যুদ্ধ ক্ষমতায়, তোর গাণ্ডীব থেকে নাকি অসংখ্য বাণ ছোড়া যায়, ঝাঁটা মারি ওই বাণের মুখে। তোর ওই কপিধ্বজ রথের মুখেও আমি ঝাঁটা মারি— ধিক গাণ্ডীবং ধিক চ তে বাহুবীর্যম।
যুধিষ্ঠিরের এই তিরস্কার চিৎকারের ফল ভালো হল না। অর্জুনের চিরকালীন প্রতিজ্ঞা ছিল এই যে, কোনও মানুষ যদি তাঁর গাণ্ডীব ধনুকের নিন্দা করে তবে তিনি তাঁকে বধ করবেন। আর ক্ষত্রিয়ের সত্য প্রতিজ্ঞার মূল্য এমনই যে, দাদা, ভাই, বন্ধু, স্ত্রী বা কোনও নিকট সম্বন্ধও সেই প্রতিজ্ঞাত সত্যকে অন্যথা হতে দেয় না। এমন অবস্থায় অর্জুন যাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় হল যে, তিনি মহামতি যুধিষ্ঠিরের ভাই তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা— তিনি যুধিষ্ঠিরের শিষ্য— কতবার এই কথা বলা হয়েছে— ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য, সেই অর্জুন তাঁর গাণ্ডীবের অপমান সহ্য করতে না পেরে হঠাৎই যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হয়ে আরম্ভ করলেন। কৃষ্ণ বললেন— কী ব্যাপার হে অর্জুন। হঠাৎ করে হাতে একটা খড়্গ নিয়ে চললে কোথায়— কিমিদং পার্থ গৃহীতঃ খড়্গ ইত্যুত।
এখন কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে এমন তো জানি না। ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের তো ভীমই যথেষ্ট ধাক্কা দিয়েছে। আর মহারাজ যুধিষ্ঠির তো কুশলেই আছেন! তাহলে কার জন্য এই যুদ্ধসজ্জা! অর্জুন বললেন— তুমি তো জানোই যে, আমার প্রতিজ্ঞা আছে। যুধিষ্ঠির আমাকে নিন্দা করে বললেন— এই গাণ্ডীব অন্য কাউকে দিয়ে দাও, ধিক এই গাণ্ডীবকে। এই অবস্থায় আমার কীই বা উপায় আছে আর। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে আমায় মারতেই হবে। তুমি তো দেখলে, তোমার সামনেই আমার গাণ্ডীবকে কীভাবে ছি-ছিক্কার করল। অতএব প্রতিজ্ঞা রাখার জন্যই এখন আমাকে খড়্গ তুলে নিতে হয়েছে হাতে। কী বলো, ঠিক করেছি তো? তুমি কী বলো?
কৃষ্ণ এবার শতগুণ ধিক্কার দিয়ে অর্জুনকে বললেন— ছিঃ অর্জুন। ছিঃ তুমি বড় ভাই যুধিষ্ঠিরকে মারতে যাচ্ছ এই সামান্য কারণে? তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান সব লোপ পেয়েছে? ধর্মবোধ, ধর্মনীতি এবং কোনটা করণীয় এবং কোনটা নয় এই সমস্ত ব্যাপারটায় তোমার বিভ্রান্তি তো চরমে উঠেছে— অনিশ্চয়জ্ঞো হি নরঃ কার্যাকার্য বিনিশ্চয়ে। খুব খানিকটা গালাগালি দিয়ে কৃষ্ণ অর্জুনকে আরও বললেন— ‘ক্রাইসিস’-এ সময় বিপন্ন সময়ে কোনটা করা ঠিক, এ-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অত সহজ নয় বাপু। তার জন্য বিদ্যা, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা লাগে। একটা জিনিস তো তোমার সাধারণ বুদ্ধিতে আসা উচিত, বোঝা তো উচিত যে, একটা মানুষকে তুমি মারতে যাচ্ছ, তার যে অন্যায়ই থাকুক, তোমার সার্বিক ধর্মবুদ্ধিতে এটা বোঝা উচিত যে, একটা মানুষকে প্রাণে না মারাটাই সবচেয়ে বড় ধর্ম— প্রাণিনাম অবধস্তাত সর্বজ্যায়ান মতো মম।
চিরকালীন দৈববাণীর মতো অথবা আর্যবাচনের মতো কৃষ্ণ যদি এইটুকু উপদেশ পরামর্শ দিয়েই শেষ কথাটা বলতেন তাহলে তিনি কৃষ্ণ হতেন না, পরম্পরা-রচিত বিধি-বচনের চেয়ে মানুষের জন্য মমতা এক নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি তাঁর জন্য এমন এক পৃথক কক্ষ তৈরি করেছিল, যেখান থেকে শুধু বিধান-নিদান ঘোষিত হত না, বরঞ্চ সেখানে মানুষ এবং সমাজ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিকতা তৈরি হত। কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন— একটি মানুষের বধ কিংবা হত্যা এড়ানোর জন্য যদি মিথ্যা কথাও বলতে হয় তাও ভালো, তবু হিংসার পথ একেবারেই উচিত নয়— অনৃতাং বা বদেদ বাচং ন তু হিংস্যাৎ কথঞ্চন। আমি তো ভাবতেই পারছি না— শুধু তো একটা হত্যা মাত্র নয়, শুধু বধ নয়, যাকে তুমি মারতে যাচ্ছ, সে তোমার বড় ভাই যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে সামান্য উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেই কৃষ্ণ বললেন— কবে যে কী ভেবে কোন পাগলামিতে তুমি এমন প্রতিজ্ঞা করেছিলে কে জানে— কলেনেব কৃতং পুরা। কিন্তু এটা মনে রেখো, সত্য জিনিসটা অত সহজ নয়। আমি একটা সত্য কথা বললাম আর সেটাই ধর্ম হয়ে গেল এমন কিন্তু নয় অথবা একটা কথা দিয়েছিলাম, সেটা যেভাবে হোক রাখলাম এবং সত্য রক্ষা করলাম, এটাই কিন্তু ধর্ম নয়। দেখতে হবে তোমার সত্য মঙ্গল করছে কিনা, সেটা বহুজনহিতায় কিনা।
অদ্ভুত লাগে এই সময়। এখন কৃষ্ণ মর্মার্থে সেই শ্লোকটাই প্রায় উচ্চারণ করছেন যা আমরা পূর্বকালে শর্মিষ্ঠার কাছে শুনেছি এবং সেই পঞ্চ-মিথ্যার প্রামাণ্য বোঝানোর জন্য ভণিতা হিসেবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা বললেন কৃষ্ণ। কৃষ্ণ বলেন— মানি এটা, হাজারবার মানি যে, সত্য কথাটা বলাই সবচেয়ে সাধুতা এবং সত্যের চেয়ে বড় কিছু নেই। কিন্তু ব্যাপারটা এত আক্ষরিক নয়, মনে রাখতে হবে যে, প্রয়োজন এবং বাস্তবের পরিস্থিতি এমন হতে পারে যে, সত্য জানলেও সেই সত্য বলা চলবে না, এমনকি মঙ্গলের প্রয়োজনে পরিস্থিতির দাবি এমনও হতে পারে যে, সত্যের বদলে মিথ্যা বলাটাই শ্রেয় হয়ে উঠতে পারে— ভবেৎ সত্যম অবক্তম/ বক্তব্যম অনৃতং ভবেৎ। মনে রেখো, এমন অবস্থায় মিথ্যাটাই কিন্তু সত্যের প্রকৃত স্বরূপ অথবা উল্টো দিকে সত্যটাই হয়তো সবচেয়ে বড় মিথ্যা। এবার কৃষ্ণের মুখে সেই পাঁচ বিদ্যার ওপর পক্ষপাত ভেসে এল— কার্যকালে, বিপন্ন সময়ে কখনও কখনও মিথ্যাটাও সত্যের স্বরূপ হয়ে উঠতে পারে। সত্য বলার জন্যই সত্য বললাম— এ নিতান্ত বাচ্চাদের মতো কথা। সত্য এবং মিথ্যার সঠিক স্বরূপ বোঝাটাই অথবা তর্কযুক্তির মাধ্যমে তার স্বরূপ প্রতিষ্ঠা করাটাই যুক্তি-পরায়ণ কর্মবিদের কাজ— সত্যানৃতে বিনিশ্চিত্য ততো ভবতি ধর্মবিৎ।
কৃষ্ণ অসাধারণ সুন্দর একটা গল্প বললেন এবার। বললেন— পুরাকালে কৌশিক নামে এক ঋষি ছিলেন। সত্য কথা বলাটা তাঁর এক অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সেই কারণেই তিনি সত্যবাদী নামে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। একদিন হল কী, তিনি নির্জন বনভূমির মধ্যে আপন আশ্রম-কুটিরে বসে তপস্যা করছিলেন, এই সময় কতকগুলি লোক পথচলতি দস্যু-তস্করের তাড়া খেয়ে কৌশিক মুনির আশ্রম-প্রান্তিক বনভূমিতে গিয়ে লুকোন। রাস্তায় ডাকাতি করা দস্যুদের মনে কোনও দয়া-মায়া ছিল না। তারা যেভাবে হোক লোকগুলিকে মেরে তাদের কাছ থেকে সব কেড়ে নিতে চায়। দস্যুরা সেই লোকগুলির পথ অনুসরণ করে কৌশিক মুনির আশ্রমে প্রবেশ করে তপস্যারত মুনিকে দেখে বলল— কোথায় গেছে লোকগুলো? তুমি সত্য করে বলো। সত্যবাদী মুনি কোনও রকম চিন্তা না করে আপন সত্যবাদিতা সপ্রমাণ করে বললেন— এই তো ওই দিকে, এই বনভূমির লতা-বৃক্ষের অন্তরালে তারা লুক্কায়িত। দস্যুরা এগিয়ে গেল এবং লোকগুলিকে খুঁজে বের করল সহজেই। তারা মারা পড়ল দস্যুদের হাতে।
কৌশিক মুনির এই সত্যপ্রিয় আচরণ দেখিয়েই কৃষ্ণ বললেন— এই যে অধর্ম হয়ে গেল, তার ফলে কৌশিক নরকে গিয়েছিলেন। আসলে কৌশিক সত্য কথা বলা শিখেছিলেন বটে, কিন্তু বিদ্যা-বৈদগ্ধ কিছুই না থাকায় কোনটা ধর্ম এবং কোনটা অধর্ম— এই বোধ তাঁর ছিল না। যার ফলে তিনি নরকে গেলেন।
কৃষ্ণ তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতায় এই সত্যটা জানেন যে, এখানেও সেই চিরকালীন শাশ্বত প্রশ্নটা উঠতেই পারে। অর্থাৎ কিনা সত্য সত্যই। তার অন্য অর্থ হয় না। আমাদের বেদ-উপনিষদ সব শাস্ত্র একত্রে চিৎকার করে বলছে সত্য কথা বলো, সেটাই ধর্ম। সত্যংবদ, ধর্মংচর ইত্যাদি। কৃষ্ণও বলেছেন— জানি, জানি ও-সব কথা। চিরকেলে শুষ্ক শাস্ত্রের ওইসব কথা আমি জানি এবং আমি বেদ-উপনিষদের কথার প্রতিবাদও করছি না। কিন্তু এটা মনে রেখো বাপু। পৃথিবীর সব ঘটনাই আগে থেকে এমন ছকে বেঁধে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়নি যে, আগে থেকে তার নিয়মও করা থাকবে, দেওয়া থাকবে বিধান— ন চ সর্বং বিধীয়তে। সবচেয়ে বড় কথা হল মানুষের জীবন, সেই জীবন বাঁচানোর জন্য যদি মিথ্যা কথা বলতে হয়, সেটাও ঠিক আছে। সত্যের চেয়েও বড় কথা হল অহিংসা, যেখানে সর্বশেষে অহিংসার প্রয়োজন কিম্বা যেভাবেই হোক হত্যা যেখানে এড়ানো যায়, সেটাই সবচেয়ে বড় ধর্ম।
সেইকালে কৃষ্ণের মতো এমন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মুখে এই কথাটাই শুনব, এটাই খুব স্বাভাবিক এবং আশ্চর্য লাগে, আজকে একবিংশ শতাব্দীর দুয়োরে দাঁড়িয়ে প্রাণদণ্ড বা ‘ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট’-এর তর্ক যুক্তি শাণিত হয় এখনও। অর্জুনের প্রতিজ্ঞা সত্যরক্ষা এবং বড় ভাই যুধিষ্ঠিরের প্রাণ বাঁচানোর ক্ষেত্রে কৃষ্ণ যে সমাধান দিয়েছিলেন, তা শুনলে মনে হবে— কত কঠিন এক জটিল পরিস্থিতিতে তিনি লঘু করে দিতে পারতেন। কৃষ্ণ বলেছিলেন— দ্যাখো অর্জুন। মানী মানুষ, সমাজের মহৎ প্রাণ মানুষেরা নিজেদের মানটুকু নিয়েই বাঁচেন, যেদিন তাঁদের সমক্ষে কেউ তাঁদের সম্মানটুকু নষ্ট করে দেয় সেটাই তাঁদের জীয়ন্তে মরণ। পৃথিবীতে কেউই তো ‘পারফেক্ট’ হতে পারে না। আচার্য, গুরু, বৃদ্ধ, বড় মানুষ, সবচেয়ে বড় কথা— তুমি, ভীম যে যুধিষ্ঠিরকে এত সম্মান কারও দাদা বলে, ধর্মরাজ বলে তাঁরাও কোনও না কোনও সময় দোষ করে ফেলতে পারেন, কিন্তু তাই বলে তাঁদের মেরে ফেলা যায় না। অথচ ধরো, তাঁদের অন্যায় আচরণে রাগও হচ্ছে, এমন মনে হচ্ছে যেন মেরেই ফেলি লোকটাকে। এ-সব ক্ষেত্রে একটাই উপায়— যে মানুষটাকে সকলে সম্মান করে, সেই মানুষটাকে সর্বসমক্ষে কষে গালাগালি দাও— এতে প্রাণে না মেরেও তাঁকে মেরে ফেলা যায়, হত্যা না করেও মানী জনের সবচেয়ে বড় হত্যা এটাই যে তুমি তাঁর সম্মান নষ্ট করেছ। তারপর দাদা যুধিষ্ঠিরের পা জড়িয়ে ধরে বলো— তুমি এই অপমান আমাকে করেছিলে, তাই আমি এমন খারাপ কথা বলেছি। তুমি রাগ কোরো না, ক্ষমা করো। দেখবে, যুধিষ্ঠিরের ক্ষমতা নেই, তোমাকে ক্ষমা না করে, না ভালোবেসে তিনি যাবেন কোথায়?
এতসব দর্শন মনন, গল্প কথার পরে একবার নিজেদের দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে। কেমন হন্তারক সময়ের মধ্যে বাস করি আমরা। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, এমনকী পিতা-মাতাও— কী বিস্ফারিত অভিমানের মধ্যে সকলে আমরা বাস করছি। এমন একটা ট্রেনের কামরা আমি দেখিনি, যেখানে ঝগড়া ছাড়া হাওড়া-শেয়ালদা যাওয়া যায়, এমন একটা পরিবারও দেখি না যেখানে কথায়-কথায় জটিল হয় না কথা। আর সমাজ, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রও এখন এক ধরনের অহিফেনবৎ ধর্ম প্রচার করে, যেখানে মানুষের মৃত্যুও কত স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। হাজারো সম্পর্ক-সেতু মানুষের জীবন-পরম্পরা তৈরি করে বটে, কিন্তু কত অল্প কারণে সেই সেতু ভেঙে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ। কৃষ্ণ বলেছিলেন— সব কিছুই আগে থেকে বলে দেওয়া নেই যে এই হলে এই করতে হবে— ন চ সর্বং বিধীয়তে। কিন্তু বিপরীত পরিস্থিতিতে যে সিদ্ধান্ত নেব সেখানে সত্যের চেয়েও বেশি দরকার মমত্ব আর বেদনা, যা অন্যতর জনকে সুখে রাখে, জীবিত রাখে।
অবশেষে এই প্রশ্নটা অবশ্যই উঠে আসে। অর্থাৎ কিনা মানুষ বুঝে সময় দেখে মাঝে-মাঝে যদি তুমি মিথ্যার আশ্রয় নাও, তাহলে তো অভব্য জনের পোয়া বারো। তারা তো মিথ্যে বলে নিজের কাজ হাসিল করবে। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মর্মকথার উদাহরণটা না হয় ছেড়ে দিলাম, কিন্তু স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিক মিথ্যা, অথবা বিবাহের ক্ষেত্রে মানুষ তো পরস্পর মিথ্যে বলবে নির্বিচারে এবং তাতে পারদায়িকতার প্রশ্রয়ও মিলবে। কেননা সেখানেও অন্য কোনও বর্গের পরস্পরের সুখ তো হচ্ছেই। বিবাহের ক্ষেত্রেও মিথ্যে বলে লোক ঠকানোর পরিমাণটা শতগুণ ‘বাড়তে’ পারে— এমনিতেই যতটুকু হয় তাতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়— তাতে যদি আবার একটা শাস্ত্রীয় সমর্থন পাই তাহলে তো সুখের অন্ত নেই। কৃষ্ণ এ-সব কথার সোজাসুজি উত্তর দেননি। কিন্তু একটা কথা মনে রাখার মতো। তিনি বলেছিলেন— মিথ্যা বলি, কিম্বা তথাকথিত অন্যায়ই করলাম, কিন্তু মিথ্যাও যেখানে ধর্ম হয়ে ওঠে, সেখানে সার্বিক মঙ্গলটুকু হওয়া চাই। পারদারিকতার একতর বর্গের যতই সুখ হোক, অন্যের অসুখ বাড়ে। বিবাহের ক্ষেত্রেও মেয়ের রঙ চাপা কিম্বা ছেলের মাইনের মিথ্যেটুকু পরবর্তী ভালোবাসায় চাপা পড়ে কিন্তু লোকঠকানির মিথ্যাটা সার্বিক মঙ্গলের হেতু নয়। আসলে সত্য বলো, ন্যায় আচরণ করো এই সাধারণ ধর্মটা প্রাথমিক প্রযোজ্য হওয়ায় মিথ্যে বলা কিম্বা অন্যায়ের সীমা কিন্তু ততটুকুই, যতটুকুতে সমাজের ধারণ হয়, কিম্বা মঙ্গলের অংশটুকু বাড়ে। বাট্রান্ড রাসেল একটা অদ্ভুত সুন্দর কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন— বাইবেল-এর নির্দেশ এইরকমই যে, তুমি তোমার প্রতিবেশীকে সবসময় ভালোবাসবে— Love thy neighbour। কিন্তু এমন ভালোবাসার সর্বাঙ্গীন উন্নতি কামনা করলেও এটা কিন্তু মঙ্গলের কথা নয় যে, তুমি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীকেও ভালোবাসবে। কাজেই কতটুকু মিথ্যা বললে ভালো, আর কতটুকু অন্যায় করলে ভালো হয়— এ-বিষয়ে তুমি নিজেই নিজের প্রমাণ। তুমি নিজেই তোমার ‘টাস্ক-মাস্টার’। তোমার অন্তরই সব।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন