যে জন আছে মাঝখানে

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

এই সম্ভাবনা আমি প্রায়ই দেখি, প্রায়ই শুনি। এই সেদিনই এক ইংরেজির অধ্যাপক, যিনি হঠাৎ হাওয়ার প্ররোচনায় মুগ্ধ হয়ে বাংলায় একটি ছোটোগল্পের সংকলন বার করে ফেলেছেন, এমনকী মহাড়ম্বরে লোকজন ডেকে একটা ‘বুক-রিলিজ’ও করে দিলেন। চেনা-পরিচিত পণ্ডিত, অপণ্ডিত, রসিক, বেরসিক অনেকে বই নিয়ে গেল। লেখক সসম্মানে আমাকেও এক কপি বই দিলেন এবং কিছুদিন পর থেকে বিভিন্ন পাঠকের কাছ থেকে ‘ফিড ব্যাক’ চাইতে আরম্ভ করলেন। আমি এবং অন্যতর একজন অধ্যাপক ভয়ে লজ্জায় কাঁটা হয়ে আছি— কারণ বইটার কয়েকটি গল্প পড়ার পর দেখলাম— শিশুরাও এমন গোল গোল গল্প লিখবে না। তবে ভদ্রলোকের মনে খুব একটা রোম্যান্টিক বিস্ফার কাজ করে, মাঝে মাঝেই তাঁর গল্পে নায়ক রবীন্দ্রনাথের গান উচ্চারণ করে এবং ততোধিক রোম্যান্টিক নায়িকাকে একেবারে মুগ্ধ-বিমোহিত করে তোলে। গল্পের মতোই সেই নায়িকাও রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করে নায়কের প্রতিবচন দেয়। কিন্তু গল্পের কোনও উত্তরণ নেই এবং গল্প হয়ে ওঠার মতো কোনও কাজ এই গল্পের নায়ক-নায়িকারা করে না, এমনকী তেমন গল্পও করে না, যাতে তাঁরা ছোট গল্পের নায়ক-নায়িকা হয়ে উঠতে পারে।

কিন্তু এতসব সমালোচনা যতই ভেবে থাকি, এ-সব কিন্তু সেই প্রৌঢ় অধ্যাপককে বলা সম্ভব ছিল না। কেননা তিনি ভীষণই আবেগপ্রবণ এবং তাঁর একবার হার্ট-অ্যাটাকও হয়ে গেছে। কর্মস্থলে এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে এইরকম ধরনের পুরুষ-মহিলা অনেক থাকেন, যাঁদের সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব শুধুই সহকর্মীদের এবং অন্যতর আত্মীয়স্বজনের। তাঁরা অনেক সময়েই অন্যায় আবদার করেন, অন্যায় আচরণ করেন, কখনও অতিরিক্ত উৎসাহ দেখান এবং কখনও ঈষৎ সমালোচিত হলেই কেঁদে ফেলেন। এইসব মানুষের জন্য অকারণ এবং সম-অপদার্থ সমব্যথীও আছেন প্রচুর— যাঁরা একান্ত মানবিক কারণ দেখান এবং সে-সব কারণ আপনি সামনা-সামনি উড়িয়েও দিতে পারবেন না, কেননা টেবিলে বসলে পরে আপনার সৌজন্যবোধ থাকতে হবে এবং মানবিকতার সাধারণ শিষ্টাচারও মানতে হবে। অতএব তাঁদের ভালো রাখতে হবে আপন মূল্যে— তাঁরা যেন ব্যথা না পান, কেননা তাঁরা চিরকাল বঞ্চিত হবার জন্যই প্রবণ হয়ে আছেন এবং যে কোনও সাধারণ টুশকিতেই তাঁরা ব্যথিত হবার চর্চাটা বজায় রেখেছেন।

তাহলে এটাই প্রমাণ হয়ে গেল যে, আমার মানবিকতার বোধ নেই, যে মানুষ অন্তত চেষ্টা করছে, তার জন্য এতটুকু সহানুভূতির বোধও নেই। সপাটে জানাই, যারা চেষ্টা করছে, তাদের প্রতি আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে, কেননা আমি নিজেই সেই শ্রমিকদের একজন। কিন্তু আমার কিছু অনীহা আছে সেই সব মানুষের জন্য, যাঁরা নিজেদের প্রতি আরোপিত অলীক কোনও অভিমানে নিজেদের স্ফীত বোধ করেন অথবা করান। আমি যুবক বয়সে এক প্রৌঢ় পক্ব ব্যক্তির সঙ্গে একজনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে খানিক গল্প, খানিক জলখাবার ইত্যাদির পর গৃহকর্ত্রী বললেন— আমার মেয়ের গান শুনে যান, ও বেশ ভালো গাইতে শিখেছে, অমুকের কাছে গান শেখে। প্রস্তাব শুনে এবং মেয়েটির যৌবনোদ্ধত চেহারায় আপাত মুগ্ধ হয়ে আমি যখন বেশ থিতু হয়ে বসতে চাইছি, তখন আমার প্রৌঢ় পক্ব সঙ্গী বললেন— না না আজ থাক, আজ বড্ডই দেরি হয়ে গেছে। আর একদিন এসে তোমার গান শুনব, মামনি! আজ আসি। এক্কেবারে নিরুপায় হয়ে গেছি, নইলে…।

রাস্তায় এসে আমার একটু রাগই হল। মনে মনে বললাম— ব্যাটা বুড়ো ভাম! একটু কেবল রাস্তা তৈরি হচ্ছিল আর অমনি উঠে এল। ঝুনো বোধহয় বুঝতে পারল আমার মনের ভাব। বলল— ওরে কোথায় তোর সুড়সুড়ি লাগছে বুঝতে পারি, কিন্তু একটা কথা শোন, বলে রাখি। শিল্প-সংস্কৃতির ব্যাপারে যে যা পারছে না, সেটা নিয়ে বেশি উৎসাহ দিবি না। আমি ওর গান আগে শুনেছি, হারমোনিয়ামের এক-একটা রিড অতি পৃথকভাবে অতিব্যবহিতভাবে ধরেই প্যাঁ-এর পোঁ করবে, আর ‘আলো আমার আলো’ গাইবে। হারমোনিয়ামটা প্যাঁ থেকে সাবলীলভাবে পোঁ-তে যায় না, এত দিন হয়ে গেল। আশা করিস না তোকে ‘ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ শোনাবে। সোজা কথা বলছি— গানটা যে ওর হচ্ছে না, এটাও বুঝতে পারে না, কিম্বা ওর মা আরও বোঝে না। এমন লোককে বেশি উৎসাহ দিয়ে আমি নিজের ধৈর্য বেশিক্ষণ রাখতে পারব না।

এইসব তাত্ত্বিক কথা তখনকার যুবক-মনে তেমন করে ধরেনি, কিন্তু পরে দেখেছি— কথাটার মধ্যে একটা নিষ্ঠুর সত্য আছে। পরবর্তী সময়ে আমি পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীকে এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন— চেষ্টা করাটা খুব বড়ো জিনিস তাতে সন্দেহ নেই, এবং চেষ্টাতে একটা জায়গায় অবশ্য পৌঁছনো যায়, কিন্তু গানের গলা, সুর-তাল-লয়ের বোধ এবং সর্বোপরি যার কানটাই তৈরি নয়, সে কখনও কোনও চরম জায়গায় পৌঁছতে পারে না। তাকে বুঝতেই হবে যে, আমি এই পর্যন্ত পারি, এর বেশি নয়। আর ঠিক এই জায়গাটাতেই আমার একটা প্রশ্ন মনে হয় যে, ‘আমি এই পর্যন্ত পারি’— এটা ক’জন বোঝেন? যাঁরা নিজের এই লিমিটেশন-টা বোঝেন না বা বুঝতে চান না, তাদের সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন যেটা, সেটা কিন্তু আরও আরও চর্চা, শিক্ষা বা আরও উদ্যোগ নয়, বরঞ্চ আরও বিনয়, আরও সংযম এবং আরও নিজেকে চেনার ক্ষমতা। তা নইলে ‘আমি সব পারি’-র মধ্যে যে আত্মসন্তুষ্টি বা অহংকার আছে, তা একটা অলীক আত্মবিশ্বাস এবং আত্মাভিমানের জন্ম দিতে পারে বটে, কিন্তু সিদ্ধি দেয় না।

আসলে সময়টা এখন খুব খারাপ এসেছে, এ-কথাটা আমার মুখে আসতে চায় না, কেননা কোনও সময়ই খারাপ নয়। তাছাড়া কথাটার মধ্যে যেন সেই কলিযুগীয় পুত্রের প্রতি সত্যযুগীয় পিতার সংলাপ নিহিত আছে। আসলে সময় খারাপ হয় না, আমরাই পরিবর্তিত হই। একটা সময় ছিল, যখন এক-একটি ঘরে পাঁচ-ছটি, অথবা নিদেনপক্ষে চার-পাঁচটি ছেলেপিলে থাকত। অর্থনৈতিক কারণে পিতার ব্যস্ততা এবং সামাজিক কারণে মায়ের ব্যস্ততা— এই মানসিকতায় তখনকার দিনে প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ের ওপর পৃথক এবং একক নজর দিয়ে তাকে গড়ে তোলা সম্ভব হত না। আমি অন্তত মনে করি— এই নজরহীনতার কারণেই ছেলেরা অন্তত স্বাধীনতা পেত অনেক বেশি, যাতে তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠত নিজেদের মতো করে। মেয়েদের ক্ষেত্রে অবশ্যই সমস্যা ছিল, এবং স্বাধীনতা কথাটা সেখানে সমস্ত সমাজের মানসিক ব্যাধি। কিন্তু ছেলেরা যেভাবে তৈরি হত, তার একটা খুব বড় উদাহরণ হল— মা-বাবারা আমাদের ভালো পড়াশুনো বা কোনও কৃতকর্মের সামান্যই প্রশংসা করতেন। ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে আসলেও বলতেন— বাঁশবনে শিয়াল রাজা। নম্বরগুলো মোটেই ভালো হয়নি। এই অবস্থায় আমাদের নিজেদের ভালো ভাবার কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু এখন এক-একটি বাচ্চার প্রতি মা-বাবার এত তীক্ষ্ন-দৃষ্টি এবং সন্তানের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য তাঁরা এতই উদগ্রীব যে শেষপর্যন্ত প্রত্যেকটি ছেলে-মেয়েই এখন কলেজ-ইউনিভার্সিটির সময় পর্যন্ত এক ধরনের অহংবাদিতার মানসিক শিকারে পরিণত হয়। অন্যদিকে মা-বাবা এই একক সন্তানদের প্রত্যেককেই এমন পূজার্হ এবং মহার্ঘ মনে করতে থাকেন যে— ওই যে আগে বলছিলাম— চেষ্টাগুলি একসময়ে ভিত্তিহীন অলীক আত্মম্ভরিতায় পরিণত হয়। অথচ নিজেকে যদি চিনে নেওয়া যেত, তাহলে নিজেকে মধ্যমানে স্থাপন করার সাহসটুকুও যেমন থাকত, তেমনই মধ্যম স্থানে থেকেই নিজের কর্মমাহাত্ম্য এঁরা ভালোই প্রকট করে তুলতে পারতেন।

আমার পিতাঠাকুর প্রাচীন একটা নীতিবাক্য উচ্চারণ করে বলেছিলেন— দ্যাখো বাছা! নিজেকে এত বড়ো ভেবে নিজের এবং পরের সমস্যা বাড়িয়ে দিও না। আর ক্ষুদ্র, সাধারণ, মধ্যম বস্তু এই জগতের যত উপকার করতে পারে মহান বড়ো মানুষেরা তা পারে না। নীতিকথার উদাহরণ বলে— এই যে রাস্তার ধারে খানিক খানিক দূরে দূরে কুয়ো তৈরি করা হয়, সেই কুয়োর জলই মানুষের তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে, সমুদ্র যে অত বিরাট, অত অগাধ গভীর তার জল, সে জল কিন্তু তেষ্টা মেটানোর কাজে লাগে না এতটুকুও— প্রায়ঃ কূপস্তূষাং হস্তি সততং ন তু বারিধিঃ। যে ভাবনা নিয়ে কথাটা বলছি, সেটা বোধহয় বোঝাতেও পারছি না। আসলে এটা বাস্তবতার কথা। আমি যদি খুব বড়ো একটা আদর্শ ধরে এগোই— যদি এমন ভাবি যে, কবি যদি হতে চাই, তবে রবীন্দ্রনাথের মতো হব, বিজ্ঞানী যদি হতে চাই তবে আইনস্টাইনের মতো হব, তাহলে কিন্তু খুব বড়ো গাছে মই বাঁধা হয়ে গেল। আমি আজকাল দেখি— একজন গান শেখেন, তিনি বললেন— আমি উস্তাদ অমুক খানের কাছে নাড়া বেঁধেছি। আমি জানি— সেই খান সাহেব মাপে এতটাই বড়ো মানুষ যে, তাঁকে এক মাস আমেরিকা, পনেরো দিন ইংল্যান্ড, দশ দিন ইন্দোনেশিয়া করে পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে হয়। ভারতবর্ষে তাঁকে যতদিন পাওয়া যায়, তাতে একজন নবীশি ছাত্রের পক্ষে তাঁকে সম্পূর্ণ পাওয়া সম্ভবই নয়। তাহলে সে শিখছে কী করে? না, খান-সাহেবের সিনিয়র এক ছাত্র সেই শিষ্যকে সর্বক্ষণের দেখাশোনা করে, আর মাঝেমাঝে সে খানসাহেবের কাছে উৎকর্ষের তালিম পায়। তাহলে আমি যা বলছিলাম তাই হল— গুরুকরণের ক্ষেত্রে, আদর্শ শিক্ষার ক্ষেত্রে জিনিয়াস বড়ো মানুষেরা খুব উপযুক্ত শিক্ষক নন। কেউ যদি ফিজিক্স অনার্স পড়ার জন্য আইনস্টাইনের কাছে টিউশন নিতে চান, তাতে ফলটা ভয়াবহ হবে বলেই আমার ধারণা। কাজেই অজস্র মধ্যম মানের মানুষেরাই মানুষের সবচেয়ে বেশি উপকারে লাগেন, হয়তো ব্যক্তিগত স্তরে অনেকানেক ব্যক্তিকে তাঁরা এই উপকার করতে পারেন। কুয়োর জলে অনেকের তৃষ্ণা নিবারণ করার মতো।

কথাটা খুব ভালো বুঝেছিলাম, একজন বৈষ্ণব গুরুর কাছে। তিনি নিজে বড়ো স্নিগ্ধ কৃপালু গুরুঠাকুর ছিলেন। নিজের ইষ্টদেবতা রাধারমণের সেবা করতেন পূর্ণপ্রাণে। পুজোর ফুল তোলা থেকে মন্দির-মার্জন তিনি নিজের হাতে করতেন। এই ভক্তিপ্রাণতায় তাঁর দু-চারটি শিষ্যও জুটে গিয়েছিল। তাঁর শিষ্যরা কেউই খুব অভিজাত ছিলেন না। কিন্তু গুরু যেভাবে তাঁদের ভজন-সাধনের নিয়মে আবদ্ধ করেছিলেন সেগুলি তাঁরা পালন করতেন যথাসাধ্য যথামতে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, সেইসব শিষ্যদের ত্যাগ-বৈরাগ্য অভ্যাস ছিল, এবং তাঁরা পরম আনন্দে গুরুর সান্নিধ্য উপভোগ করতেন। দিন চলছিল, সাধুবাবার সাত্ত্বিক জীবন চলছে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর পথ ধরে। এরই মধ্যে এক অভিজাত ধনী মানুষকে সেই সাধুবাবার কাছে আনাগোনা করতে দেখলাম। তিনি বিশালাকার প্যাকেটে সন্দেশ মিষ্টি নিয়ে আসেন ঠাকুর-সেবার জন্য। ঠাকুরের বিবর্ণ চামর দেখে নতুন রুপোর ডাঁটের চামর কিনে দেন। সাধুবাবা স্নিগ্ধ মানুষ, প্রথম দিকে সকলের মধ্যে ফল-মিষ্টি বিতরণ করে, ঠাকুরের পাশে মহার্ঘ চামর দুলিয়ে আরতি করতে লাগলেন। এরপর একদিন বোধহয় ঝুলন উৎসবের আগের সন্ধ্যা। সাধুবাবার এক গোবেচারা শিষ্য সেই ধনী মানুষটিকে বলল— কালকে রাধাকৃষ্ণের ঝুলন মহোৎসব। ব্যস! আর কিছু বলতে হল না। ধনী মানুষটি ঝুড়ি ভর্তি ফুলের মালা এনে দিলেন। পাঠিয়ে দিলেন সুগন্ধি চাল, ডাল, মিষ্টি।

এই দিন দেখলাম— স্নিগ্ধ সাধুবাবা, ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। যিনি কোনওদিন রাগ করেন না, তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে শিষ্যদের বললেন— তোমাদের আর আসতে হবে না এই গুরুবাড়ি। তোমরা নিজেদের উঠোনে পোঁতা গাছ থেকে ফুল তুলে আনতে পারছ না, নিজেরা মালা গেঁথে রাধারানীর কুঞ্জ সাজাতে পারছ না, এখানে বড়োলোকের পয়সায় তোমরা বসে খাও, আমি এই মন্দির ছেড়ে চলে যাব। শিষ্যেরা গুরুর পায়ে পড়ল, আর কোনওদিন ঠাকুর সেবার জন্য বড়লোকের মুখাপেক্ষী হবে না বলে অঙ্গীকার করল। গুরু বললেন— কাল সকালে উঠে খোল-করতাল নিয়ে কীর্তন করতে করতে সাধারণ মানুষের ঘরে ভিক্ষা করতে যাবে। যিনি যা দেবেন সাদরে গ্রহণ করবে, আর যিনি এতটুকুও দেবেন না তাঁকে আমার রাধারমণের লীলাগান শুনিয়ে আসবে।

পরের দিন ভিক্ষার চালে খিচুড়ি পাকিয়ে উৎসব হল, বড়লোকের চাল ডাল পড়ে রইল এক কোণে। সেই বড়লোক এলেন উৎসবে যোগ দিতে, তাঁকে ভিক্ষান্ন প্রসাদ দেওয়া হল। বড়লোক বললেন— সাধুবাবা, আমার চাল-ডাল-মিষ্টি আপনি গ্রহণ করলেন না? সাধুবাবা বললেন— আমার মন্দির এই এত মহার্ঘ দানের যোগ্য নয়, বাবা! এই দানের জন্য আরও বড় স্থান আছে, তুমি সেইখানে এইসব পাঠাও বাবা। ভালো হবে। আমার মন্দিরে এত সব জিনিস দিলে আমার গোবেচারা শিষ্যেরা সব ভোগী হয়ে পড়বে, ভগবানের সেবাসুখ আর ওদের কপালে জুটবে না। সাধুবাবা সেই তথাকথিত বড় সাধুর ঠিকানা দিলেন ধনীকে। পশ্চাৎ পশ্চাৎ আমিও দেখতে গেলুম সেই বড় সাধুবাবাকে। দেখলুম— তাঁর ঠাটবাট এক্কেবারে আলাদা। তিনি যথেষ্ট উচ্চচূড়ে থাকেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করাটাও অত সহজ নয়। অদ্ভুত মনোমোহিনী কথা বলতে পারেন তিনি, যেমন ইংরেজি বলেন তেমনই বাংলা। সবচেয়ে বড়ো কথা, তাঁর মুগ্ধ করার ক্ষমতা। তিনি যদি কৃপা করে কথা বলেন, তবে সে মানুষ মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। আমাদের সেই ধনী মানুষ তাঁর কাছে চাল-ডাল নিয়ে গেলেন, ধনী বলেই তাঁর কথা বলার সুযোগও আসল তাড়াতাড়ি, সেখানেই তাঁর দীক্ষা হল। তিনি এখন গুরুমশায়ের জন্য ফ্রেঞ্চ পারফিউম নিয়ে যান। গুরুমশাই বলেন— এটা নাকি গন্ধ-সেবা, অর্থাৎ সুগন্ধি-দানের মাধ্যমে এই গুরুসেবা চলছে।

আমি দেখে-শুনে একদিন, মানে, বেশ কিছুদিন পর একদিন বিরলে আমার পূর্বোক্ত স্নিগ্ধ-সাধুবাবাকে শুধোলাম— আপনি ধনী মানুষটাকে ওখানে পাঠিয়ে দিলেন কেন? উনি আরও বড় সাধু? স্মিত হেসে তিনি বললেন— উনি বড়ো না ছোটো আমার জানার দরকার নেই। তবে কিনা এইসব উৎকৃষ্ট দান ওরই উপযুক্ত, উনি হজম করতে পারেন। আমি তো হজম করতেই পারি না। আমার অতি সাধারণ, কটি অনুগামী আছে, আর আমি আছি। আর আমার ঠাকুরটাও ভিখারি, আমাদের কাছে চেয়ে চেয়ে খায়। আমাদের দ্বারা কি বড়ো কাজ হয়, বাছা! আর ওদের দ্যাখো। কত বড় বড় মানুষ আসছেন ওঁর কাছে— মানুষটার মধ্যে কিছুই না থাকলে এমনিই কি সেখানে ভিড় হয়। আমি বললাম— উনি তো শিষ্য করেন কত শত, পরে উনিই এঁদের চিনতে পারবেন না। তিনি শুনে বললেন, উনি দীক্ষার জল ছিটিয়ে মন্ত্র দিয়েছেন, শিষ্যের আধার যদি ভালো হয় ওই মন্ত্রই সে ধরে নেবে, বাবা। শুনেছ না, বলেছেন কবি…। আমি বললাম— থাক আর বলতে হবে না। তিনি বললেন— আরে রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি সাধারণ মানুষ নিয়ে থাকি। এইসব বোকাসোকা লোকেরা কত জ্বালা-যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে ঠাকুরের কৃপা পেতে চায়। আমি তাদের শেখাই— ঠাকুরের কাছে কিছু চাস না বাবা। বরঞ্চ এই চাওয়াটা যাতে বন্ধ হয় সেটাই ঠাকুরের কাছে চেয়ে নে।

আমি বুঝলাম— সাধুবাবা কত বড় কাজ করছেন। এই মানুষটি সাধারণ মানুষের যে উপকার করছেন, বড় মানুষ, বড় দার্শনিক সাধুদের দিয়ে তা হবে না। লক্ষ্য করে দেখুন, বাসে-ট্রেনে যখন কারও শরীর খারাপ হতে দেখি তখন ওই সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আকুতি দেখি, তাদেরই একজন/ দু’জনকে যখন হাসপাতালে ছুটতে দেখি, তখন বুঝি কত প্রাণ এঁদের মধ্যে কত ভালোবাসা রাস্তায় শত শত গাড়ি সবেগে চলে যায়, কিন্তু রাস্তায় হঠাৎ পড়ে যাওয়া একটা মানুষের জন্য তাঁরা হঠাৎ করে গাড়িটি থামান না। তাঁরা প্রস্থান করেন এবং দিনের শেষে স্ত্রীর কাছে গিয়ে সেই একটা লোকের হঠাৎ পতনের গল্প শোনান সাড়ম্বরে। আমার শুধু মনে হয়— এই ‘হঠ’ শব্দটা খুব খেয়াল করে দেখা উচিৎ। ‘হঠ’ মানেই যেন কোনও বিচার-বিবেচনা না করে বোকার মতো ঝাঁপিয়ে পড়া। ঠাকুমা থেকে হিতৈষী সব সময় বারণ করেন হঠকারিতা করা উচিত নয়, তাতে বড়ো ভোগান্তি হয়। আমি শুধু বলি ‘হঠাৎ’ এবং ‘সহসা’ শব্দের যদি কোনও উপযোগ না থাকত, তবে এই পৃথিবী বঞ্চিত হত অর্ধেক সুন্দর এবং অর্ধেক আনন্দ থেকে। যদি হঠাৎ দেখা না হত তার সঙ্গে তবে পৃথিবীর নিরানব্বই শতাংশ উপন্যাস তৈরি হত না। আর যদি ‘সহসা’ অথবা সহসা থেকেই তৈরি সাহস শব্দটা না থাকত, তাহলে পৃথিবীর সমস্ত রোমাঞ্চকর কাহিনি অথবা অর্ধেক সাহসিক সত্য ঘটনা থেকে আমরা বঞ্চিত থাকতাম।

মাঝে মাঝে আমি অবশ্যই ভাবি যে, সত্যিই হঠাৎ কোনও কাজ করা উচিত কিনা, করলে তা খারাপও হতে পারে। উত্তরে বলি— পৃথিবীতে এমন অনেক কাজই আছে, যা হঠাৎই করতে হয়, তখনই করতে হয়। একজন জলে ডুবে যাচ্ছে দেখেও যে পাড়ে দাঁড়িয়ে করণীয়তা সম্বন্ধে ভাবতে বলে, সে খুব বড়ো ভাবুক হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু এই ভাবুকতা কারও কোনও কাজে লাগে না, আর নিজের কাজেও লাগে না। আমার মনে আছে, কোনও এক বিষম মুহূর্তে আমি জমি কেনার জন্য কলকাতার প্রান্তদেশে একটি জায়গায় গিয়েছিলাম। জমিটা দেখে পছন্দ হচ্ছিল না; অনুযোগও করছিলাম— বাস-রাস্তা থেকে এটা অনেক দূরে, যা যা প্রাকল্পিক উন্নতি হবার কথা তা হবে কিনা, এখান থেকে কী করে যাতায়াত করব ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকক্ষণ পর জমির দালাল একটা খুব ভালো কথা বলল। বলল- স্যার! যে দামে আপনি যে জমি কিনছেন এটা যথেষ্টই ভালো। এ অঞ্চলে জমি আর পড়ে নেই। পাঁচ বছর পর যখন রাস্তাঘাটের উন্নতি হবে, তখন যদি এখানে আসেন তখন আরও পাঁচ মাইল, দূরে জমি কিনতে হবে আপনাকে, আর এখানেই যদি পাঁচ বছর পরে কেনেন তো পাঁচগুণ বেশি দাম দেবেন আপনি। কাজেই বেশি ভাববেন না। না ভেবে কিনুন।

আমি জমিটা কিনিনি, কিন্তু যাঁরা কিনেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই না ভেবেই কিনেছেন অর্থাৎ হঠাৎ করেই কিনেছেন, সাহস করেই কিনেছেন, অবশেষে ভীষণ লাভবানও হয়েছেন। আসলে আমি বুঝি— হঠাৎ করে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের ওই হঠাৎ-এর মধ্যে চিন্তা করার প্রক্রিয়াটাও খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়, ডুবন্ত লোককে উদ্ধার করার জন্য তাঁদের চিন্তাশক্তিটা মুহূর্তেই কাজ করে। প্রায়োরিটির বোধ এবং নিজের সাঁতার কাটার ক্ষমতা ছাড়া অন্য কোনও বিষয় তাঁরা চিন্তার পরিধির মধ্যে আনেন না। খুব ভালো কাজের ডিসিশন এবং খুব খারাপ কাজের ডিসিশন খুব তাড়াতাড়িই নিতে হয়। হয়তো এতে খারাপও হতে পরে কখনও। সজ্জন পণ্ডিতজনেরও খারাপ হতে পারে— এ-কথা খুব ভালো বলেছেন একজন কবি। বলেছেন— দ্যাখো বাপু! সম্পদও বড় মানুষের হয়, বিপদও বড় মানুষেরই হয়। অনেকটা চাঁদের মতো; যখন কলায় কলায় বাড়তে থাকে তখন নিশ্চিন্তে বাড়ে, আবার প্রতিদিনের কলাক্ষয়ে ক্ষইতে থাকে, তখন সে নিশ্চিন্তেই ক্ষীণ হয়ে যায়। আকাশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তারার এ-সব ঝামেলা নেই। বড় মানুষের জীবনে তাই সম্পদও আছে বিপদও আছে— সম্পদো মহতামেব মহতামেব চাপদঃ। দুর্জন বদমাশ লোকের বিপৎপাতের সঙ্গে মহৎ-সজ্জনের বিপৎপাতের পার্থক্যটা এই যে, মহান ব্যক্তি এক অন্যতর তুষ্টিতে ভোগেন। বিপদটা অন্যের কারণে ঘটেছে এবং মহাদুপকার করতে গেছেন বলেই বিপদটা হয়েছে বলে একটা পরম তুষ্টির পথ খোলা থাকে। প্রাচীনদের একটা নীতিশ্লোক বলে— বড় মানুষের স্বভাবটাই ওইরকম, আপদকালেও তাঁরা স্বভাব ছাড়েন না, বরঞ্চ পরের কাজে নিজেকে লাগিয়ে আরও জ্বলে ওঠেন— ঠিক যেমন কর্পূর, নিজেকে আগুনে দগ্ধ করার সময় আরও দ্বিগুণ জ্বলে ওঠে এবং সেই কর্পূরের গন্ধ যেন এক তীব্রতর সুগন্ধ বয়ে নিয়ে আসে— সেটাই বড়ো মানুষের স্বভাবগন্ধ— কর্পূরঃ পাবকস্পৃষ্টঃ সৌরভং লভতেতরাম।

আমি হঠাৎ এর কথা বলতে বলতে ভালো মানুষের কথায় চলে এসেছি। চলে এসেছি এই কারণে যে, সেদিন একটি মানুষকে আমি স্বচক্ষে রেলে কাটা পড়তে দেখলাম। লোকটি এমনভাবেই পড়েছে যে, তার পা-টা চলে গেছে লাইনের চাকার তলায় আর দেহটা বাইরে। বারংবার অনন্ত চাকার তলায় পিষ্ট হতে হতে তার পাটা আলাদা পড়ে রইল। লোকটা যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে অজ্ঞানের মতো হয়ে গেলেও সে নড়ছে অর্থাৎ প্রাণ আছে। ট্রেনটা থামল, গার্ড-সাহেবও সৌজন্যবোধে একবার নামলেন— সবটাই যেন এক লোকান্তরে প্রস্থীয়মান মানুষের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন জমে গেল, সব মানুষ দেখছে, নানান বিচার করছে, কেন লোকটা দৌড়ে পার হতে গেল, কেনই বা ট্রেনের গতি একটু কমানো গেল না; অন্যতরেরা বলছে— রেলের কাটা বাবা! স্পর্শ করা যাবে না। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিস মার্ডার কেস সাজিয়ে দেবে। রেল পুলিশ আসবে তারপর নিয়ে যাবে হাসপাতালে।

আমি ভাবলাম— লোকটাকে মরার জন্য কত সুন্দর প্রবহমান একটা সময় আমরা দিতে পারি! ভিড়ে সামনে এগোতে পারছি না, সকলে দেখছে, কিন্তু কেউ কিছু করছে না। আমি চেঁচাচ্ছি— লোকটাকে তাড়াতাড়ি তুলে হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করুন, এখনও প্রাণ আছে। সকলে বলল— সে হবে না গো বাবু! ‘এলে’ কাটা। এরই মধ্যে দেখলাম— এক শক্ত পোক্ত জোয়ান যুবক এলোপাথারি হাত চালিয়ে লোক সরাল। বলল— ধর একজন আমার সঙ্গে, পুলিশ-ফুলিশ পরে হবে, ধর শালা! আমি বললাম— দাঁড়াও, আমি আসছি। সে বলল— আপনার দ্বারা হবে না— বলেই সামনের আরেকটা লম্বা ছেলেকে বলল— ধর শালা! সব পরে বুঝে নেব। সেই ছেলেটি ‘শালা-শুয়োরের বাচ্চা’ ইত্যাদি বলে একটা ট্যাক্সিও থামাল এবং সেই অর্ধ-কতিত পা-টি সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে চলে গেল। ভিড় ছড়িয়ে গেল, যে যার গন্তব্যস্থলে চলে গেল এবং আমিও… কাপুরুষের মতো। অবশ্য আমার পক্ষে পিছু নেওয়াও সম্ভব ছিল না।

দু-চারদিন পরে সেই ছেলেটির সঙ্গে আমার দেখা হল। জিজ্ঞাসা করলাম— তুমিই তো ভাই দেবদূতের মতো নেমে এসেছিলে সেদিন। তা লোকটাকে যে নিয়ে গেলে কী হল সেদিন? ছেলেটি বলল— লোকটা বেঁচে গেছে, ওকে পরে একটা নকল পা দেবে, লোকটা চাকরি করে, সে চাকরি করতে পারবে। আমি বললাম— তুমি যে কত বড় কাজ করেছ তুমি নিজেও জানো না। ছেলেটি বলল— বহোত হুজ্জুতি হয়েছে, স্যার! একে তো রেলে কাটা, আর রেল তো জানেন— শালা আসবে লেটে, যাবে লেটে, লোককে মারবেও লেট করিয়ে। আর হাসপাতালও সেইরকম জায়গা। বলে— রেলে কাটা, রেলের হাসপাতালে যাও, নইলে পুলিশ আসুক, ডাইরি লিখুক, তারপর। তো আমি লোক জুটিয়ে বাওয়ালি করলাম, লাইন থেকে রেলে কাটা মানুষকে তুলে নিয়ে যাবার লোক পাইনি বটে, কিন্তু বাওয়ালি করার লোক পাওয়া যায়। সেটা পেয়ে গেছিলাম বলেই লোকটা বেঁচে গিয়েছে।

এই ছেলেটির ভাষার মধ্যে কিছু অপরিশীলন থাকতে পারে এবং আমাদের যা করুণ প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং ততোধিক করুণ নিয়ম নামাবলী, তার মধ্যে এই ছেলেটির কর্মপ্রক্রিয়া তাৎক্ষণিক দৃষ্টিতে আমার মতো ভদ্রলোকের নাসিকাও কুঞ্চিত হতে পারে হয়তো, কিন্তু ভেবে দেখুন তো সেই হঠ মুহূর্তের ক্ষণটুকু যখন সকালে রেল-লাইনে দাঁড়িয়ে একটি কর্তিত-পদ প্রায় অজ্ঞান মানুষকে দেখছিল আর বিচার করছিল; ভেবে দেখুন তো হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সেই আইন-গম্ভীর পরামর্শ এবং এই ছেলেটির তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া— আপনি চিকিৎসা করুন, কাউকে পুলিশ ডাকতে বলুন, আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি— এই সমস্ত কিছুর মধ্যে একটা ‘সহসা’ আছে বলেই, একটা সাহস এবং হঠকারিতা আছে বলেই এটা হঠাৎ হাওয়ায় বয়ে আনা সেই সুসংবাদ— লোকটা বেঁচে গেছে, স্যার! আমি জিজ্ঞাসা করি— ক্ষণজন্মা শব্দটার মানে কী?

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন