নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
আপনারা আমায় মার্জনা করুন। তথাকথিতভাবে আমি অন্যায় কথা বলছি, আপনারা কেউ যেন আমার সঙ্গে একমত হবেন না। তাই বলে আমি যে ব্যতিক্রমী খুব, তাও নয়। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় রজত নামে বাইশ বছরের ওই ছেলেটির সঙ্গে দেখা হবার পর থেকেই আমার এই স্বপ্পবোধ তৈরি হয়েছে যে, ভারতবর্ষে ‘গণতন্ত্র’ বলে মধুরভাবে প্রত্যয়িত যে শব্দটি চলে আসছে, সেটা নিতান্তই জুয়াচুরি কথা। রজত একজন প্রখ্যাত পার্টিকর্মী। কোন পার্টি জিজ্ঞাসা করবেন না; কেননা, আমার স্বপ্নবোধে সব পার্টিই সমান— সাধ্য বস্তুতে মৌল তফাৎ থাকতে পারে, সাধন সকলেরই একরকম। (ধর্মঘট বন্ধ হবার উদ্যোগে সকল পার্টির রা অথবা রায় শুনেছেন তো বটে।) রজত পার্টির বশংবদ হওয়া সত্ত্বেও ইদানীং ‘স্টোন-চিপস সাপ্লাই’-এর কাজে বেশ কিছু টাকা করে ফেলায় সে অন্য অধম এবং অধমাধম ব্যক্তিদের বিষ নজরে পড়েছে এবং যথোচিত কান-ভাঙানির ফলে দাদা-স্থানীয় নেতাদেরও নজর তার ওপর তেমন শুভ নয় এখন। রজত বলে— সে খাচ্ছে অথচ অন্যেরা তেমন করে খেতে পারছে না বলেই সকলের সেই ক্রোধাবেশ। আমি বললাম— তুমি যদি রাজতন্ত্রে রাজা বা মন্ত্রীর সেবক হতে, রজত! তাহলে একজন কী দুজনকেই সন্তুষ্ট রাখলে তোমার চলে যেত, কিন্তু গণতন্ত্রের সেবক হওয়া মানে তোমাকে অনেককে তুষ্ট রাখতে হয়। এটা সত্যিই বড় জ্বালা।
আসলে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র যা দেখছি, তা যে রাজতন্ত্রের চেয়ে কিছু অংশেই উন্নত নয়, সে-কথা আমি হলফ করে বলতে পারি; হয়তো বা সেই কারণেই ‘রাজনীতি’ কথাটাই এখনও চলে এবং সেই কারণেই সেকালের রাজসেবকদের চেহারা তথা ব্যবহারের সঙ্গে এখনকার দিনের পার্টিকর্মী, পুলিশ, ছাত্র, শিক্ষক এমনকী উচ্চপদে অধিষ্ঠিত সরকারি কর্মী অথবা একজন কলেজের অধ্যক্ষকেও মাঝে মাঝে অতি হীন সেবকের মতো লাগে। আমার পিতাঠাকুর শিক্ষক ছিলেন, তিনি বলতেন— শিক্ষকের শিরদাঁড়া সোজা থাকবে, তিনি রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন, দশটা লোক তাঁকে শ্রদ্ধা জানাবে ওই শিরদাঁড়ার ঋজুতার কারণেই। কিন্তু শিক্ষক যদি সেবক হয়ে ওঠে, তবে সেই সমাজের মেরুদণ্ডই ভেঙে যাবে। আমার ধারণা— ঠিক তাই হয়েছে এখন।
আপনারা তো মনু-মহারাজের নাম শোনামাত্রই তাঁকে গালাগালি দেন। তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদী, তিনি জাত-পাতের সংরক্ষক, তিনি স্ত্রী লোকের অধিকারে বাদ সেধেছেন ইত্যাদি আরও আরও কত শত নিন্দা-শব্দ তাঁর সম্বন্ধে প্রচলিত। তবু বলি— ভারতবর্ষের সমাজ জীবনের চলমান ধারা সম্বন্ধে মনু এমন অনেক কথা বলেছেন যা আজও বড় সত্যি, বড় বাস্তব। মনু তো রাজতন্ত্রের নিরঙ্কুশ সমর্থক এবং সে বিষয়ে তাঁর কোনও লজ্জা-দ্বিধা নেই, কিন্তু রাজনীতির চক্কর এবং রাজনৈতিক শক্তি যে গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্রকেও নিতান্তই গোষ্ঠীতন্ত্রে পরিণত করে, সেটা বোঝার বুদ্ধি তাঁর ছিল বলেই একটা দামি কথা উনি বলেছিলেন। মনু বলেছিলেন রাজা যদি বয়সে ছোটও হন বা নিতান্তই অল্পবয়সি হন তবু তাঁকে যেন কখনও সাধারণ মানুষ মনে করে অপমান-অবহেলা কোরো না বাপু। রাজা ছোটো হোক, বড় হোক, জানবে ওটা দেবতার জাত, তুমি তাঁকে শ্রদ্ধা করবে, মেনে চলবে দেবতার মতো। আপনারা তো নিশ্চয়ই বলবেন— এই তো সব সামন্ততন্ত্রী কথা— রাজার ঐশ্বরিক সত্তায় বিশ্বাসী লোকের কথা। আমি বলি বাদ দিন এসব পুরোনো কথা। কিন্তু আজকের দিনে আমি তো দেখেছি সব মন্ত্রীপুত্র, নেতা-নেত্রীদের সন্তানকুল। তাঁরা কি রাজপুত্রদের চাইতে কিছু কম? শিক্ষক থেকে আরম্ভ করে হাসপাতালের ডাক্তার তাদের কতটা বেশি খাতির করেন, সে আমি দেখেছি, এমনকী পুলিশ তাঁদের প্রতি কতটা বেশি প্রশ্রয়দাতার স্নেহ বিকিরণ করেন, তাও আমি দেখেছি। আমার জিজ্ঞাসা— তাহলে মনু ভুল বললেন কোথায়? এটা কি সামন্ততন্ত্রের কথা, নাকি চিরকালীন বাস্তব, যা এখনও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
মনু বলেছিলেন— রাজা আর আগুনের মধ্যে যদি তুলনা করো, তাহলে বলব— আগুন অনেক ভালো। কেননা ভুল করে যে আগুনে হাত দেয় বা আগুনের কাছে যায়, তবে আগুন সেই লোকটার হাত পা অথবা সম্পূর্ণ তাকেই শুধু পোড়ায়— একমেব দহত্যগ্নি-র্নরং দুরুপসর্পিণম। কিন্তু একবার যদি রাজার কোপে পড়ো, তবে সেই কোপের আগুন থেকে সেই মানুষটার মা-বাপ, ভাই-বোন, ঘর-বাড়ি সম্পত্তি সব যাবে— কুলং দহতি রাজাগ্নিঃ সপশুদ্রব্যসঞ্চয়ম। কথাটা কি আজকেও সমান সত্য নয়? মন্ত্রী কিংবা বড় বড় নেতাদের কথা রেখে দিন, পাড়ার যত ছোটো বড় দাদাপ্রতিম নেতা আছেন একবার যদি তাঁদের কোপে পড়া যায় তাহলে বাপ-মায়ের হৃদয়ে ত্রাসের সঞ্চার হয়। বাড়ির লোকজন ভয়ে কাঁপে, বোন রাস্তায় বেরোলে টিটকিরি, অবশেষে ঘরবাড়ি তছনছ। আমি কংগ্রেসের আমলে আমার বামপন্থী বন্ধুদের বাপ-মায়ের হেনস্থা চাক্ষুষ দেখেছি, বহু ছোটো ভাইকে, বহু যুবক ছেলেকে ঘরছাড়া হতে দেখেছি, দেখেছি তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি তছনছ হয়ে গেছে। আবার বামপন্থী রাজত্বে তাঁদের বিরুদ্ধ রাজনীতির কর্মীদের অবস্থাও দেখেছি। কোনও তফাৎ নেই। এক জায়গায় এসে সেই মনুর কথাটাই পরম বাস্তব হয়ে ওঠে। আমি বলে থাকি— রাজতন্ত্রে শুধু মন্ত্রী অমাত্য-সেনাপতি অথবা রাজার শালাকে আমল দিতে হত, কিন্তু আমাদের গণতন্ত্রের ছোট-বড়-মাঝারি, যে কোনও প্রকারের নেতাদের (যখন যে পার্টি রাজত্বে আছেন) যদি একবার ক্ষেপিয়ে তুললেন, সেটা নীতির চোখে যতই যথাযথ হোক, তারপর আপনার বাপ-মা-ভাই-বোন এবং আপনার বাড়ি-ঘর এবং আপনি নিজে কোথায় দাঁড়িয়ে থাকবেন, সেটা অকল্পনীয় অথবা যথেষ্টই কল্পনীয়।
এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধের মধ্যে আমি কোনও কথাই বড়ো করে বলতে চাই না। কেননা রাজতন্ত্রের রাজাদের সমস্ত বদগুণ যেভাবে গণতন্ত্রী তথা সমাজতন্ত্রী নেতাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে তার ‘লিস্টি’ বানাতে গেলে এই প্রবন্ধ ভারি হয়ে যাবে। আমি শুধু সামান্য ভণিতার শেষে দেখাতে চাই— বড়ো-ছোটো-মাঝারি নেতারা আপন আপন দুর্গে তাঁদের আশ্রিত জনের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে ঠিক রাজার মতোই ব্যবহার করেন, আবার পরোক্ষে যাঁরা এইসব নেতাদের কৃপাপ্রার্থী তাঁদের চেহারাটাও কেমন সেকালের রাজসেবকদের মতো, সেটাও একটু বর্ণনা করতে ইচ্ছা করে।
আমি একটি ক্ষুদ্র সমাবেশে এক মাঝারি নেতাকে দেখেছিলাম। তিনি সরকারে অধিষ্ঠিত পার্টির অন্যতম নেতা। আবার আমি একটি কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদককে সাধারণ ছাত্রদের ওপর কৃপাবর্ষণ করতে দেখেছি। দুই জনেরই আচার ব্যবহার রাজার মতো। কেমন ব্যবহার, সেটা মহাকবি বাণভট্ট লিখেছেন তাঁর কাদম্বরী-গদ্যকাব্যে। বাণভট্ট মহারাজ হর্ষবর্ধনের রাজসভার কবি। রাজার অনেক দাক্ষিণ্য লাভ করা সত্ত্বেও মহাকবির নিরপেক্ষ হৃদয় তাঁর মধ্যে অস্থির থাকায় পারিপার্শ্বিক মানুষ এবং সামন্ত রাজাদের তিনি দূর থেকে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। এখনকার অনেক নেতার মধ্যে এই সামন্তরাজচরিত্র দেখতে পাই বলেই বাণভট্টের কথাটা এখনও তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। বাণ লিখেছেন— এমন অনেক রাজা আছেন যাঁরা রাজা হবার পরেই (আমার মতে নেতা হবার পরেই) অর্থগৃধ্নতায় এমন করতে থাকেন, ঠিক যেমন শকুন মাংসখণ্ড দেখলে করে থাকে। এদের ‘কালচার’ বলে কোনও বস্তু নেই— পদ্মদলের মাঝখানে যদি বক এসে বসে, তাহলে পদ্মিনীর যে অবস্থা হয়, ভদ্রসভায় এরা সেইরকম।
সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের অন্যায় অনাচারগুলি এরা কেমনভাবে তুলে ধরে তার উদাহরণ দিয়ে বাণভট্ট লিখেছেন— এই সব ধূর্ত রাজারা (নেতারা) যদি জুয়ো খেলেন, তবে মানুষকে বোঝাবে যেন অনেক পরিশ্রমের পর একটু আমোদ করছেন, পরস্ত্রী গমন ব্যাপারটা এঁদের চতুরতার পরিচয়, মদ্যপান করাটা সামান্য একটু বিলাস, কোনও বিষয়েই সাবধান না হওয়াটা এঁদের বীরত্ব বা সাহসিকতার পরিচয়, নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে থাকাটা এঁদের কাছে অনাসক্তি বা বৈরাগ্যের চিহ্ন, বড় মানুষ বা গুরুস্থানীয় মানুষের উপদেশ অগ্রাহ্য করাটা এঁদের কাছে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা বলে গণ্যহয়; তাঁদের অনুচর-ভৃত্যেরা যে স্বাধীনভাবে চলে, সেটাকে এই রাজারা মনে করেন যেন তাদের সুখে সেবা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নাচ-গান-বেশ্যায় আসক্তি এঁদের রসিকতাবোধের উপাদান। নিজের লোকের গুরুতর অপরাধ শুনেও সেটা অবহেলা করাটাই এঁদের কাছে মহাপ্রভাবশালিতা বা ক্ষমতা দেখানোর উপায়, অন্যের তিরস্কার সহ্য করছেন মানে তাঁদের এঁরা ক্ষমা করছেন। স্বেচ্ছাচারিতাই এঁদের কাছে প্রভুত্ব, চিরন্তন স্তুতিপাঠকের প্রশংসাই এঁদের কাছে যশ, এঁরা যে চাপল্য প্রকাশ করেন সেটাই এঁদের উৎসাহগুণ, সূক্ষ্মভাবে কাজের পর্যালোচনা না করে কাজে নেমে পরাটাই এঁদের কাছে পক্ষপাতহীন আচরণ।
বাণ লিখেছেন— এইভাবে অসংখ্য দোষগুলিকেই নিজেদের গুণ হিসেবে আরোপ করে এইসব রাজারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারণা করেন। ক্ষমতা এবং ঐশ্বর্য এইসব ধূর্ত রাজাদের (পড়ুন নেতাদের) এমন পাগল করে তোলে যে, সাধারণ মানুষকে দর্শন দেওয়াটাকেই এঁরা অনুগ্রহ বলে মনে করেন, কারও প্রতি দৃষ্টিপাত করাটাকেও এঁরা উপকার করছেন বলে মনে করেন, কারও সঙ্গে আলাপ করলে এঁরা ভাবেন যেন সম্পত্তি ভাগ করে দিলেন, আদেশ করলে মনে করেন যেন বর দিলেন, তার ওপরে এঁরা যদি কারও অঙ্গ স্পর্শ করে আত্মীয়তা প্রকাশ করেন, তাহলে ভাবেন যেন পবিত্র করে দিলেন সেই মানুষটাকে— দর্শনপ্রদানমণি অনুগ্রহং গণয়ন্তি বৃষ্টিপাতমপি উপকারপক্ষে স্থাপয়ন্তি, সম্ভাষণমপি সংবিভাগমধ্যে কুর্বন্তি, আজ্ঞামপি বরপ্রদানং মন্যন্তে, স্পর্শমণি পাবনম আকলয়ন্তি।
এই তো রাজতন্ত্রের বহুতর রাজার চেহারা, ওপরের বাণভট্টীয় অনুচ্ছেদ থেকে দু-একটি বাদ দিলে (যেমন নৃত্য-গীত, জুয়ো, বেশ্যা— কেননা আজকের মিডিয়ার চাপে এগুলি প্রকাশিত হতে পাঁচ মিনিট লাগবে, আর ঠিক সেইজন্যই এ-সব ব্যসন থেকে নেতারা প্রকটভাবে অন্তত দূরে থাকেন) আর সমস্ত রাজতান্ত্রিক দোষ গণতান্ত্রিক নেতাদের মধ্যে এসে পড়েছে। কারণ, সেই ক্ষমতা, সেই ঐশ্বর্য, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রীয় নিয়ম— যে সিঁড়ি বেয়ে তুমি ওপরে উঠেছ, ওপরে উঠেই সে সিঁড়ি ফেলে দাও। সিঁড়ি ফেলে দেবার মানে আর যেন কেউ ওই পদের দাবিদার না হতে পারে এবং যাদের ওপর নির্ভর করে ওপরে ওঠা তাদের ভুলে যাওয়া। গণতন্ত্রের নেতারা পদে এলেই পুরাতন স্মৃতি ভুলে যান।
পদে বসে থাকা গণতান্ত্রিক নেতারা যে ঠিক রাজার মতোই ব্যবহার করেন তা আমরা সাধারণ মানুষেরা হাড়ে হাড়ে বুঝি। আমাকে একবার কলকাতার বর্তমান মেয়র সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে হয়েছিল আমার কলেজের ট্যাক্স কমানোর প্রয়োজনে। আমার সঙ্গে আমার কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, ছিলেন আর দুই অধ্যাপক বন্ধু। মেয়র নিজে সাড়ে বারোটার সময় দিয়ে, এলেন আড়াইটের সময়। সে যাক, বড় বড় মানুষেরা এমনটা করে থাকেন। কিন্তু তাঁর ঘরে ঢোকার আগে তাঁর পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং তাঁর অন্যান্য পরিষদবর্গের যে তেজ দেখলাম, তাতে আবারও সেকালের রাজতন্ত্রের কথা মনে হল। মনে পড়ল মহামতি বাণভট্টের কথা।
বাণভট্ট নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন হর্ষচরিতে। হর্ষবর্ধনের সঙ্গে দেখা করতে যাবার আগে বাণভট্টের যেমন লাগছিল আমার গণতন্ত্রের মেয়র-সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময়েও একই রকম লাগছিল। যে-সব সুবিধে থাকলে রাজার সঙ্গে দেখা করার সুবিধে হয়, সেগুলি যে গণতন্ত্রের নেতাদের সঙ্গে দেখা করার সময়েও প্রযোজ্য, তা বাণভট্টের বয়ান শুনলেই বোঝা যাবে।
বাণের সঙ্গে মহারাজ হর্ষবর্ধনের কোনও পূর্বপরিচয় ছিল না। তাঁকে রাজার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর এক প্রিয় বন্ধু, যাঁর নাম কৃষ্ণ। রাজা বা গণতান্ত্রিক নেতার সঙ্গে দেখা করতে গেলে যে রেফারেন্স থাকলে সুবিধে হয়, সেই রেফারেন্স বাণভট্টেরও ছিল না, মেয়র সাহেবের সঙ্গে দেখা করবার সময় আমাদেরও তা ছিল না। অথচ রেফারেন্স থাকলে যে এই নেতারা কতটা ভালোভাবে কথা বলেন তা আমরা প্রত্যক্ষ দেখলাম যখন মেয়র-সাহেব অন্য কয়েকজন মানুষের সঙ্গে বিগলিত ভঙ্গিতে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। প্রতি তুলনায় আমাদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল কর্কশ, নির্মম এবং এতটাই বিরস যে, তাঁর যেমন মনে হচ্ছিল— এরা উঠে গেলে ভালো হয়, আমাদেরও মনে হচ্ছিল— কখন এই তথাকথিত ভদ্রলোকের বচন-ব্যসন থেকে মুক্তি পাব।
আমি একসময় আমার মায়ের জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে গিয়ে অন্য এক ডাক্তারের রেফারেন্স নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে একটি ব্যক্তিগত খোলা চিঠি লিখে আমার হাতে দিয়েছিলেন এবং তাতে লেখা ছিল— অমুককে একটু ভালো করে দেখে দিয়ো। আমি বলেছিলাম— আচ্ছা! এই কথাটা কেমন যেন, তাই না? ভালো করে দেখে দিয়ো। একজন ডাক্তারের তো ভালো করেই দেখবার কথা। মেয়র সাহেবের কাছে আমরা কোনও রেফারেন্স নিয়ে যাইনি। শুধু মনে হয়েছিল— ইনি তো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পদে এসেছেন, অতএব একটা ‘ইনস্টিটিউশনাল’ সমস্যা নিশ্চয়ই মন দিয়ে শুনবেন। কিন্তু কোথায় কী! অতএব, বাণভট্টের অপ্রিয় সত্য কথাটাই সার হল। বাণ লিখছেন—
কী করি! রাজা তো আমাকে ভুল বুঝেছেন। বড় রাজকুল বড় বিপজ্জনক জায়গা। তার মধ্যে সেবা করা বড়ো কষ্টকর ব্যাপার। দাসত্ব করা বড় বিষম দায়। আমার তো কোনও পূর্বপুরুষের জমিয়ে রাখা প্রীতির সহায় নেই এখানে, নেই বংশপরম্পরায় আগত কোনও সাহায্য। এমনও নয় যে আগে এঁর কোনও উপকার করেছিলাম, অতএব সেটা স্মরণে রেখে আমার সঙ্গে কথা বলবেন— ন চ মে পূর্বজ-প্রবর্তিতা প্রীতিঃ, ন কুলক্রমাগতা গতিঃ, নোপকারস্মরণানুরোধঃ। এমনও নয় যে, ছোটোবেলা থেকে তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে ছিলাম, অতএব রাজার বিশেষ স্নেহ আমি লাভ করব। পুরাতন কোনও পরিচয়ও নেই তাঁর সঙ্গে যে, এখন তাঁর দাক্ষিণ্য পাব আমি। আবার আমি এমন কোনও কদরের মানুষও নই যে আমার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে অথবা বুদ্ধি বিবেচনার লেন-দেন করে লাভবান হবার আশায় তিনি আমার প্রতি আকৃষ্ট হবেন। এমন কোনও অতিশয়ী বিদ্যাও নেই আমার যাতে আমার সম্বন্ধে তাঁর কৌতূহল হবে, এমন কোনও অসাধারণ চেহারাও নয় আমার যে, আমাকে দেখামাত্রই তিনি আমাকে আদর দেখাবেন।
এর পরে বাণভট্ট যে কথাগুলি বলেছেন, সেগুলি তাঁর মধ্যে এবং এখনকার গণতন্ত্রে আমাদের মধ্যে ছিল না বলেই মেয়র-সাহেবের কাছে আমরা কোনও পাত্তাই পাইনি। বরঞ্চ বলা উচিত এগুলি থাকলে রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অথবা সর্বতন্ত্রেই ক্ষমতাসীন ব্যক্তির কাছে আমল পাওয়া যায়। বাণভট্ট লিখেছেন— সেবা করতে হলে কণ্ঠস্বরের সুর যে কত রকমভাবে বদল করতে হয়, সে সব কৌশল আমার কিচ্ছু জানা নেই, শহরের বিদ্বান ব্যক্তিদের সঙ্গে গোষ্ঠীবন্ধন করে থাকলে যে আমলটুকু তিনি দিতেন, সে বিদ্যাও আমার নেই, টাকা-পয়সা খরচ করে কাউকে ধরা করা করে তার মারফৎ যে রাজার সঙ্গে দেখা করব, তেমন টাকার জোরও আমার নেই। আর রাজার যাঁরা প্রিয় পাত্র, তাঁদের একটি লোকের সঙ্গেও পরিচয় থাকত, তাহলেই আর কোনও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু তেমন কেউ নেই আমার। তবু কী করি? যেতেই হবে সেখানেই— ন বিত্তব্যয় বশীকরণম। ন রাজবল্লভ-পরিচয়ঃ। অবশ্যং গন্তব্যম।
এইটাই সবচেয়ে বড় ভবিতব্য— তবু এইসব লোকের কাছে যেতে হয়। রাজপুরুষের সঙ্গে দেখা করতে গেলে পুরাকালে সমস্ত মনস্বিতাকে যেমন হত্যা করতে হয়, এখনও অধিকাংশ রাজনীতিবোধহীন মানুষের ভোটে-জেতা গণতন্ত্রের নায়কদের চরিত্রও একইরকম। তবু সাধারণ মানুষকে এই সব দুর্বিধাতা মানুষের কাছে যেতে হয়। আমি তো এক সাধারণতন্ত্রী মেয়র সাহেবের উদাহরণ দিলাম, নিশ্চয়ই গুণসাম্যে এবং কর্মসাম্যে এই সব গণতন্ত্রী নেতাদের চরিত্রও একইরকম ধরে নেওয়া যায়। আশ্চর্য লাগে তখন, যখন এইসব বড় বড় নেতাদের ভোট ভিক্ষা করতে দেখি। কেমন তাঁদের জোড়হস্ত হাঁটা-চলা, কেমন তাঁদের কণ্ঠস্বর, কেমন তাঁদের অভিনয় কুশলতা। বস্তুত সেকালে রাজার অনুগ্রহ নিয়েই যারা বেঁচে থাকত, ভোটের সময় ঠিক সেই চেহারা হয় আমাদের এই নেতাদের— বাণভট্টের ভাষায় এবং আমাদের চোখে অন্তত এক মাসের জন্য এইসব নেতাস্থানীয় মানুষের চেহারাটা এইরকম—
অপরের পায়ের ধুলোয় সদা-ধূসরিত তার উত্তমাঙ্গ— সে যেন এক সচল পাপোষ। চাটুভাষণে সে পুরুষ-কোকিল। সাষ্টাঙ্গ হয়ে বুক-রগড়ে চলায় সে ঠিক স্থলকচ্ছপের মতো। শব্দের মূর্চ্ছনায় সে যেন একটি বাঁশী। ছলাকলাপূর্ণ অঙ্গভঙ্গীতে সে যেন এক বেশ্যা। শালিধানের মাঝে যেমন শূন্যগর্ভ তুষ, সত্ত্বাশালী মনস্বী লোকের মাঝে সেও তেমনই এক খড়ের মানুষ।
হয়তো সেই কারণেই আজও কুশ-পুত্তলিকা-দাহের রীতি আছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন