সহিষ্ণু

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

শরীরী দেবতার চক্রান্তে যেদিন শিব-পার্বতীর প্রেম-ভালোবাসায় আঘাত নেমে এল, সেদিন অভিমানিনী পার্বতী তপস্যায় বসতে চাইলেন পিতা-মাতার অনুমতি নিয়ে। জননী মেনকা মেয়ের এই সিদ্ধান্তে এমনই বিস্ফারিত হয়ে ‘ও-মা’ ‘উ-মা’ করতে আরম্ভ করলেন যে, পার্বতীর নামই হয়ে গেল উমা। পাথর-পিতা হিমালয় অবশ্য যথেষ্ট স্নেহ-বিগলিত হৃদয়ে বোঝালেন মেয়েকে— দ্যাখো, শ্রম, তপস্যা তোমার জন্য নয়। শিরীষ ফুল যদি বা মৌমাছি কিংবা ভোমরার পায়ের ভার সহ্য করতে পারে, কিন্তু সেই ফুলের ওপরে যদি বড়ো বড়ো পাখি এসে বসতে যায়, তাহলে অত নরম ফুল সে ভার সইবে কেমন করে— পদংসহেত ভ্রমরস্য পেলবং/ শিরীষ পুষ্পং ন পুনঃ পতত্রিনঃ।

এই কথাটা আমি বিপ্রতীপ দৃষ্টিতে কল্পনাও করবার চেষ্টা করেছি। ভেবেছি, একটি শিরীষ ফুলের ওপর একটা কাক এসে বসার চেষ্টা করছে, বসতে না পেরে ঠোঁট-নখের আঁচড়ে শতচ্ছিন্ন করে ফেলছে শিরীষ ফুলের কোমল তন্তু পাপড়িগুলি। আর ঠিক এই কল্পনাতেই বুঝেছিলাম যে, সইতে পারার ক্ষমতার মধ্যেও একটা দাঁড়িপাল্লা আছে যেন এবং এই দাঁড়িপাল্লার কাঁটাটা সবসময়েই সহনীয়তার উলটো দিকেই থাকে এমন যে, সম্পূর্ণ সমাজটাকেই এখন আমার কাক-শকুনের মতো লাগে। বিশেষত সহিষ্ণুতা ব্যাপারটাকে যদি একটা তত্ত্ব হিসেবে নিই, তাহলে এটা কিন্তু কোনও সমাধানই নয় যে, দুর্বল, নিগৃহীত, পীড়িত, দরিদ্র— যাঁরা শুধু সয়েই চলেন সবসময়, তাঁদেরই শুধু সহিষ্ণুতার শিক্ষা নিতে হবে। কারণ তাঁরা সয়েই চলেছেন সব কিছু। সহিষ্ণুতা বস্তুত সকলের ধর্ম। আমি এ-প্রসঙ্গে সেই দেবতা-প্রতিম মহামহিমের কথাও বলতে চাই না, যিনি এক গালে চড় খেলে আর এক গাল বাড়িয়ে দেবার নিদান দিয়েছিলেন। তিনি প্রেমিক পুরুষ, তিনি এই সহনীয় ভাবনার ঊর্ধ্বে। ঠিক যেমন সেই প্রেমিক পুরুষও, যিনি কলসিরকানার আঘাত কপালে নিয়েও প্রেম দিতে চেয়েছিলেন। বঙ্গদেশের ভাগ্যে তিনিও এক অভ্যুদয়। তাঁর কথাও এই প্রসঙ্গে আসে না। এঁরা অনেক ঊর্ধ্বে।

আজকের এই হন্তারক সময়ে যখন বিদ্যা এবং বুদ্ধি নিছক এক জীবিকায় পরিণত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে যে অসহনীয়তা দেখি, সেটা প্রায় হিংসার পর্যায়ে পড়ে, সেখানে লোকাল ট্রেনের কামড়ায় ভিড়ের মধ্যে যদি কারও পায়ের বুড়ো আঙুল চিপে দেয়, তাতে প্রথমত মনে হয় যেন কাঁকড়া বিছে কামড়ানোর কাজ করেছে কেউ। যদিও বিছে কামড়ালেও তেমন কথ্য-শক্তি থাকে না, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে সহস্র পদ প্রতিষ্ঠার অন্ধকারে যদি একটি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠও পিষ্ট হয়, তাহলে বারুইপুর থেকে শেয়ালদা পর্যন্ত যে ঝগড়াটা চলে, তাতে সাময়িকিভাবে তিন-চারটি খুনই হয়ে যাবে বলে মনে হয়। এমনকি শেয়ালদাতে নামার পরেও আমি শেষের গানের রেশটুকুর মতো কিছু ঘুষোঘুষি মারামারিও দেখেছি। কিন্তু সহযাত্রী সহগামীদের স্থূল হস্তক্ষেপেই সে-সব ঝগড়া দিগন্তে মিলিয়ে যায়। শেয়ালদা স্টেশনের ঝগড়া ‘অ্যাবসর্ব’ করার ক্ষমতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক বেশি।

আসলে প্রথমেই যেটা বলেছিলাম, সইতে পারার ক্ষমতার মধ্যে তর-তম থাকতেই পারে পাত্র-সবিশেষে, কিন্তু সে ক্ষমতা কোনও দুর্বলের নয়, মানসিক দিক থেকে অতিশক্তিমান মানুষই কিন্তু সহিষ্ণুতার সব চাইতে বড়ো আধার। আরও একটা ব্যাপার হল— সহিষ্ণুতা-শব্দটির মধ্যে অসাধারণ এক দার্শনিক তাৎপর্য আছে এবং সবচেয়ে আশ্চর্য হল এই দাশনিক তাৎপর্যটা তৈরি করে দিয়েছে ব্যাকরণের একটি প্রত্যয়, যার নাম ‘ইষ্ণুচ’। পাণিনি-ব্যাকরণের এই প্রত্যয়গুলির নাম শুনলে আমরা আগে হাসাহাসি করতাম, কিন্তু পরে দেখেছি, এগুলো একদিকে যেমন ভীষণ রকমের বৈজ্ঞানিক নির্দেশ তৈরি করে, তেমনই এদের আর্থিক তাৎপর্যও কম নয়। ‘ইষ্ণুচ’ প্রত্যয়ের ব্যবহারটা এক ধরনের ‘ঝোঁক’ প্রবণতা বা Tendency, propensity-র নির্দেশ দেয় এবং সেই প্রবণতা এমনই যা একটা মানুষ বা যে কোনও কিছুর স্বভাব বা চরিত্রের নির্দেশিকা হয়ে ওঠে।

সেই বেদব্রাহ্মণে যখন দেবরাজ ইন্দ্রকে ‘পারয়িষ্ণুতম’ বলা হয়েছিল, সেদিনই বুঝেছিলাম— যে কোনও কাজ পেরে ওঠাটা ইন্দ্রের স্বভাবের মধ্যে এসে গেছে অর্থাৎ কাজ যত কঠিনই হোক সেই কাজটা পেরে ওঠার মধ্যেই ইন্দ্রের ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেছে। একই সঙ্গে এটাও বুঝে নেওয়া ভালো যে, এই পেরে ওঠাটা এক দিনে হয়নি, বারংবার বিভিন্ন পেরে ওঠার কাজগুলি তিনি করতে সক্ষম হয়েছেন বলেই তিনি পারয়িষ্ণু, এবং এসব অন্যান্য দেবতার কর্মক্ষমতা থেকে তিনি অধিক সক্ষম বলেই তিনি পারয়িষ্ণুতম। একইভাবে সহিষ্ণুতার মধ্যেও সহ্য করে নেবার একটা স্বভাবগত প্রবণতা থাকে এবং সেই প্রবণতা অভ্যাস এবং পরিশীলনের মাধ্যমেই তৈরি হতে হতে সেটা স্বভাবে পরিণত হয়। তার মানে, সহিষ্ণুতা নিয়ত চলমান এক মানসিক সংযমন প্রক্রিয়া যা বারংবার পরীক্ষিত হতে হতে চরিত্র হয়ে ওঠে। অথচ সহিষ্ণুতা মানে কখনওই দুর্বলতা নয়, অক্ষমতা নয়, বরঞ্চ অতি সম্মান এবং শক্তিধর মানুষেরাই সহিষ্ণু হওয়ার সবচেয়ে বড়ো দাবিদার।

সহিষ্ণুতার ক্ষেত্র কিন্তু একটা নয়। বিশেষত হানাহানি, মারামারির ক্ষেত্রে তার যে কোনও ভূমিকা আছে, এটা আমার মনেই হয় না। আমি এমন কখনও শুনিনি যে একজন আর একজনের হাতে খুব মারধোর খাবার পর হিংসাক্রান্ত সেই মানুষটিকে কেউ বলছে— তুমি আরও সহিষ্ণু হও। আসলে সহিষ্ণুতার ক্ষেত্র বোধহয় সেইগুলি যা প্রায় সব সময়ই মানুষ করতে থাকে, তার বিপরীতে। মহাভারতের স্ত্রীপর্বে গিয়ে চতুরন্ত যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে শব-শরীর দেখতে বিদুর বলেছিলেন— কতটা বঞ্চিত এই সব মানুষ! শুধু ক্রোধ আর লোভ এইসব মানুষকে এমন পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে যাতে নিজেকে আর চিনতে পারছে না তারা। ভালো বংশে জন্মে নিজেদের কুলীন-মানী ভেবে এরা নিন্দা করে তাদের, যারা বড় বংশে জন্মায়নি। যাদের টাকা-পয়সা আছে তারা গরিব মানুষকে দুষে সুখ পায়, গরিব মানুষের সামনে এরা ধন-মানের দর্প প্রকাশ করে। আর আছে সেইসব মানুষগুলি, যারা নিজেদের দিকে একবারও তাকিয়ে দেখে না নিজে কী বস্তু, কিন্তু অপরকে মূর্খ বলে গালি দেয়— মূর্খানিতি পরানাহ নাত্মানং সমবেক্ষতে।

এখানেই সূক্ষ্ম তাত্ত্বিকতায় জানাতে চাই যে, বংশ-কৌলীন্য, ধন-মান কিংবা বিদ্যার বৈভব, অথবা এমনই কিছু যা বড় একটা বিশেষণ হয়ে ওঠে জীবনের— তাঁদেরই কিন্তু সহিষ্ণুতার প্রয়োজন। কেননা মানুষ এটাই পারে না। যার সামান্য একটু জ্ঞান আছে সে কিছুতেই চুপ করে থাকতে পারে না, সে জ্ঞান দিতেই থাকে অথবা যার শক্তি আছে— সে অর্থশক্তি হোক, প্রভুত্বের শক্তিই হোক অথবা রাজনৈতিক শক্তিই হোক— সে শক্তি না দেখিয়ে পারে না। আবার যিনি খানিক দান-ধ্যান করেন, খানিক বা আত্মত্যাগও করেন, তিনি আত্মশ্লাঘা না করে থাকতে পারেন না। মহাভারত বলেছে— নিজের বাড়াবাড়ির জন্য নিজেকে কেউ শাস্তি দিতে চায় না, মানুষ শুধু অন্যের দোষ খুঁজে গালাগালি দিতে থাকে— দোষান ক্ষিপতি চাণ্যেষাং নাত্মানং সমবেক্ষতে।

আমি মহাভারতের সেই জায়গার কথা একবার বলতে চাই যে, পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞের বৈভব দেখার জন্য দুর্যোধন আর শকুনি ইন্দ্রপ্রস্থে থেকে গেলেন। আমন্ত্রিত জনেরা সবাই চলে গেলেও যুধিষ্ঠিরের সমৃদ্ধি কতটা হয়েছে, সেটা দেখার জন্যই দুর্যোধন রয়ে গেলেন। যুধিষ্ঠিরের বৈভব তিনি সহ্য করতে পারবেন না জেনেও যে তিনি কষ্ট পাওয়ার জন্য রয়ে গেলেন, এখানে অসহিষ্ণুতার একটা পূর্বচিহ্নিত ঝোঁক ধরা পড়ে। পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য-সমৃদ্ধি দুর্যোধন সইতে পারছেন না, তিনি ভেবেই যাচ্ছেন, ভেবেই যাচ্ছেন এবং এতটুকুও শান্তি পাচ্ছেন না— তিনি নিজে বলছেন— আমি সইতে পারছি না, তবু কেমন করে সইছি এটা— যো তাং মর্ষয়ামদ্য তাদৃশীং শ্রিয়মাগতাম। তার মানে, সহিষ্ণুতা যেমন সংযম-নিয়মন, অভ্যাস-পরিশীলনের একটা চলমান প্রক্রিয়া, অসহিষ্ণুতাও উলটো দিকে ঠিক তেমনই।

দুর্যোধনের এই অসহিষ্ণু প্ররোচনা যখন আরম্ভ হয়েছিল, তখন পিতা ধৃতরাষ্ট্র বাধা দেননি, তিনি সেটা বাড়তে দিয়েছেন, অর্থাৎ অসহিষ্ণুতায় অভ্যস্ত হতে দিয়েছেন। কিন্তু আজকে তিনি দুর্যোধনকে বলছেন— তোমার তো সব আছে, দুর্যোধন! অতুল ঐশ্বর্য, রাজবৈভব, সব। তোমার ভাইরা, আত্মীয়-বন্ধুরা, কেউ তো তোমার সঙ্গে বিরূপ আচরণ করে না। তবে তোমার এরকমটা হয় কেমন করে। তুমি ভালো জামাকাপড় পরছো, দিনে দিনে মাংস-ভাত খাচ্ছো, রথ-ঘোড়া-হাতির বাহন তোমায় বইছে। শোওয়ার জন্য দামি খাট-বিছানা আছে, সুন্দরী মেয়েরও কোনও অভাব নেই, যথেচ্ছ তোমার বিহার-আহার, দেবতাদের মতো সুখে আছো তুমি। অথচ তবু এমন দুঃখী লোকের মতো কষ্টে দিন কাটাচ্ছো তুমি— দেবোনামিব তে সর্বং বাচি বদ্ধং ন সংশয়ঃ— সবাই তাকিয়ে আছে তোমার দিকে, দেবতার মতো একবার মুখ খুললেই সব সুখ হাজির।

আগেই বলেছিলাম— দুর্যোধনের ঈপ্সিত রাজছত্রের মতো সব বড় মানুষের মধ্যেই অসহিষ্ণুতার সিংহাসনহীন রাজ্যবিস্তার ঘটে। উলটো দিকে সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি যুধিষ্ঠিরকে দেখুন। তিনি যখন প্রথম ধাক্কা খেয়েছিলেন, তখন তিনি আশ্রিতের মতো আছেন। রাজ্যপাট নেই; সংগতি নেই, নিতান্তই অবহেলিত। এই অবস্থায় দুর্যোধন ভীমকে বিষ খাইয়ে গঙ্গায় ফেলে দিলেন। সমস্ত অন্বেষণ এবং মৃত্যুর আতঙ্কের মধ্যেও ভীম যখন ফিরে এসে সব সত্য উদঘাটন করছেন সোচ্চারে, তখন যুধিষ্ঠির কিন্তু তাঁকে চুপ করিয়ে দিয়েছেন, কেননা নিজের অপকর্ম লোকে জেনে গেছে, এ-কথা জানলে দুর্যোধন পাণ্ডবদের আরও ক্ষতি করবেন, এই বুদ্ধি যুধিষ্ঠিরের ছিল।

কিন্তু তাই বলে এটা কোনও সহিষ্ণুতার উদাহরণ নয়, এটা নিতান্তই নিজেদের বেঁচে থাকার বুদ্ধি। এমনকি অস্ত্রশিক্ষা শেষ হবার পর যুধিষ্ঠির যখন যুবরাজ হয়ে খুব ভালোভাবে রাজ্য চালাতে লাগলেন, তখন যে বারণাবতে তাঁদের জননী-সহ জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করলেন দুর্যোধন এবং ধৃতরাষ্ট্র মিলে, তখনও কিন্তু সহিষ্ণুতার কোনও প্রশ্ন ছিল না। ভীম যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন একবার। বলেছিলেন— এই জতুগৃহ যদি আমাদের জন্যই বানানো হয়ে থাকে, তো আমরাই সেটা পুড়িয়ে দিচ্ছি না কেন, কেনই বা ফিরে যাচ্ছি না আমাদের পুরোনো হস্তিনাপুরে? যুধিষ্ঠির এবার রাজনীতি বুঝিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন— দুর্যোধনেরা আমাদের কূটহত্যা করতে চাইছে। আমরা যদি পালিয়েও যাই, তাহলে গুপ্তচরদের দিয়ে আমাদের গুপ্তহত্যা করাবে। আসলে এখন ওরা ক্ষমতার জায়গায় আছে, আর ক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতার স্থানে না থাকা লোকদের, বিশেষত যাদের হাতে এখন সৈন্য সামন্ত এবং অর্থের জোর নেই, তাদের তারা অবধারিত মেরে ফেলবে— হীনকোষান মহাকোষঃ প্রয়োগৈ ঘার্তয়েৎ ধ্রুবম।

যুধিষ্ঠির এটা রাজনীতির অবস্থান-ভিন্নতার কথা বলছেন, পদে থাকা এবং পদে না থাকার সমীকরণ-বিষমতার কথা বলছেন, এখানে সহিষ্ণুতা একটা উপচারমাত্র, মূলত সহিষ্ণুতা এখানে অক্ষমের অনিবার্য উপকরণ, জীবনোপায়। বেশ বোঝা যায়, সহিষ্ণুতাও সকলের ধর্ম, এটা অক্ষমের অনিবার্য সহনীয়তা নয়। কথাটা কিন্তু দুর্যোধনের মুখ দিয়েই বেরিয়েছিল। সেই ধৃতরাষ্ট্র যখন বোঝাচ্ছিলেন— তুমি এত খাচ্ছো-পরছো, এত তোমার ভোগ-সুখ, তবু যুধিষ্ঠিরের চাও অনিষ্ট কেন? তুমি তো সফল পুরুষ, আর কীসের প্রয়োজন তোমার। দুর্যোধন বলেছিলেন— ‘ভালো খাচ্ছি, ভালো পরছি’— এটাকে কি পুরুষ বলে? এটা কুপুরুষের লক্ষণ। নিজের প্রজাকে অন্যে যদি নিজের বলে মনে করে— সেটা যে সইতে পারে না, সেই আসলে পুরুষ। আর পুরুষ হলেন তিনি, যিনি ভবিষ্যতে প্রতিকারের আশায় শত্রুর দেওয়া সমস্ত কষ্ট সহ্য করেন, সেই সহিষ্ণু মানুষটাই পুরুষ— ক্লেশান সহিষ্ণুঃ পরজান স বৈ পুরুষ উচ্যতে।

যুধিষ্ঠির কিন্তু দুর্যোধনের বলা অর্থেই সঠিক পুরুষ, আবার এক অর্থে ননও। দুর্যোধন কখনও সন্তুষ্টি পছন্দ করেন না, সন্তাোষ, দয়া এবং ভয় তাঁর মতে সম্পদ এবং অহংকার নষ্ট করে দেয়, ফলে একটা মানুষ আর উচ্চ-উচ্চতর পদে উন্নীত হতে পারে না। হয়তো উচ্চাভিলাষী সমৃদ্ধিকামী মানুষের ব্যাপারে কথাটা খুব সত্য, কিন্তু যুধিষ্ঠির তো তেমন মানুষ নন। সন্তাোষ তাঁর অন্তর্গত গুণ বলেই কোনও কিছুই তাঁর হারাবার ভয় নেই, একই সঙ্গে দয়া— যে দয়া দুর্যোধনের মতে সমৃদ্ধি এবং অভিমান নষ্ট করে দেয়, সেই দয়া এবং সন্তাোষ তাঁর সহিষ্ণুতার প্রধান উপকরণ হয়ে ওঠে। বস্তুত সহিষ্ণুতা যদি একটা মানুষের অন্তর্জাত শৃঙ্খলা হয়ে ওঠে, তাহলে সন্তাোষ, দয়া, অনসূয়া, ক্ষমা এবং অনহংকার সেই সহিষ্ণুতার অনুপান। এই বৃত্তিগুলিই সহিষ্ণুতার প্রকট প্রকাশ। ঠিক যেমন উলটো দিকে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটে ক্রোধ, নৃশংসতা, কটু বাক্য, নির্দয় ভাব এবং আত্মাভিমানের মাধ্যমে।

যুধিষ্ঠির যখন পাশা খেলতে গেলেন, তখনই বিদুরের কাছে শকুনির কপট দ্যূতের কথা শুনেছিলেন। বিদুর স্বয়ং উচ্চারণ করেছিলেন ভয়ংকর সেই পাশাড়েদের কথা— মহাভয়াঃ কিতবাঃ সন্নিবিষ্টাঃ। কিন্তু মহামতি বিদুরের পরোক্ষ বারণ-কথা শুনেও যুধিষ্ঠির যখন বললেন— আমার জ্যেষ্ঠ পিতাঠাকুর যখন ডেকেছেন, তখন আমাকে যেতে হবেই, তখনই বুঝতে পারি, যুধিষ্ঠির এক অনিবার্য পরিণতির জন্য সহিষ্ণু হয়ে উঠছেন। মনে রাখতে হবে, যুধিষ্ঠির তখন রাজা, সদ্য রাজসূয় যজ্ঞে অতুল অর্থ এবং ধন-সম্পত্তির অধিকারি। আমি অন্তত মনে করি না যে, যুধিষ্ঠির কিছুই বোঝেননি। তিনি নিশ্চয় বুঝেছিলেন— পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থের সম্পত্তি দুর্যোধন হরণ করে নেবেন এবং সেখানে ধৃতরাষ্ট্রের লোভ এবং অভিলাষ যুক্ত হয়েছে। এমন সর্বগ্রাসী লোভের প্রতি তাঁর ঘৃণা আছে বলেই বিদুরের মতো পিতৃপ্রতিম মানুষের পরোক্ষ ইঙ্গিত থাকা সত্ত্বেও তিনি বলেছেন— আমাকে ডেকেছেন যখন বৃদ্ধ পিতা, তখন ফেরার কথা ওঠে না— আহূতো’ংহং’ ন নিবর্ত্তে কদাচিৎ— আমাকে যেন কৃপণ না ভেবে বসে কেউ। আসলে একান্ত নিকট জনের এমন পরশ্রীকাতরতা দেখে যুধিষ্ঠির রিক্ত হতে চেয়েছেন সর্বস্ব পণ করে।

পাশা খেলায় হেরে, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ সহ্য করার পর যুধিষ্ঠির যখন বনবাসে বসে দ্রৌপদীর তিরস্কার লাভ করছেন, তখন আপন আত্মকথায় বলেছেন যুধিষ্ঠির। বলেছেন— একটা হিংসা থেকে তো অন্য হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। একজন যখনই রাগ করবে আর একজনের ওপর, তখন সে তো আর চুপ করে বসে থাকবে না, সে প্রতিক্রোধ প্রকাশ করবে— প্রতিহন্যাদ হতশ্চৈব তথা হিংস্যাচ্চ হিংসিতঃ। যুধিষ্ঠির ঠিক এইখানে সহনশীলতার নিদান দিয়েছেন এবং সবচেয়ে বড় কথা— এখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে আরম্ভ করে রাজনীতি এবং সমাজ কোনওটাই বাদ পড়ে না। প্রধানত রাজনীতি থেকেই তো যুধিষ্ঠিরের কথাগুলি উঠে এসেছে। দ্রৌপদী এবং ভীম তো বলেইছিলেন— আমাদের সঙ্গে শঠতা করা হয়েছে, কপট পাশা খেলে আমাদের রাজ্যধন নিয়ে নিয়েছে, এ অবস্থায় আমরাও আমাদের সত্যে স্থির থাকব না, আমরা আক্রমণ করব।

যুধিষ্ঠির এখানে কথা আরম্ভ করেছেন সহিষ্ণুতার মূলাধার ‘সহ’-ধাতু থেকে। তিনি বলেছেন— যে পুরুষ অন্যের ক্রোধ সইতে পারে না, সে একদিন দেখবে— সে নিজেই আর পৃথিবীতে নেই— যঃ পুনঃ পুরুষঃ ক্রোধং নিষ্যংন সহতে শুভে। যুধিষ্ঠিরকে বার বার ক্ষমার কথা বলতে শোনা যাবে এবং তা শোনা যাবে উদগ্র ক্রোধ, অন্যায় এবং অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে— কিন্তু এইসব কথার মধ্যে এক একটা প্রসঙ্গ আছে, যেখানে ক্ষমার কথা বলেছেন ক্রোধশান্তির জন্য। কিন্তু মহাভারতের একটা জায়গা যেখানে তিনি এইসব মহদগুণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করছেন, সে জায়গাটায় অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই যুধিষ্ঠিরের মনের কথা বেরিয়ে আসে। সেটা বক্ষ প্রশ্নের জায়গা। যক্ষ জিজ্ঞাসা করছেন— তুমি ক্ষমা কাকে বলবে যুধিষ্ঠির?

এখানে অসামান্য একটা উত্তর আসছে এবং সেখানে সমাসের উত্তরপদটা হল সহিষ্ণুতা। যুধিষ্ঠির বললেন— ক্ষমা দ্বন্দ্ব সহিষ্ণুত্বম। অর্থাৎ ক্ষমা হল দুটি বিপরীত বস্তু গ্রহণ করার সহিষ্ণুতা। দ্বন্দ্ব মানে যুগল, দুই— যেমন সুখ-দুঃখ, শীত-উষ্ণ, জয়-পরাজয়, লাভ-অলাভ। জীবনের সারসত্য হল— সহিষ্ণুতা দুই ক্ষেত্রেই প্রয়োজন— দুঃখের বাড়াবাড়ি হলে যেমন সহিষ্ণুতার প্রয়োজন হয়, তেমনই সুখও সহ্য করতে হয়, সেখানেও সহিষ্ণুতা প্রয়োজন। আমরা অনেক সময় ফার্স্ট জেনারেশন বড়লোকের অর্থ প্রদর্শনী দেখে বলে ফেলি— এর টাকাটা হজম হয়নি; আসল কথাটা কিন্তু তাঁর অতিরিক্ত অর্থলাভ তিনি সইতে পারছেন না, সেখানে তাঁর সহিষ্ণুতা নেই বলেই তাঁর অর্থলাভ লোক চক্ষু কন্টকিত করে। একইভাবে রাজনীতিতে জয়লাভ। ভোটবাক্সের বিজয় যদি আত্মীকৃত না হয়ে জনকল্যাণের বহির্মাত্রায় চলে আসে এবং তা যদি পরাজিত পক্ষের প্রতি ক্ষমতার প্রদর্শনীতে রূপান্তরিত হয়, সেখানেও কিন্তু দ্বন্দ্ব-সহিষ্ণুতার প্রশ্ন এসে যায়। পরাজয় তো সহ্য করারই জিনিস, কিন্তু জয়টাকেও সইতে হয় সহিষ্ণুতার সতত চলমান প্রক্রিয়ায়। একইভাবে লাভ-অলাভের দ্বন্দ্বসহিষ্ণুতা— এই সহিষ্ণুতাই মানুষের মধ্যে সমবুদ্ধির অভিজ্ঞান জাগিয়ে তুলতে পারে। সর্বত্র সমবুদ্ধিই সহিষ্ণুতার আর এক নাম।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন