নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
আমি খুব সূক্ষ্মভাবে এবং স্থূলভাবে নিজেকে এবং অন্য মানুষ জনদের বিচার করে দেখেছি যে, আমার চেয়ে সকলেই প্রায় বেশি ভদ্রলোক। কর্মস্থলে আমার সহকর্মীরা প্রত্যেকেই আমার চেয়ে বেশি ভদ্রলোক। এমনকী আমার ছাত্র-ছাত্রীরা যারা অনেকেই সুকুমারমতি তরুণ-তরুণী, তারাও প্রত্যেকে আমার চেয়ে ভদ্র। আমার নিজের প্রতি নিজেরই এই অবমাননার কারণ— আমি একদিন ছাত্র-ছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম— হ্যাঁরে! মানুষে মানুষে, বিশেষত স্ত্রীলোকে-স্ত্রীলোকে ঝগড়া দেখতে তোদের কেমন লাগে? ওরা হেসে কুটিকুটি হয়ে বলেছিল— খুব খারাপ লাগে, স্যর! খুব বাজে লাগে। আমরা এরকম শুনতেও চাই না, দেখতেও চাই না। আমি তখনই বুঝেছিলাম— আমার চারপাশের সকলেই আমার চেয়ে অনেক বেশি রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। বিশেষত আমার স্ত্রী যেদিন বললেন— তোমার এই রুচি। তুমি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া শুনছ? তোমার লজ্জা করে না? আমি সেদিন আরও বুঝলাম— আমি একেবারেই ভদ্রলোক নই।
সত্যি বলতে কী, এটা আমারই কু-অভ্যাস বটে। ঝগড়া দেখতে এবং শুনতে আমার বেশ ভালোই লাগে। এই তো সেদিন আমাদের ওপরতলার মধ্যবয়সি বউটি তার স্বামীকে অজস্র গালাগালি দিচ্ছিলেন। স্বামী বেচারা কী করেছিলেন বা কী বলেছিলেন প্রথমে, সেটা আমার ঠিক ঠাহর হয়নি। কিন্তু ঝগড়াটা তখন আর প্রসঙ্গে ছিল না— আর আপনারা এটা খুব ভালোই জানেন যে, কথা যদি প্রসঙ্গে না থেকে অতিবর্তিনী হয়ে পড়ে, সেখানেই কল্পনা-শক্তি নিজস্ব পরিসর লাভ করে, আর সেই পরিসর থেকে উঠে আসতে পারে কাব্য, কবিতা অথবা সাহিত্য। সেদিন ওপরতলার সেই বউটি বলেছিল— তোমার সঙ্গে বিয়ে হয়ে আমার জীবনটাই বরবাদ হয়ে গেছে। সাধারণ একটা কথা বলেছি; বলেছি ছেলের দিকে তোমার কোনও নজর নেই, তাতেই এত বড়ো কথা। তুমি জানো, তোমার সঙ্গে বিয়ে না হলে আমি কত ভালো থাকতাম। পাঁচ-ছটা লোক আমার পিছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মধ্যে দুটো আই. আই. টি.-র ইঞ্জিনিয়ার। একবার ইশারা করলে লাফিয়ে এসে বিয়ে করে নিয়ে যেত। বর ভদ্রলোক অনেকক্ষণ শোনার পর মন্তব্য করলেন— বরঞ্চ বলো, আমার জন্য এই পাঁচ-ছটা লোকের জীবন বেঁচে গেল। বউ বলল— কী, এত বড়ো কথা! লোকে তো আর জানে না, তুমি কী চীজ। সেদিন তোমার অফিসের সেই গায়ে-পড়া মেয়েটা— সাহানা না সোহাগী— কী যেন নাম, সে বলছিল না— অমিতদা কী ভালো, মানে অমিত স্যর কী ভালো! কী ভালো কথা বলেন!
আমি সেদিন রাত সাড়ে এগারোটার সময় জানলার পাশে দাঁড়িয়ে এই বৈবাহিক সংলাপ শুনছিলাম। আমার স্ত্রীর তীব্রতায় আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম বটে, কিন্তু আমার অন্তর্হৃদয়ে বারবার এই ভাবনা ঘোরাফেরা করতে লাগল— কত কিছুই না আছে এই ঝগড়াটুকুর মধ্যে। কত আশা-আকাঙ্ক্ষা, কত ভবিষ্যৎ-সুখের কল্পনা, আর কতই বা লুণ্ঠিত সময় এই দাম্পত্য বিসংবাদের মধ্যে রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে অবশ্য হাসিও পাচ্ছিল খুব— ভদ্রমহিলাকে দেখলে বোঝা যায়, তিনি এককালে সুন্দরী ছিলেন— কিন্তু তাই বলে দুটি আই-আইটিয়ান এবং আরও গোটা চারেক হোমরা-চোমরা পুরুষ এই ভদ্রমহিলার পিছনে কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তিনি— ভদ্রমহিলা এমনিতে মূর্খ এবং প্রচণ্ড ভুল ইংরেজি বলার চেষ্টা করেন— সেই তিনি একটার পর একটা উদ্যোগী পুরুষ সিংহকে অবহেলে নাকচ করে দিচ্ছেন ভুল ইংরেজিতে— এই দৃশ্য কল্পনা করে আমার হাসিও পাচ্ছিল খুব। কিন্তু দাম্পত্য কলহ বোধহয় সেই অপূর্ব বস্তু— যা স্বামী-স্ত্রীকে মুহূর্তকাল পরেই চরম অপ্রস্তুত করে তোলে, যা পরের কানে রসায়ন, বিনা ব্যয়ে চরম বিনোদন কিন্তু আমার মতো অকারণ-কৌতূহলী অভদ্র জনের কাছে তার চেয়েও বড়ো ব্যাপার বুঝি একটাই যে সেই ঝগড়া-বস্তুটা থেকে ব্যক্তি-জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, হতাশা এবং চরম লুণ্ঠিত সময়গুলি বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসে এমন কিছু সত্য যা হলেও হতে পারত অথবা যা একেবারেই হতে পারে না।
এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, দাম্পত্য কলহে মেয়েদের ভূমিকাই একেবারে অগ্রণী এবং পুরুষেরা একেবারেই ঝগড়া করে না বা তাঁরা সংসারের চাপে একেবারে শান্ত-বৃত্তি মুনি হয়ে যান। বরঞ্চ পুরুষ মানুষের ঝগড়ার কিছু আর্ট আছে, অনেক সময় মৌখিক ঝগড়া না করেও তাঁরা এক অদ্ভুত চাপ তৈরি করতে পারেন, যা অন্য পক্ষে ঝগড়ার ইন্ধন যুগিয়ে দেবে। আর আছে স্ত্রী জীবনের সীমাবদ্ধতা, আর্থিক নির্ভরতা এবং সামাজিক সৌজন্য, যাতে অনেক রমণীকে শুধু চুপ করেই থাকতে হয় কারণ মুখ খুললেই সেখানে তিনি দজ্জাল স্ত্রী বলে গণ্য হবেন।
আমি যে হঠাৎ করে বেশ একটু সামাজিক-ঐতিহাসিকের মতো কথা বলতে আরম্ভ করেছিলাম, ওটা আমার পূর্বাভ্যাস। আসল কথা হল— ঝগড়া কত ভালো লাগে শুনতে। এক পুরাতন কবি লিখেছেন— সামাজিক বিয়ে এবং ঝগড়া— এ দুটি সমানে সমানে হলেই শোভা পায়— বিবাহশ্চ বিবাদশ্চ সময়োরেব শোভতে। এই নীতিবাগীশ কবির জীবন সম্বন্ধে কোনও ধারণাই আছে বলে মনে হয় না। আমাদের বাপ-পিতামহেরা বন-জন-কুল মিলিয়ে সমানে সমানে বিয়ে দেবার কথা বলতেন বটে, কিন্তু টাকা-পয়সা এবং বংশ-কৌলীন্য প্রায় এক হলেই যে বেশ সমান হল, তা ভাবার কোনও কারণ নেই। কারণ আচার, ব্যবহার, আহার এবং ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষার জগৎ প্রত্যেকটি পরিবারেই এমন বিপ্রতীপভাবে পৃথক যে, সমতা ব্যাপারটা ভীষণভাবে আপেক্ষিক হয়ে ওঠে। ঝগড়া-বিবাদও তাই; এই শব্দগুণ, এই পারস্পরিক অধিক্ষেপের ব্যাপারটা যেহেতু বিভিন্ন তাৎক্ষণিক এবং পরম্পরাগত মনোমালিন্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়, তাই সমানে-সমানে ঝগড়া হলেই সেটা শোভা পায়, মানায়, আর অসমপক্ষে সেটা মানায় না, শোভা পায় না, এটা তো এক্কেবারে ভুল কথা।
বিশেষত সমানতা কি শুধু দুই পক্ষেরই হয় নাকি? নিজের মধ্যেই আমরা নিজেরা কি সমান থাকি সবসময়? একজন গুণী-মানী অভিজাত মানুষ যখন ছোটোলোকের মতো ঝগড়া করতে থাকেন তখন তো নিজের সঙ্গে নিজেই অসমান হয়ে পড়েন তিনি। আর এই একটা কথা চিরকাল চলছে— ছোটোলোকের মতো ঝগড়া করিস না— যেন একমাত্র ছোটোলোকেরাই ঝগড়া করে, অভিজাত বড়ো মানুষেরা ঝগড়া করেন না। তাছাড়া ছোটোলোকেরা কারা? নিম্নবর্ণের মানুষ? নিম্নবিত্তের মানুষ? খারাপ মানুষ নাকি সাধারণ মানুষ? ঝগড়া করছে বলেই তারা ছোটোলোক এই কল্পটা অবশ্যই বাদ, বরঞ্চ নিম্নবর্ণতা, নিম্নবিত্ততা এবং আভিজাত্যহীনতা— এই সব কিছু মিশিয়ে যে মানবিক উপাদান তৈরি হয়, তারাই ছোটোলোক এবং তারাই ঝগড়া করে বলে বড়ো মানুষের পো’রা মনে করেন। অর্থাৎ সাধারণ লোকেরাই ঝগড়া করে, বড়ো মানুষেরা ঝগড়া করেন না, এমনকী কোনও খারাপ কথাও তাঁরা বলেন না। আর যদি বলেন, যদি ঝগড়া করেন, তবে সেটা ছোটোলোকের মতো হয়, নইলে স্বরূপত তিনি এমন নন।
তাহলে ঝগড়া করলে ‘ছোটোলোকের মতো’ একজন কিন্তু বড়োলোকের মধ্যেও রইল। তার মানে নিজের মধ্যেই নিজে কিন্তু সমান রইলেন না তিনি, সেই মুহূর্তে তিনিও একেবারে সাধারণ লোক। এই কথাটাই রামচন্দ্রকে রামায়ণে বলেছিলেন সীতা। লঙ্কাযুদ্ধের পর চোদ্দ বছরের বিরহিনী সীতাকে যখন প্রথম দেখলেন রামচন্দ্র, তখন যে ভাষায় রামচন্দ্র কথা বলেছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে, সেটা মোটেই ভদ্রলোকের মতো ছিল না। আর ভদ্রলোকের মতো না হলেই সেটা যে ছোটোলোকের মতো অথবা সাধারণ লোকের মতো— সেটা রামচন্দ্রের কথার উত্তরে পরিষ্কার করে দিলেন সীতা। তিনি বলেছেন— অভদ্র ইতর সাধারণ লোক যেভাবে ইতর সাধারণী স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তুমি সেই ভাবে আমাকে কথা শোনাচ্ছ— রুক্ষং শ্রাবয়সে বীর প্রাকৃতঃ প্রাকৃতামিব। এই ‘প্রাকৃত’ জনের কথাটা প্রাচীন কাব্য-মহাকাব্যের মধ্যে বারবার এসেছে এবং তা অনেক সময়েই এসেছে সেই সব প্রসঙ্গে যখন একজন বড়ো মানুষ বিসদৃশ আচরণ করছেন অথবা তাঁর চরিত্র অনুযায়ী ব্যবহার করছেন না। যেমন রামচন্দ্র বা যুধিষ্ঠির অথবা একজন অভিজাত রাজা, যিনি জীবনের অন্য সময়গুলিতে অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করছেন, অত্যন্ত ভদ্র কথা বলছেন, তাঁরা যদি জঘন্য ব্যবহার করতে থাকেন, জঘন্য ভাষা ব্যবহার করতে থাকেন, তখন সেটা যেন জীবন থেকে চ্যুতি বলে মনে করা হয়, তাঁর চির-আচরিত চরিত্র থেকে সেটাকে যেন পতিত এক সাধারণ প্রাকৃত জনের আচরণ বলে মনে করা হয়।
তার মানে, এই সম্পূর্ণ কথালাপের যা নির্যাস দাঁড়াল, তাতে অনভিজাত নিম্নবিত্ত, সমাজের নিম্নস্তরের মানুষেরাই হলেন ছোটোলোক। এবং তারাই ঝগড়া করেন। আর উচ্চবর্ণ, উচ্চবিত্ত, মানী, অভিজাত কুলীন মানুষেরা যেন ছোটোলোকের মতো ঝগড়া না করেন। আমরা শুধু বলব— এইভাবে ছোটোলোক, বড়লোক বা ভদ্রলোক দেখিয়ে ঝগড়ার মাধুর্য এবং মাহাত্ম্যও যেমন কমানো যাবে না, তেমনই ঝগড়ার অনুষঙ্গে কাউকে ছোটোলোক বা নিম্নস্তরীয় সাধারণ জন বলে তাঁর একান্ত মানবিক ব্যবহারের নিন্দা করা যায় না। বরঞ্চ এটাই বলা উচিত, ঝগড়ার ক্ষেত্রে কোনও উচ্চ-নীচ, উত্তম-অধম বর্ণাশ্রম বিভাগ নেই। যিনি ঝগড়া করেন তিনিই ছোটোলোক, অর্থাৎ ঝগড়া করাটা ছোটোলোক বা সাধারণ প্রাকৃত জন-চরিত্রের কোনও ‘নেসেসরি কন্ডিশন’ নয়। সাধারণ লোকও ঝগড়া করে, অভিজাত কুলীনেরাও ঝগড়া করেন। কিন্তু আভিজাত্য, কৌলীন্য, ঐশ্বর্য এমনকী সৌন্দর্যের সঙ্গেও ঝগড়ার একটা বৈসাদৃশ্য আছে, যাকে আমরা বলি— মানায় না।
শুধু এই ‘মানায় না’ ব্যাপারটাই ঝগড়ার ক্ষেত্রে চরমতম বৈপরীত্য তৈরি করে বলেই ঝগড়া শোনার জন্য, ঝগড়া বোঝার জন্য আমার এত কৌতূহল। সব থেকে ভালো বলেছিলেন কবি ভর্তৃহরি। বলেছিলেন— সুন্দরী আমার। এমন বিশাল তোমার নিতম্বদেশ যে চোখ ফেরানো যায় না, আর এমন ক্ষীণ কটি পরিপাটি, তার মধ্যে স্তনযুগল যেমন সুন্দর তেমনই সুখকর— নিতম্বো বিশালো কটির্মধ্যলগ্না/ কুচদ্বন্দ্বমত্যন্তভব্যং সুখং চ। কিন্তু এমনই এক মনোহরণ সৌন্দর্যের মধ্যে তোমার কথার মধ্যে যদি এতটুকুও সরসতা না থাকে, তবে— ভর্তৃহরি অন্তত চার বার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছেন— তাহলে কী হবে এই মধুরতার— ততঃ কিম ততঃ কিম ততঃ কিম ততঃ কিম।
অর্থাৎ সেই বৈসাদৃশ্য— রমণীর শারীর-সৌন্দর্যের সঙ্গে তাঁর কথা, ভাষা, ব্যবহার মানাচ্ছে না। ভর্তৃহরির ক্ষেত্রে এটা একটা মহাকাব্যিক যন্ত্রণা হয়তো, এমনকী এটা মানতেই পারি যে, অপূর্বদর্শনা সুন্দরী মেয়েরা কটু কথায় কথা বললে, কিংবা ঝগড়া করলে এক্কেবারে সেটা মানায় না। আমি একটি বিয়ে বাড়িতে এক বিবাহিতা অতিসুন্দরীর দাম্পত্য কলহ দর্শন করেছিলাম। প্রথমে তিনি একা এসেছিলেন, পরে স্বামী তাঁর সঙ্গে যোগ দেন, কিন্তু এই স্বল্পমাত্র বিরহী সময়ের মধ্যে তাঁর আগমন-প্রক্রিয়ায় যে-সব ব্যাঘাত তৈরি হয়েছিল, তা নিয়েই ঝগড়া বেধে গেল স্বামীর সঙ্গে। স্বামী বেচারা যতই তাঁকে চুপ করানোর চেষ্টা করেন, যতই তিনি আত্মদোষ স্বীকার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন, তার সুন্দরী স্ত্রী ততোধিক ক্রোধে আরক্ত মুখভঙ্গে ততই ক্রোধ প্রকাশ করতে লাগলেন। সেদিন দেখলাম— আমার মতো দুর্জনের সঙ্গে আরও বহুতর স্ত্রী-পুরুষ এই কটু কলহ আস্বাদন করছেন এবং উৎসব উপলক্ষে উপস্থিতা অন্য রমণীরা দু-একজনে আমার সামনেই তাঁদের স্বামীদের মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন— নন্দিনীকে দেখলে তো আর চোখ ফেরাতে পারো না, এদিকে যাচ্ছিলে, ওদিকে যাচ্ছিলে, নন্দিনী স্টার্টারের মাছের বড়া পায়নি বলে তোমায় এনে দেবার কী ছিল? দেখলে তো চেহারাটা, ওইরকম সবার সামনে তোমাকে বললে তোমার ওই নন্দিনী-হাভাতেপনাটা ঘুচত।
এটা অবশ্য মানতে হবে যে, অসম্ভব সুন্দরী নন্দিনী-বউদি যখন স্বামীর উদ্দেশে কটু ভাষণ করছিলেন, তখন তাঁর মুখ, চোখ, দাঁত সব কিছু এত তীক্ষ্ন হয়ে উঠেছিল, যা ভর্তৃহরির মতো আমাদের সংবেদনশীল মনে বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। কিন্তু এই বৈপরীত্য তো সর্বত্র আছে। কর্পোরেট ভাবনায় আকণ্ঠ ভাবিত মানুষ যখন বাজারে লাউওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করেন, অতি উচ্চশিক্ষিত মহিলা যখন বাসন মাজার কাজের লোককে গালাগালি দেন, অথবা সৌম্যদর্শন সাধু-সন্ত যখন অতি অল্প দোষে একান্ত ভক্তের ওপর ক্রোধারক্ত হয়ে ওঠেন তখনও তো ওই একই বৈপরীত্য এবং বৈসাদৃশ্য তৈরি হয়। আমি তো সুন্দরী রমণীকুলের ক্রোধপাতিত্যের চেয়েও লোভ-মোহ-ক্রোধ-জয়ে প্রতিজাত সাধুর ক্রোধপতন দেখে আরও বেশি মর্মাহত হই। আমি নন্দিনী-বউদির কথা বুঝি— একেবারে বয়ঃসন্ধির কাল থেকে আত্মীয়স্বজন সুন্দরী বলে তোল্লাই দিয়েছে, পাড়া-বেপাড়ার অনন্ত রক থেকে পৌরুষের শারীর-সংগীত শুনতে শুনতে একদিন বিয়ে হয়ে গেল নন্দিনীর, তার পরেও তার সৌন্দর্য স্তুতি কমেনি, বরঞ্চ স্বামী ছাড়াও আরও দেখনদার বলনদার স্তুতি পাঠক তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এমত অবস্থায় নিজেকে বহু কৌশলে বাঁচিয়ে এবং ততোধিক কৌশলে নিজেকে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’-র তাত্ত্বিকতায় খোয়াতে-খোয়াতে নিজের মধ্যে যে আত্মরমণ এবং আত্মসচেতনতা তৈরি হয়, তার ধকল কী কম! এ-সব ক্ষেত্রে স্বামীর ভূমিকা ভীষণ রকমের ‘সাপোর্টিভ’ হওয়া দরকার। অতিরিক্ত ফাগুনের মধ্যে অতিরিক্ত আগুন থাকলে তার একটা আঁচ লাগবেই। ফলত স্বামীর দিক থেকে ঈষৎ ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখলেই নন্দিনী-বউদির অন্তর-কুকুর চেঁচিয়ে ওঠে ঘেউ ঘেউ করে। আমরা দেখি, মজা পাই, কিন্তু একবারও তলিয়ে দেখি না যে, শুধু সৌন্দর্য এবং সে বিষয়ে আত্ম-সচেতনতা থাকার জন্যই যে মুহূর্তে তার কথা ঝগড়ায় পরিণত হচ্ছে, সেই মুহূর্তেই আমরা সেই বৈপরীত্য অনুভব করছি এবং বলছি— মানাচ্ছে না। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা হল— কোন ঝগড়াটা মানায় এবং কোন ঝগড়াটাই বা আমাদের মতো কৌতূহলী জনতার ভালো লাগে না। অসুন্দরী রমণী ঝগড়া করলে তাকে ঝগড়ুটে বলে গালাগাল দেবেন, আর যে পুরুষ দিন-রাত ঝগড়া করছে, দিন রাত অসভ্যতা করছে, ফ্ল্যাট বাড়িতে বসে বউকে পেটাচ্ছে, তার বউ যদি স্বামী-শ্বশুর, শাশুড়ি-ননদের উদ্দেশে কটুক্তি করে, তাহলে বৈসাদৃশ্য-বৈপরীত্য অন্যভাবে তৈরি হয়। উপাদেয়তার ক্ষেত্রে এই ঝগড়াও প্রতিবেশিকে সমান আন্দোলিত করে, ক্ষুব্ধ করে, এমনকী কখনও মায়াগ্রস্তও করে।
দেখুন ঝগড়া পৃথিবীতে থাকবেই, বিদ্বেষও পৃথিবীতে থাকবে এবং সেগুলো দেখে মজা পাওয়ার জন্য, পরচর্চা করার জন্য আমরাও আছি এবং থাকব। একজন নীতিবাগীশ শ্লোক বেঁধে বলেছিলেন— আরে, আমরা কি শালগ্রাম শিলা নাকি? কেউ দ্বেষ করছেন না, কেউ কারও কাছে কিছু যাচনা করছেন না, কেউ পরনিন্দা করছেন না, না ডাকলে কেউ নিজে থেকে যেচে আসছেন না— এমনটা যদি হয়, তাহলে পাথরও দেবতা হয়ে যায় এবং ঠিক সেই কারণেই শালগ্রাম শিলা ভগবান বলে চিহ্নিত হয়েছেন— তেনাশ্মানো’পি দেবতাম। কিন্তু সাধারণ অনুভূতিসম্পন্ন দেবতাদের দেখুন— তাদেরও রাগদ্বেষ আছে। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরেরও ইগো আছে যথেষ্ট, এক দেবতা আর এক দেবতাকে সহ্য করতে পারেন না। মনসা শিবের মাহাত্ম্যে ঈর্ষান্বিত হন, মঙ্গলচণ্ডী কাতর হন অন্য দেবতার পুজোপচারে। একমাত্র শালগ্রাম-শিলার বিকার নেই বলেই তিনি সর্বেশ্বর বিষ্ণু-ভগবান বলে চিহ্নিত হয়েছেন। সেখানে মানুষ কোন ছার, অতি বড় মানুষেরও হিংসা-দ্বেষ, লোভ-মোহ থাকবে এবং তা দেখে পরনিন্দা করা বা পরচর্চা করার লোকও থাকবে।
তবে আমার জীবনে দেখেছি— পরমা সুন্দরী রমণী এবং অত্যন্ত জ্ঞানী-মুনি-ঋষি-সাধু-সন্ত— এঁদের অবস্থা সমান। অতি সুন্দর রমণীর সামান্য একটু বাক্যদোষও যেমন তাঁর সৌন্দর্য-মাহাত্ম্যে কলঙ্করোপণ করে, তেমনই সাধুদের জীবনে যদি একবার কামনা-বাসনার রক্তিম স্পর্শ লাগে অথবা তাঁদের বাক্য হয়ে ওঠে পরুষ, কর্কশ তাহলে এইরকম অধিক্ষেপ বারবার শুনেছি— এই নাকি আবার সাধু? এই নাকি তার আচার? বস্তুত অতিসংবেদনশীল সহৃদয়ের কাছে রবীন্দ্রনাথ যেমন কখনও পায়খানায় যান না, অতি সুন্দরীরাও তেমনই বাস্তবতার অন্তরালে বিচরণ করেন, সাধু সন্তদের সম্বন্ধেও তেমনই সামান্যতম ঐহিকতাও যেন তাঁদের চরিত্রদূষণ হিসেবে গণ্য হয়। তবে সুন্দরীদের সঙ্গে সাধুদের পার্থক্য হল— সুন্দরীদের বাক-পারুষ্য মানায় না, কিন্তু সাধুদের সেটা বেশ মানায়, সাধুরা যেন রেগে মেগে খারাপ কথা বেশ বলতে পারেন। কিন্তু দৈবাৎ যদি সাধুদের মধ্যে বিষয়াসক্তি দেখা দেয়, দৈবাৎ যদি তাঁদের স্ত্রীলোকের প্রতি সামান্যতম দুর্বলতাও দেখা যায়, তাহলে আর রক্ষা নেই— মুখর জগতের মুখ নার আচ্ছাদিতে।
সাধু-সন্তদের কথা কেন রুক্ষ হয়, দু-চারজন ছাড়া অনেকেই কেন কর্কশ-বাক্য ব্যবহার করেন, তার পিছনে কিছু যুক্তি দিয়েছেন শাস্ত্রকারেরা। তাঁরা বলেছেন— সাধুরা কৃপা করেই সাধারণ মানুষের প্রতি দুর্বাক্য ব্যবহার করেন। আমরা তো সাংসারিক ভোগ-সুখে, মায়া-মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছি, সেই মোহপাশ ছিন্ন করার জন্যই সাধুরা কর্কশ ভাষায় কথা বলেন। এতে নাকি ভালোই হয়, সংসারের মায়া-মোহের অভিমুখ থেকে মানুষকে খানিকটা আধ্যাত্মিকতার দিকে টেনে আনাটাই যেহেতু ঈশ্বরভাবিত সাধুজনের কাজ, তাই অন্যমনস্ক ছাত্রের প্রতি মাস্টারমশাইয়ের স্নেহক্রোধের মতোই সাধুদের দুর্বাক্য-ব্যবহার। অন্য পণ্ডিতেরা অবশ্য খানিক মনস্তাত্ত্বিক কারণও দেখিয়েছেন সাধুদের ব্যবহারে, যদিও সাধু কথাটা উল্লেখ না করায় এই পাণ্ডিত্যভাবনাটা আরও বেশি যৌক্তিক মনে হয়। এই শাস্ত্রকার উপমা দিয়ে বলেছেন— মনুষ্যজগতে অথবা প্রাণীজগতে যারা সামান্যতম ভোগ-বিলাসেও জীবন কাটায় না, তাদের মধ্যেই সর্ববিষয়ে রুক্ষতা দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। শাস্ত্রকার সাপের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন— সাপেরা তো প্রায় হাওয়া খেয়ে থাকে বলে মনে হয়, অথচ বিধাতাকে দ্যাখো, সাপেদেরই তিনি দুটো জিভ দিয়েছেন— বাতাশিনো দ্বিজিহুতং বিহিতং পশ্য বেধসা।
চেরা জিভ অথবা দুটি জিভ বাক্যের কর্কশতা অথবা লোভের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। আমার জীবনে আমি বহুতর সাধু-সন্ত দেখেছি, যাঁরা প্রথম জীবনে অনেকেই অত্যন্ত বৈরাগ্যবান ছিলেন, কিন্তু পরবর্তী জীবনে যখন তাঁদের মাহাত্ম্য এবং সাধনসম্পদ বাড়ছে, তখন তাঁদের ভিতরে অন্যতর এক পরিণাম-রমণীয়তা আসে। আমি একটি সন্ত-সভায় দ্বিপ্রহরে উপস্থিত হয়েছিলাম— আমাকে ভোগের প্রসাদ দেওয়া হল, প্রচুর সেবা করলাম। আমার পাশেই এক সাধুজি খেলেন, তিনি অন্যত্র অন্ন (ভাত) গ্রহণ করেন না। তাঁকে ফল-মিষ্টি-দেওয়া হল। তিনি যে পরিমাণ ফল-মিষ্টি খেলেন তা আমার অন্নকূটকেও হার মানাল— পরিশেষে একটি পাঁচশো গ্রাম দইয়ের ভাঁড়। পরিতৃপ্ত অন্নপান। আবার পরিণত বয়সের বেশ কিছু গুরুজিকেও দেখলাম। ভবরোগিণী স্ত্রী-ভক্তদের উদ্ধার করার জন্য তাঁরা এতই বেশি মনোযোগী যে পুরুষ ভক্তরা সেখানে ঈর্ষ্যাসূয়ায় ভুগতে থাকেন। ভবরোগের জায়গায় তখন বিভিন্ন রকম মনোরোগ তৈরি হয়।
অনেকে অবশ্য এই ধরনের সাধুসন্ত দেখলে তীব্র নিন্দা করতে থাকেন, স্ত্রীলোকের প্রতি ঈষৎ সদাশয়তা বা তাঁদের অন্নপান তথা জীবনযাত্রার মধ্যে খানিক বিলাসিতা দেখলে অনেকেই খুব ক্ষুব্ধ হন। একটু উঁচুতে উঠে এমন কথাও আমাকে বলেছেন— আপনাদের মহাভারত-রামায়ণে এই তো সব মুনি-ঋষিদের হাল। এক একজন উর্বশী মেনকাদের দেখছেন আর স্খলিত হচ্ছেন সমস্ত বিভ্রমে? বিশ্বামিত্র, সৌভরি, মিত্রাবরুণ— কে বাদ আছেন এই পৃথিবীতে? আমরা এ-কথা অস্বীকার করি না আবার বিশ্বাসী শাস্ত্রকারদের এই যুক্তিও মানি না যে, তপস্যা জ্ঞান এবং মুক্তসঙ্গতার শক্তি একজন মুনিকে প্রায় ঈশ্বরের সমতায় নিয়ে যেত বলেই তিনি যথেচ্ছ কাম-ক্রোধের আধার হতে পারেন। ভাগবত পুরাণ তো বলেই দিয়েছে— আগুন তো সব কিছুই ভোজন করে ফেলতে পারে, তেমনই পৃথিবীতে তেজস্বী পুরুষেরা অনেক লোকবিরুদ্ধ ব্যবহার করতে পারেন, যা সাধারণ মানুষকে মানায় না। তবু সাধারণ মানুষকে নিয়ে এই দুশ্চিন্তা আমার সব সময়েই থাকে যখন অনেক মানুষকেই দেখি এবং বলতে শুনি— অমুক মানুষটা সেইটে করলে দোষ হয় না, আর আমি করলেই দোষ? বস্তুত সাধারণ্যে সত্যিই এমন একটা সাধারণ অভ্যাস প্রায়ই দেখি যে, নিজেকে অনেকেই অসাধারণ ভাবেন, নিদেন পক্ষে ‘হলেও হতে পারতাম’ — এটা তো প্রায় চিরন্তনী ধারণা।
আমরা কিন্তু তেজস্বী জনের কাম-ক্রোধের বিকারকে তেজস্বিতার অজুহাতে সমর্থন করতে চাই না। কেননা বহু বহু বড়ো মানুষের এতাদৃশ ব্যবহার অন্য বহুতর কারণেই সঙ্গে হলেও তা লোকশিক্ষার অন্তরায় হয়। আবার অনেক দেখে অনেক অভিজ্ঞতায় মহাভারত বলেছে— এমন গুণবান মহাপুরুষ প্রায় দেখাই যায় না যিনি অন্যের নিন্দা না করে চুপ করে থাকেন অথবা আত্মপ্রশংসা পরিহার করে সদাসতত অন্যের প্রশংসা করেন— অব্রুবন কস্যচিন্নিন্দামাত্মপূজামবর্ণয়ন। তার মানে সোজা কথা, গুণবান হন, ত্যাগ-বৈরাগ্যবান মুনি-ঋষি-সাধুই হন অথবা কর্কশভাষী গুরুই হন, তাঁদেরও ‘বাক্য-মনোবেগ, ক্রোধ-জিহ্বাবেগ’ অথবা ‘উদর-উপস্থ-বেগ’ও থাকতে পারে। তবে কিনা এঁদের আকস্মিক বিকারটুকু শুদ্ধও করে দিতে পারে সহজেই। অবশ্য আমার নিজের ‘থিওরি’ এখানে খুবই সংবেদনশীল। আমার নিজের কাছে পূর্বের যুক্তিটাই বহাল আছে এখনও। আমার মনে হয়— সুচিরকাল ধরে কোনও ভোগ-উপভোগের মধ্যে না গিয়ে যাঁরা বৈরাগ্য-ত্যাগ-উপবাস করে এলেন, অতঃপর মুহূর্তের অসংযমে তাঁদের সমস্ত তপস্যাটা নষ্ট হয়ে যায় না। কেননা তপশ্চরণের মাধ্যমে, নিরন্তর যোগের মাধ্যমে, সদাসর্বদা ঈশ্বরে মনঃপ্রণিধান করা কী সম্ভব, নাকি চিত্তশুদ্ধিই সম্পূর্ণভাবে সম্ভব! অতএব সাধু-সন্ত-সন্ন্যাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ রমণীর বিষয়ে দুর্বল, আবার কেউ বা বেশ ঝগড়ুটে। এই ব্যাপারটা শুধু আমরা নই, এটা লক্ষ্য করেছেন যাঁরা শাস্ত্রকার, তাঁরাও।
ভগবদগীতার পঞ্চম অধ্যায় পড়ার সময় একটা শ্লোক নজরে আসবে। সেখানে বলা হচ্ছে— বাপু! কর্ম করে যাও, যদি ভেবে থাকো যে, খুব তাড়াতাড়ি সন্ন্যাসী হয়েই ব্রহ্মজ্ঞান পেয়ে যাব, তাহলে ভুল ভেবেছ। কর্মযোগ নিয়ত পালন করতে করতে চিত্তশুদ্ধি ঘটবে, তখন যোগযুক্ত সন্ন্যাসীর পক্ষে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব হবে। তা নইলে অপক্ব অবস্থায় সন্ন্যাসীর নানান বিপদ। এই শ্লোকের টীকা করার সময় সর্বজনের মান্য শ্রীধরস্বামী একটি শ্লোক উদ্ধার করেছেন আরেক প্রসিদ্ধ টীকাকারের লেখা থেকে। শ্লোকে বলা হচ্ছে— সন্ন্যাসীরা অনেকেই আছেন যাঁরা কাম-মোহের গ্লানিতে প্রমাদগ্রস্ত, কারও নাকি আবার ধ্যান-বৈরাগ্যে মন বসে না, মন শুধু বাইরে যেতে চায়। কেউ বা আবার বেশ খলজনও বটে, যাঁরা অকারণে অন্যের মধ্যে দোষ আবিষ্কার করেন, আবার বেশ কিছু সন্ন্যাসী আছেন যাঁদের ভালোরকম প্রবৃত্তি আছে ঝগড়া করার দিকে— প্রমাদিনো বহিশ্চিত্তাঃ পিশুনাঃ কলহোৎসুকাঃ। টীকাকার শাস্ত্রপ্রমাণে জানিয়েছেন— দৈবদোষে সন্ন্যাসীদের মধ্যেও এমন দুষ্প্রবৃত্তি দেখা দেয়, তাঁরা খলস্বভাবে কাজ করেন অথবা ঝগড়া করেন। কিন্তু আমরা বলি— এটা দৈবদোষ নয়, এটা স্বভাবদোষ। এখানে সন্ন্যাসী আর বড়োলোকের তফাৎ নেই। যাঁরা ভাবেন— অকারণে দোষ আবিষ্কার করার খলস্বভাব শুধুমাত্র সাধারণ আর মধ্যবিত্তের পরিসর অথবা ঝগড়া করাটা শুধু গরীবগুর্বো আর জাঁহাবাজ মহিলাদের পরিসর, তাঁদের আমি ভারতবর্ষের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখতে বলব। আর বুদ্ধিমান খল মানুষ যে কত আছেন, তা দেখতে পাবেন বড়ো বড়ো কর্পোরেট কোম্পানির কলা-কুশলীদের মধ্যে। তাঁরা যে কত সূক্ষ্ম অনুচ্চ কলহে কত সৎপুরুষের সর্বনাশ করে দিতে পারেন, তা জানেন তাঁরাই, যাঁরা ভুক্তভোগী।
আমি তো আমোদী মানুষ, আমি শুধু ঝগড়া দেখে সুখ পাই। আর এই মনুষ্যজন্ম লাভ করে বহুতর ঝগড়া দেখলামও। ছোটোবেলায় বাপ-জ্যাঠা-কাকাদের ঝগড়া দেখেছি— কিন্তু তখনকার দিনের কুলতন্ত্র এবং পারিবারিক মূল্যবোধ অতিমাত্রায় জাগ্রত থাকায় সে-সব ঝগড়া কোনওকালেই খুব গভীর ছিল না। তবে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশির দশকে যৌথ পরিবার ভেঙে ভেঙে অণু-পরিবার সৃষ্টির যে বিচিত্র স্বার্থপদ্ধতি শুরু হল, সেখানে আমার কাছে সবচেয়ে অসহ্য ছিল শাশুড়ি-বউদের ঝগড়া। এটা আমি কোনওদিনই ‘রেলিশ’ করতে পারিনি। এখানে পুত্র-সন্তানেরা অদ্ভুত ধর্মসংকটের মধ্যে পড়েন, গর্ভধারিণী মায়ের প্রতি স্নেহঋণের কর্তব্য আর স্ত্রীর প্রতি যৌনঋণ এবং আরোপিত রোম্যান্টিকতা— এই দুয়ের দ্বৈরথে যুবক ছেলেগুলি তাড়াতাড়ি প্রৌঢ়-বৃদ্ধ হয়ে উঠত। তবে এখানে আমার কাছে সবচেয়ে আমোদের বিষয় ছিল অবক্ষীণ যৌথ পরিবারের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তখনও দুই ছেলে এক মেয়ে, অথবা দুই ছেলে নিয়ে বিধবা মায়েদের সাংসারিক অধিবেশনগুলি। বিশেষত ষাট-সত্তরের দশকে মায়েরা অনেকে সেভেন-এইট-নাইন বড়জোর টেন পর্যন্ত বিদ্যে নিয়ে সংসার-সীমান্তে চলে আসায় এবং নিজেরাও অনেকে অনেক ক্ষেত্রে যৌথ পরিবার ভাঙায় শামিল থাকায় নব্য পুত্র-কন্যার বৈবাহিক জীবনে তাঁদের ভূমিকা প্রায় রাজনৈতিক হয়ে উঠত। সংসারে নিজস্ব অথচ অকর্মণ্য প্রতিষ্ঠা রক্ষার জন্য এঁরা কখনও বড়ছেলের দিকে ঝুঁকতেন কখনও বা ছোটছেলের দিকে। এঁর যদি আবার পরগৃহোষিতা একটি বিবাহিতা মেয়ে থাকেন, তবে তিনিও কালে এবং অকালে এসে মায়ের সঙ্গে এক ভাইয়ের বিড়ম্বনা বাড়াবেন এবং অন্যতরের মাহাত্ম্য স্থাপন করবেন। এইসব সংসারের মা-জননীদের রাজনীতি-প্রবণতাজনিত যে ঝগড়াগুলি আমি দেখেছি, তা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ঝগড়াগুলির অন্যতম। দেখবেন, ঝগড়া হলে একতরফের প্রতি একটা আপেক্ষিক পক্ষপাত আসে। কিন্তু এই পারিবারিক ঝগড়ার মধ্যে Playing one against the other— এর রাজনীতি থাকায় এই ঝগড়াগুলিই আমি শুধু সইতে পারিনি। তবে সইতে পারার চেয়েও আরও কঠিন এবং কষ্টকর বোধহয় নিজের বউয়ের অন্যের সঙ্গে ঝগড়া। সযৌক্তিক হোক অথবা অযৌক্তিক হোক নিজের বউ যখন অন্যের সঙ্গে ঝগড়া করতে-করতে আমার দিকে চেয়ে আমাকেই সাক্ষী মানতে থাকেন, তার চেয়ে কঠিন এবং অসহনীয় অবস্থা বোধহয় পৃথিবীতে নেই। হয়তো শুধু এই কারণেই কলহপ্রিয়া রমণীর প্রতি এত বিরাগ ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের। ভার্যা, স্ত্রী মানেই তাদের কাছে সেই গৃহিণী মানুষটি বিনা প্রতিবাদে শুধু গৃহকর্ম করে যাবে— সা ভার্যা যা প্রিয়ংব্রুতে—, ঝগড়া যদি করতে হয় তো অন্যের সঙ্গে করুক, কিন্তু আমার সঙ্গে যেন না করে। হয়তো এদেরই পতিব্রতা নারী বলে।
আর এই শেষ ঝগড়ার কথাটুকু পৃথিবীর তাবৎ মানুষের কাছে ন্যাকামি এবং স্ত্রৈণতা, কিন্তু ব্যক্তি-পুরুষের কাছে জীবন-মরণ সমস্যা। এই ঝগড়ায় নিশান্তের চাঁদ পর্যন্ত ধূসর-ম্লান হয়ে ওঠে কিন্তু প্রিয়ার মান যায় না, এই ঝগড়ায় নিকট সরসীর সমস্ত কমলকলি একে একে ফুটে উঠতে থাকে কিন্তু ভালোবাসার মানুষের মুখ তবু ফোটে না। এই ঝগড়ায় বাইরের শত মৌমাছির গুন-গুন শব্দ শোনা যায় কিন্তু ঘরের মানুষটির গলায় শব্দ শুনতে পাই না তবু। এমনকী সেই ভোরের বেলায় পূর্ব দিগবধূর মুখখানি পর্যন্ত রবিকরের স্পর্শে রক্তিম হয়ে ওঠে কিন্তু তার মধ্যে অনুরক্তিমার চিহ্ন আসে না কোনও— রক্তা শত্রুদিগঙ্গনা রবিকরৈর্নাদ্যাপি রক্তাসি কিম?
সত্যি বলতে কি— এই ঝগড়া কবিকুলের পরিসর। এখানে রাধা মানিনী হবেন, কৃষ্ণ ‘দেহি পদপল্লবম’ বলবেন। কিন্তু বাস্তবের বিবাহপূর্ব জীবনে আকাঙ্ক্ষিতা প্রেমিকার মান হলে তারই সঙ্গে থেকে অস্তচন্দ্রের ধূসরতাও দেখা যায় না, আর কমলকলির ফুটে ওঠা তো পুরী থেকে ফেরার ট্রেনে ডান দিক বরাবর। অবশ্য বাস্তব জীবনে মানিনীদের মানও অনেক ‘ইগোসেন্ট্রিক’ হয়ে গেছে অথবা বরাবরই তাই ছিল। এখনকার দিনে অনেক স্ত্রী-পুরুষের বিবাহিত জীবন দেখলে আমার বেশ মায়া লাগে। এখানে ঝগড়া জোরে হয় না, ফলে আমার পুলকিত হবার সুযোগ নেই। আর যদি বা জোরে হয়ও, তা স্তিমিত হয়ে শুধু আত্মাভিমান বাড়ায় এবং কেমন এক নিশ্চিন্ত সমাধি লাভ করে। যৌথ পরিবারের ভগ্নাংশও উপস্থিত না থাকায় লোক দেখানো সম্পর্ক রাখারও দায় থাকে না। তাই এই ঝগড়া আর জোড়ে না, শুধুই ভাঙতে থাকে। বিবাহপূর্ণ জীবনে যাঁরা প্রেম করে বিবাহ করেছিলেন এবং বিবাহোত্তর কালে এক রক্তিম জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেখানে যৌথ পরিবারের কোনও অবকাশ ছিল না, তবু প্রেমের কী গতি হয়, সেটা বোঝার আগে বুঝি এক পুরাতনের দুঃখ বোঝা দরকার।
সেকালে রাতের গভীর ছাড়া স্বামী স্ত্রীর দেখা হওয়া বড় কঠিন ছিল। পুরুষায়িত সমাজে পুরুষ-স্বামী যদিও বা ছোঁক ছোঁক করতেন, কিন্তু স্ত্রী সেখানে সাড়া দিলেই তিনি বেহায়া, ঝগড়া-ঝাঁটি হলে এখানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঢুকে পড়বেন আত্মীয়-বন্ধুরা। সব দেখে-শুনে তিক্ত-বিরক্ত এক মহাকবি বড় গভীর এক সত্য উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন— আরে! এটাকে প্রেম বলে নাকি? পুরুষ মানুষ আর মেয়ে-মানুষের একটা ‘পরিচয়’ ছাড়া এই বিবাহিত জীবনটা কিছুই নয়। বাড়ির যাঁরা গুরুজন তাঁদের মর্যাদা পদে পদে বজায় রেখে এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা কিছু হল তো সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে এসে ঢুকবে সহৃদয় আত্মীয়স্বজন-বন্ধুরা-সুহৃদো যস্মিল্লভন্তে’ন্তরম। প্রিয়তমা স্ত্রীর সঙ্গে যদি বা কিছু ঠাট্টা-ইয়ার্কি বা রসিকতার সুযোগ হয়, তবে তা জোর করেই হয় এবং তাও সম্ভব হয় শুধু বৈবাহিক প্রেমের নিয়মবশত। সেখানে আবার স্ত্রীর লজ্জা নামক একটা বৃত্তি আছে, যা সবসময়েই তাকে আটকে রাখছে। তারপর আর কী; দিনের পর দিন আমরা প্রেমের শপথ নিই— এইসব কিছু ঠিক হয়ে যাবে— যল্লজ্জা নিরুণদ্ধি যত্র শপথৈরুৎপাদ্যতে প্রত্যয়ঃ— অথচ এটাকেই আমাদের প্রেম বলতে হবে। এটাকে প্রেম বলে নাকি?
সাংসারিক জগতে বহুজনের অপেক্ষা মেটাতে মেটাতে এবং নিজেকে সার্থক স্ত্রী হিসেবে প্রমাণ করার তাড়নায় বঙ্গদেশের বহু প্রেম ‘আপনার পথ’ খুঁজে পায়নি। কিন্তু যেখানে পেয়েছে, যেখানে যৌথ পরিবার এবং বহুজনের দুর্মন্ত্রণা কোনও বাধা সৃষ্টি করেনি, সেই দ্বৈত বৃত্তের মধ্যে এক স্বামীকে দেখেছিলাম। প্রথম জীবনে যৌথ পরিবারের বহুতর যন্ত্রণা তাঁদের জীবনে ছিল এবং তাতে তাঁর স্ত্রীকে অনেক কষ্ট সইতে হয়েছে। কিন্তু স্বামীও সেটা পরোক্ষে সয়েছেন এবং তার জন্য তার অনুশোচনাও কম ছিল না, কিন্তু অসহায়তা ছিল তার চেয়ে বেশি। অথচ এ-সবের শেষে যখন দ্বৈতপ্রেমের জীবন এল, তখন পূর্বের দশ বছরের প্রতিশোধ আরম্ভ হল অদ্ভুত এক আত্মপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে। স্বামী-বেচারা কায়িক এবং মানসিক শ্রমে স্ত্রীকে একেবারে তোলা-তোলা করে রাখতে চাইলেন। স্বামী তাঁকে বলতেন—
আপসে পহেলিবার মিলনেকি বেচয়নিয়াকো ক্যায়সে ভুলা দুঁ,
আপকি আঁখো কি গহরাইকো ক্যায়সে ভুলা দুঁ,
আপসে মিলনেকি চাহ তো হর ওয়ক্ত হোতী হ্যায়।
পর ইস জমানেকি রসমো রিয়াজোকো ক্যায়সে ভুলা দুঁ।
কিন্তু এইসব তোষামোদে কোনও কাজ হয়নি। যা ঘটেছে, তা কেন ঘটেছে, তারই অনন্ত বিচারণায় কলহ-বিবাদ চলতে চলতে আরও দশ বছর শুধু কলহান্তরিতা হয়ে পড়েন গৃহীণি। স্বামী হয়ে ওঠেন আরও ন্যুব্জ, কুব্জ, ভারের বেগেতে ঠেলে চলা এক শ্রমিক। কায়িক, বাচিক এবং সাংসারিকতা বহন করতে করতে স্বামী ধীরে ধীরে একদিন যান্ত্রিক হয়ে ওঠেন উদাসীনতায়। আমার নিজেরও ধারণা— যদি এটা অতিসংবেদনশীল রোম্যান্সের ক্ষেত্রও হয়, তবে নায়িকার দিক থেকে অতিরিক্ত প্রণয়-মান এবং প্রণয়-কলহ পুরুষ নায়ককে একদিন বৈদান্তিকভাবে আত্মস্থ করে তোলে। এক মহাকবি, তাঁর নাম জানা নেই, তিনি এই সত্য উদ্ধার করে নায়িকার সখীর জবানীতে লিখেছিলেন— হ্যাঁরে! আর পাঁচটা ঘরে গিয়ে আর পাঁচটা যুবতী মেয়েকে দ্যাখ না তুই, তাদের জিজ্ঞাসা করে দ্যাখনা যে, প্রতিদিন তাদের প্রিয়তম পুরুষটি এসে একবার করে তাদের পায়ে ধরে সাধছে কিনা। তুই তো এই মানুষটাকে ঘরের চাকর বানিয়ে রেখেছিস একেবারে— প্রেয়াংসঃ প্রণমন্তি কিং তব পুনর্দাসো যথা বর্ততে। আমার কিন্তু এবার বিপরীত মনে হচ্ছে। তুই নিজেই নিজের বড় ক্ষতি করতে চলেছিস এবার। তুই লোকের কথায় নাচিস না আর। ভালো কথা বলছি শোন— তাঁর দিক থেকে সমস্ত স্নিগ্ধতার রস যদি ছুটে যায় একবার, তাহলে সেই পুরুষটার পিছন পিছন চলেও কিন্তু আর তাকে ফেরাতে পারবি না কোনওদিন— ছিন্নস্নেহরসা ভবন্তি পুরুষা দুঃখানুবর্ত্যা যতঃ।
আমি এমন প্রণয়-কলহের কথাও শুনতে চাই না কোনওদিন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন