গজগামিনী

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

মানুষের মনের মধ্যে এই বার্তাটা যে কীভাবে এমন করে গেঁথে গেল, সেটা আমি এখনও বুঝিনি। আমার ছোটোবেলায় তো পুজো আসলেই মা-ঠাকুমাদের মুখে এই কথাটায় হর্ষ বিষাদের বিবরণ শুনতাম— এবারে তো দেবীর ‘গজে আগমন’, আর কোনও চিন্তা নেই, ফসলের অভাব হবে না। অথবা এবার তো দোলায় আসছেন দেবী, মড়ক লাগবে রে, মড়ক লাগবে। এই যে চরম এবং পরম বিশ্বাস— এই বিশ্বাসটাকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা করি সেই মানুষটাকে, যিনি অসীম ক্ষমতায় সরল সাধারণের মধ্যে এই ভিত্তিহীন ধারণাটাকে চারিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে, দেবীর গজে আগমন হলে বসুমতী শস্য-শ্যামলা হবে অথবা দেবীর নৌকায় আগমন হলে প্রচুর বৃষ্টি হবে, বন্যা হবে, কিন্তু অবশেষে শস্য-বৃদ্ধিও ঘটবে। কিন্তু তটস্থ হয়ে বিচার করলে দেখা যাবে— এই বচনাটার মধ্যে একটা সৈদ্ধান্তিক চমৎকার আছে বটে, কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পিছনে যুক্তিগুলির শাস্ত্রীয় ভিত্তি নেই কোনও।

যুক্তির কথাই বলি— এটা তো ঠিকই যে অলৌকিক লোকের দেব-দেবীকে আমরা বিশ্বাস নাও করতে পারি, না মানতে পারি দেবতার মূর্তি, তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার, অস্ত্রশস্ত্রও। কিন্তু কী জানেন— দেবতার সৃষ্টি, তাঁর মূর্তি, তাঁর বেশভূষার পিছনে আমাদের দার্শনিক যুক্তি আছে, সর্বোপরি দেবতার প্রতি আমাদের প্রিয়ত্বের যুক্তি আছে। এমনকি তাঁর পুজো কোন তিথিতে, কোন নক্ষত্রের স্পর্শে উজ্জীবিত, সুন্দর হয়ে উঠবে, তার তো একটা ভীষণ রকমের গাণিতিক শাস্ত্র আছে আমাদের দেশে। কিন্তু সবার ওপরে এই যে প্রত্যেক পঞ্জিকার মধ্যে দেবীর আগমনীতে একটি বিশেষ বাহন এবং গমনে অন্যতর এক বাহন, অবশেষে একটা বিশেষ ফল— এটার কোনও মানেই আমি বুঝিনি এবং কোনওদিন কোনও যুক্তিতে বুঝব বলেও মনে হয় না।

হ্যাঁ, এটা একটা মহৎ ভাবনা বটে যে, আমাদের দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহের ক্ষেত্রে চতুরঙ্গ-বাহিনী-চালনার একটা ভাবনা ছিল, তার দুটো এখানে এসেছে হাতি এবং ঘোড়া। কিন্তু রথ, পদাতিক আসেনি, অতএব যুদ্ধ বিগ্রহের ভাবনা থেকে দেবীর গজে আগমন, কিংবা ঘোটকে গমন— এসব চিন্তা আসেনি। সাধারণ পথ চলার সুবিধে অথবা পথ-বাহক হিসেবেই হাতি, ঘোড়া, নৌকো এবং দোলা বা পালকিতে যাতায়াতের কথাটা এসেছে। কোন সূত্র ধরে, কোন ভিত্তিতে এই গজে আগমন কিংবা ধরা যাক দোলায় গমন নির্দিষ্ট হয়, তার জন্য এক মূর্খ মহামানব একটি সংস্কৃত শ্লোক বেঁধেছিলেন এবং তাঁর সংস্কৃত ভাষাটাই এখানে মহাকালের বিশ্বাস তৈরি করে দিয়েছে।

দেবী দুর্গার পূজারম্ভ হয় সপ্তমী তিথিতে, ধরে নিতে হয়— সেটাই দেবীর মর্ত্যে আগমনের দিন। এখন এই দিনটা যদি রবিবার কিংবা সোমবারে পড়ে, তাহলে দেবীর গজে আগমন অর্থাৎ তিনি হাতীতে চড়ে আসছেন, আবার দেবীর দশমী-বিসর্জনের দিনটা যদি ওই রবি-সোমের একটা হয়, তাহলে দেবীর গজে গমন— রবৌ চন্দ্রে গজারূঢ়া। এইভাবে শনি-মঙ্গলবার যদি সপ্তমী পড়ে তবে দেবীর ঘোটকে বা ঘোড়ায় আগমন, বিসর্জনের দিন শনি-মঙ্গলবার হলে ঘোটকে গমন। নৌকায় দেবীর আগমন হতে গেলে সপ্তমী পড়তে হবে বুধবারে, আবার বিসর্জনের দিন বুধবার পড়লে তাঁর নৌকায় গমন। শেষটা হল দোলায়— বৃহস্পতি কিংবা শুক্রবারে সপ্তমী কিংবা দশমী পড়লে সেই বার অনুযায়ী দেবীর দোলায় আগমন কিংবা দোলায় গমন— গুরৌ শুক্রে চ দোলায়াং নৌকায়াং বুধবাসরে।

দেখুন আমি এই পর্যন্তও মেনে নিতে রাজি ছিলাম। বেশ তো, একজন অতিপ্রাকৃত কল্পনায় ভেবেছেন— রবি-সোমে দেবীপূজার আরম্ভ বা শেষটাকে হাতিতে চড়ে আসা যাওয়ার কল্পনায় দেখব, কিংবা শনি-মঙ্গলবারে তাঁর আসা-যাওয়াটাকে ঘোটক বাহিনী কল্পনায় সিদ্ধ করব। একই রকম মানবী কল্পনাও না হয় করলাম দেবীকে বুধবার নৌকায় বসিয়ে কিংবা বৃহস্পতি-শুক্রে তাঁকে দোলায় বসিয়ে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে এই দুর্বুদ্ধি মহাকবি বিশেষ বিশেষ এই সব বারে দেবীর গমনাগমন ঘোষণার পর তার ফল ঘোষণা করেছেন। এমনও হতে পারে যে, যিনি বার অনুযায়ী হাতি-ঘোড়ার বাহন কল্পনা করেছেন, তিনি ফলটা ঘোষণা করেননি। সেটা করেছেন অন্যতর এক ধূর্ত যার খেয়েদেয়ে কাজ ছিল না, কিন্তু সংস্কৃতের ভাষাজ্ঞান মাত্র ছিল আর ছিল বদমায়েসি বুদ্ধি— যাতে দুটো ভালো বলে আর দুটোতে সার্বজননীন আশঙ্কা তৈরি করে।

ফল ঘোষণায় তিনি লিখেছেন— দেবীর যদি গজে আগমন হয়, অর্থাৎ যদি সপ্তমীর দিনটা রবি-সোম হয়, তবে যেমন সুন্দর বৃষ্টি হবে, তেমনই শস্যপূর্ণা হয়ে উঠবে এই বসুন্ধরা— গজেচ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। এটা জানি আমরা যে, হাতি খুব ভালো প্রাণী, বৃহত্ত্বে এবং ভারবত্তায় হাতির মতো জন্তু দ্বিতীয় নেই। বাহন হিসেবেও বনে-জঙ্গলে ধীর ভ্রমণে এমনটা আর হয় না। কিন্তু হাতির সঙ্গে বৃষ্টির জল কিংবা শস্যময়ী বসুন্ধরার কোনও কার্য-কারণ সম্পর্ক আমি কোনও গবেষণার বুদ্ধিতেই খুঁজে পাইনা। অবশ্য ‘ফার্টিলিটি কালট’ কিংবা ‘ডোমোস্টিসিটি’— এইসব হম্বিতম্বির বড়ো বড়ো কথা বলে যেহেতু সবই প্রমাণ করা যায় তাই সেদিক থেকে হাতিকে যদি বা বর্ষা আর ‘বপ্রক্রীড়াপরিণ-গজের’ প্রেক্ষণীয়তায় শস্যক্ষেত্রেও তার অনুপ্রবেশ ঘটাই, কিন্তু হাতির সঙ্গে রবি আর সোমবারের সম্পর্কটা কোন পুরাণ-গহন থেকে উঠে আসল, সে আমি এখনও ধরতে পারিনি। আর আমার যা বিদ্যে বুদ্ধি, তাতে এই ‘অপূর্বনির্মাণ-নিপুণ’ কবির এই বিচিত্র মহাভাষ্য আরও বেশি ভয়ংকরী হয়ে ওঠে ঘোটকারূঢ়ার আগমন-নির্যানে।

শনি-মঙ্গলে দেবীর সপ্তমী-বিহিত আগমন ঘটলে নাকি অনাবৃষ্টি আর দুর্ভিক্ষ হয়। সংস্কৃতে তার শ্লোকার্ধ হল— ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে। কথায় বলে— মূর্খ যতক্ষণ মুখ ফুটে কথা না বলে, ততক্ষণই ভালো, কথা বললেই আপাদমস্তক মূর্খতা ধরা পড়ে যায়। প্রথমত জানাই— কালী পূজা, দুর্গা-পূজা কিংবা যে কোনও শক্তি আরাধনার ক্ষেত্রে শনি-মঙ্গলে বার হল সবচেয়ে প্রশস্ত। এখানে রজোগুণ কিংবা রক্তবর্ণের ভৌম প্রতীক হিসেবে মঙ্গলবার কিংবা শনির দৃষ্টি কাটানোর জন্য শনিবারেই মায়ের আরাধনার ব্যাপারে কোনও তান্ত্রিকী যুক্তি উপস্থাপন করতে চাই না, শুধু এই বার দুটিতে কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, তারাপীঠে গিয়ে দাঁড়াবেন এবং দেখবেন— কতক্ষণে আপনি দেবীমূর্তির সামনে গিয়ে শুধু প্রমাণ করার সুযোগ পান। কিন্তু আমাদের এই বারের পণ্ডিত লিখেছেন— দেবী শনি-মঙ্গলবারে আসলে-গেলে সেটাকে ঘোটকে আগমন-গমন বলতেই হবে— অর্থাৎ কিনা আমরা যদি একটা গামছাকে তলোয়ার বলে বলবোই ঠিক করি, তাহলে সেই যুক্তিতে শনি-মঙ্গলবারে সপ্তমী পড়লেই দেবীর বাহনে ঘোড়ার কল্পনা করা যেতে পারে। আর এর ফল কী? না, সব ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। এই মূর্খ কী ছত্রভঙ্গ মানে জানেন, নাকি গালভরা একটা শব্দ প্রয়োগ করে লোক ভোলালেই হল!

আমরা জানি— এখনও যদি একটা উৎকট জন-সমাবেশ হয়, এবং সেটা যদি শাসকপক্ষের পছন্দ না হয়, তাহলে পুলিশ লাঠি চালালে জনতা যখন ছড়িয়ে যায়, পালিয়ে যায়, তখন আমরা বলি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। বস্তুত প্রাচীনকালে— সেনাবাহিনীর যে রথ কিংবা হাতি চলত তখন সৈন্য-সেনাপতির রথে একটি করে ছাতার মতো আবরণ শক্ত করে লাগানো হত। এটা রোদ-বৃষ্টি আটকানোর জন্যও বটে আবার মর্যাদার প্রতীকও বটে। রথ-বাহিনী এবং হস্তীবাহিনীতে এই বহু ছত্রের সমাবেশ যদি প্রতিপক্ষের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে যেত, তাহলে সেই একত্র সমাহিত ছত্র-যুক্ত রথ, হাতি এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেলেই সেনার ছত্রভঙ্গ ঘটে যেত। এই দৃষ্টিতে দেখলে পরে শনি-মঙ্গল বার সপ্তমী পড়লে কীসের ছত্রভঙ্গ হবে ভেবে পাই না বলে মূর্খের ভাষ্যকার মূর্খতর ব্যাখ্যা দিয়ে বলে— শুকনো মাটিতে ঘোড়া আসা মানেই ধুলো, রাজভীতি, রাজার পেয়াদা আরও কত কিছু, তার মানে অনাবৃষ্টি দুর্ভিক্ষ হবে। হায়! শনি-মঙ্গলবার দেবীর আগমন ঘটলে কী ঘোড়া-রোগে যে এত কোথায় ছত্রভঙ্গ হয়, এটা আমার বুদ্ধিতে কুলোয় না।

এর মধ্যে বুধবারের সপ্তমীর ফলটা ভালো বলেছেন মূর্খ পণ্ডিত। দেবীর নৌকায় আগমন-গমন হলে ভালো বর্ষা, ভালো শস্য— শস্য বৃদ্ধিস্তথা জলম। পুজোর আগে এবং পুজোর সময় অতি বৃষ্টি, বন্যা হলে বুধবারে যদি সপ্তমী পড়ে তবে এই মূর্খের কথাটা ‘কয়েনসাইড’ করে, আর লোকে ভাবে— কী ভবিষ্যৎবাণী করেছে লোকটা। কিন্তু চতুরের এই লোক ঠকানো ফল ঘোষণা একেবারে ব্যর্থ হয়ে যায়, যখন তিনি বলেন— দেবী দোলায় চড়ে আসলে ফল হচ্ছে মড়ক— দোলায়াং মরকং ভবেৎ। অর্থাৎ কিনা সপ্তমী কিংবা দশমী যদি বৃহস্পতি কিংবা শুক্রবারে পড়ে, তাহলে মড়ক লাগবে। বৃহস্পতি-শুক্রের মতো দুই দেবাসুরগুরুর সঙ্গে দোলার যোগাযোগ কোথায়— তাও যেমন আমার ভাবনায় আসে না, তেমনই দেবী দোলায় ওঠার সঙ্গে মড়কের সম্পর্ক কী, তাও বুদ্ধিমানের পুরাণ-চর্চায় আসে না। আমরা মধ্যযুগের কবির বাণীতে সোচ্ছ্বাস মন্তব্য শুনেছি— ‘তারে বলি সুকৃতি যে দোলা-ঘোড়া চড়ে’। তার মানে পালকির দোলায় চড়া অথবা ঘোড়ায় চড়া হল সুকৃত কর্মের লক্ষণ। দুটিই মঙ্গলবহ— পুরাণ-ইতিহাস দোলায় আরোহণ এবং অশ্ববাহনের মঙ্গল শুনিয়ে আসছে বেদের আমল থেকে। সেই ঘোড়ার সঙ্গে দোলাও অচ্ছুৎ হয়ে গেল বার-ঘোষক এই মহাকবির কাছে। মানুষটার বিপদ আরও বেড়েছে কেননা, এখন কলেরা-টাইফয়েডে মানুষ মরছে না। মড়ক-ব্যাপারটাই উচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

অতএব শেষ পাতে মানুষ জনকে জানাই— এই মূর্খ কবির শ্লোকের চমকে দোলা-ঘোড়ার সঙ্গে হাতি-নৌকাকেও একত্রে রাখবেন সুফলের জন্য। গ্রহ-নক্ষত্র তিথির কথা হলেও কিছু ভাবতাম অন্যরকম, কিন্তু কতগুলি বিশেষ বারের ওপর নির্ভর করে দেবী দুর্গার করুণা-মূর্তিকে অগ্রাহ্য করে কিংবা দোলা-ঘোড়াকে অচ্ছুৎ করে দেওয়াটা ভীষণ অন্যায় হবে। হাতি-ঘোড়া-পালকি জয় কানহাইয়া লালকী।

***

অধ্যায় ২২ / ২২

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন