নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
তথাকথিত প্রাচীন অনার্য জনসম্প্রদায়গুলির একাংশ ম্লেচ্ছ নামে পরিচিত, শতপথ ব্রাহ্মণে ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটিকে একটি আর্যেতর বর্বর ভাষা-নাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রাহ্মণদের ‘ম্লেচ্ছ’ ভাষায় কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে, কারণ এটি অসুরদের ভাষা। পণ্ডিতরা মনে করেন যে, সব জনজাতি আর্যসভ্যতা প্রবর্তিত সংস্কৃত ভাষা উচ্চারণে সক্ষম ছিলেন না, তাঁরাই ম্লেচ্ছ হিসেবে বিবেচিত হতেন। স্বয়ং বৈয়াকরণ পতঞ্জলি তাঁর পম্পপা আহ্নিকে ব্যাকরণ শাস্ত্রের উপযোগিতা দেখাতে গিয়ে বলেছেন— আমরা যাতে ভুল সংস্কৃত উচ্চারণ না করি, সেজন্যই ব্যাকরণ পড়া দরকার, কেননা ম্লেচ্ছ মানেই অপশব্দের উচ্চারণ— তস্মাদ ব্রাহ্মণেন ন ম্লেচ্ছিতবৈ নাপভাষিতবৈ। ম্লেচ্ছো হ বা প্রষযদপশব্দঃ ম্লেচ্ছা মা ভূম ইত্যধ্যেয়ং ব্যাকরণম। এখানে ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটি ক্রিয়াপদ রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে ভুল সংস্কৃত উচ্চারণের প্রতিশব্দ হিসেবে। মহর্ষি মনু স্বয়ং ম্লেচ্ছ ভাষা ব্যবহারকারীদের দস্যু এবং অত্যন্ত হীন চরিত্র বলে বর্ণনা করেছেন, মনুর উপদেশ মতে ম্লেচ্ছরা এতটাই হীন চরিত্রের যে এঁদের সব সময়ই মন্ত্রণা স্থল থেকে দূরে রাখা উচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মহাভারতেও ম্লেচ্ছভাষার উল্লেখ পাওয়া যায়। পাণ্ডবরা যখন বারণাবত যাচ্ছিলেন সে সময় বিদুর ম্লেচ্ছ ভাষায় যুধিষ্ঠিরকে জতুগৃহ সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, মনে রাখা দরকার যে, বিদুর জন্মসূত্রে দাসী গর্ভজাত, ফলে বিদুরের পক্ষে নিম্নবর্গের মধ্যে প্রচলিত ম্লেচ্ছ ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। অন্যদিকে শৈশব থেকে বিদুরের বিশেষ ঘনিষ্ঠ যুধিষ্ঠিরও তাঁর থেকেই ম্লেচ্ছ ভাষার ব্যবহার শিখেছিলেন, ফলে কুরুবংশীয় বিদূর বা যুধিষ্ঠিরের ম্লেচ্ছ ভাষা ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে ওঠার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
তবে ম্লেচ্ছ বলতে শুধুই আর্যেতর ভাষাভাষী বা আর্যেতর আচার আচরণকারী বোঝায় না। আর্য-পূর্ব ভারতীয়রাও অনেকেই জাতিগতভাবে ম্লেচ্ছ নামে কথিত হয়েছেন। সেক্ষেত্রে ম্লেচ্ছ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে শুধুমাত্র ভাষা হিসেবে নয়, প্রাচীন আর্য-পূর্ব জনজাতির নাম এবং তাঁদের সংস্কৃতি হিসেবেও। ঐতিহাসিক রোমিলা থাপর ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটিকে ভাষার থেকেও অনেক বেশি সংস্কৃতি বলে ব্যাখ্যা করেছেন—Mlechha represents a caltural event rather than a linguistic fact.
থাপর ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণের সাহায্যে বুঝিয়েছেন যে ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটিও কোনও মৌল শব্দ নয়। এই শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সুমেরীয় শব্দ Me-luh-ha থেকে। সুমেরীয়রা ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমের অধিবাসীদের Me-luh-ha নামে উল্লেখ করতেন। এই ‘মেলুহা’দের সঙ্গে সুমেরীয়দের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান চলত। সেক্ষেত্রে প্রাচীন উত্তরপশ্চিম ভারতের সিন্ধু সভ্যতার মানুষজনই ‘মেলুহা’ নামে চিহ্নিত হতেন বলে বোঝা যায়।
ঐতিহাসিক I. Mahadevan হরপ্পার দুটি প্রাচীন লিপি চিত্রের পাঠোদ্ধার করেছেন, যেখানে দেখা যায় যে, হরপ্পার অধিবাসীরা নিজেদের অভিহিত করত ‘মিল-এচ’ নামে। হরপ্পার এই প্রাচীন জনজাতির কাছে ‘মিল-এচ’ শব্দের অর্থ ছিল— যে মানুষরা উচ্ছ্বল। এই মিল-এচ শব্দটিই সুমেরীয় ভাষার ‘মেলুহা’-তে রূপান্তরিত হয়েছে আর এই ‘মিল-এচ’ শব্দ থেকেই পরবর্তী সময়ে ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দের উৎপত্তি। পণ্ডিত থাপর এবং মহাদেবনের বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, পরবর্তী সময়ে আর্যরা ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটিকে যতই নেতিবাচক অর্থে প্রয়োগ করুন, কিংবা ম্লেচ্ছ ভাষাকে যতই হীন বলে বর্ণনা করা হোক না কেন, ‘ম্লেচ্ছ’ ভাষাভাষী এবং ‘ম্লেচ্ছ’ জনজাতির মানুষজন ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিলেন। [Romila Thapar, The Image of the Barbarian in Early India, In Cultural Pasts, p. 236]
রামায়ণেও ম্লেচ্ছজাতির উল্লেখ মেলে। রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের সময় অযোধ্যায় ম্লেচ্ছ রাজপুরুষরা উপস্থিত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। আবার সীতাহরণের পর সুগ্রীব সীতার সন্ধানে তাঁর বানর সেনাপতিদের যে সব দেশে পাঠিয়েছিলেন সেগুলির মধ্যে ম্লেচ্ছদেশ অন্যতম।
ম্লেচ্ছ জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে মহাকাব্য ও পুরাণে একাধিক কাহিনি প্রচলিত আছে। কুরুরাজ যযাতির পুত্রদের সঙ্গে ম্লেচ্ছদের উৎপত্তি বিশেষভাবে সম্পর্কিত। যযাতির তিন পুত্র যদু, তুর্বসু এবং অনু প্রত্যেকেই নিজের যৌবনের পরিবর্তে পিতার জরা গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় অভিশপ্ত হন, যযাতি তাঁর দুই পুত্র যদু ও তুর্বসুকে ভবিষ্যতে ম্লেচ্ছ জাতির অধিপতি হওয়ার অভিশাপ দেন, তবে এ প্রসঙ্গে অনুর অভিশপ্ত হওয়ার ঘটনাটি সবিস্তারে আলোচনা করা প্রয়োজন। পিতার জরা গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হওয়ায় যযাতি অনুকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন যে, তিনি বেদ বর্ণিত অগ্নি সম্পর্কিত আচার থেকে বঞ্চিত হবেন— অগ্নিপ্রস্কন্দনর্পরন্ত্বঞ্চাপ্যেবং ভবিষ্যসি।। অভিশপ্ত অনুর বেদ-ধর্মচ্যুত উত্তর পুরুষরাই ম্লেচ্ছ নামে পরিচিত— অনোস্তু ম্লেচ্ছজাতয়ঃ।
আবার পুরাণে প্রচেতাগণের ঔরসে মারিষার গর্ভে দক্ষ নামে এক শক্তিশালী রাজার জন্ম গ্রহণের কথা পাওয়া যায়। এই দক্ষ থেকেই পরবর্তীকালে বহু ম্লেচ্ছ জাতির উদ্ভব হয়। অবশ্য মৎস্য পুরাণে প্রচেতার একশো পুত্রকে প্রচেতাগণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এঁরা সবাই উত্তরদিকে ম্লেচ্ছ রাজ্যগুলির অধিপতি হন।
মহর্ষি বশিষ্ঠের কামধেনু নন্দিনীর দেহ থেকেও ম্লেচ্ছ জাতির উদ্ভব হয়েছিল, ঋষি বিশ্বামিত্রের সৈন্যরা নন্দিনীকে হরণ করার চেষ্টায় তাঁকে চাবুকের আঘাতে আহত করেন, আহত নন্দিনীর দেহ থেকে এ সময় বহু অনার্য জনজাতির উদ্ভব ঘটে। এই সময় নন্দিনীর মুখ নিঃসৃত দুগ্ধজাত ফেনা থেকে ম্লেচ্ছ জনজাতির উদ্ভব হয়। উদ্ভূত হয়েই এঁরা বিশ্বামিত্রের সৈন্যদের আক্রমণ করে।
অপর একটি বর্ণনা অনুযায়ী স্বায়ম্ভুব মনুর বংশে অঙ্গ নামে এক প্রজাপতি ছিলেন। এই অঙ্গ মৃত্যুর কন্যা মুখরা ও খল স্বভাব সুনীথাকে বিয়ে করেন। সুনীথার গর্ভে অঙ্গের পুত্র অত্যাচারী রাজা বেণের জন্ম হয়। বেণের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ব্রাহ্মণকুল তাঁকে অভিশাপে দগ্ধ করেন। সেই সময় বেণের দেহ মন্থনের ফলে অসংখ্য ম্লেচ্ছ জনজাতির সৃষ্টি হয়। বেণের মাতা সুনীথার অংশ থেকে জাত বলে এইসব ম্লেচ্ছদের গায়ের রং কালো এবং চেহারা অত্যন্ত কুৎসিত—
তৎকায়ান্মথ্যমান্যাৎ তু নিপেতুর্ম্লেচ্ছজাতয়ঃ।।
শরীরে মাতুরংশেন কৃষ্ণাঞ্জনসমপ্রভাঃ।
ভাগবত পুরাণ মতে ঋষি বিশ্বামিত্রের মধ্যম পুত্রের নাম মধুচ্ছন্দা। এই মধুচ্ছন্দার নামানুসারে তাঁর একশোটি ভাই মধুচ্ছন্দস নামে বিখ্যাত। বিশ্বামিত্র পরবর্তীকালে অজীগর্তের পুত্র শুনঃশেফকে নিজ পুত্র রূপে গ্রহণ করেন এবং মধুচ্ছন্দসদের আজ্ঞা দেন শুনঃশেফকে তাঁদের জ্যেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। একশো মধুচ্ছন্দসদের মধ্যে ঊনপঞ্চাশজন বিশ্বামিত্রের আজ্ঞা পালন করতে অস্বীকার করেন। ফলস্বরূপ বিশ্বামিত্র এঁদের ম্লেচ্ছ হওয়ার অভিশাপ দেন।
হৈহয়, তালজঙ্ঘ ইত্যাদি ক্ষত্রিয় জাতির আক্রমণের ফলে ইক্ষ্বাকু বংশীয় রাজা বাহু রাজচ্যুত হন। বনবাসের সময় বহু কষ্ট সহ্য করে বাহু প্রাণত্যাগ করেন, এই বাহুর পুত্রই হলেন সগর। পিতার দুর্দশার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সগর শক, যবন, পারদ ইত্যাদি ক্ষত্রিয় জাতিগুলিকে পরাজিত করে তাঁদের বেদাচারচ্যুত ম্লেচ্ছ সম্প্রদায়ে পরিণত করেন।
সভাপর্বে ম্লেচ্ছদের আবার উত্তম, মধ্যম ও অধম— এই তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে— সর্বে ম্লেচ্ছাঃ সর্ববর্ণা আদি মধ্যান্তজাস্তথা।। এই তিন প্রকার ম্লেচ্ছরাই যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হয়েছিলেন।
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, প্রাচীনকালে ম্লেচ্ছ বলতে কোনও একটি বিশেষ জাতি নয়, বরং সেই সমস্ত জনজাতিগুলিকেই বোঝানো হত যাঁরা বেদাচার করতেন না। অর্থাৎ তখনও পর্যন্ত অনার্যায়িত, তাঁরা আর্য আচার-শুদ্ধতার অধীনে আসেননি। ফলে ম্লেচ্ছদেশ অর্থে কোনও একটি ভূ-খণ্ডকে বোঝানো হত না। যে সব অঞ্চলেই ম্লেচ্ছ জনজাতীয়েরা বাস করতেন, সেইসব অঞ্চলই ম্লেচ্ছদেশ, ভীষ্ম পর্বে ভারতের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত ম্লেচ্ছ অধ্যুষিত দেশ ও ম্লেচ্ছ জনগোষ্ঠীগুলির নামের একটি তালিকা পাওয়া যায়। সেই দেশ ও জাতিগুলি হল— যবন, চীন, কম্বোজ, বৈশ্য, শূদ্র, আভীর, দরদ, কাশ্মীর, পশু, খাসীর, অন্তচার, পহ্নব, গিরিগহ্বর, আত্রেয়, ভরদ্বাজ, স্তনপোষিক, প্রোষক, কলিঙ্গ, তোমর, হন্যমান ও করভঞ্জক, পুরাণেও এ জাতীয় একটি সূচি পাওয়া যায়। পুরাণে উল্লিখিত ম্লেচ্ছদেশগুলি হল— কুকুর, রৌন্ধ্র, বর্বর, যবন, খস, পুলিক, কুলত্থ, অঙ্গলোক, চীন, রুষান, দ্রুহ ইত্যাদি।
ভীম সেনের দিগবিজয় সূত্রে আবার ভারতবর্ষের পূর্ব উপকূলে বসবাসকারী ম্লেচ্ছদের কথা জানা যায়। ভীমসেন এইসব জাতিগুলিকে জয় করে তাদের কাছ থেকে কর হিসেবে মূল্যবান রত্ন, মণি-মুক্তা, অগরু, চন্দন, প্রবাল ইত্যাদি গ্রহণ করেন। এছাড়াও পূর্বদেশীয় ম্লেচ্ছ রাজারা তাঁকে শতকোটি পরিমাণ ধনও কর হিসেবে দেন—
স সর্বান ম্লেচ্ছনৃপতীন সাগরানূপবাসিনঃ।
করমাহারয়ামাস রত্নানি বিবিধানি চ।।
চন্দনাগুরুবস্ত্রাণি মণিমৌক্তিককম্বলম।
কাঞ্চনং রজতঞ্চৈব বিদ্রুমঞ্চ মহাধনম।।
তে কোটিশতসংখ্যেন কৌন্তেয়ং মহতা তদা।
আবার সহদেব দিগবিজয়ের সময় ভারতবর্ষের দক্ষিণদিকে অভিযান করেন। তিনি দক্ষিণ দিকের সমুদ্রতীরবাসী ম্লেচ্ছদের পরাজিত করেন, অন্যদিকে নকুল পশ্চিমদিকে অভিযানের সময় ওই অঞ্চলের ভয়ংকর ম্লেচ্ছ জাতিগুলিকে জয় করেছিলেন। নকুলের দিগবিজয়সূত্রেই জানা যায় যে, মহাভারতের কালে ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূল সম্পূর্ণভাবে ম্লেচ্ছ অধ্যুষিত ছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে, ভারতবর্ষের চতুঃসীমায় ম্লেচ্ছরা বাস করত, পুরাণে স্পষ্টই বলা হয়েছে ভারতবর্ষের চারদিকের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বর্বর ম্লেচ্ছদের বাস— দ্বীপো হু্যপনিবিষ্টো’য়ং ম্লেচ্ছৈরন্তেষু সর্বশঃ। বৃহত্তর ভারতের চারদিকের সীমান্তে ম্লেচ্ছ জাতিগুলির অস্তিত্বের কথা পুরাণে অন্য উপমার মাধ্যমেও উল্লেখ করা হয়েছে। পুরাণে পৃথিবীকে ভগবান নারায়ণের দেহজাত একটি পদ্মের আকৃতিবিশিষ্ট বলে বর্ণনা করা হয়। সেই পদ্মাকৃতি পৃথিবীর সব পাপড়িগুলিতে পর্বতসংকুল দুর্গম ম্লেচ্ছ দেশগুলি অবস্থিত।
তে দুর্গমাঃ শৈলচিতা ম্লেচ্ছদেশা বিকল্পিতাঃ।।
দ্রোণ পর্বেও ম্লেচ্ছদের একটি শাখার কথা পাওয়া যায় যাঁরা হিমালয় পর্বতের দুর্গে (সম্ভবত পার্বত্য গুহায়) বাস করত— ম্লেচ্ছানাং পাপকতৃনাং হিমবদদুর্গবাসিনাম।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, ম্লেচ্ছরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করতেন। ফলে কোনও একটি বিশেষ ভূখণ্ডকে ম্লেচ্ছদেশ রূপে চিহ্নিত করা অনুচিত। তবে পণ্ডিতদের একাংশের ধারণা, বর্তমান পাঞ্জাবের অন্তর্গত সির্সা (Sirsa) অঞ্চলটি মূলত ম্লেচ্ছদেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। মনে করা হয় যে, ‘মাহেচ্ছ’ (Mahechha) শব্দটি থেকেই ‘ম্লেচ্ছ’ কথাটির উৎপত্তি। ‘মাহেচ্ছ’ আবার ‘মাহেয়’ শব্দজাত, প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বর্তমান গুজরাটের আমেদাবাদ অঞ্চল দিয়ে মাহী নদীটি প্রবাহিত বলেই এই স্থানটি মাহেয় নামে এক সময় পরিচিত ছিল। এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, পুরাকালে ম্লেচ্ছদেশের বিস্তার খুরসান এবং উত্তর ইরাক পর্যন্ত ছিল। ডি সি সরকার বলেছেন যে, মহাভারতের যুগে ম্লেচ্ছদেশ বলতে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের বাইরে অবস্থিত অনার্য জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলকে বোঝান হত।
পুরাণে দক্ষিণ সাগর অর্থাৎ ভারত মহাসাগরের অন্তর্গত বহু পর্বত ও দ্বীপের উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে ম্লেচ্ছ জাতিদের বাস। এইসব দ্বীপগুলি হল— অঙ্গদ্বীপ, মলয় দ্বীপ ও বরাহদ্বীপ।
এছাড়াও ভীষ্ম পর্বে কুশদ্বীপে ম্লেচ্ছদের বসবাসের কথা পাওয়া যায়।
যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময় পূর্ব উপকূলে বসবাসকারী ম্লেচ্ছদের প্রাগজ্যোতিষপুরের (প্রাচীন কামরূপ) রাজা ভাগদত্তের নেতৃত্বে ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হতে দেখা যায়। এ থেকে পূর্ব দেশী ম্লেচ্ছদের উপর ভাগদত্তের প্রভাব স্পষ্ট হয়। মহাভারতে সে কারণেই ভগদত্তকে ম্লেচ্ছদের অধিপতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে— প্রাগজ্যোতিষাধিপঃ শূরো ম্লেচ্ছানামাধিপো বলী।
আবার যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ-এর সময় যজ্ঞীয় অশ্বটি ম্লেচ্ছ জনজাতিদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল, রীতি অনুযায়ী অশ্বটিকে অনুসরণকারী অর্জুনের সঙ্গে সে সময় ম্লেচ্ছ জাতিগুলির প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।
অশ্বমেধ-এর শেষেও ম্লেচ্ছ জনজাতির উল্লেখ পাওয়া যায়, যজ্ঞের পর পাণ্ডবরা প্রচুর ধন-সম্পদ দান করেন। ম্লেচ্ছরা সেই সব ধন-সম্পদ বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ম্লেচ্ছদের কৌরব ও পাণ্ডব উভয় পক্ষে যুদ্ধ করতে দেখা যায়।
ম্লেচ্ছরা হাতিতে চড়ে যুদ্ধ করতে বিশেষ পারদর্শী ছিল বলে মনে হয়। মহাকাব্যে ম্লেচ্ছ সেনাপতিদের হাতিতে চড়ে যুদ্ধ করার কথা বহুবার উল্লিখিত হয়েছে। দ্রোণ পর্বের বর্ণনা অনুযায়ী কৌরবপক্ষে যোগদানকারী ম্লেচ্ছরা বিশালাকৃতি বিশিষ্ট হাতিতে চড়ে অর্জুনকে প্রচণ্ড আক্রমণ করেছিলেন।
মহাভারতকার ম্লেচ্ছ সৈন্যদের চেহারার বর্ণনা করতে গিয়ে তাদের সম্পূর্ণ বা অর্ধেক মুণ্ডিত মস্তক অথবা জটাধারী বলেছেন, এঁদের মুখমণ্ডল দেখে অত্যন্ত কুটিল স্বভাব বলে মনে হত— মুণ্ডার্দ্ধ মুণ্ডান জটিলান, শুচীন কুটিলাননান। যুদ্ধে অর্জুন এত পরিমাণ ম্লেচ্ছ সৈন্য সংহার করেছিলেন যে, যুদ্ধক্ষেত্রের একাংশ ম্লেচ্ছদের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল।
কর্ণপর্বে মদ্ররাজ শল্যের সঙ্গে অঙ্গরাজ কর্ণের বাগবিতণ্ডার সময় কর্ণ ম্লেচ্ছদের অত্যন্ত কঠোর শব্দে সমালোচনা করেছিলেন। তিনি ম্লেচ্ছদের মানবদেহজাত বর্জ্য পদার্থের সঙ্গে তুলনা করেছেন— মানুষাণাং মলং ম্লেচ্ছ।
কর্ণের ভাষায় বিভিন্ন ম্লেচ্ছ জনগোষ্ঠীদের মধ্যে উটের ব্যবসায়ীরা আরও নিম্নস্তরীয়— ম্লেচ্ছানামৌষ্ট্রিকা মলম, ম্লেচ্ছরা শুধুমাত্র তাঁদের নিজস্ব সাংকেতিক ভাষা বুঝতে পারে— ম্লেচ্ছাঃ স্বসংজ্ঞানিয়তাঃ। এতে বোঝা যায়, ভারতবর্ষের কোথাও কোথাও সংস্কৃতের বাইরেও অতিপৃথক ম্লেচ্ছভাষা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
ম্লেচ্ছদের সম্পর্কে এছাড়াও বহু সমালোচনামূলক বর্ণনা মহাভারতে পাওয়া যায়। যেমন— অনুশাসন পর্বে ম্লেচ্ছদের সৎ মানুষের সঙ্গে বসবাসের অযোগ্য বলা হয়েছে, আবার মৌসল পর্বে মহাভারতকার গোপদস্যুদের নিন্দা করতে গিয়ে তাঁদের ম্লেচ্ছদের মতোই ধর্মহীন বলে উল্লেখ করেছেন।
অবশ্য অনুশাসন পর্বে স্বয়ং ভীম ম্লেচ্ছদের উপবাস রীতির প্রতি আকর্ষণের প্রশংসা করেছেন, পুরাণে ম্লেচ্ছদের পিতৃ আরাধনার কথাও একাধিকবার উল্লিখিত হয়েছে।
অঙ্গরাজ কর্ণ দিগবিজয়ের সময় ম্লেচ্ছদের জয় করেন ম্লেচ্ছরা এক সময় পুরুবংশীয় দুষ্মন্তের শাসনাধীনও ছিলেন। রাজা ভরতও ম্লেচ্ছদের পরাজিত করেছিলেন। আবার অসুর সুন্দ ও উপসুন্দ ত্রিভুবন জয় করার সময় ম্লেচ্ছ সংহার করেছিলেন।
দ্রোণ পর্বে সুহোত্র নামে এক প্রাচীন রাজর্ষির কথা পাওয়া যায়। এই সুহোত্র পৃথিবীকে ম্লেচ্ছশূন্য করেছিলেন।
বনপর্বে মার্কণ্ডেয় ঋষি যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে কলিযুগের নানান বিপর্যয়ের কথা জানানোর সময় বলেছিলেন যে, কলিযুগে ম্লেচ্ছরাজারা পৃথিবীকে অপশাসনে ভরে তুলবেন, সমগ্র পৃথিবী তাঁদের পাপে একটি বিষণ্ণ এবং নীতি বহির্ভূত স্থানে পরিণত হবে। কলিযুগের শেষভাগে সততার কোনও অস্তিত্ব থাকবে না, চারিদিকে শুধুমাত্র চৌর্যবৃত্তির প্রশংসা শোনা যাবে, সে সময় ভগবান নারায়ণ কল্কী অবতার রূপে আবির্ভূত হয়ে পৃথিবীকে ম্লেচ্ছমুক্ত করবেন।
পুরাণেও একই ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে, ম্লেচ্ছদের প্রভাবে কলিযুগে সমস্ত সম্প্রদায়ই তাঁদের নিজস্ব বিশুদ্ধতা হারিয়ে মিশ্র জাতিতে পরিণত হবে। ধার্মিক মানুষ নিজেদের বাসভূমি ছেড়ে উপকূলবর্তী ম্লেচ্ছ অধ্যুষিত নিম্নভূমিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবেন। কলিযুগে প্রায় ৩৮০ বছর ধরে শূদ্র ও ম্লেচ্ছরা পৃথিবী শাসন করবেন, তারপর কল্কীর হাতে শুরু হবে ম্লেচ্ছ নিধন, কল্কীর নিধন যজ্ঞের সময় ম্লেচ্ছরা ভয়ে হিমালয়ের গুহায়, গভীর অরণ্যে বা লবণাক্ত জলাভূমিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবেন।
আবার পুরাণে কলিযুগে পুরঞ্জয় বিশ্বস্ফূর্জি নামে এক রাজার আবির্ভাবের কথা বলা হয়েছে, এঁর শাসনকালে ম্লেচ্ছরা সিন্ধুনদ এবং চন্দ্রভাগা নদীর তীরভূমি এবং কাশ্মীর অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করবেন, এই সময় অধার্মিক, অসৎ এবং ব্রাহ্মণ হত্যাকারী ম্লেচ্ছরাই পৃথিবী শাসন করবেন। ফলে সমগ্র পৃথিবী ম্লেচ্ছাচারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
পুরাণেই দ্বাপর যুগের শেষ ও কলির প্রারম্ভে ভগবান বিষ্ণু প্রমতি নামে আবির্ভূত হয়ে পৃথিবীতে ম্লেচ্ছ সংহার করবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রমতি প্রায় কুড়ি বছর সময়কাল ধরে তাঁর বাহিনী নিয়ে ম্লেচ্ছ নিধন করবেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন