নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
এই প্রশ্নটায় আজকাল খুব বিরক্ত বোধ করি, একাধারে বিব্রতও। অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন— আচ্ছা, প্রাচীনকালে কি গোমাংস ভক্ষণ চলত? আমি উলটে জিজ্ঞাসা করি— কেমন প্রাচীন? খুব প্রাচীন, নাকি এই খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ-ছ’শ বছর? প্রশ্নকর্তারা এই সময়ে বিচলিত হন একটু। কিন্তু গোমাংস ভক্ষণের রীতিতে এই প্রসঙ্গটা আসবেই— কেননা, বহু প্রাচীনকালে গোমাংস খাওয়া হত, কিন্তু পরবর্তী প্রাচীনে তা বন্ধও হয়ে গেছে। একই সঙ্গে এটাও জানা ভালো যে, মানুষের খাদ্যাভ্যাস শাস্ত্রবিধি মেনে তৈরি হয় না, দেশ, জলবায়ু এবং মানুষের শারীরিক চাহিদা অনুযায়ী এক প্রকার সামাজিক খাদ্যাভ্যাস তৈরি হয়, ফলত কোনওকালে গোমাংস খাওয়া হত বলে এখনও গোমাংস খাওয়াটা খুব শাস্ত্রীয় হয়ে ওঠে এমনও যেমন নয়, তেমনই পরবর্তী প্রাচীন পর্যায়ে সেটা খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে বলে গোমাংস ভক্ষণটা খুব অশাস্ত্রীয় এমন ভাবারও কারণ নেই। আমি বরঞ্চ মাঝামাঝি প্রাচীন— মোটামুটি প্রাচীন— অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব হাজার থেকে আটশ খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। এটি বেদ এবং উপনিষদের মাঝখানে ব্রাহ্মণগ্রন্থের উদ্ধৃতি।
যাজ্ঞিক ঋত্বিক এখানে যজমানকে (যিনি যজ্ঞ করবেন) যজ্ঞশালায় প্রবেশ করানোর সঙ্গে সঙ্গে বলা হচ্ছে— এ যেন গোরু কিংবা ষাঁড় না খায়, কেননা গোরু এবং ষাঁড় এই পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রেখেছে। দেবতারা অন্যান্য সমস্ত প্রাচীন প্রাণশক্তি গোরু এবং ষাঁড়ের মধ্যে দিয়েছেন। অতএব এই দুটি প্রাণীকে খেয়ো না। খেলে মহাপাপ হবে। এই এক অনুচ্ছেদ ধরে গোমাংস ভক্ষণের সম্বন্ধে পাপ উচ্চারণ করার পর একেবারে শেষ পঙক্তিতে হঠাৎই এক নামী ঋষির স্পষ্ট উচ্চারণ শোনা গেল (সে তোমরা যে যাই বলো) গোমাংস ব্যাপারটা রান্না করার পর যদি বেশ তুলতুলে নরম হয়, তাহলেই আমি সেটা পছন্দ করি— তদু হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্যো অন্নাম্যেবাহম অমংসলং চেদ্ভবতি।
যাজ্ঞবল্ক্যের এই ছোট্ট কথাটা থেকে বেশ বোঝা যায় যে, পূর্বপ্রচলিত গোমাংস ভক্ষণের স্বাদ এখনও তাঁর মুখে বেশ লেগে আছে এবং যত নিষিদ্ধই হোক এখনও তিনি সে মাংস খান। আমার বলতে বাধা নেই— পরিপূর্ণ বৈদিক কালে যে বিরাট যাগ-যজ্ঞের আড়ম্বর তৈরি হয়েছিল, সেখানে যজ্ঞে পশুবধ করে তার মাংস দেবোদ্দেশে আহুতি দেওয়াটাও অন্যতম আড়ম্বর হিসেবে গণ্য হত। এই পশুর মধ্যে অন্যতম ছিল গোরু। আর ষাঁড় তো বারবার উচ্চারিত হয়েছে যজ্ঞীয় পশু হিসেবে। ঋগবেদের একটা ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে, ইন্দ্রের এক পুত্র একটি যজ্ঞ করেছেন, সেখানে অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রেরও আসার কথা ছিল, কিন্তু তিনি আসেননি। এই অবস্থায় বসুক্রের স্ত্রী একটু দুঃখ করেই বলছেন—
সমস্ত প্রভুসম্মিত দেবতারাই এই যজ্ঞে এলেন, কিন্তু আমার শ্বশুরমশাই ইন্দ্র এলেন না। যদি আসতেন তিনি, তাহলে ঘিয়ে ভাজা যবের ছাতু খেতে পেতেন, সোমরসও পান করতে পারতেন— জক্ষীয়াদ ধানা উত সোমং পাপীয়াৎ (ইন্দ্রের পুত্রবধূ এখনও আশা ছাড়েননি, তিনি শ্বশুরের উদ্দেশে বলেছেন—) পাথরের ওপর ছেঁচে যাঁরা সোমরস তৈরি করেন, সেই সোমরস তুমি পান করো, তারা অনেক ষাঁড়ের মাংস রান্না করেছেন, তুমি তা ভোজন করো— পচন্তি ত্বে বৃষভাঁ অৎসি তেষাং পৃক্ষেণ যম্মঘবন হূয়মানঃ— আহুতি চলছে, তুমি এসো।
আমাদের ধারণা, ইন্দ্র কিংবা অগ্নি বেদের খুব জবরদস্ত দেবতা বলেই গোরুর চেয়ে ষাঁড়ের মাংস বেশি পছন্দ করতেন। অগ্নির একটা বিশেষণই হল— উক্ষান্ন— উক্ষ মানে বাচ্চা ষাঁড়— ষাঁড়ের পক্ক মাংস সহ ভাত কিংবা ভাজা যবের ছাতু— উক্ষান্ন। আর ইন্দ্রের উদ্দেশে ঋষিরা ষাঁড়ের মাংস পাক করেন এ-কথা ঋগবেদের শব্দ-মন্ত্রে বলা আছে এবং সেটা তীব্র সোমরস সহ— অমা তে তুম্রং বৃষভং পচানি।
ষাঁড়ের মাংসস্তুতি শুনে এটা ভাবার কারণ নেই যে, তাঁরা গোরু খেতেন না। তবে হ্যাঁ, গোরুর ব্যাপারে একটা ভাবনা ছিল যে, বেশিরভাগ সময়েই একটা বন্ধ্যা গাভী, যজ্ঞীয় পশু বিহিত ছিল। এই বন্ধ্যা গাভীর বৈদিক ভাষা হল ‘বসা’। অগ্নিকে উক্ষান্নের মতো ‘বসান্ন’-ও বলা হয়েছে। আর উক্ষান্ন কিংবা বসান্ন যে শুধুমাত্র দেবতাদের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল না, সেটা প্রমাণ হয়ে যায় যজ্ঞীয় পশুটির ভাগ থেকে। ঋগবেদের পুরোহিত থেকে অথর্ববেদের পুরোহিত এবং তাঁদের সহকারী ঋত্বিকরা পশুর কোন কোন অঙ্গ এবং অঙ্গাংশ বাম-ডান কোন দিক থেকে পাবেন, তাও কিন্তু শাস্ত্রবিধি অনুসারেই বলা হয়েছে।
এইসব কথার ওপরে হল ‘গোঘ্ন’ কথাটা। গোঘ্ন শব্দের অর্থ হল অতিথি। কেননা বড়ো অতিথি এলে বাড়িতে গোরু কাটা হবে। গোরুটা অতিথির কারণে কাটা হত বলে অতিথির নামই হয়ে গেল ‘ঘোঘ্ন’। তাছাড়া অতিথি উপস্থিত হলে যে মধুপর্ক দানের রীতি ছিল, সে মধুপর্ক কিন্তু মাংস ছাড়া সম্পূর্ণই হত না— নামাংসো মধুপর্ক স্যাৎ— এবং সে মাংস হয় মাঝারি সাইজের একটি ষাঁড় অথবা বড়ো ছাগল— মহোক্ষং বা মহাজং বা।
অনেক দৃষ্টান্ত আরও দেওয়া যায়, কিন্তু সেটার থেকেও বড়ো প্রয়োজন এটাই বলা— ষাঁড়ের মাংস খাওয়াটা জনপ্রিয় ছিল বেশি, সেখানে গোরু খাওয়ার চল থাকলেও গোরুর দুধের মূল্য এবং পুষ্টি বেশ তাড়াতাড়িই বুঝতে পারেন প্রাচীন বৈদিকেরা, ফলে গোবধের জন্য বন্ধ্যা গাভীর ব্যবস্থাটা একটা ‘পয়েন্টার’। বৈদিক পরবর্তী যুগে গো দুগ্ধের বহুল উপকারিতা স্মরণ করেই কিন্তু যজ্ঞে গোবধ নিবারিত হতে থাকে। মহাভারতে রন্তিদেবের যজ্ঞে বহুল গোবধের কথা সগর্বে স্মরণ করা হলেও এই মহাভারতেই শুধু জীবনধারণের প্রয়াসে একটি গোরু পাবার জন্য অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, তবু একটা গোরু তাঁকে কেউ দেয়নি। তার মানে কি গোরু কমে আসছিল! নাকি গোহত্যা বন্ধের পিছনে নাস্তিক অহিংসবাদী বুদ্ধের বৌদ্ধিক আক্রমণও একটা কারণ। সে যাই হোক, গোরু খাওয়ার ব্যাপারে ব্যক্তিগত চয়েস এবং হজম শক্তিটাই জরুরি। অতএব গোরু খাওয়া বা গোবধ করা যেমন প্রগতিশীলতার কোনও মাপকাঠি নয়, তেমনই গোবধ যাঁরা করছেন কিংবা যাঁরা খাচ্ছেন, তাঁদেরকে কোনও অন্যায় অশাস্ত্রীয় চিহ্নে চিহ্নিত করাটাও একেবারেই কাজের কথা নয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন