নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
এই অসার্থক প্রবন্ধ-গন্ধী রচনার প্রথমাংশের সঙ্গে দ্বিতীয়াংশের কোনও মিল নেই। দ্বিতীয়াংশের সঙ্গে তৃতীয়াংশের কোনও সম্বন্ধ নেই। পরম্পরার তাৎপর্যও নেই। আমি বোকা এবং ছোটোবেলা থেকে রচনা লেখায় সবচেয়ে কম নম্বর পেতাম বলে কোনও রচনাকেই কার্য-কারণসূত্রে আবদ্ধ করে ক্রমিক আরোহণ পন্থায় যৌক্তিকতা সাজিয়ে সিদ্ধান্ত তৈরি করতে পারি না এবং প্রতিপাদ্যও তৈরি করতে পারি না। তবু যদি এই লেখা পড়ার পর আপনাদের মনে হয়— আমি কিছু বলতে চেয়েছি তাহলে বুঝবেন সেটা আপনার মনের ভুল।
আমি খাদক হিসেবে খুব পাউরুটি ভক্ত নই। কিন্তু বহমান জীবনে পরিস্থিতির তাড়নায় আমাকে বহু রকমের স্যাঁকা পাউরুটি খেতে হয়েছে। তাতে দেখেছি— উনুনের হালকা আঁচে মধ্যম-স্যাঁকা পাউরুটির মাখনের প্রলেপ সহ সবচেয়ে স্বাদু। কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে সবসময় এমন জোটে না, তাই যেটা সবচেয়ে আমার খারাপ লেগেছিল, সেটা বলা দরকার। আমার এক বউদিমণি। (নাকি নিরুপায় হয়ে) আমাকে একবার এক প্রসিদ্ধ কিসিমের পাউরুটি-স্যাঁকা খাইয়েছিলেন। সেই পাউরুটিটি ছিল অসম্ভব কড়া, কড়াক্কর, অনেকক্ষণ ধরে ধীর গভীর চেষ্টায় সেটাকে ওই পর্যায়ে নিয়ে এসে তার ওপরে মাখনের উদার প্রলেপ দিয়ে মোক্ষম দানা চিনি সহকারে আমাকে তিনি পরিবেশন করেছিলেন সেই পাউরুটি। স্বাদ গ্রহণের সময় দেখলাম— মুখের মধ্যে অনেকক্ষণ কড়মড়ির পরে সেই পাউরুটি বাগে এল অবশেষে, এমনকি প্রলিপ্ত মাখনের গন্ধটুকুও চর্বণের ক্রমে মাঝে মাঝে, ক্ষণিকের জন্য পথিমধ্যে ভাসমান সুন্দরীর বাস-গন্ধের মতো অনুভূত হল। সত্যি বলি— এই ধরনের স্যাঁকা পাউরুটি এবং মাখন আমি একেবারেই পছন্দ করি না, এমনকী ওই ক্ষণিকের উত্তাল বস্ত্রগন্ধও নয়।
মানুষের মধ্যে যাঁদের মুখে এই রকম মাখন থাকে এবং সমস্ত ব্যবহারটার মধ্যেই ওইরকম কঠিন কড়াক্কর ভাব, তাঁদেরও আমি কোনওদিন পছন্দ করতে পারলাম না। আমাকে একজন বলেছিলেন— যারা একদম রেগে যায় না, রেগে কথাও বলেন না, কখনও সৌজন্য-রুচিও অতিক্রম করেন না, তাঁরা সবচেয়ে মিষ্টি করে খুন করতে পারেন। উপরি-নির্দিষ্ট কড়া-পাউরুটিতে প্রলিপ্ত মাখন যেমন কখনও মেশে না, তেমনই আমি কত মিষ্টি বুদ্ধিজীবী দেখেছি, রাজনীতিক দেখি কত, সদা ব্যস্ত নেতা দেখি কত— তাঁরা হাসেন, সুন্দর কথা বলেন, ওপরের আলগা মাখনটুকুর গন্ধও পাওয়া যায়, অথচ কী সুন্দর করে খুন করতে পারেন তাঁরা। ওঁরা ভাবেন— কেউ কিছু বোঝে না, নাকের বদলে নরুন দিলেও বুঝবে না, কৃষির বদলে শিল্প দিলেও বুঝবে না, ওপরে মাখন দিয়ে কড়া পাউরুটি দিলেও বুঝবে না। আসলে সত্যিই তো বোঝে না। দিনের পর দিন লক্ষ লক্ষ মানুষকে অশিক্ষিত করে রাখার যে অসাধারণ শিল্প, সেটা ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি প্রদেশের প্রত্যেকটি রাজনীতিক এমনভাবেই আয়ত্ত করেছেন যে, আমি শুধু অবাক হই, শুধু অবাক হই। এত সাক্ষরতা অভিযান, এত সর্বশিক্ষা অভিযান, সব কি অসামান্য কৌশলে বিফল হয়। এত এম. পি. ফান্ড, এম. এল. এ ফান্ড— তাঁরা যদি গ্রামে গ্রামে দু-মাইল পর পর ইস্কুল প্রতিষ্ঠা করতেন, তাহলে অবহেলিত মানুষেরাও বুঝত যে, কৃষির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের উন্নতিও করা দরকার। এই দরকারটুকু বুঝলে সেটা কীভাবে, কোন বুদ্ধিতে করলে কৃষকের চির আচরিত অভিমানে লাগে না, অথচ শিল্পেরও সম্ভাবনা তৈরি হয়, সেটাও বোঝানো যেত। সবচেয়ে বড় কথা, এতগুলি মানুষের মাথা যেভাবে চলে গেল— সেটা যে কোনও রাজনৈতিক দলেরই হোক, এতগুলি মানুষের মাথার জন্য দরকার, রাজনৈতিক দল এবং বিরোধী দল সকলেরই বোধহয় আরও সুবিহিত চিন্তা করা উচিত ছিল। যে কোনও রাজনৈতিক নেতাই কিন্তু যখন প্রত্যাঘাতে বিপন্ন হন, তখন বলেন— আমরা জনগণের কাছে যাব। জনগণ আমাদের এখানে এনেছেন, আমরা জনগণের মতামত নেব। আমার শুধু জিজ্ঞাসা হয়— কারা এই জনগণ? তারা কি আমাদের মতো আপামর জন-সাধারণ? এর পরেই একটা বড় মিটিং হবে— গড়ের মাঠে বা অন্য কোনও মাঠে। বিশিষ্ট এবং প্রতিবিশিষ্ট কতগুলি মানুষ কাতারে কাতারে সংঘশক্তি দেখাতে দেখাতে আসবে— মুখ ভরে নিজেদের হরিনাম করবে এবং মাঠ ভরে হাগবে। ব্যাস! জনমত যাচাই হয়ে গেল, আপন গন্ধে আপনি পাগল কস্তুরীমৃগসম।
সত্য কথা বলছি, আমি কোনও বিশিষ্ট রাজনৈতিক দল বা সরকারের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করতে বসিনি। বিশ্বাস করুন, সে সাহসই আমার নেই— বড় বড় নেতাদের কথা ছেড়েই দিন, পাড়ায়-পাড়ায় গজিয়ে ওঠা দাদাদেরই আমি যথেষ্ট ভয় করি। আবার এতদদ্বারা যদি কেউ ভাবেন, আমি বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সমর্থক— আমি সেটাকেও ভয় করি। কারণ এই শ্যাম বঙ্গদেশের যা পরিস্থিতি, তাতে বিরোধীজনের সমর্থনও ভয়ের। যদি বলি— দেখুন, আমি কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থক নই, কিন্তু আমি রাজনৈতিক চেতনা-সম্পন্ন মানুষ, আমার সমালোচনা করার অধিকার আছে, তাতে আমাদের পাড়ার ধীরেনদা বলেছিলেন— গণতন্ত্রে সমালোচকের কোনও ঠাঁই নেই, সমালোচক মানেই তুমি বিরোধী পক্ষ। তোমাকে ঠ্যাঙানি খেতে হবে।
এতদিন সব দেখার পর আমি এই সার বুঝেছি— আমি বড় একা। এবং একা একা কিছুই করা যায় না। মহাভারতের দার্শনিক কবি উপদেশ দিয়েছিলেন— একটা বিরাট জনপদের মধ্যে যদি কোথাও অনেকের মধ্যে দুঃখ নেমে আসে, তবে একা একা তার জন্য কষ্ট পেয়ে লাভ নেই— ন জানপদিকং দুঃখম একঃ শোচিতুমর্হূতি— কারণ একা একটা কষ্ট পেয়ে যদি অনেকের দুঃখ প্রতিকার করতে পারো, তবে সুযোগ থাকলে সেই চেষ্টাই করো, কেননা শুধু শুধু কষ্ট পেয়ে সত্যিই লাভ নেই, আমরা ভাবি এটা সত্যিই খুব দার্শনিক কথা যে, একা একা দুঃখ পেয়ে কোনও লাভ নেই। কিন্তু মহাভারতের কবি তো আর ভারতবর্ষের গণতন্ত্র দেখেননি, আর আমাদের মধ্যেও সেই দার্শনিকতা নেই, যাতে জ্ঞানপদিক দুঃখে শোকগ্রস্ত না হয়েও প্রতিকারের চেষ্টায় সময়মতো উজ্জীবিত হতে পারি। মধ্যবিত্তের মনস্তত্ব বড় জটিল, তাদের ক্ষমতা নেই, কিন্তু প্রতিবাদ আছে, জ্ঞান নেই কিন্তু মুখরতা আছে, ত্যাগ করার শক্তি নেই, কিন্তু সামান্য কর্তব্য সাধন করলেই আত্মশ্লাঘা তৈরি হয়। আমিও তো বোধ হয় এইরকম একসাধারণ মধ্যবিত্ত যে সংসার চালাতে গেলে শুধু ডি. এ. বাড়ার হিসেব করে মিষ্টির দোকানে প্রথমে জিলিপি আর কচুরি সাঁটিয়ে তারপর বাজার করে এবং বাড়িতে গিয়ে বলে— সকালে আর ব্রেকফাস্ট করবো না, পেটটা ভুটভাট করছে। আপনারাই বলুন, এই আমার মতো লোক দিয়ে অন্যের দুঃখের কি কোনও প্রতিকার হতে পারে? আমাদের মতো লোকেরা ট্রামে-বাসে-ট্রেনে প্রচণ্ড প্রতিবাদ করবে, তারপর ভোট দেবার সময় কী জন্য প্রতিবাদ করেছিলাম ভুলে গিয়ে সভয়ে গণতান্ত্রিক ভোট দেবে। সত্যি বলতে কী, পূর্বকথিত অসংখ্য ভীত-পীড়িত অশিক্ষিত মানুষ, আর আমাদের মতো সদা-স্বার্থপর সংশয় জর্জর মধ্যবিত্ত— এদের নিয়েই হ্যারল্ড লাঙ্কির অধিকাংশ মূর্খের ভোটে নির্বাচিত মূর্খের সরকার, গণতন্ত্র, গঠিত হয়।
তবে কিনা একটা প্রশ্ন থেকেই যায়— নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সরকারকে মূর্খ যতই বলি, সরকার কখনও মূর্খ হয় না। চালাকির দ্বারা মহৎ কার্য সিদ্ধ হয় না বটে, কিন্তু চালাকির দ্বারা অমহৎ কুকর্ম খুব ভালো সিদ্ধ হয়। রাজনীতির নেতারা ধূর্ত হবেন, চালাক হবেন, স্বার্থপর হবেন, নিজেদের সাম্রাজ্য সুস্থিত রাখতে চাইবেন, এটা কোনও অপূর্ব আশ্চর্য কথা নয়। এমনকী এটাও কোনও আশ্চর্য নয় যে, রাজা এবং এখনকার গণতান্ত্রিক নেতাদের মধ্যে কোনও চরিত্রগত তফাৎ আমি অত বুঝি না—তো সেই রাজা বা নেতাদের মধ্যে ‘আসুর ভাব’ একটা থাকবেই। আসুর ভাব মানে— আক্রমণ-প্রত্যাক্রমণ, বিরোধ-বিরোধীর মূলোচ্ছেদ, যেন তেন প্রকরেণ নিজের প্রভাব বিস্তার, যার মধ্যে ন্যায়-নীতির স্থান নেই। মুশকিল হল— রাজনীতি, কূটনীতি ইত্যাদির মধ্যে ন্যায়-নীতির মাত্রা না থাকাটা চিরন্তনী হলেও জনসমষ্টির রাষ্ট্রের মঙ্গল নিয়ে মনু থেকে মহাভারত, অ্যারিস্টটল থেকে গান্ধি অনেকেই চিন্তা করেছেন। এমনকি এখনকার রাষ্ট্র নেতারাও মাঠে-ঘাটে, গৃহে-গোঠে সে-সব কথা বলেন। আমাদের বক্তব্য হল— বিরোধ এবং গ্রাসেরও একটা মাত্রা আছে— বিরোধ-প্রতিরোধে যখন মানুষের মাথা চলে যায়, তখন কোনও অজুহাত চলে না।
অথচ অজুহাত কেমন ‘রেডি’ থাকে। আদেশ কার্যকরী করার ভার যাদের ওপর থাকে, তাদের দিকে আঙুল তুলে নেতারা বলেন— আমরা ঠিক এতটা চাইনি। ওরা একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছে। বোঝাতে পারি না— ওরে! পুলিশ এবং অজস্র পাড়ার অজস্র দাদা-নেতাদের যাঁরা আপন হাতের দোলায় তৈরি করেন, সেই কর্মী-পুরুষদের মাত্রাজ্ঞান থাকে না। তাঁরা উচ্চতর নেতাদের উষ্ণতায় উষ্ণতর হয়ে ওঠেন সমুদ্রতটের বালির মতো। প্রখর সূর্যের তাপ যদি বা সহ্য হয়, কিন্তু সূর্যতাপে তপ্ত বালুকারাশির ওপর হেঁটে পথ চলা আরও কঠিন। সংস্কৃতে একটা শ্লোক আছে— এক একটি পুষ্করিণীতে জলের পরিমাণ অনুসারেই পদ্মফুলের উচ্চতা তৈরি হয়। অর্থাৎ জলের গভীরতা থেকে যে উচ্চতা তৈরি হয়, পদ্মের নাল-দণ্ডটিও তত বড় হয় এবং ফুল ফোটে সেই উচ্চতাকেই। একইভাবে পুলিশ এবং দাদারা তাঁদের চালক নেতাদের উচ্চতার পরিমাণেই নিজেরাও উচ্ছ্রিত বোধ করেন। এমনকি বিরোধী নেতৃত্বেও এ-কথা সত্য। সেখানে পুলিশ থাকে না বটে, কিন্তু দাদারা থাকেন। আপন প্রচুর শক্তি, বল, দর্প অনুযায়ী কর্মীদেরও স্থান-বিশেষে শক্তি-বলের প্রকটন ঘটে— স্বস্বামিনা বলবতা ভৃত্যো ভবতি গর্বিতঃ। সূর্যের ক্ষেত্রেও তখন বালির গরম বেশি লাগে।
সরকার, সরকারি দল আর বিরোধী গোষ্ঠীর রেষারেষিতে মাথা কাটা পড়ে সাধারণ লোকের। তারা ব্যবহৃত হবার মর্ম বোঝে না। আবেগ প্রবণতা তাদের ব্যবহৃত হবার রাজপথ তৈরি করে। তারা মাথা দিয়ে আসে— সে মাথার দাম নেই কারও কাছে। আমাদের মতো গরীব মধ্যবিত্তজনেরা স্ব-স্বাধীন আবেগ-প্রবণতায় কিছু দিন সেই কাটা মাথার শ্রাদ্ধ করে, তারপর যেমন ছিল তেমন— রাজনীতি চলে আপন পথেই।
দুই
কুণাল নামটা ভীষণ জানা সকলের। সম্রাট অশোকের ছেলে কুণাল। অসাধারণ সুন্দর দেখতে ছিলেন তিনি, বিশেষত তাঁর চোখদুটি ছিল আরও বেশি সুন্দর, যে চোখের প্রেমে তাঁর জননী স্থানীয়া তিষ্যরক্ষিতা পর্যন্ত আকৃষ্ট বোধ করেছিলেন এবং অবশেষে তাঁরই অত্যাচারে সে চোখ হারিয়েও ছিলেন। সেই কুণাল, যিনি বুদ্ধগুণের অনুস্মৃতিতে প্রতিহিংসার পরিবর্তে ক্ষমাগুণ অবলম্বন করে সব ফিরে পেয়েছিলেন।
বুদ্ধদেবের অনুশাসন লাভ করার পর রাজপদে অভিষিক্ত হওয়া সত্ত্বেও যেখানেই বৌদ্ধ ভিক্ষু বা বুদ্ধানুগত ব্যক্তিদের দর্শন লাভ করতেন, সেখানেই কুণাল তাঁদের পায়ে মাথা নুইয়ে প্রণাম করতেন। জনাকীর্ণ স্থানেই হোক অথবা নির্জন স্থানেই হোক, বৌদ্ধ ভিক্ষু দেখলেই তিনি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন— আকীর্ণে বা রহসি বা, তত্র শিরসা পাদয়োর্নিপত্য বন্দতে স্ম। কুণালের একজন মন্ত্রী ছিলেন, যাঁর নাম যশ। রাজার এই প্রণিপাতবৃত্তি দেখে অমাত্য যশের খুব খারাপ লাগত। একদিন তিনি সইতে না পেরে কুণালকে বলেই ফেললেন— মহারাজ! এটা আপনি কি করেন প্রতিদিন? এইসব ভিক্ষুদের জাতি-বর্ণের কোনও মাথামুণ্ডু নেই। বামুন-ক্ষত্রিয়, বৈশ্য-শূদ্র সব জাত থেকেই লোক এসে ভিক্ষু-শ্রমণ হয়েছে। তাদের সবাইকে আপনি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন, এটা কেমন হয়? আপনার মতো রাজার কি এটা উচিত?
রাজা কুণাল অমাত্যের কথার কোনও জবাব দিলেন না। কিছুদিন কেটে যাবার পর যখন প্রসঙ্গটা যশ নামক অমাত্যের ভুলে যাবার কথা, তখন কুণাল একদিন সমস্ত অমাত্যদের রাজসভায় ডাকলেন। সকলের দলে যশ-অমাত্যও আছেন সেখানে। রাজা অমাত্যদের বললেন— বিভিন্ন রকম প্রাণীর মাথা সংগ্রহ করে দিতে হবে আমাকে। আমার খুব প্রয়োজন। তা আপনি অমুক প্রাণীর মাথা কেটে নিয়ে আসবেন, আপনি তমুকের, আর আপনি তমুকের। এইভাবে আদেশ দিতে দিতে যশামাত্যের দিকে তাকিয়ে বললেন— আর আপনি একটা মানুষের মাথা কেটে নিয়ে আসবেন, সেও তো প্রাণী। রাজার আদেশ, আর অমাত্যরা ভাবলেন— রাজাদের কতরকম কাজ থাকে, কতরকম খেয়াল হয়। সকলেই মাথা আনতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
বিভিন্ন প্রাণীর মাথা সংগ্রহ হয়ে গেলে কুণাল এবার অমাত্যদের বললেন— আপনারা নগরের বাজারে যান, সেখানে এই মাথাগুলি বিক্রি করে আসবেন। বিনিময়ে মূল্য যা যা পাবেন, সব অর্থ এনে আমাকে দেবেন। আমার সেটাতেই প্রয়োজন। অমাত্যেরা যার যার সংগৃহীত পশুমস্তক নিয়ে বাজারে গেলেন এবং একে একে সব মাথাগুলিই বিক্রি হয়ে গেল, কিন্তু সেই যশ-অমাত্যের আনা মানুষের মাথাটি কেউ কিনল না— তদেব মানুষ্যং শিরো ন কশ্চিদ জগ্রাহ। সব কটা মাথাই বিক্রি হয়ে গেল, অথচ মানুষের মাথাটি বিক্রি হল না, তার পয়সাও পাওয়া গেল না। যশ-অমাত্য কাচুমাচু মুখে কথাটা জানালে কুণাল বললেন— ঠিক আছে, ঠিক আছে, এর জন্য তুমি চিন্তা কোরো না। তুমি আবার বাজারে যাও। এটার জন্য তুমি কোনও পয়সা চেয়ো না। বিনামূল্যেই তুমি মানুষের মাথাটা কাউকে দিয়ে এসো।
যশ-অমাত্য আবার গেল বাজারে। কিন্তু বিনা পয়সাতেও মানুষের মাথাটা কেউ নিল না। অন্য অমাত্যরা যে যে পশুর মাথা এনেছিল, সব বিক্রি হয়ে গেল, অথচ তাঁর ওপরে ভার দেওয়া সত্ত্বেও অমাত্য যশ মানুষের মাথাটি বিনা পয়সাতেও কাউকে গছাতে পারলেন না। তাঁর ভারি লজ্জা হল, লজ্জানত মুখে তিনি কুণালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন— মহারাজ! গোরু-গাধা, মৃগ-পক্ষী সব প্রাণীর মাথা মানুষ মূল্য দিয়ে কিনে গিয়ে গেল। কিন্তু মানুষের মাথা নিতান্ত মঙ্গলচিহ্নহীন অপ্রশস্ত বলেই কেউ বিনা মূল্যেও নিল না— ন গৃহ্যতে মূল্যমৃতে ‘পি রাজন। কুণাল সকপটে জিজ্ঞাসা করলেন— কী ব্যাপার বলো তো মন্ত্রী, সবরকম পশুর মাথা পর্যন্ত লোকে পয়সা দিয়ে নিয়ে গেল, অথচ মানুষের মাথাটা কেউ বিনি পয়সাতেও নিল না, কী ব্যাপার? মানুষের মাথাটাই তো সবচেয়ে দামি— কিমিদমিতীদং মানুষ-শিরো ন কশ্চিদ গৃহ্নাতীতি? অমাত্য জবাব দিয়ে বললেন— কী জানি মহারাজ— এমন নয় তো যে শুধু এই বিশেষ মানুষটার মাথাই লোকে ঘেন্না করছে, কিম্বা অপ্রশস্ত মনে করছে। অন্য মানুষের মাথা বিক্রি করতে গেলে দাম দিয়ে নিয়ে নেবে। যশ-অমাত্য বললেন— না মহারাজ! আমি যা বুঝেছি, তাতে কোনও মানুষের মাথাই বিকোবে না, মানুষের মাথা মাত্রেই বড় জুগুপ্সিত, বড় ঘেন্নার জিনিস, এটাই আমি সার বুঝেছি। রাজা এবার ঠান্ডা মাথায় অমাত্যকে বললেন— তুমি কি মনে করো, এই যে আমার মাথাটা, দেশের রাজার মাথা বলে কথা, সেটাও কী অন্যদের মতো একই রকম ঘৃণার্হ জুগুপ্সিত হবে— কিমিদং মদীয়মপি শিরো জুগুপ্সিতমিতি?
অমাত্য যশের খানিক সংকোচ হল, ভয়ও হল একটু। তিনি উত্তর দিতে চাইলেন না, সত্য বলতে তাঁর অস্বস্তি হচ্ছে। মন্ত্রীর মানসিকতা সম্পূর্ণ আন্দাজ করেই বললেন— তুমি সত্য উচ্চারণ করো, তোমার কোনও ভয় নেই। যশ অমাত্য বললেন— হ্যাঁ মহারাজ। রাজার মাথা হলেও সেই কাটা মাথা বিনি পয়সাতেও বিকোবে না— এবমিতি— রাজার মাথাও একইরকম ঘৃণার্হ, জুগুপ্সিত। কুণাল এবার বললেন— তুমি এতটুকু অসত্য বলোনি, অমাত্য! অন্যান্য মানুষের মতো রাজার কাটা মাথাও একইরকম জুগুপ্সিত, ঘৃণার্হ। আমি তোমাকে শুধু বলতে চাই— ঘৃণ্যতার কারণে বিনা মূল্যেও যেহেতু মানুষের মাথা বিকোয় না, যে মাথার দাম কোনও পশু-পক্ষীর কাটা মাথার চেয়েও মূল্যহীন, সেই মাথা দিয়ে আমি বৌদ্ধভিক্ষুকের চরণবন্দনা করে খানিক পুণ্যসঞ্চয় করার চেষ্টা করেছি, তুমি সেখানে জাত পাত নানা কথা তুলে আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছ। আমি বলব— মানুষের অন্তর্গত গুণ এবং শ্রদ্ধাভাবটুকু বোঝার চেষ্টা করো, নইলে দ্যাখো রাজার মাথারও কোনও মূল্য নেই। এই শরীর থেকে একবার প্রাণ যদি যায়, তবে প্রভু-ভৃত্য, রাজা-প্রজা কারও সঙ্গে কারও তফাৎ নেই। পণ্ডিতেরা তাই বলেন— নাসৌ পার্থিব-ভৃত্যয়ো-বির্ষমতাং কায়স্য সংপশ্যতি।
মর্যাল :
রাজা থাকার সময় বা নেতা মন্ত্রী হয়ে যাবার পর প্রজা বা সাধারণ মানুষের মাথার কোনও মূল্য নেই, কথার তো নয়ই। কুণাল একটি বৌদ্ধ-বুদ্ধু যে কারণে রাজা-প্রজার বিষমতা বুঝতে পারেন না। বাস্তবে সাধারণ মানুষের মাথা এবং রাজা-নেতাদের মাথার বিলক্ষণ তফাৎ আছে।
তিন
বিশালবুদ্ধি বার্নার্ড শ-এর নাটক The Man of Destiny; ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এই নাটকের অন্যতম চরিত্র। নাটকের প্রারম্ভে নেপোলিয়নের চরিত্র এবং যে সামাজিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল— প্রধানত ফরাসী বিপ্লব এবং তারপর ফ্রান্সের শাসনে নিযুক্ত ‘ডিরেক্টরি’ — তার মাধ্যমে নেপোলিয়ন কীভাবে আপন ক্ষমতায় আরোহণ করেছেন এবং আপন বুদ্ধি-কৌশলে অধুনা ফরাসী সৈন্যদলের জেনারেল অর্থাৎ সেনাধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হয়েছেন তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে। নেপোলিয়নের অসামান্য ব্যক্তিগুণ, অনুমান শক্তি, সামরিক কৌশল, অস্ত্র চালনার দাপট এবং ভবিষ্যতকে পড়তে পারার অসাধারণ ক্ষমতার সঙ্গে তাঁর দোষগুলি, বিশেষত যুদ্ধক্ষেত্রে তথা ভাবনাগতভাবেই তাঁর নৃশংসতার কথাও এই প্রারম্ভিক উন্মোচনের মধ্যে বলা হয়েছে। এই দুদিন আগেই লোদির যুদ্ধে নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়ার সেনাদলের উদ্যত আক্রমণের বিরুদ্ধে কামান দেগে এক অসাধ্য যুদ্ধ জয় করে এসেছেন। এই মুহূর্তে তিনি তাভাজ্জামো নামক একটি অখ্যাত জায়গায় আছেন, যেখান থেকে ইতালির মিলান-এ যাওয়া যায়। এখানে একটি সরাইখানায় তিনি আশ্রয় নিয়েছেন। আশেপাশের লোকজন যুদ্ধজয়ী জেনারেলকে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু সরাইখানার পাহারাদার-এর অগ্নিদৃষ্টিতে কেউই খুব একটা সুবিধে করতে পারছে না। এই সরাইখানার মালিক এবং একাধারে সেবক গিসেপ্পি অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং রসিক লোক। এই মুহূর্তে নেপোলিয়ন ছাড়া আরও একজন অভিজাত মহিলা নেপোলিয়ন প্রবেশ করার আগেই সরাইখানার ওপরতলায় এসে আস্তানা গেড়েছেন।
নেপোলিয়ন খাবার টেবিলে বসে আছেন। তাঁর সামনে একটি লোক্যাল ম্যাপ। কোথায় কোন পোজিশনে সৈন্য দাঁড় করালে আগামী যুদ্ধটা জয় করা যাবে তার পরিকল্পনা করছেন নিহিত মনে, অন্য সব দিকেই তিনি অন্যমনস্ক। এই অবস্থায় সরাইখানার চতুর মালিক-সেবক— গিসোপ্পিঃ মহামহিম প্রভু! কিছু বলছেন নাকি?
নেপোলিয়নঃ (ম্যাপের দিকে ঝুঁকে রয়েছেন, আনমনে বিড়-বিড় করছেন এবং বাঁ হাতে নানারকম ভঙ্গি করছেন যান্ত্রিকভাবে) একদম কথা বোলো না। আমি খুব ব্যস্ত আছি।
গিসেপ্পিঃ নিশ্চয় প্রভু! আমি বুঝতে পারছি।
নেপোলিয়নঃ আচ্ছা! একটু লাল কালি পাওয়া যাবে? আমার দরকার।
গিসেপ্পিঃ কপাল আমার! প্রভু! এখানে তো কেউ নেই।
নেপোলিয়নঃ (মনের ভিতর যাই থাকুক, মুখের ওপর অমায়িকতা ঘনিয়ে নিয়ে) কাউকে অথবা কিছু একটা মারো এবং তার রক্ত এনে দাও আমাকে।
গিসেপ্পিঃ (মুখটা একটু বেঁকিয়ে) কাকে মারব প্রভু! এখানে তো কেউই নেই। এখানে থাকার মধ্যে আছে আমার প্রভুর ঘোড়াটি, বাইরে ওই পাহারাদার, ওপরে ওই ভদ্রমহিলা, আর আছেন আমার স্ত্রী।
নেপোলিয়নঃ তাহলে তোমার স্ত্রীটিকেই মারো।
গিসেপ্পিঃ সে তো মারতেই পারি প্রভু। কিন্তু দুঃখের বিষয় কী জানেন, আমার গায়ে অত শক্তি নেই। ও-ই আমাকে মেরে দেবে।
নেপোলিয়নঃ তাতে আমার কোনও অসুবিধে নেই, আমার কাজটা হয়ে গেলেই হল।
গিসেপ্পিঃ এটা কী বলছেন, প্রভু! আমার দ্বারা আপনার একটা উপকার হবে, এটা বোধহয় আপনি আমাকে একটু বেশিই সম্মান দেখাচ্ছেন। (নেপোলিয়নের খাবার টেবিলে রাখা ওয়াইন-ফ্লাস্কের দিকে হাতটা একটু বাড়িয়ে) আমার মনে হয়, যে-কারণে আপনার লাল-কালি বা রক্তের দরকার হচ্ছে, সেটা সম্ভবত এই তরল খাদ্যের সাহায্যেই করা যাবে।
নেপোলিয়নঃ (কোনওমতে তাড়াতাড়ি পানীয়ের ফ্ল্যাস্কটিকে আগলে রেখে বেশ গম্ভীরভাবে) মদ? মদ ব্যবহার করাটা এখানে নিতান্তই একটা অপচয় হবে। আসলে তোমরা সবাই এক ধরনের অপচয়। অপচয়। অপচয়। (নেপোলিয়নের ততক্ষণে তাঁর কাটা-চামচের একটি ফলাকা তরকারির ঝোলে চুবিয়ে তাঁর যুদ্ধ-মানচিত্রের মধ্যে চিহ্ন দিতে দিতে) এই তুমি যাও এখান থেকে। টেবিল পরিষ্কার করে দিয়ে তুমি এসো এখান থেকে। (মদ্যপান শেষ করলেন নেপোলিয়ন। তারপর চেয়ারটা একটু পেছনে ঠেলে নিজেকে একটু এলিয়ে দিলেন পা-দুটি সামনে টান টান করে মেলে দিয়ে। তাঁর মুখমণ্ডল এখনও কিন্তু ভাবনার ভ্রুকুটি এবং চিন্তার চিহ্ন জেগে রইল)।
গিসেপ্পিঃ (টেবিল পরিষ্কার করে ট্রেতে তুলতে তুলতে) প্রত্যেকেই তার নিজের ব্যবসার জায়গাটা ঠিক বোঝে, বুঝলেন প্রভু। এই যে আমরা সরাইখানা চালাই, আমাদের ঘরে সস্তার মদ আছে প্রচুর। ফলে খানিক মদ চলকে পড়ে গেল, খানিকটা নষ্ট হল, আমরা কিন্তু অপচয় নিয়ে এতটুকুও ভাবি না। তেমনই আপনারাও তো বড় বড় সেনাধ্যক্ষ, সস্তায় এবং সহজে রক্ত মেলে আপনাদের, অতএব সে রক্তও খানিকটা ঝরলে, খানিকটা চলকে পড়লে, আপনারাও সেটা নিয়ে তেমন বিব্রত হন না। তাই নয় কি, বলুন প্রভু?
নেপোলিয়নঃ রক্তের জন্য কোনও পয়সা লাগে না হে। মদের জন্য দাম লাগে। (নেপোলিয়ন দাঁড়ালেন এবং ফায়ার-প্লেসের দিকে এগিয়ে গেলেন)।
গিসেপ্পিঃ লোকে বলে মানুষের জীবন ছাড়া আর সব কিছুর ব্যাপারেই আপনি খুব সচেতন।
নেপোলিয়নঃ মানুষের জীবন। বন্ধু, ওই একটা জিনিস আছে যেটার ব্যাপারে মানুষ নিজেই খেয়াল করবে। (চেয়ারে এলিয়ে বসলেন)
গিসেপ্পিঃ (সপ্রশংসভাবে) অবশ্যই, অবশ্যই। আমরা কী বোকা না? আপনি ছাড়া সবাই আমরা কী বোকা। আমি যদি সত্যিই বুঝতে পারতাম কী করে আপনি জীবনে এত সফল হলেন, এর রহস্যটা যদি সত্যিই বুঝতে পারতাম।
নেপোলিয়নঃ সেটা বুঝলে তো তুমি এই ইতালির সম্রাট হতে? হতে চাও?
গিসেপ্পিঃ সেটা বড্ডই ঝামেলার ব্যাপার হবে, প্রভু। সম্রাট-টম্রাট হওয়ার ব্যাপারটা আপনার ওপরেই রাখলাম। তাছাড়া আমি সম্রাট হলে আমার এই সরাইখানাটার কী হবে? এই যে আপনি বসে বসে দেখছেন— আমি কীভাবে সরাইখানাটা চালাই, কীভাবে আপনার সেবা করি— আপনি দেখে মজা পান নিশ্চয়ই। আবার আমিও এমনি মজা পাব যখন দেখব— আপনি এই সমগ্র ইয়োরোপের সম্রাট হয়েছেন এবং আমার হয়ে দেশ শাসন করছেন। (বক বক করতে করতে সে এমনভাবে টেবিলের ওপরে পাতা কাপড়টা তোলার চেষ্টা করল। নেপোলিয়নের পাতা ম্যাপটা এতটুকু না সরিয়ে চাদরটার চারটে কোনা চারদিকে ধরে বার করে নিল ভাঁজ করার জন্য।
নেপোলিয়নঃ হাঃ ইউরোপের সম্রাট। শুধু ইউরোপের কেন?
গিসেপ্পিঃ তাই তো, শুধু ইউরোপের কেন? আপনি হবেন পৃথিবীর সম্রাট। সত্যিই তো পৃথিবীর নয় কেন? (সে টেবিলের চাদরটাকে ভাঁজ করার সময় এক-এক বিশেষ বাক্যের ওপর জোর দিয়ে বলতে লাগল) একটা মানুষ তো আর একটা মানুষের মতোই। (প্রথম ভাঁজ) একটা দেশও আর একটা দেশের মতো। (দ্বিতীয় ভাঁজ) একটা যুদ্ধও ঠিক আর একটা যুদ্ধের মতো। (শেষ ভাঁজ দেবার পর সে টেবিলের ওপর চাদরটাকে রেখে একটা চাঁটি মারল, চাদরটাকে মুড়িয়ে নিল এবং দীর্ঘ বক্তৃতার উপসংহার টানার মতো করে বলল) একটা জেতো তারপর সব জিতে নাও। (রোল-করা চাদরটা নিয়ে পাশে দেয়াল আলমারির ড্রয়ারে রেখে দিল)
নেপোলিয়নঃ তারপর সকলের জন্য সকলের হয়ে শাসন করো, সকলের হয়ে লড়াই করো, তারপর সর্বময় প্রভুত্বের আচ্ছাদনে সকলের মাথায় থেকে সকলের সেবা করো— be everybody’s servant under cover of everybody’s master.
পাদটীকাঃ
গিসেপ্পি লোকটাকে নেপোলিয়নের ভালো লেগে গিয়েছিল। সে রসিকতা বোঝে এবং রসিকতা করতেও পারে, কিন্তু মর্যাদা অতিক্রম করে না, আবার কথাচ্ছলে করেও। নেপোলিয়ন এক সময় এক অধস্তন অফিসারের ক্রিয়া-কর্ম, কথাবার্তা এবং বুদ্ধির ব্যাপারে বিরক্ত হয়ে গিসেপ্পির কাছে মন্তব্য করছেন—
নেপোলিয়নঃ (কথা বলার সময় বিরক্তির মধ্যেও একটু রসিকতার ছাঁদে) এই অফিসারকে নিয়ে আমি কী করি বলো তো গিসেপ্পি। যা কিছুই এই অফিসার বলে, সব ভুল বলে।
গিসেপ্পিঃ (সঙ্গে সঙ্গে) ওকে আপনার মতো সেনাধ্যক্ষ জেনারেল করে দিন প্রভু! তখন দেখবেন— ও যা কিছু বলছে, ঠিক বলছে।
নেপোলিয়নঃ (হাসলেন এবং একটু তির্যক সুরে গিসেপ্পির কানের কাছে গিয়ে) তোমার মতো একটা লোক এই সরাইখানায় পড়ে আছে। (নেপোলিয়ন গিসেপ্পির সামনে স্কুল মাস্টারের মতো বসলেন) তোমাকে আমি আমার সঙ্গে নিয়ে যাব এবং তোমাকে মানুষ করে ছেড়ে দেব।
গিসেপ্পিঃ (বার বার নেতিবাচক ভাবে মাথা নেড়ে) না, না, না, না, কখনওই না। সারাটা জীবন ধরে অনেকেই আমাকে মানুষ করার চেষ্টা করেছে। আমি যখন বালক ছিলাম, আমাদের ধর্মযাজক গুরু আমাকে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন, আমাকে তিনি লিখতে পড়তে শিখিয়েছিলেন। তারপরে আমাদের মেলেগন্যানো থেকে এলেন সেই অদ্ভুত বাদ্যকর। তিনি আরগ্যান বাজাতেন। তিনিও আমাকে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন, আমাকে তিনি যন্ত্রসংগীতের পাঠ দিয়েছিলেন। তারপর পুলিশের সেই নিয়োগ আধিকারিক সারজেন্টটি— তিনি তো আর একটু হলে আমাকে মানুষ করেই ফেলেছিলেন, নেহাত আমি কয়েক ইঞ্চি বেশি লম্বা এই বলে তাঁর সম্ভাবনা সার্থক হতে পারল না। এই যে যত লোক আমাকে মানুষ করতে চাইল, তারা সবাই আসলে আমাকে দিয়ে কাজ করাতে চেয়েছে, আর সত্যি বলতে কি কাজ করতে আমার বড় আলস্যি। ভগবানকে ধন্যবাদ আমি তাই নিজেকে রান্না করাটা শিখিয়েছি, আর তার ফলেই আজ আমি এই সরাইখানার মালিক। এখন তো কাজ করার চাকর-বাকরও অনেক রেখে দিয়েছি, যাতে আমাকে আর কোনও কাজ করতে না হয়। কাজ না করে আমি শুধু কথা বলে যাব, কেননা ওই কথা বলে যাওয়াটাই আমাকে সবচেয়ে মানায়।
নেপোলিয়নঃ (গিসেপ্পির দিকে চিন্তান্বিতভাবে তাকিয়ে) এতে কি তুমি সুখী মনে করো নিজেকে?
গিসেপ্পিঃ (সানন্দ সম্মতিতে) পুরোপুরি সুখী, প্রভু!
নেপোলিয়নঃ আসলে তোমার মধ্যে হাঁ-করা সর্বগ্রাসী শয়তানটা নেই। যাকে সবসময় অনন্ত কাজ আর বিজয়ের খাবার দিয়ে পেট ভরাতে হয়। দিন-রাত তাকে ঠাসিয়ে রাখতে হয়, কিন্তু যদি তার কাছ থেকে পেতে হয় তবে মাথা আর শরীরের ঘাম ঝরিয়ে পেতে হয়, কয়েক সপ্তাহের হাড়ভাঙা খাটুনির পর দশ মিনিটের মজা জোটে। এই সর্বগ্রাসী শয়তানটা একদিকে তোমার আজ্ঞাবহ চাকর অন্যদিকে তোমারই স্বেচ্ছাচারী শাসক; সে-ই তোমার চূড়ান্ত প্রতিভা এবং সে-ই তোমার সর্বনাশ। সে একদিকে তোমার হাতে রাজমুকুট ধরিয়ে দেবে, অন্য দিকে জাহাজের দাঁড় টানা ক্রীতদাসের লগিটা তুলে দেবে তোমার অন্য হাতে। এই ক্ষুধার্ত শয়তান তোমাকে পৃথিবীর সমস্ত রাজ্যের সন্ধান দেবে এবং তোমাকে সেইসব রাজ্যের শাসক রাজা করে দেবে এই শর্তে যে তুমি সকলের দাস হয়ে থাকবে— who shews you all the kingdoms of the earth and offers to make you their master on condition that you become their servant. আমার জিজ্ঞাসা হয়, গিসেপ্পি! এই রকম সর্বগ্রাসী শয়তানটা তোমার মধ্যে নেই, তাই না?
গিসেপ্পিঃ না, আমার মধ্যে ওই শয়তানটা নেই, সেটা আমি জোর দিয়েই বলতে পারি। তবে আমার মধ্যে যে হাভাতে শয়তানটা আছে, সেটা আপনারটার থেকেও খারাপ। সে আমাকে কোনও রাজমুকুট দেয় না, রাজ্যও দেয় না। তার ইচ্ছেটা এইরকম যে, সে কিচ্ছুটি না দিয়ে সব পেতে চায়— ভাল সসেজ, ওমলেট, আঙুরদানা, চিজ, পোলেনটা, মদ— দিনে ওর তিনবার এইরকম চাই। এর থেকে কমে কিছুতেই ওর পেট ভরানো যাবে না, প্রভু!
উপসংহারঃ
১. be everybody’s servant under cover of everybody’s master.
২. who shews you all the kingdoms of the earth to make you their master on condition that you become their servant.
স্বৈরাচারী একনায়ক নয়তো গণতন্ত্রের নেতা— তাঁরা এই দুই বাক্যের মানে কী বুঝলেন? দুইটি বাক্যের অর্থ একই নাকি?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন