Smart—গীতা

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

ভগবদগীতা বইটা কেমন, এ বই কী বলতে চায়— এমন সব প্রশ্ন একেবারেই অনালোচ্য। একমাত্র অল্পশ্রুত, অল্পজ্ঞ মানুষ ছাড়া যাঁদের সামান্যতম বোধ আছে তাঁরা এই গ্রন্থের মর্মকথা নিয়ে কথা বলতে চাইবেন না। এমনকী যে ভদ্রলোক এই গীতার উপদেশ-আদেশ-অনুশাসন রথের ওপর দাঁড়িয়ে এক নাগাড়ে উচ্চারণ করেছিলেন সেই ভগবৎস্বরূপ কৃষ্ণের পক্ষেও গীতার বক্তৃতাটা দ্বিতীয়বার যে বলা সম্ভব হবে না, একথা মহাভারতে নিজের মুখে স্বীকার করেছেন কৃষ্ণ। মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ তখন কবে শেষ হয়ে গেছে, তারপর যখন সেই অশ্বমেধিক পর্ব চলছে, তখন একদিন অর্জুন, সখা কৃষ্ণের কাছে বায়না ধরলেন। বায়নার কারণও ছিল।

অশ্বমেধ শেষ হবার পর যুধিষ্ঠির তখন কৌরব রাজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত রাজা। পাণ্ডব-ভাইরা সকলেই ‘রিলাক্সড’, কৃষ্ণ ফিরে যাবেন দ্বারকায়। তখন একদিন অর্জুন কৃষ্ণের সঙ্গে কথালাপ করতে করতে বললেন— দ্যাখো সখা! এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে তুমি বন্ধুত্বের খাতিরেই আমাকে বেশ অনেক কথা বলেছিলে, কিন্তু পোড়া কপাল, আমার ভুলো মন, সেসব কথা আমি অনেকটাই ভুলে গেছি— নষ্টং মে ভ্রষ্টচেতসঃ। কিন্তু বিষয়টা এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, আমার বার বার কৌতূহল হয় সেই কথাগুলো শোনার জন্য। আমার জন্য তুমি আর একবার সেগুলো বলো আমার কাছে— মম কৌতূহলং ত্বস্তি তের্থেষু পুনঃপুনঃ।

অর্জুনের কথা শুনে কৃষ্ণ প্রাথমিকভাবে তাঁকে একবার জড়িয়ে ধরলেন বটে, কিন্তু তারপর খানিক তিরস্কার করেই যেন কৃষ্ণ বললেন— এত গভীর কথা তোমাকে বলেছিলাম তখন যে তুমি সেটা ভালো করে গ্রহণ-ধারণ করতে পারোনি, এটা তোমার বুদ্ধির দোষ এবং এই অমনোযোগটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না— অবুদ্ধ্যা নাগ্রহীর্যস্ত্বং তস্মে সুমহদপ্রিয়ম। আরও আমার রাগ হচ্ছে এইজন্য যে, সেই সমস্ত কথা যে ক্ষণে যে ভাবে আমি বলতে পেরেছিলাম, এখন সেটা এই ক্ষণবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আমারও স্মৃতির মধ্যে আসছে না, তখন যা বলেছিলাম, এখন সেটা অশেষে বিশেষে পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে— ন শক্যং তন্ময়া ভুয়স্তথা বক্তুমশেষতঃ। আসল কথা, তখন যা বলেছিলাম সেখানে বিষয়ের সঙ্গে বক্তার বুদ্ধিচেতনা একত্তর যোগযুক্ত হয়ে উঠেছিল। সেই যোগযুক্ত অবস্থায় আমি তোমাকে যা বলতে পেরেছিলাম, এখন আর সেটা পারব না— পরং হি ব্রহ্ম কথিতং যোগযুক্তেন তন্ময়া।

কথাটা আর একভাবে বলেছিলেন প্রসিদ্ধ পার্লামেন্টেরিয়ান হীরেন মুখার্জী। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন— পার্লামেন্টে একটা ভালো বক্তলতা এক-একটা সময় বিষয়-আশয় সম্বন্ধে আপনা থেকে তৈরি হয়ে যায়, ওই বক্তৃতাটাই দ্বিতীয়বার করতে বললে আমি মোটেই পারব না। আমাদের বক্তব্য— ইনি তো আবার কৃষ্ণ, যিনি সারাজীবন কত মোক্ষম বক্তৃতা দিয়েছেন তার ঠিক নেই। সেই তিনিই বলছেন গীতা আগে যেভাবে বলেছি, এখন আর তা পারব না। স্বয়ং ভগবানেরও এই অতিবাস্তব মানুষী অক্ষমতা থেকে একটা কথাই প্রমাণ হয় যে, ভগবদগীতা কত গভীর এক সর্বব্যাপী চেতনার আস্বাদন করে, তা শুধু বিচার-আলোচনা করে শেষ করা যাবে না।

আজকের এই দড়ি টানাটানি আর ইঁদুর দৌড়ের দিনে সামাজিক পরিস্থিতি যেখানে অহর্নিশ হন্যমান হতাশায় ব্যাধিগ্রস্ত, চারিদিকে যেখানে সরবরাহের সুর কী চাহিদা কাদের মেটায়, সেখানে ভগবদগীতার কোন বিষয় নিয়ে আমি কথা বলব। কোন বিষয়ের বই নয় এটা! এটা দর্শনের চরমতম গ্রন্থ, এটা সমাজ-দর্শনেরও চরম কথা বলে, এটা বাস্তব জীবনের চরম রহস্যটুকুও জানে এবং মনস্তত্ত্বের চরম বিজ্ঞানও ভগবদগীতার অধিগত বিষয়। আর আজকের দিনে ভগবদগীতার যে বিষয়টি আধুনিকভাবে আমাকে মুগ্ধ করে, সেটা হল ‘ম্যানেজমেন্টে’র অন্তর্গত ‘লিডারশিপ’-এর ভাবনা।

একটা মামুলি কথা দিয়ে আরম্ভ করি। গীতা বলছে— শ্রেষ্ঠ মানুষেরা যে আচরণ করেন, সাধারণ মানুষ সেটাকেই অনুসরণ করে আর বড় মানুষ যেটা একবার প্রমাণ করে ফেলেন, সাধারণ মানুষ তার অনুবর্তন করে— যদ যদ আচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ। মুশকিল হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে নিয়ে। কেননা মধ্যম মানের মানুষ জাগতিক রহস্য খানিকটা বোঝে এবং অনেকটাই বোঝে না বলেই সদা সংশয়ী, তারা প্রচুর প্রশ্ন করে এবং সব সময়েই মনে মনে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও ওপরে এমন একটা ভাব দেখায় যেন সে সব বোঝে। আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ সবই সে একটু আধটু উদ্ধার করতে পারে, কিন্তু ‘ক্রাইসিস’ যখন আসে তখন তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি। কেননা মধ্যম মানের সদাসংশয়ী মানুষ কখনও নিজে ডিসিসন নিতে পারে না।

এরই বিপ্রতীপে আছেন শ্রেষ্ঠ— তিনি লিডার— তাঁর আচরণ এবং সিদ্ধান্ত মানুষ মেনে নেয় আনন্দ মনে। চৈতন্যদেব ভক্তির শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করে দিয়ে ভক্তির আন্দোলন তৈরি করেছিলেন, মানুষ সেটা হাজারে হাজারে মেনে নিয়েছে। রামকৃষ্ণদেব যত মত তত পথের উদারতা প্রমাণ করেই আপন সাধন পথের প্রবর্তনা করেছিলেন, লোকে সেটারই অনুবর্তন করে। অন্য ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যখন আপন অমানুষী প্রতিভায় কবিত্বের শ্রেষ্ঠতা লাভ করলেন, তখন কত লক্ষ বাঙালি যে কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিলেন, তার পরম্পরা এখনও পর্যন্ত মালুম হয়।

ঠিক এখনই প্রশ্ন ওঠে— তাহলে শ্রেষ্ঠ কে? ভারতবর্ষের এই শ্রেষ্ঠের অনেক পর্যায় শব্দ আছে— যেমন, গুরু। ধর্মগুরু থেকে নেটগুরু সকলেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ; সেকালের রাজা এবং একালের মন্ত্রী, সকলেই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারেন। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হল নেতা— যাঁকে আমরা Leader বলি। ভগবদগীতা যে নেতা শব্দটা ব্যবহার করেনি, তার কারণ তাতে ধর্মগুরু, রাজা, মন্ত্রী, কবি, শিল্পী কিংবা শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী, শ্রেষ্ঠ একজন চাষিও বাদ পড়ে যেতে পারত। বিশেষত নেতা শব্দটার একটা গভীর তাৎপর্য আছে এবং সেটা ইংরেজি leader শব্দটার চাইতে অনেক বেশি গভীর, যদিও নেতা বলতে কোনওকালে আমরা রাজনৈতিক নেতার কথা ভাবিনি।

নেতা শব্দটা আমাদের কাছে যে আরও গভীর এক ব্যঞ্জনাময় শব্দ সেটা প্রমাণ হয় এই শব্দে মৌল ক্রিয়াপদ থেকে। এখানে মূল ধাতু হল ‘নী’— যার অর্থ নিয়ে যাওয়া, টেনে নিয়ে যাওয়া। যিনি তাঁর নেতৃত্বের গুণে অপর অনেক মানুষকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে টেনে নিয়ে যান, তিনিই নেতা। এই নী-ধাতু থেকে দ্বিতীয় শব্দ হল নীতি— যেসব ‘মরাল’ এবং ‘এথিক্যাল’ ভাবনা আমাদের একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য তৈরি করে, এমনকি সেটা রাজনীতিও হতে পারে। এই নী-ধাতু থেকেই আসছে নয়ন, চোখ— চোখও আমাদের নির্দিষ্ট গম্য স্থানে টেনে নিয়ে যায়। আরও আশ্চর্য লাগবে শুনে যে, নেত্র মানেও তো নয়ন এবং সেটাও নী ধাতু থেকেই আসছে, কিন্তু মহাভারতে নেত্র শব্দে ‘নেতা’ অর্থ বুঝিয়ে পার্থসারথিকে এক জায়গায় পাণ্ডবদের নেতা বলা হয়েছে— শব্দটা হল কৃষ্ণনেত্র।

নেতৃত্ব মানেই শুধু একা পথ চলা নয়, নেতৃত্ব মানেই পিছনে একটা ‘অরগ্যানাইজেশন’ আছে, নয়তো বা একটা ‘টিম’ আছে, নিদেন পক্ষে নিজেকে ছাড়া আরও অন্তত একজনকে নিয়ে পথ চলা এবং সেই পথ চলার যত বাধা, সে বাধা দূর করে অনুবর্তীকে নিয়ে একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছনোই তাঁর কাজ। গীতার মধ্যে অর্জুন যখন এক বিরাট ‘ক্রাইসিস’ বা বিপদের মধ্যে পড়েছেন, তখন তাঁর মানসিক বিপর্যয় তার শরীরকেও প্রভাবিত করছে। তাঁর শরীর কাঁপছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, হাত থেকে যেন খসে পড়ছে গাণ্ডীবধন্বার গাণ্ডীব। শরীরের এই অবস্থায় তাঁর মাথাটাও ঘুরছে যেন— ভ্রমতীব চ মে মনঃ। একটা ‘ক্রাইসিস’ যেখানে এতকাল সম্পূর্ণ যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জ্ঞাতি ভাই, আচার্যস্থানীয় মানুষ, পিতামহ ভীষ্মের মতো মানুষ— এঁদের বিরুদ্ধাচরণ করে যুদ্ধ করতে হবে— এই ‘ইমোশন’গুলো হঠাৎই এমন তীব্র হয়ে উঠল যে, অর্জুনের মতো মহাবীর বলতে আরম্ভ করেছেন— সবকিছুই কেমন বিপরীত হয়ে যাচ্ছে বন্ধু, আমি আর পারছি না— নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব। অর্জুনের মতো মহাবীরের মনেও আজ ‘কনফিউশন’ হচ্ছে, যিনি জীবনে প্রায় একটা যুদ্ধও হারেননি, তাঁরও মনে হচ্ছে— ঠিক বুঝতে পারছি না, কোনটা ভালো হবে, এ যুদ্ধে আমরাই জিতবো, না জিতবে— ন চৈতদবিদ্মো কতরন্নো গরীয়ো/ যদ বা জয়েম যদি বা নো জয়েয়ুঃ!

যখন ‘ক্রাইসিস’ এইরকমটা আসে তখন সাধারণ মধ্যম এমনকি প্রায় উত্তম পুরুষও— যারা আপনার অধস্তন অথবা যারা আপনার ‘টিমমেট’ তারা আপনার কাছে— মানে আপনি যদি leader হন, তবে আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করবে হতাশায়! যেমনটা অর্জুন করছেন। তিনি বলছেন— এতকাল যারা শত্রুতা করেছে, তাদের ব্যাপারে নানান দয়া-মায়া, আমার স্বভাবটাকে আক্রান্ত করছে। আমি তোমায় জিজ্ঞাসা করছি, কৃষ্ণ! তুমিই বলো নিশ্চিত কোনটা ভালো হবে। আমি তোমার কাছে শিষ্যের মতো শরণাপন্ন, তুমি বলো আমি কী করব এখন— যচ্ছ্রিয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রহি তন্মে/ শিষ্যন্তে’হং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম।

সত্যি বলতে কী, অর্জুনের সঙ্গে কৃষ্ণের সখ্য-সম্পর্ক— ‘আহার-শয্যা-সনভোজনেষু’— তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে ওঠেন বসেন, তার কাছে উপদেশ ভিক্ষা করতে যাওয়াটা অনেকটা এখনকার ইনডাস্ট্রিতে team leader-এর কাছে আত্মসমর্পণ করার মতো। আর একই টিমে যিনি ‘রোল মডেল’ হয়ে আছেন, তাঁর কাছে মাথা নোয়াতে নিজের ‘ইগো’তে লাগে। ভগবদগীতা এটা দেখাচ্ছে যে, তুমি যখন পারছ না, তখন leader-এর কাছে মাথা নোয়াতে হবে নিঃশর্তে। আর leadership একটা ‘স্পনটিনিয়াস প্রসেস’। কৃষ্ণ আজ থেকে পাণ্ডবদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন না। সর্বত্র তাঁর নেতৃত্বের ক্ষমতা আগেও দেখা গেছে। ফলত তাঁর কাছে মাথা নোয়াতে ‘টিমমেট’-এর ‘ইগো’ থাকলে চলে না।

অন্যদিকে কৃষ্ণকেও দেখুন তিনি এমনই একজন ‘বস’ এবং এতটাই তিনি উঁচু মানের যিনি নিজে কখনও উচ্চ অভিযানমঞ্চে বসে থাকেন না। টিম-মেট-এর ‘ক্রাইসিস’টাকে তিনি প্রথমত উড়িয়ে দেন, বকাঝকা করে। কৃষ্ণ বললেন— কেন যে তোমার এই বিভ্রান্তি আসছে, এত ‘কনফিউজড’ হচ্ছো এই বিপরীত সময়ে বুঝি না বাবা— কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম? এটা তো তোমার মতো বড় মানুষকে মানায় না— অনার্যজুষ্টম— আর সবচেয়ে বড় কথা— এমন বিভ্রান্তিতে কোনও ‘ফিউচারিস্টিক অ্যাপ্রোচ’ থাকে না— অস্বর্গ্যম। পাণ্ডবরা যদি একটা ‘অরগ্যানাইজেশন’ হয় তবে তার খ্যাতির সঙ্গে তো এটা বেমানান— অকীর্তিকরমর্জুন। তোমার এই ক্ষুদ্র হৃদয়ের দুর্বলতা ত্যাগ করে তুমি উঠে দাঁড়াও, stop this neuter-gendering yourself…’ ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ… ত্যক্তেত্তিষ্ঠ পরন্তপ।

কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে লিখেছেন— রাজার মধ্যে ‘সদোত্থায়ী’ একটা ভাব থাকবে অর্থাৎ কিনা সবসময় তিনি প্রস্তুত, সব সময় তিনি উৎসাহ উদ্যমে উত্থানশক্তি প্রদর্শন করবেন— রাজ্ঞো হি ব্রতমুত্থানম। কৃষ্ণ সেই উত্থানশক্তি জোগান দিয়ে অর্জুনকে বললেন— কাদের জন্য তুমি কষ্ট পাচ্ছো? এই দুর্যোধন-দুঃশাসন-শকুনিরা কীই বা করেছে তোমাদের! এখন যখন সঠিক প্রতিশোধ নেবার সময় এসেছে, তখন তাদের জন্য তোমার মায়া হচ্ছে— it’s a case of misplaced sympathy— তুমি এটা করতে পারো না— অশোচ্যান অন্বশোচস্ত্বম। দ্রৌপদীকে রাজসভায় এনে দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণেরা কী করেছিল, এই মহামতি ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ— সব তো সেদিন চুপ করেছিলেন, এখন তাদের জন্য আচার্য, পিতা-পিতামহ— এইসব বড় বড় কথা বলছো— প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে— like managers tending to make impressive arguments to justify his own inclinations.

কৃষ্ণ বলেছেন— এখন তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে, এটাই তোমার কাজ। এটা তোমার মতো ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম। যে কোনও ‘অরগ্যানাইজেশন-এর যে কোনও ‘ম্যানেজেরিয়াল লেভেলে’ সংকট আসতেই পারে, কিন্তু সংকটের সময় বিহ্বল বিভ্রান্ত না হয়ে একজন ভালো ‘ম্যানেজার’ কিন্তু সমস্যার জায়গাটাকেই নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগে পরিণত করতে পারে। অর্জুন তোমার জীবনের এই সংকটটাই তোমার নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ এনে দিয়েছে— তোমার সামনে এই যুদ্ধের সুযোগ এসেছে অবধারিত নিয়তির মতো এবং তোমার সামনে সেটাই স্বর্গের দ্বার খুলে দিয়েছে— যদৃচ্ছায়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম। এরকম যুদ্ধ পেলে তোমার মতো ক্ষত্রিয়ের সুখী হবার কথা, এটাই তোমার সুযোগ। you should seize the opportunity.

কিন্তু এই সুযোগটা একজন ম্যানেজারকে নিতে হয় কীভাবে— সেটা বলতে গিয়েই কৃষ্ণের মতো leader সেই অসাধারণ কথাটা বলেছেন— যেটা অর্জুনের, আমাদের এবং তোমাদের সমস্ত বিভ্রান্তির উত্তর। অর্জুন বলেছিলেন— আমরা এ যুদ্ধে জিতব, ওরাই আমাদের জয় করে নেবে— কোনটায় যে ভালো হবে, তাই বুঝতে পারছি না। এর উত্তরে মহাভারতের নেতা, leader সমস্ত গীতার সার কথাটা বলে দিয়েছেন— কাজটায় তোমার সিদ্ধি হবে অথবা সিদ্ধি হবে না, এর কোনওটাই তোমার ভাবার দরকার নেই— তুমি কাজটার সঙ্গে সার্বিকভাবে জড়িয়ে থেকেও যখন তার সিদ্ধির ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে, তখনই কাজটা সব দিক থেকে সার্থক হবে— সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে। কাজের ব্যাপারে পূর্ণ মনোযোগ অথচ কাজের ফলের জায়গায় অনাসক্তি— এটা কিন্তু কোনও ঔদাসীন্যের প্রশ্ন তোলে না, বরঞ্চ এটাই most efficient behavioural strategy.

কর্মসিদ্ধির সম্ভাবনাগুলিকে চরম তার্কিকতায় সিদ্ধান্তে পরিণত করাটাই যোগযুক্ত হয়ে কাজ করা, সেই কাজটা তার নিজের গতিতেই কর্মসিদ্ধি ডেকে আনবে। কিন্তু সেই সিদ্ধির ব্যাপারে অনাসক্তি ব্যাপারটা কাজের তুষ্টিটাকে একটা নিস্তরঙ্গ শান্তরসের মধ্যে সমাহিত করে। তাতে আমিত্ব গৌণ হয়ে যায়। সমস্ত ‘অরগ্যানাইজেশনাল টিম’ নতুন কর্মে উদ্দীপিত হয়।  

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন