সাফাই

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

ছাত্রাবস্থায় পিতাঠাকুর চানক্য শ্লোক বলতেন। তখন তেমন বুঝতাম না, কিন্তু পরবর্তীকালে অধ্যয়নের বিরাট ক্ষেত্রে এসে দেখেছি— শুধু চানক্যের মতো নীতিশ্লোক নয়, আরও শত-সহস্র শ্লোক আছে এবং সে সব শ্লোকের রচয়িতার কোনও নাম নেই ধাম নেই পরিচিতি নেই, ঠিকানাও নেই, কেউ একটিমাত্র শ্লোক লিখেছেন, কেউ দুটি, কেউ বা তিনটি-চারটি। দৈবাৎ তাঁদের নাম মেলে, কিন্তু প্রায়ই নয়। চানক্যের নামে কত শ্লোক, সেগুলি সবই প্রায় নীতিমূলক রচনা, কিন্তু আমি যাঁদের কথা বলছি, তাঁদের বক্তব্য বিষয় ভিন্ন ভিন্ন। কেউ স্ত্রীলোকের কথা লিখেছেন, কেউ বা মূর্খের কথা। কেউ কবিতার কথা লিখেছেন, কেউ বা ডাক্তার-বদ্যি নিয়ে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই যে অন্তর্গত সত্যটা প্রকট হয়ে ওঠে, সেটা একেবারে চিরন্তন এবং তার রস কখনও তিক্ত, কখনও মধুর, কখনও বা ভীষণ ঝাঁঝালো এবং তির্যক।

এগুলিকে অনেক সময় আমি ঠিক ‘কবিতা’ বলতে চাই না, বরঞ্চ পদ্য বলতে চাই। আবার অনেক সময় এগুলির এক-একটিকে আমি ভীষণভাবেই কবিতা বলতে চাই এবং তা এমন কবিতা যা একজন বৃহৎ কাব্য রচয়িতাকে লজ্জা দিতে পারে। তেমন হীরক-খণ্ডের মতো কবিতার আস্বাদন দেবার সময় মাঝে-মাঝেই কিন্তু আমি সেই ছোট্ট ছোট্ট পদ্যগুলিও বলতে থাকব— যেগুলি এক একজন কবির জীবনমন্থনজাত বিষের মতো— জীবনকে দেখার তিক্ত কষায় অভিজ্ঞতা। আমি এগুলোকে শুধু নীতিবাক্য বলতে রাজি নই, কেননা তাহলে এগুলি চির-পঠিত চানক্য-শ্লোকের বেশি মর্যাদা পায় না। বরঞ্চ এগুলোকে আমি জীবনের উপলব্ধি বলতে রাজি, যে উপলব্ধির শব্দগুলি পড়লে, বললে বা বুঝলে মনে হবে— আমারও ছিল মনে, কেমনে ব্যাটা পেরেছে সেটা জানতে। আবার এ সত্যগুলি এমনই সাংঘাতিক সত্য, যা বাস্তবে ঘটলে পরে মনে হবে যেন এমনটা না ঘটলেই ভালো হত। পদ্যগুলি তাই ততটাই নির্মম।

বালক কবি

আমাদের সময় দেখতুম— অসংখ্য লোক কবিতা লিখছে, এখনও লেখে। সেই অসংখ্য কবির মধ্যে অনেকেই আপন প্রতিভায় বিকশিত হয়েছেন পরে। আবার এমন অনেক কবিকে দেখেছি— তাঁদের কবিই বলব, কেননা তাঁরা নিজেরাই নিজেদের কবি বলে দাবি করেন— কিন্তু সেইসব কবিতা পড়ে নিজেকেই এমন বিপন্ন মনে হত যে, কী আর বলব! সহৃদয় বন্ধু হিসেবে অনেক সময় অকারণে প্রশংসা বাক্যও উচ্চারণ করতে হত, তাতে ভবিষ্যতে বিপদ বাড়ত বই কমত না, কখনও এমনও বলতুম— দ্যাখ! ভালো কবিতা লিখতে গেলে আগে ভালো কবিতা এবং ভালো কবির কবিতা পড়া দরকার। তাতে কবিতার বোধ তৈরি হয়। কিন্তু এই পরামর্শ বিফলে যেত। সেই সব কবিরা, যাঁরা আপন স্বরোপিত প্রতিভার স্ফূরণে আপনি আকুল হতেন, তাঁদের সম্বন্ধেই এক সংস্কৃত কবির নির্মম শ্লিষ্ট মন্তব্য—

অপ্রগলভাঃ পদন্যাসে জননীরাগহেতবঃ।
সন্ত্যেতে বহলালাপাঃ কবয়ো বালকা ইব।।

এখানে প্রত্যেকটি পদেই শ্লেষ আছে এবং এই পদ-শ্লেষের মাধ্যমে রচয়িতা বুঝিয়ে দেন যে, অনেক কবি বড়ো ‘ইমম্যাচিওর’, তাঁদের নিতান্তই বালক বলে চিহ্নিত করা যায়। এই ধরনের কবির কবিতা শুনে তাঁর বাড়ির লোকেরাই শুধু আহা উহু করতে পারে, কিন্তু তাদের লেখার সঙ্গে বালকোচিত ক্রিয়া-কলাপের মিল আছে। কবি লিখেছেন— শিশুরা প্রথম পদ-সংক্রমণের সময় ভালো করে হাঁটতেই পারে না, তেমনই এই বালক কবিরাও পদ-পদার্থ চয়নের ব্যাপারে একেবারেই অক্ষম— অপ্রগলভাঃ পদন্যাসে— এখানে পদ কথাটির ওপরেই শ্লেষোক্তি। আবার তেমন শিশুর আরও আরও হাঁটা যেমন শুধু তার মায়ের কাছেই ভালো লাগে, শিশুপদের অর্ধস্খলিত সংক্রমণ যেন তার জননীর অনুরাগের হেতু— জননী রাগহেতবঃ— তেমনই অপক্ব বালক-কবির ব্যবহৃত শব্দরাশি পাঠক সহৃদয়ের বিরাগের কারণ ঘটায়—শব্দটা এখানে ভেঙে পড়তে হবে—’জন-নীরাগহেতব্যঃ’। শ্লোকে ব্যবহৃত ‘বহলালাপাঃ’ শব্দটাও বিশ্লেষণ করলে শিশুর পক্ষে মানে দাঁড়ায়— যে শিশু প্রচুর লালা ফেলে মুখ দিয়ে, অনেক লালা খেয়েও নেয়— বহু লালা পাঃ। আর অপক্ব কবির পক্ষে মানে হবে— যে কবি বহুল অর্থাৎ প্রচুর ‘আলাপ’ করে, অর্থাৎ এটা-ওটা প্রচুর লেখে। অথচ তা কবিতা হয় না।

বিশাল কবিকুলের মধ্যে এমন অপরিপক্ব কবির সংখ্যা দেখে আমাদের সমালোচক কবি শংকিত হয়ে শব্দশ্লেষে তাঁদের বালক বলে চিহ্নিত করেছেন।

কুকবি

সংস্কৃত সাহিত্যে ধুরন্ধর রসশাস্ত্রবিদ রাজশেখর এক জায়গায় বলেছিলেন— কবিতা না লিখে ‘অকবি’ থাকা অনেক ভালো, অন্তত ‘কুকবি’ হওয়ার চেয়ে তা অনেক ভালো। কেননা রাজশেখরের মতে ‘কুকবিতা’ হল ‘জীয়ন্তে মরণ ভেল’— জীবনের মধ্যে সে এক মরণ। অর্থাৎ কবিতা পড়ার আনন্দ পাব বলে যেটা পড়তে আরম্ভ করলুম, তা যদি আমার হৃদয়কে এতটুকুও নাড়া না দেয়, তবে সেটা যেন জীয়ন্তে মরণ— অন্তত রাজশেখর তাই মনে করেন। তবে কিনা, কুকবি তো আর কুকবিতা লিখে নিজে বুঝতে পারেন না যে, তিনি কুকবি। অতএব তিনি কবিতা লিখে কী ভাবেন, সেই অন্তর্লোক বোঝাতে গিয়ে এক কবি লিখেছেন যে, বেশ্যা রমণীর নাগর আর কুকবির জাত প্রায় এক রকম। পুরো শ্লোকটা এইরকম—

গণয়ন্তি নাপশব্দং ন বৃত্তভঙ্গং ক্ষয়ং ন চার্থস্য।
রসিকত্বেনাকুলিতা বেশ্যাপতয়ঃ কুকবয়শ্চ।।

এখানেও অনেক পদেই শ্লেষ আছে। বলা হচ্ছে— বেশ্যার রসিক আর কুকবি— এই দুজনের ব্যবহারই একরকম। দুজনেই নিজের রসিকতায়, রসবোধে নিজেই আকুল হয়ে থাকেন। বেশ্যার রসিক অপশব্দ, খারাপ কথা বা নোংরা গালাগালি গায়ে মাখে না; সে নিজেও নোংরা কথা বলে, নোংরা শুনতেও তার আপত্তি নেই। আর কুকবি যে অযথার্থ অপশব্দ প্রয়োগ করেন, তা নিয়েও তাঁর মাথাব্যথা নেই। বেশ্যারসিক ‘বৃত্তভঙ্গ’ অর্থাৎ তার চরিত্র (বৃত্ত) নষ্ট হওয়ার ভয় পায় না একটুও, আর কুকবি বুঝতে পারেন না তাঁর ছন্দ (বৃত্ত) ভঙ্গের অক্ষমতা। বেশ্যারসিক প্রেয়সীর মূল্য চুকোতে অর্থ নষ্ট করে, আর কুকবি শব্দ প্রয়োগের সময় শব্দার্থের কথা ভাবেন না। বেশ্যার রসিক আর কুকবি আপন রসিকতা-বোধে আপনি আকুল।

কবিতা এবং কবিতার বেরসিক

কবিতা যাঁরা লেখেন, তাঁরা কেন লেখেন তা নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। বোধহয় না লিখে থাকতে পারেন না বলেই লেখেন। কেউ সে কবিতা বোঝেন, কেউ বা বোঝেন না— এমন তো হতেই পারে। যাঁরা লেখেন, তাঁদের কবিতাও যে সব সময় ভালো হয়, তাও নয়। সে কথা আমরা আগেই বলেছি। আবার আমরা সেই মানুষটাকে নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছি— যার কবিতা বোঝার বুদ্ধি নেই, অথচ সার্থক কবির কবিতাকে নিন্দা না করলেও বোধহয় ভাত হজম হয় না। রবীন্দ্রনাথ এই মানুষটিকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছিলেন— অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষার কথা।

বিপুল হৃদয়াভিযোগ্যে খিদ্যতি কাব্যে জড়ো না মৌর্খ্যে স্বে।
নিন্দতি কঞ্চুকমেব প্রায়ঃ শুষ্কস্তনী নারী।।

যে কাব্য বিশাল-হৃদয় সহৃদয়ের যোগ্য, সেই কাব্য পড়ে জড়বুদ্ধি লোক শুধু নিন্দাই করে যায়, সে কখনও নিজের মূর্খতাকে দোষ দেয় না। যে রমণীর পূর্ব প্রশংসিত পীন স্তন শুষ্ক হয়ে যায়, সে প্রায়ই বক্ষবন্ধনীর দোষ দেয়।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন