সময়

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

সময়

বেশ বুড়ো হয়ে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। আমার চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই— ওই যখন চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে, ওই চালশের পরেই যখন চশমা নিলাম— সেই চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, মনে মনে কিছুতেই আমি বুড়ো হব না। হ্যাঁ, এটা মানতে কোনও অসুবিধে নেই যে, মানুষের দেহপ্রস্থে পরিণতির অবক্ষীয়মাণ স্পর্শটুকু লাগবেই। সেখানে তো যম-দেবতার নোটিস পড়বে সেই অসামান্য লোক কথার কেতায়। সেই যে একজন চল্লিশেই মরতে বসেছিল বলে যমের ওপর রাগ করে গালাগাল দিচ্ছিল। যম বললেন— তোমার সময় হয়েছে, তাই নিতে এসেছি, এত বকবক করছো কেন। চল্লিশ বলল— ইয়ার্কি পেয়েছো! মর্ত্যলোকে তবু কিছু নিয়ম-কানুন আছে, জজ-সাহেবের বিচার আছে, তোমাদের স্বর্গে তো তাও নেই। সেখানে শুধু গুণ্ডামি চলে; নইলে এইভাবে এই বয়সে কোনও ভদ্রলোক আমাকে শেষ করে দিতে পারে? যম বলছেন— সেই বিচার হয়ে গেছে বলেই তো তোমায় নিতে এসেছি। লোকটি বলল— চোপ। এখানে একটা সামান্য চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেও এক মাসের মিনিমাম নোটিস দিতে হয়। এক স্কুল ছুটি হলে পর্যন্ত আগে থেকে নোটিস দিতে হয়। এমনকি ওরে শমন! তোর নিজের নামেই আমাদের আদালতে একটা বস্তু আছে— মানে, আদালতে জজ-সাহেব তোকে যদি একবার দেখা করতে বলে, তবে শমন আসে বাড়িতে। বলে যায়, অমুক দিন যেতে হবে। তুই মর্ত্যে এসেছিস আমায় নিতে, তা নোটিস দিবি না একটা। বললি, আর চলে যাব। অত সোজা নয়।

স্বর্গলোকে বিচারহীনতার এমন অভিযোগ শুনে যম একেবারে ঘাবড়ে গেলেন। তো তো করে বললেন— আচ্ছা বুঝলাম, তুমি ঠিক কী ধরনের ‘নোটিস’ চাও বলো তো? লোকটি বলল— আমার ছেলেটা এখনও মানুষ হয়নি, মেয়েটার বিয়ে হয়নি। আর বউটা তো এখনও ডাগরই রয়ে গেছে, আর তুমি এই বেলাতেই নিতে এলে আমাকে বিনি-নোটিসে। এ-সব চলবেনে এখানে। এখেনে আইন-কানুন আছে এখনও। যমরাজ এ-সব তর্কযুক্তি শুনে একটু বিব্রতই হলেন। বললেন— আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি থাকো আরও কিছুদিন এই পৃথিবীতে। যা করবার করে নাও। লোকটি যমের মুখ থেকে ছাড়া পেয়ে যমকে পেন্নাম করে বলল— বাঁচালেন প্রভু। ছেলে-মেয়ে রেখে যা আতান্তরে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যাই হোক, পরে যখনই আপনি আসবেন, নোটিস দিয়ে আসবেন, নইলে এখানকার আইনে আপনার জান কয়লা হয়ে যাবে। যমরাজ আচ্ছা আচ্ছা বলে চলে গেলেন।

তারপর অনেকদিন হয়ে গেল। সেই মরণোন্মুখ লোকটির ছেলে মানুষ হয়ে গেল, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল, বউ বুড়ো হয়ে গেল। যমরাজ একবার লোকটিকে মৃদু মৃত্যু শঙ্কার ধাক্কা দিয়েছিলেন বলে লোকটিকে একটু বেশিই বাঁচার সুযোগ দিলেন। লোকটার এখন বয়েস হয়ে গেছে। কিন্তু বুড়ো বয়সেও তার এটা মনে হচ্ছে না যে, তার সব কাজ শেষ, কর্তব্য শেষ, এবার মরলেই হয়। বরঞ্চ সাধারণ একটা ত্যাগবুদ্ধিতেও এটা মনে হয় না যে, এই পৃথিবীতে যতটা না সফল হয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি মরীচিকা সমুদ্রের জল পান করেছি আমরা, যত কাজ আরম্ভ করে শেষ করেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি বার আরম্ভগুলো যাত্রারম্ভেই শেষ হয়ে গেছে, অনেকটা ছোট পশুর মতো— পনেরো বার চেষ্টা করার পরে একবার শিকার ধরতে পারে— সমারম্ভাঃ ভগ্নাঃ কতি ন কতিবারাংস্তব পশো। কিন্তু আশ্চর্য, এই যে লোকটার কথা বলছিলাম, এরকম মানুষ তো অনেক আছে, এমনকি দু-চারবার যমের ধাক্কা খাওয়া লোকেরও অভাব নেই পৃথিবীতে। কিন্তু তবু যেই না একটু ঠিক হল, অমনই শতধা ছিন্ন আশাগুলি আবার তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে।

লিখেছেন কবি ভর্তৃহরি— মুখে কপালে বলিরেখার শেষ নেই চুল পেকে শনের মতো হয়ে গেল, সমস্ত গায়ের, সন্ধি-গ্রন্থি ঢিলে হয়ে গেল, কিন্তু মনের মধ্যে যুবতী হয়ে রইল যেটা, সেটা হল তৃষ্ণা, আশা, আরও আরও পাবার ইচ্ছে, তার জরা নেই, গাঁটে ব্যথা নেই, সে তরুণীতরা হয়ে ওঠে বৃদ্ধ বয়সেও— গাত্রাণি শিথিলায়ন্তে তৃষ্ণৈকা তরুণায়তে। আমাদের মতো সেই যমের ধাক্কা খাওয়া লোকটাও কিন্তু এইভাবেই ‘আশপাশশতৈর্বদ্ধঃ’ অবস্থাতেই বসেছিল। অবশেষে যমরাজ এলেন এবং মিষ্টিমুখেই বললেন— এবার তো যেতে হবে! নাকি! এবার সেই বুড়ো লোকটি বলল— সে কী কথা! আমার তো কিছু কাজ বাকি আছে এখনও। ভেবেছিলাম, তুমি নোটিস দেবে, আমি কাজ সেরে নেব। আর তোমাকে আগেই আমি বলেছিলাম— বিনি-নোটিসে কোনও কাজ হবে না এখেনে। এ তোমার ছন্নছাড়া দেবলোক নয় যে, যা ইচ্ছে তাই করা যাবে। তুমি যাও এবার, নোটিসের জোগাড় করো। তোমাদের দেবলোকের একদিন মানে মনুষ্য-দিন-মানে অনেকগুলি বছর। তোমাদের মানে দু-চার ঘণ্টা দিলেই আমার কাজ চলে যাবে।

যমরাজ বললেন— ওরে মূর্খ! অনেকক্ষণ বাতেলা শুনছি। আমি কিন্তু নোটিস দিচ্ছি বহু দিন ধরে, তুমি দেখলাম কিছুই খেয়াল করলে না। লোকটি বলল— কোথায় নোটিস, কিসের নোটিস, আমি কিছুই পাইনি। যম এবার হেসে বললেন— মুখ্যু মর্ত্যবাসী। দেবলোকের নোটিস কী তোদের মতো কাগজ ধরানো নাকি রে! শোন তাহলে— যে দিন মেয়ের বিয়ে দিলি, তার দু-মাস আগে তোর সামনের দুটো দাঁত পড়ে গেল। তুই নকল দাঁত বাঁধিয়ে মেয়ের বিয়ে সামাল দিলি বটে, তবে ওটা একটা নোটিস ছিল। অথচ দাঁত বাঁধানোর তাড়নায় তোর খেয়ালই হল না যে, এটা একটা নোটিস। তারপর পঞ্চান্নয় তোর চুলগুলো সাদা হয়ে গেল সব। কিন্তু তোর একবারও খেয়াল হল না যে, তোর মাথার ওপর যমরাজের নোটিস পড়েছে। তুই কী করলি, তুই চুলে কালো কলপ করে আমার নোটিস মুছে দিলি। একবার নয় পনেরো কুড়ি দিন পর পর চুলের সাদা তো আবার বেরিয়ে পড়ে, তুই সেই পার্মানেন্ট নোটিস বারবার ঢেকে দিয়েছিস। তুই নিজে ভাবার চেষ্টা করলি— এগুলি কিছুই নয়, একটু বয়স হলে এরকম হয়ই। কিন্তু মনে মনে তুই বুঝতে পারছিলি বলেই আমার নোটিস অগ্রাহ্য করেছিস বারবার। এরপর যেদিন রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে পা ভাঙলি, সেদিনও তোর বোধ হল না যে, সময় ঘনিয়ে আসছে। খুব তো বলেছিলি যে, বউটা এখনও ডাগর আছে, তোর ভোগের ইচ্ছে দূর হয়নি, তাই সময় দরকার; তা এখন তাঁর কী অবস্থা, আর ভোগ করার ক্ষমতা আছে, না ইচ্ছে আছে?

যমের মুখে বারবার মুখ-ঝামটা খেয়ে লোকটি এবার থতমত হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল— দেবতার নোটিস এইভাবেই পড়ে, এইভাবেই নেমে আসে পরলোকের সাবধান-বাণী। লোকটি বলল— হ্যাঁ, মানছি তোমার কথা। নোটিস এভাবে পড়েছে বটে। কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমার ভোগের ইচ্ছে এখনও যায়নি, বিশেষত এই অল্প বয়সি ছেলেমেয়েগুলোকে যেভাবে নির্ভাবনায় ইচ্ছাপূরণ করতে দেখছি, তাতে আমার ভোগের ইচ্ছেটা আরও বেড়ে গেছে। যম বললেন— সেটা কী আর আমি লক্ষ্য করিনি ভেবেছো। তুমি আজকাল গা-দ্যাখানো পাঞ্জাবি পরে বাজারে যাচ্ছো। বলি, কোন গা দ্যাখাচ্ছো, কাকে দেখাচ্ছো? তোমার বউ আরও স্নো-পমেটম মাখছে, বার বার ভাঙা দেওয়ালে চুনকাম করছে, তুমি ভাবছো— তাঁকে ভালো দেখাচ্ছে না, তোমাকে খুব রুস্তম দেখাচ্ছে! বুঝিস না, তোরও ওই একই অবস্থা। লোকটা বলল— হ্যাঁ, আমার শরীরটা বুড়ো হয়েছে বটে, কিন্তু মনটা এখনও বুড়িয়ে যায়নি যমরাজ! তাই এখনও পাঞ্জাবিটা এমন কাপড়ের কিনছি, যাতে মনে হয় পরেছি কী পরিনি। যমরাজ বললেন— ওরে দুষ্টু বুড়ো! এমন পাঞ্জাবিটা মনকে তরুণ রাখার লক্ষণ, নাকি নিজেকে শারীরিকভাবে বুড়ো না দেখাবার লক্ষণ?

বুড়োর কথা এবার বন্ধই হয়ে গেল। যমরাজ আর ছাড়লেন না, নিয়ে চললেন বুড়োকে পরের জগৎ দেখানোর জন্য। আমি এই কথোপকথন থেকে কিঞ্চিৎ শিক্ষা নিয়েছি। সেই যে আমি চশমা নেবার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম— শরীর বুড়োয় তো বুড়িয়ে যাক, কিন্তু মনটাকে বুড়ো হতে দেব না। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, আমাকে এই জরদগব বয়সেও তাজা মনে রমণীয় চিন্তা করতে হবে। আসলে জীবনটাকে একটু দার্শনিকভাবেই বোঝা দরকার। আখির ইয়ে ওয়ক্ত কেয়া হ্যায়? ইয়ে কেয়া হ্যায়? ইয়ে কেয়া হ্যায় আখির? মু সাল সাল গুজর রহা হ্যায়। ইয়ে য্যায়সে গুজরা অবতক কাঁহা থা? কঁহি তো হোগা।

আমি যে ভেবেছিলাম, চশমা নিয়েও আমি পা মেলাবো এই চলমান নতুন জীবনের সঙ্গে, অন্তত মনে মনে থাকব নতুন, মেনে নেব নতুনের ইস্তেহার। কিন্তু দেখলাম, সেটা হয় না। পা তো মেলাতে পারিই না, কেননা নব্য যুবকের দ্রুতপদী চরণ-চারণার তুলনায় আমার পদ-চারণা ধীর, অচঞ্চল এবং শারীরিক ব্যতিপাত যাতে না ঘটে, সেই কারণেই দৃঢ়। যদি বলি— ঠিক আছে শরীর চলুক তার আপন চালে, আমার মন চলুক এই শত শত তরুণ-তরুণীর মনোবাক্য-বুদ্ধি-অহংকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। দেখলাম, সে চলার মধ্যেও একটা ভালোর সঙ্গে আরেকটা ভালো মেলে না, প্রাচীন পঁচিশ বছর আগের ভালোর সঙ্গে এখনকার চলমান ভালোটা মিলছে না। আসলে ভালো-র সংজ্ঞাটা নির্ধারণ করার অধিকার আমাদের কারও হাতে নেই, সময় বা কালই বোধহয় সেই দার্শনিক অধিকারী যে সময় এবং সময়ান্তরের ভালোটাকে পর্যায়ক্রমে নির্ধারণ করে চলে। কিন্তু সে নির্ধারণ আমাদেরই চলার নির্ধারণ, আমাদেরই পর্যায়-কালের নির্ধারণ— সময় দাঁড়িয়ে আছে স্থির এক সাক্ষী-চৈতন্যের মতো— আখির ইয়ে ওয়ক্ত কেয়া হ্যায়? কাঁহা সে আয়া, কিধার গয়া হ্যায়? ইয়ে কবসে কবতককা সিলসিলা হ্যায়? ইয়ে ওয়ক্ত কেয়া হ্যায় আখির?

এই তো সেদিনই কলেজে টিচার্স রুমে আমার কাছে কতগুলি ছেলে-মেয়ে এসেছিল কথা বলার জন্য। চার ফুট দূরে নবনীতা ঘোষ বসেছিলেন। বছর পঁয়ত্রিশের মহিলা। খুব স্মার্ট, শেপড অ্যান্ড ইকুইপড, ওড়না পরেন না। শুনি নাকি ক্লাসে পড়ানও ভালো। তিনি হঠাৎই বাইরে থেকে আনা এক প্লেট চিকেন-কষা টোস্ট সহ খেতে আরম্ভ করলেন। ছাত্র-ছাত্রীরা দেখছে, কথাও বলছে, পিছনের এক জনকে মুখ চেপে একটু হাসতেও দেখলাম। আমি ভাবলাম— যা কিছুই হচ্ছে অন্যরকম, তা এই নবনীতার জন্যই হচ্ছে। এর কিছুদিন পরে দেখলাম— মহিলাদের মধ্যে পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশের কয়েকজন, যাঁদের শাড়ি ছাড়া দেখিনি কখনও, তাঁরাও নবনীতার অনুবৃত্তিতে সালোয়ার-কামিজ পরে কলেজে আসতে আরম্ভ করলেন। তাতে তাঁদের শারীরিক বিকলতা-বৈগুণ্য, যা হঠাৎ চোখে ধরা পড়ত না, তাও বেশ বোঝা যেতে লাগল এবং তার সঙ্গে রইল শাড়ি পরেননি বলে এক সর্বাঙ্গীণ সাংস্কারিক জড়তা, যা নবনীতার তুলনায় বিপ্রতীপ। এই অবস্থায় একদিন যখন বছর পঞ্চাশের সীমন্তিনী ভদ্র আমার সঙ্গে কথা বলছেন, তখন তাঁকে খুব অপ্রতিভ এবং জড়সড়ো লাগছিল। শেষপর্যন্ত আমি তুলেই ফেললাম কথাটা, আসলে কর্মস্থলে এই কথা তুলবার মতো মান্যতা আমাদের দুই তরফেই ছিল।

বললাম— এই পোশাকে তুমি কিন্তু অস্বস্তি বোধ করছ। এটাতে তুমি অভ্যস্তও নও। তুমি কিন্তু অনুকরণ করে নিজের এই অস্বস্তি ডেকে এনেছ নিজেই— সীমন্তিনী বলল— দেখুন, এই পোশাকে সুবিধে অনেক বেশি। তাছাড়া…। তাছাড়া— আমি বললাম— তাহলে অনেক আগে থেকেই এই সুবিধেগুলো তুমি নিতে পারতে। সীমন্তিনী আরও কিছু বলার আগেই আমি দেখলাম নবনীতা এগিয়ে আসছে। আমি একটু সংবৃত হলাম। কিন্তু নবনীতা যথেষ্টই স্মার্ট, সে হেসে বলল— আমি জানি, কী ব্যাপারে আপনি কথা বলছেন। আসলে কী জানেন— আরম্ভটা সবাই করতে পারে না, সেটা একজনকে করতে হয়। কিন্তু ব্যাপারটা ওঁদের মনেও ছিল। আমি বললাম— কেমনে ব্যাটা পেরেছে সেটা জানতে। তুমি ওঁদের মনের কথা জানতে পেরেছিলে এখানে আসার আগে থেকেই। তুমি কী মনে করো— শুধুমাত্র সুবিধে! আর কিছু নয়? পুষ্পে কীট-সম আর কিছু নেই এখানে? এই যে শত শত মধ্যবিত্ত মহিলাকে— রোগা, কালো, ভাঙা, নুলো, থসা, ধসা— এত মহিলাকে আমি শুধু পুরীর সমুদ্র-সৈকতে প্রথমবার সালোয়ার কামিজ পরতে দেখেছি এবং সৈকত বাস শেষ হতেই ট্রেনের মধ্যে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখেছি— পরের দিন থেকে শাড়িতে বিস্রংসিত হতে হবে বলে— সে কি সুবিধের জন্য, আর কিছু নয়? নবনীতা বলল— আর যাহা আছে তাহা কহিবার নহে সখী!

আর যাহা আছে, সেটা নবনীতা উচ্চারণ করতে না চাইলেও আমি জানি। বিদেশি গবেষকরা জানিয়েছেন যে, তাঁদের অনন্ত দর্শন এবং গবেষণায় যৌবনের ধর্মটাই একটা বেখেয়ালি অযান্ত্রিক মন তৈরি করে দেয় মেয়েদের। এত যে লো-কাট জিনস, পুশ আপ ব্রা, কিংবা এত যে উঁচিয়ে চলা, উদ্দাম বিভঙ্গ— এগুলো কোনওটাই নাকি ভীষণ সচেতন কোনও প্রয়াস নয়, ছেলেদের দেখানোর জন্য তা নয়, বরঞ্চ নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এ হল তার অন্তর্গত উর্বরতার প্রয়াস। আমি জীবনের অনন্ত শিক্ষণীয়তা থেকে এই তত্ত্ব স্বীকার করি এবং মেনেও নিই। হয়তো বা নবনীতাও এই কথাই বলতে চেয়েছিল আধুনিকতার সাম্রাজ্য বিছিয়ে। আমারও এই আধুনিক তত্ত্বে আপত্তি নেই, কেননা এই তত্ত্ব প্রাচীনতম এক আধুনিকতা। ট্র্যাডিশন-এর মধ্যেও শতেক রমণী দিলেন— তাঁদেরও এই উর্বরতা ছিল এবং আমাদের মতো পুরুষরাও সেটা জানতেন।

আসলে রমণীর উর্বরতার মতো এক সহজন্য কারণের কার্য যেটা, তার ফল তো সুদূর-প্রসারী। মনে আছে মহাভারতে পাণ্ডবজননী কুন্তীর সেই কুতূহলী আচরণের কথা। দুর্বাসার বরদান তো এক নিমিত্ত মাত্র, যা রমণীর এই সহজাত উর্বরতাকে সাপোর্ট করে, ‘জাস্টিফাই’ করে। যেন তিনি বরদান করেছিলেন বলেই কুন্তী এক অজানা পুরুষকে আহ্বান করার সাহস পেলেন; হোন না তিনি দেবতা, কিন্তু তিনি সেদিন মানুষের আচরণেই কুন্তীকে তাঁর উর্বরতার প্রসঙ্গকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন তোমার সংকোচের কোনও কারণই নেই তত। এই দ্যাখো, কন্যা শব্দটাই এসেছে কম ধাতু থেকে, অর্থাৎ কিনা যে কোনও পুরুষকেই সে কামনা করতে পারে। এই প্রসঙ্গেই আজকের ভাবুকদের থেকেও আধুনিক কথাটা এসেছে সূর্যের মতো এক দেবতার মুখে। তিনি বলেছেন— তোমার শরীর-মনের ওপর তোমারই অধিকার শুধু, তোমার মা, বাবা, তোমার গুরুস্থানীয়রাও কেউ তোমার ইচ্ছের ব্যাপারে মতামত দিতে পারেন না— ন তে পিতা ন তে মাতা গুরুবো বা শুচিস্মিতে।

কিন্তু এই সূর্যের মত-মতো স্বাধীনতা— স্ব-অধীনতা মেয়েদের এটা কী সেকালের পিতা-মাতারা মানতে পেরেছেন। কেননা রমণীর এই সহজ স্বাধীন উর্বরতা ধারণ করবে যে পুরুষ, তার সংযম না থাকাটাও তারও একান্ত স্বাধীন উর্বরতা। কারণ পুরুষ-মানুষ স্বভাবতই বড় ভঙ্গুর, স্বভাবতই বড়ো উত্তেজনা প্রবণ। এই উত্তেজনার রাশ টেনে ধরার জন্য যে পরিশীলন, যে সংযমাভ্যাস দরকার, সেই অভ্যাসও কার্যকাল উপস্থিত হলে কার্যকরী হয় না বলেই আমাদের মতো বুড়োরা শেষপর্যন্ত জ্ঞান দেবার রাস্তা বেছে নেয়— আখির এ ওয়াক্ত কেয়া হ্যায়? কঁহি তো হোগা। আসলে এই দু-পক্ষের উর্বরতার দ্বন্দ্ব শেষ হবার কোনও উপায় দেখি না, এখানে আমাদের মতো বুড়োদের অবস্থাটা সেই দুই জুয়াড়ি ভাইয়ের মায়ের মতো— যেমনটা কৃষ্ণ বলেছিলেন মহাভারতে। দুই ভাই দুজনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জুয়ো খেলতে বসেছে। তখন মা ভাবেন— আমি চাই আমার বড় ছেলে জিতুক, কিন্তু ছোটটাও যেন কিছুতেই না হারে।

তার মানে, এই বুড়ো বয়সে আমি বুড়ো আধুনিকমনা হয়েও আমি কিন্তু সমস্যার কোনও সুমীমাংসা করতে পারি না। কেননা মহাকাল কতগুলি চিরসত্য কোলে নিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, মাঝখান দিয়ে আমার চোখে চশমা এসে জানান দেয়— সত্য বস্তুটাকে তুমি কিন্তু তোমার কালের চলমানতা দিয়ে বিচার করছো, অথচ তোমার কালের চলমানতা তোমার কালেই স্থির হয়ে গেছে। সেখানে জায়গা নিয়েছে অন্য এক চলমান স্থির। সেই কবি খুব ভালো লিখেছিলেন কথাটা। বলেছিলেন— একটা চলতি গাড়ি থেকে আমি দেখছিলাম— অনন্ত বৃক্ষরাজি পাশ দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে, অথচ সবচেয়ে বড় সত্য যে সমস্ত গাছই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এতে প্রমাণ হয়— সব ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, আমিই চলছি শুধু, চলতে চলতে ফুরোচ্ছি—

মগর হকিকতমে পেড় আপনি জগাহ খাড়ে হ্যাঁয়,
সারি সদিয়া কাতার আপনি জগাহ খাড়ি হোঁ,
ইয়ে ওয়ক্ত সাকিত হো অউর হম ভি গুজর রহে হোঁ,
সফরমে হাম হ্যাঁয়, গুজরতে হাম হ্যাঁয়,
জিসে সমঝতে হ্যাঁয় গুজরতা হুয়া, উয়ো থমা হুয়া হ্যাঁয়,
আখির ইয়ে ওয়ক্ত কেয়া হ্যাঁয়, কেয়া হ্যাঁয় আখির।

ঠিক এই সময়ে আমার মহাভারতের সত্যবতীর কথা মনে পড়ে। সত্যবতী মহাভারতের শ্রেষ্ঠবুদ্ধি নায়িকাদের একজন এবং তিনি প্রবীণতমা। জীবনের অভিজ্ঞতাও তাঁর কম নয়। সেই প্রথম যৌবনসন্ধিতে কন্যা অবস্থাতেই ঋষি পরাশরের সঙ্গে তাঁর মিলন হয়েছিল। তাঁর সেই কন্যাগর্ভের সন্তান স্বয়ং মহাভারতের কবি দ্বৈপায়ন ব্যাস। পরবর্তীতে তিনি হস্তিনাপুরের রাজবধূ হয়ে এলেন নিজের শর্তে মহারাজ শান্তনুর স্ত্রী হিসেবে। হস্তিনাপুরে যতদিন না ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধ শাসন চালু হয়নি, ততদিন তাঁর ব্যক্তিত্ব অনুসারেই গোটা কৌরব রাজ্য চলেছে। কিন্তু হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে সময় পালটাল, নাকি সময় পালটে দিল সত্যবতীকে।

সত্যবতী চোখের সামনে দেখলেন— রাজা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর নাতি পাণ্ডু রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেন। শতশৃঙ্গ পর্বতে তাঁর মৃত্যু হল। তাঁর ছেলেরা রাজবাড়িতে ফিরল, কিন্তু তাঁরা সেই অভিনন্দন পেলেন না, যা পাণ্ডুর স্থলাভিষিক্ত ধৃতরাষ্ট্র দিতে পারতেন। পাণ্ডুর শ্রাদ্ধাবসানে সেদিন আচ্ছন্ন হয়ে বসেছিলেন সত্যবতী। মায়ের অবস্থা দেখে তাঁর কাছে এলেন পুত্র দ্বৈপায়ন ব্যাস। তিনি বললেন— তোমার সুখের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, মা! এখন যে সময় আসছে, সে বড় খারাপ সময়— অতিক্রান্ত সুখাঃ কালাঃ পর্যু পস্থিতদারুণাঃ। বস্তুত এই সুখের কাল ভীষণভাবে আপেক্ষিক এবং বড় বেশি নির্দিষ্ট প্রজন্মনির্ভর। এটাই সত্য যে, পরবর্তী প্রজন্মে যেটা সুখ, আমার প্রজন্মে সেটা সুখ নয়। বৃদ্ধজনেরা স্ব-সময়ের ছায়া চলমান প্রজন্মের মধ্যে দেখতে পান না বলেই সময়টাকেই খারাপ বলে ফেলেন। কিন্তু এইটুকু তাঁরা বোঝেন না যে, এই চলমান সময়ের ভালোটা তাঁদের সময়ের ‘ভালো’ নয়, কেননা আমার বাবার সময়ের ‘ভালো’টা আমার বাবার সময়ের ‘ভালো’ ছিল না।

দ্বৈপায়ন ব্যাস অসামান্য কবিকল্পে এই কথাটা জানিয়েছেন সত্যবতীকে। বলেছেন— পৃথিবী তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছে মা, সামনে যত পাপের দিন আসছে। তুমি আর থেকো না এখানে, তুমি আমার শান্ত আশ্রমে চলো আমার সঙ্গে— শ্বঃ শ্বঃ পাপিষ্ঠদিবসাঃ পৃথিবী গত-যৌবনা। আবার সেই কথাটাই আসে— চলতি গাড়িতে থাকলেও গাছ স্থির আছে, অর্থাৎ পৃথিবী যৌবন হারায় না কখনও। সে অনন্তযৌবনা। আমার গৌরব-কাল যখন পৃথিবীর যৌবনের সঙ্গে একত্তর হয়, সেটাই আমার কাল। কিন্তু আমি চলতে থাকি, চলতে চলতে ফুরোতে থাকি— সফরমে হম হ্যাঁয়, গুজরতে হম হ্যাঁয়, জিসে সমঝতে হ্যায় গুজরতা হুয়া উয়ো থমা হুয়া হ্যাঁয়।

ঠিক এতটা যখন আমি দার্শনিকভাবে বুঝতে পেরেছি, তখনই আমার বোধ হল, এমন বিচ্ছিরিভাবে বুড়ো হলে চলবে না। কেননা মানুষের যে মনটা চলে, সেই মনের কিন্তু সত্যিই কোনও বুড়োমি নেই। এরই মধ্যে অবশ্য যাঁরা যৌবনকাল থেকেই বৃদ্ধত্বের চর্চা করেন, অত্যল্প কারণেই অবসন্ন বোধ করেন, একাকিত্বকে যাঁরা এক কর্মশেষের অভ্রান্ত পরিণতি বলে গ্রহণ করেছেন, তাঁদের প্রতি আবার কোনও আবেদনও নেই, নিবেদনও নেই। মহামতি বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন—

আমি অন্ত্র-দন্তহীন ত্রিকালের বুড়ার কথা বলিতেছি না— তাঁহারা দ্বিতীয় শৈশবে উপস্থিত। যাঁহারা আর যুবা নাই বলিয়াই বুড়া, আমি তাঁহাদিগের কথা বলিতেছি। যৌবন কর্ম্মের সময় বটে, কিন্তু তখন কাজ ভালো হয় না। একে বৃদ্ধি অপরিপক্ক তাহাতে আবার রাগ দ্বেষ ভোগাসক্তি, এবং স্ত্রীগণের অনুসন্ধানে তাহা সতত হীনপ্রভ। এজন্য মনুষ্য যৌবনে সচরাচর কার্য্যক্ষম হয় না। যৌবন অতীতে মনুষ্য বহুদর্শী, স্থিরবুদ্ধি লব্ধপ্রতিষ্ঠ এবং ভোগাসক্তির অনধীন, এজন্য সেই কার্যকারিতার সময় এই জন্য, আমার পরামর্শ যে বুড়া হইয়াছি বলিয়া কেহ স্বকার্য্য পরিত্যাগ করিয়া মুনিবৃত্তির ভান করিবে না। বার্দ্ধক্যেও বিষয়চিন্তা করিবে।

এই ‘বিষয়চিন্তা’ ব্যাপারটা যে জীবনাবধি টাকা জমানো, আর বাড়ি-গাড়ি-সম্পত্তির ভাবনা করা নয়, সেটা বুঝিয়ে দিতে সময় নেননি বঙ্কিম। তিনি বলেছিলেন— পরের জন্য কাজ করার এই সময়। আমি অবশ্য পরহিতের চেয়েও নিজের হিতের জন্য বেশি চিন্তা করি। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। এইজন্য বলছি এ-কথা যে, শত শত মানুষকে এখন দেখছি— বৃদ্ধত্বের আভাস তাঁদের অকারণে পঙ্গু করে তুলছে, কতগুলি যুবক-যুবতীর মধ্যেও আমি এই নিরুত্তাপ বৃদ্ধত্ব দেখতে পাচ্ছি। এক-একটি অণু-পরিবারে একটি একটি ছেলে কিংবা মেয়ে। পিতা-মাতার অনন্ত সুনজরে তারা এত শিক্ষিত, এত ভালো, এত ভদ্র এবং এত ‘গাণ্ডু’ হয়ে উঠছে যে, একটি মা-বাবাকে দেখলাম— তিনি ছেলেকে প্রেম করিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু এমনই কপাল যে, আধারভূতা রমণীটি আমাকে আড়ালে এসে বলল— এটা কী একটা ছেলে? আমি ভাবলাম— সত্যিই তো, এ ছেলে তো কোনও দিন গুলি খেলেনি, কোনও দিন ঘুড়ি ওড়ায়নি, কোনও দিন বাপের পকেট কেটে যৌবনসন্ধিতে হেলেন-এর নিতম্ব-নৃত্য দেখেনি, কোনও দিন ভুল করেও জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির বউদির সালস্য চুল-আঁচড়ানোও দেখেনি, এমন দুধু-ভাতু ছেলেকে নিয়ে কোন রমণী আস্বস্ত বোধ করবে! বস্তুত বৃদ্ধত্ব তোলা রইল এঁদের জন্য। আর রইল টি. এস. এলিয়ট-এর সেই সাংঘাতিক কথাটা, যা তিনি বোদলেয়ার-এর কথা টেনে বলেছিলেন— So far as we are human, what we do must be either evil or good; so far as we do evil or good, we are human; and it is better, in a paradoxical way, to do evil than to do nothing; at least we exist.

অধ্যায় ১ / ২২

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন