তাহলে আর ভগবান কী করলেন

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

আমার পুরোনো পাড়ায় ক্যাওড়াতলা শ্মশানের উল্টো দিকের এক গৃহস্থ বাড়িতে একটি রাধা-কৃষ্ণের মন্দির ছিল। মন্দির না বলে সেটাকে ঘর বলাই ভালো। গৃহস্থ বাড়ির সেবা, রাস্তার ওপরে ঘর, লোকে বাজার যাবার পথে, অফিস যাবার পথে হাত তুলে নমস্কার করার সুযোগ পায়, এক দণ্ড প্রার্থনা করার সুযোগ পায়— ভালো রেখো ঠাকুর।

একদিন রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎ দেখি— একটি ছেলে পায়ের চটি খুলে অনেকক্ষণ ধরে নমস্কার করছে এবং বিড় বিড় করে বেশ আকুলভাবে ঠাকুরকে কিছু জানাচ্ছে। ছেলেটিকে আমি চিনতাম— অত্যন্ত ডানপিটে দুষ্ট প্রকৃতির বালক, পড়াশুনোর নামগন্ধ নেই। তাঁকে হঠাৎ রাস্তার মাঝে এমন ধ্যানী-ভাবে দেখে আমার একটু সন্দেহই হল। একবার মনে হল— অখিল রসামৃত-মূর্তি কৃষ্ণের অহৈতুকী কৃপা কার ওপরে কখন বর্ষিত হয়, কিছুই বলা যায় না। তবে আমি নিজে মর্ত্যধামের সংশয়ী মানুষ, ঈশ্বরের কৃপা বস্তুটাকেও এত সহজ বলে মনে হল না। আমি ছেলেটির বন্ধুকে— সে চার পা দূরেই নির্বিকার মুখে খাতা-বই হাতে দাঁড়িয়েছিল— সেই বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলাম— কী ব্যাপার রে নন্দ! আজ তোর বন্ধুর এত প্রণামের ঘটা কেন রে? ছেলেটি বলল— আজ পরীক্ষা আরম্ভ হচ্ছে তো! ভীষণ ভয় করছে, তাই ও এই…।

আর বলার দরকার ছিল না। পড়াশুনো বাদ দিয়ে সারাদিন বদমায়েশি করার পর আকস্মিক এই ভগবৎ-প্রীতির কারণ সহজেই বুঝলাম। পরবর্তীকালে অন্যতর একটি ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখলাম। দেখলাম, পদার্থবিদ্যার এক অধ্যাপক কম্পিত কলেবরে এক দৈবজ্ঞের শরণ গ্রহণ করছেন। এমনিতে তাঁর কর্মজীবন প্রশস্ত ছিল, তবু কী একটা ভবিষ্যৎ উন্নতির সম্ভাবনায় তাঁর মন এমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল যে, আমার কাছে জ্যোতিষের গণনা নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করলেন। আসলে এটা হয়। আমি সংস্কৃত-পড়া-মানুষ, আর সংস্কৃতজ্ঞ মানুষ দেখলেই এটা একটা সাধারণ চালু ধারণা যে, জ্যোতিষ, ধর্মবিশ্বাস, পূজা-অর্জনা, ঈশ্বর— এই সব দুর্ভেদ্য বিষয়ে একটা দুর্বলতা থাকবেই। ব্যক্তিগতভাবে জানাই— উপরিউক্ত বিষয়গুলিতে আমার অবশ্যই দুর্বলতা আছে, কিন্তু সঙ্গে ঈষদিষদ দার্শনিকতার বোধ থাকায় এই বিষয়গুলিকে আমি অপ্রতর্ক্য এবং যুক্তির অতীত বিষয় বলে মনে করি না। ফলে পদার্থবিদ অধ্যাপক যখন জ্যোতিষিক বিষয়ে আমার মত চাইলেন, তখন প্রথমে আমি তাঁর কাছে পুরোনো পাড়ার সেই পরীক্ষার্থীর ভক্তিনম্র গল্পটা আগে করলাম। তারপরেই বললাম— এখন প্রশ্ন হল— বিদ্যায় অভিনিবিষ্ট ওই পরীক্ষার্থীকে ভগবান অনেকটা নম্বর দিয়ে দিতে পারেন কিনা! যদি পারেন, তবে দৈবজ্ঞও তোমাকে সমাধান দিতে পারবেন।

পদার্থবিদ অবহিত হয়ে বসতেই বললাম— দেখো ভাই। এ-কথা তো অসংখ্যবার শুনেছ যে কালিদাস মূর্খ ছিলেন, পরে সরস্বতীর বরে মহাকবি হয়েছেন। এমনকী আদি কবি বাল্মীকিও দস্যু ছিলেন, পরে রামনাম জপ করে তাঁর এমন অবস্থা হল যে, তাঁর মনোভূমিটাই অযোধ্যার চেয়ে সত্য হয়ে গেল। বাস্তব ক্ষেত্রে— আমার এমন বিশ্বাস হয় না। কারণ এটা ভগবানের কাজের মধ্যে পড়ে না। শাস্ত্র ঘেঁটে যা বুঝেছি— তাতে ভগবৎকৃপায় আমার কোনও অবিশ্বাস নেই, তাঁর কৃপায় অবশ্য মূক বাচাল হতে পারে, পঙ্গু গিরি লঙ্ঘন করতে পারে। তবে কিনা, সেই কৃপা এমনই এক অপূর্ব বস্তু যা পেলে মানুষ আর কবিও হতে চাইবে না, ধন-জন-যৌবনও চাইবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা হল— কেউ যদি ভগবৎ কৃপার বলেই মূর্খ বিদ্বান হতে চায়, অথবা দস্যু থেকে মহাকবি হতে চায়, তবে সেই কৃপালাভের অনুকূল কাজগুলিও তাকে করতে হবে। অর্থাৎ মূর্খত্ব পরিহারের জন্য বিদ্যালাভের যথোপযুক্ত আয়োজন করতে হবে, মহাকবি হবার জন্য দস্যুবৃত্তিও ত্যাগ করতে হবে।

পদার্থবিদ বললেন— তাহলে আর ভগবান কী করলেন! মূর্খকে বিদ্যার আয়োজনও করতে হচ্ছে, দস্যুকেও নিজের কু-প্রচেষ্টা ত্যাগ করতে হচ্ছে— এখানে ভগবানের আর কী কাজ থাকল? আমি বললাম— সত্যিই তাই। ভগবানের কাজ এগুলো নয়। যিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেছেন, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা যাঁর নাম নিয়ে আপন কক্ষপথে চলতে শুরু করল, সেই ভগবানের এত বড় বড় কাজ আছে, যে বেশ কিছু কাজের দায়িত্ব অন্যের ওপর দেওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনও উপায় নেই। তিনি এমন হঠাৎ করে কিছু করেন না। আমার কথা শোনো, এক প্রাচীন কবি বলেছেন— দেবতার সেবা-শুশ্রূষা, স্মরণ করলেই কর্মবন্ধন মুক্ত হয়ে যায় না, বাছা। যদি তাই হত, তাহলে শিবের যে ওই ষাঁড়টি, তাকে আর ঘাস খেয়ে দিন কাটাতে হত না। ওই ষাঁড়টি শিবের কত প্রিয়, ওই বৃষবাহনে চড়ে তিনি কৈলাস থেকে কন্যাকুমারী কতই না ঘুরেছেন, এমনকী বিয়েও করতে গিয়েছেন ওই ষাঁড়ের পিঠে চড়েই, তবু তাকে সারাজীবন ওই ঘাসই খেয়ে যেতে হল, শিবের কৃপায় ও তো প্রতিদিন বিরিয়ানি খেতে পারত। অথচ— জঘাস ঘাসমেবাসৌ বলীর্বর্দঃ কপর্দিনঃ।

উপরি উক্ত কথাগুলির মধ্যে কথঞ্চিৎ রসিকতা মেশানো আছে বলে মনে হলেও, এই কথাটার মধ্যে কিন্তু ভারতীয় দর্শনের মৌলিক সূত্রটি লুকানো আছে। আসলে এই বিশ্বসংসারে কোন মানুষটি কী করে বেড়াচ্ছে এটা চক্ষুভেদ করে দেখে রাখার সময়ও ঈশ্বরের নেই তার সেই ভাবনায় তিনি বিশ্বসংসার চালানও না। তিনি এত বুদ্ধিমান যে, ভালো কাজ করার ইচ্ছে এবং অনিচ্ছেটুকু তিনি অত্যন্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মনুষ্যের স্বাধিকারেই রেখে দিয়েছেন। অর্থাৎ এ-ব্যাপারে মানুষকে তিনি স্বাধীনতা দিয়েছেন— সম্পূর্ণভাবে। অনেকে বিলাপ করে বলে না— ভগবান। আমাকেই তুমি এত দুঃখ দিলে, আমি তো কোনও খারাপ কাজ করিনি, অথবা পরীক্ষাটা তো ভালোই দিয়েছিলাম, কেন যে এমন হল… ইত্যাদি। আপনাদের পরিষ্কার জানিয়ে রাখি— এইসব বিষণ্ণ, বিপন্ন বিষয়ে ভগবানের কোনও হাত নেই। যদি কারও হাত থাকে তো, সে নিজের কর্ম, নইলে অন্যের দ্বারা কৃত-কর্ম। কিন্তু সেখানে ভগবানের কোনও ভূমিকা নেই। দুঃখে, বিপদে পড়লেই মানুষের এই অনন্ত দোষারোপ, অথচ সুখের মুহূর্তে উজ্জ্বল কৃতিত্বের সময় সমস্ত ‘ক্রেডিট’টাই নিজের— এই নিতান্ত মানব মনস্তত্ত্বের কথা ভগবান অনেক আগেই বুঝেছিলেন বলেই তিনি সেই সময়েই হাত ধুয়ে ফেলেছিলেন। ভগবদগীতায় তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন— দ্যাখো অর্জুন। ঈশ্বর কাউকে পুণ্যও দান করেন না, পাপও দান করেন না, তিনি কারও পুণ্য গ্রহণও করেন না, কারও পাপও গ্রহণ করেন না— নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ। ভালো কাজ বা মন্দ কাজ করার ব্যাপারে ঈশ্বরের কোনও কর্তৃত্ব নেই, মানুষ নিজের স্বভাব অনুসারে নিজের কাজ করে এবং তার ফল পায়— ন কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ।

সত্যি কথা বলতে কি নিজের কাজটুকু করা এবং তার সঙ্গে ঈষৎ ভাগ্যের সংযোগ— এতেই দুনিয়ার সব কিছু হয়। অবধারিত প্রশ্ন ওঠে, তাহলে ভাগ্যটাই কি ভগবান? এর উত্তর খুব কঠিন, বস্তুত ভাগ্য ব্যাপারটা যে ঠিক কী তা আজও আমি বুঝতে পারিনি। এটা কি কাল, মহাকাল, ‘টাইমিং’, নাকি বুদ্ধি, নাকি অন্যের সঞ্চিত কর্ম— এ ব্যাপারে আমার এবং আপনারও নিশ্চয় প্রচুর বিভ্রান্তি আছে। এক ভদ্রলোককে দেখেছিলাম— তিনি ‘সিনিয়রিটি’ ভিত্তিতে সরকারি অফিসের একটি সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, অন্য জন হননি। অথচ দুজনে একই দিনে রিটায়ারও করেছিলেন। সেই অন্য জন সারাজীবন দুঃখ করে গেলেন— উনি নাকি তাঁর সহকর্মীর চাইতে এক ঘণ্টা পরে অফিসে ‘জয়েন’ করেছিলেন, তারই ফল ভুগলেন সার জীবন ধরে। তা এটাকে কাল বললেন, না ভাগ্য বলবেন? ভাগ্য যদি ভগবানই হত, তাহলে ভগবানদের অবস্থাটা কী?

মহাকবিরা অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। বলেছেন— ভবিতব্যতা এমন জিনিস যে, সেই ভবিতব্যতা অনুসারেই বুদ্ধি তৈরি হয়, সেই ভবিতব্যতা অনুসারেই মানুষকে তার কাজগুলোও করতে হয়, এমনকী সহায়ক লোকগুলিকেও সেই অমোঘ ভবিতব্যতার দিকেই টেনে নিয়ে যায়— তাদৃশী জায়তে বুদ্ধিব্যবসায়ে’পি তাদৃশঃ। এ-ব্যাপারে সবচেয়ে বড় উদাহরণ রামচন্দ্র। কোথা থেকে মায়া-হরিণ এসে সীতার সামনে ঘোরাঘুরি করতে আরম্ভ করল এবং যে সীতা রামচন্দ্রের কাছে কোনওদিন কিছু চাননি, রাজসম্পত্তি ত্যাগ করে যিনি বলে এসেছেন, সেই সীতা রামচন্দ্রের কাছে বায়না ধরলেন— তাঁর সোনার হরিণ চাই। ছোট ভাই লক্ষ্মণ তাঁকে বারণ করলেন, তবু রামচন্দ্র কথা না শুনে ছুটলেন সেই অসম্ভব-জন্মা সোনার হরিণের পিছনে। পণ্ডিত কবিরা বললেন— কর্মন্য বাধ্যতে বুদ্ধিঃ— অর্থাৎ রামচন্দ্রের কপাল, তাঁর প্রারব্ধ কর্মই তাঁকে এমন বুদ্ধি জুগিয়েছে। অন্য আর এক কবি বললেন— সোনার হরিণ কোনওদিন জন্মায়ওনি, কোনওদিন সোনার হরিণ কেউ দেখেওনি, এমন কোনও খবরও আসেনি কোনও দিন যে, সোনার হরিণ কেউ দেখেছে, অথচ তবুও রামচন্দ্রের তৃষ্ণা বলবতী— সোনার হরিণ পাবই। কী আর বলব, সর্বনাশের সময় যখন এগিয়ে আসে, তখনই এমন বুদ্ধি হয়— তথাপি তৃষ্ণা রঘুনন্দনস্য বিনাশকালে বিপরীতবুদ্ধিঃ।

তার মানে, আমাদের দর্শন বলে— ভগবান হোন আর যেই হোন, ভবিতব্য এমন জিনিস যে, ভগবানও তা থেকে রেহাই পান না। আমার তো রামচন্দ্রের কথা মনে হলেই সেই গল্পটা মনে পড়ে। দেহাতি আদিবাসীদের নাটক দেখছিলাম রাতের অন্ধকারে হ্যাজাকের আলোয়। ওরা রাসযাত্রার সোনার হরিণ পালা করছিল। পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার সেই বন্য অঞ্চলে হরিণ আর কোথায় পাওয়া যাবে। ওরা একটা মোষের বাচ্চা নিয়ে এসেছিল, সে আসলে হরিণের পার্ট করছিল। মোষের বাচ্চাকে ওদের ভাষায় বলে— কাঁড়া। অভিনয় করছিল দুই সাঁওতাল যুবক-যুবতী। তারা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রাসযাত্রা করছিল। সোনার হরিণের ইতি-উতি বিচরণের প্রতীতি আনার জন্য দুটি লোক দুটি দড়ি মোষের বাচ্চার গলায় লাগিয়ে পর্যায়ক্রমে একবার এদিকে টানছিল, আর একবার ওদিকে, যেন সোনার হরিণ দৌড়াচ্ছে। এর মধ্যে সীতারূপী দেহাতি যুবতী রামচন্দ্রের কাছে বায়না ধরল— উঁই হরিণটা আমি লিব। তু দিবেক নাই। উই হরিণটা আমি লিব। যুবক আকণ্ঠ মদ গিলে বসে আছে, মদের ঘোরে তার পার্টও মনে নেই ভালো করে, অতএব সীতা দেহাতি বারবার বায়না করলেও রামচন্দ্র প্রথমে কিছু বললেন না বটে, কিন্তু পৌনঃপুনিক বায়না— উই হরিণটা আমি লিব— চলতেই থাকায় তিনি হঠাৎই রেগে গিয়ে বললেন— উঁই হরিণ লিতে নাই, উ ঘোষদিগের কাঁড়া বটে। অর্থাৎ ওটা গয়লাদের ঘরের মোষের বাচ্চা, ওটা সোনার হরিণ নয়।

আমার বক্তব্য— মদের ঘোরে থাকা দেহাতি আদিবাসী পুরুষও যে সত্যটা বোঝে, ভগবান রামচন্দ্র সেটা বোঝেননি, চরম বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও সময়ে তাঁর মাথা কাজ করল না— সুবুদ্ধিরশি যদরামঃ হৈমং হরিণমন্বগ্যাৎ। মহাভারতের কবি রামায়ণের রামচন্দ্রকে নিয়ে ফুট কেটে বললেন— হয়, এ-রকম হয়। বিপদ যখন সামনে এসে পড়ে তখন বুদ্ধিমান লোকেরও বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে যায়— প্রায়ঃ সমাসন্ন-বিপত্তি-কালে ধিয়োপি পুংসাং মলিনীভবন্তি। আমরা এটাকেই ভাগ্য বলছি, ভবিতব্যতা বলছি, ভগবান সর্বশক্তিমান হলেও নরলীল অবস্থায় নিতান্ত এই মানবোচিত ভবিতব্যতাকে অতিক্রম করেন না। রামচন্দ্রের এই ভবিতব্যের কথা মহাভারতে যাঁকে শোনানো হচ্ছিল, তিনি কিন্তু ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, যিনি কপালের ফেরে পাশাখেলায় হেরে বনবাসে গেছেন। কৃষ্ণের মতো সহায়ও এই ভবিতব্য এড়াতে কোনও উপায় বার করতে পারেননি।

আবার দেখুন, সঞ্চিত কর্মও তো ভাগ্য তৈরি করে অথবা সঞ্চিত অর্থ। আমাদের তো নিশ্চয়ই অদ্ভুত লাগে মাঝে মাঝে— এক-একটা লোককে দেখি— গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে, অর্থচিন্তা নেই, কোনও গুপ্তচিন্তাও নেই, গাড়ি-বাড়ি-সহযোগে দিব্যি পাঁচ ওয়ক্ত খান-দান, আড্ডা মারেন। এক কবি তো ঈর্ষাবশে বলেই ফেললেন— ভাগ্য যদি থাকে, তবে অলস লোককে বিছানা থেকে উঠতেও হয় না। ধনৈশ্বর্যের প্রতীক লক্ষ্মী এই মানুষগুলি সর্বাঙ্গ সমর্পণ করে বিপরীত বিহারে রতিক্রিয়া করেন পুরুষায়িত ভঙ্গিতে— অলসমপি ভাগ্যন্তং ভজতে পুরুষায়িতে শ্রীঃ। অর্থাৎ রতিক্রিয়ার পরিশ্রমটুকুও করতে হয় না এমন ভাগ্যবান মানুষও আছে এই দুনিয়ায়।

তবে আমার মতে এঁদের ঈর্ষা করে লাভ নেই। পুরুষাসনে স্ত্রীকে রেখে বড় অলস এক অর্থজীবন কাটিয়ে দেওয়া কোনও মানুষের কাম্য হতে পারে বটে, তবে আমার কাছে তার চেয়ে মৃত্যুও অনেক ভালো। তবে হ্যাঁ, এই সব উদাহরণ থেকে এটা মেনে নিতে পারি যে, হ্যাঁ ভাগ্য বলে একটা জিনিস নিশ্চয় আছে, তবে সেটা ঠিক কী তা আজও বলতে পারি না। নইলে কেন এমন হয়— অতি সুন্দর দেখতে পুরুষের অতি কুরূপা স্ত্রী, অথবা খুব সুন্দরী, অথচ তার স্বামী মারা গেছে, ছেলেও হয়নি একটা, অথবা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খুব ভালো, খুব সুন্দর অথচ দারিদ্র দহন তাদের শরীরে, মনে, গৃহে, সংসারে— কী বলবেন একে, কপাল ছাড়া।

তা এই কপাল, ভাগ্য, বিধিলিখন— যাই হোক, তাকে যে নামেই ডাকুন, সেটা কাল হোক, পূর্বসঞ্চিত কর্ম হোক অথবা কোনও আকস্মিকতা, আমাদের প্রাচীনেরা কিন্তু সেটাকেই সব বলে মেনে নেননি। আমাদের প্রাচীনেরা যতই ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস করে থাকুন, এটা তাঁরা বলবেন না যে, সারা বছর পড়াশুনো করলাম না, অঙ্ক করলাম না, আর পরীক্ষার হল-এ ঠাকুর এসে পরম অলৌকিকতায় আমার অঙ্ক মিলিয়ে দেবেন খপাখপ— এটা আমাদের প্রাচীনেরা বিশ্বাস করতেন না, সবার ওপরে তাঁরা কর্মে বিশ্বাস করতেন, ভারতবর্ষের ধর্মে, দর্শনে, আচার-বিধিতে কর্ম কথাটা এমনভাবে প্রবেশ করেছে যে, সেখানে ভাগ্য, কপাল, বিধিলিপি কথাগুলো প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এমনকী যে খারাপ অবস্থা বা বিপন্নতায় মানুষ ভুগছে, অথবা সেটা যদি অলসের প্রতিধনলক্ষ্মীর পুরুষায়িত সম্ভোগও হয়, অর্থাৎ সেটা যদি খুব ভালো অবস্থাও হয়, তবে আমাদের দার্শনিক প্রাচীনেরা সেটাকে ব্যক্তি বিশেষের পূর্বজন্মকৃত প্রারব্ধ শুভাশুভ কর্ম বলবেন, কিন্তু কপাল বা ভাগ্য বলে আকাশমুখী লঙ্কার মতো বসে থাকেন না।

অথচ আমাদের দেশেই এত ভাগ্যগণনা হয়, অন্তত পাঁচটা টিভি চ্যানেলে রোগা-মোটা দেবজ্ঞ পুরুষেরা বিচিত্র বেশে দূরস্থিত দূরভাষী ভাষিণীদের ভয় দেখান এবং আশ্বাস দেন, এ-দেশেই টিয়া-পাখি আপনার ভাগ্য বলে দেয়, এ-দেশেই এখনও কুষ্ঠি বিচার করে সুসমাহিত বিবাহ ভেঙে দেওয়া হয়। তবে কিনা আমার এক বন্ধু জ্যোতিষ, কালীঘাটের সাহানগর স্কুলের পার্শ্ব-নিবাসী দক্ষিণারঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছিলেন— জ্যোতিষ একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিমাত্র, যাতে গ্রহ-নক্ষত্রের সংস্থান বিচার করে একটি মানুষের ভাগ্যস্থিতি খানিকটা বলে দেওয়া যায় মাত্র, কিন্তু জ্যোতিষ দিয়ে ভাগ্য বদলানোও যায় না, আর বিভিন্ন লগ্নমান নবাংশমানের ভুলে ভুল বিচার হওয়াটাও যথেষ্ট স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় কথা হল সেই ব্যক্তি-মানুষ— যিনি উদ্যোগ নেবেন, জীবনের ক্রিয়াকারিতায় যাঁর চেষ্টা এবং প্রয়াসই তাঁর ভাগ্য গড়ে দেয়। এই ভদ্রলোক তাঁর জ্যোতিষ-গণনার ছাপানো প্যাডে প্রাচীন এক মহাজনের পদ সর্বাগ্রে রেখেছেন, যেটা আমার খুব ভালো লেগেছে। সেই সংস্কৃত পদের আহ্বানটুকু এই— মহাশয়। একটা রথ চালাতে গেলে অন্ততপক্ষে দুটো চাকা লাগে। একটামাত্র চাকায় যেমন রথের গতি তৈরি হয় না, তেমনই বিনা পুরুষকারে বিনা চেষ্টায় ভাগ্যও কিছু ফলে না— বিনা পুরুষকারেণ তথা দৈবং ন সিধ্যতি।

কোনও জ্যোতিষ, কিংবা দৈবজ্ঞ যদি এই প্রত্যয় নিয়ে কথা বলেন, তবে আমাদের বলার কিছু থাকে না। কিন্তু অধিকাংশ জ্যোতিষীই চেষ্টা, পুরুষকার এবং উদ্যোগ ব্যাপারগুলোকে দৈব-খ্যাতি দিয়ে এমন আচ্ছন্ন করে দেন যে মানুষ তখন অনেকটাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, খানিকটা দৈব নির্ভরও হয়ে পড়ে। এক প্রাচীন কবি জ্যোতিষের গণনা পদ্ধতি নিয়ে বেশ মজা করে বলেছেন— গণক জ্যোতিষ তো বসে বসে নানা জনের জন্মপত্রিকা লিখছেন, নানা ভবিষ্যদবাণীও করছেন— শুভ এবং অশুভ। যদি সে-সব ভবিষ্যদবাণীর একটাও মেলে, তবে তিনি নিজের দক্ষতা দেখিয়ে অনেক কথা বলেন। আর যদি নিজের কথা না মেলে, তবে তিনি লগ্নদ্রষ্টা গ্রহের নানা ফিকির-ফন্দি এবং ক্ষমতার কথা শোনাবেন। কবি লিখেছেন— এইভাবেই গণক-জ্যোতিষী লোকের টাকা মারেন। আসলে দৈবজ্ঞ-গণকের বিশাল জালটাই এইরকম— ন ফলতি যদি লগ্নদ্রষ্টুরেবাহ মোহং/ হরতি ধনমিহৈবং হস্ত দৈবজ্ঞ-পাশঃ।

আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, তবে আমি বলব— আমি ভগবানেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি, এমনকী বিচিত্র দৈবগতিতেও একটু একটু বিশ্বাস করি, কিন্তু দৈবজ্ঞের কথা শুনে বসে থাকি না। ভগবান অথবা দৈব ক্ষমতায় যে বিশ্বাস করি, তার কারণ ওই যে ট্রেইন-অ্যাকসিডেন্ট হলে কামরার সবাই মারা গেল, অথচ একটি শিশু বেঁচে রইল অক্ষত, (সেটা সেই শিশুর ভাগ্য না দুর্ভাগ্য, সেটা অন্য কথা) কিন্তু বেঁচে থাকাটাই তো সেখানে দৈব্যের বিন্যাস, সেটা অস্বীকার করি কী করে? তবে এই ধরনের অলৌকিক ক্রিয়া-কলাপ ছাড়া দেবতা আমাকে জীবনের ধনগুলি পাইয়ে দেবেন, এতে আমার বিশ্বাসও নেই আর দেবতার কাছে আমি এমনটা চাইও না। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের পরম দেবতারাও সেইরকম। এক মহাকবি লিখেছেন— যিনি স্বয়ং মহেশ, যাঁর শ্বশুর নগেশ (হিমালয়), যাঁর সখা ধনেশ (কুবের) এবং যাঁর ছেলে গণেশ, তিনি নিজে কিন্তু ভিক্ষা করে বেড়ান, পরম ঈশ্বরের ইচ্ছাটাই হয়তো এইরকম—

তথাপি ভিক্ষাটনমেব শম্ভোর্বলীয়সী কেবলমীশ্বরেচ্ছা।

আমাদের কথা হল— ভিক্ষা করা নিয়ে মহাদেব শম্ভুর কোনও দুঃখ নেই। তিনি সমস্ত সম্পদের অধীশ্বর হয়েও এই বৈরাগী জীবন বেছে নিয়েছেন। মানুষের মধ্যেও যদি এই বিরাগ আসে, তাহলে তার থেকে আনন্দ আর কী থাকতে পারে। কবি ঋষি তো অভয় দিয়ে বলেইছেন— এখনও ভারতভূমিতে নদীর জল শুকিয়ে যায়নি, এখনও শত শত পরোপকারী বৃক্ষ আছে, যারা ফল দেয়, শোবার জন্য এখনও আছে কত মুক্ত স্থান, গাছের ছায়া, পর্বতের গুহা। কিন্তু এই অকিঞ্চন ভাল-বৈরাগ্যের যে চেহারা— এটা সত্ত্বগুণের চেহারা এবং সত্ত্বগুণের এই চেহারার সঙ্গে সবচেয়ে মিল হয় তমোগুণী মানুষের। তফাত শুধু এক জায়গায়। সত্ত্বগুণী বৈরাগীর হৃদয় সদা-সন্তুষ্ট আর তমোগুণী মানুষ সদাই অলস, নিষ্ক্রিয়, অথচ ভোগের ইচ্ছার কোনও কমতি নেই। এরাই দৈবজ্ঞ, জ্যোতিষী আর ভাগ্য জানার আশপাশে মত্ত থাকে। এঁদের উদ্দেশেই বিবেকানন্দ বলেছিলেন— তোর গীতা পড়ার দরকার নেই, তুই ফুটবল খেলার চেষ্টা কর। অর্থাৎ এই সব মানুষের অলস তমোগুণ থেকে কর্মতৎপর রজোগুণে উত্তরণ দরকার।

একথা আমরা মানি যে, বড়লোকের বাড়ির পোষা বেড়াল পরের বাড়িতে মজায় থাকে, আর চরম বলবান হওয়া সত্ত্বেও সিংহকে বনেই বাস করতে হয়। ভাগ্যের এই তফাতটুকু আছেই, কিন্তু নীতিশাস্ত্রকারেরা বলেছেন— বলবান সিংহও যদি মাটিতে হাঁ করে শুয়ে থাকে, তবে হরিণেরা স্বেচ্ছায় তার মুখের মধ্যে এসে ঢুকবে না, সিংহকেও হরিণ ধরার জন্য চেষ্টা করতে হয়, তাকে দৌড়তে হয় বারবার। আবার বেড়ালকে দেখুন, সে যে বাড়িতে থাকে সে বাড়ির খাবার দাবার যতই পাক, তবু তার ছোঁকছোঁকানি যায় না, তবু সে পরের বাড়ির ইলিশ মাছটি খাবার জন্য অন্ধকারে থাবা বাড়ায়। এই বেড়ালগুলোর সঙ্গে তুলনা আসে সেই সব উদ্যমী পুরুষ-নারীদের যাঁরা জীবনে যথেষ্ট পাওয়া সত্ত্বেও আবার জ্যোতিষ দৈবজ্ঞের কাছে ছোটেন। বলেন— দেখুন তো আমার অমুক পদটা হবে কিনা, অমুক প্রমোশন, অমুক অ্যাসাইনমেন্ট, অমুক প্রজেক্ট।

দুনিয়ার এই হালচাল দেখে আমরা বড় বিভ্রান্ত বোধ করি। যার অনেক আছে, সে আরও চাইতে থাক এবং আরও পেতেও থাক। যেদিন এদের ক্রমিক পাওনায় বাধা পড়বে, সেদিন এরা বুঝবে চাওয়ার কোনও শেষ নেই। সেদিনের জন্য তাদের সবচেয়ে বড় পাওনা রইল ‘ফ্রাসটেশন’। কিন্তু এদের নিয়ে আমরা বিব্রত নই একটুও। আমার ভাবনা তাদের নিয়ে— যারা চেষ্টা ছেড়ে ভাগ্যের ওপর বসে রইল। কবি লিখেছেন— পৌরুষ, পুরুষকার, চেষ্টা, সাহস বাদ দিয়ে যারা দৈবের অপেক্ষায় বসে রইল আর গণক দিয়ে হাত দেখাল, তাদের অবস্থা অনেকটা বড়লোকের বড় বাড়ির বাইরে বসা মাটি আর সিমেন্টের তৈরি সিংহের মতো। তাদের মাথায় কাকও বসতে ভয় পায় না, বরঞ্চ নির্ভয়ে তার মাথায় মলত্যাগ করে— প্রাসাদ-সিংহবত্তস্য মূধ্যি তিষ্ঠন্তি বায়সাঃ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন