পুরোহিত বনাম পুরুত

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

বহুমানিত শব্দ যখন মহাকালের বেত্রাঘাতে অপশব্দের রূপ ধারণ করে, তখন সেটার পূর্বগরিমার কথা স্মরণে আসে না। ‘ভাতার’ কথাটা যেকালে সম্পূর্ণ ভরণ করার মহিমায় ‘ভর্তা’ ছিল, তখন স্ত্রীর মুখে এমনই স্বরক্ষেপ শোনা যেত— আবার যদি জন্ম লাভ করি এই পৃথিবীতে, তাহলে তুমিই যেন আমার ভর্তা হও— ত্বমেব ভর্তা ন চ বিপ্রযোগঃ— যেন তোমায় ছাড়া না জন্মাই আমি। কিন্তু ভর্তা যদি কালবশে ‘ভাতার’ হন, তাহলে তার শব্দক্ষেপ, স্বরক্ষেপ, এমনকি ভাবক্ষেপণও অন্যরকম হবে। অর্থাৎ একটি শব্দের অপভ্রষ্ট রূপ ভাবও পরিবর্তন করে দেয়। আমাদের পুরুত-মশাই যখন পুরোহিত ছিলেন, তখন তাঁর মর্যাদা, তাঁর গাম্ভীর্য, তাঁর মন্ত্র এবং মন্ত্রণার শক্তি ছিল এতটাই যে, বড় বড় রাজারাও তাঁদের মাথায় করে রাখতেন।

এখানে অবশ্য সমালোচনার জায়গা আছে একটা। পণ্ডিতরা বলেন— তৎকালীন ব্রাহ্মণরা অনেকেই খুব বিদ্বান-বুদ্ধিমান ছিলেন, সেই বিদ্যা-বুদ্ধির সঙ্গে যাগ-যজ্ঞ এবং অনেক ধর্মীয় অঙ্গ জুড়ে যাওয়ায় তাঁদের আধিপত্য তৈরি হয়ে যায় যুদ্ধজীবী ক্ষত্রিয় এবং রাজা-রাজড়াদের ওপর। এমন পণ্ডিতও আছেন যাঁরা বলেন— বিদ্যাবুদ্ধির থেকেও যাগ-যজ্ঞের ‘ম্যাজিক’ যে পুরোহিত-তন্ত্র গড়ে তুলেছিল, তার ফলেই সমাজে যত শাসন-শোষণ তৈরি হয়েছে! আমরা অবশ্য এটা মানি না পুরোপুরি। বৈদিক গ্রন্থগুলি তথা রামায়ণ-মহাভারত থেকে যা প্রমাণ আসে, তাতে প্রধানত বিদ্যা এবং তদুচিত বুদ্ধির জোরেই রাজসভায় পুরোহিতের পদ তৈরি হয়। এটাও ঠিক যে, বিদ্যা-বুদ্ধির সঙ্গে ক্ষাত্র-শক্তির সংঘর্ষও তৈরি হয়েছে বারবার, যেমন বশিষ্ঠের সঙ্গে বিশ্বামিত্রের সংঘর্ষ বেদের আমল থেকে রামায়ণ-মহাভারতের কাল পর্যন্ত চর্চিত, তেমনই চর্চিত পরশুরামের সঙ্গে কার্তবীর্য অর্জুনের সংঘর্ষ। কিন্তু শেষপর্যন্ত জিতেছে ব্রাহ্মণ্য, জিতেছে পুরোহিত। শেষপর্যন্ত যত রাজনীতি-অর্থনীতির গ্রন্থ সেখানে সব জায়গায় নির্দেশ জারি করা হল— সর্ব বিদ্যায় বিশারদ একজন পুরোহিতকে রাজা নিয়োগ করবেন রাজা হবার পরেই— পুরোহিতষ্ণ কুর্বীত সর্বশাস্ত্র বিশারদম।

বস্তুত রাজার যিনি পুরোহিত হতেন, সেই রাজপুরোহিতের মর্যাদা রাজমন্ত্রীদের সমান ছিল। অনেক সময়েই তাঁরা মন্ত্রীদের মতো বেতনভোগী ছিলেন, যদিও এই বেতনের ইঙ্গিত যেখানে দেওয়া হয়েছে, সেই কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে কিন্তু এটাও দেখা যাচ্ছে যে, মন্ত্রী-নিয়োগের সময় রাজা পুরোহিতের সাহায্য নেবেন। এই যে মাইনে করা বিদ্বান বুদ্ধিমান পুরোহিত— এঁরা ছাড়াও একদল বিশাল ব্যক্তিত্বের নাম পাওয়া যাবে রামায়ণ-মহাভারতে যাঁরা অনেকেই মহর্ষি, বিপ্রর্ষি, ব্রহ্মর্ষি। বিদ্যা-বুদ্ধি তো বটেই, তাঁদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং বৈরাগ্য এমন পর্যায়ের ছিল, যাঁরা মাথার ওপর থাকলে সে-কালের রাজারা ধন্য বোধ করতেন।

রামায়ণের বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, কিংবা মহাভারতের ধৌম্য পুরোহিত এই জাতের পুরোহিত। ভরত দৌষ্মন্তির পুরোহিত কণ্বমুনি এই জাতের পুরোহিত। আর একজনের কথা না বললেই নয়। তিনি আমাদের মহাবৈয়াকরণ পতঞ্জলি। পাণিনির ব্যাকরণটাকে যিনি অসামান্য চাতুর্যে আমাদের কাছে বোধ্য করে তুলেছিলেন— সংস্কৃত ভাষা-গঠনে যাঁর অবদান স্মরণ করে দেশী-বিদেশী সমস্ত গবেষকরা যেখানে আশ্চর্য স্তম্ভিত হয়ে যান, সেই মহাভাষ্যকার পতঞ্জলিও কিন্তু পুষ্যমিত্র শুঙ্গের পুরোহিত ছিলেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাঁকে প্রমাণ করা যায়। নিজের লেখা মহাভাষ্যেই একটি পাণিনি-সূত্রের উদাহরণে তিনি লিখছেন— আমরা এই রাজ্যেই থাকি, এখানেই পড়াশোনা করি, আমরা পুষ্যমিত্রের যজ্ঞে যাজনের কর্ম করি।

সেকালের ব্রাহ্মণ্য-ক্ষত্রিয়ের অতিঘনিষ্ঠ সংস্রব থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, পুরোহিতরা শুধু রাজার যজন-যাজনই করতেন না, তাঁরা রাজনীতিতে রীতিমতো অংশ নিতেন, পররাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ধি-বিগ্রহের ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতেন, এমনকি যুদ্ধের সময়েও তাঁদের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট। কিন্তু পুরোহিতের পদমর্যাদার গৌরবের অবনমন ঘটতে আরম্ভ করল সেইদিন থেকে, যেদিন থেকে রাজপুরোহিতের পদ বংশানুক্রমিকতায় ধরে রাখার চেষ্টা হল। এই প্রবণতা শেষ বৈদিক কাল থেকেই আরম্ভ হয়েছিল এবং তা রামায়ণ-মহাভারতের আমলেই বেশ বড়ো চেহারা নিয়ে নেয়। একটা সংঘর্ষ বাধতে থাকে বৈরাগ্যবান অযাচক বৃত্তি ব্রাহ্মণের সঙ্গে যাজক এবং রাজবৃত্তিকামী পুরোহিতদের। খোদ ঋগবেদের মধ্যে ঐলূষ কবষ ঋষি, যিনি বেদের অন্যতম মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি, তিনি কুরুশ্রবণ রাজার কাছে যাচনা করে বলেছিলেন— আমি আপনার পিতার অনুগত মানুষ, তাঁর বন্দনা করেছি আমি— পিতুস্তে অস্মি বন্দিতা। তিনি সহস্র সংখ্যায় দক্ষিণা দিতেন আমাকে, সকলে তখন আমার স্তবস্তুতি করত, আমি রথে উঠলে তিনটে ঘোড়া আমার রথ টানত— তিস্ত্রো বহন্তি সাধুয়া। স্তবৈ সহস্রদক্ষিণে।

কবষ রাজা এসদস্যুর গুণ-গান করে এখন তাঁর পুত্র কুরুশ্রবণের কাছে সেই পদ যাচনা করছেন, যা এতদিন তাঁর পিতার কাছে পেয়েছিলেন। রাজ-পরম্পরায় যখন এই পৌরোহিত্যের প্রার্থনা করছেন ঋষি, তেমনই আপন বংশ পরম্পরাতেও পুরোহিত হতে চাইতেন রাজার পরে অন্য রাজার। বংশানুক্রমে এই যাচনাই কিন্তু পরবর্তীকালে পৌরোহিত্যের মহাকাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৌরোহিত্যের এই সোপান-পংক্তি সম্রাট অশোক ভেঙে দেন, তিনি পুরোহিতের পদটাই তুলে দেন। কিন্তু অশোকের পর বৌদ্ধতন্ত্রের ওপর ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র আবার ফিরে আসে শুঙ্গ রাজাদের আমলেই এবং পুষ্যমিত্র শুঙ্গ যজ্ঞাদি কর্মের জন্য মহাভাষ্যকার পতঞ্জলিকেই নিয়োগ করেছিলেন।

রাজার ঘরে যা হয়েছে, সাধারণ মানুষের ঘরে তার চারগুণ যাতনা বেড়েছে এই পরম্পরায়। ব্রাহ্মণই হোন আর ক্ষত্রিয়ই হোন, পরম্পরা-বাহিত প্রত্যেকটি মানুষই তো ভালো হন না সব সময়। ফলে ব্রাহ্মণের এই স্বার্থৈষণা যখন পৌরোহিত্যের মধ্যে সংক্রমিত হল, তখন থেকেই কুল-পুরোহিত, কুল-যাজক ইত্যাদি শব্দও সামাজিক মানুষের ধর্মভাবনার মধ্যে প্রোথিত হল। যে পুরোহিত সার্ববর্ণিক মানুষের জন্ম-কর্ম-বিবাহ থেকে অন্ত্যেষ্টি-শ্রাদ্ধের মতো সংস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে গেল, তখন এই পৌরোহিত্যের মধ্যে যাচনার বৃত্তি তৈরি হয়ে গেল। পুরোহিত আস্তে আস্তে পুরুতে পরিণত হলেন। মহাভারত-মনুর সময় থেকেই মন্দিরের পুরোহিত (দেবলোক), নক্ষত্র-যাজক, শ্মশান-যাজক যেমন নিম্ন-নিম্নতর স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তেমনই সাধারণ পুরোহিতও যাচনার বৃত্তি গ্রহণ করায় সমাজের চোখে তার প্রাচীন গৌরব হারিয়ে ফেলেন। পুরোহিত হয়ে ওঠেন পুরুত কিংবা বামুন ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—

কোনো সম্মান বিনা মূল্যের নহে। যথেচ্ছ কাজ করিয়া সম্মান রাখা যায় না। যে রাজা সিংহাসনে বসেন তিনি দোকান খুলিয়া ব্যবসা চালাইতে পারেন না। সম্মান যাঁহার প্রাপ্য তাঁহাকেই সকল দিকে সর্বদা নিজের ইচ্ছাকে খর্ব করিয়া চলিতে হয়। গৃহের অন্যান্য লোকের অপেক্ষা আমাদের দেশে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীকেই সাংসারিক বিষয়ে অধিক বঞ্চিত হইতে হয়— বাড়ির গৃহিণীই সকলের শেষে অন্ন পান। ইহা না হইলে আত্মম্ভরিতার উপর কর্তৃত্বকে দীর্ঘকাল রক্ষা করা যায় না। সম্মানও পাইবে, অথচ তাহার কোনও মূল্য দিবে না, ইহা কখনোই চিরদিন সহ্য হয় না।

আমাদের আধুনিক ব্রাহ্মণেরা বিনা মূল্যে সম্মান আদায়ের বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছিলেন। তাহাতে তাঁহাদের সম্মান আমাদের সমাজে উত্তরোত্তর মৌখিক হইয়া আসিয়াছে। কেবল তাহাই নয়; ব্রাহ্মণেরা সমাজের যে উচ্চকর্মে নিযুক্ত ছিলেন সে কর্মে শৈথিল্য ঘটাতে, সমাজেরও সন্ধিবন্ধন প্রতিদিন বিশ্লিষ্ট হইয়া আসিয়াছে।

পুরোহিত যেদিন তাঁর বিদ্যা-ব্রাহ্মণ্য এবং ত্যাগবৃত্তি পরিত্যাগ করে যজন-যাজনের জন্য যাচনার বৃত্তি গ্রহণ করল, সেদিন তাঁর সম্বন্ধে এই ব্যঙ্গ তৈরি হল যে, পুরীষ-শব্দের ‘পু’, রোষ-শব্দের ‘রো’, হিংসা-শব্দের ‘হি’ এবং তস্কর-শব্দের ‘ত’ দিয়ে পুরোহিত শব্দ তৈরি হয়েছে— আদ্যাক্ষরনি সংগৃহ্য বেধাশ্চক্রে পুরোহিতম।

এতদিনে আমাদের পুরুতমশাইরা বোধহয় নিজের ভুল কিছু শুধরেছেন। তা নইলে দুর্গাপূজার আগে এখন তাঁদের ট্রেনিং দেখছি কেন? মন্ত্রোচ্চারণ থেকে অযাচকতা— সব কিছুরই এখন ট্রেনিং প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।  

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন