সূর্যমুখী – অর্পিতা সরকার

অর্পিতা সরকার

বাইকের স্পিডটা আরেকটু বাড়িয়ে সিঞ্চন চেঁচিয়ে বলল, বহ্নি তোমার ওই পুরুষালি বান্ধবীটার সঙ্গে একটু মেলামেশাটা কম করো তো! মেয়েটাকে দেখলে আমার কেমন একটা বিরক্ত লাগে। বার্গেন্ডি কালারের চুল, হাতে বালা, ছেঁড়া ফাটা জিন্স – অদ্ভুত লুক্স। মেয়েসুলভ কোনো কমনীয়তা নেই।

বহ্নি হেসে বলল, কে বিপস?

হ্যাঁ ওই বিপাশা।

নামটাও যেন কেমন! বিপাশা থেকে বিপস। আমি তো বুঝতে পারি না বহ্নি তোমার মতো সংস্কৃতিমনস্ক, রুচিশীল মেয়ের এমন একজন বান্ধবী হয় কী করে?

বহ্নির হলদে ওড়নাটা হাওয়ায় উড়ছে। একরাশ বসন্ত বাতাস এসে কানে কানে যেন বলছে…ভালোবাসি। বহ্নি আরেকটু ঘন হয়ে বসল সিঞ্চনের কাছে। সিঞ্চনের কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, আমি তো ওরকম নই তাই না?

সিঞ্চন বাইকের স্পিডটা কমিয়ে বলল, নও বলেই তো তোমার সঙ্গে আমার আলাপ হল দীর্ঘস্থায়ী।

আজ সিঞ্চন আর বহ্নির সেকেন্ড মিট।

প্রথম দেখাটা হয়েছিল একটা কফি শপে।

সেদিন দুজনেই বিশেষ কথা বলতে পারেনি। ফেসবুকের মাধ্যমেই ওদের পরিচয়। একটা সাহিত্য চর্চার গ্রুপে টুকিটাকি কবিতা লিখতো সিঞ্চন। সেখানেই কমেন্ট করতো বহ্নি। সিঞ্চনের লেখা একটা কবিতা পাঠও করেছে বহ্নি। তার থেকেই আলাপের সূত্রপাত। গত পাঁচমাস হোয়াটসআপ ও ফোনে কথা বলার পরে গত সপ্তাহে ওদের ফার্স্ট মিট ছিল। বিপসকে সঙ্গে করে এনেছিল বহ্নি। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কাউকে বিশ্বাস করে একা চলে আসতে একটু ভয় পেয়েছিল বহ্নি। বিপস ওর সেই প্রাইমারি বেলার বান্ধবী। দুজনের স্বভাব সম্পূর্ণ আলাদা হলেও একই পাড়ায় বাড়ি বলেই বন্ধুত্বটা রয়ে গেছে।

বিপসকে যে মোটেই পছন্দ করেনি সিঞ্চন সেটা ওর মুখভঙ্গিমা দেখেই বুঝেছিল বহ্নি। শুধু বহ্নি নয়, বিপসও বোধহয় বুঝেছিল। তাই মিনিট দশেক পরেই কফির কাপটা শেষ করে আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, তোমরা কথা বলো আমার একটা কাজ আছে। আজ আসি সিঞ্চনদা। পরে আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে। বিপস চলে যেতে বেশ জোরেই একটা নিশ্বাস ফেলেছিল সিঞ্চন। মুখে বলেছিল, বললে না তো আমাদের বন্ধুত্বটা ভার্চুয়াল ওয়ার্লের বাইরেও চিরস্থায়ী হবে কিনা! সিঞ্চনের ভদ্র ব্যবহার, আবেগী কথার সুরে ভেসে গিয়েছিল বহ্নি।

ঘাড় নেড়ে লাজুক মুখে বলেছিল, অনুভূতিগুলো দীর্ঘস্থায়ী হলেই বন্ধুত্বও স্থায়িত্ব পাবে।

সিঞ্চন বলেছিল, তোমায় যদি কেউ বলে তুমি কেমন জীবনসঙ্গী চাও তবে কী বলবে তুমি বহ্নি?

বহ্নি আরেকটু লজ্জিত হয়ে বলেছিল, যে আমাকে বুঝবে…যে আমার অনুভূতিগুলোর মূল্য দেবে এমন কেউ।

সিঞ্চন নরম গলায় বলেছিল, যদি কখনও এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই তাহলে জানিও কিন্তু।

পাশ দিয়ে দুটো মালবোঝাই লরি জান্তব আওয়াজ তুলে পেরিয়ে গেল।

এই বহ্নি, কথা বলছ না কেন?

আচমকা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বহ্নি বলল, প্রথম দিনের তোমার বলা কথাগুলো মনে পড়ছিল সিঞ্চন।

সিঞ্চন হেসে বলল, প্রথম দিনকে মনে করতে গিয়ে আজকের দিনে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছ? তাহলে কি আমি এক্সাম হল অবধি পৌঁছাতে পেরেছি?

বহ্নি হেসে বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন সিঞ্চন?

সিঞ্চন বাইকের স্পিডটা সামান্য বাড়িয়ে বলল, নাম না জানা ঠিকানায়। দেখো এই রাস্তা ধরে অনেকক্ষণ যাব, যতক্ষণ পর্যন্ত না ক্লান্ত হই। তারপর কোনো ধাবায় বসে খাওয়া-দাওয়া করে আবার ফিরব। নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্যস্থল নেই।

বহ্নি সদ্য মাস্টার্স কমপ্লিট করে বিএড এ ভর্তি হয়েছে। সিঞ্চন রেলে জব পেয়েছে বছর দুয়েক।

ওদের এখন অনেক গল্প। দুজনের দুজনকে বুঝে নেওয়ার গল্প, দুজনের দুজনকে চিনে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

শহর থেকে একটু দূরে একটা ধাবায় বসল ওরা। চায়ের অর্ডার দিয়ে সিঞ্চন বলল, বহ্নি একটা সত্যি কথা বলবে? জাস্ট কৌতূহল…আমি কি তোমার ফার্স্ট লাভ?

ইচ্ছে না হলে উত্তর নাও দিতে পার। তবে বললে সত্যিটুকু শুনতে চাই।

বহ্নি একটু ইতস্তত করে বলল, মানে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না একতরফা ভালোবাসাটাকে কাউন্ট করা উচিত কিনা!

আসলে আমি যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি তখনই আমাদের পাড়ারই একটি ছেলে আমায় প্রোপোজ করেছিল। আমি জানতাম ইন্দ্র আমায় ভালোবাসে।

সিঞ্চন চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আর তুমি? তোমার কোনো সফট কর্ণার তৈরি হয়নি কখনো?

বহ্নি লজ্জিত মুখে বলল, একেবারে হয়নি বলি কি করে! কিন্তু ইন্দ্রকে আমাদের বাড়িতে মেনে নেবে না বুঝেই আমি আগ্রহ দেখাইনি। ইন্দ্র বহুদিন পর্যন্ত একতরফা ভালোবেসে গেছে আমায়। কিন্তু আমার দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সরে গেছে আস্তে আস্তে।

সিঞ্চন মুচকি হেসে বলল, না এটাকে ঠিক কাউন্ট করতে পারলাম না। তার মানে আমিই ফার্স্ট লাভ।

বহ্নি মজার ছলে বলল, আমি কি তৃতীয় চতুর্থ নম্বরে আছি তোমার লিস্টে?

সিঞ্চন একটু ভেবে বলল, বুঝলে বহ্নি আমিও একজনকে ভালোবাসতাম। হয়তো একটু বেশিই ভালোবাসতাম। সেও বাসত। কিন্তু সমস্যা হল আমাদের দুজনের রুচির বেজায় ফারাক। তাই ওই তর্ক-বিতর্ক হতে হতে ক্রমশ মরচে ধরে যেতে লাগল ভালোবাসার বারান্দার কার্নিশে। জং ধরে গেল দরজা-জানালায়।

অভিমান, অনুযোগের সুরগুলো বদলে গেল দোষারোপের সুরে। সেই ছোট্ট ছোট্ট পাওয়ার আনন্দটা গেল হারিয়ে। তাই আর অকারণে সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যাওয়া লাটাইটা আঁকড়ে বসে না থেকে দুজনেই দুজনকে মুক্তি দিলাম বলতে পার। আমার প্রেমিকা লোপামুদ্রা এখন অন্য একজনের প্রেমিকা।

বহ্নি অপলক তাকিয়ে বলল, খোঁজ নাও লোপামুদ্রার?

সিঞ্চন হেসে বলল, রাগ করলে?

বহ্নি বলল, উঁহু শুধু একটু চিরচিরে হিংসা হল বলতে পার।

সিঞ্চন বললো, না গো লোপার খোঁজ আর নেওয়া হয় না। ভালো থাকুক ও। শুনেছি অনেকের কাছেই ও বলেছে, আমি নাকি ওর ভালোবাসার যোগ্য ছিলাম না। বড়ই এলোমেলো। জীবন সম্পর্কে উদাসীন। সে বলুক, আমি চাই লোপা ভালো থাকুক। গুছিয়ে নিক নিজের জীবনটাকে।

বহ্নি বলল, প্রেমে আঘাত পাওয়ার পর শুনেছি দ্বিতীয় প্রেমে মানুষ ভয় পায়? তুমি ভয় পাচ্ছ না তো সিঞ্চন?

সিঞ্চন আলগোছে বলল, না বহ্নি ভয় পাইনি, তবে এবার হারালে দুঃখ পাবো বইকি। জানি না কেন, তোমার সঙ্গে চ্যাট করতে করতেই মনে হয়েছিল আমাদের রুচির মিল আছে। আমাদের দুজনেরই কবিতা পছন্দের। কবিগুরুর গানে আমরা হারিয়ে যেতে পারি বহুদূরে।

বহ্নি হেসে বলল, আরেকটা মিল আছে সিঞ্চন…সম্পর্কের কাছে সৎ থাকতে পছন্দ করি। তাই তো তুমি লোপামুদ্রার কথা আমায় বলে দিলে উজাড় করে।

আচ্ছা বহ্নি বললে না তো, লোপার কথা শোনার সময় কেন তোমার জেলাস ফিল হচ্ছিল?

বহ্নি বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, ফিরতে হবে। চলো…সূর্যও বাড়ির পথ ধরেছে।

বাইকে উঠেই সিঞ্চন বলল, আমি শুনেছি ভালোবাসা নাকি পজেসিভ হয়। মানে ভালোবাসার নিজস্ব ধর্ম এটা। তবে কি পজেসিভনেস থেকেই জেলাসের উৎপত্তি!

বহ্নি লাজুক গলায় বলল, জানি না যাও।

জানো বহ্নি লোকে বলে ভালোবাসা শর্ত দিয়ে হয় না। আমিও তোমায় কোনো শর্ত দিচ্ছি না। তবে একটাই কথা বলব, তোমার চারপাশে যেসব মানুষদের মানায় না তাদের থেকে একটু দূরে থাকো।

বহ্নি বেশ বুঝতে পারল সিঞ্চন ইঙ্গিতে বিপসকে বোঝাতে চাইল। আসলে বহ্নি ঠিক কীভাবে বিপসকে এড়িয়ে চলবে সেটাই তো বুঝতে পারছে না! বিপস বোধহয় বহ্নিকে সব থেকে বেশি বোঝে। বহ্নি একটু ভিতু স্বভাবের ছিল সেই স্কুল থেকেই। তখন থেকেই বিপস ওর অলিখিত অভিভাবক। স্কুলে ওকে সমস্ত লেগপুলিং থেকে বাঁচাত বিপস। এখনও মুভি দেখতে যাওয়া থেকে শপিং সবকিছুর সঙ্গী বিপস।

আসলে বিপস ওকে ভীষণ ভালোবাসে। ওর বাইরেটা এমন রুক্ষ হলে কী হবে, ভিতরটা বড্ড নরম। সেই নরম জায়গায় বহ্নি বসে আছে সেই স্কুলবেলা থেকে।

বিপস সকলের থেকে আলাদা। সকলে যখন মাস্টার্সের পরে বিএড করতে গেল তখন ও পড়াশোনায় ইতি করে দিল। এগ্রিকালচার নিয়ে মাস্টার্স শেষ করেই মাথায় ভূতটা চাপল। ওর ঠাকুমার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে রীতিমত হাতে কোদাল নিয়ে জমিতে চাষ করতে লেগে গেল। ওর বাবা-মা পর্যন্ত বিরক্ত মেয়ের এই কাজে। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই ওর। প্রায় মাস দুয়েক বিপস আর কলকাতামুখী হল না। যখন এল তখন বহ্নি দেখে চিনতে পারছিল না। ওর চামড়া রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে।

মুখে অমলিন হাসি। হেসে বলল, এই বহ্নি কালকে আমার গ্রামের বাড়ি বীরপুর যাবি? তোকে দেখাব আমি জমিতে কেমন পটল, ঢেড়শ গাছ বসিয়েছি।

বহ্নি গিয়ে চমকে গিয়েছিল। ওই শহরের রাজকীয় সুখে থাকা মেয়েটা, ঠাকুমার পোড়ো বাড়িটার একটা ঘরকে বাসযোগ্য করে দিব্যি রয়ে গেছে। গোটা পাঁচেক মুনিস নিয়ে কাজ করাচ্ছে জমিতে।

বহ্নি ভয়ে ভয়ে বলেছিল, কাকু বকবে না তোকে?

তুই পড়াশোনা ছেড়ে দিলি, চাকরি করবি না?

পুকুরের ধারের আমবাগানের নীচে একটা বাঁশের মাচায় বসে পা দুলিয়ে বিপাশা বলেছিল, আচ্ছা বহ্নি আমরা যে দিনরাত বলি আমাদের রাজ্য কৃষিপ্রধান…দারুন জলবায়ু, সব চাষ হয়। কিন্তু আমরা কটা শিক্ষিত ছেলেমেয়ে চাষবাস নিয়ে ভাবি বলবি?

সরকারি চাকরির পিছনে বছরের পর বছর সময় নষ্ট না করে নিজেরা যদি অন্য কিছু ভাবি তাহলে মন্দ হবে না। এই যে আমার ঠাকুমার বিঘে দশেক জমি আছে, যেটা ঠাম্মি আমায় দিয়ে গেছে সেটাতে কিন্তু আমি অনেক কিছু করতে পারি জানিস। একটা ছোটখাটো ফার্ম হাউজ গোছের করব ভেবেছি। এখানে বেশ কিছু বেকার ছেলেকে কাজ দেব। পুকুরটাতে মাছ চাষ করব। অনেক প্ল্যান আছে বুঝলি!

একটু ভড়কে গিয়েছিল বহ্নি। ও নিতান্ত সাধারণ মেয়ে। গান, কবিতা করে। পড়াশোনাতে মন্দ নয়। পড়াশোনা কমপ্লিট করে একটা চাকরির চেষ্টা করবে এমনই ভাবনা আছে ওর।

এসব অবান্তর ভাবনা একমাত্র বিপাশার মাথাতেই আসতে পারে।

বিপাশা ওর জমির নরম সবজে চারাগুলোতে হাত বুলিয়ে বলেছিল, কান পেতে শোন ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। জানিস মাটির বুক চিরে যখন ট্রাক্টরের ফালগুলো ঢুকছিল তখন আমি স্পষ্ট শুনলাম, মাটি আমার কাছে জল চাইছিল। বড্ড শুকিয়ে গিয়েছিল ওর গলা।

আমি পাইপ দিয়ে জল দিতেই হেসে উঠল মাটি।

বরাবরই ক্লাসের সকলে বিপসকে পাগলা বলত। ওর এসব বেহিসেবি এলোমেলো কথার জন্য।

ক্লাসে সকলে যখন বলত, বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হব তখন ও উদাস গলায় বলত, বড় হয়ে স্বাধীন হব। নিজের খেয়াল মত বাঁচব।

বিপস বরাবরই পড়াশোনায় ভালো। তাই সকলেই ভেবেছিল ও হয়তো সত্যিই একটা ভালো জায়গায় যাবে। শেষপর্যন্ত ঠাম্মির জমিতে চাষবাস করবে ও! ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল বহ্নির।

মাটির ভাঁড়টা ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বিপস বলল, বহ্নি এই কাপে যদি একটা করে শব্দ লেখা থাকত ব্যাপারটা কিন্তু অন্য লেভেলের হয়ে যেত। মানে ধর বাঙালি তো কাশির ওষুধ থেকে মাথা ধরার ওষুধ, মুড অফ অন করার দায়িত্বও চা-কেই অর্পণ করেছে তাই ভাবছি চায়ের ভাঁড়টাকে যদি একটু আর্টিস্টিক করা যায় আরকি!

বহ্নির কৌতূহলী চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, যেমন ধর লেখা থাকল— তৃষ্ণা অথবা তৃষা অথবা পিপাসা এই টাইপ আরকি।

বহ্নি বেশ বুঝেছিল, মাথার যে দু-চারটে স্ক্রু টাইট ছিল সেগুলোও ঢিলা হয়ে গেছে।

বিপস যেন কেমন! সমাজের কে কী ভাবল, কেন ভাবল, ওকে নিয়ে কী গসিপ করল এসবে ওর কোনো মনোযোগ নেই। বরং যখন যা ইচ্ছে হল সেই মতো চলাই যেন লক্ষ্য। আচমকা মাস খানেক আগে চুলের রং করে এসে হাজির। বলল, বহ্নি দেখত আমাকে কি বেগনভেলিয়া গাছের মতো লাগছে?

একমুখ নির্মল হাসি নিয়ে বলেছিল বিপস। বহ্নির বরাবরই বিপাশার এই উদ্ভট কাজকর্মগুলো ভালো লাগে না। ভালো লাগে না ওর সাজপোশাক বা কথা বলার ধরন। তবুও ওই ছোটবেলার বন্ধু বলেই বিপাশা রয়ে গেছে ওর জীবনে। আর তাছাড়া বিপাশার মনটা ভালো, এটা অবশ্য জানে বহ্নি।

সিঞ্চন বাইকটা থামিয়ে বলল, কী হল এমন চুপচাপ হয়ে গেলে যে! ভাবনার জগতে বিচরণ করছ না ঘুমিয়ে গেলে দেখব বলেই বাইক থামালাম।

বহ্নি তুমি যে বলেছিলে তোমার বাবা ভীষণ রকমের রাগী মানুষ, একবারে মহব্বতের অমিতাভ বচ্চন টাইপ, তাহলে আমাদের প্রেমটা ভদ্রলোক মেনে নেবেন তো? নাকি কোনো একদিন তুমি এসে বলবে, সিঞ্চন ভালো থেকো, আমাকে ভুলে যেও। আমার বাবা কিছুতেই এই সম্পর্কটা মেনে নিলেন না.. ইত্যাদি, প্রভৃতি…

আসলে কী জানো বহ্নি ঘরপোড়া গরু তো তাই সম্পর্কের ভাঙনে বড্ড ভয় পাই। সম্পর্কটা যখন তৈরি হয় তখন আরেকজনের কিছু ভালোলাগা, কিছু অভ্যেস ধীরে ধীরে অন্যের মধ্যেও চলে আসে। পরবর্তীকালে সম্পর্ক ভেঙে গেলেও ওই পুরোনো অভ্যেসগুলো রয়ে যায় নিজের মধ্যে। তখন বড্ড কষ্ট হয় বুঝলে! তাই ভালোবাসাটা চূড়ান্ত গভীরতা পাওয়ার আগে একটু জেনে নিচ্ছি আরকি! এরপরেও ভেঙে গেলে আমরা দুজনেই অপারগ ছিলাম ভাবতে হবে ঠিকই। তবে আগে থেকে যেটুকু চেনা যায় সেটকুর চেষ্টা চালাচ্ছি।

বহ্নি একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সত্যিই বহ্নির বাবা অভিজাত্যে বিশ্বাসী। বাবার বেশ কতগুলো অযৌক্তিক ট্যাবু আছে। প্রেম করে বিয়ে করলে নাকি বংশের সম্মানহানি হয়। বাবারও বিপাশাকে অপছন্দ। ওর পোশাক, ওর এমন স্বাধীনচেতা মানসিকতা বহ্নির বাবার পছন্দ নয়। কিন্তু বহ্নির কোথাও যেন মনে হয় ও যদি পারতো বিপস হতে…যদি…

বহ্নি একটু ভেবে উত্তর দিল, সিঞ্চন ভালোবাসা কি কোনো অঙ্ক? যোগবিয়োগ করে কি হয়? নাকি ভাগফল শূন্য হবে আগে থেকেই জানা সম্ভব! তবে আমার যতদিন না পড়াশোনা কমপ্লিট হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত বাড়িতে আমাদের সম্পর্কের কথা না জানাই ভালো। আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরে বাবাকে বললে, আশা করি বাবা নিমরাজি হবে।

সিঞ্চন বলল, বহ্নি তোমার সবটা আমার বড্ড প্রিয়। এই যে মেয়েদের এই লাজুক লাজুক স্বভাব… এই চুড়িদার বা শাড়ি পরার স্টাইল। এই নিচু গলায় মিষ্টি করে কথা বলা সবটা…

আমার স্বীকার করতে বাধা নেই, তুমিই আমায় স্বপ্নচারিনী ছিলে। বহ্নি চোখ নিচু করে নিল। গালে এক মুঠো আবিরের ছোঁয়া।

সিঞ্চন বলল, তোমার ওই বান্ধবীর মতো মেয়েদের আমি অসম্মান করছি না, কিন্তু আমার পছন্দের নয় এরা। তুমি যেন কখনও ওই স্বভাবের হয়ে যেও না প্লিজ।

বহ্নি বলল, সিঞ্চন ও আমার সেই প্রাইমারি বেলার বান্ধবী। এতদিনে যদি স্বভাব পালটানো যেত তাহলে আমি বিপস আর বিপস বহ্নি হয়ে যেতো তাই না!

হইনি যখন তখন আর হব না।

তবে বিপসের মনটা কিন্তু খুব ভালো।

সিঞ্চন হেসে বলল, তাই নাকি!

তা তোমার বিপস কী করে এখন? পড়াশোনা?

বহ্নি একটু ইতস্তত করে বলল, না চাষবাস করছে। কীসব ফার্ম হাউজ বানানোর পরিকল্পনা করছে। কোন জমিতে কী চাষ ভালো হবে তার ওপরে পড়াশোনা করছে।

সিঞ্চন হেসে বলল, তাহলেই বোঝো। এই বয়েসে কেরিয়ারের চিন্তা না করে আজেবাজে সময় নষ্ট করছে। এর সঙ্গে একটু কম মিশবে তুমি বহ্নি।

বহ্নির বাবা-মাও এতদিন একই কথা বলেছে, বিপস মোটেই ভালো মেয়ে নয়। আজ সিঞ্চনও একই কথা বলল। এরপরে বহ্নিকে সত্যিই ভাবতে হবে। কিন্তু বিপসকে এড়িয়ে যাবে কি করে!

সিঞ্চন কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ভালোবাসা শব্দের অনেক দায়িত্ব। আমি একটু একটু করে গুছিয়ে নেব। এবার থেকে তোমার সব রকমের সমস্যায় আমায় ডাকবে বহ্নি। আমি ট্রাই করব তোমার দায়িত্ব নিতে।

বহতা নদীর ওপর দিয়ে ওদের পালতোলা নৌকাটা প্রেমের হাল বেয়ে মসৃণ ভাবেই চলছিল।

বহ্নির সবটুকুকে আগলে রেখেছিল সিঞ্চন।

বিপসের সঙ্গে এখন আর শপিংয়ে যাওয়া হয় না। মুভি দেখাও হয় না। বিপস ফোন করলেও টুকিটাকি কথা বলে দায়সারা রেখে দেয় বহ্নি। সিঞ্চন মোটে পছন্দ করে না ওকে।

বিপসও ইদানিং আর কল করে না ওকে। আচমকা মেয়েটা যেন গায়েব হয়ে গেল পাড়া থেকে। রোজ সকালে বিপসের বাইকের আওয়াজ পেত বহ্নি। না স্কুটি নয়, বাইক চালায় বিপস। মোড়ের মাথায় বেশ একটা জোরে হর্ন বাজায় ও।

বেশ কয়েকদিন ধরে সেই হর্ন শুনতে পায়নি বহ্নি।

বিএড এর প্রেশার, সপ্তাহে অন্তত দুদিন সিঞ্চনের সঙ্গে দেখা করা…নিজের কবিতা চর্চা সবকিছু মিলিয়ে বড্ড সুখী বহ্নি।

আসলে সিঞ্চনের মতো জীবনসঙ্গী বোধহয় সব মেয়েরই কাম্য।

বহ্নির বান্ধবীরা বলে, তোর মতো লাকি কজন আছে? সম্পর্ককে এতটা যত্নে রাখতে কজন জানে বলত?

বহ্নি লজ্জা পায়, বহ্নি গর্বিত হয়।

ওর আর সিঞ্চনের সম্পর্কটা দু-বছরে পা রেখেছে। সিঞ্চনের পরিবার ওদের সম্পর্কের কথা জানলেও বহ্নির বাবা-মা এখনও জানে না। বহ্নি আরও কিছুদিন সময় চেয়েছে সিঞ্চনের কাছে। তারপর বাড়িতে জানাবে।

বহ্নি কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছিল। বৈশাখের গরমে গোটা শহর তেতেপুড়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা জল আর লস্যিই একমাত্র ওষুধ এসময়। বিকেল চারটে থেকে আকাশ থমথমে হয়ে আছে। কালবৈশাখীর পূর্বাভাষ কি না জানে না, তবে ঝড় একটা উঠবে। অন্তত আকাশ সেই কথাই বলছে।

ফোনটা রিসিভ করতেই সিঞ্চন বলল, ঝটপট রেডি হয়ে নাও। মুভির টিকিট কেটেছি। সাড়ে পাঁচটা থেকে শো। বহ্নি একটু দুর্বল গলায় বলল, ফিরতে রাত হলে বাবা কিন্তু বকবে সিঞ্চন।

সিঞ্চন হেসে বলল, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কোনো লোয়ারের বাচ্চার সঙ্গে প্রেম করছি। বাবা বকবে আর বকবে! তুমি আসবে না আমি টিকিট নষ্ট করে ফেলব!

অগত্যা মাকে ভুলভাল বুঝিয়ে মুখ ভারী আকাশকে সাক্ষী রেখেই বেরিয়ে পড়ল বহ্নি।

ট্যাক্সি থেকে নেমেই দেখল, হোয়াইট টি শার্ট পরে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিঞ্চন।

ওকে দেখেই ফিসফিস করে গেয়ে উঠল, কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে তবে আসতে পারলে!

বহ্নি লাজুক হেসে বলল, বোধহয় ঝড় উঠবে।

সিঞ্চন বহ্নির হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি ছিন্ন পালের কাছি, মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছো আমি আছি।

মুভি দেখে বাড়ি ফেরার আগেই তুমুল ঝড়টা উঠল। হলের বাইরে এসেই বহ্নি বুঝতে পারল, ঝড় উঠেছে। ফোনে বাবার গোটা পাঁচেক মিসড কল দেখে ভীত হয়ে বলল, এখন কী হবে সিঞ্চন?

সিঞ্চন বলল, বলো বন্ধুদের সঙ্গে মুভি দেখতে এসেছিলে, ঝড়ে আটকে গেছ, থামলেই ফিরবে।

বাবার গম্ভীর গলা শুনে ভিতরে ভিতরে ভয় করছিল বহ্নির। কেন যে বহ্নি এত ভয় পায় কে জানে! কেন যে ও এত ভীতু…যদিও সিঞ্চন বলে ওর এই ভীরু চাহনিটাই নাকি পাগল করে সিঞ্চনকে।

ফেরার পথে রাস্তা বেশ শুনশান। বাইকটা খুব বেশি জোরে চালাতে পারছে না সিঞ্চন। রাস্তায় রীতিমতো গাছের ডাল পড়ে আছে। যথারীতি লোডশেডিং।

আচমকাই দুটো বাইক এসে ঘিরে ফেলল সিঞ্চনদেরকে। বহ্নিদের পাড়ায় ঢোকার গলির মুখেই ঘটল ঘটনাটা। বহ্নির গলার ওড়নাটা টেনে ধরল একজন। আরেকটু হলেই রাস্তায় ছিটকে পড়ছিল বহ্নি। দুটো ছেলে খুব বাজে ভাষায় কথা বলছিল বহ্নির দিকে তাকিয়ে। মদ্যপ অবস্থায় রয়েছে ছেলেগুলো।

সিঞ্চন একটা গাছের ডাল নিয়ে এগিয়ে যেতেই দুজন এসে আক্রমণ করল বহ্নিকে।

আচমকাই একটা বেল্ট এসে তীরের বেগে লাগল দুটো ছেলের গায়ে। বহ্নি ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখল বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিপস।

বেশ জোরেই বিপাশা বলল, সিঞ্চনদা ওইদিকে একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম। এদেরকে লকাপে ঢোকাতে হবে বুঝলেন।

বিপাশা একটু এগিয়ে গিয়ে পুলিশের গাড়িটাকে ডেকে আনল। যথারীতি ছেলে চারটেকে গাড়িতে টেনে তুলল পুলিশ। একজন অফিসার বললেন, আপনারাও আসুন। অভিযোগটা লেখাবেন।

বহ্নি থমকে দাঁড়িয়ে আছে দেখেই বিপস বলল, কি হল চল, রিপোর্ট লেখাতে হবে। বহ্নি ঠকঠক করে কাঁপছিল, বিপসকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই আমায় বাড়ি পৌঁছে দে প্লিজ। বাবা থানায় গেছি জানতে পারলে আর বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।

বিপাশা সিঞ্চনকে বলল, সিঞ্চনদা তুমি যাও আমি ওকে আমি বাড়ি দিয়ে আসি।

সিঞ্চন অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, বহ্নি তুমি এত বড় একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না? বহ্নি ঘাড় নেড়ে বলল, আমার ভয় করছে। আমি বাড়ি যাব। বিপাশার বাইকে চেপে বাড়ি চলে এল বহ্নি।

বিপাশা বলল, আমি তো বহুদিন কলকাতায় ছিলাম না রে। গত পরশু ফিরেছি। আজকেও একটা কাজে গিয়েছিলাম, গলির মোড়ে দেখি তোরা দুজন। ওই চারটেকে শিক্ষা দিতে হবে বুঝলি। বহ্নি কোনো সাড়া দেয়নি। চুপচাপ বাড়িতে ঢুকে গেছে।

বিপাশা থানায় পৌঁছে দেখল, সিঞ্চনকেও পুলিশ সন্দেহের তালিকায় রেখেছে। বারবার জিজ্ঞেস করছে, আপনি কোন দলে ছিলেন? মেয়েটা কোথায়?

বিপাশা ঢুকেই বলল, স্যার মেয়েটা আমার বান্ধবী, ওকে বাড়িতে রেখে দিয়ে এলাম। আকস্মিক এমন আঘাতে ও যথেষ্ট ভয় পেয়েছে। আপনি ওর স্টেটমেন্ট বাড়ি গিয়ে রেকর্ড করে আনতে পারলে ভাল হয়।

পুলিশ অফিসার বিপাশার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের মত মেয়েরাই বিপদে পড়ে বুঝলে। রাত করে বাড়ি ফেরা, কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করা…

রিপোর্ট লিখিয়ে সিঞ্চন আর বিপস যখন থানার বাইরে এল তখন ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘরে ধাক্কা দিয়েছে।

সিঞ্চন বললো, চলো বিপাশা তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি। রাত অনেক হল। আজ তুমি না থাকলে হয়তো ওই ছেলে চারটের সঙ্গে আমাকেও থানায় রাত কাটাতে হত। বিপাশা মুচকি হেসে বলল, ভগবান এই একটা জিনিস আমায় দেননি। মা বলে, ওটা দিতে ভুলে গেছেন ভদ্রলোক। ভয়। আমি একাই যথেষ্ট, তুমি বাড়ি ফিরে যাও সিঞ্চনদা আমি চলে যাব।

সিঞ্চন বিপাশার ফোন নম্বরটা নিয়ে বলল, যদি দরকার হয় অবশ্যই কল করব।

মেয়েটাকে যেমন ভেবেছিল তেমন নয় বিপস। শুধু সাহসী নয়, যথেষ্ট প্রতিবাদী মেয়ে। ওর কথার মধ্যে বেশ একটা তেজ রয়েছে। পুলিশ স্টেশনে যখন কথা বলছিল অফিসার পর্যন্ত চুপ করে শুনছিল। রাতে অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঘুম আসছিল না সিঞ্চনের। বহ্নির আজকের ব্যবহারে ও বিস্মিত। এভাবে সিঞ্চনকে বিপদে ফেলে দিয়ে কী করে বাড়ি ফিরে গেল ও! এর একটাও ফোন বা মেসেজ করে জানতেও চাইল না সিঞ্চন কেমন আছে? কি হল থানায়! বহ্নি কোনো ছোট মেয়ে নয়, বাবাকে এভাবে ভয় পাওয়ার কারণটা কী!

বিপাশার ফেসবুক প্রোফাইল ঘাঁটছিল। কী সুন্দর সাজানো একটা ফার্ম হাউজের ছবি। ট্রাক্টরে বসে আছে বিপাশা। বহ্নি বছর দুয়েক আগে বলছিলো বটে বিপস নাকি একটা ফার্ম হাউজ তৈরি করতে চায়। শুনে হেসেছিল সিঞ্চন। একা একটা মেয়ে নাকি বানাবে ফার্ম হাউজ। তারপরে অমন উড়নচণ্ডী শহুরে মেয়ে! মেয়েটা করে দেখিয়েছে। ফার্ম হাউজের অ্যাড্রেসও দেওয়া আছে। কলকাতা থেকে ঘণ্টাখানেকের মত দূরত্বেই রয়েছে ওর ”সবুজ বাড়ি”। বিপসের ফার্ম হাউজের নাম ”সবুজ বাড়ি”।

মেয়েটার কাজকর্ম দেখে মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছে হচ্ছে সিঞ্চনের। ওর দেখা মেয়েগুলোর থেকে বড্ড আলাদা। ভীষণ রকমের অদ্ভুত মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে হবে ওকে।

প্রায় দুদিন কেটে গেছে। বহ্নির কোনো ফোন নেই। ভিতরে ভিতরে কষ্ট হচ্ছে সিঞ্চনের। এ কেমন ভালোবাসা, যেখানে আরেকদিকে দুশ্চিন্তাটুকুও নেই! বিপাশাকে কলটা করেই ফেলল সিঞ্চন।

বিপস কেমন আছো? বিপাশা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই বলল, ভালই আছি সিঞ্চনদা। তোমরা কেমন?

সিঞ্চন একটু ইতস্তত করে বলল, বহ্নি কেমন আছে বিপস?

বিপাশা বলল, ভালোই আছে। আজ ছাদে দাঁড়িয়েছিল, আমি গিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। অল্প কথা হল।

সিঞ্চন আচমকা বলে বসল, তুমি এখন কোথায় বিপস? আমি কি একবার দেখা করতে পারি?

বিপাশা মুখে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে বলল, কিন্তু আমি তো কলকাতায় নেই। বীরপুরে আছি।

সিঞ্চন জেদ ধরে বলল, আমি আসছি বীরপুরে।

ফোনটা কেটে দিয়ে সিঞ্চন প্রায় উদ্ভ্রান্তের মতো রেডি হয়ে নিল। ওই রাতের পর থেকেই বারবার বহ্নির ওই দ্বিধান্বিত মুখটা মনে পড়ছে, মনে পড়ছে আর একটাও খোঁজ নিতে চায়নি বহ্নি। আর এদিকে থানা থেকে জানাল, বিপাশা নাকি গত কালকেও আবার থানায় গিয়ে বেশ করে বুঝিয়ে এসেছে, ওই ছেলে চারটে যেন হ্যারাজমেন্ট প্লাস মলেস্টের জন্য সাজা পায়।

সিঞ্চন যখন বীরপুরে পৌঁছাল তখন মাথার ওপরে বৈশাখের প্রখর সূর্যের তাপ। রীতিমত হাঁসফাঁস করছিল সিঞ্চন। একটা দোকানে জিজ্ঞেস করল, বিপাশা রায়ের ফার্ম হাউজটা কোথায় বলতে পারবেন?

ভদ্রলোক একটু ভেবে বলল, ওহ আপনি কি জংলি দিদির ”সবুজ বাড়ির” খোঁজ করছেন?

জংলি দিদি বলার সময় ভদ্রলোকের চোখে বেশ সম্ভ্রম দেখল সিঞ্চন।

সুন্দর সাজানো একটা একতলা বাড়িতে এসে ঢুকল সিঞ্চন। গোটা চারজন ছেলে-মেয়েকে সামনে বসিয়ে কিসব শেখাচ্ছে বিপস। ওকে দেখে ইশারায় বসতে বলল।

সিঞ্চন বসতেই কাঁচা আমের শরবত নিয়ে এসে দাঁড়ালেন একজন ভদ্রমহিলা। বিপস মুচকি হেসে বলল, তোরা এখন আয়। ওরা বেরিয়ে যেতেই বিপস বলল, তুমি সত্যি সত্যি চলে আসবে আমি ভাবিনি সিঞ্চনদা। বলো, কেন ট্রাভেল করে এলে? ফোনে বলা যেত না!

সিঞ্চন অস্থির হয়ে বলল, এমনিই এলাম। বলতে পার তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে।

আমি তোমাকে বড্ড খারাপ ভাবতাম। বহ্নিকে বারণ করেছিলাম তোমার সঙ্গে মিশতে। সেদিনের রাতের পর থেকে একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব কাজ করছে আমার মনের মধ্যে। বহ্নি কি আদৌ আমায় ভালোবাসে?

আমার তো মনে হয় ও একটা জড় পদার্থ। এত বড় একটা সমস্যার মধ্যে আমায় ফেলে দিয়ে চলে গেল।

সিঞ্চনের এক নাগাড়ে কথা শোনার পরে বিপস মুচকি হেসে বলল, এখন কি আমায় তোমার ভালো লাগছে? ক্লিয়ারলি বলো তো, এখন কি তোমার আমায় ভালো লাগছে?

অমন অকপট কথার সম্মুখীন কখনও হয়নি সিঞ্চন। কেউ যে কদিনের পরিচয়ে এমন বলতে পারে ভাবতেই পারেনি সিঞ্চন।

সিঞ্চন বারদুয়েক চেষ্টা করে বলল, তোমায় ভালো লাগছে কিনা বলতে পারব না। তবে বহ্নিকে আর সহ্য হচ্ছে না। এতটা অমেরুদন্ডী মানুষকে জীবনসঙ্গী ভাবতে লজ্জা করছে। আর সত্যি বলতে কি তোমার সাহস আর সততা আমায় মুগ্ধ করেছে।

বিপস বেশ গলার জোরেই বলল, কল্পনাদি আমার গেস্টের লাঞ্চের ব্যবস্থা করো। যাও সিঞ্চনদা খাওয়াদাওয়া করে নাও। বিকেলে আমার সবুজ বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাব তোমায়।

সিঞ্চন আর বিপাশা বিকেলে বেরুলো ওর ফার্ম হাউজ দেখতে। মাত্র দু-বছরে মেয়েটা করেছে কী! অন্তত দশজন ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান করে দিয়েছে মেয়েটা। ডিম, মাছ, সবজি প্যাকিং হচ্ছে একদিকে। আরেকদিকে গাড়িতে লোড হচ্ছে শহরে যাওয়ার জন্য। শ্রদ্ধায় সিঞ্চনের মাথা ঝুঁকে গেল। একটা চাকরির স্বপ্নই দেখেছিল সিঞ্চন। এই জন্যই বোধহয় বলে, স্বপ্নটা অন্তত বড় দেখতে হয়।

সিঞ্চন বলল, বিপস সত্যি বলছি আমি ভাবতে পারছি না তুমি বয়েসে আমার থেকে ছোট হয়েও এত কম সময়ে এতটা করে দেখিয়েছ।

পশ্চিম আকাশের ডুবন্ত সূর্যের আলোয় বড্ড মায়াবী লাগছিল বিপাশাকে। ওর দু-চোখে উদাসী স্বপ্নের কাজল আঁকা।

নরম গলায় বলল, কিছুই করতে পারিনি। আরো অনেক জমি কিনতে হবে। বিশাল প্ল্যান আমার বুঝলে সিঞ্চনদা।

সিঞ্চন বলল, আমি অভিভূত।

বিপাশা বলল, ওই দেখো সিঞ্চনদা ওগুলো কী গাছ তুমি জানো?

সিঞ্চন মুচকি হেসে বলল, কলকাতার ছেলে বলে কী কুমড়ো গাছ চিনব না?

আর পাশের গাছটা কী গাছ বলত?

সিঞ্চন বলল, ও তো কলা গাছ। এগুলো কেমন প্রশ্ন বিপস? তুমি কি আমায় অপদার্থ ভাব নাকি!

বিপস বলল, কুমড়ো গাছগুলোর পাশে দেখো একটা করে লাঠি দেওয়া আছে। ওগুলোকে বলে ঠেকনা। ঠেকনা দিয়েও ওর লতানে স্বভাবকে আমরা পরিবর্তন করতে পারি না। আমরা সবাই জানি কুমড়ো লতাবেই। আর কলাগাছ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এমনই সৃষ্টি। এখন যদি কুমড়ো গাছকে আমি বলি তোকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, বেচারার কী বিপদ হবে বলত?

বহ্নি হল লতা। বড্ড নরম, ভীষণ নাজুক। তোমার এরকমই মেয়ে পছন্দ ছিল তাই না সিঞ্চনদা?

সিঞ্চন কিছু বলার আগেই বিপস বলল, কিন্তু তুমি চাইছ বহ্নি লাজুক থাক, ভীতু থাক, বাধ্য হোক আবার প্রতিবাদী হোক। সিঞ্চনদা ওটা কি দামি টাচ ফোন নাকি, যে সবরকম ফিচার তুমি পাবে?

তুমি তো জানতে বহ্নি কেমন, তারপরও তো ওকে ভালোবেসেছিলে। এখন ওর ওই ভীতু স্বভাবকে ঘৃণা করলে কী করে হবে!

একটা ফোন তো তোমারও করা উচিত তাই না?

সিঞ্চন ইতস্তত করে বলল, বিপাশা তুমি বোধহয় ঠিকই বলছ। একটা মানুষের মধ্যে সবগুন থাকা সম্ভব নয়।

সিঞ্চনের ফোনটা কানে ধরেই কেঁদে উঠল বহ্নি।

ফুঁপিয়ে বলে উঠল, আমায় ক্ষমা কর সিঞ্চন। সেদিন আমার ওভাবে চলে আসাটা অন্যায় হয়েছে। লজ্জায় আমি তোমায় ফোন করতে পারিনি। তুমি কি আমায় ক্ষমা করবে আর! কিন্তু আমি যে তোমায় ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না। আমি বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছি তোমার কথা। বাবা আলাপ করতে চায় তোমার সঙ্গে। তুমি কি আসবে সিঞ্চন?

বিপস হেসে বলল, এটাই বহ্নি। বুকের ভিতর অনেকটা ভালোবাসা আর কষ্ট একসঙ্গে চেপে রেখে হাসতে পারে। আমার মতো যেটা চাই সেটা ছিনিয়ে নিতে শেখেনি এখনও।

তুমি যদি ওকে সত্যিই ভালোবাসো সিঞ্চনদা তাহলে ওকে এভাবেই মেনে নাও। জোর করে ওর মধ্যে অন্যগুণ যোগ করার চেষ্টা করো না। তাহলে ও আর বহ্নি থাকবে না। বিপস হয়ে যাবে। যার ওই এক প্রতিবাদী আর সাহসী স্বভাব ছাড়া বাকি তোমার সব কিছু অপছন্দের।

সিঞ্চন ধরা গলায় বলল, বিপস আজ থেকে তুমি শুধু বহ্নির বন্ধু নও আমারও বন্ধু। এভাবে সত্যি কথাটা ঠিক সময়ে বুঝিয়ে দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ তোমায়।

বিপস বলল, চলো আমার সূর্যমুখী ফুলের চাষ দেখবে চলো। সে মহারানীকে আবার যতই চেষ্টা করো, সূর্য উঠলে তিনি অন্য কারোর দিকে তাকাবেন না। আসলে কি জানো আমরা সকলে পৃথক পৃথক স্বভাব নিয়েই জন্মেছি। জোর করলে নিজস্বতাটুকু হারাবে, লাভ কিছুই হবে না।

দুটো সূর্যমুখী ফুল হাতে নিয়ে সিঞ্চনকে দিয়ে বিপাশা বলল, তোমাদের দুজনের জন্য।

সিঞ্চনের বাইকটা চলে গেল। বিপস মুচকি হেসে মনে মনে বলল, বিপসকে ভালোবাসা একটু কঠিন সিঞ্চনদা। আমি নিজেই নিজের মনটাকে কবজা করতে পারলাম না, অন্য কেউ আমায় কি চিনবে।

তার থেকে বরং আমায় এটাই চিনুক, আমি উড়নচণ্ডী ছন্নছাড়া…..

‘আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়মকানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি নাকো কোন আইন’

সকল অধ্যায়

১. সুখের আড়ালে – অর্পিতা সরকার
২. সেদিন ভোরে – অর্পিতা সরকার
৩. নাম বিভ্রাট – অর্পিতা সরকার
৪. রেড স্কুটি এবং.. – অর্পিতা সরকার
৫. অগোছালো সংসার – অর্পিতা সরকার
৬. ভালোবাসার রামধনু – অর্পিতা সরকার
৭. ইছামতীর তীরে – অর্পিতা সরকার
৮. অলক্ষ্মী – অর্পিতা সরকার
৯. বিজয়িনী – অর্পিতা সরকার
১০. অবহেলা দ্য কিটু সাকসেস – অর্পিতা সরকার
১১. মনের ডুবুরি – অর্পিতা সরকার
১২. ভালোবাসা মিসিং – অর্পিতা সরকার
১৩. লোকে পাগল বলে ডাকে – অর্পিতা সরকার
১৪. নিলামে উঠেছি আমি – অর্পিতা সরকার
১৫. হঠাৎ বৃষ্টি – অর্পিতা সরকার
১৬. রুমমেট – অর্পিতা সরকার
১৭. এক টুকরো সুখ – অর্পিতা সরকার
১৮. দ্য মিস্ট্রি অফ ফ্রেন্ডশিপ – অর্পিতা সরকার
১৯. যদি কখনো অজান্তে – অর্পিতা সরকার
২০. আট নম্বর রুম – অর্পিতা সরকার
২১. ফর এভার – অর্পিতা সরকার
২২. নিশ্চুপ পিয়ানো – অর্পিতা সরকার
২৩. চলো বন্ধু হই – অর্পিতা সরকার
২৪. সূর্যমুখী – অর্পিতা সরকার
২৫. বাবা – অর্পিতা সরকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন