অর্পিতা সরকার
বললে না তো আমাদের ফার্স্ট অ্যানিভার্সারিতে তুমি আমায় কী গিফট করবে?
চন্দ্রিমা ওর অবাধ্য চুলকে শাসন করে পার্পেল কালারের নেলপলিশটা সুন্দর করে লাগাচ্ছিল ম্যানিকিওর করা আঙুলে। সেদিকে অপলক তাকিয়ে অঙ্কুর বলল, বলো কী চাও?
অঙ্কুরের থেকে বয়েসে অন্তত বছর সাতেকের ছোট চন্দ্রিমা। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে এমন একটু-আধটু বয়েসের ডিফারেন্স থাকে বলেই মনে করেছিলেন চন্দ্রিমার এক্স-মিলিটারিম্যান বাবা। চন্দ্রিমা বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে। ছোটবেলায় মাতৃহারা বলেই হয়তো বাবার অত্যন্ত আদরে একটু হলেও প্যাম্পার্ড চাইল্ড বলা যায়। ওর মুড পরিবর্তন বোধহয় আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের স্কেলেও ধরা পড়ে না। তাই রিটায়ার্ড মিলিটারিম্যান সুশোভন সরকার একমাত্র কন্যার বিয়ে দেওয়ার সময় একটু ম্যাচিওরড পার্সনকেই পছন্দ করেছিলেন। ছেলে হিসাবে অঙ্কুরকে খুবই পছন্দ হয়েছিল সুশোভনবাবুর।
ধীর-স্থির, নম্র-ভদ্র, ভালো চাকরি করে। সাইড বিজনেসও আছে। যেহেতু এম.বি.এ. করেছিল তাই বিয়ের পর থেকে অঙ্কুরের ব্যবসার অনেকটা দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে চন্দ্রিমা। ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের বিজনেস। চন্দ্রিমার এমনিতেই ঘর সাজানো ভারি পছন্দের কাজ। তাই অঙ্কুরের শখ করে শুরু করা ব্যবসাটার দায়িত্ব বিয়ের পর থেকেই চন্দ্রিমার। অঙ্কুর রেলে কর্মরত। কেন তারপরেও ওর এমন একটা ব্যবসার কথা মাথায় এল, এটা নিয়েই ওকে দেখতে যাবার পরে প্রথম প্রশ্নটা করেছিল চন্দ্রিমা।
অঙ্কুর বলেছিল, এটা আসলে বাবার ব্যবসা। আমার বাবা ব্যবসাপ্রিয় মানুষ ছিলেন। কয়েকযুগ এগিয়ে ভাবতে পারতেন। প্রচুর পড়াশুনা করতেন। কিন্তু ব্যবসাদার ছিলেন না বলেই বুঝতে পারেননি আমাদের এখানে ইন্টিরিয়রের ব্যবসা চলবে না। শেষপর্যন্ত বাবাকে কাঠের ফার্নিচারের ব্যবসা করতে হয়েছিল। কিন্তু ইন্টিরিয়রের ব্যবসার জন্য বানানো অফিসটাতে মাঝেমাঝেই গিয়ে বাবা বসে থাকতেন। তাই বাবার মৃত্যুর পর কাঠের ফার্নিচারের ব্যবসাটা বন্ধ করে দিলেও এই স্বপ্নটাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছি মাত্র। চাকরির পরে সময় তেমন দিতে পারি না। তবুও বাঁচুক যে ক-দিন পারে।
চন্দ্রিমার খুব পছন্দের বিজনেস এটা। আর এই মুহূর্তে রমরম করে চলছে। কলকাতা শহরের ছোট্ট ছোট্ট ফ্ল্যাটগুলোকে কম জায়গার মধ্যে ছবির মতো সাজিয়ে দেওয়ার জন্য ডাক পড়ছে অন্দরমহলের। ‘অন্দরমহল’ নামটাও অঙ্কুরের বাবার দেওয়া। অফিসে একটা বড় করে ছবি টাঙিয়ে রেখেছে চন্দ্রিমা স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইয়ের। তাতে রোজ নিজের হাতে মালা পরায় চন্দ্রিমা।
অঙ্কুর এই একবছরে এটুকু বুঝেছে, চন্দ্রিমার বয়েসটা কম তাই উচ্ছলতা একটু বেশি। কিন্তু কোনো দায়িত্ব দিলে ও সেটা যেভাবেই হোক পালন করে। স্ত্রীকে অঙ্কুর একটু বেশিই প্রশ্রয় দেয়।
চন্দ্রিমা বলল, আগে বলো দেবে। প্রমিস করো।
অঙ্কুর বলল, চাঁদে জমি কিনতে বোলো না প্লিজ।
চন্দ্রিমা মিষ্টি করে হেসে বলল, যতক্ষণ না তুমি প্রমিস করছ ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার গিফটের কথা কিছু বলব না তোমায়।
অঙ্কুর অভিমানী গলায় বলল, এখনও পর্যন্ত তুমি যা আব্দার করেছ সেটা আমি দিইনি এমন হয়েছে? তাহলে এটা অবিশ্বাস করছ কেন? আচ্ছা বাবা প্রমিস করছি দেব।
চন্দ্রিমা অঙ্কুরের বুকে মাথা ঠেকিয়ে আলতো আব্দারের সুরে বলল, একটা পিয়ানো চাই।
অঙ্কুর বলল, এই কথা! এখন তো তুমিই অন্দরমহলের মালিক। আমার থেকে তোমার কাছে টাকা বেশি আছে। তারপরেও যখন মুখ ফুটে আমার মিষ্টি বউটা আমার কাছে আব্দার করেছে তখন আমি নিশ্চয়ই তোমাকে একটা দামি পিয়ানো কিনে এনে দেব।
ঘাড় নেড়ে চন্দ্রিমা বলল, না, এটা তুমি এইচ পালের দোকানে পাবে না। আসলে কী জানো, আমাদের ভারতে অরিজিনাল পিয়ানো তৈরিই হয় না। এইচ পালের দোকানে পিয়ানো সারাই হয়ে বিক্রি হয়। যদিও ওক আর মেহগনি কাঠের পিয়ানোই সব থেকে ভালো হয়। পিয়ানো শব্দটি ইতালীয় শব্দ ‘Pianoforte’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। সংগীতের পরিভাষায় ‘Piano’ অর্থ ‘নিঃস্তব্ধতা (Quiet)’ এবং ‘Forte’ অর্থ ‘শব্দময়তা (Loud)’। আসলে পিয়ানোর চাবিতে স্পর্শ করলেই এটি শব্দ সৃষ্টি করে এবং ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিঃস্তব্ধ হয়ে যায় বলে যন্ত্রটির এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।
কিন্তু আমার চাই অন্য কিছু।
অঙ্কুর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, তুমি কি পিয়ানো শিখেছিলে নাকি? বলোনি তো?
চন্দ্রিমা বলল, না শিখিনি। তবে শেখার আগ্রহ আছে। আমার একটা ১৯০৫ সালের পিয়ানো চাই।
অঙ্কুর বলল, সর্বনাশ! তখনকার পিয়ানো পাব কোথায়?
চন্দ্রিমা বলল, আছে আছে। আমার স্কুলের বান্ধবী রাখী ডিসুজার ঠাকুমা আরিয়া ডিসুজার কাছেই আছে এমন একটা পিয়ানো। আমি স্কুলে পড়াকালীন গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। রাখী এখন জার্মানি চলে গেছে। বিয়ে-থা করে ওখানেই সেটেল্ড। রাখীর বাবা মারা গেছেন। ওর ঠাকুমা একাই পড়ে থাকেন ওদের গোলপার্কের বাড়িতে। জানো তো, ভদ্রমহিলা নিজের বাড়িতে নিজেই ভাড়া থাকেন!
ওঁর ছেলে নাকি বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে গিয়েছিল। শুনলাম ওবাড়ির সব জিনিস নিলামে উঠিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন বর্তমান বাড়ির মালিক ভদ্রলোক। আরিয়া ডিসুজার বাড়ির আসবাব মানে তো ওই পিয়ানোটাও নিশ্চয় আছে। প্লিজ প্লিজ অঙ্কুর আমার ওটা চাই।
অঙ্কুর বলল, বুঝলাম। তো এই অকসনটা কোথায় হচ্ছে?
উৎসাহ পেয়ে গেছে চন্দ্রিমা। ওকে আর দেখে কে!
উত্তেজিত হয়ে বলল, আমার কাছে সব খবর আছে। মিস্টার চ্যাটার্জী সব পুরোনো জিনিস দিয়ে ওঁর বাড়িটা ডেকোরেশন করাবেন বলে অন্দরমহলকে কন্ট্রাক্ট দিয়েছেন। তারপর থেকে আমি শ্যামল আর কেকাকে নিয়ে গোটা কলকাতা চষে ফেলেছি। প্রচুর নিলামে ওঠা জিনিসও কিনেছি দরদাম করে।
অঙ্কুর হেসে বলল, যা! ওই দুটোই আমার একটু ভালো এমপ্লয়ী ছিল। ওদের মাথাটাও তুমি নিজের মতো করে খারাপ করে দিলে!
চন্দ্রিমা মুখ ভার করে বলল, ও আমার মাথা খারাপ? অঙ্কুর চন্দ্রিমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, এই নিয়ে সন্দেহ আছে এমন মানুষ কলকাতা শহরে আছে নাকি!
অঙ্কুর চন্দ্রিমার মুড আর পাগলামি নিয়ে মাঝে মাঝেই লেগপুলিং করে। এ নতুন কিছু নয়।
চন্দ্রিমা বলল, ধুর বাবা, তারপর শোনো না… মেহগনি কাঠের একটা পালঙ্ক নিয়েছি সেদিন এই অকসন থেকে। মিস্টার চ্যাটার্জী চা-বাগানের মালিক বুঝলে। তাই দেদার টাকা খরচ করছেন বাড়িটাকে এমন সব অ্যান্টিক জিনিস দিয়ে সাজাতে। শেষে খুঁজতে খুঁজতে বেরিয়ে গেল ওই পালঙ্কটা নাকি জগৎ শেঠের কোনো আত্মীয়ের। ভাবতে কেমন রোমাঞ্চ লাগছে না অঙ্কুর!
অঙ্কুর ছদ্ম বিস্ময়ের ভঙ্গি করে বলল, বলো কী! সেই তখনকার জিনিস!
চন্দ্রিমা বলল, মিস্টার চ্যাটার্জীর বাড়িটা ডেকোরেট করে ফেলার পরে তোমায় একদিন নিয়ে যাব। দেখবে ঝাড়লণ্ঠনটা। ড্রয়িং রুমে ঢুকলে ওটার দিকেই তাকিয়ে থাকবে। আর জানো, মাস্টার ক্লকটা তো সেই ইংরেজ আমলের।
অঙ্কুর ফিসফিস করে বলল, মিস্টার চ্যাটার্জী তার মানে আস্ত একখানা চিড়িয়াখানা বানাচ্ছেন।
অঙ্কুরের অত্যাধুনিক হ্যান্ডি ফার্নিচারই বেশি পছন্দের। কিন্তু আদুরে বউয়ের সামনে সে কথা প্রকাশ না করেই বলল, নিশ্চয় যাব দেখতে। তুমি বাড়িটাকে মনের মত করে সাজাচ্ছ আর আমি দেখব না তাই হয়!
চন্দ্রিমা বেজায় খুশি হয়ে বলল, তাহলে কালকে মিসেস ডিসুজার বাড়ি গিয়ে নিলামে ওঠার আগেই পিয়ানোটা কিনে নিয়ে আসি?
ফোনটা বেজে উঠল ঠান্ডা ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে। চন্দ্রিমার ফোনের রিংটোনটা অঙ্কুরের খুব পছন্দের।
‘তুমি আসবে বলেই
সোনালি স্বপ্ন ভিড় করে আসে চোখে
তুমি আসবে বলেই
আগামী বলছে দেখতে আসব তোকে…”
ফোনটা রিসিভ করেই চন্দ্রিমা বলল, হ্যাঁ শ্যামল বলো। সেকি কখন? তাই নাকি? তাহলে তো আমাদের সকাল দশটার আগেই পৌঁছাতে হবে।
চন্দ্রিমা ফোন রেখে বলল, আর বোলো না, মিসেস আরিয়া ডিসুজার বাড়িওয়ালা আগামীকাল ওঁকে বাড়ি ফাঁকা করে দিতে বলেছেন। তাই সব জিনিস নিলামে বিক্রি হয়ে যাবে বোধহয়। ওঁর কাছে বাড়ি ভাড়ার টাকা নেই। তাই উনি কাঠের সিন্দুক, শ্বেতপাথরের পরী বিক্রি করে দিয়েছেন। বাকি আছে খুব সামান্যই। ওগুলোও তার মানে ওই লোভী লোকটা আত্মসাৎ করতে চাইছে। এটা হতে দেওয়া যায় না। আরিয়া ডিসুজা যা দাম চায় আমি সেটা দিয়েই কিনব।
অঙ্কুর ওর চেকবুকটা এগিয়ে দিয়ে বলল, কিনে এনো তোমার অ্যানিভার্সারি গিফট। আমি সাইন করেই রেখেছি তুমি অ্যামাউন্ট বসিয়ে নিও।
চন্দ্রিমা সকাল সকাল রেডি হয়ে বেরিয়ে গেছে। অঙ্কুরের ব্রেকফাস্ট সাজানো আছে টেবিলে।
ধীরে সুস্থে খবরের কাগজটা খুলল অঙ্কুর। সকালে সেকেন্ড কাপ চা খেতে খেতে দৈনিক সংবাদ পড়াটা ওর নিস্তরঙ্গ জীবনে বিলাসিতা।
ভীষণরকমের প্রাইভেট পার্সন ও। ঠিক চন্দ্রিমার বিপরীত। ও যেমন পার্টি, হইহুল্লোড়ে মেতে থাকতে ভালোবাসে অঙ্কুর আবার নিয়ন আলোয় রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। এতে অবশ্য ওদের দুজনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কারণ ওরা দুজনেই ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। চন্দ্রিমাও কখনও জোর করে ওকে ডিস্কোতে নিয়ে যায়নি। আর অঙ্কুরও ওকে বাধ্য করেনি নিজেকে পরিবর্তন করতে।
দুই মেরুর তাই সুন্দর সহাবস্থান ঘটেছে ওদের দুজনের সংসারে। তবে চন্দ্রিমাকে নিয়ে সবসময় একটা চাপা আতঙ্ক কাজ করে অঙ্কুরের মনে। মেয়েটা বড্ড সরল স্বভাবের। সহজেই লোকজনকে বিশ্বাস করে ফেলে।
খবরের কাগজের হেডলাইনটা পড়ে চমকে উঠল অঙ্কুর।
এরকমই একটা নাম বলেছিল না চন্দ্রিমা!
গোলপার্কের বাসিন্দা মিসেস আরিয়া ডিসুজার বাড়িতে গতকাল রাতে ডাকাতি হয়। ভদ্রমহিলার বয়স প্রায় আশি বছর। একাই থাকতেন বাড়িতে। দেনার দায়ে নিজের বাড়িটা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গেছে। মালিক দয়া করেই থাকতে দেন ওঁকে। এমন দরিদ্র মানুষের বাড়িতে ঠিক কী কারণে ডাকাতি হল তার হদিশ পায়নি পুলিশ। ভদ্রমহিলা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। ভোরে উঠে দেখেন ঘর তছনছ হয়ে গেছে।
বাড়ির মালিক থাকেন দোতলায়। তাঁর জবানবন্দিতে জানা যায়, ঘরে খুব সামান্য আসবাবই অবশিষ্ট আছে। ডাকাত কিছুই নিয়ে যায়নি। শুধু দরজাটা ভাঙা রয়েছে। আর ঘরটা লন্ডভন্ড হয়ে রয়েছে।
পুলিশের ধারণা দুষ্কৃতীরা ভুল ঠিকানায় ঢুকে পড়েছিল। তবে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে স্থানীয় পুলিশ।
অঙ্কুর দেরি না করে ফোন করল চন্দ্রিমাকে। বলবে এখুনি চলে এসো। ওই বাড়িতে ঢোকার দরকার নেই। শেষে পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে।
কিন্তু মহারানীর তো ফোন নট রিচেবেল বলছে। উফ, এই মেয়েটা ওকে পাগল করে ছাড়বে। উঠল বাই তো কটক যাই। এখুনি ওর ১৯০৫ সালের পিয়ানোর ঠিক কী দরকার কে জানে!
অস্থিরভাবে পায়চারি করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। কেকা আর শ্যামলের ফোনেও তাই। তার মানে কী ওরা ওই বাড়িতে ঢুকে পড়েছে!
বাড়িটাতে ঢুকতেই কত পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল চন্দ্রিমার। হাতে গুনে বার দুয়েক এসেছিল ও রাখীদের এই বাড়িটাতে। ওর দাদু তখনও বেঁচে ছিলেন। কুঁচকে যাওয়া চামড়া, কপালে অনেকটা জীবন কাটিয়ে আসার দুশ্চিন্তা। চালসে পড়া চোখে তাকিয়েছিলেন ওর দিকে। রাখী আর চন্দ্রিমা লম্বা বারান্দা দিয়ে একটু এগোতেই ওর দাদু গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, দক্ষিণের ঘরের দিকে কেন যাচ্ছ? ওদিকের ঘরে যাবে না।
রাখী রাগ দেখিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ জানি। যাব না ওই ঘরে। ওই ঘরে তো তোমার লাখ টাকার সম্পত্তি রয়েছে না!
আমরা ছাদে যাব।
চন্দ্রিমা কৌতূহলবশত বলেছিল, ওই ঘরে কী আছে রে?
রাখী মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, হাতির মাথা। একটা পিয়ানো, কটা বই আর একটা চেয়ার আছে। ওটা নাকি দাদুর প্রাইভেট সময় কাটানোর জায়গা। তাই ওঘরে কেউ ঢুকলে বিরক্ত হয়। আমি কলেজে উঠলেই বাবা বলেছে একটা ফ্ল্যাট কিনবে। এই ইংরেজ আমলের বাড়িতে কে থাকবে রে? যতসব বস্তাপচা জিনিসে ভর্তি ঘরবাড়ি।
চন্দ্রিমা বলল, তোর দাদুর নাম কী রে?
রাখী বলল, রবার্ট ডিসুজা। দাদুর মুখে শুনেছি আমার পূর্বপুরুষ পোর্তুগালে ছিলেন। ওখান থেকে কোনো কারণে এদেশে আসেন। তারপর এদেশের জলমাটির মায়া ত্যাগ করে আর ফিরে যাননি। তিনি এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করে এদেশেই বসবাস শুরু করেন। আমরা কিন্তু পাক্কা বাঙালি বুঝলি। এমনকি আমার দাদুরও খুব প্রিয় শহর কলকাতা।
চন্দ্রিমা বলল, একবার উঁকি মেরে দেখব ওই ঘরটা?
দুজনের মাথাতেই দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেল।
খুব সন্তর্পনে খুলে ফেলল দরজার ছিটকিনি। পা টিপে টিপে ঢুকল ওই ঘরে। নেহাতই সাদামাটা একটা ঘর। কাঠের আলমারিতে বেশ কিছু বই। একটা ইজি চেয়ার। আর একটা বিশাল পিয়ানো। সাদা রঙের একটা ঝালর দেওয়া কাপড়ের কভার পরানো আছে। দেওয়ালে একটা ছবিতে রাখীর দাদু স্যুট পরে পিয়ানো বাজাচ্ছেন।
চন্দ্রিমা বলল, এই রাখী কভারটা একটু সরিয়ে দেখা না রে?
রাখী ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে বলল, তোকে শনিবার বিকেলে একদিন আনব। প্রতি শনিবার বিকেলে দাদু এই পিয়ানোর ঢাকা নিজে হাতে সরায়। তারপর অনেকক্ষণ ধরে নিখুঁত করে মুছে দিয়ে আবার কভার পরিয়ে রাখে। আমি যখন খুব ছোট তখন দাদু বাজাত, ঠাকুমাও শিখেছিল টুকটাক। কিন্তু দীর্ঘদিন হয়ে গেল পিয়ানোটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে। বাবা বলেছিল মিস্ত্রি ডেকে মেরামত করে দেবে। দাদু বলেছে, কেউ হাত দেবে না। এ জিনিস এখানের নয়। হাতুড়ে এসে আরও নষ্ট করে দিয়ে যাবে। সিলিঙের ওপরের ঝাড়টা দেখিয়ে রাখী বলেছিল, ওটা নাকি বেলজিয়াম গ্লাস দিয়ে তৈরি। আমার দাদুর বাবাকে কোন ইংরেজ মেম উপহার দিয়েছিল। এবাড়ির বেশিরভাগ আসবাবই বিদেশের। সব আমার দাদুর বাবা বিদেশ থেকে আনিয়েছিল। অথবা ইংরেজদের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিল। ইংরেজ কোম্পানিতে চাকরি করত তো তাই। আমার দাদুও প্রথম জীবনে ইংরেজদের কোম্পানির এমপ্লয়ী ছিল। তারপর ওরা এ দেশ ছেড়ে চলে গেলে রেলে চাকরি নিয়েছিল।
চন্দ্রিমার চোখের সামনে কত কত অদেখা অতীত ভিড় করে এসেছিল। ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েই কল্পনা করেছিল, এখানে একটা পার্টি চলছে… রাখীর দাদু পিয়ানো বাজাচ্ছেন। চারপাশে সাহেব, মেম হাতে সোনালি পানীয় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়ির সামনে ফিটন গাড়ির লাইন। আর বাইরে স্বদেশিরা ওঁৎ পেতে বসে আছেন কখন কোন সাহেবের গাড়ির ওপরে ইট ছুঁড়ে মারবেন। পরিবেশটা কল্পনা করেই শিউরে উঠেছিল চন্দ্রিমা। সেই থেকেই রাখীদের এই বাড়িটার প্রতি ওর ভীষণ আগ্রহ ছিল। রাখী অবশ্য কথা রেখেছিল। এক শনিবার ওরা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছিল সম্পূর্ণ ওক কাঠের তৈরি এই বিশাল পিয়ানোটাকে। রবার্ট ডিসুজা সুন্দর করে পরিষ্কার করছিলেন। প্রতিটা রিডকে যত্ন করে মুছছিলেন।
রাখীর দাদু রাশভারী হলে কী হবে রাখীর ঠাম্মি আরিয়া ডিসুজা ছিলেন মাই ডিয়ার মানুষ। কত সব গল্প করেছিলেন চন্দ্রিমার সঙ্গে।
বলেছিলেন, রাখীর দাদু আসলে মাথাপাগলা লোক। যখন যা মন হয় তাই করে। এখন যেমন সে ওই ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না। আমাকেও না। পিয়ানোটা কাউকে ধরতে দেয় না। বাজানো দূরে থাক, খারাপ হয়ে পড়ে আছে, সেটা সারায় না পর্যন্ত। ১৯০৫ সালের জিনিস ওটা। খাঁটি বিদেশি জিনিস। কী সুন্দর ওর সুর। রবার্ট নাকি বাজাতোও দারুণ।
ঘরগুলোতে পা দিয়ে স্কুলজীবনে ফিরে যাচ্ছিল চন্দ্রিমা। কেকা ফিসফিস করে বলল, দিদি মিসেস ডিসুজা বসে আছেন। ওই দেখুন।
চন্দ্রিমা দেখল একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন মিসেস আরিয়া ডিসুজা। সেই চেহারা আর নেই। কী সুন্দর দেখতে ছিলেন। গোলাপি ফর্সা, পাতলা ঠোঁটে কী সুন্দর একটা হাসি লেগে থাকত। সুখী সুখী হাসি। এখন শরীরটা জরাজীর্ণ। মনে হচ্ছে যেন একটা দুর্ধর্ষ কালবৈশাখী এসে তছনছ করে দিয়ে গেছে ওঁর জীবনটা। দৃষ্টিতে চূড়ান্ত বৈরাগ্য। শরীরে নেমেছে ক্লান্তি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও জীবনটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার বিরক্তি ফুটে উঠেছে ভাঁজ পড়া কপালের রেখায়। পরমায়ু কেন এখনও রয়ে গেছে বলেই হয়তো আক্ষেপ করছেন ভদ্রমহিলা।
চন্দ্রিমা নরম গলায় বলল, কেমন আছো গো ঠাম্মি? আমায় চিনতে পারছ?
আরিয়া ডিসুজা ঝাপসা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে বললেন, কে? কে তুমি?
চন্দ্রিমা ওঁর শিরা বেরোনো হাতের ওপরে হাত রেখে বলল, আমি রাখীর বন্ধু ছিলাম। আগে আসতাম তোমাদের বাড়ি।
রাখীর নামটা শুনে ভদ্রমহিলা একটু হেসে বললেন, আমার নাতনী তোমায় পাঠাল? কী বলেছে সে? একটা ফোনও তো করে না আমায় কেউ। ওঁর গলায় অভিমানী ক্ষোভ দলা পাকাচ্ছে।
চন্দ্রিমা বলল, ঠাম্মি আমি তোমার পিয়ানোটা কিনতে চাই। বিক্রি করবে আমায়?
আরিয়া ডিসুজা অপলক তাকিয়ে বললেন, পিয়ানো কেনার খদ্দের তো দুপুরে আসবে বলেছিল সুধীর। আমার বাড়িওয়ালা সুধীর বলেছিল, আজ ওই ঘরের চেয়ার আর পিয়ানো দুটো বেচে দেবে। দিয়ে ওর পাঁচ মাসের বাড়ি ভাড়া শোধ করে নেবে।
চন্দ্রিমা বলল, কত করে বাড়ি ভাড়া দিতে হয় তোমায়?
আরিয়া ডিসুজা আক্ষেপের সুরে বললেন, আমার ছেলে এই বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছিল। আমায় ভাড়াটে করে রেখে সকলে উঠে গিয়েছিল অন্য ফ্ল্যাট কিনে। তারপর থেকে জমানো টাকা একটু একটু করে খরচ করে বেঁচে আছি। এ ঘরের ভাড়া দিতে হয় পাঁচ হাজার করে। আমার কাছে কমই নেয় সুধীর।
গলাটা কাঁপছে আরিয়া ডিসুজার। সারাটা জীবন বিলাসিতা আর সম্মানের সঙ্গে বেঁচেছেন, এখন এমন অক্ষম অবস্থায় আত্মসম্মান খুইয়ে যন্ত্রণা পাচ্ছেন।
চন্দ্রিমার মনটা কেঁদে উঠল। ওর বাবা একটা বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্বে আছে। এক্স-মিলিটারিম্যান এখন রীতিমতো ব্যস্ত ওই বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে। চন্দ্রিমা ভাবল আরিয়া ঠাম্মিকে যদি বাবার ওই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো যায় মন্দ হবে না।
চন্দ্রিমার বাবা বলেন, ‘অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানা বুঝলি! তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখাটা প্রধান কর্তব্য।’
বাবার রুটিনে কোনো ফাঁকি নেই। এখনও ভোরে উঠে মর্নিংওয়াকে যাওয়া। তারপর ব্রেকফাস্ট খেয়ে, সংবাদ মাধ্যমের অযৌক্তিক খবরের সমালোচনা করে বেরিয়ে পড়ে বৃদ্ধাশ্রমের জন্য ফান্ড কালেক্ট করতে। বাবার ইচ্ছে, ওটাকে খুব সুন্দর করে সাজানোর। আরও কয়েকটা ঘর বাড়ানোর। কিন্তু অনেক টাকার ব্যাপার।
যাই হোক, আরিয়াঠাম্মির জন্য একটা ব্যবস্থা করতেই হবে ওকে। এত বয়েসের মানুষ এভাবে একা একা থাকতে পারে নাকি!
রাখীর ওপরে খুব রাগ হল চন্দ্রিমার। ফেসবুক ফ্রেন্ডে আছে ও। যদিও এখন আর বেশি কথা হয় না। তবুও একবার অন্তত ওকে বলতে হবে যে এভাবে ঠাম্মাকে ফেলে দিয়ে তাঁকে সর্বস্বান্ত করার মানে কী!
ঠাম্মি, রবার্ট দাদুর সেই পিয়ানোটা আছে এখনও? চন্দ্রিমার কথায় মিসেস ডিসুজা যেন অতীতের সোনালি দিনে পাড়ি দিতে চাইছিলেন।
ওঁর চোখের চাউনিতে সোনালি দিনের মেদুরতা।
সেই জমজমাট বাড়িটা যে এমন হয়ে গেছে ভাবতে চন্দ্রিমারই কেমন কষ্ট হচ্ছে।
মিসেস ডিসুজা বললেন, এখনও আছে। তবে আজ দুপুরেই বিক্রি হয়ে যাবে। চন্দ্রিমা ইতস্তত করে বলল, ‘কত দাম দিয়েছেন তোমার বাড়ির বর্তমান মালিক সুধীর?’
মিসেস ডিসুজা বললেন, পঞ্চাশ হাজার দাম দিয়েছে। ও জিনিস তো বাজে না। ভাঙাচোরা জিনিস। নেহাত কাঠটা দামি বলে দামটা পাচ্ছি। ওর বাড়ি ভাড়া মিটিয়ে কয়েকদিন চলে যাবে আমার। গলাটা বড্ড অসহায় শোনাচ্ছিল ওঁর।
চন্দ্রিমা বলল, আমি যদি দেড় লাখ দিই আমায় দেবে ঠাম্মি?
অপলক তাকিয়ে রইলেন মিসেস ডিসুজা। তারপর নরম গলায় বললেন, ওটা কিন্তু বাজে না। নেহাত রবার্টের খুব প্রিয় ছিল তাই আমি ধুলো জমতে দিইনি। রবার্ট বলেছিল, এটা কোনোদিন কাউকে দেবে না। এ তোমায় বুড়ো বয়েসে খাবার জোগাবে।
রবার্ট বোধহয় নিজের সন্তানকে আমার থেকেও বেশি চিনতে পেরেছিল। আমার ছেলে যে এভাবে আমায় নিঃস্ব করে দেবে সেটা বোধহয় বুঝেছিল। রবার্ট তাহলে ঠিকই বলত, এটা বিদেশি পিয়ানো আরিয়া, এর অনেক দাম। চোখ দুটো ভিজে এল আরিয়া ডিসুজার। সত্যিই আমায় ওই পিয়ানোর জন্য এত দাম দেবে তোমরা?
চন্দ্রিমা বলল, দেব ঠাম্মি। আরেকটা কথা, তোমাকে যদি এ বাড়ি থেকে আমি একটা ভালো জায়গায় নিয়ে যাই যেখানে তুমি অনেক বন্ধু পাবে, যাবে?
আরিয়া হেসে বললেন, ওল্ডএজ হোম? হ্যাঁ যাব। কিন্তু সেখানে থাকতে গেলে তো টাকা লাগবে আমি কোথায় পাব?
চন্দ্রিমা বলল, আমি ব্যবস্থা করছি।
কথার মাঝেই বাড়ির বর্তমান মালিক সুধীর ঘোষ ঢুকলেন।
বিরক্তির গলায় বললেন, আবার কী পুলিশের লোক নাকি? আরে আপনাদের তো বললাম, এঁর ঘরে চুরি করার মতো কিছুই নেই। নিশ্চয়ই দুষ্কৃতীরা ঠিকানা ভুল করে ঢুকেছিল। বয়স্ক মহিলা ভয়ে চেঁচিয়ে ফেলেছেন, সেই থেকে শুরু হয়েছে। সামনের বাড়িতেই এক মিডিয়ার ইঁচড়ে পক্ক ছেলে থাকে। সেই পুলিশে খবর দিয়েছিল। সেই আবার খবরও করে দিয়েছে কাগজে। আমি বলছি শুনুন, আদপে চুরি করার কিছুই নেই এ বাড়িতে। আপনারা আসুন এখন।
চন্দ্রিমা হাত তুলে নমস্কার করে বললো, আমি চন্দ্রিমা সরকার। আমার ‘অন্দরমহল’ নামে একটি হাউজ ইন্টিরিয়র ডেকরেশনের বিজনেস আছে। আমি পুরোনো জিনিস, অ্যান্টিক জিনিস কিনে থাকি। শুনলাম এবাড়ির অনেক জিনিস নিলাম করছেন আপনি?
সুধীরবাবুর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, কিন্তু বেশিরভাগ জিনিস তো বিক্রি হয়ে গেছে। থাকার মধ্যে আছে ওই সুরবিহীন পিয়ানো আর ইজিচেয়ারটা। তো ওই দুটোর জন্য কত টাকা দেবেন আপনি? আজ একটা খদ্দেরের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছিল সত্তর হাজারে। আপনি তাহলে আশি দিন, আমি দিয়ে দেব। মিসেস ডিসুজার ধার আছে অনেক টাকা।
চন্দ্রিমা বুঝল, সুযোগ বুঝে সুধীরবাবু ত্রিশ হাজার বেশি চাইছেন। কথা না বাড়িয়ে চেক কেটে দিলো চন্দ্রিমা। আরিয়া ঠাম্মির কানে কানে বলল, তোমার আরও টাকা পাওনা রইল। আর খুব তাড়াতাড়ি আমি তোমায় নিয়ে যাব।
শ্যামল ফোন করে অন্দরমহলের নিজস্ব মালবাহী গাড়িটাকে ডেকে নিল।
বাইরে বেরোতেই অঙ্কুরের ফোন।
কী ব্যাপারটা কী? ফোন রিসিভ করছ না কেন? গতকাল মাঝরাতে ওই বাড়িতে ডাকাত ঢুকেছিল জানো? দেখো, কোনো পুলিশি ঝামেলায় পড়ো না।
অঙ্কুরকে শান্ত করে ফোনটা রাখল চন্দ্রিমা। বাবাকে ফোন করে বলল ওদের বাড়িতে আসতে। আজই আরিয়াঠাম্মির একটা ব্যবস্থা করতে হবে। সব জিনিস নিয়ে নেওয়া হয়ে গেছে সুধীরবাবুর, এবারে যেকোনো দিন বাড়ি থেকে ঠাম্মিকে বের করে দেবে।
পিয়ানোটা নিয়ে যখন বাড়িতে ঢুকল তখন দুপুর হয়ে গেছে। রান্নাঘর থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছে। অঙ্কুর অফিসে যায়নি। বাবা, অঙ্কুর আর সারদাদি মিলে কিছু একটা রান্না করছে দেখেই আতঙ্কিত হল চন্দ্রিমা। তবে দুপুরে খেতে বসে দেখল চিকেনটা মন্দ রাঁধেনি তিনজন মিলে।
শ্যামল আর কেকা অন্দরমহলের চেম্বারে চলে গেছে। এবেলা আর যায়নি চন্দ্রিমা। সেই স্কুলবেলার মতো একটা উত্তেজনা হচ্ছে ওর। ঠিক যেন নিষিদ্ধ জিনিসে হাত দিতে চলেছে। সেই যে রাখীর দাদু বলেছিলেন, দক্ষিণের ঘরে ঢুকবে না। আর রাখী বলেছিল, দাদু নাকি কাউকে ওই ভাঙা পিয়ানোতে হাত ছোঁয়াতেই দেন না। আজ মিসেস ডিসুজা বললেন, উনি মারা যাবার পরে শনিবার করে ধুলো মুছে কভার পরিয়ে রাখা ছাড়া আর কিছুই করেননি তাই বোধহয় সাদা সাটিনের কভার পরানো পিয়ানোটা ওকে ডাকছে হাতছানি দিয়ে।
কোনোমতে খাবার খেয়েই ছুটে চলে গেল ড্রয়িংরুমে। ওর পিছন পিছন বাবা আর অঙ্কুরও এসে দাঁড়িয়েছে।
ধীরে ধীরে কভারটা খুলে ফেলল চন্দ্রিমা। অরিজিনাল ওক কাঠের পালিশে আলো পড়ে চকমক করে উঠল। নিজের আভিজাত্য জানান দিল পিয়ানোটা। ওপরে পিতলের প্লেটে খোদাই করে লেখা আছে H.D Rowlson-১৯০৫।
অঙ্কুর বললো, তার মানে চন্দ্রিমা এটা মিস্টার ডিসুজাদেরও নয়। ওঁর কাছেও এসেছিল হাত বদল হয়ে।
চন্দ্রিমা হাত বুলিয়ে নিল একবার। কেমন যেন অদ্ভুত একটা টান আছে পিয়ানোটায়।
চন্দ্রিমার বাবা বললেন, বাজাতে তো পারিস না। সরে যা একটু, আমি বাজিয়ে দেখছি।
অঙ্কুর বললো, আপনি পারেন নাকি বাবা?
সুশোভনবাবু মুচকি হেসে বললেন, অঙ্কুর এই তো খুব বড় ভুল করলে! কোনোদিন কোনো মিলিটারি ম্যানকে জিজ্ঞেস করবে না সে কোনো কিছু পারে কিনা! জানবে সে সব পারে, বুঝলে!
হৃষিকেশে আমার পাশের কোয়ার্টারে এক ভদ্রলোক থাকতেন। খুব আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। তিনি সন্ধে হলেই পিয়ানো নিয়ে বসতেন। আমিও গিয়ে আড্ডা জমাতাম মাঝে মাঝেই। তখনই উনি আমায় শিখিয়েছিলেন এর টুকিটাকি। খুব একটা ভালো বাজাতে পারি না। তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের অনভ্যাস। তবে একটু আধটু তো পারবই।
চন্দ্রিমা হেসে বলল, বাবা এটা তো খারাপ পিয়ানো। বাজে না। নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে।
সুশোভনবাবু অবাক হয়ে অঙ্কুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এতটা প্রশ্রয় মেয়েকে দেওয়া কী ঠিক হচ্ছে অঙ্কুর? এ একটা ভাঙাচোরা পিয়ানো লাখ টাকা দিয়ে কিনে আনল আর তুমি হাসছ!
চন্দ্রিমা বলল, এর অরিজিনাল দাম শুনলে তুমি চমকে উঠবে বাবা। এর দাম প্রায় ষোলো লক্ষ টাকা।
অঙ্কুর বলল, তাই নাকি!
সুশোভনবাবু জমিয়ে বসলেন পিয়ানোর সামনের বেঞ্চে।
তারপর বললেন, বেশ আমি একটু খুটখাট করে দেখি এর থেকে কোনো কথা বের করতে পারি কিনা! তীক্ষ্ন নজরে তাকিয়ে বললেন, এমন ঝকঝকে পিয়ানোর একটা ছোট্ট জিনিস বড় দৃষ্টিকটু লাগছে চন্দ্রা। কীবোর্ডের একটা রিডের রং অন্যগুলোর মতো ব্ল্যাক নয় বুঝলি। একটু যেন ব্রাউন। এটা কেন? দাঁড়া প্রপস্টিকটাকে আগে তুলি বুঝলি। ভিতরে কিছু গন্ডগোল আছে মনে হচ্ছে।
প্রপস্টিক দিয়ে পিয়ানোর ওপরের ঢাকনাটা খুলতেই এক কোণে চোখে পড়ল একটা ব্ল্যাক রিড। সুশোভনবাবু বললেন, অদ্ভুত তো। এই রিডটা কি কাজ করে না নাকি! তাই হালকা ব্রাউন রিডটা লাগানো হয়েছিল?
ব্রাউন রিডটা টেনে খুলে ব্ল্যাক রিডটা লাগিয়ে প্যাডেলে পা দিতেই চোখের সামনে পিয়ানোটার ভিতরের দুটো ছোট্ট বক্স খুলে গেল। তার মধ্যে কোনো তার নেই। রয়েছে দুটো ছোট্ট বাক্স।
চন্দ্রিমা অবাক হয়ে বলল, ওগুলো কী বাবা!
অঙ্কুর প্রথম বক্সটা খুলতেই বেরিয়ে এল সোনার গিনি। আরেকটা বক্সে বেশ কিছু চিঠি। বেশিরভাগ চিঠি কোড ওয়ার্ডে লেখা।
সুশোভনবাবুর চোখে জল।
চন্দ্রা, ডিসুজারা প্রকৃতপক্ষেই বাঙালি ছিলেন রে। তুই কী বললি, ওঁরা পোর্তুগিজ ছিলেন! বাংলা লুঠ করতেই হয়তো এসেছিলেন এদেশে! কিন্তু তারপর বাংলার মাটিকে ভালোবেসে রীতিমত বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। সম্ভবত মিস্টার রবার্ট ডিসুজার বাবা স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ইংরেজ কোম্পানিতে চাকরি করতেন অথচ স্বদেশিদের সাহায্য করতেন অর্থ দিয়ে। চিঠির অক্ষরে পরিচিত কয়েকজন স্বদেশি নেতার নামেরও উল্লেখ আছে। ইংরেজদের ফিটন গাড়িতে সাহেবের অস্ত্রশস্ত্র লুঠ করার একটা নকশাও রয়েছে কাগজে আঁকা। আরেকটা চিঠিতে মেয়েদের চুলের সোনার কাঁটা আটকানো আছে।
চন্দ্রিমা বলল, বাবা এটা হয়তো কোন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সোনার কাঁটা। সাজসজ্জা যাঁদের কাছে অর্থহীন ছিল। দেশকে স্বাধীন করে তোলবার মন্ত্রেই যাঁরা দীক্ষিত ছিলেন।
সোনার চুলের কাঁটা দিয়ে চিঠিটাকে এমনভাবে ভাঁজ করা আছে যে দেখে মনে হবে কোনো কুমারী হৃদয়ের প্রেমপত্র। কিন্তু খুলতেই দেখা গেল সেই আগুন জ্বালানো বাণী…বন্দে মাতরম। নীচে লেখা—
‘আমার সমস্ত অলঙ্কার প্রদান করিলাম দেশমাতৃকার উদ্দেশ্যে।’
—সীমন্তিনী দাশগুপ্ত
চন্দ্রিমা বলল, বাবা এই নামটা আমরা ইতিহাসের কোথাও পড়িনি তাই না? অমরত্ব লাভ করেনি কত নাম। অথচ তাঁদের অবদান লুকিয়ে আছে এই স্বাধীনতার পিছনে।
সুশোভনবাবু বললেন, হ্যাঁ, আর এই যে রবার্টের পরিবার খাঁটি ভারতপ্রেমী ছিলেন, এটা তো আজ এই পিয়ানোটা না পেলে জানতেই পারতাম না। সুরবিহীন পিয়ানোটা কত বছর আগেকার ইতিহাস বহন করে চলেছে বলত!
অঙ্কুর আরেকটা বাক্স এনে বলল, বাবা এতেও গোল্ড আছে।
চন্দ্রিমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তার মানে রবার্ট ডিসুজা জানতেন সব। হয়তো ছেলে নিঃস্ব করবে বুঝেই এগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন। যাতে আরিয়া ডিসুজার অর্থাভাব না হয়। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকে আচমকা মারা যান বলেই বলে যেতে পারেননি।
সুশোভনবাবু বললেন, বুঝলি চন্দ্রা, আমার দৃঢ় ধারণা কাল ও বাড়িতে কোনো বাইরের ডাকাত ঢোকেনি। ওই সুধীরই রাতে তল্লাশি চালিয়েছে। হয়তো ওর কাছে খবর ছিল ডিসুজাদের বাড়িতে সম্পত্তি আছে। তাই বাড়িটা কিনে নিয়েও মিসেস ডিসুজাকে থাকতে দিয়েছিল। আর সমস্ত আসবাব নিলামে তোলার নাম করে সবকিছু খুঁজে দেখেও নিয়েছে। আজকে দুপুরে এই পিয়ানোটা নিলামে উঠত। আর কিছুই অবশিষ্ট নেই ওবাড়িতে। তাই সুধীর বাকি ঘরগুলো তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল।
অঙ্কুর বললো, বাবা এই সম্পত্তি কী পুলিশে দেওয়া উচিত?
সুশোভনবাবু বললেন, এর মালিক আমরা নই অঙ্কুর। মিসেস ডিসুজার সম্পত্তি এটা। উনি যা ভালো বুঝবেন করবেন। চন্দ্রিমা আজ বিকেলে গিয়ে ওঁকে নিয়ে চলে আয়। ওঁকে হয়তো সুধীর এবারে রাস্তায় বের করে দেবে।
চন্দ্রিমা সুধীরবাবুর সামনে গিয়ে আরিয়াঠাম্মাকে নিয়ে যেতে চাই বলতেই ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ নিয়ে যান। আমিও এ বাড়ির খদ্দের দেখেছি। কয়েকদিনের মধ্যেই এ বাড়ি বিক্রি করে দেব প্রমোটারকে। গুজবে কান দিয়ে এ বাড়ি কিনে আমি বড় লোকসান করেছি। বিক্রি করে দেব। ওঁর থাকার জায়গা নেই। ওঁকে কোথায় রাখব সেটাই ভাবছিলাম।
মিসেস ডিসুজা চিঠিগুলো ঘাঁটছিলেন। হাত বোলাচ্ছিলেন। অস্ফুটে বললেন, আমার শ্বশুরমশাই গোপনে স্বদেশীদের সাহায্য করতেন বলে আমারও মনে হত। কিন্তু কখনো বুঝতে দেননি।
চন্দ্রিমা বলল, ঠাম্মি চিঠিগুলো আমার কাছে রাখব? ওই চিঠিগুলোর মধ্যে কত বিপ্লবীর হস্তাক্ষর আছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে ওগুলো দেখলে।
মিসেস ডিসুজা বললেন, নিশ্চয়, তুমি রাখো। পিয়ানোটার গায়ে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে আর্দ গলায় বললেন, ওই জন্যই রবার্ট বলত, পিয়ানোটা কখনো বেচবে না। ওই তোমায় বুড়ো বয়েসে খাবার জোগাবে। কাউকে হাত দিতে দিত না এটাতে। রবার্ট আমার সব ব্যবস্থা এভাবে করে রেখে গিয়েছিল জানতেও পারিনি।
সুশোভনবাবুর হাতে বাক্সটা তুলে দিয়ে মিসেস ডিসুজা বললেন, আপনার ওল্ডএজ হোমকে আরও বড় করুন। আমি আজ থেকে ওখানেই থাকব।
অঙ্কুর বললো, দেখো, ভদ্রমহিলার চোখেমুখে কী তৃপ্তি! আত্মসম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারবেন ভেবেই উনি আনন্দিত।
শোনো চন্দ্রিমা, এই পিয়ানোটা আমি সারিয়ে আনব। আমাদের অ্যানিভার্সারী গিফট। চন্দ্রিমা হাসি মুখে বলল, আরিয়াঠাম্মির হাসিটাই আমার উপহার অঙ্কুর। আমার সব বায়নায় তোমাকে পাশে পাই বলেই আজ একজনের মুখে হাসি ফোটাতে পারলাম। পিয়ানোর সুরের মতোই নির্মল এই হাসি।
মিসেস ডিসুজা নিশ্চুপ পিয়ানোর সামনে বসলেন, আঙুল ছোঁয়ালেন পিয়ানোর রিডে। গুনগুন করে গাইলেন—
I cried a tear
For nobody but you
I’ll be a lonely one, if you
Should say we’re through…
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন