ভালোবাসা মিসিং – অর্পিতা সরকার

অর্পিতা সরকার

এই নিশা, আন্টিকে আমার খুব ভালো লাগে জানিস। কী সুন্দর মা সুলভ একটা মানুষ। নিশা ঠোঁটের কোণে হাসি জমিয়ে বলল, হ্যাঁ আমার মা তো ভালোই। মায়েরা যেমন হয় আর কি। তবে তোর মাকে আমার অন্যরকম লাগে। মনে হয় হাঁ করে তাকিয়ে দেখি। শ্রেয়ান হেসে বলল, কেন রে সুন্দরী বলে? তোদের মেয়েদের যে সৌন্দর্যের প্রতি কিসের এত নেশা বুঝি না বাবা।

নিশা সাইকেলের বেলটা জোরে বাজিয়ে বলল, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বলে। কী সুন্দর করে একা হাতে তোদের সংসারটা সাজিয়েছেন। শ্রেয়ান বলল, সে আর কী করা যাবে বল? ইগো বাঁচাতে ডিভোর্স নিয়েছিল তো তাই একাই কাটাতে হবে বাকি জীবনটা। নিশা বেশ বুঝতে পারে শ্রেয়ানের মধ্যে একটা চাপা রাগ আছে ওর মায়ের প্রতি। কিন্তু নিশার ভারী মিষ্টি লাগে শতাব্দী আন্টিকে। ঠিক যেন ভোরের শিউলি ফুলের মতো তাজা। কোনো গোঁড়ামি নেই, কুসংস্কার নেই ঠিক যেন প্রাণখোলা দক্ষিণা বাতাস।

যদিও ক্লাস ইলেভেনেই শ্রেয়ানের সঙ্গে পরিচয় নিশার। এর আগে ও পড়ত গার্লস স্কুলে আর শ্রেয়ান বয়েজে। তাই ওর মুখ চেনা থাকলেও বন্ধুত্ব তেমন ছিল না। এখন একই স্কুলে দুজনে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হওয়ায় মৌখিক আলাপটা বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে। যদিও শ্রেয়ানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া মুখের কথা নয়। একেবারে চুপচাপ ছেলে শ্রেয়ান। অকারণে হৈহট্টগোল করা ওর একেবারে অপছন্দ। ক্লাসের কারোর সঙ্গেই অতিরিক্ত কথা বলে না ও। টিফিন টাইমে গল্পের বই পড়ে। কারোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না ঠিকই কিন্তু নিজেকে একটা গণ্ডির মধ্যে ঘিরে রাখে। সকলের সঙ্গেই একটা অদ্ভুত দূরত্ব বজায় রেখে চলে ও। তাই কারোর সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি ওর। নিশার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু বোধহয় এটাই ছিল। শ্রেয়ানের এমন নির্লিপ্ত, ঠান্ডা ব্যবহারই বোধহয় নিশাকে একটু একটু করে টেনে নিয়ে গেছে শ্রেয়ানের দিকে। কিছুদিন মেশার পরে নিশা বুঝেছে শ্রেয়ান একটা ক্ষোভ পুষে রেখেছে মনের মধ্যে। নির্দিষ্ট কাউকেই দোষারোপ করে না ও। কিন্তু এ পৃথিবীর সবকিছুর ওপরেই যেন ওর অহেতুক আক্রোশ। সেদিন নিশার কাকার ছেলের জন্মদিন ছিল। ভাইয়ের বন্ধুরা নিমন্ত্রিত ছিল। নিশার তরফ থেকে একমাত্র নিমন্ত্রিত ছিল শ্রেয়ান। শ্রেয়ান অবশ্য নিমন্ত্রণ শুনেই গুটিয়ে গিয়ে বলেছিল, হইট্টগোলের বাড়িতে আমি বড্ড আনইজি ফিল করি রে! নিশা বলেছিল, জানি তো পছন্দ করিস না। তবুও তোকে বন্ধু ভাবি তাই নিমন্ত্রণ করলাম, ইচ্ছে হলে আসিস।

নিশার স্থির বিশ্বাস ছিল শ্রেয়ান আসবে না। কিছুতেই নিজের ওই একাকীত্বের মোড়কে মোড়ানো খোলসটা ও ভাঙবে না। কিন্তু নিশার ভাবনাকে মিথ্যে করে দিয়ে হাজির হয়েছিল শ্রেয়ান। গেটের বাইরে থেকে ফোন করেছিল নিশাকে।

নিশা ফোনটা রিসিভ করেই বলেছিল, জানতাম আসবি না। তাই আর জোর করিনি।

শ্রেয়ান ধীর গলায় বলেছিল, আমি তোর গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। তুই বললে ফিরে যেতেও পারি। নিশা গেট খুলে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। হাতে একটা গিফটবক্স নিয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল শ্রেয়ান। নিশাকে দেখে বলেছিল, ভিতরে কী যেতেই হবে? তুই তো দেখলি আমি তোর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলাম। এতেই হবে না?

নিশা মুচকি হেসে বলেছিল, উঁহু হবে না। বাড়ির ভিতরে চল, আমি সকলকে বলে রেখেছি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতির ডাইনোসর দেখাব, যে কারোর সঙ্গে মিশতে ভালোবাসে না। চল চল শিগগির ভিতরে চল। নিশার কথা বলার ভঙ্গিমায় গম্ভীর শ্রেয়ান হেসে ফেলল।

ওর ভাইয়ের হাতে গিফ দিয়েই বুঝল অনুষ্ঠানটা নেহাতই ঘরোয়া অনুষ্ঠান। ওর ক্লাস সেভেনে পড়া ভাইয়ের কয়েকটা বন্ধু উপস্থিত হয়েছে মাত্র। নিশা আর ওর কাকাদের বলতে গেলে একটাই বাড়ি। শুধু আলাদা দুটো সংসার মাত্র। নিশার মা, কাকিমা খুব যত্ন করে শ্রেয়ানকে বসিয়ে খাওয়ালেন। নিশার মা বললেন, তোমার কথা নিশা প্রায় বলে। তোমার মায়ের কথাও খুব বলে। সেদিন পত্রিকাতে তোমার মায়ের ইন্টারভিউটাও পড়ে শোনাল ও। ওনার ছবি দেখে তো আমি ভাবতেই পারিনি ওনার এত বড় ছেলে আছে। নিশা বলে, মা তুমি বুড়িয়ে যাচ্ছ আরেকটু যত্ন নাও শরীরের। আর হয়ে ওঠে না বুঝলে বাবা।

কী সুন্দর ঘরোয়া কথাবার্তা। ঠিক যেন মায়ের মতো। চোখের সামনে ভেসে উঠল, ওর ভীষণ স্টাইলিশ জিন্স, টিশার্ট পরা মায়ের ছবিটা। রোজ ভোরে উঠে ট্রেডমিলে না ছুটলে ওর মায়ের দিন শুরুই হয় না। তারপরে নিউজ পেপার নিয়ে জমিয়ে গ্রীন-টির কাপে চুমুক। মাসে একবার পার্লারে যাওয়া, নিজের পরিচর্যা করা…কেন যে এত নিজেকে ইম্পোর্টেনস দেয় শতাব্দী সেন, সেটা অবশ্য আজও বুঝে উঠতে পারল না শ্রেয়ান। না ওকে কখনও অবহেলা করেনি ওর মা। কিন্তু অন্যদের মায়ের মতো সাধাসিধে নয় ওর মা। কাউকে ঠিক বোঝাতে পারবে না শ্রেয়ান, কিন্তু সমস্যা তো একটা আছেই। নিজেকে নিয়ে এত সচেতন বলেই হয়তো রাগ হয় শ্রেয়ানের।

নিশা বলল, এই কী এত ভাবিস রে সারাদিন তুই?

শ্রেয়ানের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। নিশাকে একটু এগিয়ে দেবার জন্যই এসেছে শ্রেয়ান। কিন্তু নিশার মুখে একনাগাড়ে মায়ের প্রশংসা শুনে বড্ড বিরক্ত লাগছিল। শ্রেয়ান লক্ষ্য করেছে, নিশা যতক্ষণ ওদের বাড়িতে ছিল, অপলক তাকিয়ে ছিল ওর মায়ের দিকে। ওর চোখে ছিল সম্ভ্রমের দৃষ্টি। মাকে সামনে থেকে দেখা, ওর সঙ্গে আলাপ করাটা যেন নিশার স্বপ্ন ছিল। ওর ভাইয়ের জন্মদিনের দিনেই বলেছিল নিশা একদিন তোদের বাড়িতে নিয়ে যাবি? আজ শ্রেয়ান নিয়ে এসেছিল ওকে।

শ্রেয়ানকে বুঝে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার মানুষের সংখ্যা বড্ড কম এ পৃথিবীতে। নিশা ওই কম সংখ্যার মধ্যে একজন। আরেকজন আছেন ওর ড্রয়িং টিচার। খুব ছোট থেকেই শ্রেয়ানের স্বভাব বোঝেন বলেই হয়তো শ্রেয়ানকে আপন করে নিয়েছেন।

সেই নিশা যখন একনাগাড়ে মায়ের প্রশংসা করেই চলেছে তখন একটু হলেও বিরক্ত হচ্ছে ও। আসলে শতাব্দী সেনের স্ট্রাগলের ইন্টারভিউ শুনতে শুনতে ও জাস্ট ক্লান্ত। শ্রেয়ান জানে ওর মা একজন সেলিব্রিটি। একটা নামী পত্রিকার সম্পাদিকা। কলেজের প্রফেসর, সঙ্গে মোটিভেশনাল স্পিকার। মায়ের ”লড়াইটা চলবে” ইউটিউবের ভিউয়ার্সের সংখ্যা এখন দশ লাখ। তাই ওর মা যে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে খুব সহজেই সেটা ও খুব ভালো করেই জানে।

লোকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে শতাব্দী সেনের স্পিচ। কিন্তু ওর একটা মাত্র কাছের বন্ধু নিশার মুখেও সেই একই পুরোনো কথার পুনরাবৃত্তি শুনতে বড্ড বিরক্ত লাগছে ওর।

শ্রেয়ান বলল, বুঝবি না বুঝলি। আসলে তোর মায়ের সবটুকু অ্যাটেনশন পেয়ে যাস তো ইজিলি তাই আমার কষ্টটা ঠিক বুঝবি না। আসলে কী জানিস মা শব্দটায় একটু ত্যাগ, বেশি পরিমাণে মমতা, নিজের প্রতি অবহেলা এগুলো থাকলেই বোধহয় ভালো লাগে। যেমন তোর মা বা কাকিমাকে দেখলাম ওরকম। নিশা বোকার মতো তাকিয়ে বলল, কী সব ভুলভাল বকছিস বলতো বুঝলাম না। তোর মা কী তোকে ভালোবাসে না?

শ্রেয়ান সাইকেলটা একটু জোরে প্যাডেল করে বলল, এক কথায় উত্তর দেব বললেই তো সব প্রশ্নের উত্তর হয় না নিশা। তাই এটার উত্তরও আমি তোকে একটি বাক্যে দিতে পারব না। তুই জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে, হ্যাঁ বাসে। খুবই ভালোবাসে। কিন্তু একটা সমস্যা দিনরাত পিছু ধাওয়া করে আমার, সেটা কাউকে বোঝাতে অক্ষম আমি। যাকগে, আন্টিকে বলিস আমি আরেকদিন যাব তোদের বাড়ি। নিশা বলল, সে তোর যেদিন ইচ্ছে চলে যাস। মা তো গুড বয়ের উদাহরণে অলওয়েজ তোর নামটাই উচ্চারণ করে।

শ্রেয়ান বলল, কাল স্কুলে দেখা হবে। চল বাই।

নিশা চলে গেল নিজের বাড়ি। শ্রেয়ান ফিরে এল।

বাড়িতে ঢুকতেই মা বলল, শ্রেয়ান তোর এই বন্ধুটি কিন্তু দারুন মিশুকে। এর পাল্লায় পড়ে তুইও যদি একটু বকবক করতে পারিস তো অমন ভ্রু কুঁচকে দিনরাত থাকবি না। নিশাকে আমার দারুণ লেগেছে। খুব জলি মেয়ে।

শ্রেয়ান নির্লিপ্তভাবে বলল, হ্যাঁ ওরও তোমাকে ভাল লেগেছে বলল। হালকা হেসে মা বলল, শ্রেয়ান, নিশাকে তোর কেমন লাগে রে?

শ্রেয়ান একটু থতমত খেয়ে বলল, বন্ধু হিসাবে মন্দ নয়। তবে বড্ড বকবক করে। মা হেসে বলল, তা মন্দ কী? সবাই কি তোর মতো গম্ভীর হবে নাকি?

মায়ের দিকে নির্নিমেষ তাকাল শ্রেয়ান। নিখুঁত প্লাক করা ভ্রু। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। চুলে নরম ব্রাউন কালার করা। কানে দুটি হিরের টপ। পরনে লংস্কার্ট আর টপ। ঠিক যেন কলেজগার্ল। শ্রেয়ানকে অনেকেই বলেছে, তোর মাকে মনে হয় তোর দিদি।

নিশার মাও হয়তো শতাব্দী সেনের সমবয়সিই হবেন। নিশাদের অবস্থাও মন্দ নয়। বেশ উচ্চবিত্ত ফ্যামিলি। তারপরেও নিশা বলে, ওর মা নাকি নিজে না খেয়ে ওদের দিয়ে দেয় ভালোমন্দটা। পার্লারেও যায় না। মুখেও নিয়ম করে অ্যান্টি এজিং ক্রিম লাগায় না। কই প্রফেসর শতাব্দী সেন তো এমন নয়। বরং তার নিজস্ব খাবার রুটিন আছে। হালকা, স্পাইসি নয় এমন খাবার খায়। সৌন্দর্য ধরে রাখতে এত কিসের পরিশ্রম কে জানে। শ্রেয়ান যা চায় মা সব দেয়। কিন্তু কখনো এমন তো বলে না, তুই খেলেই আমার খাওয়া। যেমন নিশার মা সেদিন বললেন, তোমরা খেলেই আমার পেট ভরে যাবে।

কেন শ্রেয়ানের মা সকলের থেকে এত আলাদা। নিজেকে এত ভালোবাসাটাই শ্রেয়ানের সবচেয়ে বিরক্তির কারণ।

সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছে মা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। লেখালিখি করছে, নয়তো পত্রিকা সম্পাদনার কাজ করছে, নয় কলেজের খাতা দেখা…তারমধ্যেই শ্রেয়ানের হোমওয়ার্ক করিয়ে দিয়েছে মা। বা স্কুলের প্রজেক্ট করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শ্রেয়ান কখনো দেখেনি ওর মা ছেলের ভালোলাগার জন্য নিজের সব কিছু ত্যাগ করেছে। অদ্ভুত স্বভাব মহিলার। আবার গলাবাজি করে বলে, আমি তোর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও বড্ড ভালোবাসি রে শ্রেয়ান। তাই নিজেকেও যত্ন করি।

নিজের ঘর থেকেই শুনতে পেল শ্রেয়ান, ইউটিউবে লাইভে এসেছে মা নিজের চ্যানেলে।

লাইভটা খুলে বসল ও নিজের মোবাইলে।

শতাব্দী সেন বলছে, ‘ইচ্ছেশক্তিটাকে বাঁচিয়ে রাখুন যত্নে। ইচ্ছেশক্তিই আপনাকে এগিয়ে দেবে অনেকটা পথ। মনে রাখবেন, কোনো কিছুই সহজে পাওয়া যায় না। হাসিল করতে হয়। লড়ে নিতে হয়, তাই লড়াইটা চলবে।’

মায়ের লাইভ দেখতে দেখতেই অন্যমনস্ক হয়ে গেল শ্রেয়ান।

শ্রেয়ান তখন বছর ছয়েকের ছেলে, কিন্তু কিছু কথা স্মৃতির পাতায় চিরস্থায়ী দাগ কেটে যায়। মা কলেজে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই বাবা আর ঠাকুমা আলোচনা করেছিল, ধন্যি মেয়েমানুষ বটে, নীলষষ্ঠীর দিনেও কলেজে ছুটল। ছেলেটার প্রতি কোনো মায়াদয়া নেই রে শুভ। শ্রেয়ানের বাবা মানে শুভময় মায়ের কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ সকালে মনে করিয়েছিলাম তোমার কথা মতো। বলল, আমায় ছেলে নিজের ভবিষ্যৎ নিজে গড়ে নিতে পারবে। আমায় খালি পেটে থেকে, উপোষ করে ওর ভবিষ্যৎ গড়তে হবে না। বরং আমি খালি পেটে থাকলে, অসুস্থ হলে ওর দায়িত্ব এ বাড়ির কেউ নেবে না। শ্রেয়ানের খুব কষ্ট হয়েছিল। মনে হয়েছিল মা ওকে একটুও ভালোবাসে না। মাকে বাড়ির কেউ পছন্দ করত না। ঠাম্মা, দাদু, বাবা কেউ না। মা যেন কেমন সৃষ্টিছাড়া। কিন্তু রাতে যখন শ্রেয়ান মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাত তখন মায়ের গায়ের গন্ধটা ওকে অনেকটা শান্তি দিত। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, বাবান সবাইকে সম্মান করবে। বাবা, দাদু, ঠাম্মা সকলকে।

তার এক বছরের মধ্যেই কী যে হল, মা ও বাড়ি ছেড়ে চলে এল শ্রেয়ানকে নিয়ে। না মামার বাড়িতেও যায়নি মা। শ্রেয়ান আর মা একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া ছিল কিছুদিন। তারপর এই নতুন ফ্ল্যাটটা কিনে নিয়েছিল। মাসে একবার করে একটা নির্দিষ্ট দিনে বাবা নিয়ে যেত ওই বাড়িতে। সবাই কত আদর করত ওকে। আবার ফিরিয়ে দিয়ে যেত মায়ের কাছেই। মাকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছে শ্রেয়ান, আমরা আর ওই বাড়িতে ফিরব না মা?

মা হেসে বলেছে, না রে শ্রেয়ান। বড্ড বেমানান আমি ওই বাড়িতে। ওই মহিলা মানেই কোনোমতে জীবনটা অতিবাহিত করার নীতিতে নিজেকে ফেলতে পারলাম না রে। চেষ্টা করেছিলাম জানিস তো, শুধু তোর জন্যই চেষ্টা করেছিলাম। তারপরে বুঝলাম, তোর বাবা একদম ঠিক বলেছে, আমি বড্ড স্বার্থপর। আমি নিজেকেও ভালোবাসি এটাই আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ। আমি নিজেকে সুন্দর রাখতে চাই, নিজেকে সুস্থ রাখতে চাই সেটাও অপরাধ। শ্রেয়ানের ছোট্ট মাথায় অত ঢোকেনি। শুধু বুঝেছিল, ওরা আর ফিরবে না ওই বাড়িতে।

শ্রেয়ানের মা প্রাইভেসি, নিজস্ব প্রাইভেট টাইম এসবে বিশ্বাসী। তাই নতুন ফ্ল্যাটে এসেই শ্রেয়ানের মনের মতো করে ওর পছন্দমত জিনিস দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল ওর নিজের ঘরটা। আস্তে আস্তে শ্রেয়ানও অভ্যস্ত হয়ে গেল ওই মাসের একটা রবিবার ওই বাড়িতে যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে।

ওই বাড়িতে গেলেই ঠাম্মা, বাবা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করত, শতাব্দী সেনের দৈনিক রুটিন। কী করে সে? আর কোনো পুরুষ আসে কিনা তাদের বাড়িতে এসবও জিজ্ঞেস করত ঠাম্মা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে শ্রেয়ান বাড়ি ফেরার পরে মা বলতো, কী রে আজ তো খুব আদর খেলি ঠাম্মা, বাবার কাছে। আমি বলব আজ তোকে ঠাম্মা কী খাইয়েছে?

নিশ্চয়ই ফ্রায়েড রাইস আর মটন তাই না?

তোর ঠাম্মা কিন্তু মটনটা দারুন রাঁধে বুঝলি। মায়ের আলাদা কোনো কৌতূহল ছিল না। বাবার বা ঠাম্মার নামে কোনো অভিযোগ ছিল না। মা ব্যস্ত থাকত উপন্যাসের চরিত্রে। নয়তো পত্রিকার প্রচ্ছদে। আর পাঁচজনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই মাটাকে কেমন যেন অচেনা মনে হত শ্রেয়ানের।

এভাবেই কোনো কারণ ছাড়াই একটা অদ্ভুত অচেনা রাগ জমছিলো মায়ের ওপরে। আজ নিশার প্রশংসা শুনে রাগটা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল যেন। মায়ের লাইভ শেষ হল।

পড়ার টেবিলে বসতেই মা এসে কফি দিয়ে গেল।

যাওয়ার সময় বলে গেল, আজ রাতে তোর পছন্দের ডিনার হচ্ছে… সারপ্রাইজ।

শ্রেয়ানের চুলে হালকা হাত বুলিয়ে চলে গেল মা।

মায়ের হাঁটাচলা, কথাবলা সবকিছুর মধ্যেই একটা ইউনিক ব্যাপার আছে। এটাতেই আপত্তি শ্রেয়ানের। আক্ষেপও বটে। কেন যে ওর মা আর পাঁচজনের মতো সাধারণ হল না!

ডিনারে বসেই দেখল বাটার নান আর চিকেন বানানো হয়েছে। শ্রেয়ানের এটা ফেভারিট ডিস। তবুও আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। বারবার একটা কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, ওর বেস্টফ্রেন্ড নিশাও ওকে বুঝল না। সেও মায়ের রূপে-গুনে মুগ্ধ হয়ে গেল?

খাবার টেবিলে মা একদম অন্যরকম। সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে ডিনার সার্ভ করতে পছন্দ করে। যেন মনে হয় বাড়িতে কোনো গেস্ট এসেছে। শুধু শ্রেয়ানকে নয়, নিজের প্লেটেও মা খুব যত্ন করেই খাবার নেয়। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। চিকেনের দুটো লেগপিসের একটা দিল শ্রেয়ানকে আরেকটা নিজে নিল। শ্রেয়ান লক্ষ্য করছিল। সেদিন নিশাদের বাড়িতে দেখেছে ওর মা-কাকিমারা নিজেদের জন্য না রেখেই সবাইকে দিয়ে যাচ্ছিল। মায়েদের ওই আন্তরিকতাটুকু কোনোদিন পেল না শ্রেয়ান।

দিনগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিল শ্রেয়ানের। শুধু নিশার সঙ্গে বন্ধুত্বটা আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল। নিশার সমস্ত বিষয়ে যেন একটা অচেনা অধিকারবোধ জন্মাচ্ছিল। এই যেমন নিশার ফ্রেন্ডলিস্টে কে কে স্থান পাবে সেটা ঠিক করে দিচ্ছিল শ্রেয়ান। নিশা কী পরবে না পরবে তার উপরেও বিধিনিষেধ দিয়েছিল। নিশা মুচকি হেসে বলেছিল, তুই এত পজেসিভ কেন রে?

শ্রেয়ান অন্যদিকে তাকিয়ে বলেছিল, জানি না। শুধু জানি তুই সকলকে আমায় জায়গায় বসাবি না ব্যস। এইচ এস এক্সামের পরে অখন্ড অবসরে নিশাকে উদ্দেশ্য করে বেশ কয়েকটা চিঠিও লিখে ফেলেছিল শ্রেয়ান। কিন্তু দেওয়া হয়ে ওঠেনি। নিশার বাড়িতে শ্রেয়ানের অবাধ যাতায়াত। ব্রিলিয়ান্ট, ভদ্র ছেলে বলেই নিশার মায়েরও খুব পছন্দ শ্রেয়ানকে। রিনা আন্টিকেও খুব ভালো লাগে শ্রেয়ানের। বাঙালি মায়ের প্রতিমূর্তি যেন।

কপালে লাল টিপ, হালকা রঙের শাড়ি, হাতে শাঁখা,পলা. .সন্তানরা খেলেই নিজের খাওয়া। তাদের সুখেই নিজের সুখ ভাবা একজন নারী। নিজেকে নিয়ে কখনও কিছুই বলতে শোনেনি রিনা আন্টিকে। শুধুই পরিবারের সকলের ভালোমন্দের গল্প করেন।

শ্রেয়ান নিশাকে বলেওছিল.. তোদের বাড়ি আমি ঘনঘন যাই তার কারণ আন্টির আকর্ষণে।

নিশা হেসে বলেছিল, সেম হিয়ার। আমিও তোদের বাড়িতে যাই শতাব্দী সেনের আকর্ষণে।

নিশাকে লেখা এলোমেলো চিঠিগুলো দেওয়া হয়নি নিশাকে। বলা হয়নি ওকে শ্রেয়ান ভালোবাসে।

নিশাও অবশ্য বলেনি যে ও শ্রেয়ানকে ঠিক কী চোখে দেখে? শুধুই বেস্টফ্রেন্ড নাকি অন্য কিছু।

উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট আউটের পরেই নিশা বলল, আমি ভাবছি আরেকবার জয়েন্ট দেব। এখন ফিজিক্স অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়ে যাই, তারপর দেখছি। শ্রেয়ান অলরেডি জয়েন্টে ভাল র‌্যাঙ্ক করে ইঞ্জিনিয়ারিং ভরতি হয়েছে।

নিশার কথার সুরেই শ্রেয়ান বলল, তুই ফিজিক্স নিয়েই পড় না। তোকে কে বলেছে জয়েন্টে পাশ করতেই হবে? নিশা হেসে বলল, কেউ বলেনি রে। আমার ইচ্ছে। শ্রেয়ান গম্ভীর হয়ে বলেছিল, আমার ইচ্ছে তুই ইঞ্জিনিয়ারিং নয় জেনারেল লাইনেই পড়াশোনা কর। নিশা মজা করেই বলেছিল, কেন তুই কি আমার অভিভাবক?

শ্রেয়ান অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিল, যদি ভবিষ্যতে হই তাহলে কী তোর আপত্তি আছে?

নিশা হেসে বলেছিল, প্রোপোজ করেই উঠতে পারলি না এখনও আর …

শ্রেয়ান আরেকটু গম্ভীর হয়ে বলেছিল, তুই তো সবটা বুঝিস তাহলে আবার প্রোপোজের কী দরকার?

নিশা ওর সামনে একটা শ্রেয়ানের লেখা চিঠি এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, তাহলে অ্যাটলিস্ট এগুলো আমায় অফিসিয়ালি দিয়ে দে। কেন নিজের কাছে জমিয়ে রেখেছিস?

শ্রেয়ান লজ্জা পেয়ে বলেছিলো, তুই কী করে পেলি?

তোর অনুপস্থিতিতে তোর বাড়িতে গিয়ে। আন্টি আর আমি দুজনে সেদিন কত আড্ডা দিলাম। আন্টি তার লেখালিখি শুরুর সব মজার মজার কথা বলছিল। তারপরেই আমি তোর ঘরে ঢুকেছিলাম। গিয়ে দেখলাম, একটা হলদে ডায়েরিকে যত্ন করে বালিশের নিচে রেখে দিয়েছিস। তারমধ্যে এমন চিঠি কত আছে। আমি এই একটাই নিয়ে এসেছি। যেটাতে তুই লিখেছিস।

নিশা,

তুই আমায় একটুও বুঝিস না। তাও আমি তোকে ভালোবাসি। তুই আমার কাছে থেকেও যেন কয়েকযোজন দূরে, তাও আমি তোকে অনুভব করি….

শ্রেয়ান লজ্জা পেয়ে বলল, তুই ভবিষ্যতে ডাকাতি করতে পারবি জানিস।

শ্রেয়ান ভরতি হল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। নিশা ফিজিক্স নিয়ে।

বেশ চলছিল শ্রেয়ানের জীবনটা। নিশাকে ভালোবেসে, ওকে শাসন করে…কিন্তু ওই যে ওর অসাধারণ মা যখন থেকে নিশার দায়িত্ব নিতে শুরু করল তবে থেকেই নিশা যেন কেমন একটু বদলে যেতে শুরু করল। কদিন আগে শ্রেয়ান নিজের কানে শুনল, মা নিশাকে বলছে, সময় নষ্ট করিস না নিশা। আরেকবার জয়েন্টে বস। আমি বিশ্বাস করি.. তুই পারবি। অসহ্য রাগ হয়েছিল মায়ের ওপরে।

একপ্রকার রাগ করেই মাকে বলেছিল, আমি ও বাড়িতে চলে যাচ্ছি। তুমি বরং আমার কাছ থেকে কী করে নিশাকে কেড়ে নেবে সেটা ঠিক কর।

মা অবাক চোখে তাকিয়ে বলেছিল, কেড়ে নেব? কেন?

আমারও খুব ইচ্ছে ভবিষ্যতে নিশা আমার মেয়ে হয়ে আসুক এ বাড়িতে। সেইজন্যই তো ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি চিন্তিত। তুই ওকে ভালোবাসিস সেটা আমি জানি শ্রেয়ান। নিশাও তোকে ভালোবাসে, তাই তো আমি ওকে সঠিক পরামর্শ দিচ্ছিলাম। এতে কেড়ে নেওয়ার কী হল?

শ্রেয়ান বিরক্ত হয়েছিল। বলতে পারেনি নিশাও ওর মতো ইঞ্জিনিয়ার হোক এটা ও জাস্ট চায় না।

মেয়েদের ঠিক মানায় না সবকিছু।

শ্রেয়ান রাগ করেই নিজের ব্যাগ গুছিয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে চলে গিয়েছিল বাবা আর ঠাম্মার কাছে।

নিশা সারাদিন ধরে কয়েকশো কল করেছিল, রিসিভ করেনি শ্রেয়ান। অদ্ভুত ভাবে শতাব্দী সেনের ফোন আসেনি ওর ফোনে।

দুদিন খুব আদর করেছিল বাবা আর ঠাম্মা। তারপরেই ঠাম্মা বলেছিল, তুই কদিন থাকবি রে এখানে? শ্রেয়ান বলেছিল, আর ফিরব না। ঠাম্মা আর বাবা চমকে উঠে বলেছিল, সেকি কেন? ঠাম্মা ভয়ে ভয়ে বলেছিল, আমাদের তো বয়েস হয়েছে, এত দায়িত্ব কী আমরা নিতে পারি?

বাবাও গম্ভীরভাবে বলেছিল, ডিভোর্সের সময় তোর মা তো বড়মুখ করে বলেছিল, আমার সন্তানের দায়িত্ব আমি নিতে পারি। এখন কী হল, দম ফুরিয়ে গেল? চালাকি করে ছেলেকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে নাকি?

শ্রেয়ানের ঘৃণা করেছিল আর একমুহূর্তও ওই বাড়িতে থাকতে। বুঝতে পেরেছিল, কেন মা এ বাড়ি ছেড়ে কোনোরকম খোরপোষ না নিয়ে চলে গিয়েছিল।

মৌখিক ভালো ব্যবহার করা আর একটা ছেলের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবার মধ্যে একটা বড় ফারাক আছে। ঠাম্মা আর বাবা শ্রেয়ানের আড়ালেই আলোচনা করেছিল, ছেলেকে তার মানে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে চাইছে তাই তো? তাই এ বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। শ্রেয়ান শুনে ফেলেছিল ওদের আলোচনাটা। ফিরে এসেছিল মায়ের কাছে।

মা একটাও প্রশ্ন করেনি। শুধু বলেছিল, তোর যদি আমার সঙ্গে থাকতে বা আমাকে মেনে নিতে খুব কষ্ট হয় তাহলে তোর জন্য একটা রেন্টে ফ্ল্যাট দেখে দিতে পারি। ভেবে বলিস আমায়।

মায়ের মুখের মেকআপ ছাপিয়ে একটা ক্লান্তির ছায়া দেখেছিল শ্রেয়ান। তবে কী মায়ের এই আপাত খুশি খুশি মুখটার পিছনে একটা গভীর যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে?

শ্রেয়ান গম্ভীরভাবে বলল, আমি এখানে থাকলে কী তোমার কোনো অসুবিধা হবে মা?

শতাব্দী সেন ল্যাপটপ থেকে মুখটা তুলে বলল, না তো। অসুবিধা হবে না বলেই তো তোকে গর্ভে ধারণ করেছিলাম। অসুবিধা হবে না বলেই তো ডিভোর্সের সময় তোকে নিজের কাছে রাখবার দাবি জানিয়েছিলাম। অসুবিধা হবে না বলেই তো তোকে কখনো কাছ ছাড়া করতে চাইনি।

কিন্তু আমাকে নিয়ে বোধহয় তোর একটু বেশিই অস্বস্তি হয় তাই না শ্রেয়ান?

তোর মা কেন আর সকলের মতো এঁটো, কাঁটা খেয়েই বলে না, তোর পেট ভরলেই আমার ভরল।

কেন তোর মা সকাল হলেই ট্রেডমিলে দৌড়ায়? কেন পার্লারে যায়? কেন এসব মর্ডান পোশাক পরে? এরকম এত এত প্রশ্নের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে তোর মনে হয়, মা নামক মানুষটার এত শখ থাকবে কেন?

জানিস শ্রেয়ান তোদের ওই বাড়িতেও তোর বাবা আর ঠাম্মার এই একই প্রবলেম ছিল। বউমানুষ তার আবার এত শখ কিসের? সংসার, স্বামী, সন্তানকে বাদ দিয়ে নিজেকে এত গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কী আছে? তোর দোষ নয় শ্রেয়ান। আসলে আমরা ছোট থেকে মায়ের এমন একটা অদ্ভুত প্রস্তর মূর্তি দেখতেই অভ্যস্ত। মা মানেই সে সকলের শেষে খাবে, খিদেতে তার হাজার কষ্ট হলেও সে আগে খাবে না। মা মানেই যে যা বলবে সব মুখ বুজে সহ্য করে নেবে। মা মানেই নিজস্ব সব শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে শুধুই পরিবারের সবার কথা ভাববে। কিন্তু শ্রেয়ান আমি যে তোর মতোই এত কষ্ট করে এত পড়াশোনা করেছিলাম, কষ্ট করে চাকরি পেয়েছিলাম। অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করব সেসবের কী হবে? একটা সন্তান হয়ে যাওয়া মানেই নিজের সবটুকু স্বপ্নকে মেরে ফেলতে হবে? তবেই সে প্রকৃত মা হতে পারবে?

কেন শ্রেয়ান, এরকম হয় না যে আমিও আমার স্বপ্নগুলো পূরণ করছি সঙ্গে তোকেও ভালো করে মানুষ করছি? হয় না এমন?

মায়ের চোখে এই প্রথম জল দেখল শ্রেয়ান। এর আগে পর্যন্ত মাকে ধীরস্থির দেখেছে। অবিচল থেকে সব সিদ্ধান্ত একা নিতে দেখেছে।

শ্রেয়ান, চল্লিশ বছর বয়েস থেকেই মেয়েদের শরীরে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম কম হতে শুরু করে। কোমরে, হাঁটুতে ব্যথা শুরু হয়। কেন জানিস? কারণ মায়েরা আর নিজেদের খাওয়া-দাওয়ার লক্ষ রাখে না। আমার শরীর অসুস্থ হলে তোকে কে দেখবে রে? আমি ছাড়া যে কেউ নেই তোর দায়িত্ব নেবার। তাই সবসময় চেষ্টা করি নিজেকে ফিট রাখতে। এটা কি খুব অন্যায় করি রে?

তোকে না খাইয়ে, তোর শখ না পূরণ করে শুধুই কি নিজের শখ পূরণ করি? বল না শ্রেয়ান?

কত যুগ পরে শ্রেয়ান সেই বাচ্চাবেলার মতো মাকে জড়িয়ে ধরল। মা কাঁদছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শ্রেয়ানের টিশার্টটা ভিজে যাচ্ছে।

মনে হচ্ছে কত বছরের কান্না জমিয়ে রেখেছিল বুকের মধ্যে। জানিস শ্রেয়ান, আমি আজও মনে করি নিজেকে ভালোবাসা, সুন্দর রাখা দোষের নয়। এতে মানুষের শরীর-মন দুই ভালো থাকে।

শ্রেয়ান মাকে জড়িয়ে ধরেই বললো, আমি ভুল ছিলাম মা। বড্ড বোকা আমি। সব মানুষ তো এক নয়। তুমি নাহয় একটু আলাদা হলেই। কেন যে চেনা গতের বাইরে কিছু দেখলেই আমাদের চোখে লাগে কে জানে!

সারাটা বিকেল অপেক্ষা করল শ্রেয়ান, নিশা ফোন করবে। ফোন নিশ্চয়ই করবে…কিন্তু ওর মেসেজ সিন করলেও রিপ্লাই দিল না নিশা।

সন্ধেবেলা চা খেতে খেতে শ্রেয়ান লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলল, নিশা কী তোমায় ফোন করেছিল আজকে?

মা মিষ্টি হেসে বলল, হ্যাঁ করেছিল তো। জিজ্ঞেস করছিল, হেয়ার স্পা করাবে কোন কোম্পানির করাবে সেটাই।

শ্রেয়ান গম্ভীরভাবে বলল, আমার মেসেজের উত্তর দেয়নি নিশা। তুমি কী জানো? ও দায়িত্ব নিয়ে আমায় অপমান করছে।

মা হেসে বলল, মুশকিল কী বলত শ্রেয়ান তুই মনে করিস ইগনোর করার, অপমান করার অধিকার তোর। শুধু তোর।

যেদিন তুই এবাড়ি থেকে চলে গেলি সেদিন নিশা এসেছিল। আমার সামনে বসে অন্তত পঞ্চাশটা কল করে গেছে তোকে। মেসেজ করে গেছে। তুই একটাও রিসিভ করিসনি। একটাও মেসেজের আনসার দিসনি, তাই না শ্রেয়ান?

সবসময় এটাই কেন ভাবছিস যে নিশা তোর অভিমান ভাঙাবে? এটাকে আবার ভালোবাসা বলে গর্ব করছিস? বরং মেল ইগো স্যাটিসফ্যাকশন নাম দে। ভালোবাসা একতরফা হয় না।

শ্রেয়ান মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল অপলক। মায়ের যুক্তিগুলো খুব নিখুঁত। এর উপরে কথা বলার কিছু খুঁজে না পেয়েই নিশার নম্বরটা ডায়াল করল শ্রেয়ান। মা বলল, একান্ন বার করবি কল। আমি ওকে বলে দিয়েছি একান্ন নম্বর কলটা রিসিভ করতে। মায়ের ঠোঁটে মুচকি হাসি।

শ্রেয়ান গুনে গুনে এতগুলো কল করার পরে হাঁপিয়ে গিয়েছিল। একত্রিশ নম্বর কলে ফোনটা রিসিভ করে নিশা বলল, আরও কুড়িটা বাকি আছে তোর।

শ্রেয়ান অস্ফুটে বলল সরি। আজ একবার দেখা করবি? সেই তোর পছন্দের ব্লু টপটা পরে। যেটা আমি পরতে বারণ করেছিলাম ওইটা পরে।

পার্কের নিস্তব্ধতা প্রথম ভাঙল শ্রেয়ান। নিশা, তুই জয়েন্টটা অবশ্যই দে। আমি সবরকম হেল্প করব।

আর আজ থেকে প্লিজ আমাকে ভয়ে ভালোবাসিস না, জোর করে ভালোবাসিস না, মন থেকে বাসিস। আসলে কী বলত জোর করে কোনো সম্পর্কের সেতু বাঁধলে সেটা ভেঙে যেতে বাধ্য। তুই তোর নিজের ইচ্ছে মতোই চলিস, শুধু অবসরে আমাকে ভালোবাসিস একটু।

নিশা বলল, শ্রেয়ান তুই জানিস তুই আমার থেকেও বেশি কষ্ট দিয়েছিস আন্টিকে। তুই আন্টিকে ওই বাড়ির চোখেও ছোট করেছিস। মাথা নিচু করে শ্রেয়ান বলল, জানি।

জানিস নিশা এটা আমাদের বড্ড খারাপ ধারণা যে মা মানেই সে ত্যাগের প্রতিমূর্তি হবে। সে যে একটা স্বতন্ত্র মানুষ, তার যে চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে, ইচ্ছে থাকতে পারে এটাই যেন ভুলে যাই। মনে হয় মা মানে শুধুই সকলের জন্য নিজের সব খুশির বলিদান দেবে।

নিশা বলল, জানিস শ্রেয়ান, আমি চাই আমার মা আন্টির মতো হোক। নিজেকেও ভালোবাসুক, নিজেরও যত্ন করুক। কিন্তু মা কিছুতেই শোনে না। হয়তো মায়ের চোখেও ওই চিরাচরিত মায়ের রূপটাই আঁকা হয়ে আছে। তাই নিজেকে বদলাতে মায়ের বড্ড আপত্তি।

শ্রেয়ান আগামী পরশু আন্টির জন্মদিন। এবারে আমরা ওটা সেলিব্রেট করব কেমন?

শ্রেয়ান নিশার হাতটা ধরে বলল, প্রতিবছর আমার বার্থডেতে মা খুব জাঁকজমক করে জানিস। আর নিজের বার্থডেতে মা একটা নতুন পোশাক পরে আর একটা বই কেনে। বইয়ের ওপরে লেখে মাই বার্থ ডে গিফ। মা নিজেই নিজেকে গিফ করে। কেন যে এতদিন মনে হয়নি মাকে একটা গিফ করা উচিত কে জানে!

নিশা বলল, এবারে করবি। এমন কিছু দেরি হয়ে যায়নি। চল বাড়ি ফিরতে হবে।

‘প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা

একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা।’ মা গান গাইছে গুনগুন করে।

শ্রেয়ান পিছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল, You are the best mom in the world.

মা বলল, শুধু এই কথাটা শুনব বলে অপেক্ষায় ছিলাম। ডিভোর্সি, অ্যাডজাস্ট করতে পারিনি, অহংকারী, স্বার্থপর, সিঙ্গেল মাদার তো দেখব ছেলেকে কেমন মানুষ করে….এসব কথা সব শুনে নিয়েছিলাম….শুধু এই কথাটা শুনব বলেই অপেক্ষায় ছিলাম। একটা দীর্ঘ অপেক্ষা….

সকল অধ্যায়

১. সুখের আড়ালে – অর্পিতা সরকার
২. সেদিন ভোরে – অর্পিতা সরকার
৩. নাম বিভ্রাট – অর্পিতা সরকার
৪. রেড স্কুটি এবং.. – অর্পিতা সরকার
৫. অগোছালো সংসার – অর্পিতা সরকার
৬. ভালোবাসার রামধনু – অর্পিতা সরকার
৭. ইছামতীর তীরে – অর্পিতা সরকার
৮. অলক্ষ্মী – অর্পিতা সরকার
৯. বিজয়িনী – অর্পিতা সরকার
১০. অবহেলা দ্য কিটু সাকসেস – অর্পিতা সরকার
১১. মনের ডুবুরি – অর্পিতা সরকার
১২. ভালোবাসা মিসিং – অর্পিতা সরকার
১৩. লোকে পাগল বলে ডাকে – অর্পিতা সরকার
১৪. নিলামে উঠেছি আমি – অর্পিতা সরকার
১৫. হঠাৎ বৃষ্টি – অর্পিতা সরকার
১৬. রুমমেট – অর্পিতা সরকার
১৭. এক টুকরো সুখ – অর্পিতা সরকার
১৮. দ্য মিস্ট্রি অফ ফ্রেন্ডশিপ – অর্পিতা সরকার
১৯. যদি কখনো অজান্তে – অর্পিতা সরকার
২০. আট নম্বর রুম – অর্পিতা সরকার
২১. ফর এভার – অর্পিতা সরকার
২২. নিশ্চুপ পিয়ানো – অর্পিতা সরকার
২৩. চলো বন্ধু হই – অর্পিতা সরকার
২৪. সূর্যমুখী – অর্পিতা সরকার
২৫. বাবা – অর্পিতা সরকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন