অর্পিতা সরকার
মা, তুমি কিছু তো বলো? আমরা দুই ভাইবোন মিলে বাবার কাজটা একটু ঘটা করেই করতে চাইছি, তুমি বলো না, মেনুতে কি রাখব বাসন্তী পোলাও না ফ্রায়েড রাইস? মাছ তো তিনরকম থাকছেই।
ড্রয়িংয়ের সোফায় স্থির হয়ে বসে আছেন পুষ্পবালাদেবী। মনে করার চেষ্টা করছেন ঠিক কবে এই বাড়িতে দুধে আলতায় পা চুবিয়ে অন্দরে প্রবেশ করেছিলেন। বাপের বাড়ি বলে তেমন কিছুই ছিল না পুষ্পবালার। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পরেই ওর সৎমা একাগ্র মনে চাইতো, পুষ্পর কবে বিয়ে দেবে? ক্লাস এইটে পড়তে পড়তেই মাত্র চোদ্দো বছর বয়েসেই বিয়ে দিয়ে দিল ওর। ওর থেকে বয়েসে প্রায় পনেরো বছরের বড় সুখরঞ্জনের সংসারে যখন পা রেখেছিল ও তখনও সংসার সম্পর্কে কোনো ধারণাই তৈরি হয়নি। সুখরঞ্জন ছিল ওদের ঘোষ বংশের সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান। একটু উদাসীন, এলোমেলো, বই পাগলা সুখরঞ্জনের বিয়েটা তাই একটু দেরি করেই দিয়েছিল ওর বাবা। প্রায় ঊনত্রিশ বছর বয়সে হাঁটুর বয়েসি একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল সুখরঞ্জন।
পড়াশোনা করেছিল কলকাতার মেস বাড়িতে থেকে, সংসারে আসক্তি তারও ছিল না। একটার পর একটা চাকরি ছাড়াই ছিল সুখরঞ্জনের নেশা। বিয়ের আগেই সে গোটা সাতেক চাকরি ছেড়ে আট নম্বরে জয়েন করেছে। ইংরেজদের মতো ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারা ছেলের তখনকার দিনে অফিস-কাছারিতে ভালোই গুরুত্ব ছিল। কিন্তু অস্থিরমতি সুখরঞ্জন কোনো কাজেই মন বসাতে পারত না। তার কেবলই মনে হত, পরের গোলামি কেন করব? লোকের হুকুম কেন শুনব? একবার করে চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসত সে। আবার বাবা, দুই দাদার গালাগাল খেয়ে কলকাতা ফেরত আসত। এমন অস্থিরমতি, ভবিষ্যতের ভাবনা নেই সুখরঞ্জনের সংসারে পড়ল পুষ্পবালা। সেও বড্ড ছোট, তারও বোধবুদ্ধি তেমন নেই। তবে কলকাতার ভাড়া বাড়িতে থাকতে থাকতে তার মনে হয়েছিল, লোকের বাড়িতে কেন থাকব, কেন হবে না আমার নিজের একটা বাড়ি? একদিন আনমনে বলেও ফেলেছিল কথাটা সুখরঞ্জনকে। উদাসীন, পাগলাটে গোছের স্বামীকে বশ করার জন্য গোটা দুই তাবিজ পাঠিয়েছিলেন তার শাশুড়িমা। কিন্তু অমন পাগলাটে স্বামীর হাতে ওসব তাবিজ বাঁধার সাহস পায়নি সে। সুখরঞ্জন তার যাবতীয় জ্ঞানের ভাণ্ডার উপুড় করে দিয়েছিল নেহাতই অজ্ঞ পুষ্পবালার কাছে। একদিন তার স্বামী রাত্রিবেলা ফিরে বলেছিল, কাল থেকে তুমি স্কুলে যাবে। এইটুকু মেয়ে, পড়াশোনা বাদ দিয়ে ভাত রাঁধবে কেন? আর শোনো পুষ্প, যদি স্বামী সোহাগ দেখাতে চাও তবে স্কুলে গিয়ে ভালো রেজাল্ট করে দেখাও। ভয়ে ভয়ে সুখরঞ্জনের হাত ধরে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল পুষ্পবালা। স্বামীকে সে যমের মতো ভয় খেত। মানুষটা বকত না, শুধু কেমন যেন অস্থির হত মাঝে মাঝে। ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বলত, বুঝলে পুষ্প এভাবে হয় না। খাচ্ছি দাচ্ছি, অফিসে যাচ্ছি, জীবন এটা চায়না। নিজে তো কিছুই গড়লাম না।
পুষ্প এত শক্ত শক্ত কথা বুঝত না। তাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকত সুখরঞ্জনের দিকে। মানুষটার এতটা কাছে থেকেও যেন মানুষটা বড্ড অচেনা। কোনো কিছুর অভাব তো নেই, তবুও কেন যে মানুষটা এত অস্থির কে জানে! পুষ্পবালাকে রোজ রাতে পড়তে বসাত সুখরঞ্জন। পুষ্প যেন একটা মাটির তাল, তাকে নিখুঁত ভাবে প্রতিমা বানানোর দায়িত্ব যেন সুখরঞ্জনের। পুষ্পবালা মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে যখন ভরতি হল, তখন সুখরঞ্জন একটা বৃষ্টি ভেজা রাতে বলেছিল, পুষ্প ভালোবাসা মানে কি তুমি জানো?
পুষ্পবালার দুটো গালে একমুঠো আবিরের মাখামাখি, ঠোঁটটা কেঁপে উঠেছিল। এতদিন ঘর করছে কখনো তো এমন প্রশ্ন করেনি মানুষটা! পুষ্প ভয় পেয়েছে, সম্মান করেছে, কিন্তু ভালোবাসা নামক অদ্ভুত অনুভূতির ভাষা তো জানে না। সুখরঞ্জন পুষ্পবালাকে নিজের হাতে সাজিয়ে বলেছিল, এই যে তুমি লজ্জা পাচ্ছ, আমার স্পর্শে কেঁপে উঠছ, আরও আঁকড়ে ধরতে চাইছো আমায়, অথচ সংকোচে এগোতে পারছ না…এর নামই ভালোবাসা। লজ্জায় লাল হয়ে সুখরঞ্জনের বুকে মুখ লুকিয়েছিল পুষ্পবালা। মানুষটা ওর কানে কানে বলেছিল, একটা জায়গা কিনব, সস্তায় পাচ্ছি। পরে ধীরে ধীরে একটা বাড়ি করব। তোমার নিজের বাড়ি। আমি জানি ভাড়া বাড়ি তোমার মোটে পছন্দ নয়। পুষ্পবালা সাহস করে বলেছিল, এই যে না বলা মনের কথা বুঝে নেওয়া, এটাকেই বা কী বলে?
সুখরঞ্জন স্ত্রীর ঠোঁটে ঠোঁটটা ডুবিয়ে বলেছিল, এর নাম আদর। এতদিন ছোট ছিলে তাই আদর করিনি। ভালোবেসেছি কিন্তু প্রকাশ করিনি। এই প্রথম দেখলাম, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরতে পরতে তোমার চোখ দুটো লজ্জায় ভারী হল, বুঝলাম তুমি বড় হয়ে গেছ।
ওদের পুতুল পুতুল সংসারটা ধীরে ধীরে শক্ত ভিতের তৈরি হল। সুখরঞ্জন একটা একতলা বাড়িই কিনে ফেলল কম দামে। বাড়ির মালিক নাকি ছেলের কাছে বিদেশে চলে যাচ্ছে, তাই জলের দামে বেচে দিচ্ছে একতলা বাড়িটা।
বাড়িটা কেনার পর রং করতে শুরু করেছিল সুখরঞ্জন। কিন্তু ততদিনে জমানো টাকা প্রায় সব শেষ। পুষ্পবালাকে বলেছিল, কিন্তু ওই বাড়ি না সাজিয়ে তো আমি তোমায় ওখানে নিয়ে যেতে পারি না পুষ্প। ওটা যে তোমার স্বপ্ন। স্বপ্নকে এলোমেলো করে দিলে চলে, তাকে রঙিন করে তবেই তোমায় উপহার দেব।
ততদিনে বি.এ পাশ করেছে পুষ্প। সুখরঞ্জন চেয়েছিল পুষ্প আরও পড়ুক, কিন্তু বেঁকে বসেছিল পুষ্প, বলেছিল ঢের হয়েছে আর নয়। এবারে আমি গৃহিণী হব, গুছিয়ে নেব আমাদের সংসারটাকে।
সুখরঞ্জন অফিসের পরে কোথায় যে পার্টটাইম কাজ করতে যায়, সেটা জানে না পুষ্পবালা। তবে সুখরঞ্জন যখন বাড়ি ফেরে তখন ওর মুখ দেখেই বোঝে বড্ড পরিশ্রম হচ্ছে ইদানীং।
আরও মাস ছয়েক পরে একদিন সুখরঞ্জন পুষ্পবালাকে বলল, চলো তোমার ভালোবাসা দেখে আসবে।
বাড়ির বাইরে সাদা ফলকে লেখা ”ভালোবাসা”। নীচে লেখা, পুষ্পবালা ঘোষ।
পুষ্পবালাকে চমকে দিয়ে বলেছিল, একটু অপেক্ষা করো। ওকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেই ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল সুখরঞ্জন।
তারপর পুষ্পবালা দেখেছিল, দুধে আলতার থালা, সাদা কাপড় আর ফুল ছড়ানো বারান্দা।
দুধে আলতায় পা চুবিয়ে সাদা কাপড়ে পা রেখে নিজের বাড়িতে ঢুকেছিল পুষ্পবালা। তখন ওর কতই বা বয়েস হবে, বড়জোর কুড়ি-একুশ। সেই থেকে এ বাড়িতে ওদের বাস। সুখরঞ্জন পরে এই বাড়িকে তিনতলা করেছে। ওদের ছেলে, মেয়ে হয়েছে, কিন্তু সেদিনের স্মৃতি ওর কাছে আজও উজ্জ্বল। সুখরঞ্জনের সাথে শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি গেছে পুষ্পবালা কিন্তু দু-রাতের বেশি থাকেনি সেখানে। তাই এই বাড়ির প্রতি ওর আকর্ষণটা যেন বড্ড বেশি। দিনের মধ্যে বেশিরভাগ সময় তো সুখরঞ্জন বাইরেই থাকত, এত বড় বাড়িটার প্রতিটা আসবাব, প্রতিটা দেওয়াল নিজের হাতে পরিষ্কার রাখতে রাখতে কবে যেন এর প্রতিটা ইট, কাঠ পাথরের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল পুষ্পবালার। কেন যে বারবার মনে হত, এই বাড়িটা ওর বাপের বাড়ি নয়, শ্বশুর বাড়ি নয়, এ একান্তই ওর। এ বাড়ির বাগানের প্রতিটা গাছ পর্যন্ত পুষ্পবালার কথা শুনত যেন।
রিপন আবার বলল, মা, বলো, কি মেনুতে রাখব?
বেলাও দাদার সাথে যোগ দিয়ে বলল, বাবা বোধহয় মাছের মাথা দিয়ে ডাল খেতে ভালোবাসতো তাই না মা?
পুষ্পবালা অন্যমনস্ক ভাবে বলল, তোদের বাবা আমার হাতের সব রান্না খেতেই বড্ড ভালোবাসতো।
রিপনের বউয়ের ফিসফিস করে বলা কথাটা কানে এল পুষ্পবালার। তোমার মা তো নতুন বউয়ের মতো আচরণ করছে গো? বেলা হেসে বলল, মা যেন এখনও বাবার আদুরে বউটিই রয়ে গেছে।
রিপন ধীর গলায় বলল, মা, অ্যাক্সিডেন্টকে অস্বীকার করার তো উপায় নেই বলো। তাছাড়া এমন কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে বোধহয় কারোরই কিছু করার থাকে না।
পুষ্পবালা শান্ত গলায় বলল, তোমরা অতদূরে বসে আর কী করবে বল? একজন ব্যাঙ্গালোরে আরেকজন মুম্বাইয়ে, কেন যে মনে হচ্ছে, সময়মত নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো মানুষটা বেঁচে যেত। আসলে এতদিন কলকাতায় আছি বটে, কিন্তু মানুষটার ওপরে এতটাই নির্ভরশীল ছিলাম যে একা পথ চলতে ভয় করে। সব সময় তোমাদের বাবা আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছিলেন, তাই হাত ছাড়া রাস্তা হাঁটার অভ্যেসটাই যে তৈরি হল না। যদি সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে না নিয়ে কিছু আমাকে দিতেন, তাহলে হয়তো সেদিন আমি ওরকম অবস্থায় পাশের বাড়ির সুজয়কে ডাকতে না গিয়ে নিজেই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তোমাদের বাবাকে নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে পারতাম।
রিপন আস্তে আস্তে বলল, মা, তোমাকে নিয়ে আমি মুম্বাই চলে যাব। আমি জানি বাবা ছাড়া তুমি এক পাও কখনও চলোনি। এমনকী নিজে একটা শাড়ি-ব্লাউজ অবধি পছন্দ করে কেনোনি। তাই বাবার অবর্তমানে তুমি যে এই শহরে কিছুই পারবে না সেটা আমি আর বেলা আলোচনাও করেছি, সুনেত্রাও বলছিল, মাকে একা ফেলে রেখে ফিরে গিয়েও শান্তি পাব না। পুষ্পবালা নিজেও জানে, ছেলেমেয়েরা তাকে ফেলবে না। বেলা বলল, দাদার কাছে ছয়মাস, আমার কাছে ছয়মাস থাকবে তুমি। একা দাদাই কেন তোমার সব আদরে ভাগ বসাবে। ছেলে, মেয়ে, বউমা, জামাই, নাতি, নাতনিতে বাড়ি ভরতি, তবুও যেন বড্ড ফাঁকা লাগছে বাড়িটা আজ। সুখরঞ্জন বাড়ি ফিরেই হাঁক পাড়ত, পুষ্প শিগগির এসো, দেখো তোমার জন্য কী এনেছি…
একটা ফুলকপি থেকে দুটো বেগুন অথবা দামি শাড়ি সবেতেই এই একই ডাক ছিল, দেখো কী এনেছি তোমার জন্য। পুষ্প মাঝে মাঝে মজা করে বলত, বেগুন দুটো যদি আমার জন্য হয়, তবে ভর্তা করে সবটাই আমি খাব।
সুখরঞ্জন হা হা করে প্রাণখোলা এসে বলত, পারবে? আমায় ছাড়া খেতে পারবে? তোমার দুর্বলতা যে আমি জানি পুষ্প। পুষ্পবালা অভিমান করে বলত, কাউকে বেশি ভালোবাসা উচিত নয় বুঝলে?
সুখরঞ্জন সম্মতি দিয়ে বলত, একেবারে হক কথা বললে গিন্নি, আমিও ভাবছি এবার থেকে একটু কম ভালোবাসবো কাউকে। পুষ্পবালা রেগে গিয়ে বলত,বটে? সুখরঞ্জন বলত, তুমি তো জানো আমি দুজনকেই ভালোবাসি…বউ আর বই।
পুষ্প কোমরে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করত, কাকে বেশি?
সুখরঞ্জন হেসে বলত, বই তো আর চোখ পাকাতে পারে না? বইয়ের তো আর এমন গোলাপি ঠোঁট নেই, বনলতা সেনের মতো অন্ধকার চুল নেই? তাই ও বেচারাকে দ্বিতীয় পজিশনে রাখলে প্রাণে মরার ভয় নেই।
এমন কত টুকরো টুকরো কথা যে মনে পড়ছে আজ তার ঠিক নেই। আর দশটা দিন কাটলেই অশৌচটুকুও কেটে যাবে পুষ্পর। মানুষটা যেন ফানুসের মতো গায়েব হয়ে গেল ওর জীবন থেকে। সবাই বলছে বয়েস হয়েছিল। কিন্তু কেউ বুঝতেই পারছে না বাহাত্তর বছর বয়েস হলেও মানুষটা ছিল বড্ড ছেলেমানুষ, প্রাণ শক্তিতে ভরপুর। সেদিন রাতেও সব কাজ গুছিয়ে ফিরেছিল বাড়িতে। তারপর মধ্যরাতে বুকে ব্যথা বলতে বলতেই কী যে হল!
বেলা বলল, তাহলে মা তুমি রেস্ট নাও। বাবার কাজটা মিটে গেলেই অনেকগুলো কাজ করতে হবে। এই বাড়ির খদ্দের দেখা, বাবার কলেজ স্ট্রিটের ব্যবসাটাও তো বিক্রি করে দিতে হবে। এসব তো আর আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। পুষ্পবালা অবাক চোখে তাকাল ছেলেমেয়েদের দিকে। এরা কি স্বভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে বাবার মৃত্যুটাকে, শুধু ওই কেন মেনে নিতে পারছে না!
এই দুদিন একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ছিল পুষ্পবালা, বুঝতে পারছিল না কীভাবে দিন-রাত হচ্ছিল। এখন বেলার কথায় মনে পড়লো কলেজ স্ট্রিটের ব্যবসার কথা। একমাত্র নববর্ষ আর দোকানের প্রতিষ্ঠা দিবসের দিন সুখরঞ্জনের সাথে কলেজস্ট্রিট যেত পুষ্পবালা। প্রেসের সব কর্মচারীরা বউদিমনি বলে সম্মান করত।
আচমকা চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল সেদিনের দৃশ্য। তখন সদ্য এ বাড়িতে এসেছে ওরা। প্রতিমাসের সংসার খরচ বাঁচিয়ে একটা করে আসবাব কেনার প্ল্যান করেছে পুষ্পবালা। সবে একটু স্থিত হয়েছে সুখরঞ্জন। পুষ্পবালার শাশুড়িমা ছেলের বাড়ি ঘর দেখে বেজায় খুশি হয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, তুই একমাত্র আমার দস্যি ছেলেটাকে বাঁধতে পারলি। নিজের হাতের দুটো সোনার বালা পুষ্পর হাতে পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এবারে একটা ছেলেপুলে হলেই দেখবি আমার ছেলেটার শিকড় গাঁথা হয়ে যাবে এই বাড়িতে।
শ্বশুরমশাইয়ের বয়েস হলেও কষ্ট করে এসেছিলেন কলকাতায়। ছোটছেলের উড়নচণ্ডী ভাবটা কমেছে দেখে বউমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, তুই সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। এতকাল সৎ মায়ের সংসারে পুষ্পবালা নিজেকে বড় অলক্ষ্মী মনে করত, সবাই বলত জন্মেই যে মাকে খায় সে কী করে লক্ষ্মী হবে! ঘোষ পরিবারে এসে সকলের আদর, যত্ন, সম্মান পেয়ে ও যে মানুষ হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সেটা অনুভব করেছিল।
শ্বশুর, শাশুড়ি ফিরে যাবার পরেই আবার সুখরঞ্জন অস্থির হয়ে গিয়েছিল। ভুলভাল বকবক করত বারান্দায় পায়চারি করতে করতে। যে মানুষটাকে পুষ্পবালা এত ভালোবাসে তাকেও যেন বড্ড অপরিচিত লাগত। কান পেতে শোনার চেষ্টা করত ওর নিজের মনে বলা কথাগুলো। সেদিনও অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতেই বলছিল, বইয়ের অক্ষরের সাথে বেইমানি কেউ কোনোদিন ক্ষমা করবে না। আমি নিজে ছাপাব বই, ব্যবসা করব, লাভ হবে কিন্তু বেইমানি করে নয়। বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠেছিল পুষ্পবালার।
আবার ওর গোছানো সংসারের ওপরে আস্তে চলছে ঘূর্ণিঝড়, সুখরঞ্জনের জেদের সাথে ও পরিচিত আগে থেকেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে সুখরঞ্জন ঘরে ঢুকে বলেছিল, তোমার বিয়ের গয়নাগুলো আমার ধার দেবে? না ধার নয়, একেবারে নিঃস্বার্থে দান করতে পারবে পুষ্প। এ শহরে আর কেউ নেই যার কাছে আমি হাত পাততে পারি। বাবা, দাদা কেউ আমায় বিশ্বাস করে না, ভাবে আমি উড়নচণ্ডী। তুমি তো বিশ্বাস করো বল, তোমার মনে হয় না, এই যে আমি তোমাকে ”ভালোবাসা” উপহার দিলাম, এরকমই আরেকটা স্বপ্নকেও গুছিয়ে উপহার দিতে পারব? বল না পুষ্প, আমি পারব না?
উদভ্রান্ত স্বামীকে শান্ত করার জন্যই পুষ্পবালা বলেছিল, নিশ্চয়ই পারবে। তুমি না পারলে আর কে পারবে? গয়না মেয়েদের অসময়ের সঙ্গী, অত্যন্ত প্রিয় জিনিস, তবুও পুষ্প বিনা বাক্যব্যায়ে স্বামীর হাতে গয়নার বক্সটা তুলে ধরে বলেছিল, এই নাও। সুখরঞ্জন দ্বিধা দ্বন্দ্ব মেশানো গলায় বলেছিল, যদি এ লড়াইয়ে জিতি তাহলে তোমায় সব গয়না ফেরত দেব, যদি হারি নিঃস্ব হবে তুমি, কষ্ট হবে না?
পুষ্পবালা মাথা নিচু করে বলেছিল, সেই ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া মেয়েটা, যে নিজেকেই চিনত না, তাকে হাত ধরে পৃথিবী চিনিয়েছ তুমি। সেই মেয়েটাকে লক্ষ্মীর সম্মান দিয়েছ তুমি, তারপরেও এসব গয়নার জন্য কষ্ট হবে? তবে আমি বলছি, তুমি জিতবে, আমার এ গয়না দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসবে। সুখরঞ্জন ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, তুমিই আমার শক্তি। আমি চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি পুষ্প। ওই নিয়মমাফিক জীবন আমার জন্য নয়। কোনো সৃষ্টি নেই, আত্মতৃপ্তি নেই, শুধুই কারোর হুকুমে কলম পেষা। পুষ্পবালার বুকটা কেঁপে উঠেছিল, কলকাতা শহরে কীসের ব্যবসা খুলবে সুখরঞ্জন? এমন ভালো চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিন্তের পথে কেন যে পা বাড়াবে কে জানে! পুষ্পর খুব ইচ্ছে করছিল সেদিন, হাত দুটো ধরে নিষেধ করে, হয়তো ও নিষেধ করলে শুনত মানুষটা। কিন্তু প্রতিদিন একটু করে ক্ষয় হত সুখরঞ্জনের, নিজের স্বপ্নগুলোকে মরতে দেখত চোখের সামনে। তাই ভয়, দুশ্চিন্তা হলেও নিষেধ করেনি পুষ্প। ভেবেছিল টালমাটাল নৌকাটা যদি ডুবে যায় আবার শুরু করবে নদীর কিনারা থেকে।
সুখরঞ্জন উৎসাহের আতিশয্যে বলেছিল, তুমি জিজ্ঞেস করলে না তো, কীসের ব্যবসা করব?
পুষ্পবালা নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, কীসের ব্যবসা? স্বপ্ন গড়ার?
সুখরঞ্জন স্ত্রীকে আদর করে বলেছিল, তুমি বড্ড বোঝো পুষ্প, তোমায় আর বলার কিছু নেই। তবুও আন্দাজ করে বলত দেখি? পুষ্পবালা একটুও না ভেবে বলেছিল, বইয়ের ব্যবসা কি? কোনো বইয়ের দোকান করবে?
সুখরঞ্জন আনন্দের আতিশয্যে ছোটখাটো পুষ্পবালাকে মাটি থেকে শূন্যে তুলে বলেছিল, আগে বলো, আমার মন পড়ার যে যন্ত্রখানা তুমি লুকিয়ে রেখেছ নিজের কাছে, সেটা তুমি দেখাবে?
পুষ্পবালা চেঁচিয়ে বলেছিল, আগে নামাও, ফেলে দেবে তুমি! সুখরঞ্জন আরো জোরে চেপে ধরে বলেছিল, বলো কী করে তুমি আমার সব গর্ভবতী ভাবনাদেরকেও হাতে নাতে ধরে ফেলো?
পুষ্পবালা লজ্জিত হয়ে বলেছিল, ভালোবাসলে এমন পারে সবাই।
পুষ্পকে মাটিতে নামিয়ে সুখরঞ্জন বলেছিল, শুধু বইয়ের দোকান নয়, আমি প্রকাশনা খুলব বুঝলে? একটা প্রেস কেনার কথা প্রায় পাকা হয়ে গেছে। আপাতত ছোট একটা দোকান ভাড়া করে শুরু করব, তারপর দেখি কালো অক্ষর আমায় কোথায় টেনে নিয়ে যায়!
দিন নেই রাত নেই, সুখরঞ্জন পড়ে থেকেছে কলেজস্ট্রিটের গলিতে। প্রথম যেদিন পুষ্পবালা সুখরঞ্জনের ব্যবসা দেখতে কলেজ স্ট্রিট গিয়েছিল, সেদিন অবাক হয়ে দেখেছিলো, চারিদিকে শুধু বই আর বই। এত বইয়ের দোকানের মাঝে আরেকটা বইয়ের দোকান করে ঠিক কি লাভ হবে, সেটাই মাথায় ঢুকছিল না ওর। সুখরঞ্জন বলেছিল, বলো পুষ্পবালা এই প্রকাশনার কী নাম রাখব, তুমি যা বলবে তাই হবে আমার স্বপ্নের নাম।
পুষ্প একটু ভেবে বলেছিল, ”রামধনু” দিলে কেমন হবে?
সুখরঞ্জনের পাশ থেকে আরেক ভদ্রলোক বলে উঠেছিলো, দাদা, বউদিমনির দেওয়া নামটাই দিন। সুখরঞ্জন হাসি মুখে বলেছিল, তা তোমাদের বউদিমনিই যখন এই ব্যবসার মূলধন জুগিয়েছেন তখন তার দেওয়া নামটাই রাখলাম। ”রামধনু প্রকাশনা” নামে একটা বড় সাইনবোর্ড তৈরি করাও তো তারিণী। তারিণী নামের ভদ্রলোকই একটা কাঠের টুল এগিয়ে দিয়ে পুষ্পবালাকে বলেছিল, বউদিমনি চা খাবেন, ডাবের জলও পাবেন।
পুষ্পবালা একটু অস্বস্তিতেই পড়েছিল। গার্লস স্কুল, গার্লস কলেজ থেকে পাশ করা মেয়ে ও। সুখরঞ্জনের সঙ্গে ছাড়া রাস্তায় বেরোয়নি তেমন। ওই বাড়িটাই ওর পৃথিবী। তাই তারিণীবাবুর অমন সম্মান দেওয়া,মালকিনের মতো ব্যবহার করায় পুষ্পবালা বেশ সংকুচিত হয়ে পড়েছিল।
সুখরঞ্জন ঠিকই বলে, পুষ্প তোমাকে শুধু শুধুই আমি এত বই পড়ালাম, মানুষ হলে না তুমি। এই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখো,বাসন্তীর মায়ের বাইরের বড় পৃথিবীটাকে নিজের চোখে দেখতে শেখ। আমাকে ছাড়াই হাঁটতে শেখ পুষ্প, নাহলে আর পড়াশনা করে কি লাভ? এই যে তুমি এত গল্প উপন্যাস পড়ো, তাতে কোথাও দেখেছ নায়িকা তোমার মতো মুখচোরা, ঘরকুনো হয়?
পুষ্পবালা মাথা নিচু করে বলেছিল, আমি একা একা হারিয়ে যাব, আমায় যদি নিয়ে বেরোতে না চাও তাহলে আমার ঘরই ভালো। সুখরঞ্জন আপশোসের সুরে বলেছিল, পুষ্প নিজের দৃষ্টিতে কলকাতাকে দেখো, আমার নজরে নয়। নিজের দৃষ্টিতে দেখলে তবেই তো তোমার ভিন্ন ভাবনাচিন্তা গড়ে উঠবে। সুখরঞ্জনের কথাকে পাত্তা না দিয়ে ঘরকুনোই হয়ে ছিল পুষ্পবালা। তারিণীবাবু বলেছিলেন, বউদিমনি আপনিও তো শুনেছি বই পড়তে ভালোবাসেন, তাহলে মাঝে মাঝে আসবেন দোকানে। পুষ্পবালা কিছু বলার আগেই সুখরঞ্জন হেসে বলেছিল, তোমাদের বউদিমনি হারিয়ে যাবে বুঝলে। লেখাপড়া জানা মেয়ে নাকি হারিয়ে যায়! লজ্জায় অধোবদন হয়েছিল পুষ্প। মানুষটার যেন কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই। লোকজন মানে না।
সুখরঞ্জন বলত, বুঝলে পুষ্প বইও হলো কমোডিটি। বই যেমন ভালোবাসার জিনিস তেমনি সঠিক দামে, সুন্দর বাধাইয়ে সকলের কাছে একে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও একজন প্রকাশকের বা ব্যবসাদারের। আমাদের বাংলা সাহিত্যকে যদি সঠিকভাবে সকলের কাছে পৌঁছে দিতেই না পারলাম, তাহলে আর বইকে ভালোবাসি বলে চেঁচিয়ে কি লাভ। বেশ কয়েকটা প্রকাশনা দেখলাম অধিক মুনাফার লোভে সস্তার কাগজ, কমা বাঁধাই করে বই মার্কেটে ছাড়ছে। পাঠকরা এসে দুদিন পরে যখন বলছে, বইয়ের পাতা খুলে যাচ্ছে তখন সেই প্রকাশক সম্পূর্ন উদাসীন। চাকরির পরে কলেজ স্ট্রিটে পড়ে থেকেছি, প্রূফ রিডিং, এডিটিং সব শিখেছি মন দিয়ে। তখন প্রূফ চেকিংটা পার্ট টাইম জব হিসাবে করতাম, আমার প্রকাশনাতে এডিটর হবে পুষ্প? তোমায় মাইনে দেব, বিনা পয়সায় খাটাব না!
পুষ্পবালা ভয়ে কুঁচকে বলেছিল, আমি এসব পারব না। সুখরঞ্জন বলেছিল, তোমায় শেখাব। তখন নতুন লেখকের লেখা সকলের আগেই তুমি পড়তে পারবে। কেমন হবে বলত? নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হবে বুঝলে!
পুষ্পবালা বুঝেছিল, পাগল মানুষটার মাথায় আবার খেয়াল চেপেছে। পুষ্পকে হাতে ধরে ফর্মা বুঝিয়েছিল, আর প্রূফ প্রথমে পুষ্প পড়ত, প্রূফ চেকিংয়ের খুঁটিনাটি শিখিয়েছিল। ও প্রথম এডিট করত তারপর সেটা সুখরঞ্জন নিজে পড়ে তবেই প্রেসে যেত।
পুষ্পবালা যখন প্রথমবার গর্ভবতী হল তখন সুখরঞ্জন বলেছিল, চলো তোমায় আমার প্রেসে নিয়ে যাই, কাগজ, কালি, নতুন বইয়ের গন্ধ নেবে প্রাণ ভরে।
পুষ্পবালা বলেছিল, ধুর আমার লজ্জা করবে, তুমি গিয়েই হয়তো বলবে আমার বাচ্চা হবে। সুখরঞ্জন হেসে বলেছিল একি লুকানোর কথা পুষ্প? এযে বড় আনন্দের খবর। সবাইকে বলতে হয়।
জোর করে চারমাসের পুষ্পবালাকে প্রেসে নিয়ে গিয়েছিল সুখরঞ্জন। জোরে জোরে নিশ্বাস নাও, দেখো নতুন বইয়ের গন্ধ পাবে। আমাদের সন্তানও কালো অক্ষরকে ভালোবাসবে, দেখো। যদিও রিপন আর বেলা পড়াশোনায় ভালো হলেও বাবার মতো বুকওয়ার্ম হয়নি।
তারপর রিপন আর বেলাকে সামলাতে সামলাতে এডিটিং করা আর হয়ে ওঠেনি পুষ্পবালার। সুখরঞ্জনও পাগলের মতো মেতে উঠেছিল ব্যবসা নিয়ে। বড় শো রুম করেছিল কলেজ স্ট্রিটের বুকে।
ওদের ‘ভালোবাসা’ নামক ছোট বাড়িটাও একতলা থেকে তিনতলা হয়েছিল। ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করে চাকরি পেয়েছে। তাদের বিয়ে দিয়েছে সুখরঞ্জন, কিন্তু একদিনের জন্যও বিশ্রাম নেয়নি। বলত, বিশ্বাস করো পুষ্পবালা ওই কাগজ, আর কাঁচা কালির গন্ধ ছাড়া আমি অসুস্থ হয়ে যাব। পুষ্পবালা বলত, সারাজীবন কি খেটেই যাবে? এখন তো আর অভাব নেই, আমার সব গয়না তুমি ফিরিয়ে দিয়েছ। ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছ, বিয়ে দিয়েছ। এবারে তো ছুটি নাও।
সুখরঞ্জন হাসতে হাসতে বলত, আর কদিনই বা কাজ করতে পারব বল, বয়েস তো হচ্ছে! যে কদিন পারি, ছুঁয়ে থাকতে চাই স্বপ্নটাকে।
পুষ্পবালা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তুমি তোমার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েও ছুটি নাওনি, স্বপ্নকে ছুঁয়েই চলে গেলে পৃথিবী ছেড়ে। আমাকে সম্পূর্ণ একা করে দিলে!
বেলা ডাকছে, মা, তোমার আলমারির লাল শাড়িগুলো কী হবে? আমি আর বউদি নিয়ে নেব?
সুখরঞ্জনের বড্ড প্রিয় রং ছিল লাল। পুষ্পর জন্য প্রায় সব শাড়িই কিনত লালের ছোঁয়া।
পুষ্পবালা বলত, বুড়ি হচ্ছি আর তুমি যত লাল রং খুঁজে আমার জন্য কিনছ? সুখরঞ্জন হেসে বলেছিল, তোমাদের কে এমন শেখাল গো, যে লাল শুধু তারুণ্যেরই প্রতীক। যতদিন বেঁচে আছো ততদিন এই ধমনীর রক্তের রং কিন্তু লাল। পুষ্পবালা অবাক হয়ে দেখত বড্ড চেনা মানুষটার দিকে। ছক ভাঙা মানুষটা যেন ভীষণ রকমের আলাদা ছিল। কিছুতেই চিনতে পারত না ও।
পুষ্পবালা নরম গলায় বলল, ওগুলো সব তোদের বাবা কিনে দিয়েছে সব, তোদের শাড়ি দরকার হলে বলিস, আমি কিনে দেব। ওগুলো আলমারিতেই থাক।
বেলা অদ্ভুত একটা অঙ্গভঙ্গি করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সুনেত্রার ঠোঁটে একটা বিদ্রুপের হাসি ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে গেল যেন।
রিপন আর বেলা দুজনেই কদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে কলকাতা। বাবার কাজটা মিটলেই চলে যাবে। তাই হাতে সময় খুব কম ওদের। যা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। এই বাড়ির খদ্দের দেখা থেকে বাবার কলেজ স্ট্রিটের ব্যবসা বিক্রি করার ব্যবস্থা করে, মা-কে নিয়ে তবেই ফিরবে।
বেলা, রিপন আর বউমা আলোচনায় ব্যস্ত। এই বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাবে? ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠল পুষ্পবালার। ওই বছরে একবার বইমেলাগুলো সব মেটার পরে তিনদিনের জন্য ছেলের ফ্ল্যাটে আর তিনদিনের জন্য মেয়ের ফ্ল্যাটে নিয়ে যেত সুখরঞ্জন। তাছাড়া এই বাড়ি ছেড়ে তেমন থাকেনি কখন�। শ্বশুর, শাশুড়ি মারা যেতে অবশ্য বেশ কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল দেশের বাড়িতে, তখনও এই বাড়ির চিন্তায় পাগল হত পুষ্পবালা।
বাড়ির উঠানে বাঁশ পড়েছে। মানুষটা নিমেষে কর্পূরের মতো উধাও হয়ে গেল যেন, এখন তারই পারলৌকিক কাজের ব্যবস্থা চলছে।
রিপন এসে বলল, মা আমাদের এই বাড়িটা কি তোমাদের জয়েন্ট নামে ছিল? তাহলে আবার বাবার ডেথ সার্টিফিকেট সাবমিট করতে হবে রেজিস্ট্রি অফিসে।
পুষ্পবালা করুণ গলায় বলল, তোর বাবা তো প্রায় জেদ করেই এ বাড়ি আমার নামে করে রেখেছিল। ব্যবসাও তো আমার নামেই, কী যে বুঝতো লোকটা কে জানে! রিপন খুশি হয়ে বলল, যাক বাঁচালে, তার মানে তুমি সাইন করলেই কাজ মিটে যাবে। আমি অফিসে মেল করে দিয়েছি, আরও দিন দশেক ছুটি বাড়ানোর জন্য।
বাবার কাজটা মিটলে এইগুলোকে মিটিয়ে ফেলতে হবে। পুষ্পবালা বলল, তোরা যা ভালো বুঝিস তাই কর, আমায় কোথায় সাইন করতে হবে বলিস, করে দেব।
রিপন ঘাড় নেড়ে বলল, বুঝতে পারছি মা, তোমার এই বাড়ি ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে, কিন্তু আমাদেরও তো উপায় নেই বল, জব ছেড়ে তো আর কলকাতায় পড়ে থাকতে পারি না? পুষ্পবালা নরম গলায় বললেন, তাই কী হয় রে! তাছাড়া তোর বাবাকে ছাড়া আমিও একা কিছুই জানিনা।
সুখরঞ্জনের কাজ মিটল। ছেলে, মেয়ে মিলে বেশ জাঁকজমক করেই সারলো বাবার পারলৌকিক কাজকর্ম। মধ্যাহ্ন ভোজনেও কোনো ত্রুটি রাখল না।
বেলা আর সুনেত্রা মিলে মায়ের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে বড় বড় ব্যাগে। এ তো আর তিনদিনের জন্য যাওয়া নয়, এ একেবারে সারাজীবনের জন্য যাওয়া। তাই মায়ের যেগুলো দরকার সবই গুছিয়ে নিচ্ছে। বেলা বলল, মা যে কি করে এই বাড়ি ছেড়ে থাকবে কে জানে!
সুনেত্রা ফিসফিস করে বলল, দায়ে পড়লে সব মেনে নিতে হয় দিদি, মা যে একা কিছুই পারে না সেটা তুমি-আমি ভালোই জানি। আসলে দোষ মায়ের নয়, বাবার অতিরিক্ত আদরেই মা এমন হয়েছে। তোমার ভাই তো চাকরিটুকু করেই খালাস, আমাকেই সামলাতে হয় সবটুকু, নিজের জব সামলেই করতে হয় এসব। আসলে তোমার মাকে তো কিছু করতে দেয়নি তোমার বাবা, তাই মা সুখ কার নাম সেটা ভালো করেই ভোগ করছে। মা তো বাবার থেকে প্রায় পনেরো বছরের ছোট, মায়ের তো এখনো রিটার্মেন্টের বয়েস হয়নি, তারপরেও মাকে দেখো, কেমন যেন, কিছুই পারে না।
সব কথাগুলোই কানে আসছিল পুষ্পবালার, কথাটা বউমা নেহাত ভুল বলেনি, তবে সুখরঞ্জন করতে দেয়নি এটা ভুল। সে মানুষটা সব কিছু হতে ধরে শেখাতে চেয়েছিল, শিখিয়েওছে অনেকটা, কিন্তু পুষ্পবালা কখনো অ্যাপ্লাই করেনি।
ফোনটা বাজছে পুষ্পবালার। কে আবার ফোন করছে ওকে, ছেলে, মেয়েরা তো সব বাড়িতেই আছে। ফোনটা রিসিভ করতেই বেশ ভয়ার্ত গলার স্বর, বউদিমনি আপনি শিগগির কলেজ স্ট্রিট আসুন, আমাদের প্রেসে আগুন ধরেছে, আপনি আসুন প্লিজ।
তারিণীবাবু!
পুষ্পবালার ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। বেডরুমে টাঙানো সুখরঞ্জনের বড় ছবিটার দিকে তাকালো ও। সুখরঞ্জনের ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি, যেন বলতে চাইছে পুষ্প, তুমি আমার স্বপ্নটাকে পুড়তে দিচ্ছ? কি নিষ্ঠুর তুমি, কি স্বার্থপর তুমি পুষ্পবালা।
পুষ্পবালা যন্ত্রচালিতের মতো নিচের ঘরে গেল, ওদের ড্রাইভার বিজয় বসে বসে একটা বই পড়ছে। বিজয়কে বইয়ের নেশা ধরিয়ে ছিল সুখরঞ্জন। বলেছিল, অবসর সময়ে যদি দেখি তাস পেটাচ্ছিস, তাহলে চাকরি থেকে দূর করে দেব হারামজাদা। একটু ডিসপুট বইগুলো বিজয়কে এনে দিত সুখরঞ্জন, বলত পড়ে রাখবি, পড়া ধরব। কী করে যেন বিজয়েরও বইয়ের নেশা হয়ে গেল।
পুষ্পবালা উদভ্রান্তের মতো এসে বলল, বিজয়, শিগগির চল বাবা, প্রেসে আগুন ধরেছে।
বিজয় আর পুষ্পবালা যখন প্রেসে পৌঁছল তখন ঘড়িতে প্রায় রাত দশটা।
বেলা হন্তদন্ত হয়ে রিপনের ঘরে ঢুকে বলল, দাদা, মা তোকে কিছু বলেছে রে, কোথায় গেছে জানিস? সারাবাড়ি খুঁজে ফেললাম তো। হ্যাঁ রে দাদা, মা আবার বাবার শোকে সুইসাইড করে বসবে না তো? তাহলে কিন্তু আমাদের নামেও কেস হয়ে যাবে। রিপন বলল, ফোন করেছিস? বেলা ঘাড় নেড়ে বলল, মায়ের বেডরুমে বাজছে ফোনটা। মা নিয়ে যায়নি সঙ্গে। সেই জন্যই তো চিন্তা হচ্ছে রে। রিপন বিরক্ত হয়ে বলল, বড্ড আদিখ্যেতা বুঝলি, কারোর যেন স্বামী মারা যায় না! মা এমন করছে যেন পৃথিবীটা থমকে গেছে। মানলাম বাবার মৃত্যুটা আকস্মিক, কিন্তু বারো দিন কেটে যাবার পরেও মায়ের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বেলা বলল, মাকে নিয়ে দেখছি আমরা বিপদে পড়ব। সুনেত্রা বিরক্তির স্বরে বলল, আদুরে মা কিনা!
একি তারিণীবাবু, আপনি যে বললেন, আগুন ধরেছে… সব শেষ হয়ে গেল!
তারিণীবাবু বললেন, গেল তো বউদিমনি, সব তো শেষ হয়েই যাবে আপনার একটা সাইনে। আপনার ছেলে তো ”রামধনু”কে অন্যের হাতে দেবে বলে কথা ফাইনাল করে ফেলেছে। শুনলাম নাকি আপনারও মত আছে। আগুনে পোড়ার থেকে কি এটা কম বউদিমনি?
আসুন, তারিণীবাবুর সাথে ভিতরে ঢুকল পুষ্পবালা। তারিণীবাবু বললেন, বউদিমনি আমাদের দাদাবাবু ওই চেয়ারে বসতেন, আপনিও একবার বসুন।
পুষ্পবালা মন্ত্রমুগ্ধের মতো গিয়ে বসল সুখরঞ্জনের চেয়ারে। চেয়ারের পিছনে রাখা আকাশি তোয়ালেতে এখনো মানুষটার ঘেমো গন্ধ। অনেকটা পরিশ্রমের গন্ধ রয়েছে সামনের কাঠের টেবিলটায়, ”রামধনু” লেখা প্যাড, পেন সব রয়েছে সাজানো।
তারিণীবাবু জোরে ডাকলেন তোরা আয়। দেখবি আয়, তোরা বেঘর হোসনি। দাদাবাবু নেই তো কি হয়েছে, ওনার স্বপ্নের ঘুড়িটাকে ওড়ানোর জন্য বউদিমনি এসেছে দেখ। ওই দেখ, ওনার হাতে ”রামধনু” লেখাটা পেনটা।
অন্যমনস্কভাবেই পুষ্পবালা সুখরঞ্জনের পেনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। প্রায় জনা ত্রিশ লোক এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্পবালার দিকে তাকিয়ে। সকলের চোখেই আর্তি, তারিণীবাবু বললেন, এরা সবাই ”রামধনু”র বিভিন্ন বিভাগে কাজ করে বউদিমনি। রিপনদাদা যদি প্রকাশনটা বেচে দেয়, তাহলে এরা চাকরি খোয়াবে। আপনি মা হয়ে এতগুলো সন্তানকে বঞ্চিত করতে পারবেন?
পুষ্পবালা ভয়ে ভয়ে বলল, কিন্তু আপনাদের দাদাকে ছাড়া আমি যে কিছুই পারিনা।
তারিণীবাবু হেসে বললেন, বউদিমনি, আমি যেদিন ”রামধনু”তে এসেছিলাম, সেদিন আমিও এমনভাবেই বলেছিলাম, দাদাবাবু আমি তো কিছুই জানি না। দাদাবাবু বলেছিল, কিশলয়, সহজপাঠ পড়েছো হে? বাংলা শব্দ চেন তো? তাহলে সব পারবে।
বউদিমনি আপনিও নিশ্চয়ই এই দুটো বই পড়েছেন, তাই আপনিও সব পারবেন। দাদাবাবু আমায় যেমন করে শিখিয়েছেন আমিও আপনাকে সবটুকু শিখিয়ে দেব। শুধু ”রামধনু”র লাটাইটা কখনও ছাড়বেন না।
পুষ্পবালা ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল, শান্ত গলায় বলল, তারিণীবাবু আমিও আপনাদের দাদাবাবুর মতো সকাল দশটার মধ্যেই অফিসে ঢুকব। আরেকটা কথা, শোরুমে আপনাদের দাদাবাবুর যে ছবিটা টাঙিয়েছেন ওতে রোজ টাটকা মালা দেবার ব্যবস্থা করুন। আমি এসে মালাটা পরাব আর ধূপ জ্বালব, আর প্রতিদিন আপনাদের দাদাবাবুকে দেখিয়ে দেব পুষ্পবালাও পারে তার স্বপ্নের লাটাই-সুতো সামলে রাখতে। বড্ড ব্যঙ্গ করত মানুষটা আমায়, তুমি ছোটই রয়ে গেল পুষ্প, এবারে সে দেখুক আমিও পারি। আমি না-হয় বুড়ি হয়েই বড় হলাম।
আঁচলের খুঁটে নিজের চোখের জলটা মুছে গাড়িতে উঠল পুষ্পবালা।
বাড়িতে ঢুকতেই ছেলে, মেয়েরা চূড়ান্ত তিরস্কার করল। এভাবে তাদের চিন্তায় ফেলার অর্থ কি!
পুষ্পবালা বলল, তোরা যে আমায় ভালোবাসিস সেটাই একটু বাজিয়ে দেখে নিই বুঝলি। বউমা, ব্যাগ গোছানো বন্ধ রাখ। আমি ”ভালোবাসা” আর ”রামধনু” ছেড়ে কোথাও যাব না। রিপন, তোর খদ্দেরদের বলে দে আপাতত এই প্রপার্টি বিক্রি করবে না পুষ্পবালা ঘোষ।
কিন্তু মা, তুমি তো একা কিছুই পারো না…তাছাড়া মুম্বাইয়ে আমি একটা বড় ফ্ল্যাট বুক করব ভেবেছি এই বাড়ি বিক্রির টাকায়। সেই মতো অ্যাডভান্স দিতে আসবে কাস্টমার কালকেই। এখন বলছ, বিক্রি করবে না? তুমি একা একা তো কিছুই পারো না মা!
পারি রে, আমি একাই পারি, এতদিন প্রয়োজন হয়নি তাই করিনি, এবারে করব।
রিপন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই বেলা বলল, এখানে একা থাকবে যদি তোমার কিছু হয়, তখন তো লোকে আমাদের দোষ দেবে।
পুষ্পবালা হেসে বলল, তোদের বাবাও তো চলে গেল, আমরা তো কেউই কিছু করতে পারলাম না। মৃত্যু কবে শিয়রে এসে দাঁড়াবে বলে প্রতি মুহূর্তে মরতে হবে? তোদের বাবা সব সময় বলত, যে কদিন আছি স্বপ্ন দেখে যাব।
তোরা চিন্তা করিস না, আমি পারব।
পরের দিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্রিম কালার আর রেডের কম্বিনেশনের একটা তাঁতের শাড়ি পরে রেডি হয়ে নেমে এল পুষ্পবালা। চোখে সোনালি চশমা, হাতে রামধনুর কিছু ফাইল। নরম গলায় বলল, যেদিন ”রামধনু” শুরু হয়েছিল সেদিন তোদের বাবা এই শাড়িটা কিনে এনেছিল। বলেছিল, যেদিন ”রামধনু”তে যাবে সেদিন এই শাড়িটা পরে যাবে। প্রথম যেদিন ”রামধনু”তে গিয়েছিলাম তোদের বাবার সাথে সেদিনও পরে গিয়েছিলাম, আজ তোদের বাবার স্বপ্নটাকে স্পর্শ করতে যাচ্ছি, তাই তার পছন্দের শাড়িটাই পরলাম।
বেলা বলল, মা লালটা পরে না শুনেছি….
সুনেত্রা বলল, আসলে এই তো সবে বাবার কাজটা মিটেছে, বড্ড দৃষ্টিকটু লাগে, এই আরকি!
পুষ্পবালা বলল, আমিও তাই জানতাম, কিন্তু তোর বাবা বলত, অন্য সাতটা রঙের মতো নাকি এটাও রামধনুর একটা রং মাত্র।
বিজয়, গাড়ি বের কর বাবা, তোদের দাদাবাবু আমায় খুব জব্দ করে গেছেন, বাড়ি থেকে এতকাল না বেরোনোর সাজা দিয়ে গেলেন।
বিজয় ঢক করে প্রণাম করে বলল, বউদিমনি, দাদাবাবু প্রায় বলতেন, আমি যখন থাকব না, বউদিমনির খেয়াল রাখবি বিজয়। আমি ঘাড় নেড়ে বলতাম, রাখব।
পুষ্পবালা হাসি মুখে বলল, মানুষটা সারাজীবনই আমাকে শূন্যে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেবার মতলব করত। দেখলি তো কেমন জব্দ করে গেল!
ফিসফিস করে পুষ্পবালা বলল, কি গো, শান্তি হয়েছে এবারে, তোমার পুষ্প তোমার সাজানো অফিসে বসবে, খুশি তো তুমি?
কেউ যেন কানে কানে বলল, খুব খুশি, তুমি পারবে পুষ্পবালা, ঠিক পারবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন