অর্পিতা সরকার
অদ্ভুত টাইপের মানুষ তো তুমি, একটা রাস্তার পাগলিকে বাড়িতে তুলে নিয়ে চলে এলে?
আরে মেয়েটার বাড়ি কোথায়? কী হল চুপ করে আছ কেন?
বিশ্বনাথবাবু গম্ভীর স্বরে বললেন, আমি ওর বাড়ি জানি না। মেট্রো স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। কাউকে যেন খুঁজছিল। আমায় দেখে এগিয়ে এসে বলল, আমায় নাকি চেনে। তারপর আমার পিছু পিছু এল। মুখটা দেখে মায়া লাগল তাই নিয়ে এলাম বাড়িতে। সম্ভবত ওর কেউ নেই বুঝলে! পোশাক বা চেহারা কিন্তু বেশ সম্ভ্রান্ত বাড়ির মতোই। তাই না?
মৃন্ময়ী অসহ্য রাগে গর্জে উঠলেন, তোমার কি আর কখনো বুদ্ধি হবে না গো?
বিশ্বনাথ তরফদারের বুদ্ধিসুদ্ধি একটু কম এটা অবশ্য ফুলশয্যার পরের দিন থেকেই বলতে শুরু করেছিলেন ওর নতুন স্ত্রী মৃন্ময়ী। তাই বিশ্বনাথবাবুও এত বছর ধরে এই কথায় বিশ্বাস করে আসছেন। মানে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরের মতোই ধ্রুবসত্য বিশ্বনাথবাবুর সাংসারিক বুদ্ধি একেবারেই নেই। নেহাত মৃন্ময়ীর মতো শক্তপোক্ত গিন্নী মেয়ের হাতে পড়েছিলেন বলেই গরম ভাতের ওপরে ঘি দিয়ে ভাত খেয়ে অফিস দৌড়াতে পারেন।
সেই কম বয়সে মা মারা গিয়েছিল বিশ্বনাথের। তাই বিয়ে-থা যে হবে এমন কোনো আশাও ছিল না। নেহাত মৃন্ময়ীর এক পাড়াতুতো দাদা বিশ্বনাথের অফিসে চাকরি করে বলেই, ভবঘুরে বিশ্বনাথ এ যাত্রায় সংসারী হতে পারল।
আর তো মাত্র বছর পাঁচেক চাকরি জীবন বাকি আছে। এত বছর রেলের কেরানিগিরি করে, এত খাতা পিষেও এক ফোঁটা বুদ্ধি বাড়ল না বিশ্বনাথের। এ আক্ষেপ মৃন্ময়ীর সর্বক্ষণের সঙ্গী।
পঞ্চান্ন বছরের বিশ্বনাথ তরফদার নিজের ডিপার্টমেন্টে অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও গুণী মানুষ বলেই পরিচিত। কিন্তু তার স্ত্রীর কাছে নিতান্ত বোকা, হাড় জ্বালানে টাইপ মানুষ রয়ে গেলেন।
মৃন্ময়ী আবার চেঁচিয়ে বললেন, আরে আশ্চর্য মানুষ তো, একটা অপরিচিত মেয়েকে একেবারে ঘরে এনে তুললে কেন সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি?
এত যখন দয়ামায়া শরীরে তখন হাতে টাকা বা খাবার ধরিয়ে আসতে পারতে! একেবারে স্কুটিতে চাপিয়ে সঙ্গে করে অন্দরে ঢোকাতে হল?
বিশ্বনাথবাবু বরাবরই মৃন্ময়ীর জেরার মুখে পড়লে তোতলান। আজও আমতা আমতা করেই বললেন, আসলে আমাদের মনির বয়সি মেয়ে, এমন করে বলল তাই আর…
মৃন্ময়ী একটুও না থেমে বললেন, মনির বয়সি মেয়ে তো এ দেশে কম নেই গো। তাই বলে সকলকে এ বাড়িতে এনে ঢোকাবে? চোর-ডাকাত কিনা কে জানে! দিনরাত যে খবরের কাগজ মুখস্থ করছ তাতে কী দেখো? দেখো না, কত মায়াবী চোখের অধিকারিণী রীতিমতো খুনি। লাদেনের চোখ দেখে কী মনে হয়? স্বর্গ থেকে দেবদূত নেমে এসেছিলেন। তাহলে?
স্বামীকে আর প্রশ্ন করে বেশি লাভ নেই দেখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃন্ময়ী বললেন, তোমার নাম কী গো মেয়ে?
মেয়েটা কথা না বলে ফ্যালফ্যাল করে স্কুটিটার দিকে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়ী ফিসফিস করে বললেন, নির্ঘাত বাইক চোর। এখন তো আবার চোরের প্রকারভেদ আছে। মনি বলছিল, সেদিন নাকি একটা মেয়ে ট্রেনের জানালার ধারে বসে হেডফোনে গান শুনছিল। আচমকা স্টেশন ছাড়ার মুখে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে তার ফোনটা কেড়ে নিয়ে পালিয়েছে একটা চোর। মনি বলছিলো, এরা নাকি স্মার্টফোন চুরি করায় পারদর্শী।
আর এই তো দুদিন আগেই টিভির খবরে বলছিলো, একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে দুজন বয়স্ক মানুষ থাকতেন। একটা কমবয়সি মেয়ে তাদের দেখাশোনা করত। সে নাকি ওদের খুন করে সব হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে। বিশ্বনাথবাবু অপলক তাকিয়ে ছিলেন তার এত বছরের পরিচিত জীবনসঙ্গীর দিকে। মৃন্ময়ীকে দেখলে বোঝাই যায় না সে দেশের এত খোঁজখবর রাখে। এসব শুনে বিশ্বনাথবাবু একটু ফ্যাসাদে পড়েই বললেন, তাহলে এখন কী করা উচিত? এমন ভর সন্ধেবেলা মেয়েটাকে তাড়িয়ে দেব?
ওদের কথা শেষ হবার আগেই বাড়িতে পা রাখল মনিদীপা। ঢুকেই বলল, জানো মা আমাদের গোটা পাড়া নিস্তব্ধ। কোনো কোনো বাড়ি থেকে সিরিয়ালের আওয়াজ ভেসে আসছে আবছা। শুধু আমাদের বাড়ি থেকেই তোমার চিৎকার শোনা যাচ্ছে ওই মোড়ের পিন্টুর দোকান থেকে।
কেন জানতে পারি মা?
মৃন্ময়ী ভ্রু কুঁচকে বললেন, কী করব মনি? এ পাড়ার সকলে তো আর এমন অপরিনামদর্শী মানুষ নিয়ে ঘর করে না। তাই তাদের গলা দিয়ে সর্বদা মধু বেরোয়। কেউ তো ভর সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে বাজারে বেরিয়ে একজন অপরিচিত মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে না তাই তাদের গলাও কেউ শুনতে পায় না।
মনিদীপা সাইকোলজি নিয়ে পড়ছে। মাস্টার্সের ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। সাইকোলজি নিয়ে পড়ার দৌলতেই হয়তো ওর বয়সি ছেলে-মেয়েদের থেকে ও একটু বেশিই গভীরতা ধরে ওর চিন্তাভাবনায়।
মায়ের কথা শুনেই আঁচ করলো, বাড়িতে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। এটা অন্যদিনের মতো পালংশাকের বদলে কলমি শাক আনার মতো ছোট্ট ভুল নয়। বাবার মুখচোখ দেখেও মনে হল বেশ অস্বস্তিতে আছে। তারপরেই চোখে পড়ল, ওরই সমবয়েসি বা ওর থেকে একটু ছোট একটা মেয়ে বারান্দার অন্য কোনটাতে বসে আছে কাঁচুমাচু করে।
মনিদীপা বাবাকে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলো, ওকে তুমি চেন?
বিশ্বনাথবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, না রে চিনি না। কিন্তু ও বলল, ও নাকি আমায় চেনে। ওর কেউ নেই শুনে আমি বাড়িতে নিয়ে এলাম।
মনিদীপা এতক্ষণে মায়ের চেঁচামেচির কারণটা বুঝতে পারল। বাবার এমন কাজে মনি খুব একটা অবাক হয়নি। বিশ্বনাথ তরফদার এত হিসেব করে জীবন চালায়নি কোনোদিনই। ছোট থেকেই মনি দেখে এসেছে কারণে অকারণে বাবা বকা খায় মায়ের কাছে। বাবার নাকি সাংসারিক বুদ্ধি নেই একেবারেই। আপাত নিরীহ বাবার মধ্যে কিন্তু একটা সাহসী মানুষকে লুকিয়ে থাকতে দেখেছে মনি নিজে। এই সাহসী বিশ্বনাথ তরফদারকে হয়তো আদৌ কেউ চেনে না। কিন্তু মনি চেনে। যদিও ওই সাহসী মানুষটার প্রকাশ খুব কম। দেখা যায় সাদা চোখে। বেশিরভাগ সময়ই বিতর্কে না গিয়ে চুপ করে যায় বাবা। তবে মনি যখন ক্লাস সিক্সের স্টুডেন্ট তখন বাবার স্কুটারে করে স্কুলে যাচ্ছিল একদিন।
তখন দেখেছিল, অত্যন্ত আধুনিক পোশাক পরিহিতা এক ভদ্রমহিলা এক রিকশাওয়ালাকে জোরে থাপ্পড় মেরেছিলো। কারণটা তেমন কিছুই নয়, বৃষ্টির পরে রিকশা নিয়ে বেরিয়েছিল লোকটা। বসার সিটটা মুছে নিলেও জল থেকে গিয়েছিল হয়তো স্পঞ্জের ভিতরে। ভদ্রমহিলার দামি শাড়িটা ভিজে গিয়েছিল অল্প। তাই রিক্সা থেকে নেমেই লোকটিকে চড় মেরেছিল সে। বাবা স্কুটার দাঁড় করিয়ে মনিকে বলেছিল, একটু দাঁড়া তো। ওর ভীতু, বুদ্ধি কম বাবাটা এগিয়ে গিয়েছিল মহিলার সামনে। গিয়ে বলেছিল, রিকশাওয়ালার কাছে ক্ষমা চান এখুনি। মহিলা হকচকিয়ে বলেছিল, আপনি কে?
বাবা হাসিমুখে বলেছিল, মানুষের বিবেক। আমার কাজ যখন সেটা অহংকারে অন্ধ হয়ে যায় তখন তাকে জাগিয়ে তোলা। একজন বাবার বয়সি রিকশাওয়ালাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাপ্পড় মারতে লজ্জা করল না? নাকি মনে করেন সম্মান শব্দের ওপরে আপনার একচেটিয়া অধিকার আছে?
ওরও একটা সম্মান আছে। আপনি এভাবে কারোর গায়ে হাত তুলতে পারেন না। আপনি যদি ক্ষমা চান ভালো। নাহলে আমি ওদের কমিটিতে গিয়ে জানাব। ভদ্রমহিলা হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। বাবা রিক্সাচালকের পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল, এসব কথা মনে রাখবেন না। রাস্তাঘাটে এমন ভদ্র পোশাকের অশিক্ষিত মানুষ অনেক পাবেন।
স্কুটারে উঠেই বাবা বলেছিল, মনি বাড়ি ফিরে মাকে আজকের ঘটনার কথা কিছু বলার দরকার নেই।
এমন অনেক প্রতিবাদের ঘটনা মনি জানলেও আর কেউ বিশেষ জানে না। তাই বাবা যখন মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যাপার আছেই।
মনি বলল, ঠিক আছে মা। এত চেঁচামেচি করে তো লাভ নেই। ওই মেয়েটাকে একটু খেতে দাও। আমি ওর সঙ্গে পরে কথা বলছি। বুঝলে কালকে থানায় দিয়ে আসব। বা ওর ঠিকানা বের করতে পারলে বাড়িতে কল করে দেব।
মৃন্ময়ী বললেন, কিন্তু যদি চোর-ডাকাত হয়ে তখন কী করবি?
মনিদীপা বলল, বললাম তো আমি দেখছি বিষয়টা।
মৃন্ময়ী নরম গলায় বললেন, হ্যাঁ রে সূর্যর সঙ্গে তোর কাল দেখা হবে? আমি কাল পায়েশ বানাব তাহলে ওকে একটু দিতিস।
মায়ের মুখে সূর্যর নামটা শুনেই অকারণে মনিদীপার গালে এক মুঠো আবির ছড়িয়ে গেল। হোয়াটসআপে জ্বলজ্বল করছে সূর্যর মেসেজটা।
সূর্যর সঙ্গে মনির আলাপ খুব অল্প দিনের। কিন্তু মাকে কোনো কথাই লুকিয়ে যায় না মনি। তাই সূর্যর সঙ্গে পরিচয়টাও বলেছিল। মায়ের দৃঢ় ধারণা সূর্য মনিকে পছন্দ করে। মনিও যে ওকে অপছন্দ করে এমন নয়। তবে সূর্যর সঙ্গে ওর বেশ কিছু চিন্তাভাবনায় বড্ড অমিল।
সূর্য বিশাল বড়লোকের ছেলে। বাবার বড় ব্যবসা আছে। সূর্য নিজে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করেও বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করতে চায় না। এই নিয়ে ওদের ফ্যামিলিতে বেশ অশান্তি চলছে। সূর্য যে চাকরি করতে চায় তাও নয়। একটু যেন কেমন অদ্ভুত টাইপ।
মনিদীপা আবার বড্ড গোছানো টাইপের মেয়ে। নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে স্থির। তাই এমন এলোমেলো স্বভাবের ছেলেকে ভালো লাগলেও সম্পর্কে সিরিয়াস হতে চাইছে না এখনই। তাছাড়া মাত্র মাস তিনেকের পরিচয় ওদের। তবুও কেন কে জানে সূর্যর মেসেজ বা ফোন পেলে একটু হলেও বেসামাল হয়ে পড়ে মনিদীপা। আগামীকাল সূর্যর সঙ্গে ওর দেখা হওয়ার কথা আছে। মনিদীপা যে স্কুলে গান শেখায় তার ঠিক পাশের বাড়িটা সূর্যর।
উজ্জয়নীর গানের স্কুল ওটা। উজ্জয়নী আর মনি একই সঙ্গে গান শিখেছিল সেই ছোট্ট থেকে। উজ্জয়নী হঠাৎই গ্রাজুয়েশনের পরে গানের স্কুল করে বসল। উদ্বোধনের দিন মনি নিজেও উপস্থিত ছিল ওর স্কুলে। বড্ড যত্ন করে সাজিয়েছিল উজ্জয়নী স্কুলটা। মেয়েটা বরাবরই বড্ড মুডি। মাস চারেক আগে মনির বাড়িতে হাজির। সঙ্গে বিয়ের কার্ড। মনি, আমি বিয়ে করছি রে। মনিদীপা জিজ্ঞেস করেছিল, কাকে বিয়ে করছিস এমন আচমকা। উজ্জয়িনী হেসে বলেছিল, সেও গান গাইতে পারে জানিস। আমরা দুজনে গানের ভেলায় ভেসে যাব। মনি বলেছিল, আর তোর শখের স্কুল?
সংগীত বাসরের কী হবে?
উজ্জয়িনী বলেছিল, আপাতত মাস পাঁচেক বন্ধ রাখব ভেবেছি তারপর নাহয়…পরক্ষণেই লাফিয়ে বলেছিল, এই মনি প্লিজ তুই আমার স্কুলটার দায়িত্ব নিবি। তুই তো দুর্দান্ত গান করিস। এখনও চর্চায় আছিস। তুই পারবি।
মনিদীপা হকচকিয়ে বলেছিল, আমি মাস্টার্স করছি, পড়াশোনার চাপ আছে রে। আমি কি পারব? উজ্জয়নী উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, আলবাত পারবি। আর সপ্তাহে মাত্র একদিন তো। শনিবার বিকেলে দু ঘণ্টার ক্লাস। পনেরো জন ছাত্রী-ছাত্রী আছে আমার স্কুলে। প্লিজ চালিয়ে দে কটা মাস। কিছুটা জোর করেই মনির ওপরে দায়িত্বটা চাপিয়ে দিয়েছিল উজ্জয়িনী। অবশ্যই এই পাঁচমাসের স্কুলের ইনকাম মনির। একটা টাকাও নেবে না উজ্জয়িনী।
মনিদীপা একটু ভয়ে ভয়েই শুরু করেছিল। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক যাওয়ার পরেই উজ্জয়িনীর সংগীত বাসরকে আপন করে নিয়েছিল।
সংগীত বাসরের ঠিক গায়েই তিনতলা সাদা আর ধূসর রঙের বাড়িটা সূর্যদের।
মনিদীপা খেয়াল করেছিল, ও যখন তানপুরায় সুর তোলে তখন রোজই দোতলার একটা নির্দিষ্ট ঘরের জানালা খুলে যায়। একটা মুখ জানালার গ্রিলে থুতনি ঠেকিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।
একদিন সংগীত বাসরের ক্লাস শেষে সমস্ত স্টুডেন্ট চলে যাওয়ার পরে দরজায় তালা ঝোলাবার জন্য রেডি হচ্ছিল মনিদীপা তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আসতে পারি?
সেই প্রথম জানালায় দেখা মুখটা স্পষ্ট চোখের সামনে দেখেছিল মনিদীপা। যাকে বলে সুপুরুষ। ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমার নাম সূর্য। আপনার? আগে তো এটা অন্য একজনের স্কুল ছিল, আপনি বুঝি নতুন?
মনিদীপা হেসে বলেছিল, ওহ তাকে দেখতে না পেয়েই বুঝি উতলা হয়ে উঠেছেন? কিন্তু স্যার তার তো বিয়ে হয়ে গেছে। সূর্য মুচকি হেসে বলেছিল, না ম্যাডাম উজ্জয়িনীর সঙ্গে আমার আলাপ ছিল মৌখিক। তাকে দেখার জন্য আমি জানালায় দাঁড়াতাম না নিয়ম করে। যেটা এখন করি।
মনিদীপা লজ্জা পেয়ে বলেছিল, উজ্জয়িনী আমায় দায়িত্ব দিয়েছে মাস পাঁচেকের। ও আমার বান্ধবী।
সূর্য বলেছিল, উজ্জয়িনী ম্যাডামের গান ভালো ছিল। কিন্তু আমাকে এভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি। যেটা মিস…
মনিদীপা বলেছিল, আমার নাম মনিদীপা তরফদার। সূর্য আলগোছে বলেছিল, মনিদীপা আপনার গলায় ম্যাজিক আছে, বিলিভ মি। অদ্ভুতভাবে জাদু করেছেন আমায়। এভাবেই আচমকা পরিচয় হয়েছিল সূর্যর সঙ্গে। তারপর ফোনে কথা বা হোয়াটসআপ চ্যাটেও কথা হয় রোজই।
একদিন গানের স্কুলে গিয়ে ওর স্কুটি বিগড়ে গিয়েছিল। সেদিন সূর্য ওকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল নিজের বাইকে করে।
সূর্যর যে মনিকে পছন্দ সেটা মাও বুঝে গেছে। অথচ মনিদীপার মনে এখনো দ্বন্দ্ব। হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে পড়ার জন্যই নাকি এমন সন্দেহবাতিক মন ওর, এটাই বলে মা মনিকে।
হোয়াটসআপ ওপেন করতেই চোখে পড়ল মেসেজটা, আমি মুহূর্ত গুনছি। আগামীকাল বিকেলের জন্য।
মনি কি উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে একটা হাসির ইমোজি পাঠিয়ে দিল।
নিজে পোশাক বদলে মেয়েটার জন্য একটা সালোয়ার নিয়ে বাইরে বেরোল।
মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, কি নাম তোমার?
মেয়েটা ভীতু গলায় বলল, সুপর্ণা। আমি চোর নই। চুরি করব বলে আসিনি।
মনিদীপা বলল, বেশ বুঝলাম। এখন ওয়াশরুমে গিয়ে পোশাক বদলে ফ্রেস হয়ে নাও। আমার বাবা মানুষ চিনতে ভুল করে না। তাই তুমি আজকের রাতটা এখানেই থাক।
মৃন্ময়ী চূড়ান্ত বিরক্ত হয়েই বললেন, বাবা-মেয়ে শুধু শুধু বাড়িতে না থেকে একটা আশ্রম খুলতে পার। আমার মতন পাপী-তাপি মানুষের একটু পুণ্য হয় তোমাদের সংস্পর্শে এসে।
খাওয়ার পরেই মনি সুপর্ণাকে ডেকে নিল নিজের ঘরে। মেয়েটার চোখেমুখে আতঙ্ক। সবসময়ই একটু অন্যমনস্ক যেন! না সে চোর নয়। সম্ভবত মানসিক রোগী।
মনিদীপা বলল, সুপর্ণা তুমি গান শুনতে ভালোবাসো? ফেভারিট সিঙ্গার কে তোমার?
সুপর্ণা হয়তো এমন প্রশ্ন আশা করেনি। তাই একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েই বলল, আমার অরিজিৎ সিংকে ভালো লাগে। শ্রেয়া ঘোষাল শুনতে ভালো লাগে। আমি তো গান চালিয়ে আয়নার সামনে নাচতাম। মনিদীপা হেসে বলল, আজ নাচবে? চলো দুজনে মিলে নাচি। সুপর্ণা উচ্ছ্বসিত হতে গিয়েও থমকে গিয়ে বলল, আজ থাক।
মনিদীপা হেসে বলল তবে থাক। তুমি কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়ছ সুপর্ণা? আমি সাইকোলজিতে মাস্টার্স করছি।
সুপর্ণা বলল, আমি ইংরাজি নিয়ে পড়ছি। আমার বিএ ফাইনাল ইয়ার। আমার দিদি মাস্টার্স করছে জিওগ্রাফি নিয়ে। আমরা দুই বোন।
মনিদীপা বলল, তার মানে তুমি সাহিত্য প্রেমী তাই তো! সুপর্ণা লজ্জিতভাবে বলল, ইংরাজি পড়তে আমার ভালো লাগে।
মনিদীপার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠেছে সুপর্ণা। এটাই মনির উদ্দেশ্য ছিল। কোথায় বাড়ি? কেন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এসব জিজ্ঞেস করলে মেয়েটা যে বলবে না এটা মনি জানে। মানুষ আরও সচেতন হয়ে যায় তখন। হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে পড়ার দৌলতে মানুষের মন বুঝতে একটু সুবিধাই হয়।
মনিদীপা ফিসফিস করে মজার ঢঙে বলল, আর ক্রাশ? প্রেম করো নাকি?
সুপর্ণা লজ্জিত গলায় বলল, ক্রাশ আছে কিন্তু প্রেম করি না। আমাদের পাড়ার অভিজিৎদাকে ভালো লাগে সেই ছোট থেকে। কিন্তু বলা হয়নি কখনো। এখন তো অভিজিৎদা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরিও পেয়ে গেল।
মনিদীপা বলল, সেকি এখনও প্রোপজ করে উঠতে পারনি? সুপর্ণা হেসে বলল, ধুর ওকে দেখলেই আমার লজ্জা করে।
মনিদীপা বলল, তোমাদের একই পাড়ায় বাড়ি? এবারে সুযোগ বুঝে টুক করে বলে ফেল।
সুপর্ণা অন্যমনস্ক স্বরে বলল তা আর বোধহয় হয় না দিদিভাই। সুপর্ণার মুখে দিদিভাই শব্দটা বড্ড মিষ্টি লাগল। না বিশ্বনাথ তরফদার মানুষ চিনতে ভুল করে না। এ মেয়েটা অন্তত চোর নয়। তবে এর একটা লুকানো ইতিহাস আছে। সেটার সন্ধান পেতে হবে মনিকে। খুব ধীরে ধীরে পৌঁছাতে হবে ওর মনের অন্দরমহলে। ওর কষ্ট যন্ত্রণাগুলোকে রক্তাক্ত না করে ধীর পায়ে এগোতে হবে।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। সামনে টিভিতে কোনো একটা হিন্দি সিরিয়াল চলছে।
সুপর্ণা আচমকা বলে বসল, তোমার কোনো ভাই নেই?
মনি হেসে বলল, না রে ভাই নেই। আমি একাই। কেন? মনিদীপা সুপর্ণাকে কখন যে তুই বলে ডেকেছে ওর খেয়াল নেই। মেয়েটার চোখদুটো বড্ড মায়া জড়ানো।
সুপর্ণা সামলে নিয়ে বলল, এমনি। আচ্ছা দিদিভাই প্রতিবাদ মানে কী?
মনি চুলটা আলগা খোঁপা করতে করতেই বলল, যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোকে প্রতিবাদ বলে।
সুপর্ণা বলল, প্রতিবাদ যে করে সে বুঝি খুব খারাপ মেয়ে হয়ে যায়! অন্যায় যে করে সে তাহলে ভালো কী করে হয়!
মনিদীপা একটু ভেবে বলল, আসলে কি জানিস আমাদের সমাজের অদ্ভুত নিয়ম আছে। যে অন্যায় করছে তাকেই সবাই আড়াল করতে চায়। তাই প্রতিবাদী চেহারাটা সকলের সম্মুখে চলে আসে। তখন সে হয়ে যায় বিতর্কিত চরিত্র।
সুপর্ণা বলল, কিন্তু অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে যে আরেকটা অন্যায় ঘটবে সেটা কেন কেউ বোঝে না? মনিদীপা বেশ বুঝতে পারছিল মেয়েটার মনের মধ্যে একটা ঝড় চলছে। কিন্তু ও কিছুতেই প্রকাশ করতে পারছে না। সংকোচ এসে পথরোধ করে দাঁড়াচ্ছে ওর।
সুপর্ণার ঠোঁটটা কেঁপে উঠল। কিছু বলতে গিয়েও পারল না। মনিদীপা বলল, তবে কী জানিস আমার বাবা বলে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করবি। নাহলে বুঝবো তুইও ওই অন্যায়কারীর মতোই অপরাধী। আমার বাবা ছোট থেকে কোনো অন্যায় দেখলেই এগিয়ে যেত।
সুপর্ণা মনির হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। ওর চেরী রেড স্কুটিটার দিকে আঙুল তুলে বলল, এটা কি তোমারই স্কুটি? নাকি সেকেন্ড হ্যান্ড কিনেছ কারোর কাছ থেকে?
মনি একটু হকচকিয়ে বলল, না শোরুম থেকে কিনে এনেছি। কেন রে?
মৃন্ময়ী কথাটা শুনতে পেয়েই বললেন, কেন গো মেয়ে স্কুটিতে তোমার কী দরকার? সেই বাড়িতে ঢুকে থেকে দেখছি স্কুটির দিকে নজর তোমার। কেন বলবে?
মনি মাকে থামিয়ে বলল, উফ মা তুমি থামবে। আমি তো কথা বলছি ওর সঙ্গে। মৃন্ময়ী বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
সুপর্ণা বলল, বিশ্বাস করবে আমায়? বলো বিশ্বাস করবে?
মনি ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, তুই নির্দ্বিধায় বল।
আমি মাত্র মাসখানেক আগে রেপড হতে হতে বেঁচে যাই। খুব কপালের জোরে একটা গাড়ির আলো এসে ছেলেটার মুখে পড়েছিল আর ছেলেটা পালিয়েছিল। আমি শুধু তখন দেখেছিলাম স্কুটির নম্বরটা। ঝড়ের গতিতে মনির স্কুটির নম্বরটা বলে দিল সুপর্ণা। বাড়িতেও বলেছিলাম এ ঘটনার কথা। কিন্তু বাবা-মা সবাই আমায় মুখ বন্ধ করে রাখতে বলেছে। সমাজে নাকি ওদের সম্মানহানি হবে। লোকে বলবে ছি ছি ওদের মেয়ের এভাবে সম্মানহানি হয়েছে? তার মানে মেয়েটা খারাপ। আমার নাকি বিয়ে হবে না, আমার দিদিকেও কেউ বিয়ে করতে চাইবে না, তাই আমি মুখ বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হই।
কিন্তু তারপর থেকে একটা রাতও আমি ঘুমাতে পারিনি বিশ্বাস করো। ছেলেটা স্কুটিটা নিয়ে মেট্রো স্টেশনের দিকে পালিয়ে গিয়েছিল। নিয়ম করে এই একমাস আমি রোজ বিকেলে মেট্রোর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি। আজকে দেখলাম এই নম্বরের স্কুটিটা চালিয়ে আসছে এক বয়স্ক ভদ্রলোক। বুঝতে পারলাম এই ভদ্রলোকের ছেলেই হয়তো…তাই তোমার বাবার পিছু পিছু তোমাদের বাড়িতে উপস্থিত হই। এসে দেখলাম আমার ভাবনা ভুল। এ বাড়িতে কোনো ছেলে নেই। কিন্তু বিশ্বাস করো ছেলেটা এই স্কুটিটা চেপেই এসেছিল। নম্বরের প্রতিটা ডিজিট দিবারাত্র ভাসছে চোখের সামনে।
মনিদীপা অবাক হয়ে বলল, তোর ভুল হচ্ছে সুপর্ণা। এ স্কুটি আমি আর বাবা ছাড়া আর কেউ কখনো চালায়নি রে। ওই অবস্থায় তুই হয়তো ঠিক মনে রাখতে পরিসনি। কিন্তু তুই থানায় যাসনি কেন?
সুপর্ণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই যে তুমি যেমন বিশ্বাস করলে না তেমন কোনো প্রমাণ ছাড়া থানাও যে বিশ্বাস করত না। তাছাড়া বাবা-মা বারণ করে দিয়েছিল। আমি যেন কাউকে না বলি। কিন্তু সারারাত আমি পাগলের মতো জেগে থাকি। সেই মুখটা ভাসে চোখের সামনে। আর এই স্কুটির নম্বরগুলো।
মনিদীপা বলল, তোর কোথাও ভুল হচ্ছে রে। আমার স্কুটির নম্বরের সঙ্গে তুই হয়তো সেই স্কুটির নম্বরগুলো ঘেঁটে ফেলেছিস! চল মা খেতে ডাকছে খেয়ে আসবি। তোর বাবা মা তো চিন্তা করবে তাদের একটা ফোন করে অন্তত বলে দে তুই বন্ধুর বাড়িতে আছিস।
নিজের পার্স থেকে ফোনটা বের করে বাড়িতে কল করল সুপর্ণা। মনিদীপা বলল, চল খেয়ে আসবি চল। কালকে সকালে আমি নিজে তোকে বাড়িতে পৌঁছে দেব। সুপর্ণা বাইরে বেরিয়েও আড়চোখে আরেকবার তাকালো উঠোনে রাখা রেড স্কুটিটার দিকে।
রাতে খাওয়ার টেবিলেও মা চুপচাপ ছিল। বিরক্তি স্পষ্ট মায়ের চোখেমুখে। বাবা শান্তভাবে খেয়ে যাচ্ছে, বিরাট ভুল কাজ করে ফেলার গ্লানি নেই মুখের শিরা-উপশিরায়। শুধু মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতে একটু অস্বস্তি রয়েছে। সুপর্ণা মনির পাশের চেয়ারেই বসেছে। সেভাবে খেতে পারছে না। আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে। থমথমে পরিবেশটাকে হালকা করতেই মনি বলল, কালকে আমি নিজে গিয়ে সুপর্ণাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব। মায়ের ঠোঁটের কোণে বিরক্তি। কেন ও নিজে চিনে বাড়ি যেতে পারবে না নাকি? অন্যের বাড়ি চিনে চলে আসতে পারছে। অপরিচিত লোককে রাস্তায় চেনা লাগছে আর নিজের বাড়ির রাস্তা ভুলে গেছে?
সুপর্ণা ঘাড়টা নিচু করে নিল। মনিদীপা বলল, ভুলবে কেন ওই তো আমায় চিনিয়ে নিয়ে যাবে।
রাতে সুপর্ণা মনির পাশেই শুয়ে পড়ল। আর একটাও কথা বলল না। মনিও জোর করল না।
‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শূন্যগগনবিহারী।
আমি আমার মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা—
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম অসীমগগনবিহারী’
গানটা তোমার জানা মনিদীপা? তাহলে কাল সন্ধেতে এই গানটা দিয়েই আমায় ডেকো প্লিজ।
সূর্যর মেসেজটা পড়তে পড়তে বারংবার লজ্জা পাচ্ছিল মনি। সূর্য লিখল, শুধু টাইপিং দেখাচ্ছে অথচ মেসেজ এসে পৌঁছাচ্ছে না আমার দুয়ারে।
তুমি কি শেষপর্যন্ত আমার প্রেমে পড়ে গেলে? তাই কি এত সংশয়?
মনিদীপা বলল, জানি না। কাল দেখা হচ্ছে। সত্যিই কী তবে মনিদীপা সূর্যের প্রেমে পড়ে গেল?
সকালে উঠেই নিজের চুড়িদারটা পরে রেডি হয়ে বসে আছে সুপর্ণা। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে স্কুটির নম্বর প্লেটের দিকে।
মনিও রেডি হচ্ছে। ওকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে টিউশন সেরে সংগীত বাসরে যাবে। মা দুটো টিফিন কৌটো ধরিয়ে দিয়ে বলল, একটাতে পায়েস আছে। আর আরেকটাতে লুচি তরকারি। তোর বাবার আজ জন্মদিন তাই পায়েস বানালাম।
তোরা ফিরে এলে রাতে ভালো করে রান্না করব।
মনি বলল, তাহলে আমি ফেরার পথে একটা কেক আনব মা। বাবা কাটবে আজ। মা মুচকি হেসে বলল, আনিস। ও মানুষ তো কোনোদিন মুখফুটে নিজের ইচ্ছের কথা জানতেও পারবে না।
মনিদীপা ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে বললো, হ্যাঁ রে সুপর্ণা ওই ঘটনাটা যখন ঘটেছিল তখন রাস্তায় লোকজন ছিল না?
সুপর্ণা ভয়ে ভয়ে বলল, আমি গলির রাস্তা ধরে যাচ্ছিলাম। তখন ঝড়ের পরে লোডশেডিং ছিল। গলির মুখটাতেই ছেলেটা এসে জোরে আমার বুকটা খামচে দিয়েছিল। আমি পড়ে গিয়েছিলাম রাস্তার ধারে। ছেলেটা আমার হাত ধরে টেনেছিল। তারপর জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ রেখেছিল। জামাটা ছিঁড়ে দিয়েছিল কিছুটা। আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। তখনই একটা গাড়ির আলো পড়েছিল ছেলেটার মুখে। ছেলেটা আমায় ছেড়ে দিয়েছিল। ওই গাড়ির আলোতেই দেখেছিলাম…থেমে গেল সুপর্ণা।
মনিদীপা বলল, চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি তোর বাড়িতে।
সুপর্ণার বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। স্কুটিতে মিনিট দশেকের রাস্তা। স্কুটি থেকে নেমে সুপর্ণা বললো, তুমি বুঝি অ্যাভেঞ্জারের ভক্ত?
মনিদীপা হেসে বলল, একেবারেই নয়। বরং উলটো। আমার ওসব মাথাধরা মুভি মোটেই পছন্দ নয়। সুপর্ণা হেসে বলল, তাহলে তোমার স্কুটিতে অ্যাভেঞ্জারের স্টিকার কেন লাগিয়েছো?
চমকে উঠল মনিদীপা। স্কুটিটা দুদিন পড়েছিল সূর্যর কাছে। ও সারিয়ে দেবে বলেছিল। ফেরত দেবার সময় বলেছিল, আমার ফেভারিট মুভির স্টিকার লাগিয়ে দিলাম তোমার স্কুটিতে।
চকিতে ঘটনাটা মনে পড়ে গেল মনিদীপার। সূর্যর হোয়াটসআপ ডিপিটা সুপর্ণার সামনে কাঁপা হাতে ধরল মনিদীপা। ঈশ্বরকে স্মরণ করে নিল, ভগবান যেন সুপর্ণা বলে এই ছেলেটা নয় দিদিভাই।
সকালে স্নান করতে করতেও সূর্যর প্রিয় গানটা বার দুয়েক গুনগুন করে নিয়েছে মনি। আজ এই গান শুনেই ওর ঘরের জানালা খুলবে সূর্য।
সুপর্ণা কেঁপে উঠল। ঠোঁটটা থরথর করে কাঁপছে। একটা আঙুল তুলে বলল, এটা কে হয় দিদিভাই তোমার? তুমি একে চেনো?
মনি অধৈর্য হয়ে বলল, তুই চিনিস?
সুপর্ণা ডুকরে কেঁদে উঠে বললো, দিদিভাই এই ছেলেটা। এই মুখটা দুঃস্বপ্নের মতো এসে দাঁড়ায় আমার সামনে আজ প্রায় একমাস ধরে। একে ভুলতে পারিনি এক মুহূর্তের জন্যও।
ব্যাগে সূর্যর জন্য মায়ের দেওয়া খাবার। ওর মনে ছিল তুমি সন্ধ্যার মেঘমালার সুর। সব ছাপিয়ে গিয়ে কঁকিয়ে উঠল সুপর্ণার গলাটা— ‘দিদিভাই এই ছেলেটা’।
মনিদীপা বলল, চল আমার সঙ্গে।
সংগীত বাসরের পাশের সাদা আর ধূসর বাড়িটার সামনে স্কুটিটা থামাল মনিদীপা।
বাড়ির নীচেই একজন পরিচারিকাকে দেখে মনিদীপা বলল, এই যে শুনছেন..এ বাড়ির ছেলে সূর্য আছে?
পরিচারিকা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে বলল, সূর্য, সেটা আবার কে? এ বাড়ির কোনো ছেলে নেই। দুই বয়স্ক মানুষের বাড়ি এটা। এদের ছেলে-মেয়েরা বাইরে থাকে। আমিই এদের দেখাশোনা করি।
আরও বিস্মিত হয়ে মনিদীপা বলল, কি বাজে বকছেন? সূর্য এ বাড়ির একমাত্র সন্তান। বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছে, বাবার বিজনেসে বসতে নারাজ…আপনি ওর বাবাকে ডেকে দিন প্লিজ।
ভিতর থেকে একজন সত্তর বছরের বয়স্ক ভদ্রলোক বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, শিউলি ওনাদের বলো এ বাড়িতে আর ভাড়া দেবার ঘর ফাঁকা নেই।
মনিদীপা এগিয়ে গিয়ে বলল, সূর্য কী আপনার ছেলে? ভদ্রলোক হেসে বললেন, আমার ছেলের নাম প্রকাশ। সূর্য বলে তো কাউকে চিনি না।
মনিদীপা বাধ্য হয়ে ছবিটা দেখিয়ে বললো, একে চেনেন?
ভদ্রলোক হেসে বললেন, ওহ অরুণ? তাই বলো। ও তো আমার ভাড়াটে। আমার তো দোতলা আর তিনতলায় ভাড়া থাকে অনেকে। এটা অরুণের ছবি। ওপরের ঘরে যাও ও রয়েছে এখনও।
মাথাটা কেমন টলছিল মনিদীপার। সূর্য ওকে নিজে বলেছিল, এটাই ওর বাড়ি। ওর বাবা, মা, কাকা, ভাই, বোন মিলে থাকে এই বাড়িতে। এত মিথ্যে কেন?
দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলল সূর্য। ওকে দেখে ভূত দেখার মতো চমক উঠে বলল, একি তুমি বাড়িতে? বাবা-মা কেউ দেখেনি তো?
মনিদীপা ওর সামনেই নিজের বাবাকে ফোন করে বলল, বাবা থানায় একটা রিপোর্ট লেখাতে হবে, এখুনি। নাহলে হয়তো হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে বিশ্বপ্রেমিকটি।
সুপর্ণাকে সামনে দাঁড় করিয়ে মনিদীপা বলল, চিনতে পারো নাকি অরুণ একে? ঝড়ের পরে লোডশেডিং-এর রাতে একে কোথাও দেখেছ নাকি তুমি?
অরুণ থতমত খেয়ে বলল, মনে পড়ছে না। সুপর্ণা ওর গালে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বলল, তোর ঘাড়ের কাছে ট্যাটুতে ”A” লেখা আছে। তাই না রে? রাস্তাঘাটে অন্ধকারে মেয়েদের সঙ্গে নোংরামি করাটা তোর স্বভাব। আর দিনের আলোয় অত্যন্ত ভদ্র প্রেমিক হয়ে মেয়েদের ফাঁসানোটা নেশা তাই না? মনিদীপা অরুণের জামার কলারটা সরাতেই চোখে পড়ল ”A” লেখা ট্যাটুটা।
অরুণকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। ওর নামে নাকি ফ্রড কেসের ডায়েরিও আছে।
শনিবারের ক্লাস করছে মনিদীপা। গলাটা একটু কেঁপে উঠল যেন। সুর কাটল বার দুয়েক।
বার দুয়েক চোখ চলে গেল ওই বন্ধ জানালাটার দিকে। সুপর্ণা ওর নতুন স্টুডেন্ট। সেও বসে আছে বাকি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে।
মনিদীপা কী তাহলে ওই মিথ্যুকটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল? তাই কী বুকের ডান দিকটা চিনচিন করছে?
সুপর্ণা বলল, দিদিভাই আমার এখন নিশ্চিন্তে ঘুম হয়। আর ওই মুখটা আমার সামনে আসে না জানো। তুমি আমায় বাঁচালে।
মৃন্ময়ী এসব জানার পরে একটু বেশিই চুপ হয়ে গেছেন। বিশ্বনাথ তরফদার তার স্বভাবগত ঠান্ডা স্বরে বলেছেন, মনি সময়কে একটু সময় দে, দেখিস সে সব ভুলিয়ে দেবে। মানুষটা খাঁটি হওয়া বড্ড জরুরি মনি। ভালোবাসা তো একটা অনুভূতি মাত্র। খাঁটি মানুষ পেলে ও অনুভূতি তৈরি হতে সময় লাগবে না। তুই শুধু সময়কে একটু সময় দিস।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে মনি বলেছে, বাবা তুমি আমার সুপারম্যান। লম্ফঝম্ফ না করেই কি সুন্দরভাবে আমার সামনে সত্যিটার প্রকাশ ঘটালে সুপর্ণাকে আমার কাছে এনে দিয়ে।
বিশ্বনাথবাবু হেসে বললেন, তোর মায়ের বকুনি খেয়ে একটু যা মানুষ হয়েছি। নির্মল হাসি বাবার মুখে। সেদিকে তাকিয়ে মনিদীপা মনে মনে বলল, শক্তি দাও আমায়, স্মৃতিগুলোকে ঝাপসা করে ফেলার জন্য।
মনিদীপা গুনগুন করে উঠল…
‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।
এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে
আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো—’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন