রুমমেট – অর্পিতা সরকার

অর্পিতা সরকার

তোর সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, মেসের ওই ছোট্ট ঘরটাতে। আমি আসামের নেহাতই মফসসলের মেয়ে। মুখচোরা, লাজুক…এত কথা না বলে বরং তোদের ভাষায় আনস্মার্ট বললেই ভালো হয়। আমাদের মেস বাড়ির মালিক মানে গগন জ্যেঠু বললেন, দরাজ খোলামেলা ঘর, দক্ষিণ খোলা বারান্দা। আমি, তুই আর আমার বাবা মিলে গেলাম গগন পাত্রর খোলামেলা ঘর দেখতে, তুই ততক্ষণে প্রথম দর্শনের সংকোচ কাটিয়ে ফেলেছিস। সংকোচ! আদৌ কি তোর মধ্যে সেটা ছিল রিয়া? তিনটে বছর তোকে খুব কাছ থেকে দেখে যেটা বুঝেছি, সেটা হলো সংকোচের ধার পাশ দিয়েও তুই যাস না। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তুই ফিসফিস করে বলেছিলিস, দুজন পাশাপাশি উঠতে পারবে না এমন সিঁড়ির মাথার ঘর কেমন খোলামেলা হয় সেটাই দেখার।

বাসন্তীদেবী কলেজের আশপাশে চক্কর মেরেই এই মেস বাড়িটা খুঁজে পেয়েছিলাম আমি আর বাবা। এসে দেখি আমার মতই আরেক তীর্থের কাক বসে আছে ঘরের আশায়।

তোর ধারণাই সত্যি হল রে, গগন জ্যেঠুর খোলামেলা ঘরে দুটো খাট পাশাপাশি রাখার পর যে কোনো একজনের পড়ার টেবিল রাখার জায়গা হবে। দুটো টেবিল ধরবে না। আমার বাপি আমার দিকে তাকিয়ে নেতিবাচক ঘাড় নাড়তেই আমি বুঝলাম বাপির পছন্দ হয়নি। তোরও দুই ভ্রুর মাঝে বিরক্তির চিহ্ন দেখেই বুঝলাম, অপছন্দের জিনিসকে জোর করে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ লড়াই চলছে মনের মধ্যে।

তারপরই তুই বিজ্ঞের মতো বলে বসলি, ইলেকট্রিক বিল কি ঘর ভাড়ার মধ্যেই? এই ঘরের ভাড়া কিছুতেই হাজার টাকা হওয়া উচিত নয়। তবুও যদি ইলেকট্রিক বিল এই হাজারে হয় তবেই ভেবে দেখব।

আমি আর বাপি মুগ্ধ হয়ে তোর সপ্রতিভ আচরণ দেখছিলাম। আমার মুখের ভ্যাবলা ভ্যাবলা চাহনি দেখেই তুই বোধহয় আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারিসনি, তাই বাপিকে জিজ্ঞেস করেছিলিস, হাজারের বেশি হওয়া উচিত আঙ্কেল আপনিই বলুন?

বাপি তখন তোর স্মার্টনেস দেখে মুগ্ধ, সেটা বাপির মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারছি।

বাপি আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, কি রে তুই থাকতে পারবি? সেদিন তুই না থাকলে আমার উত্তর নিশ্চিত না হত, কিন্তু তোর কনফিডেন্স দেখেই আমিও ঘাড় নেড়ে বললাম, না থাকার কি আছে। আমরা তো বেশিরভাগ সময় কলেজেই থাকব।

গগন জ্যেঠুও নিমপাতা গেলা মুখ করে তার ওই দুই চৌকি বসানো ফুটবল খেলার মাঠের মতো ঘরটাকে হাজার টাকাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন।

এরপর তুই আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলিস, আমার বড্ড বাজে স্বভাব, আমি চেয়ার টেবিলে বসে পড়তে পারি না। আধ শোয়া হয়ে পড়ার জন্য মায়ের কাছে খুব পিট্টি খাই। তাই স্টাডি টেবিল তুই আনতে পারিস ওই ফাঁকা জায়গায়। আমি হাঁফ ছেড়ে বললাম, যাক তোমার সাথে আমার একটা অন্তত মিল পেলাম। তুই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললি, আমিও এই বছরই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছি। আমি অবাক হয়ে বললাম, হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি তো!

তুই আবার বললি, আমিও ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।

আমিও বুদ্ধুর মতো আবার রিপিট করলাম, সেটা বুঝেছি।

এরপর তুই আমার কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে বললি, আমি তোর ঠাকুমা?

এতক্ষনে তোর কথার সূক্ষ্ম মানেটা ধরতে পেরে আমি বললাম, তুই কি কাল থেকেই থাকবি?

তুই একমুখ হেসে বললি, দয়া করে তুই বলিস রে, নাহলে আমার পিতৃদেব আবার ভাববে বয়েস বেড়ে গেছে মেয়ের তাই বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত।

কে জানে কেন, আমার মতো নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখা মেয়েরও প্রথম দর্শনেই তোকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। তোর ওই সপ্রতিভ আচরণ, আত্মবিশ্বাসী দুচোখ, মিশুকে স্বভাবের জন্যই বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি কলেজে সকলে বলা বলি শুরু করেছিল, দেবলীনা আর উজ্জয়িনী সম্ভবত লেসবি। তোর ওই খটমট নামটা ছাড়াও একটা ডাকনাম আছে কিনা জানতে চাওয়ায় তুই বলেছিলি, আছে লীনা, আমার নিক নেম রিয়া।

আমার নামকে পারমিশন ছাড়াই তুই ছোট করে নিয়ে ঘরোয়া করে নিয়েছিলিস, তখনও আমি অপেক্ষা করছিলাম, তোকে রিয়া বলে ডাকবার। ওই জন্যই তো তুই সবার প্রিয়, আর আমি কেবল প্রফেসরদের। জানিস রিয়া ডায়রী লেখার স্বভাবটা আমার আগে ছিল না রে। এই হঠাৎই আজ তোকে অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে হল বলেই নিয়ে বসলাম।

তবে কি জানিস, আমাদের তিনবছরের সব অনুভূতিদের ডায়রি বন্দি করতে গেলে, একটা ডায়রি কম পড়ে যাবে।

স্মৃতি কি কিছু কম আছে আমাদের। বিশেষ করে মিস উজ্জয়িনী যেখানে স্বয়ং বর্তমান সেখানে যে ঘটনার ঘনঘটা ঘটবেই তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে।

আমরা থাকতে শুরু করেছিলাম, গগন জ্যেঠুর ওই দরাজ ঘরে। যেখানে দেওয়ালে দড়ি টাঙিয়ে রাখা থাকত আমাদের রোজকার পরিধেয়। চৌকির নীচে থাকত মায়েদের সত্তর সালের বিয়ের ট্রাংক। তার মধ্যেই ভালো জামাকাপড়।

আমার বাড়ি যেহেতু অনেকটা দূরে তাই আমি বড় ছুটি না পেলে যেতেই পারতাম না। তুই বহরমপুর যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলিস কেন সেটা তুই মুখে না বললেও আমি জানি। এই ভ্যাবলারাম রাতে ভূতের ভয় পায় বলেই হয়তো। আমি জানি, তুই একদিন গগন জ্যেঠুকে বলেছিলিস, আমি কয়েকদিনের জন্য বাড়ি যাচ্ছি, জেঠিমা কি লীনার কাছে রাতে শুতে পারবে? মেয়েটা আবার এক থাকতে বড় ভয় পায়। কে জানে কেন, সমবয়সি হয়েও তোকে আমার অভিভাবক মনে করতাম। বারবার মনে হত, সব সমস্যার সমাধান তুই।

বারান্দার একপাশে ছিল আমাদের রান্নার ব্যবস্থা। আমাদের পুতুল পুতুল রান্না ঘর। আজও মনে আছে, আমার বানানো প্রথম রুটি খেয়ে তুই বলেছিলিস, হ্যাঁরে লীনা, তুই কি আমাকে সারমেয় গোত্রের ভেবেছিস?

পড়াশোনায় ব্রিলিয়ান্ট হলেই যে সব কথা এন্টেনায় ধরা পড়বে এমন নয়। আমারও মাথার এন্টেনাটা কেবল একদিকে ঘোরানো ছিল, সেখানে কেবল কেমিস্ট্রির ইকুয়েশন কাজ করত। তোর ওইসব ভুল ভাল কথায় পাত্তা না দিয়েই রুটিতে কামড় মেরেছিলাম। একটুকরো রুটি বেশ কিছুক্ষণ চিবিয়ে যখন চোয়াল ব্যথা হয়ে গিয়েছিল, তখন বুঝেছিলাম, তুই কেন নিজেকে কুত্তা বলেছিলিস।

তুই অমনই ছিলিস। ঝকঝকে, জড়তাহীন, প্রতিবাদী, মিশুকে…আরও অনেক কিছু। আমি বাংলার স্টুডেন্ট ছিলাম না, তাই এত সমার্থক শব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিন।

তোর ম্যাথস অনার্স ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই তুই একটু অঙ্ক কষে চলতিস। তাই তো আমাকে বলেছিলিস, বুঝলি লীনা আমরা যদি সকাল বেলা এই রান্নাবান্না নিয়ে বসি তো নামী কলেজের সার্টিফিকেট না নিয়ে সেরা রাঁধুনির পুরস্কার নিয়ে কলকাতা থেকে ফিরতে হবে। এক কাজ করি, জ্যেঠুকে বলি, একটা রাঁধুনি দেখে দিতে। তুই দুশো আমি দুশো দিলেই হবে।

তোর কথার বিরুদ্ধে কথা বলবো এত কনফিডেন্স হয়তো আজও নেই। আমি সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে পরের দিনই বাপিকে ফোন করলাম মোড়ের মাথার বুথ থেকে, বাপিও তোর কথায় একদম রাজি। দুশো টাকা বেশি আসতে শুরু করল পরের মাস থেকে। আমাদের রাঁধুনির বয়েস আবার আমাদের থেকে একটু কমই হবে। তাই তুই বাথরুমে গেলে কনক তোর নেলপলিশ পরে নিত এলোমেলো করে। তুই একদিন হেসে বলেছিলিস, কনক তুই কি জানিস নেলপলিশ পরলে মনখারাপ ভালো হয়ে যায়, তুই আমার নেলপলিশ থেকে রোজ নেলপলিশ পরবি। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম তোকে। কি সুন্দর করে ওর ওই ছোট্ট চুরিটাকেও তুই আটকে ছিলিস। আমি তোকে রিয়া বলে ডাকলেও উজ্জয়িনী নামেই তোকে মানাত বেশি। তোর চরিত্রের সাথে বেশ একটা গাম্ভীর্যপূর্ণ নাম থাকবে তবেই না। আমাকে ইভটিজিং করা ছেলেগুলোকে একদিন তুই রাস্তায় দাঁড় করিয়ে প্যান্টের চেন খুলতে বলেছিলিস। বলেছিলিস, আগে নিজেদের দৌড়টা দেখা, তারপর আমার ফ্রেন্ডের ব্রায়ের সাইজ জানবি। লজ্জায় আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম আমি। পরেরদিন থেকে ওড়নাটাকে চাদরের মতো জড়িয়ে বেরোচ্ছিলাম দেখে তুই বললি, এভাবে আমাকে ইনসাল্ট না করলেও পারতিস লীনা। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, কী করেছি রে?

তুই বিরক্ত মুখে ভ্রু কুঁচকে বলেছিলিস, ওই ছেলেগুলো আজ তোকে দেখে ভাববে ওদের ওই নোংরা কথায় বিশাল কাজ হয়েছে। একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে, আমার জন্য অপেক্ষা না করেই তুই চলে গিয়েছিলিস কলেজের দিকে। আমিও ওড়নাটা যে ভাবে রোজ নিতাম সেভাবেই নিয়ে বেরিয়েছিলাম। অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছিল জানিস, তোকে আজও বলা হয়নি। ওই রকে বসা ছেলেগুলো আমাকে দেখেই অন্য দিকে তাকিয়েছিল। একটা টুঁ শব্দ করেনি আর। ওদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমার মনে মনে গর্ব হচ্ছিল, তুই আমার বন্ধু বলে।

রিয়া জানি আজও হয়তো তুই আমাকে ক্ষমা করতে পারিস না। তবে আমার ভুলটা ভেঙেছে মাত্র দিন দুই আগে।

ফেসবুকের একটা ছবি দেখে।

অনেক খুঁজেছি তোকে। অর্কুট, গুগুল একাউন্ট কোথাও পাইনি।

উজ্জয়িনী মিত্র খুঁজে খুঁজে আমার ফার্স্ট সার্চ অপশন ওটাই হয়ে গিয়েছিল। পাই নি রে। সেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধের পর আমার চোখের অনেক নোনতা জলের বন্যা বয়ে গেছে, যেটার খবর তুই জানতিস না রিয়া।

আমাদের টিউশনেই পরিচয় হয়েছিল শুভদীপের সাথে। প্রথম দিন দেখেই আমি শুভদীপের প্রেমে পড়েছিলাম। প্রেমে যে পড়েছিলাম সেটা অবশ্য বুঝেছিলাম বেশ পরে। প্রথম প্রথম তো শুধুই ভালো বন্ধু ভাবতাম। গ্রুপ স্টাডি করার সময়ও শুভদীপ আমার গ্রুপেই পড়ত। কেন জানিনা ওর সাথেই আমার ওয়েভলেন্থ ম্যাচ করল সব থেকে বেশি। তারপর থেকে তোর আর আমার কথার মাঝে শুভদীপের হানাদারি শুরু হল। কথায় কথায় আমি বলে ফেলতাম ওর নাম। তুই চোখ ছোট করে বলতিস, বাচ্চাটাকে তো একদিন দেখতে হচ্ছে। তখন আমাদের পার্ট ওয়ান পরীক্ষার মারাত্মক চাপ। দুজনেই দারুণ রেজাল্ট করবার সংকল্প নিয়েই বাড়ি ছেড়ে এই অচেনা পরিবেশে আছি। তাই মাঝ রাত পর্যন্ত আমাদের ঘরে লাইট জ্বলত। গগন জ্যেঠু বলেছিলেন, পরের মাস থেকে ইলেকট্রিক বিল বাড়বে।

তুই ভেংচি কেটে বলেছিলিস, বাথরুমে জল ঢাললে নিজের দিকেই ফিরে আসে, তার জন্য আগে ফাইন দিন, তারপর ইলেকট্রিক বিল বাড়াবেন। গগন জ্যেঠু বিড়বিড় করতে করতে পালিয়ে বেঁচে ছিলেন।

আমি আর তুই জড়িয়ে ধরে খুব একচোট হেসে ছিলাম। তোর সাদা খাতায় তখন শুধুই সংখ্যার বাধ্যতা। আমার চোখে কেমিস্ট্রির অবাধ্য ফর্মুলা। অবশেষে পরীক্ষা শেষ হল আমাদের। কয়েকদিনের নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসতেই তোর সাথে পরিচয় হয়েছিল শুভদীপের। আমরা তিনজনে ভিক্টরিয়ার সামনে আড্ডা দিয়েছিলাম। শুভদীপ বলেছিল, লোকে ভাববে আমি দুজন মেয়ের সাথেই প্রেম করছি। আমার মনে সেই প্রথম আশা জেগেছিল, যে শুভদীপ হয়তো আমাকে ভালোবাসে। তাই এমন একটা কথা বলেছিল। মুশকিলটা হয়েছিল বেশ কয়েকদিন পরে। যখন তোর প্ররোচনায় আমি শুভদীপকে প্রোপোজটা করে ফেললাম। তুই বললি, বুঝলি লীনা, শুভদীপও তোর মতোই বাঁকা এন্টেনার পাবলিক। এ আরও ক্যাবলা, জীবনে কোনোদিন প্রোপজ করবে না। তার থেকে বরং বেহাত হবার আগে তুইই প্রোপোজ করে দে। তুই ছিলিস আমার গডমাদার, তাই তোর কথা মতো টিউশনি শেষে একসাথে ফেরার সময় আমতা আমতা করে বলেই দিলাম শুভদীপকে। শুভদীপ একটু ঘাবড়ে গিয়ে বোকা বোকা তাকিয়ে বলল, কিন্তু দেবলীনা আমি তো তোকে খুব ভালো বন্ধু ভাবি রে। এর বেশি কিছু নয়। আমি তোকে কখনো প্রেমিকা হিসাবে ভাবিনি। আসলে আমার মনে আমার প্রেমিকা সম্পর্কে একটা চেহারা আঁকা হয়ে গেছে, যার সাথে তোর মিল নেই রে দেবলীনা। আমার পা কাঁপছিল, হাত ঘামছিল। লজ্জায় আর অপমানে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। না, শুভদীপ অপমান করেনি। শুধু বুঝিয়ে বলেছিল। আমি রাগে গড়গড় করতে করতে দাঁত চেপে বলেছিলাম, তোর পছন্দের প্রেমিকার অবয়বটা জানতে পারি?

ও ভাবুক মুখে একটু চিন্তা করে বলেছিল, যেমন ধর উজ্জয়িনী, অনেকটা ওর মতন। সাহসি, ঝকঝকে, মেয়েলি ন্যাকামো বিহীন একজন হবে। আমি প্রায় ছুটতে ছুটতে বাসে উঠেছিলাম। পরের সপ্তাহে পড়তে গিয়ে শুভদীপের সাথে কথা বলিনি। ও বলতে এসেছিল, আমি সাড়া দিই নি। ও বলতে এসেছিল, আমরা যেমন বন্ধু ছিলাম তেমনই থাকি। আমি কোনো কথা না বলে চলে এসেছিলাম। আমাদের বন্ধুত্বের মৃত্যু ঘটেছিল স্যারের বাড়ির সামনেই।

তুইও রোজ রাতেই জিজ্ঞেস করেছিলিস, হ্যাঁরে, শুভদীপকে প্রোপোজ করতে পারলি, নাকি গলা কেঁপে টয়লেট করে বাড়ি চলে এলি। আমি বলেছিলাম, ওসব ছাড়। সামনেই ফাইনাল ইয়ার, পড়ায় মন দে। তুই তোর স্বভাব সুলভ ঢঙে বলেছিলি, চাপ নিস না, শুভদীপ তোকে বিয়ে না করলে আমি তো আছি রে। আমি রুটি করব তুই খাবি। তোর ওই সামান্য সামান্য মজাগুলোতেই আমার আরও রাগ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তুই সবটা জেনেও ইচ্ছা করে এমন করছিস। হয়তো শুভদীপ তোকে সবটা বলেছে। আমি একটু বেশিই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। খাবার পাতে তোর ডিম ভাজা থেকে কোনা কেটে নিলাম না দেখেই সেদিন তুই বলে বসলি, তুই বদলে যাচ্ছিস লীনা। আমিও সেই প্রথম বার তোকে বললাম, কেন রে, তুই একাই স্মার্ট হতে পারিস, তোর একারই আত্মসম্মান থাকতে পারে, আমার কিছু না! তুই আমার কথার ধারে চমকে গিয়েই হয়তো খাবার থালায় মন দিয়েছিলিস। তারপর থেকেই তোর আর আমার মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেলো। এতটাই সুক্ষ সে ব্যবধান যে সামনে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না। শুধু এখন আমি কলেজ যাওয়ার সময় আমাদের কমন দড়ি থেকে তোর ওড়না টেনে নিয়ে চলে যাই না, তুইও আমার ব্যাকক্লিপ মাথায় লাগিয়ে বেরিয়ে যাস না। তোর আর আমার মাঝের এই ফাটলটা আর কেউ না দেখতে পেলেও ওই ফাটলে দুজনেরই রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল, সেটা আমাদের মন ঠিকই বুঝতে পারছিল। তারপর সেই বৃষ্টিভেজা সন্ধেতে তোদের একসাথে দেখে আমাদের সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছিলাম আমি।

তুই বলেছিলিস তোদের টিউশন স্যার এক্সট্রা ক্লাস নেবেন পরীক্ষার সামনে। তাই ফিরতে সন্ধে হবে।

আমি ঘরে পড়ছিলাম, একা একা। সামনে পরীক্ষা তাই জীবন মরণ সংশয়। পার্ট ওয়ানের পরীক্ষায় যেহেতু আমার দুর্দান্ত রেজাল্ট হয়েছিলো, তাই প্রফেসররাও আমার ওপরে ভরসা করেন। সেই কারণেই হয়তো অথবা শুভদীপকে টেক্কা দেবার লোভেই দিনরাত এক করে পড়ে চলেছি। পড়তে পড়তেই ক্ষিদেটা অনুভব করেছিলাম। না, বিস্কুট, মুড়ির ক্ষিদে নয়। একটু মুখরোচক কিছুর ক্ষিদে। ঘরে পরা চুড়িদার পরেই ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম সামনের নটরাজ রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। মিশন মটন চাউ। ভেবেছিলাম বেশি করে কিনে আনব, তোরও খুব পছন্দ ছিল ওটা। টিউশন থেকে ফিরে ঘরে ঢুকেই তুই বলতিস, কি রে তোর স্টকে কি কিছু আছে, তাহলে ছুঁচোর মুখে একটু দিতাম। বলতে বলতেই আমার বিস্কুটের কৌটো থেকে বেকারির বিস্কুটে কামড় মেরে বলতিস, উফ! কি ক্ষিদে পেয়েছিল রে। ভাগ্যিস তুই ছিলিস। তোর সব ছেলে মানুষীগুলো মিস করছিলাম। তাই চেষ্টা করছিলাম আবার যদি ওই সুতোটাকে শক্ত করে বেঁধে নেওয়া যায়, যেটা ছিঁড়ে গিয়েছিল কদিন আগেই। আবার যদি আমাদের বন্ধুত্বের তানপুরার তারগুলো সঠিক সুরে বাজে তাহলে বোধহয় আমরা দুজনেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। মেস বাড়ি থেকে বেরোতেই বড় রাস্তায় ওঠার আগে যে কফি শপটা আছে তার কাচের জানালা দিয়ে দেখেছিলাম, তুই হাসি মুখে একটা ছেলের সাথে কথা বলছিস। হাতে নাতে ধরব বলেই এগিয়েছিলাম। আমাকে না জানিয়ে প্রেম করা, মনে কিন্তু বেশ আনন্দ ছিল বিশ্বাস কর, তোর মতো ডাকাত মেয়ে প্রেমে পড়েছে জেনে। কিন্তু কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকার আগেই দেখলাম তোর প্রেমিকের মুখটা। হাত থেকে পার্সটা পড়ে গেল মাটিতে। শুভদীপের এই স্কাইব্লু স্ট্রাইপ শার্টটা আমার ভীষণ পছন্দের ছিল। ক্ষিদেটা মরে গিয়েছিল, বরং গলার কাছে একটা বমি বমি ভাব নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছিলাম।

তুই ঢুকলি আধঘণ্টা পড়েই।

কবিরাজি কাটলেটের প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে বললি, গরম থাকতে থাকতে খেয়ে নে।

আর শোন, শুভদীপ তোর যোগ্য নয়। ওর দিকে আর ঘুরেও তাকাবি না বুঝলি। আমি আগ্নেয়গিরির মতো ব্লাস্ট করলাম। কেন রে রিয়া, ও বুঝি তোর যোগ্য?

উজ্জয়িনী মিত্র, মুখোশের আড়ালের মুখটা আজ বেশ পরিষ্কার আমার কাছে। কেন রে কলকাতা শহরে ছেলের বুঝি অভাব ছিল! নাকি তোর ছলাকলায় আর কেউ ঘায়েল হল না? কাটলেটের প্যাকেটটা ছুঁড়ে মারলাম তোর মুখে। তারপর বালিশে মুখ গুঁজে সারারাত কেঁদে ছিলাম। ভোর রাতে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একটু।

সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম, তুই স্থির চোখে তাকিয়ে আছিস আমার দিকে।

আমি দেখলাম, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটার বেইমানি, নির্লজ্জতা। ভিতরে ভিতরে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলেও বাইরে তার প্রকাশ করিনি আমরা কেউই। শুধু সেদিন থেকে লীনা আর রিয়া নামটা ধরে ডাকাডাকি শুনতে পায়নি গগন জ্যেঠু।

ফাইনাল এক্সাম শেষ হল, লাগেজ গুছিয়ে বেরিয়ে আসার সময় আমি বলেছিলাম, বিয়েতে নিমন্ত্রণ করিস উজ্জয়িনী। তুই আর শুভদীপ সুখে থাকিস। তোর ঠোঁটের ব্যাঙ্গের হাসিটা দেখে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো সেদিন। মনে হচ্ছিলো, শুভদীপকে জিতে নেবার অহংকার তোর চোখের দৃষ্টিতে।

কেটে গেছে অনেক বছর। আমি এখন একটা স্কুলের কেমিস্ট্রির টিচার। একসন্তানের মা। আমার ছেলের বয়েস দু-বছর। আমার স্বামী রেলের বড় অফিসার। সুখী দাম্পত্য জীবন আমাদের। শুভদীপ হারিয়ে গেছে ভাবনা থেকে সেই কবেই। এম এসসি করার সময়েই আলাপ হয়েছিলো অনির্বাণের সাথে, তারপরে দুজনেই জব পেয়ে বিয়ে করি। জানিস লীনা, আজও মোচার চপ খেতে গেলে মনে পড়ে তোর কথা। তুই বলতিস, ভাগ্যিস লোকে কলা পর্যন্ত অপেক্ষা করেনা, তাই তো এমন সুস্বাদু জিনিস খাওয়া যায়। আসলে তোর উপস্থিতিটাই ছিল ভীষন জমকালো। যার সাথে তুই দুদিনও কাটাবি সেই তোকে ভুলতে পারবে না, আর আমরা তো পাক্কা তিন বছর কাটিয়েছিলাম। তোকে ভোলা কি সহজ রে।

সপ্তাহ খানেক আগে শুভদীপ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে উঠেছিল। এই ছেলেটার জন্যই আমাদের বন্ধুত্বের মৃত্যু ঘটেছিল। না, শুভদীপের দোষ নেই, দোষী তো আমি রে। আমিই হিংসায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সেটাই তো স্বাভাবিক, উজ্জয়িনী আর দেবলীনা পাশাপাশি থাকলে যে কোনো মানুষের চোখ দেবলীনাকে অতিক্রম করে উজ্জয়িনীতে গিয়েই স্থির হবে। শুভদীপের দোষ নেই রে, ভেবেই ওর রিকোয়েস্টটা নিয়েছিলাম। চমকে গিয়েছিলাম ওর পাশে ওর বউ হিসেবে তোকে না দেখে। তারমানে তোদের ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছিল সেই ভেবেই মেসেঞ্জারে লিখেছিলাম, তুমি উজ্জয়িনীকে বিয়ে করো নি?

শুভদীপ দুটো স্মাইলি পাঠিয়ে বলেছিল, কি ইয়ার্কি করছিস দেবলীনা? উজ্জয়িনীর সাথে আমার প্রেম ছিল কবে যে বিয়ে করব?

আমার দু-চোখের অবাধ্য নোনতা জলের ধারাকে সম্বরণ করেই লিখেছিলাম, আমি যে তোকে আর ওকে ওই কফি শপে দেখেছিলাম সেই সন্ধেতে।

বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে ও বলেছিল, সেদিন তো আমি উজ্জয়িনীকে প্রোপোজ করেছিলাম। কিন্তু ও পরিষ্কার বলে দিয়েছিল, তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে ও বোনের লাভার হিসাবে দেখতে রাজি, অন্য কিছু নয়।

বিশ্বাস কর রিয়া, সেই মুহূর্ত থেকে বুকের ভিতরের রক্তক্ষরণটা হয়েই চলেছে। আমি এত কাছে থেকেও চিনতে পারলাম না তোকে। তোর মনের অভিমানের পাহাড়টা ডিঙানোর চেষ্টাও করলাম না একবারও। কোথায় হারিয়ে গেলি উজ্জয়িনী, একবার সুযোগ দে, নিজের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছি না রে। প্লিজ, রিয়া একবার, মাত্র একবার ধরা দে আমার কাছে। আবার তোর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দে আমাকে। দেখিস তোর অভিমানের পাহাড় ডিঙিয়ে আমরা আবার পৌঁছে যাব মেস বাড়ির সেই অগোছালো ঘরটাতে, যেখানে তুই পেত্নী সেজে আমাকে বলতিস আমি মরে গেলেও তোর ঘাড়ে চাপব, তোকে কিছুতেই ছাড়ব না। ফিরে আয় রিয়া, একবার ফিরে আয়।

ডায়রির পাতার অক্ষরগুলো ধেবড়ে যাচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা জলে।

সকল অধ্যায়

১. সুখের আড়ালে – অর্পিতা সরকার
২. সেদিন ভোরে – অর্পিতা সরকার
৩. নাম বিভ্রাট – অর্পিতা সরকার
৪. রেড স্কুটি এবং.. – অর্পিতা সরকার
৫. অগোছালো সংসার – অর্পিতা সরকার
৬. ভালোবাসার রামধনু – অর্পিতা সরকার
৭. ইছামতীর তীরে – অর্পিতা সরকার
৮. অলক্ষ্মী – অর্পিতা সরকার
৯. বিজয়িনী – অর্পিতা সরকার
১০. অবহেলা দ্য কিটু সাকসেস – অর্পিতা সরকার
১১. মনের ডুবুরি – অর্পিতা সরকার
১২. ভালোবাসা মিসিং – অর্পিতা সরকার
১৩. লোকে পাগল বলে ডাকে – অর্পিতা সরকার
১৪. নিলামে উঠেছি আমি – অর্পিতা সরকার
১৫. হঠাৎ বৃষ্টি – অর্পিতা সরকার
১৬. রুমমেট – অর্পিতা সরকার
১৭. এক টুকরো সুখ – অর্পিতা সরকার
১৮. দ্য মিস্ট্রি অফ ফ্রেন্ডশিপ – অর্পিতা সরকার
১৯. যদি কখনো অজান্তে – অর্পিতা সরকার
২০. আট নম্বর রুম – অর্পিতা সরকার
২১. ফর এভার – অর্পিতা সরকার
২২. নিশ্চুপ পিয়ানো – অর্পিতা সরকার
২৩. চলো বন্ধু হই – অর্পিতা সরকার
২৪. সূর্যমুখী – অর্পিতা সরকার
২৫. বাবা – অর্পিতা সরকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন