এক টুকরো সুখ – অর্পিতা সরকার

অর্পিতা সরকার

দিনরাত কী এত টেনশন করছ বলবে? খাওয়ার সময়েও কপালে ভাঁজ কেন! ফুলকপির রেসিপিটা কেমন হয়েছে বললেও না! ইউটিউব দেখে শিখেছি।

গরম ভাতে ডাল সেদ্ধটা মাখতে মাখতে পূর্ণেন্দু বলল, ভালো হয়েছে, ভালো হয়েছে। এত কেন করতে যাও, আমার যাহোক কিছু হলেই চলে। অপর্ণা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, সারাদিন তো বাড়িতেই থাকি, একটা তরকারি আর ডাল করতে পারব না! আশ্চর্য লোক বটে। একটু কুণ্ঠার সাথেই ও বলল, আসলে অপর্ণা…ভেবেছিলাম এ মাসে তুমি আর আমি একটু কোথাও ঘুরে আসব। বিয়ের পর থেকে তো মন্দারমনি ছাড়া আর কোথাও ঘোরা হয়ে ওঠেনি। ওদিকে দিদির ছোটছেলের অন্নপ্রাশনে সোনার হার দিতে হবে বলে বাবা কাল রাতে ফোন করেছিল। চাকরি তো করছি সবে তিনটে বছর। এর মধ্যে এই ফ্ল্যাটটা নেওয়ার পর মাসের প্রথমেই মাইনে থেকে বেশ কিছু টাকা কেটে নেয় হোম লোনের জন্য। তবুও তো ব্যাংকে চাকরি করি বলেই এই মাইনেতে ফ্ল্যাটটা নেওয়ার রিস্ক নিলাম, লোনটা নিয়ে প্রবলেম হল না।

অপর্ণা একটু চিন্তা করে বলল, কিন্তু আগের ফ্ল্যাটে তো অনেকগুলো টাকা করে ভাড়া গুনতে হচ্ছিল গো!

আচ্ছা পূর্ণেন্দু, তুমি কি এই ক্ল্যারিকাল জবটা ছাড়া অন্য কিছু পেতে পার না!

পূর্ণেন্দু একটু হেসে বলল, বুঝলে অপর্ণা আমরা একটা কোচিং সেন্টারে সবাই মিলে চাকরির কোচিং নিতে যেতাম। প্রচুর ছেলে-মেয়ে ছিল সেখানে।

সবারই লক্ষ্য ছিল সরকারি চাকরি। জেনারেল লাইনে পড়ে এ ছাড়া উপায়ই বা কী! আমার বাবার ক্ষমতা ছিল না খরচ করে এম বি এ পড়াবে। আমাকে স্যার বলেছিলেন, পূর্ণেন্দু বয়েস কিন্তু এগোচ্ছে, পারলে এ বছর লাগিয়ে ফেল ব্যাংকে। নাহলে কিন্তু বেশ কিছু ব্যাংকের পরীক্ষা তোমার হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে। প্রথম ব্যাংকে যে চাকরিটা পেয়েছিলাম সেটা মেঘালয়ে। তাই পেয়েও ছেড়ে দিলাম। নিজের রাজ্যেই চেষ্টা করছিলাম দাঁতে দাঁত চেপে। কোনোবার কাট অফ উঠছে ৭৫ আমি পাচ্ছি ৭৩। মুঠো ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তারপর যেদিন এস বি আইএ এই জবটা পেলাম সেদিন কোচিংয়ের সবাই বেশ সমীহর চোখে তাকিয়েছিল। ততদিনে আমারও বয়েস সাতাশের কোটা পার হচ্ছে। আমি কোনোদিনই খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলাম না। সায়েন্স নিয়ে পড়লেও রেজাল্ট তেমন দেখনদার নয়। মিডিল বেঞ্চের মিডিওকার। আমার কাছে ক্লারিক্যাল জব মানেই অনেক। পি ও র এক্সামের রেজাল্ট দেখতেই সাহস হত না। বন্ধুরা ফোনে বলত, হয়নি রে। আমাকে ওই কোচিং থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হল, আমি খুব খুশি হলাম। আসলে বাবার টাকায় ফর্ম তুলতে তুলতে আমি তখন মেরুদণ্ডের পচন শুনতে পাচ্ছি। প্রতিবার ফর্মের টাকা চাইতে গেলেই বাবা উদাস স্বরে বলত, এটা কী এল আই সি? এটা কি রেল? মাথা নিচু করে বলতাম, দিয়ে দেখি। প্রিলি পাশ করার পর বন্ধুদের কঙ্গোও পেতাম। পাড়ার মাঠে জল্পনা হত, যদি মেইন পাশ করতে পারিস তাহলেই তো তোর মাইনে হবে প্রায় একুশ রে!

পাঁচশো টাকা পকেটমানির লোক একুশ হাজার শুনেই কড় গুনে হিসেব করতে লাগতাম। মনে হত, ওরে বাপরে মাসে মাসে কত টাকা!

জবের জয়েনিং ডেটের দিন বাবা, মা, দিদি সবাইকে প্রনাম করার সময় প্রথম অতটা নিচু হয়ে প্রণাম করার পরেও সোজা হয়ে ঋজু শিরদাঁড়ায় দাঁড়াতে পেরেছিলাম। মা বলেছিল, এবারে আমায় একটা শ্বেতপাথরের ঠাকুরের সিংহাসন কিনে দিবি ইন্দু?

দিদি বলেছিল, তোর জামাইবাবুকে বলে বলে অস্থির হয়ে গেছি তাও দেয়নি, ভাই আমায় একটা হেয়ার স্ট্রেইটনার কিনে দিবি? বাবা শুধু তৃপ্তির চোখে তাকিয়ে বলেছিল, একদিন বড় রেস্টুরেন্টে খাওয়াস তো ইন্দু, ওই টিভিতে যেমন দেখায়! সারাজীবন কেরানির চাকরি করে ডাল-ভাত জীবন টেনে ওসব জায়গায় যাওয়াই হল না কখনো।

প্রথম কেউ আমার কাছে আব্দার করেছিল জানো। সুখী সুখী উষ্ণ হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ডেলিপ্যাসেঞ্জারদের মতো ট্রেনের কামরায় পা রেখেছিলাম আমি। দু-দিন অফিস করেই বুঝেছিলাম, বর্ধমান থেকে কলকাতা রেগুলার অফিস করা সত্যিই ইম্পসেবেল। বাবা বলেছিল, শুধু রাতটুকু ঘুমানোর জন্য কেউ বাড়ি ফেরে নাকি! শরীরের থাকবেটা কি! মায়ের চোখে কষ্ট রোজ ছেলেকে না দেখতে পাবার। ওইভাবেই মাস পাঁচেক যাতায়াত করার পরে আর পারছিলাম না। একটা মেসে শিফট করে গেলাম। সপ্তাহান্তে যেতাম বাড়ি।

এরই মধ্যে দিদি এসে বলল, ভাই একা কেন থাকবে? একটা বিয়ে দাও, ওখানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকুক। আমি তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলাম আর দুটো বছর পরে!

দিদি আর মা মিলে যুক্তি করে নিয়ে গেল মেয়ে দেখতে।

যখন বুঝলাম আমি মেয়ে দেখতে এসেছি পাত্র সেজে, তখন অলরেডি তুমি সামনে এসে গেছ অপর্ণা!

কী জানি কী হল তোমায় দেখে, মনে হল এই পারফেক্ট আমার জন্য। আমার লড়াইগুলো বুঝবে। আমার কষ্টগুলোর সাথী হবে।

তোমার মা বলেছিলেন, আমার তিন মেয়ে, এই হল বড়। নিজের মেয়ে বলে বলছি না, আমার মেয়ের একটাই গুন, ও যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে। এখন বিয়ে করব না বলে জেদ ধরা ছেলেটাও সুবোধ বালকের মতো বলে বসল, মেয়ে আমার পছন্দ।

অপর্ণার গালে হালকা লালের আভা। সেদিকে বোকার মতো তাকিয়ে পূর্ণেন্দু বলল, তুমি এখনও আমায় লজ্জা পাও!

অপর্ণা একমুখ হেসে বলল, হ্যাঁ গো আজ কি ব্যাংক ছুটি! পা ছড়িয়ে গল্প করতে বসলে যে!

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেও পূর্ণেন্দু বলল, শোনো না, তারপর আমাদের বিয়েটা হয়েই গেল। বুঝলাম একুশ হাজার টাকাটা দুটো সংসারের জন্য নস্যির সমান। তবুও হোম লোন নিয়ে তোমায় নিজের ফ্ল্যাটে রাখার দুঃসাহস হল। বাবার পেনশনে কুলায় না সবটা, তুমি তো জানোই। লোকলৌকিকতা হলেই বাবার ফোন আসে। অপর্ণা, তোমার খুব কষ্ট হয় তাই না গো!

তোমার মতো সুন্দরী মেয়ের তো আরও ভালো বিয়ে হতে পারত। আসলে তখন বোধহয় তুমি জানতে না ব্যাংকে চাকরি করা মানেই সে ব্যাংকের মালিক নয়, তাই না!

অপর্ণা মুখ বেঁকিয়ে বলল, তুমি ওঠো তো, আমার কিছু সমস্যা হচ্ছে না। নেক্সট মাসে বেড়াতে গেলেই হবে। তুমি দিদির ছেলের গয়নার জন্য টাকাটা পাঠাও। আর এখন অফিসে যাও।

পূর্ণেন্দুর মুখে তৃপ্তির হাসি। অপর্ণা, ফুলকপিটা একটু টিফিনেও দিয়ে দিও তো। দত্তদা প্রায় বলে তোমার বউ কেমন রান্না করে একটুও তো খাওয়ালে না!

হাসি মুখে পূর্ণেন্দুর টিফিনটা গুছিয়ে দিল ও।

ফোনটা বাজছে দেখে রিসিভ করেই দেখল ওর ছোটবোন ঈশা।

এই দিদিভাই, তোর কাছে গ্রীন আর ইয়েলো শাড়ি আছে রে! কলেজ ফেস্টে পরবো।

অপর্ণা বলল, দাঁড়া দেখে বলছি। বিয়েতে পাওয়া অনেক শাড়িই তো এখনো ভাঙাই হয়নি। চুড়িদার পরেই বাজার দোকানে যাই বলে শাড়িগুলোর রংগুলো সব সময় মনে থাকে না রে।

কথা বলতে বলতেই দেখল, পূর্ণেন্দু হাত নেড়ে টা টা করে বেরিয়ে গেল অফিস।

আলমারি খুলতেই নতুন-পুরোনো অনেক শাড়ির গন্ধের সাথে পুরোনো অ্যালবামটাও চোখে পড়ল।

হ্যাঁ রে ঈশা, একটা সানা সিল্ক আছে ওই কম্বিনেশনে, আরেকটা তাঁত আছে।

ঈশা লাফিয়ে উঠে বলল, যাক প্রবলেম মিটল। আমি কাল দুপুরে কলেজ থেকে তোর বাড়ি যাব। শাড়িটা নিয়ে সন্ধেতে ব্যাক করব। ভালো ভালো রেঁধে রাখিস। শুধু তো জিজুকেই খাওয়াস।

অপর্ণা হেসে বলল, বেশ তুই আয় হিংসুটে, তোর সবটা আদর রেখে দিলাম, জিজুকেও দেব না।

পূর্ণেন্দু চলে যাবার পরে অখণ্ড অবসর অপর্ণার।

ফেসবুক ঘাঁটা, গল্পের বই পড়া, গান শোনা বা কোনো মুভি দেখা এ ছাড়া আর কাজই বা কি দুটো মানুষের সংসারে।

অ্যালবামটা খুলতেই ছুটে এসে নাকে প্রবেশ করল ওর মেয়েবেলার কিছু পুরোনো ছবির গন্ধ। কলেজের বান্ধবীদের সাথে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা দেবদারু গাছের তলায়। ছবিটা খুলতেই মেয়েগুলোর মুখগুলো পরিষ্কার হল। এর মধ্যে শুধু প্রিয়াংকা আছে ওর ফ্রেন্ড লিস্টে। বাকিগুলো গেল কোথায়! কতদিন কোনো যোগাযোগই নেই। অথচ কলেজ ছাড়ার দিন সকলেরই চোখের কোণে জল ছিল, মনে ছিল প্রতিশ্রুতি, আবার মিট করব আমরা। মুখে বলেছিল তোদের সকলকে ভীষণ মিস করব রে। কোনোটাই কিন্তু ফাঁকি ছিল না, সবটাই ছিল অন্তর থেকে। তারপর কে যে কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে। যোগাযোগ কমতে কমতে মুছে গেল স্মৃতিরেখা থেকে।

ফেসবুকে খুঁজেতে হবে এদের। ফোনটা নিয়েই সার্চ করতে লাগল বন্ধুদের নামগুলো। এই রে বিয়ের পরে আবার সারনেম পালটে যায়নি তো! তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছিল অপর্ণা। হঠাৎই ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে খেয়াল হল, আরে, টিফিনবক্সটা তো নিয়েই যেতে ভুলে গেছে মানুষটা। দিনরাত কি যে দুশ্চিন্তা করে যাচ্ছে, কে জানে। ওরা তো যথেষ্ট ভালো আছে। কজন থাকতে পারে কলকাতার মতো শহরে নিজস্ব ফ্ল্যাটে। ছয়শো স্কয়ারফুট হলেই বা, এই বা কজনের আছে! বিয়ের দুটো বছর মাত্র হয়েছে, তার মধ্যেই অপর্ণা যা পেয়েছে ওর কোনো আক্ষেপ নেই।

ধুর, এই মানুষটার জন্য একটুও শান্তি পায়না ও।

চুড়িদারটা পরে কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে ভাবল, একটা কাজ করলেও হয়, ওকে টিফিনটা ব্যাংকে দিয়ে, পার্লারটা করে ফিরলে হয়। বহুদিন ফেসিয়াল করা হয়নি। বেস্ট আইডিয়া। ফিরে খাবে, একদিন ভাত খেতে দেরি হলে মরে যাবে না।

ফ্ল্যাটে লক করে লিফটে চাপল অপর্ণা।

পূর্ণেন্দুর ব্যাংকে যখন পৌঁছল তখন বেশ ভিড় রয়েছে কাউন্টারগুলোতে। এর আগে দু-দিন মাত্র এসেছিল ও এই ব্যাংকে। একটা জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের জন্য, আর একটা কী কারণে যেন!

সোজা পূর্ণেন্দুর কাউন্টারে যেতেই ও হেসে বলল, জাস্ট দু মিনিট দাঁড়াও। এই কাস্টমারটাকে ছেড়েই বেরোচ্ছি।

একটা নয় তিনজনকে ছেড়ে বেরিয়ে এল ও।

অপর্ণার হাতের টিফিনবক্সটা দেখেই বলল, ওহ, দেখেছ ভুলে গেছি। ওই জন্যই বলি, বাড়িতে বেশি সেজেগুজে থেকো না, তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সব ভুলে যাই আমি। আবার কষ্ট করে আসতে গেলে কেন, কিছু একটা খেয়ে নিতাম।

অপর্ণা মুখ বেঁকিয়ে বলল, খালি ঢং। কাউন্টারের মেয়েগুলো তো বেশ দেখতে সুন্দর। পূর্ণেন্দু ফিসফিস করে বলল, ওদের দিকে তাকাতে সাহস পাইনা, ওরা তো আমার বউ নয়, তাই।

অপর্ণা ফিক করে হেসে বলল, চললাম। যাও কাজ করো, খেয়ে নিও।

লিফটে ওঠার মুখেই ভীষণ পরিচিত অথচ অপরিচয়ের আড়ালে ঢাকা একজনের মুখ দেখে থমকে তাকাল কয়েক পলক! খুব চেনা একজনের মুখের সাথে বেশ মিল আছে, কিন্তু সে ছিল নিতান্ত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, আর এনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, হাই স্ট্যান্ডার্ড ফ্যামিলিতে বিলং করেন। চোখের দৃষ্টি সরিয়েই নিতে যাচ্ছিল তার আগেই মহিলা অল্প হেসে বলল, অপর্ণা না? হুগলি উইমেনস

অপর্ণা লিফটের মধ্যেই ওর হাতটা চেপে ধরে বলল, আরে মহুয়া! মাই গড, কী পরিবর্তন তোর! সেই লম্বা বেণী কোথায় গেল রে! আর দুই ভ্রুর মধ্যে কালো তিলের মতো টিপটাই ছিল তোর সিগনেচার আইডি।

মহুয়া মুচকি হেসে বলল, সেসব কবেই উড়ে গেছে। বিয়ে হয়েছে তিনবছর হল।

লিফট এসে গেল গ্রাউন্ডফ্লোরে।

এই তিনবছরে ওই মধ্যবিত্ত মহুয়াকে জাস্ট ধুয়ে মুছে ফেলে দিতে হয়েছে রে। বুঝতেই তো পারছিস, যে ফ্যামিলিতে বিয়ে হয়েছে আমার সেখানে আগের মহুয়াকে চেঞ্জ না করলে আকাশের মান সম্মান থাকত না।

অপর্ণা বলল, সে বেশ করেছিস। এই লুকেও তোকে ঘ্যাম লাগছে কিন্তু। আমি তো কথা বলতেই ভয় পাচ্ছিলাম।

আজকেই আমাদের পুরোনো কলেজের ছবিটা দেখছিলাম। আমরা রেলগাড়ির মতো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দেখে হেসেই বাঁচি না। কীসব দিন ছিল বল।

তারপরেই ফেসবুকে সবাইকে খুঁজতে চেষ্টা করছিলাম।

মহুয়া বলল, আমায় মহুয়া বলে পাবি না। আমার বরের দেওয়া আদরের নামেই খুলেছি অ্যাকাউন্ট। মুনিয়া রায় বলে সার্চ করবি পেয়ে যাবি।

হ্যাঁ রে, তুই এই ব্যাংকে কী করছিলিস! কাছেই নাকি তোর বাড়ি?

অপর্ণা হেসে বলল, হ্যাঁ রে কাছেই, ট্যাক্সিতে মিনিট দশেক লাগে। আরে আমার হাজবেন্ড পূর্ণেন্দু তো এই ব্যাংকেই আছে।

মহুয়া ওর হাতটা ধরে বলল, এই ব্রাঞ্চে?

মাই গড, আমার ফ্ল্যাটও এখান থেকে মিনিট কুড়ি লাগে। আর আমার হাজবেন্ড তো এই ব্রাঞ্চের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার রে। তোর বরের নাম বল, আমি কর্তাকে বলব পরিচয় করতে। বলব আমার কলেজ ফ্রেন্ডের হাবি।

এই শোন না, অপর্ণা, তুই কিন্তু রিকোয়েস্ট পাঠাবি।

আরে আমি আজ ব্যাংকে এসেছিলাম কারণ আমার এখানেই যাবতীয় অ্যাকাউন্ট, তাই একটু কাজে এসেছিলাম। তোর মত বরের সাথে প্রেম করতে নয় মশাই।

অপর্ণা হেসে বলল, থাম তো, প্রেম নয়, টিফিন ফেলে এসেছিল, তাই দিতে।

ফোন নম্বর বিনিময়ের পর হালকা খুশির বাতাস বইছিল দুই বন্ধুর মনেই। কত কত পুরোনো স্মৃতি উঠে আসছিল মুহূর্তের গল্পে। অপর্ণা বলল, এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নয়, একদিন আমার বাড়িতে চলে আয়, জমিয়ে আড্ডা দেব। মহুয়া ফোন নম্বরটা দিয়ে বলল, এটাই বেস্ট আইডিয়া।

সামনের উইকেই আসছিস তুই আমার ফ্ল্যাটে। তারপর আমি তোর ফ্ল্যাটে যাব। দুই বন্ধু জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা বিনিময় করল। মহুয়া এগিয়ে গেল পার্কিংয়ের দিকে। অপর্ণা বাসের সিঁড়িতে পা দিল।

মনে হচ্ছিল কখন পূর্ণেন্দু ফিরবে, আর কখন ওকে সব বলবে। ইস, ওর কত পুরোনো বন্ধুর সাথে আচমকা দেখা হয়ে গেল। মহুয়া ওর খুব ভালো বন্ধু ছিল। বাকি আছে প্রীতিটাকে খুঁজে বের করা।

মহুয়ার বরও পূর্ণেন্দুর ব্যাংকেই জব করে। কী মিল ওদের!

সন্ধেতে পূর্ণেন্দু ফিরতেই একঝুড়ি কথার সাথে চায়ের ট্রে নিয়ে এসে সামনে বসল অপর্ণা!

এই শোনো না, তুমি আকাশ রায়কে চেন? আরে তোমাদের ব্যাংকেই চাকরি করে গো!

পূর্ণেন্দু একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি স্যারকে কী করে চিনলে!

অপর্ণা হাসি মুখে বলল, আরে স্যার স্যার করো না তো, উনি আমার কাছের বন্ধুর বর বুঝলে!

পূর্ণেন্দু মলিন হেসে বলল, তোমার বন্ধুর বর বলেই তো সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে না! উনি হলেন ওই ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। উনি তো অফিসার গো! আর আমি ওই ব্রাঞ্চের সামান্য ক্লার্ক। এই দুটোর পার্থক্য বোঝো প্লিজ।

অপর্ণা বিরক্ত হয়ে বলল, থামো তো, দুজনের কাজই তো ব্যাংকে বসে টাকা গোনা। সে উনি একটু সিনিয়র তো কি হয়েছে।

পূর্ণেন্দু আর বোঝানোর চেষ্টা না করেই চায়ের কাপটা টেনে নিল। পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে পেয়ে অপর্ণার ঠোঁটে যে হাসি ফুটেছে সেই হাসির উৎসস্থলে আঘাত করতে মন চাইলো না। বোঝাতে পারল না, আকাশ রায়ের নামের আগে ওরা দ্য বসায়। রীতিমতো রাজকীয় ভাবে সাজানো থাকে ওনার কেবিনটা। এত জটিলতায় দরকার কি অপর্ণার।

ও ফেসবুকে মহুয়ার অ্যাকাউন্টে ঢুকে ছবিগুলো দেখতে ব্যস্ত। বেশিরভাগই বিদেশ ট্যুরের ছবি।

আচমকা অপর্ণা বলল, শোনো আমরাও এবারে পাহাড়ে যাব। দার্জিলিং যাব।

পূর্ণেন্দু ঘাড় নেড়ে বলল, কিন্তু অপর্ণা তুমি যে ছবিগুলো দেখছ ওগুলো দার্জিলিংয়ের নয়, সম্ভবত সুইজারল্যান্ডের।

অপর্ণা অসহায়ভাবে হেসে বলল, ওহ।

শোনো না, মহুয়া খুব ভালো মেয়ে জানো। এই রবিবার ও যেতে বলেছে, তোমায় নিয়ে যেতে বলেছে। তোমার সাথে ওর কর্তার আলাপ করিয়ে দেবে। তোমরা তো কলিগ, অথচ আলাপ নেই, এটাই তো খারাপ।

পূর্ণেন্দু দেখছিল অপর্ণার সহজ চোখের চাউনিটা। মেয়েটা বড্ড সরল। জটিলতা শব্দটা ওর ডিকশনারিতে নেই। তাই ওর ছোট ছোট চাওয়াগুলোতে মুখের ওপর না বলতে ভালো লাগে না পূর্ণেন্দুর।

এই যে অমন একজন অফিসার, যে ওকে জাস্ট চেনেই না হয়তো, অথবা ভিড়ের মাঝে বার দুই দেখেছেন… তার বাড়িতে যাওয়ার সাহস ওর কোনোদিনই ছিল না। কিন্তু অপর্ণাকে বোঝাবে কে!

সে তো মহুয়ার বাড়িতে কোন পোশাক পরে যাবে তাই ঠিক করতে বসে গেছে।

একটু ভয়ে ভয়েই রবিবারের সন্ধেতে পূর্ণেন্দু পা রেখেছিলো আকাশ রায়ের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টে।

মহুয়া মানে অপর্ণার বান্ধবীও বেশ যত্ন আত্তি করেছিল ওদের। আকাশ রায়ও পূর্ণেন্দুর ফোন নম্বরটা নেওয়ার সময় বললেন, ক্লারিক্যালে পড়ে না থেকে এক্সামগুলো দিন। উচ্চাশা থাকা উচিত প্রতিটা মানুষের!

পূর্ণেন্দুর অস্বস্তি হচ্ছিল। অপর্ণা বুঝতেও পারছিল না, মহুয়া ওকে নানারকম বিদেশি পারফিউম, জিনিস গিফ করছিল আর বলছিল, এগুলো নিয়ে যা, একবার মাত্র ইউজ করেছি, বাড়িতে জঞ্জাল হয়ে পড়েই ছিল। তুই বরং ব্যবহার করবি। অপর্ণার চোখদুটো আনন্দে খুশিতে ভরে উঠেছিল। খুব অপমানিত বোধ করছিল পূর্ণেন্দু।

তবুও চুপ করেই বসেছিল।

মহুয়া ওর নিজের বিদেশ ভ্রমনের গল্প করতে করতেই জিজ্ঞেস করেছিল, এই তোরা হানিমুনে কোথায় গিয়েছিলিস রে।

মন্দারমনি শুনে ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলেছিল, পূর্ণেন্দুদা এটা কিন্তু ভীষন অন্যায়। আমার বন্ধুকে বোকা পেয়ে ওটুকু করেই হানিমুনের পার্ট মিটিয়েছেন!

দিস ইজ আনফেয়ার।

আকাশবাবু মুচকি হেসে বলল, মোটেই না মুনিয়া। উনি যে স্যালারিটা পান, তাতে দিঘা আর মন্দারমনির বেশি কিছু হয়না। তুমি শুধু শুধু ওনাকে দোষারোপ করছ।

বেশ জম্পেশ বড়লোকি একটা ডিনার সেরে ওরা ট্যাক্সি ধরেছিল। ট্যাক্সিতে উঠেই পূর্ণেন্দু বিরক্ত হয়ে বলেছিল, হ্যাংলার মতো লোকের অর্ধেক ব্যবহার করা জিনিস নিতে লজ্জা করছিল না!

এতদিনের চেনা অপর্ণা কেমন বদলে গেল মুহূর্তে। বিরক্ত হয়ে বলল, এসব জিনিস জীবনে কোনোদিন চোখেও তো দেখনি। ওই তো আকাশবাবুও তো ব্যাংকে জব করেন, আর তুমি দিনরাত কাঁদুনি গাইছো। এই নেই সেই নেই। ওরা তো এত এত ফরেন ট্যুর করে বেড়াচ্ছে, আর আমরা একবার মন্দারমনি। বেশ করেছি নিয়েছি, পার্লারে গিয়ে দেড়শো টাকার সব থেকে কমা প্যাকেজের ফেশিয়াল করি আমি, সে তুলনায় এসব কসমেটিকস তো কোনোদিন ইউজই করিনি। এসব মেখেই মহুয়ার অমন দাবা রংটা ফর্সা হয়েছে বুঝলে।

বেশি আত্মসম্মানের দোহাই দিও না তো।

আমিও ওদের নিমন্ত্রণ করেছি রোববার, তুমি বাজারের সব থেকে ভালো জিনিসগুলো এনে দেবে। দয়া করে কিপটেমি করো না ওইদিন।

অপর্ণার এতদিনের নরম ব্যবহারটার কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ওদের ফ্ল্যাটের, ওদের ফার্নিচারের গল্প করতেই ব্যস্ত।

না, ওদের ফ্ল্যাটে আকাশবাবু আসেন নি, এসেছিল মহুয়া রায়। এসে থেকে ওরা ওইটুকু ফ্ল্যাটে কিভাবে থাকে ভেবে বন্ধুর প্রতি একটু বেশিই কাতর হয়ে গিয়েছিল। বারবার বলছিলো, ইস, অপর্ণা তোর খুব কষ্ট হয় রে!

অপর্ণা অবশ্য বলেছিল, না রে বিয়ের আগে তোর আমার দুজনেরই তো মধ্যবিত্ত অবস্থা ছিল, তাই কষ্ট তেমন কিছু হয়না। মহুয়া সেটা শুনেই বলেছিল, আগে ছিলিস বলে সারাজীবন থাকবি পাগলি! জীবনে কত কিছু আছে উপভোগ করার, সেসব না দেখেই মরে যাবি!

তুই পূর্ণেন্দুদাকে বল না রে পুজো ভ্যাকেশনে আমাদের সাথে অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে যেতে। কি মজা হবে বলত, আমরা দুই বন্ধুতে দারুন এনজয় করব। গোটা সন্ধেটা এমন কিছু সুপরামর্শ অপর্ণার কানে ঢেলে মহুয়া বাড়ি গিয়েছিল।

সেদিন থেকেই অপর্ণার অল্প অল্প খুশিগুলো বড় বড় চাওয়াতে পরিণত হয়েছিল। রবিবারের সন্ধেতে মুভি দেখে পাঁপড়ি চাট খেয়ে বাড়ি ফেরার পর ওর মুখে যে খুশির আলোটা পূর্ণেন্দু দেখেছিল সেটা অপসৃত হয়েছিল। ওই একটুকরো ফ্ল্যাটের সবটুকু সুখ যেন মহুয়া শুষে নিয়ে চলে গিয়েছিল।

অপর্ণার মুখে শুধুই মহুয়ার গল্প। আজ মহুয়ারা পুরোনো গাড়িটা বেচে নতুন একটা গাড়ি কিনল, নয়তো মহুয়া আজ হিরের এই গয়নাটা কিনেছে, দেখো…

গত পাঁচমাস ধরে অপর্ণার গল্পের বিষয়ে শুধুই মহুয়ার অফুরন্ত ঐশ্বর্যর কথা উঠে এসেছে। সাথে সাথে পূর্ণেন্দু একই ব্যাংকে চাকরি করে কিছুই করতে পারেনি। জাস্ট লুজার একটা মানুষকে বিয়ে করেছে ও, এটাই বারবার বলার চেষ্টা করেছে অপর্ণা। বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে পূর্ণেন্দু। নিজের অক্ষমতা ঢাকতে ব্যাংকের হার ভাঙা খাটুনির পরেও আবার পড়াশনা শুরু করেছে, অন্য চাকরির পরীক্ষায় বসবে বলে। অপর্ণার অতৃপ্ত মুখটা দেখে কষ্ট হয় পূর্ণেন্দুর। কিন্তু ও নিরুপায়, ওর ওই মাইনেতে এর থেকে বেশি বিলাসিতা করা কোনোভাবেই পসেবেল নয়। তারপর বাড়িতেও কিছু পাঠাতে হয়।

সত্যিই তো অপর্ণা ওকে বিয়ে করে কিই বা পেল! মহুয়ার সাথে অপর্ণার পার্থক্যটা কোথায়! অথচ মহুয়া কেমন থাকে আর অপর্ণা কেমন! মনখারাপ থেকেই রাগের জন্ম নেয় ওর মনে।

ফেসবুকে আরও বন্ধুদের খুঁজে পেয়েছে ও। প্রত্যেকেই কম্পিটিশন করে বেড়াতে যাওয়ার ছবি, দামি শাড়ি পরে সুখী সুখী ছবি পোস্ট করে, সেসব দেখে বোধহয় অপর্ণার মনে খুব কষ্ট হয়।

দুদিন আগেও বিছানায় শুয়ে অপর্ণার গায়ে হাত দিতে গেলে ও খুব ঠান্ডা গলায় বলল, প্লিজ পূর্ণেন্দু গল্পের মতো কাব্যিক ভালোবাসার থেকেও অর্থনৈতিক দিকটা বেশি ভালো হওয়া দরকার। তাহলেই সুখ থাকে হাতের মুঠোয়। যেমন আছে মহুয়া, প্রীতি ওদের।

দিনরাত হিসেব কষে মাস চালাতে হলে এইসব কাব্যিক প্রেম জাস্ট জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়।

পূর্ণেন্দু জিজ্ঞেস করেছিল, বেশ বলো কোথায় ঘুরতে যেতে চাও তুমি!

ও বিছানায় সোজা হয়ে উঠে বসে বলেছিল ব্যাংকক, পাটায়া। জানো প্রীতি প্রচুর ছবি পোস্ট করেছে, ওরা ওখানে গেছে। মহুয়ার তো চারবার ঘোরা জায়গা।

আমাকে সেদিন মহুয়া টিপ্পনি কেটে বলল, তুই এক কাজ কর অপু, আমার ব্যাংককের ছবিগুলো নিয়ে এডিট করে নিজেকে বসিয়ে দিয়ে ছবি পোস্ট করে দে ফেসবুকে। তুই তো আর জীবনেও ঘুরতে যেতে পারবি না। বিশ্বাস করো গায়ে ছ্যাঁকা লাগল যেন। এসব অপমানগুলো আমায় সহ্য করতে হয় শুধু তোমার জন্য।

ব্যাংকে চাকরি করছ, দিনরাত এত টাকার বান্ডিল দেখছ, তারপরেও ইচ্ছে করে না নিজের পকেটে আরেকটু টাকা থাকুক। একটুও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই তোমার।

পূর্ণেন্দু একটু চুপ করে থেকে বলল, বেশ তোমাকে আমি ঘুরিয়ে আনব ব্যাংকক, সামনের মাসেই।

উত্তেজনায় পূর্ণেন্দুর ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে অপর্ণা বলল, উফ, দেখিয়ে দেব ওদের!

পূর্ণেন্দু একটু হেসে বলল, শুধু দেখানোর জন্য নয়, আমি তোমায় নিয়ে যেতে চাই তোমার ঠোঁটের হাসিটার জন্য।

সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। অপর্ণা দুপুরের পর বার চারেক ফোন করার চেষ্টা করেছে পূর্ণেন্দুকে। সংসারের কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস আনতে বলার জন্য। কিছুতেই লাইন পায়নি। তারপর শুরু হয়েছে বৃষ্টি। এ যেন থামতেই চায়না।

সন্ধের মুখে মুখেই বিরক্ত হয়েই টিভির সুইচটা অন করলো অপর্ণা। এসময় রান্নাঘর আর দিদি নম্বর ওয়ান দেখাটা ওর নেশা।

চ্যানেল ঘোরাতে গিয়েই খবরটাতে চোখ আটকে গেল। সর্বনাশ, এ যে পূর্ণেন্দুর ব্যাংকের নাম বলছে।

ওদের ব্রাঞ্চে কী যেন হয়েছে। লোকজনের ভিড়, লোকজনের হাতে ইট পাথর। বেশ গন্ডগোলের একটা দৃশ্য। নীচের হেডলাইনে একটাই কথা লেখা উঠছে। টাকা তছরূপের দায়ে এই ব্রাঞ্চের বেশ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। সিবিআই তদন্ত চাইছে জনগণ। পুলিশ সরেজমিনে দেখছে ব্যাপারটা।

শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে ঠান্ডা রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে অপর্ণার। পূর্ণেন্দু এক সপ্তাহ আগেই ওকে কথা দিয়েছিল ব্যাংকক নিয়ে যাবে। তবে কি ও ব্যাংক থেকে লোকের টাকা চুরি করে…আর ভাবতে পারছিল না অপর্ণা। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, মহুয়া, প্রীতি সবাই জানবে ওর বর চোর! লোকে ছি ছি করবে। ওর দোষেই আজকে এই হল। নিজের চুলগুলো মুঠো করে ধরে টানছিল অপর্ণা। এ কী করল ও। সামান্য ফেসবুকে কটা ছবি দেবে, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় লোকদেখানোর জন্য পূর্ণেন্দুর মতো সৎ একটা মানুষকে এই পথে নামাল!

ওই জন্যই বোধহয় ওর ফোনটা নট রিচেবেল বলছে। বোধহয় পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ওর। নিজের ওপরে ঘেন্না হচ্ছিল অপর্ণার। কী সুন্দর একটা মিষ্টি সংসার পেয়েছিল ও। মাসের শেষে একটু টানাটানি থাকুক তবুও সপ্তাহে একদিন সিনেমা, ফুচকা খাওয়া, ফেরিওয়ালার কাছে দাম দর করে শাড়ি কেনা, সারাদিনের ঝগড়ার পরে মধ্যরাতে পূর্ণেন্দুর আদরে অভিমান ভেঙে ওর বুকে মুখ গুঁজে নিশ্চিন্তে ঘুমানো, সব কিছু নিজের হাতে শেষ করে দিল ও। বোলপুরের মেলার কেনা দেওয়াল জুড়ে ছবিটার দিকে স্থির চোখে তাকিয়েছিল ও।

শিল্পী কেন এই সবুজ ঘাসের মধ্যে ঘোড়াটাকে এমন স্থির অথচ প্রাণবন্ত করে এঁকেছেন! পাশের দুটো ঘোড়া প্রতিযোগিতা করে প্রবল বেগে ছুটছে, কিন্তু একটি ঘোড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়ে প্রশান্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছুটন্ত ঘোড়াদুটোর দিকে। শিল্পী যেন বলতে চাইছে, ওই একলা ঘোড়াটা প্রতিযোগিতায় আগ্রহী নয়। সে সবুজের প্রান্তরে নিজেই নিজেকে নিয়ে ভীষণ সুখী। তার সামনে দিয়ে এরা ছুটে চলে গেলেও ওর কোনো তাড়া নেই, নেই মেকি কম্পিটিশনে পাল্লা দেওয়ার। সে ধীরে সুস্থে, চারিদিকের শোভা দেখতে দেখতে পৌঁছাবে গন্তব্যে।

বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল অপর্ণার!

পূর্ণেন্দু তো এমনই ছিল। অল্পেই খুশি, নেই কোনো লোকদেখানো মেকি ব্যবহার, শুধুমাত্র ওর মুখে হাসি ফোটাতেই ও আজ অসৎ পথে পা দিল!

ফোনটা বাজছে অপর্ণার।

ঈশা ফোনে বেশ হুড়োহুড়ি করে বলল, দিদি টিভি খোল। জিজুর ব্যাংকে নাকি কীসব গন্ডগোল হয়েছে দেখাচ্ছে। বাবা খুব চিন্তা করছে রে। জিজু বাড়িতে ফিরেছে!

কথা বলতে গিয়ে অপর্ণা অনুভব করল ওর গলাটা শুকিয়ে গেছে। স্বর বেরোচ্ছে না শুকনো গলা দিয়ে।

টেবিলে রাখা বোতলটা কাঁপা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে একটু জল খেল ও। ওদিকে বাবার গলার স্বর, অপু, এই অপু কথা বলছিস না কেন! পূর্ণেন্দু ফিরেছে।

শোন চিন্তা করিস না, পূর্ণেন্দুর মতো সৎ ছেলে যে এসব তছরূপ কেসে জড়াবে না সেটা আমি জানি রে।

যে ছেলে এক পয়সা পন ছাড়া বিয়ে করে তার যে লোভ নেই সে আমি ভালোই জানি। তবে কি বলত, জনগণ ক্ষেপে গেছে তো, তাই এখন সকলেই আক্রমণ করবে। শোন, কাঁদিস না। পূর্ণেন্দু ফিরলেই আমাদের জানাস।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ননদের ফোন ঢুকল, অপর্ণা, ভাই বাড়ি ফিরেছে? ওর ব্রাঞ্চে কী সব গন্ডগোল হয়েছে শুনলাম!

সকলকেই ভীতু গলায় উত্তর দিচ্ছিল অপর্ণা, ফিরলে জানাবে। ফোনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। কখন থানা থেকে ফোনটা আসবে ওর ফোনে।

এই সময় দুজনে বসে একসাথে চা আর কিছু টিফিন খেত। টিভিতে চলত অপর্ণার প্রিয় সিরিয়াল। পূর্ণেন্দু বলত, হ্যাঁ গো এই সিরিয়ালের বউগুলো এত মেকআপ করে কেন! আমার বউকে দেখে তো শিখতে পারে, সিম্পল অবস্থাতেও কী মিষ্টি লাগে আমার বউটাকে।

অপর্ণা জিভ ভেঙিয়ে বলত, ন্যাকা!

বেলটা বাজছে। অবশ পা দুটোতে একটুও জোর নেই অপর্ণার। ঘড়ির কাঁটা নটার দিকে ছুটছে। এত রাতে নিশ্চয়ই পুলিশ এসেছে বাড়িতে। বাড়িতে কাঁচা টাকা রেখেছে কিনা তার তল্লাশি করবে বলে।

কোনোমতে চারবার বেল বাজানোর পরে দরজাটা খুলল অপর্ণা। সামনে কাক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণেন্দু। ওকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল অপর্ণা। এতক্ষণের চেপে রাখা নোনতা জল দুই গাল দিয়ে ঝরছে অনর্গল।

পূর্ণেন্দু অবাক হয়ে বলল, কাঁদছ কেন! বাবা ভালো আছেন? কারোর কিছু হয়েছে?

অপর্ণা ওর বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়েই যাচ্ছে। অনেক কষ্টে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, শুধু আমার জন্য আজ তুমি এই কাজ করলে তাই না!

তোমাদের ব্রাঞ্চে পুলিশ গিয়েছিল। কয়েকজনকে টাকা তছরূপের দায়ে ধরেওছে দেখলাম। যদিও নাম এখনও জানায়নি পুলিশ। কিন্তু আমি জানি, তুমি আমায় বিদেশে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেই লোকের টাকা চুরি করেছ। এখুনি পুলিশ আসবে তাই না!

পূর্ণেন্দু শান্ত গলায় বলল, তুমি এই চিনলে আমায় অপর্ণা! ভাবলে কি করে তোমার স্বামী এত বড় অন্যায় করতে পারে। আমি পাসবুকগুলোতে সাইন করি ডেট বসাই আর দেখি কিছু নিরীহ অসহায় মানুষের চোখের চাহনি। করুন গলায় তারা জিজ্ঞেস করে, স্যার এক বছরে কত সুদ পাব! স্যার মেয়ের বিয়ের জন্য জমাচ্ছি। কেউ বলে, ছেলেকে মানুষ করব স্যার। ওর আঠেরো বছরে ম্যাচিওর করবে এমন স্কীম কী আছে বলুন। ছেলেটাকে আমার মতো মুদির দোকানে কাজ করাব না বুঝলেন স্যার। ওদের গলার ওই স্বর, ওদের চোখের চাউনি দেখার পরেও ওদের টাকা চুরি করি কী করে! ওরা যে আমার থেকেও গরিব অপর্ণা!

অপর্ণা ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বললো, তাহলে কে করেছে তছরূপ!

শান্ত গলায় পূর্ণেন্দু বলল, মিস্টার আকাশ রায়। প্রায় তিনকোটি টাকা তছরূপের দায় পড়েছে ওনার আরও দুজনের ওপরে।

ওনার বাড়ির সামনেও লোক ঘিরে রেখেছিল। আকাশ স্যারকে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ। আমি অনেক কষ্টে একটা ট্যাক্সি নিয়ে গিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে তোমার বন্ধুকে ওর বাপের বাড়িতে দিয়ে এলাম। নাহলে মহুয়াদেবীরও বিপদ হত। জনতা ক্ষেপে গেছে। ওনাকে হয়তো মেরেই ফেলত। তখন তুমি বলতে, মহুয়ার এই বিপদের দিনে তুমি ওর পাশে দাঁড়ালে না পূর্ণেন্দু!

তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ওদের বাড়িতে গিয়ে মহুয়াদেবীকে বের করে পৌঁছে দিলাম।

অপর্ণা বলল, তোমায় ফোনে কেন পাচ্ছিলাম না গো!

পূর্ণেন্দু বলল ফোনটা চার্জ শেষ হয়ে গেছে বোধহয়।

তবে জানো অপর্ণা, জনগণ এত রেগে গেছে তার মধ্যেও আমি যখন বেরোচ্ছি গেট দিয়ে তখন জনা দশেক বেশ চেঁচিয়ে বলল, ওনার গায়ে হাত দিবি না, উনি সব সময়ই আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেছেন। বড়লোক কাস্টমার আর গরিব কাস্টমার ওনার কাছে একই গুরুত্ব পেয়েছে। আমি নিশ্চিন্তে বেরিয়ে এলাম ওই বিস্ফোরক জনতার মাঝ দিয়ে।

অপর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি আর কখনো ব্যাংকক যাবার কথা বলব না পূর্ণেন্দু, তুমি প্রেশার নিও না।

পূর্ণেন্দু হেসে বলল, এখন আর উপায় নেই ম্যাডাম, আমি অলরেডি প্লেনের টিকিট কেটে ফেলেছি। তবে ব্যাংককের নয়, আসামের। এবারে আমরা আসাম ঘুরে আসি বুঝলে, বুড়ো বয়েসে নাহয় আমি আমার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখব, তোমায় ব্যাংকক ঘোরাব। কি গো রাগ করলে!

অপর্ণা ডুকরে কেঁদে ওঠে বলল, ক্ষমা করো আমায়।

মেসেঞ্জারে একটা ছোট্ট মেসেজ ঢুকল মহুয়ার।

সরি অপর্ণা। তুই একটা খাঁটি মানুষকে জীবনসঙ্গী পেয়েছিস, সামলে রাখিস।

অপর্ণা আস্তে আস্তে মহুয়া, প্রীতি, অনুরাধাকে আনফ্রেন্ড করল। দেখতে চায়না ও ওদের বৈভব! দেখতে চায়না ওদের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় লোক দেখানো ভালো থাকার অভিনয়গুলো।

ওর ছোট্ট পৃথিবীটা ও সুন্দর করে সাজাবে। দিঘার সমুদ্রের ঢেউ গুনে, আসামের বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে, ফুচকার ঝাল জিভ লাল করে ও সাজাবে ওর একান্ত ভালোবাসার বারান্দাটাকে। পূর্ণেন্দুর লোমশ পুরুষালী হাতে নিজেকে সমর্পণ করে বারবার হেরেও বহুবার জিতবে ও ভালোবাসায়।

পূর্ণেন্দু বলল, শুনছ এই দু-মাস সপ্তাহে দুদিন মাছ আর একদিন মাংস খাব, বাকি দিনগুলো নিরামিষ। আর মাসে একটা মুভি দেখব তাহলেই জমে যাবে আমাদের আসাম ট্যুরের টাকাটা।

অপর্ণা বলল, শোনো না, এই দুমাস আমি পার্লারে যাব না, ঘরোয়া রেমেডি দিয়েই রূপচর্চা করব, তোমার বউ তো এমনিতেই সুন্দরী তাই না!

বহুদিন পরে আবার ওদের ছোট ফ্ল্যাটে অনাবিল হাসির শব্দ শোনা গেল।

সকল অধ্যায়

১. সুখের আড়ালে – অর্পিতা সরকার
২. সেদিন ভোরে – অর্পিতা সরকার
৩. নাম বিভ্রাট – অর্পিতা সরকার
৪. রেড স্কুটি এবং.. – অর্পিতা সরকার
৫. অগোছালো সংসার – অর্পিতা সরকার
৬. ভালোবাসার রামধনু – অর্পিতা সরকার
৭. ইছামতীর তীরে – অর্পিতা সরকার
৮. অলক্ষ্মী – অর্পিতা সরকার
৯. বিজয়িনী – অর্পিতা সরকার
১০. অবহেলা দ্য কিটু সাকসেস – অর্পিতা সরকার
১১. মনের ডুবুরি – অর্পিতা সরকার
১২. ভালোবাসা মিসিং – অর্পিতা সরকার
১৩. লোকে পাগল বলে ডাকে – অর্পিতা সরকার
১৪. নিলামে উঠেছি আমি – অর্পিতা সরকার
১৫. হঠাৎ বৃষ্টি – অর্পিতা সরকার
১৬. রুমমেট – অর্পিতা সরকার
১৭. এক টুকরো সুখ – অর্পিতা সরকার
১৮. দ্য মিস্ট্রি অফ ফ্রেন্ডশিপ – অর্পিতা সরকার
১৯. যদি কখনো অজান্তে – অর্পিতা সরকার
২০. আট নম্বর রুম – অর্পিতা সরকার
২১. ফর এভার – অর্পিতা সরকার
২২. নিশ্চুপ পিয়ানো – অর্পিতা সরকার
২৩. চলো বন্ধু হই – অর্পিতা সরকার
২৪. সূর্যমুখী – অর্পিতা সরকার
২৫. বাবা – অর্পিতা সরকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন